অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব-২৭+২৮

0
694

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-২৭

অহনা নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। আয়ন্তিকা হতভম্ব!এভাবে হুটহাট কান্নার মানে তার বোধগম্য হলো না। এবং আয়ন্তিকা এটাও বুঝতে পারলো না কেনো অহর্নিশ অহনা কে দেখে এমন পাংশুটে মুখ বানিয়ে খাবার প্লেটে রেখেই রুমে চলে গেলো। এরকম আরো কয়েককবার লক্ষ্য করেছে সে। অহর্নিশ অহনা কে দেখলেই বিদঘুটে আচরণ করে। কখনো রেগে কথা বলে, কখনো তো কথাই বলেনা! মায়ের প্রতি অহর্নিশের এমন আচরণ দেখে আয়ন্তিকার রাগ হয়। প্রচন্ড রাগ! এ কেমন মানুষ অহর্নিশ?

আয়ন্তিকা সবেমাত্র অহনা কে জিজ্ঞেস করেছিলো কেনো অহর্নিশ তার প্রতি এমন আচরণ করে?এই প্রশ্নটা করার পরপরই অহনা কেঁদে চলেছে একাধারে। কিন্তু আয়ন্তি বুঝলো না সে কি কোনো কান্না করার মতো প্রশ্ন করেছে? না তো! তাহলে?
আয়ন্তিকা অহনার দিকে পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে বলল,

‘ মামি তুমি কি আরো কিছুক্ষণ কান্না করতে চাচ্ছো?’

অহনা ঘাড় উঁচু নিচু করে ইশারা করে ‘ হ্যা ‘ জানায়। আয়ন্তিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ ঠিক আছে। তুমি তোমার কাজ করো তাহলে। আমি যাবো আর আসবো। আসার পর তোমার এই কান্না যদি চলমান দেখি, তাহলে আমি কিন্তু তোমার সাথে আর কখনোই কথা বলবো না। ‘

কথা শেষে আয়ন্তিকা এক মূর্হতও দাঁড়ালো না। চট করে চলল অহর্নিশের রুমের উদ্দেশ্যে। রুমে এসেই সে দেখলো অহর্নিশ জানালার কাছে কেমন থমথমে মুখ নিয়ে বাহিরে দৃষ্টি স্থাপন করে রেখেছে। চোখদুটো কেমন চকচক করছে! তবে আয়ন্তিকা তা দেখেও না দেখার ভান করে এগিয়ে যায় সামনে। অহর্নিশের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে ঠাস ঠাস করে দু’টো থাপ্পড় মেরে দেয়! রাগে রীতিমতো কাঁপছে সে। অহর্নিশ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায়। গালে হাত দিয়ে ভড়কানো কন্ঠে বলল,

‘ থাপ্পড় মারলে কেনো আয়ন্তিকা? ‘

আয়ন্তিকা ফুঁসে উঠে বলল,

‘ মাত্র তো দু’টো মেরেছি। এখন আরো চারটা মারতাম। দয়ার খাতিরে ছেড়ে দিয়েছি। ‘

অহর্নিশ অসহায় কন্ঠে বলল, ‘ কিন্তু আমি করেছিটা কি? কি কারণে আমার ওপর এতো রেগে আছো?’

‘ মায়ের সাথে কেও এমন ব্যাবহার করে?মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত! আপনি তা জানেন?উফ! জানবেন কি করে? নামাজ, কোরআন এর তো খবরই নেই আপনার। আমি সেই প্রথম হতে দেখছি আপনি মামীর সাথে উদ্ভট ব্যাবহার করেন। অপমান করতেও দেখেছি একদিন! আপনার বিবেকে বাঁধে না? যেই মা আপনাকে দশ মা দশ দিন গর্ভে ধারণ করে এতো কষ্ট সহ্য করলো আপনি তাকেই কষ্ট দিচ্ছেন? কেনো অহর্নিশ? কারণটা বলুন দয়া করে! কি হয়েছে? আপনি নিজের আপন মায়ের সাথে এমন ব্যাবহার কেনো করছেন?’

অহর্নিশ মূর্হতে কেমন অদ্ভুতুরে হয়ে গেলো। চোখ দুটো লাল! চোখের কার্নিশে এসে জমা হয়েছে স্বচ্ছ নোনা পানির ঢল। যেকোনো সময় টুপ করে গড়িয়ে পড়বে। হাতের উল্টোপিঠে চোখের অশ্রুকণা মুছে নিয়ে অহর্নিশ নিজেকে ধাতস্থ করার প্রয়াস চালায়। পরিশেষে নম্র কন্ঠে বলল,

‘ তিনি আমার আসল মা নন! আমার মা বহু আগেই মারা গিয়েছে। আমাকে একা করে চলে গেছে। ‘

আয়ন্তিকা বিষ্ফোরিত চাহনি দেয় অহর্নিশের দিকে। পাল্টা প্রশ্ন করার জন্য সে উদ্বিগ্ন হতেই ডাক পড়ে অহনার। চটজলদি সে রুম হতে বেড়িয়ে অহনার নিকট এসে দেখে সে ফুপাচ্ছে। অহনা তার হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে দেয়। নাক টেনে বলে,

‘ তুই সব জানতে চাস না?আজ তোকে সব বলবো। আমি অহর্নিশের আসল মা নারে আয়ন্তি! ‘

আয়ন্তিকা খানিকটা থতমত খেয়ে বলল,

‘ জানি। মাত্রই বললেন উনি। আপন মা না হলে কি হয়েছে মামি?তাই বলে সে এমন ব্যাবহার কেনো করে সে তোমার সাথে?’

‘ অহর্নিশের আসল মা যিনি ছিলেন আলিশা! তিনি খুব একটা ভালো ছিলেন না। কিন্তু অহর্নিশ ছোট বেলাই থেকে মা ভক্ত ছিলো। মাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না। আলিশার নিজের বাচ্চাদের প্রতি কোনো ভালোবাসা ছিলো না। তাট বয়ফ্রেন্ড ছিলো। ইমান ব্যাবসার কাজে প্রায় সময়ই দেশের বাহিরে থাকতেন। আর্নিয়া বোডিং স্কুলে! আলিশা ওর বয়ফ্রেন্ড কে বাসায় এনে অনৈতিক কাজ করতো। অহর্নিশ তখন ক্লাস ফোরে পড়তো। মায়ের এসব কীর্তিকলাপ বাবাকে বলতো না। বাবা মাকে মারবে বলে। তাড়িয়ে দিবে! আলিশাকে অহর্নিশ পা ধরে, মায়ে মাথা ঠেকিয়ে পর্যন্ত বলেছে একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন আলিশা ওকে খুব মেরেছিলো। রড আগুনে গরম করে এনে ঐটা দিয়ে পিটিয়ে ছিলো। আলিশার বয়ফ্রেন্ড অহর্নিশ কে সেদিন টানা ২ ঘন্টা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ছিলো। আলিশা তা দেখে কোনো বাঁধা প্রদান করেনি। শুধু হেঁসেছে। একজন মা এতোটা নিষ্ঠর কিভাবে হয় রে আয়ু? সেদিন থেকেই অহর্নিশের ওপর নরক যন্ত্রণা শুরু হলো। প্রায়ই আলিশা অহর্নিশ কে মারতো। হাত দিয়ে না মোটা মোটা লাঠি দিয়ে। কতদিন খেতে দেয়নি আমার ছেলেটাকে! ‘

অহনা আঁচলে মুখ চেপে হু হু করে কেঁদে দেয়। আয়ন্তিকা নিজেও কাঁদছে। ইশ! মানুষ এতো নিষ্ঠুর প্রকৃতির কিভাবে হয়? আয়ন্তিকা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

‘ আলিশা আন্টি এমন কেনো করতো? নিজের ছেলেকে এতোটা কেও মারে কিভাবে? ‘

‘ ইমানের সাথে বিয়েতে আলিশার মত ছিলোনা। ও অন্যজনকে ভালোবাসতো। ইমান আলিশাকে পছন্দ করতো। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে দিয়েছে তিনি আলিশাকে। বাচ্চা হবার পর ইমান আলিশার কিছু পরিবর্তন দেখে ভেবেছিলো ও ভালো হ’য়ে গেছে। তাই সে বাহিরে চলে যেতো নিশ্চিতে! আর তখনই আলিশা এসব করতো। দিনকে দিন অহর্নিশের ওপর অত্যাচার বেড়েই চলেছিলো। ছোট সেই ছেলেটা কিভাবে যেনো এতো অত্যাচারা সহ্য করেও বেঁচে ছিলো আলিশা তাকে একদিন ভালোবাসবে তার আশায়! তারপর একদিন ইমান বাসায় আসে। নিজ চোখে দেখে ছেলেকে অত্যাচারের দৃশ্য। সেদিনই পুলিশ আলিশা আর ওর বয়ফ্রেন্ড কে ধরে নিয়ে যায়। ওরা এখনো জেলে। তারপর থেকে অহর্নিশ অন্যরকম হয়ে যায়। মেয়েদের ঘৃণা করা শুরু করে। একটু চাপা স্বভাবের হয়ে যায়। অয়ন ওর জীবনে আসলে যদিও ঠিক হয়ে যায় অনেকটা। কিন্তু মেয়েদের ওপর থেকে ঘৃণাটা সরাতে পারেনি। বিশেষ করে আমার! ইমান আমাকে অহর্নিশের খেয়াল রাখার জন্যই বিয়ে করেছিলো। ‘

অহনা থেমে গিয়ে বলল,

‘ আমার কষ্ট নেই অহর্নিশের করা ব্যাবহারে। আমি শুধু চাই ছেলেটা ভালো থাকুক। ওকে দেখে রাখিস আয়ু। আমার ছেলেটা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। আজ আসি! ‘

কথা শেষে ক্ষনের জন্য না দাঁড়িয়ে চটজলদি বাসা থেকে বেড়িয়ে যায় অহনা। আয়ন্তিকা দু’হাতে মুখ চেপে অশ্রুপাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। নিজের ডান হাতটাকে তার কেটে কুচিকুচি করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এ কি করলো সে?এই থাপ্পড়টা কেনো আগে সে তার গালে মারলো না?কেনো না জেনে এমন ভয়ংকার কাজটা করলো?

আয়ন্তিকা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় অহর্নিশের রুমে। কোমল বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে অহর্নিশ। নেত্রপল্লব বন্ধ! ঘুমিয়ে পড়েছে কি?সামনে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসতেই বোধগম্যতা পায় অহর্নিশ সত্যিই ঘুমে। আয়ন্তিকা যেই গালটায় অহর্নিশ কে দু’টো থাপ্পড় মেরেছিলো সেই গালটাতে পরাপর কয়েকটা চুমু খেয়ে নিলো সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,

‘ আর কখনোই আপনাকে কষ্ট পেতে দিবো না প্রমিস। এখন থেকে আপনাকে সুখে রাখার দায়িত্ব আমার। ‘

আয়ন্তিকা অহর্নিশের পাশ ঘেঁসে শুয়ে পড়লো! তার একটা ঘুম প্রয়োজন। কান্নার করার কারণে মাথায় চাপ সৃষ্টি হয়ে ব্যাথা শুরু হয়েছে। ভীষণ ব্যাথা!

__________________________

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই বসে আছে অহর্নিশ। শুভ্র বর্ণের টিস্যুটা দিয়ে বারংবার ললাট হতে ঘাম মুছে নিচ্ছে। এই প্রথম কোনো মন্ত্রী তাকে পারসোনালি মিট করতে ডেকেছে তাি নিজ বাসভবনে! মন্ত্রীদের সাথে মূলত তার অফিশিয়ালি কথা হতো সবসময়। এই মিটিং! সেই মিটিং! তার মাঝেই মন্ত্রীদের তার সহিত সাক্ষাৎ হতো। টুকটাক কথা চলতো। সৎ, নম্র স্বভাব এবং অল্প বয়সেই এতোটা খ্যাতি অর্জনের জন্য বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর কাছে সে প্রিয়পাত্র!

আধাঘন্টা পেরুতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহাদ উদ্দিনের ব্যাক্তিগত কর্মচারী এসে বলল সাহাদ তার জন্য বাগানে অপেক্ষামান। অহর্নিশ সৌজন্যমূলক হাসি দিলেও নিভৃতে সে তিক্ততা প্রকাশ করে। বাগানেই যদি সাক্ষাৎ করবে তাহলে তাকে এতক্ষণ ড্রইং রুমে বসিয়ে রাখার মানেটা কি?হু?

বাগানে যেতেই অহর্নিশ খেয়াল করে সাহাদ সাহেব বাগানে স্থাপনকৃত সোফায় বসে আছে হাসিমুখে। হাত ইশারা করে তাকে ডাকছে! অহর্নিশ পদচারণা দ্রুততর করে সাহাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম স্যার। ভালো আছেন?’

সাহাদ ম্লান হাসে। পরবর্তীতে ভ্রু কুঞ্চিত রূপে প্রতিস্থাপন করে বলে,

‘ এইতো ভালো আছি! বসো তুমি। ‘

অহর্নিশ বসতে বসতে প্রতুত্তরে বলল, ‘ স্যার হটাৎ আমায় পারসোনালি ডেকে পাঠালেন?এনি প্রবলেম?’

‘ বলছি ইয়াং ম্যান! আগে বলো চা নাকি কফি?’

‘ কফি। ‘

সাহাদ একজনকে নির্দেশ দেয় কফি আনার জন্য। অতঃপর সে সটান হয়ে বসে বলল,

‘ তোমাকে ডেকেছি এক বিশেষ কারণে অহর্নিশ। কারণটা মাসুদ! সে আমার কাছে অভিযোগ করেছে তুমি বাল্যবিবাহ করেছো। ১৫ বছরের একজন মেয়েকে বিয়ে করেছো। এরজন্য সে তোমার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাচ্ছে। এবং বলছে যেনো তোমার বিরুদ্ধে স্ট্রং কোনো স্টেপ নিয়ে তোমাকে যে করেই হোক এমপি পদ হতে সরাতে। ‘

অহর্নিশ কফি মগে চুমুক দিয়ে ভাবনা ছাড়াই বলল,

‘ স্যার এখন এতে আমার কি করার আছে?মাসুদ আপনাকে এসব বলেছে তা এখন আমি কি করতে পারি?আমাকে কেনো এসব বলছেন? মাসুদ যা বলছে তা যদি আপনার কাছে ঠিক লাগে তাহলে তা করুন। আমি বাঁধা দিবো না বা বাঁধা দেয়ার সাধ্য আমার নেই! ‘

‘ জানি তোমার বাধা প্রদানের কোনো ক্ষমতা নেই তাই বলছি তোমার ওয়াইফ এর বর্তমান বয়স ১৭, আর ক’দিন পরই ১৮ তে পড়বে। এসবে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। মাসুদ তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো অনেকবার তার নিশ্চিত কোনো না কোনো প্রমান আছে তোমার নিকট? সেই প্রমান আমার কাছে দাও। আমি ওর বিরুদ্ধে স্টেপ নিবো। মন্ত্রীর নাতী, মেয়রের ছেলে হলে কি হয়েছে? এতো বড় অপরাধী এভাবে পার পেয়ে যেতে পারেনা। তোমার ওপর আমার যথেষ্ট ভরসা আছে। তুমি আমার খুব পছন্দের একজন! আমার ছেলের মতো তাই বলছি। ‘

অহর্নিশ গভীর দৃষ্টিতে তাকায় সাহাদের দিকে। পৃথিবীতে তবে কি এখনো ভালো মানুষের অস্তিত্ব আছে? সে তো ভেবেই নিয়েছিলো তার মৃত্যু দুয়ারে! পৃথিবী একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে তার। বিশেষ এক ধন্যবাদ।

__________________________

অহর্নিশ রাত করে বাসায় আসে। আজ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো তার। বাসায় এসে নিজের সাথে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে নিয়ে লক করে চটজলদি। নিজ রুমে এসে আয়ন্তিকার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আয়ন্তিকার এক হাত আঁকড়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,

‘ তুমি আমার কাছে খুব বেশি স্পেশাল আয়ন্তিকা! একটু বেশিই স্পেশাল। এইযে তুমি আমার জীবনে পা রাখলে। আমার লাইফটা ফুলের মতো সুন্দর হয়ে উঠছে দিনকে দিন। আমার সাধাসিধে দুঃখে ভরা জীবনটাকে ফুলের মতো সুন্দর করা জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। ‘

আয়ন্তিকার হাতে নিজের ওষ্ঠাধরের স্পর্শ এলিয়ে দেয় অহর্নিশ। দিনশেষে এটাই যেনো শান্তি, পূর্ণতা!

চলবে…

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-২৮

পৌষের প্রথমাংশ! আগের বছর গুলো হতে এ বছর শীত যেনো একটু বেশিই। কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতিতে পশ্চিমে লালাভ সূর্য ডুবোডুবো প্রায়। মোটা একটা শাল গায়ে জরীয়ে নিয়ে আয়ন্তিকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অহর্নিশ তার কাজে ব্যাস্ত। দুপুর হতে সেই যে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে দিন দুনিয়া ভুলে। কারো দিকে তাকানোর তার সময় নেই। অভিমান, রাগ চেপে নিয়ে আয়ন্তিকা বারান্দায় এসে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। অহর্নিশ আঁড়চোখে দেখেছিলো একবার আয়ন্তিকা কে। তবে সে অসহায়! কাজ ছেড়ে ওঠার বিন্দুমাত্র সময় নেই তার হাতে।

পরিশেষে আরো দুই ঘন্টা পর অহর্নিশ ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সোজা বেলকনিতে এসে আয়ন্তিকা কে পেছন হতে আলত করে জরীয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি স্থাপন করে নিয়ে বলল,

‘ রাগ করেছো চাঁদ? ‘

‘ চাঁদ ‘ নামে অহর্নিশ আয়ন্তিকা তখন ডাকে যখন আয়ন্তিকা তার ওপর ভিষণ ক্ষেপে থাকে। রাগ গলাতে তখন অহর্নিশ এই নামে ডাকে তাকে। এবং তার খানিক বাদেই আয়ন্তিকা গলে পানি হয়ে অহর্নিশ এর সাথে স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু আজ! ১০, ১৫ মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরও আয়ন্তিকা তার দিকে ঘুরে পর্যন্ত তাকালো না। অহর্নিশ তপ্তশ্বাস ফেলে আয়ন্তিকা কে ছেড়ে আয়ন্তির পাশাপাশি দাঁড়ায়। নম্র কন্ঠে বলে,

‘ আমার কাজগুলোই এমন আয়ন্তিকা। আমি চাইলেও তোমায় পূর্ণরূপে সময় দিতে পারিনা। বাধ্য আমি! হাত, পা শিকল দিয়ে বাঁধা আমার। এতো বড় দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছি, ঠিকঠাক ভাবে সেই দায়িত্ব পালন না করলে তো দিনশেষে তোমাকেই সবাই ইনসাল্ট করবে না? আমি তো ইনসাল্ট হবোই সাথে তোমাকেও তারা আঘাত করে কথা বলবে। ওটা তো আমি সহ্য করতে পারবো না। ‘

আয়ন্তিকার পর্বতসম অভিমান একটুখানি গলে পানি হলো বোধহয় অহর্নিশ নম্র, যৌক্তিক কথা শ্রবণ করে। সে একটু নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে নতজানু হয়ে বলল,

‘ আমি তো বলিনি আপনি আমায় সারাক্ষণ টাইম দিন। শুধু বলেছি এক ঘন্টা পাশে থাকলেও হবে। আপনি তো এখন আমার পাশে আধাঘন্টাও ঠিকমতো থাকেন না। ‘

‘ এখন কাজের চাপটা একটু বেশিই..! তাই এমন হচ্ছে। আমায় একটু সময় দাও। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে তোমায় কোলে করেই সারাদিন চুমু খাবো প্রমিস! ‘

অহর্নিশ রসিকথা মিশ্রিত কন্ঠ। আয়ন্তিকা অহর্নিশের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেয়। ফিচেল হাসে অহর্নিশ তা দেখে! হুটহাট আয়ন্তিকার এমন তীক্ষ্ণ, রাগী দৃষ্টি তার কাছে বেশ লাগে। অহর্নিশ এগিয়ে গিয়ে আয়ন্তিকার একহাত টেনে ধরে ঠেসে নিজের ওষ্ঠাধর স্পর্শ করায়! পরিশেষে হাত টাকে শক্ত ভাবে আঁকড়ে নিয়ে বলল,

‘ বাহিরে যাবে?’

‘ এই শীতে? ‘

‘ হু! আমরা তো আর সিঙ্গেল কাপল না যে বাহিরে গেলে শীতে কাঁপাকাপিঁ করবো। আমরা ম্যারিড! একই শালের নিচে দু’জনের উষ্ণতা আমাদের শীত আভাসটা কাটিয়ে দিবে। ‘

অহর্নিশ দুষ্টু হাসে। আয়ন্তিকা লজ্জায় লাল, নীল হয়ে পিছন ফিরে তাকায়। ইশ! এই লোকটা কি কখনোই মানুষ হবেনা? এতো লজ্জা কেনো দেয় সে লাজুকলতা কে? অহর্নিশ বড় কোনো শাস্তি পাওয়া উচিত এই কর্মের পরিপ্রেক্ষিতে! ভিষণ লজ্জায় কুকরে দেয়ার অপরাধে অহর্নিশ কে অবশ্যই শাস্তি দেয়া উচিত। বিশেষ ধরনের শাস্তি!

অহর্নিশ আশপাশ তাকিয়ে নিয়ে বলল,

‘ জলদি চেঞ্জ করে আসো আয়ন্তিকা। আমরা বাহিরে যাচ্ছি এটা ফাইনাল! ‘

আয়ন্তিকার ইচ্ছে হলো সে ‘ না ‘ বলবে। তবে পরবর্তীতে নিজের ঘোরতর ইচ্ছেটাকে দমন করতে না পেরে সে রাজি হয়ে বাহিরে যেতে। বেশ কয়েক দিন হলো বাহিরে যাওয়া হয়না অহর্নিশের সাথে। বাহিরে যাওয়া বলতে কলেজ যাওয়া – আসা! ব্যাচে যাওয়া এতটুকুই।

রুমে সে তৈরি হয়ে পরিপাটি হয়ে নেয় আয়ন্তিকা। অহর্নিশ নিজেও পাশের রুমে গিয়ে চটজলদি তৈরি হয়ে নেয়। গাড়িতে বসার পর ক্ষন মাঝে অহর্নিশ চট করে আয়ন্তিকার গালে চিমটি বসিয়ে দিয়ে বলল,

‘কারো নজর না লাগুক ফুহ্! ‘

রক্তিম চোখে আয়ন্তিকা দৃষ্টি দেয়ার মধ্যিখানে এক পর্যায়ে সে অহর্নিশের করা কর্ম রিপিট করে। তবে সে চিমটিটা বেশ জোরেসোরে দিয়ে উঁচু গলায় বলল,

‘ নজর না লাগুক ফুহ্! থুহ্! ‘

অহর্নিশ শব্দ করে হেঁসে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। একান্ত কিছু মূর্হত অনুভব করার জন্য তারা পারি দেয় তাদের পছন্দসই কোনো এক স্থানে। নিভৃত হতে অনুভব করার প্রয়াসে দিন দুনিয়া ক্ষনিকের জন্য ভুলে যায় দুজন কপোত – কপোতী!

_________________________

বছর খানেক পর!

ভারী শরীর নিয়ে উঠে বসার প্রয়াস চালায় আয়ন্তিকা। তবে সে বুঝি ব্যার্থ! পেটে বাবু আসার পরপরই অনেকটা মোটা হয়ে গিয়েছে সে। অহনা পাশে থাকায় সে উঠতে সাহায্য করে আয়ন্তিকা কে। পরিশেষে অহনা নিজ স্থানে বসার পর বলল,

‘ ভাবা যায়! আমাদের সেই ছোট্ট আয়ন্তি কতো বড় হয়ে গেছে। তার পেটে এখন দুই দুটো বাবু। এতো বড় হলি কবে বল তো?এইতো ক’দিন আগেই তো মনে হয় তোর ১৮ তম জন্মদিন আমরা পালন করলাম। তোকে কেক দিয়ে ভুত বানিয়ে দিলো অহর্নিশ। ভার্সিটি ওঠার পর যদিও তোর মধ্যে অনেক ম্যাচিউর ভাবটা এসেছে। তবুও বিশ্বাসই হয়না আমার। ‘

আয়ন্তিকা একগাল হাসে! ভীতু সেই ছোট্ট ১৫ বছরের আয়ন্তিকা এখন ১৯ বছরের একজন তরুণী। কিছুদিন পরই সে মা হয়ে যাবে দুজন নব্য শিশুর। আয়ন্তিকা মুখশ্রীতে এখন আর বাচ্চাটে ভাবটা অতোটা নেই। তবে আছে পরিশিষ্ট! আগের মতোই আচরণ করেনা সে। সবার কাছে এ যেনো নতুন এক আয়ন্তিকা। কিন্তু অহর্নিশের নিকটে সে সেই আগেরই আয়ন্তিকা হয়ে যায় দিনশেষে!

আয়ন্তিকা বালিশে ঠেস দিয়ে বসে বলল,

‘ আমারও বিশ্বাস হয়না আম্মু। আমার পেটে যে দু’টো বাচ্চা আছে তা একদমই মানতে ইচ্ছে হয়না। কিন্তু তারা দুজন যখন পেটের ভিতর মারামারি শুরু করে তখন ফিল করি আমিও মা হতে যাচ্ছি। ‘

‘ অহর্নিশ টাকে ধরে কয়টা থাপ্পড় মারা উচিত ছিলো রে আয়ু! ১৮ বছর হওয়ার পরই সে উঠে পড়ে লেগেছে বাচ্চার জন্য। ফাজিল! ‘

তাদের কথার মাঝে পিছন হতে কেও ভরাট কন্ঠে বলল,

‘ তুমি কি আমায় সত্যিই মারবে মা?’

আয়ন্তিকা, অহনা পিছন দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখে অহর্নিশ কে। গাল ভর্তি দাঁড়ি, আগের থেকে আরেকটু সুদর্শন হয়ে গিয়েছে বলে মনে হয় আয়ন্তিকার নিকট। অহনা তেজি কন্ঠে বলল,

‘ অবশ্যই। এইযে যারা আসছে তাদেরকে তুই দেখে রাখবি। ভুলেও যেনো আয়ন্তিকার ওপর বাচ্চাদের দিয়ে দিব্যি টইটই করবি না। ‘

‘ বাচ্চাদের আমিই দেখে রাখবো মা। ওদের আগে আসতে দাও। তারপর দেখবে একজন পার্ফেক্ট বাবা কাকে বলে?’

অহনা, অহর্নিশ দুজনের মধ্যে কথা বলা শুরু করলো। আয়ন্তিকা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে মা, ছেলেকে! সময়ের ব্যাবধানে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে তাদের সম্পর্ক। আর পাঁচটা সাধারণ মা, ছেলের মতোই তাদের সম্পর্ক এখন। তবে যদি ভিন্নতা ধরা হয় তাহলে তাদের দু’জনের ভালোবাসা টা বেশ গাঢ় হিসেবে দেখা যায়। অহর্নিশ এখন মা বলতে যেমন পাগল তেমনি অহনা আগের মতোই ছেলে বলতে পাগল। এখানে কিছুটা ক্রেডিট অবশ্য আয়ন্তিকা কে না দিলেই নয়!

অহনা আর কিছুক্ষন কথা বলে বেড়িয়ে যায় কেবিন থেকে। অহর্নিশ নিজের হাতে থাকা জিনিসপত্র রেখে এগিয়ে আসে আয়ন্তিকার নিকট। এসে পাশে বসে স্বভাবগত মতে আয়ন্তিকার এক হাত টেনে ধরে সে আলত চুমু খায়। অতঃপর শীতল কন্ঠে বলল,

‘ ভয় পাচ্ছো আয়ন্তিকা? ‘

আয়ন্তিকা ভ্রুকুটি কিঞ্চিত কুঁচকে নিয়ে বলল,

‘ ভয় কেনো পাবো?’

‘ আজ তোমার ডেলিভারি। আমাদের বাচ্চার আসবে পৃথিবীতে। এসময় প্রায় সবাই-ই তো একটু ভয় পায়। ‘

‘ ভয় আমি মোটেও পাচ্ছিনা অহর্নিশ। বরং আপনি যে ভয়ে কুপোকাত তা আপনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ‘

অহর্নিশ শুকনো ঢোক গিলে। সে আসলেই প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে। আয়ন্তিকার প্রেগন্যান্সিতে কিছু জটিলতা থাকার কারণে সিজার করতে হচ্ছে। অহর্নিশের ভয় এখানেই। বোকার মতো তার সব চিন্তাধারা। পেট কাটলে তার আয়ন্তিকা ঠিক কতোটা ব্যাথা পাবে?পেট কাটলে কেও বেঁচে থাকে?এসব ভিত্তিহীন চিন্তা করে সে ভিতরে ভিতরে প্রায় চুপসে গিয়েছে। অতিরিক্ত চিন্তায় তার মাথার ভেতর থেকে আউট হয়ে গিয়েছে সব কিছু! একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও সে এসব চিন্তাধারা করছে তা শুনে অয়ন হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার অবস্থা।

অহর্নিশ কে ঘামতে দেখে আয়ন্তিকা ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বলল,

‘ ঘামছেন কেনো আপনি?ঠিক আছেন তো?’

অহর্নিশ নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

‘ ঠিক আছি। তুমি শান্ত থাকো তো একটু। চুপচাপ বসে থাকো। হাঁটবে? ‘

‘ উঁহু! ‘

অহর্নিশ আয়ন্তিকার হাত শক্ত করে ধরে চুপ করে বসে থাকে। মৌনতা পালন করা যদিও এ মূর্হতে তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না তবুও চেষ্টা করে নিজেকে স্থির রাখার। সে এমন ব্যাকুল হয়ে গেলে কিভাবে চলে?
______________________________

ওটির সামনে অস্থিরতম রূপে পায়চারি করছে অহর্নিশ। তার পাশেই সিটে বসে হাই তুলছে অয়ন। কয়েকবার সে অহর্নিশ কে টেনে এনে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করার পর অহর্নিশ তাকে রাম ধমক দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ সে এই চেষ্টা আর দ্বিতীয়বার করেনি। অহর্নিশের বর্তমান অবস্থা এমন সে ওটির দরজা ভেঙে ভেতরে যেতে পারলে তবে বুঝি আসতো শান্তি!

অয়ন উঠে দাঁড়িয়ে অহর্নিশের পাশে এসে দাঁড়ায়। বিরক্তি নিয়ে সে বলল,

‘ ভাই থাম! আর কত হাঁটাহাটিঁ করবি?একটু বস! ভাবীর কিছু হবেনা। চিল! সারার সময় আমি কতো কান্নাকাটি করছিলাম মনে আছে?মানে হুদ্দাই করলাম! সারা একদম ঠিক ছিলো আল্লাহর রহমতে। তুই বসে আল্লাহকে ডাক। জীবনে তো নামাজ ঠিকমতো পরোস নাই। এ সময় নামাজ পড়তে পারলে কাজে লাগতো। যাইহোক..! ‘

অয়নের কথা শেষেই অহর্নিশ চট করে বলল,

‘ দোস্ত আমি নামাজ পড়বো। তুই আমাকে একটা জায়নামাজ এনে দে! জলদি যা! ‘

অয়ন ম্লান হেঁসে বলল, ‘ আচ্ছা ওয়েট কর। আনতেছি। ‘

খানিক বাদে অয়ন জায়নামাজ আর টুপি নিয়ে আসে। অহর্নিশ ওযু করে এসে নামাজের নিয়ম জেনে নামাজ পড়া আরম্ভ করে। নামাজ শেষে দীর্ঘ সময় নিয়ে মোনাজাত করে সে আসে ওটির সামনে। নির্দিষ্ট সময় পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই অহর্নিশ অয়নের একহাত শক্ত করে চেপে ধরে। ক্ষনিক পর দুজন নার্স টাওয়ালে করে দুটো বাবু নিয়ে এসে হাজির হয় অহর্নিশের সামনে। হাসিমুখে তাদের মধ্য হতে একজন বলল,

‘ অভিনন্দন স্যার। আপনার এক ছেলে এবং এক মেয়ে হয়েছে। কোলে নিন! ‘

অহর্নিশ স্তব্ধ! থমকানো দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতকের দিকে। দু’টো বাচ্চা অহর্নিশের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আলত করে হাত নাড়ছে। অয়ন হেঁসে বলল,

‘ এমপি সাহেব কংগ্রাচুলেশনস! কোলে নে বাবুদের।’

অহর্নিশ কাঁপা হাতে সর্বপ্রথম তার মেয়েকে কোলে নিয়ে চুমু খায়। কানের পাশে কাঁপা কন্ঠে আজান দেয়। অয়ন নেয় ছেলেকে! পরবর্তীতে অহর্নিশ নার্সকে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আমার ওয়াইফ?’

‘সুস্থ আছে স্যার। বেডে দেয়া হবে। দেখা করতে পারবেন কয়েক ঘন্টা পর। ‘

অহর্নিশ এবার ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে কানের পাশে আজান দেয়। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে সে ছেলের দিকে। বাবা হওয়ার এতো প্রশান্তি? অহর্নিশের মনে হলো পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখী মূর্হতে সে বসবাস করছে। সে সবচেয়ে সুখী ব্যাক্তি এই দুনিয়ার। পিতৃত্বের এতো সুখানুভূতি তা আজ হারে হারে অনুভব করছে অহর্নিশ।

চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা