#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি
পর্ব__১২
ভালোয় ভালোয় হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। চন্দ্রদের যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেখানে বসে চুল শুকিয়ে নিচ্ছে।এই অবেলায় আবার গোসল করতে হয়েছে স্পন্দনের ঐ ভাবে হলুদ মাখানোর জন্য।মনে মনে খুব অভিমান হয়েছে স্পন্দনের উপর।তাই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে চন্দ্র। হঠাৎ করেই দরজায় শব্দ হতেই তাকিয়ে দেখে ওর মা দাঁড়িয়ে। চন্দ্র সালাম দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।ওর মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
__এখনো রেগে থাকবি চন্দ্র?ক্ষমা করবি না তোর আব্বু আম্মু কে?
__তোমরা কোনো অপরাধ করো নি আম্মু।তাই ক্ষমা করা বা রেগে থাকার মতো কিছু হয়নি।যা হয়েছে তা আমার নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছি।এই নিয়ে আমার অভিমান থাকলেও অভিযোগ নেই কোনো আম্মু।
__ও বাড়িতে আর আসবি না চন্দ্র?
__আসবো না কেনো?সময় হোক। তারপর আসবো।
__আমি জানি আমরা তোর মতের বিরুদ্ধ গিয়ে তোকে এভাবে জোর করে বিয়ে দিয়ে উচিত করি নি। কিন্তু বিশ্বাস কর চন্দ্র,,,,,
__বিশ্বাস বলছো কেনো আম্মু? আমি তোমাদের মেয়ে। তোমাদের যেভাবে আমি চিনি তেমন করে তো আর বাইরের কেউ চিনতে পারবে না।তাই এভাবে বলো না আমাকে।
__আমরা ভীষণ নিরুপায় ছিলাম চন্দ্র।তোর দাদিমার একটাই কথা ছিলো যেনো বিয়েটা আমরা যেভাবে হোক দিয়ে দেই।
__একটা কথা বলবা আম্মু?
__বল কি বলবি চন্দ্র।
__দাদিমা আমার সাথে এমনটা কেনো করলো?
__আমি জানিনা আম্মা এটা কেনো করেছে।তবে আমরাও তোর কাছে সমান অপরাধী।পারলেই আমরা তোর দাদিমার কথা উপেক্ষা করতে পারতাম। কিন্তু তোর আব্বু চায়নি তার আম্মার মনে কষ্ট দিতে। আজীবন তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছে।তাই আর পিছপা দিতে পারেনি।
__মায়ের কথা রাখতে গিয়ে মেয়ের মুখটাই ভুলে গেলো আব্বু?
__চন্দ্র? এভাবে বলিস না মা।
__চন্দ্র এখন আর কাউকে দায়ী করে না আম্মু। কারণ চন্দ্র একটা মেয়ে।তার কোনো অধিকার নেই নিজের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়ার। সেখানে দাঁড়িয়ে অন্যকে দোষারোপ করা চন্দ্রের সাজে না আম্মু।গত কয়েকদিন ধরে চন্দ্র যতটা আঘাত পেয়েছে তা যথেষ্ট তাকে শক্ত হয়ে থাকতে। তুমি আর আব্বু ও অভ্যস্ত হয়ে যাও তোমাদের মেয়ের এই পরিবর্তন দেখে।যত তাড়াতাড়ি তোমরা সত্যিটা মেনে নিবে তত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে তোমাদের মেয়ে কেমন ছিলো আর এখন কেমন আছে।
__কিন্তু চন্দ্র?
__অনেক সময় ধরে এখানে আছি আম্মু। আমাদের এবার বাইরে যাওয়া দরকার।
__এড়িয়ে যাচ্ছিস?
__কিছুটা।
__চন্দ্র?
__আসছি আম্মু।
চন্দ্র রুম থেকে বেরিয়ে সোজা চিলেকোঠার ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলো। পেছনে না ফিরেও স্পষ্ট বুঝতে পারলো ওর আম্মু অশ্রুসিক্ত নয়নে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চন্দ্র চিলেকোঠার ঘরে পুরোনো আসবাবপত্রের পাশেই হাঁটু গেড়ে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।আর বিরবির করে বলতে লাগলো,
__আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মু। আমি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিনা। তোমরা এই বিয়েটা কেনো দিলে আম্মু?তোমরা চাইলেই দাদিমাকে বোঝাতে পারতে। চাইলেই আমার হাসিখুশি জীবনটাকে এভাবে এলোমেলো হতে বাঁচাতে পারতে।কেনো করলে না আম্মু?আর দাদিমা?যাকে আমি সবথেকে বেশি ভালোবাসি সেই মানুষটি আমাকে বিনা অস্ত্রেই ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। কিভাবে করতে পারলো?তোমরা সবাই স্পন্দনের জীবন সাজাতে চাইলে চন্দ্রের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়ে।সবাই তার ভালো চাইলে, কিন্তু কেউ আমার ভালো চাইলে না।
চন্দ্র মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন শুষ্ক মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খুব শান্ত ভাবে বললো,
__আমি যদি তোকে এই মুহূর্তে কোথাও নিয়ে যেতে চাই। তুই যাবি চন্দ্র?
চন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে স্পন্দনকে বললো,
__চলুন।
চন্দ্রের হাতটা ধরে স্পন্দন সবার চোখের আড়ালে বাইরে বেরিয়ে গেলো। গাড়িতে উঠে দু’জনেই চুপচাপ বসে আছে।গাড়ি ড্রাইভ করছে স্পন্দন। চন্দ্রের চোখ মুখ ফুলে আছে অসম্ভব ভাবে।বেশ অনেক সময় ধরে কেঁদেছে তাই হয়তো এমন লাগছে।কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে একটা পার্কের পাশেই গাড়িটা থামলো।স্পন্দন নিজে নেমে চন্দ্রকেও নামতে বললো। চন্দ্র চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো।একটা ছোট্ট লেখের পাশেই পার্কটা। খুব নিরিবিলি আর গাছপালা আছে সাড়ি সাড়ি। আশেপাশে বেঞ্চ ও আছে।তার একটার কাছে এগিয়ে গিয়ে স্পন্দন বসতে বললো চন্দ্রকে।নিজেও বসে পড়লো। এরপর আবার পিনপতন নীরবতা।সূর্য কিছুটা হেলে এসেছে। গোধূলির ঠিক কিছুটা আগে হবে বোধহয়। চন্দ্র চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো।মনে মনে ভাবলো,
__এখানে কেনো আনলো স্পন্দন? আবার আমাকে মে’রে টেরে গুম করে দিবে না তো? অসম্ভব!স্পন্দধ এমন করতেই পারেনা। আবার মানুষের মন কখন কি হয় বলা যায় না।হয়তো দিতেও পারে।
এসব জল্পনা কল্পনার মধ্যে স্পন্দন বললো,
__আমি তোকে এখানে মে’রে টেরে রেখে যেতে পারি এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি কিছু বলার জন্য তোকে এখানে এনেছি। আমার জীবনের কিছু কথা তোর জানা দরকার চন্দ্র।
চন্দ্র কি সব উল্টাপাল্টা ভাবছিলো স্পন্দনকে নিয়ে তা আবার মনে করতে দাঁত দিয়ে জিভ কামরে ধরলো।স্পন্দন বললো,
__আমি তখন মাস্টর্স করছি। ছেলে বন্ধু থাকলেও মেয়ে বন্ধু ছিলো না বললেই চলে। স্বভাবতই আমি হৈচৈ আড্ডা এগুলো এড়িয়ে চলতে পছন্দ করতাম। নিজের মতো থাকতাম বেশিরভাগ সময়। একদিন বন্ধুগুলো অনেকটাই জোর করে অডিটোরিয়ামের কোনো একটা ফাংশানে নিয়ে যায়। সেখানে তখন স্টেজে একটা মেয়ের পারফরম্যান্স হচ্ছিলো।তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্পন্দন থমকে গেলো। মেয়েটির চোখে মুখে অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধ হাসি লেগেই ছিলো।সেটাই স্পন্দনকে আকৃষ্ট করছিলো বারবার।ক্ষণে ক্ষণে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলো স্পন্দন। অনেকটাই বিমোহিত হয়ে পড়লো মেয়েটির উপরে।মেয়েটিই ছিলো হৃদি। এরপর অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় ওর সাথে পরিচয় করতে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এরপর তা ভালোবাসায় রূপ নেয়।
এটুকু বলেই স্পন্দন থেমে গেলো। চন্দ্রের বুকটা ভারী হয়ে আসছে। তবুও নিজেকে সামলে রেখেছে।স্পন্দন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আগের ন্যায় চুপচাপ বসে আছে। চন্দ্র বললো,
__হৃদি আপু কোথায় এখন স্পন্দন?
__জানিনা চন্দ্র।
__কেনো জানেন না?
__সে যে ঠিকানায় চলে গেছে সেখান থেকে তার খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি স্পন্দনের।
__কোথায় গেছে স্পন্দন?
স্পন্দন আবার নীরব। চন্দ্র আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
__কি হয়েছে হৃদি আপুর?
__সেদিন আমাদের দেখা করার কথা ছিল।হৃদি ফোনে খুব কান্নাকাটি করছিলো।ওর বাড়ি থেকে আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছিলো।তারা রাজী ছিলোনা।তাই হৃদিকে বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছিলো। এদিকে আমি তখনও বেকার। চাকরি হয়নি। বাবার টাকায় চলছি। তবুও ওকে কথা দিয়েছিলাম যাই হয়ে যাক না কেনো আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবো। কখনো ছেড়ে দিবো না তাকে।ও ভরসা করতো। কিন্তু বাবা ভাইয়ের চাপের জন্য প্রচন্ড ছটফট করতো। আমার সাথে দেখা করা কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলো।মাঝে মাঝে লুকিয়ে বাড়ির ফোন থেকে ফোন করতো। নিজের ফোনটা ওরা নিয়ে নেয়। আমি ও ছটফট করতে থাকতাম ওর একটা খবর নেওয়ার জন্য।একটু কথা বলার জন্য।ও ভীষণ কান্নাকাটি করতো ফোন করে।আমি অসহায় হয়ে শুধু দেখতাম।কিছুই করার ক্ষমতা ছিলো না তখন আমার।
__সেদিন দেখা করেছিলেন?
__নাহ্।ও আসেনি সেদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত অব্দি আমি এই বেঞ্চিতে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বাড়তে থাকে যত সময় গড়াতে থাকে ততই।ভয়ে বুক কাঁপতে লাগলো আমার।কি হয়েছে না হয়েছে এগুলো নিয়ে ভয়ংকর সব কথা মাথায় আসতে থাকে।
__এরপর কি হয়েছে?
__আমি এখনো সেই বেঞ্চিতে বসে লাস্ট দু’বছর ধরে অপেক্ষাই করছিলাম।যদি কখনো হৃদি ফিরে আসে তাই। কিন্তু আমার অপেক্ষার শেষ হয় যেদিন দাদিমাকে ওয়াদা করি তোকে বিয়ে করার জন্য। আমি দাদিমাকে কথা দেই তার বলা কথাটা আমি রাখবো।
__দাদিমাকে হৃদি আপুর কথা বলেননি কেনো?
স্পন্দন একটু হাসলো। তারপর বললো,
__বললে কি হতো চন্দ্র?
__আপনার আমাকে বিয়ে করতে হতো না। আপনার সাথে হৃদি আপুর বিয়ে হতো। আমি তখন আপনাদের মাঝে কাঁটা হয়ে আসতাম না স্পন্দন।
কিছুক্ষণ আবার শুনশান নীরবতা। চন্দ্র আবার বলে উঠলো,
__আপুকে খুব ভালোবাসেন। তাইনা স্পন্দন?
__হুম ভীষণ ভালোবাসতাম।
__এখনো ভালোবাসেন?
__এখন ভালোবাসি কি-না তা জানিনা।তবে তার স্মৃতি এখনো বুকের মধ্যে তাজা হয়ে রয়ে গেছে।
__ভালোবাসলে কি ভুলে যাওয়া যায়?
__না তা হয়তো যায় না। আমি ও পারিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে।তবে,,,,,,,
__তবে কি স্পন্দন?
#চলবে,,,,,,
#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি
পর্ব__১৩
স্পন্দন একটু চুপ করে থেকে বললো,
__এতোদিন ওর স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে ছিলাম চন্দ্র। কিন্তু যেদিন দাদিমা তোকে বিয়ে করতে বাধ্য করলো তার পর থেকে আমার জীবনটাও পাল্টে যেতে লাগলো। ধীরে ধীরে আমি যেনো আবার এলোমেলো ছন্নছাড়া জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলাম। খুব চেষ্টা করেছি নিজেকে ঐ স্মৃতিতে ডুবিয়ে রাখতে। কিন্তু একটা চঞ্চল মেয়ে সারাক্ষণই আমার হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে পাথর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে আবার সেই আমিতে আনতে চেষ্টা করছে। আমি আবার সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে দু’বছর আগে আমার ভালোবাসার শুধু স্মৃতি ছিলো আমার কাছে। আমি এখন তোর মধ্যে হৃদির ছায়া খুঁজে পাই চন্দ্র। তুই আমার আসেপাশে থাকলে মনে হয় আমি যেনো ভালো থাকি। আমার ভালো থাকার জন্য হলেও তোকে আমার লাগবে চন্দ্র। আমাকে ভালোবাসার নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে হলেও তোকে আমার চাই চন্দ্র। চন্দ্র ছাড়া স্পন্দন কিচ্ছু না।তার কোনো অস্তিত্বই নেই আজ।তাইতো ভয়ে ভয়ে থাকি এই বুঝি আমাকে ছেড়ে চন্দ্র হারিয়ে যায়।এই বুঝি আমার সবটাই আবার ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। এবার তোকে হারিয়ে ফেললে স্পন্দন আর বাঁচতে পারবেনা।নিঃস্ব হয়ে যাবে চন্দ্র।
চন্দ্র স্পন্দনের হাতটা শক্ত করে ধরে বসলো। সাথে সাথে স্পন্দন বাচ্চাদের মতো চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। চন্দ্র এবার কাঠ হয়ে বসে আছে। বুকের মধ্যে ভীষণ রকম তোলপাড় শুরু হয়েছে ওর।স্পন্দন কাউকে এতোটা ভালোবেসে কাছে পায়নি।অথচ কেমন করে এখনো তার মধ্যে হৃদির অস্তিত্ব খুঁজে চলেছে। শুধু একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে স্পন্দন।জড়ানো গলায় বললো,
__আমাকে ছেড়ে যাস না চন্দ্র। আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি তোকে পেয়ে আবার বেঁচে থাকতে শিখেছি। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। আমাকে এভাবে আগলে রাখার জন্য হলেও আমার জীবনে থেকে যা চন্দ্র। আমি এবার তোকে হারিয়ে ফেললে আর আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা।তোর মতো করে এভাবে আর কেউ আমাকে বুঝে না চন্দ্র।প্লিজ তুই আমাকে ছেড়ে যাস না।
চন্দ্র মুখে কিছুই বললো না।আস্তে আস্তে করে একটা হাত স্পন্দনের পিঠে দিয়ে স্পন্দনকে আরেকটু কাছে টেনে নিলো।ভাবতে লাগলো,
__এমন করে স্পন্দনকে ফেরাস না চন্দ্র।ওর এই অসহায় আবেদন উপেক্ষা করিস না তুই। নাইবা হলি তুই ওর প্রথম ভালোবাসা তবুও তো তোকে ভালোবেসে সে নতুন করে বাঁচতে চাইছে। এমন ভালোবাসার মানুষ কে পায়ে ঠেলে দিস না চন্দ্র। জীবনে এমন সুযোগ বারবার আসেনা রে।স্পন্দনের এই ভালোবাসা পাওয়ার লোভে হলেও তুই ওকে ফেরাস না আজ।
ঠিক কতটা সময় ধরে ওরা এভাবে বসে আছে তার হিসাব নেই।চারপাশটা অন্ধকার হতে শুরু করেছে।রোড লাইট গুলো জ্বলেছে বেশ কিছু সময় আগেই। চন্দ্র খেয়াল করলো স্পন্দন এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে। তবুও চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে আছে স্পন্দন।এত সময় একবার ও চন্দ্র স্পন্দনকে থামায় নি। বহুদিন ধরে স্পন্দনের বুকে যে কষ্টের পাহাড় জমে ছিল সেখানে এখন শীতলতা দরকার। কাঁদলে স্পন্দনের মনটা হালকা হবে।তাই চন্দ্র চুপচাপ বসে আছে।স্পন্দনকে আরেকটু শান্ত হতে দেখে চন্দ্র বললো,
__স্পন্দন?
__হু হুম।
__বাড়িতে ফিরে চলেন স্পন্দন। অনেক সময় গড়িয়ে গেছে।সবাই হয়তো চিন্তা করছে। কাউকে কিছু বলেও আসিনি।
__হু হুম যাবো।তবে আগে বল তুই আমায় ছেড়ে,,,
কথা শেষ করতে না দিয়ে চন্দ্র বললো,
_কোথাও যাবো না স্পন্দন। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।এই যে হাতটা ধরেছি এটা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে থাকবে চন্দ্র।
স্পন্দন মাখা তুলে চন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। এরপর চন্দ্রের কপালে একটা ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়েছে স্পন্দন। চন্দ্র চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।এতো সময় ধরে ওর হৃদয়ে যে তোলপাড় করা ঝড় উঠেছিলো সেটা এখন থেমে গেলো।
ওরা দুজন বাড়িতে পৌঁছাতেই শোরগোল পড়ে গেলো।সবাই এতো এতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো স্পন্দন আর চন্দ্রকে।স্পন্দন এখনো চন্দ্রের হাতটা তেমন করে ধরে আছে। সবাইকে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অবশেষে রুমের দিকে যেতে পেরেছে দুজন। চন্দ্র ফ্রেশ হয়ে আসতে না আসতেই ওকে হির হির করে টেনে নিয়ে গেলো সবাই। মেহেদী পড়বে বলে এতো সময় ধরে সবাই অপেক্ষা করছে।স্পন্দন ফ্রেশ হয়ে এসে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে ভাবতে লাগলো,
__কি থেকে কি হয়ে গেলো। কোনোদিন যে হৃদিকে ছাড়া অন্য কাউকেও যে ভালোবাসতে পারবে এটা ভাবতেই পারিনি কখনো। কিন্তু এখন যাই হয়ে যাক না কেনো চন্দ্র শুধু আমার। আমার থেকে কেউ চন্দ্রকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারবে না। আমি দিবো না।নাহ্ কিছুতেই না।যে করেই হোক চন্দ্রকে আগলে রাখবে স্পন্দন। দরকার হলে এই শহর এই বাড়ি এই আত্মীয় স্বজন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে দূরে অনেক দূরে চলে যাবে চন্দ্রকে নিয়ে। তবুও চন্দ্রের কিছু হতে দেবো না।নাহ্ কিছুতেই নাহ্।
অনেক সময় হয়ে গেছে চন্দ্র গেছে।আসার আর নাম গন্ধ ও নেই।স্পন্দন এবার ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে লাগলো। অস্থির হয়ে উঠেছে ওর মন।আর থাকতে না পেরে ধুপধাপ পা ফেলে ছাদে গিয়ে হাজির হলো। গিয়ে দেখে চন্দ্র সবাইকে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছে।স্পন্দনকে দেখেও চন্দ্রের কাজে কোনো বিরতি নেই।তা দেখে স্পন্দন বললো,
__তোদের কি আক্কেল টাক্কেল উড়ে গেছে নাকি?
মিতু বললো,
__কেনো ভাইয়া?
__আমার বউকে দিয়ে এভাবে কাজ করাতে তোদের খারাপ লাগছে না?
__খারাপ লাগবে কেনো? চন্দ্র খুব ভালো মেহেদী দিতে পারে।ওর মতো করে কেউই দিতে পারে না।তাই আমাদের সবাইকে মেহেদী পড়াতে হবে চন্দ্রের।
__মায়ের বাড়ির আবদার আর কি? আমার বউ এর আর খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই না?
__আরে ভাইয়া তুমি রাগ করছো কেনো?আর একটুখানি বাকি আছে। এরপর তোমার বউ তুমি যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারো।
__হয়েছে হয়েছে।এতো বকবক করতে হবে না। নিজেদের টা নিজেরাই দিয়ে নে। আমার ঘুম পাচ্ছে।
__তোমার ঘুম পাচ্ছে তুমি ঘুমাও না ভাইয়া। আমাদের জ্বালাতন করতে এসেছো কেনো?
__আমার ঘুম পাচ্ছে।আর ঘুম পেলে আমার বউ লাগবে।তাই বউ যেহেতু চন্দ্র তাই এখন আমার চন্দ্রকেই লাগবে।
কথাটা শুনেই চন্দ্রের কান গরম হয়ে গেলো।ছোট ছোট ভাই বোনদের সামনে এগুলো কি শুরু করেছে স্পন্দন। ভাবতেই লজ্জায় নুইয়ে পড়লো।স্পন্দন বললো,
__চন্দ্র ঘরে চল।
__আরে ও ঘরে যাবে কি ভাইয়া?ওর এখনো মেহেদী ই পড়া হয়নি।
__আর পড়তেও হবে না। অনেক হয়েছে তোদের এই মেহেদী পড়া।এতো সময় বউ ছাড়া থেকে তোদের কাজে হেল্প করেছি এটাই বেশির বেশি। আমার এখন বউ লাগবে মানে লাগবেই।তাতে তোদের মেহেদী পড়া হোক আর না হোক।
বলেই স্পন্দন কোনোদিকে না তাকিয়ে ফট করে চন্দ্রকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিলো।তা দেখে সবাই যেনো ৪৮০ ভোল্টে ঝটকা খাওয়ার মতো চোখমুখ করে তাকিয়ে পড়লো। সেদিকে স্পন্দন থোড়াই কেয়ার না করে চন্দ্রকে কোলে তুলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই ওর মায়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো। চন্দ্র তো লজ্জায় না পারছে মাটির নিচে ঢুকে যেতে।স্পন্দনের বুকের দিকে আরো চেপে মুখ লুকিয়ে নিলো।উনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বিচলিত হয়ে বললো,
__চন্দ্র কি হয়েছে তোর?শরীর খারাপ করেছে? আমাকে বলিস নি কেনো স্পন্দন।দেখি কোথায় কি হয়েছে চন্দ্র।
চন্দ্র এবার আরো গুটিয়ে গেছে।স্পন্দন যে এমন কান্ড করবে তা ও ভাবতেই পারেনি।স্পন্দন এবার আবার বিরক্ত হয়ে বললো,
__আরে মা থামো তো।কিছু হয়নি ওর।
__তাহলে তোর কোলে উঠে আছে কেনো?
__ও কেনো কোলে উঠে থাকবে।ওতো আসতেই চাইনি তাই কোলে তুলে নিয়ে আসছি।
__আসতে চায়নি তো আনলি কেনো?
__আমার ঘুম পেয়েছে।
স্পন্দনের উত্তর শুনে উনি আরো অবাক হয়ে বললো,
__তোর ঘুম পেয়েছে তো চন্দ্রকে কোলে নিয়ে কি করছিস?যা ঘুমা।
__আমার বউ ছাড়া ঘুম আসে না।দেখি সরো তো।এ বাড়িতে আমার বউকে নিয়ে সবাই পড়ে আছে। আমার আর তার আশেপাশে থাকার সুযোগ ই নেই।আজব তো । তোদের বউ চাই থুরি জামাই চাই তো বিয়ে করে নে না। আমার বউ নিয়ে এতো কাজ করানোর কি আছে?
বলেই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে রুমে ঢুকে গেলো স্পন্দন।ওর মাও মনে হয় কারেন্টে ঝটকা খাওয়ার মতো চোখ মুখ করে তাকিয়ে আছে।তা দেখে ইরা বললো,
__কি হয়েছে ভাবী? এভাবে দাঁড়িয়ে কি দেখছো?
__দেখছি কি সেটা পরে।আগে একটা চিমটি দে তো ইরা।দেখি আমি স্বপ্ন দেখছি না জেগে আছি।
ইরা ও সাত পাঁচ না ভেবে একটা চিমটি বসিয়ে দিল।ওমনি উনি আহ্ করে লাফিয়ে উঠে বললো,
__আমি তো জেগেই আছি ইরা।তাহলে সব ঠিকঠাক দেখেছি বল।
__আরে কি দেখেছো তুমি ভাবী?
__কিছু না।সর তো? আম্মা কোথায়?
__নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
স্পন্দনের মা খুশিতে ডগমগ করতে করতে সেদিকেই ছুটলো।মাঝ খানে কি হয়েছে তার আগামাথা কিছু না বুঝতে পেরে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো ইরা।
#চলবে,,,,,,,
লেখার ভুল ত্রুটি মার্জনীয়