অন্তর দহন পর্ব-১০

0
382

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব_১০

অফিসে বসে জরুরি কাজ সারছিলো স্পন্দন। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই কারো ভয়ংকর হাসির শব্দ আসতে লাগলো।স্পন্দনের বুঝতে বাকি নেই ফোনটা কার। খুব শান্ত ভাবেই বললো,

__কি চাই আবরার চৌধুরী?

__আরে বাহ্। সৈয়দ স্পন্দন মির্জা আমার গলা না শুনে শুধু হাসি শুনেই নাম বলে দিলো। এরচেয়ে বড় খুশির খবর আর কি হতে পারে আবরারের জীবনে।

__এসব ফালতু বকবকানি শোনার জন্য স্পন্দন মির্জা বসে নেই।কি বলতে চান বলে ফেলেন।

__আজকের মিটিংয়ে সমস্ত টেন্ডার গুলো আমার চাই স্পন্দন মির্জা।

__স্টপ ইট মিস্টার আবরার চৌধুরী। আজকের একটা টেন্ডার ও আপনার হবেনা।এটা যত তাড়াতাড়ি করে মাথায় ঢুকিয়ে নিবেন ততই ভালো আপনার জন্য।

__সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে তো আঙ্গুল বাঁকাতেই হচ্ছে।

__ভুলেও সে কাজ করতে যাবেন না।তাহলে এই স্পন্দন কি কি করতে পারে তা কি আপনার অজানা?

__স্পন্দন মির্জা?

__গলা নামিয়ে কথা বলুন আবরার চৌধুরী।গলা নামিয়ে,,,

আবরার চৌধুরী একটা ফিচেল হাসি হেসে বললো,

__মিসেস্ চন্দ্র কোথায় এখন মি. স্পন্দন মির্জা?

__খবর’দার! খবর’দার বলছি আবরার চৌধুরী।এর মধ্যে চন্দ্র কে টানবেন না। আপনার শত্রুতা আমার সাথে। চন্দ্র এর কিছু জানেনা।তাই ওকে এর মধ্যে টানলে কিন্তু ভালো হবেনা।

গগন কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে ফোন কেটে দিলেন আবরার চৌধুরী।স্পন্দন কাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।কোনোদিকে চিন্তা ভাবনা না করেই ছুটলো চন্দ্রর কাছে। কিন্তু সেখানেও চন্দ্রকে পেলো না। এবার কি করবে স্পন্দন মাথায় কিছুই আসছে না। অফিস থেকে মিটিংয়ের জন্য ফোন আসছে বারবার। এদিকে চন্দ্রকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে ফোন করলো নিরুপায় হয়ে।বললো,

__চন্দ্র কোথায় মা?

__কলেজ গেছে। আসেনি এখনো।

স্পন্দন খট করে ফোনটা কেটে দিলো।মাথার চুল টেনে ধরে বসে পড়ল বেঞ্চে।কি করবে? কোথায় যাবে? ঠিক করলো আবরার চৌধুরীকে ফোন দিবে। এমন সময় ওর মায়ের ফোন এলো।ধরতেই শুনলো,

__স্পন্দন তাড়াতাড়ি করে বাড়িতে আয় বাবা।

__কি হয়েছে মা? চন্দ্র? চন্দ্র এসেছে মা?

__না আসেনি।তবে একটা ফোন এসেছে ল্যান্ড লাইনে। তুই তাড়াতাড়ি করে আয় স্পন্দন।তোর দাদিমা কেমন করছেন।তোর বাবা,,,,

স্পন্দন ফোন কেটে দিয়ে ছুটলো বাড়িতে। গিয়ে দেখে দাদিমা নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা। অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। কার ফোন এসেছিলো কি বলেছে কিছুই জানে না কেউ। এদিকে চন্দ্রের খবর নেই।স্পন্দন ওর মায়ের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে হাতটা ধরে বললো,

__এবার বুঝি সব শেষ হতে চলেছে মা। আমি পারলাম না আর কিছুই রক্ষা করতে। তোমার ছেলে হেরে গেছে মা। আমার সব আবার হারিয়ে যেতে বসেছে মা। আমি কি করবো? এবার ভেঙে গেলে আর উঠতে পারবোনা মা।আর তোমার স্পন্দনকে খুজে পাওয়া যাবেনা মা।

__এই স্পন্দন কি হয়েছে বাবা?দাদিমা ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে ভেঙে পড়িস না বাবা।উঠ স্পন্দন।

__স্পন্দন? তোমার দাদিমা ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে ভেঙে পড়ো না।

বাবার কথায় রেগে উঠে দাঁড়ালো স্পন্দন।বললো,

__চুপ করুন সৈয়দ মির্জা। আজকে আপনার জন্য স্পন্দন শেষ হতে চলেছে দ্বিতীয় বারের মতো। প্রথম বারেও আপনার জন্য শুধুমাত্র আপনার এই টাকা পয়সার অহংকার ধনদৌলত এর মোহে অন্ধ হয়ে একের পর এক অন্যায় করেছেন। আপনার নিজের ছেলেকে শেষ করে দিয়েছেন। আজকে শুধু মাত্র আপনার জন্য আমি চন্দ্রের জন্য ও বিপদের কারণ হয়ে গেছি। মেয়েটাকে লাস্ট তিন ঘণ্টা ধরে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।দাদিমা মরতে বসেছেন আপনার কুকীর্তি লুকাতে গিয়ে।কি চান আপনি?বলেন আর কি চান? শুনুন সৈয়দ মির্জা সাহেব আপনার জন্য আজকে দাদিমা আর চন্দ্রের যদি কিছু হয় তাহলে কোনো দিন আপনাকে ক্ষমা করবে না স্পন্দন।

চন্দ্রকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে সৈয়দ মির্জা আর স্পন্দনের মা দুজনেই কেঁপে উঠলো।ওর মা বললো,

__চন্দ্রকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি বলতে চাইছিস তুই?

__আমি চন্দ্রকে খুঁজে চলেছি মা। কিন্তু কোথাও পাইনি। আমাকে ক্ষমা করে দিও মা। তোমার চন্দ্রকে রক্ষা করতে পারে নি এই অমানুষ ছেলেটা।

স্পন্দনের বাবা বসে পড়লেন সোফায়।তার জন্য আজ পরিবারের এই অবস্থা।রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিতে নিতে বললেন,

__আমাকে মাপ করে দিও তোমরা সবাই। আমি চাইনি এমন কিছু হোক।

__আপনি জানেন চন্দ্র কোথায় আছে? জানেন আপনি?বলুন না আমাকে,প্লিজ বলুন।

__আমি জানিনা স্পন্দন। বিশ্বাস করো বাবা আমি জানি না।তবে হয়তো আবরার চৌধুরীর,,,

স্পন্দন উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।চোখ মুখ মুছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখে চন্দ্র হাতে পায়ে মাথায় ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় বান্ধবীকে ধরে ধরে বাড়িতে ঢুকছে।দেখেই সবাই দৌড়ে গেলো।স্পন্দন গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

__কি হয়েছে কি তোর চন্দ্র?এতো ব্যান্ডেজ কেনো? কোথায় লেগেছে চন্দ্র? কিভাবে হলো?

__এসব পরে শুনবি বাবা।আগে মেয়েটাকে ভেতরে নিয়ে চল স্পন্দন।

স্পন্দন দ্রুত কোলে তুলে নিলো চন্দ্রকে।নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো ব্যান্ডেজ।স্পন্দন একদমই বাচ্চাদের মত করে মুখ করে আছে।চোখে মুখে ভীষণ অস্থিরতা।এখনো আঁকড়ে ধরে বসে আছে। চন্দ্রের এবার লজ্জা লাগছে। সামনে বড় আব্বু বড় আম্মু রাত হিয়া আছে।আর এদিকে চন্দ্রকে কোলে নিয়ে বসে আছে স্পন্দন।সেদিকে যেনো ওর কোনো খেয়াল ই নেই।ওর চোখ শুধু চন্দ্রের ঐ ক্ষতবিক্ষত আঘাত গুলোর দিকে। চন্দ্র নিরুপায় হয়ে মাথা নিচু করে বললো,

__আমি ঠিক আছি স্পন্দন। এবার তো নিচে নামিয়ে রাখুন।

শুনেও স্পন্দনের মুখের ভাবসাবে কোনো পরিবর্তন না দেখে হতাশ হলো চন্দ্র।রাত আর হিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে ওরা মিটমিট করে হাসছে।স্পন্দনের মা বললেন,

__তোমরা বসো মা। চন্দ্রের এমন হলো কিভাবে?

__আসলে আন্টি কলেজ থেকে ফেরার সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় পড়ে যায় চন্দ্র। আমরা উল্টা দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম গাড়ির জন্য। এমন সময় ওকে পড়ে যেতে দেখে নিয়ে হাসপাতালে গেছিলাম। সেখান থেকে ড্রেসিং করে বাসায় আনলাম।

__হাঁটার সময় চোখ কোথায় থাকে চন্দ্র?চোখ কি কপালে তোর আদৌও আছে? আমার তো যথেষ্ট সন্দেহ আছে এই নিয়ে।

__আহ্ স্পন্দন মেয়েটাকে আর বকিস না।যা হবার হয়ে গেছে।মা নে তো জুসটা খেয়ে নে তো।তোমরাও নাও মামনি।

চন্দ্র নাক সিঁটকায় বললো,

__খাবো না বড় আম্মু। ইচ্ছে করছে না খেতে।

স্পন্দন গ্লাসটা তুলে চন্দ্রের ঠোঁটে শক্ত করে চেপে ধরলো।বাধ্য হয়ে খেতে হলো পুরোটাই।শেষ হতেই স্পন্দন কাউকে কিছু না বলেই চন্দ্রকে কোলে তুলে নিয়ে গট গট করে হেঁটে রুমে চলে গেলো। চন্দ্র এভাবে কোলে করে যেতে লজ্জায় লাল নীল হয়ে গেছে।রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে ভালো করে ফ্রেশ করিয়ে দিলো স্পন্দন।এবার ড্রেস চেঞ্জ করতে গেলেই চন্দ্র লাফিয়ে একটু সরে যেতে নিলেই ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো।স্পন্দন হেসে বললো,

__এভাবে দেখার কি আছে চন্দ্র? আমি জানি আমি ড্রেস পাল্টে দিলে তোর কোনো আপত্তি নেই বরং ভালো লাগবে।

__এই দূরে যান।যান বলছি।

__যাবো তো। আগে পাল্টে দেই চন্দ্র।

__এই চুপ চুপ।কি সব বলেন এসব।যান এখান থেকে বেডা খচ্চর।

__কি বললি তুই?আমি খচ্চর? আজকে তো খচ্চর কত প্রকার ও কি কি তা দেখাতে হচ্ছে।

__কি করবেন আপনি?

__সেটা সময় এলেই দেখতে পাবে মিসেস চন্দ্র স্পন্দন মির্জা।

চন্দ্র ফাকা ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলো স্পন্দনের দিকে।স্পন্দন এবার মুখটা গম্ভীর করে বললো,

__তোকে একা কোথাও যেতে মানা করেছিলাম চন্দ্র।

__আসলে ভাবছিলাম,,,,

__তুই কি ভাবছিস না ভাবিস নি আই ডোন্ট কেয়ার চন্দ্র। কিন্তু আমার কথা না শুনে তুই যে নিজেকে বারবার বিপদে ফেলছিস। সেটা কি বুঝতে পারছিস?

চন্দ্র কেঁপে উঠলো স্পন্দনের ধমক শুনে।কি বলবে মাথায় আসছে না।থতমত খেয়ে গেছে স্পন্দনের সামনে। আসলেই তো আজকে কতবড় বিপদ হতে পারতো ওর। একটু ওয়েট করলেই তো পারতো।তা না পাগলের মতো ছুটে আসতে গিয়ে হাত পা মাথায় আঘাত লাগিয়ে বসে আছে।

__তোর কোনো ধারনাই নাই চন্দ্র আমি ঠিক কেমন করে ছটফট করে কাটিয়েছি। জরুরী মিটিং। সেটাও যেতে পারিনি।তা নিয়ে আমার আফসোস নেই। কিন্তু তুই?কতটা খারাপ হতে পারতো ভেবে দেখ একবার।

__স্ সরি।আর হবে না।

__চুপ কথা বলবি না তুই। আমি এসে যেনো ঠিক এখানেই পাই। কোনো নড়াচড়া লাফালাফি যদি করেছিস তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।

__এখন কেমন লাগছে চন্দ্র?

__বড় আম্মু?দাদিমা কোথায়?সবাই এলো দাদিমা এলো না যে।

__আম্মার শরীর হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে পড়েছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।ডাক্তার অক্সিজেন দিয়েছেন। এখন আগের চেয়ে ভালো আছেন চন্দ্র।

__আমাকে একটু নিয়ে যাবা বড় আম্মু?

__তোকে এই অবস্থায় দেখলে আম্মার শরীর আবার খারাপ হতে পারে চন্দ্র। আম্মা আরেকটু ভালো হলেই নিয়ে যাবো।

__টেন্ডার গুলো সব আবরার চৌধুরী পেয়েছে স্যার। আপনি ছিলেন না তাই আমাদের প্রেজেন্টেশন রিজেক্ট করে দিয়েছে।

__আবিদ এসব বাদ দাও। নতুন করে কি দিয়ে কি করা যাবে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।আর শোনো।

__জ্বী স্যার বলুন।

__মিসেস্ চন্দ্র স্পন্দন মির্জার সিকিউরিটি দিয়ে দাও। খুব গোপনে।কেউ যেনো কিছু টের না পায়।

__জ্বী স্যার। কিন্তু হঠাৎ করে?কিছু হয়েছে স্যার?

__ওরা আজকে চন্দ্রকে গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে গেছে।

#চলবে,,,,,,,,

লেখার ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।