অনুরাগে সখি নিভৃতে যতনে পর্ব-০৮

0
2

#অনুরাগে_সখি_নিভৃতে_যতনে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০৮
___________________________
রাতের খাবার খেয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছে তারিনি।তার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

-“কি থেকে কি হয়ে গেল!আমার জীবনটা এমন নাহলেও তো পারতো।যাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসলাম সে এমনটা করলো!যা অসুখ হয়েছে অপারেশন হলে কি আমি আদোও বাঁচবো?কিন্তু আমার তো এখন বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা বৃদ্ধি পেয়েছে আমার সন্তানের জন্য।ও-কে না দেখে ম*রে গেলে যে ম*রেও শান্তি পাবো না আমি।”

আশহির রুমে প্রবেশ করে তারিনির কথাগুলো শুনতে পায়।সে গিয়ে তারিনির পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

-“কিছু হবে না তোমার তারিনি।সবটা ঠিক হয়ে যাবে।”

তারিনি নিজেকে সামলে বললো,

-“তুমি এখানে কি করছো আশহির?ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।আমার বিষয় আমি বুঝবো।”

আশহির কিছুক্ষণ তারিনির দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

-“আমাকে তুমি অনেক ঘৃণা করো তাই না?”

-“ঘৃণা করার মতো কাজ করলে ঘৃণাই তো করবো আশহির।”

দুজনের মাঝে নিরবতা!নিরবতা ভেঙে তারিনি বললো,

-“নিজেকে অনেক বুঝালাম কথাটা যেন না বলি কিন্তু না বলে থাকতে পারছি না।তাই বলিই,আশহির আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবে?”

আশহির অবাক হয়ে তারিনির দিকে তাকালো।সে দেখলো তারিনি তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আশহির তাকাতে তারিনি বললো,

-“আমি জানি এটা ঠিক না।কালকে মা*রা যাই নাকি ঠিক নেই ধরে নেও এটাই তোমার কাছে আমার শেষ চাওয়া।আর কখনো কিছু চাইবো না বিশ্বাস রাখতে পারো।”

আশহির আর কিছু না বলে তারিনিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“তোমার কিছু হবে না তারিনি তা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।আমি জানি তুমি আমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।তবে তুমি আমার থেকে যতই দূরে সরে যাও না কেনো আমি সারাজীবন তোমাকেই ভালোবেসে যাবো।”

তারিনি কিছু বললো না।খানিকক্ষণ পরে আশহিরকে ছেড়ে বললো,

-“এইসব কথা আর বলো না আশহির।বড্ড বিরক্ত এসে গিয়েছে এই কথাগুলোর প্রতি।”

তারিনি আর বেলকনিতে না দাঁড়িয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।আশহির সোফাতে শুয়ে বললো,

-“তারিনি আমার জীবনে অনেক ভুল থাকলেও তুমি আমার জীবনের একমাত্র সঠিক!আর যাই মিথ্যা হোক তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো মিথ্যা ছিল না।”

তারিনি আর কিছু না বালিশে মুখ গুঁজে চোখের পানি ফেলতে লাগলো।

_____________________
মৌরিন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কি যেন ভাবছে।ফরহাদ সেখানে গিয়ে বললো,

-“তা আপনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন?”

মৌরিন সোজা হয়ে বসে বললো,

-“স্যার আমি ভাবলাম কিছু দিন যাক তারপরে না হয় যা করার করবো!”

-“কেনো কি হয়েছে?”

-“কালকে মিসেস.তারিনির অপারেশন।আমি চাই উনি যতদিন না সুস্থ হচ্ছেন আশহির মির্জা উনার পাশে থাকুক।”

ফরহাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“তাহলে তাই হোক।বাই দ্যা ওয়ে আপনি কি আজ রাতেও এখানেই থাকবেন?”

-“কি আর করার স্যার!থাকার তো কোনো ব্যবস্থা করতে পারলাম না।তাই এখানেই থাকতে হবে।”

-“আচ্ছা তাহলে আপনি রেস্ট নিন আমি বরং আমার ক্যাবিনে যাই।”

-“আজকে তো আপনার কোনো ডিউটি নেই।তাহলে অফিসে কেনো থাকবেন স্যার?”

-“ধরে নিন আপনার জন্য।এই চার দেয়ালের মাঝে আপনার কোনো বিপদ হতে পারে না তা কে বলতে পারে!”

মৌরিন কিছু বলতে গেলে ফরহাদ তাকে বাঁধা দিয়ে বললো,

-“আমার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমি তা নিয়ে নিয়েছি।তাই আমাকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।”

কথাগুলো বলে ফরহাদ চলে গেল।মৌরিন কিছুক্ষণ সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বললো,

-“স্যার আমার একটু বেশিই কেয়ার করেন।না না অনেকটা বেশিই!”

______________
সকালবেলা সবকিছু গুছিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা দেওয়ার সময় তারিনি বললো,

-“আশহির আমাদের সাথে যাবে না।”

আশহির অবাক হয়ে বললো,

-“তারিনি বাড়ির সবাই যাচ্ছে আর আমি যাবো না?”

-“না তুমি যাবে নাহ্ আমাদের সাথে।”

এই বলে বাড়ির সবাই মিলে ড্রাইভারকে নিয়ে একটা গাড়িতে করে চলে গেল।আশহির দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“ওফ সব অশান্তি আমাকে আঁকড়ে ধরেছে।”

আশহির সেখানে আর না দাঁড়িয়ে আরেকটা গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

তারিনি আনমনে হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যেতে গেলে রেজওয়ান এসে তাকে ধরে ফেলল।তারিনিকে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে বললো,

-“আপনি ঠিক আছেন?”

তারিনি কিছু বলতে যাবে তার আগে বাড়ির সবাই সেখানে এসে উপস্থিত হলো।অথৈ তারিনির হাত ধরে বললো,

-“ভাবি তুমি কোনো ব্যথা পাওনি তো?”

তারিনি মৃদু হেসে বললো,

-“আরে না আমি পড়ে যাওয়ার আগেই তো উনি ধরে ফেললেন।আপনাকে ধন্যবাদ।”

মাস্কের আড়ালে মুচকি হেসে রেজওয়ান বললো,

-“ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই।এটা আমার কর্তব্য!”

রেজওয়ান কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে গেল।রেজওয়ান চলে যেতে অথৈ বললো,

-“ভাবি লোকটা কেমন অদ্ভুত না?কেমন ক্যাপ আর মাস্ক পড়ে ঘুরছে।মুখই তো দেখা গেল না!”

তারিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“যে যেভাবে চলছে চলতে দেও।”

এরমধ্যে আশহির সেখানে এসে পৌঁছালো।আশহিরকে দেখে তারিনি বললো,

-“তোমার কাজ বাদ দিয়ে তুমি এখানে না আসলেও পারতে আশহির।”

-“তারিনি তুমি কিন্তু এবার অদ্ভুত কথা বলতেছো।সাথে আসতে দেওনি ঠিক আছে আমি একা এসেছি তাতেও প্রবলেম!”

তারিনি আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল।কিছুক্ষণ পরে তারিনিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো।সবার থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে আছে রেজওয়ান।সে বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে।আশহির অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারি করছে।অথৈ গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

-“ভাইয়া এইসব নাটক না করলেও হয়।”

আশহির অবাক হয়ে বললো,

-“মানে?”

-“মানে এই যে তোর যদি ভাবির জন্য এতোই চিন্তা হতো তাহলে তুই কখনোই আরেকজনকে বিয়ে করে নিয়ে আসতি না!”

আশহির আর কিছু না বলে সবার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।কারণ সবার মাঝে থাকলে তাকে এইসব কথা শুনতেই হবে।



মৌরিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা বাড়ি ভাড়া পেল নিজের থাকার জন্য।সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর ভাবছে,

-“আজকে তো মিসেস.তারিনির অপারেশন।আমার কি একবার যাওয়া উচিত?কিন্তু উনারা যদি আমাকে আবার অপমান করেন?না যা হবার হবে একবার বরং যাই।”

মৌরিন হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিল।সে হাসপাতালে যেতেই রেজওয়ানকে দেখতে পেল।কারণ সে এই বেশে রেজওয়ানকে আগেও দেখেছে।মৌরিন রেজওয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

-“বাহ্!আপনি এখানে চলে এসেছেন?”

রেজওয়ান মৌরিনকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।তারপরে নিজেকে সামলে বললো,

-“আসতে তো হতোই।কিন্তু আপনি এখানে?”

-“মিসেস.তারিনির এতো বড় একটা অপারেশন না আসলে নিজেকেই নিজের কাছে ছোট মনে হতো।”

-“ওহ্ আচ্ছা। তবে আপনি এতো বড় একটা প্রমাণ হাতে পেয়েও আশহিরকে কিছু বলেননি?”

-“এই অপারেশনটা শেষ হয়ে মিসেস.তারিনি ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরুক তারপরে মিস্টার আশহির মির্জাকে নিউ শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাবো।”

মৌরিনের কথা শুনে নিঃশব্দে হাসলো রেজওয়ান।পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“আপনার এই আবেগ প্রবণতা কি তারিনির জন্য নাকি আশহিরের জন্য?”

মৌরিন বিরক্তি নিয়ে বললো,

-“আবেগ প্রবণতা কোথায় পেলেন?”

-“এই যে তারিনির অপারেশন জেনে তার জন্য হাসপাতালে আসা আবার এই অপারেশনের কারণেই তো আপনি আশহিরকে অ্যারেস্ট করেননি।তাই বললাম!”

-“এটাকে আবেগ প্রবণতা বলে না।আর শুনুন আমি যা করছি সবটা শুধুমাত্র মিসেস.তারিনির জন্য।আর প্লিজ ওই আশহির মির্জার সাথে আমাকে মিলিয়ে কিছু বলবেন না।”

আশহির হঠাৎ করে খেয়াল করলো মৌরিন একটা লোকের সাথে তার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।আশহির ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“উনি এখানে কি করছেন?”

আশহির মৌরিনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

-“আপনি এখানে?”

আশহিরকে দেখে রেজওয়ান গলা পাল্টে বললো,

-“ম্যাডাম আমি তাহলে আসি।”

রেজওয়ান দ্রুত গতিতে সেখান থেকে চলে গেল।রেজওয়ান চলে যেতে মৌরিন বললো,

-“আমার জানা মতে হাসপাতাল পাব্লিক প্লেস।তাই যে কেউ এখানে আসতেই পারে।”

আশহির কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“সে না হয় বুঝলাম।তবে লোকটা কে ছিল?আমাকে দেখে মনে হয় পালিয়ে গেল!”

মৌরিনের মনে মনে রা*গ হলো রেজওয়ানের ওভাবে পালিয়ে যাওয়ার জন্য।খানিকক্ষণ পরেই নিজেকে সামলে বললো,

-“আপনাকে দেখে পালিয়ে যাবে কেনো?উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন ক্যান্টিন কোথায় আমি বলেছি আমি জানি নাহ্ তাই উনি উনার প্রশ্নের মনমতো উত্তর না পেয়ে চলে গিয়েছেন।”

আশহির ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“সত্যি তো?”

-“শুনুন আমি এখানে আপনার সাথে কথা বলতে আসিনি।আর আপনার মতো একজন লোকের সাথে কথা বলতেও আমার ঘৃণা হয়।”

মৌরিন কথাগুলো বলে আশহিরের সামনে থেকে চলে গেল।

#চলবে…………..

[ভূল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]