অন্তহীন বসন্ত পর্ব-১২

0
303

#অন্তহীন_বসন্ত~১২
লিখা- Sidratul Muntaz

অবন্তীরা পৌঁছালো রাত এগারোটায়। খুব বেশি রাত নয়। কিন্তু বাড়ির অবস্থা দেখে মনে হলো, সবাই ঘুম৷ পরিবেশ অত্যন্ত নিঝুম। সদর দরজার কাছেই উঠানের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে কেউ। অন্ধকারে ক্ষুদ্র অগ্নিবলের উঠা-নামা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি তখন নেই। কিন্তু শীতল বাতাস পরিবেশে স্নিগ্ধতা এনে দিয়েছে। অবন্তীর শরীর বেয়ে ভয়ের একটা স্রোত প্রবাহিত হলো। কারণ দূরে দাঁড়ানো ওই ছায়ামূর্তিটি অন্য কেউ নয়- সানভী৷ সে রক্তাভ দৃষ্টিতে অবন্তীকে দেখছে। এই মানুষটির কথা অবন্তী প্রায় ভুলতে বসেছিল। সে অপ্রস্তুত কণ্ঠে নিশান্তকে শুধালো,” সানভী আঙ্কেল না?”

নিশান্ত একপলক সেদিকে তাকাল। তারপর হেসে বলল,” ভয় পেয়েছো?”

” না, ভয়ের কি আছে? আমি শুধু অবাক হলাম একটু। এভাবে তাকাচ্ছে কেন?”

” অবাক হওয়ার কিছু নেই। সকালে রাত্রি মামীর সাথে ঝগড়া হয়েছিল। মামী রাগ করে চলে গেছে বাপের বাড়ি। তখন থেকে মামার মেজাজ গরম। সেজন্যই হয়তো যাকে দেখছে তার দিকেই এভাবে তাকাচ্ছে। তুমি পাত্তা দিও না। চলো আমরা ভেতরে যাই।”

ড্রয়িংরুমেই দেখা হলো হেলেনের শ্বাশুড়ী মিসেস দিলারার সাথে। তিনি আরাম করে সোফায় বসে আছেন। কুলসুম তাঁর মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে। তিনি আধো ঘুম, আধো জাগ্রত অবস্থায় ছিলেন। অবন্তীকে দেখে কুলসুম বিস্ময়ের একটা শব্দ উচ্চারণ করল। এতোরাতে তাকে এই বাড়িতে দেখে খুব আশ্চর্য হয়েছে সে। কুলসুমের চিৎকারে দিলারার ঘোর চট করে ভেঙে গেল। অবন্তীকে দেখে তিনিও বিস্মিত হলেন। অবন্তী অস্বস্তি মেশানো একটা হাসি দিয়ে বলল,” আসসালামু আলাইকুম নানু। ”

দিলারা বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন,” ওয়া আলাইকুম। অবন্তী না?”

অবন্তী সবেগে মাথা নাড়ল। দিলারা উঠে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন,” কতদিন পর! কেমন আছো?”

তিনি প্রশ্নটা করলেন অবন্তীকে। কিন্তু তাকিয়ে আছেন দরজার দিকে। নিশান্ত বলল,” আর কেউ আসবে না। হেলেন মামীরা বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিল। অবন্তী বাসায় একা থাকবে, তাই নিয়ে এসেছি।”

” ওরা অবন্তীকে একা রেখে বিয়ের দাওয়াতে চলে গেল? কি আজব!” দিলারা অসহিষ্ণু হলেন। অবন্তী প্রশমিত কণ্ঠে বলল,” আমিই যেতে চাইনি। আর হঠাৎ ঝড় হলো, তাই ওরা ওখানে আটকে গেছে। নাহলে তো রাতে চলেই আসতো।”

” ভাগ্যিস নিশান্ত ওইদিকে গিয়েছিল৷ নাহলে তুমি একা বাসায় কি করতে বলোতো?” দিলারার কণ্ঠে আফসোস।

অবন্তী হেসে বলল,” কি আর করতাম? এতোক্ষণে হয়তো ঘুমিয়েই যেতাম।”

” একা বাড়িতে ঘুম আসতো? ভালো হয়েছে এখানে চলে এসেছো। রাতে খেয়েছো?”

নিশান্ত জবাব দিল,” না। আমরা কেউই এখনও খাইনি।”

দিলারা ব্যস্ত হয়ে বললেন,” এই কুলসুম, যাও ওদের দ্রুত খাবার বেড়ে দাও। তোমরা হাত-মুখ ধুঁয়ে টেবিলে বসো।”

কুলসুম দ্রুত ছুটে গেল। কোমরে আঁচল বেঁধে রান্নাঘরে ঢুকল খাবার গরম করতে। তখন জানালা দিয়ে শব্দ এলো৷ কুলসুম অল্পতেই ভয় পেয়ে যায়। সে শব্দের উৎস খোঁজার বদলে জানালা থেকে দূরে সরে গেল। তখন মাথা বাড়াল সানভী। তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলল,” এই গাঁধী, এদিকে আয়।”

কুলসুম হতভম্ব গলায় বলল,” আপনি এইখানে কি করেন?”

সানভী এদিক-ওদিক চেয়ে বিভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,” ভেতরে নিশান্তর সাথে কে এসেছে রে? অবন্তী নাকি?”

কুলসুম মাথা নেড়ে বলল,” জ্বী৷”

সানভীর ঠোঁটে খেলে গেল অদ্ভুত গা শিরশিরে হাসি৷ তাকে খুব আনন্দিত মনে হলো। খোশমেজাজে হাত বাড়িয়ে বলল,” এদিকে আয়। তোকে একটা জরুরী কাজ করতে হবে।”

বারান্দা থেকে ভেসে আসছে বুনো ফুলের ঘ্রাণ। অবন্তী অনেকক্ষণ ধরে দু’টো ফুল ছেঁড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু উচ্চতার অভাবে পারছে না। যাওয়ার পথে নিশান্ত এই দৃশ্য দেখে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,” বাদ দাও। তোমার মতো লিলিপুটের দ্বারা হবে না।”

অবন্তী রেগে তাকাল। কোমরে হাত গুঁজে বলল,” তা তুমি যখন এতোই লম্বুশ, তুমি পেড়ে দাও না!”

” স্যরি। রাতের বেলা আমি গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ি না।”

অবন্তী মুখ দিয়ে ভেংচি কা-টল। নিশান্ত অবশ্য তা দেখল না। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই মিসেস দিলারা বললেন,” অবন্তী, তুমি আজকে আমার সাথে ঘুমাতে এসো। বৃষ্টির রাত তো, সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। অন্য কোনো ঘর খালি নেই।”

অবন্তী আনন্দের সাথে বলল,” কোনো সমস্যা নেই নানু। আমি আপনার সাথেই ঘুমাতে চাই।”

” ঠিকাছে , এসো তাহলে।”

দিলারা এই কথা বলে নিজের ঘরে গেলেন। নিশান্ত উঠল হাত ধুঁতে। অবন্তী যেতে নিলেই সে ডাকল,” শোনো।”

অবন্তী দাঁড়িয়ে পড়ল,” হ্যাঁ বলো।”

নিশান্ত খুব জরুরী কথা বলতে চায় এমন ভাব করে কাছে এলো। অবন্তী মনোযোগ দিয়ে শোনার প্রস্তুতি নিল। নিশান্ত ফিসফিস করে বলল,” গুডনাইট।” কথাটা শুনে অবন্তী চোখ বড় করে তাকাল রাগী দৃষ্টিতে। নিশান্ত হেসে উঠল। প্রায় সাথে সাথে অবন্তীও হেসে ফেলল। তারপর বলল,” গুড নাইট।” সে চলে যেতে নিলেই কুলসুম কাঁপা কণ্ঠে ডাকল,” অবন্তী, এইটা তোমার ব্যাগ না?”

” ওহ ভুলে গেছিলাম।” অবন্তী ফিরে এলো। কুলসুম ততক্ষণে অবন্তীর হ্যান্ড ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। সে ব্যাগটা এগিয়ে দিল। অবন্তী আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল,” থ্যাংক য়্যু আপু।”

কুলসুম হাসল। হাসিটা মলিন। অবন্তী ব্যাগ নিয়ে মিসেস দিলারার ঘরে চলে এলো। এদিকে কুলসুমের মাথা ঘুরছে। এতোবড় একটা অন্যায় সে কিভাবে করল তা নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। তার হাতের প্রত্যেকটি আঙ্গুল কাঁপছে। হৃৎপিন্ডে ধুকপুক শব্দ। সে ডাইনিং টেবিল থেকে খাবারগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় অসাবধানতা বশত মেঝেতে ফেলে দিল। নিশান্ত বিস্ময় নিয়ে তার কান্ড দেখল। কাছে এসে বলল,” কি হয়েছে তোমার? এনি প্রবলেম?”

কুলসুম জবাব দিল না। তার কেঁদে ফেলতে মন চাইল। সে দ্রুত হাতে ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করতে লাগল। নিশান্তও তাকে সাহায্য করতে এলো। কুলসুম বলল,” দরকার নাই ভাইয়া। আপনি যান এখান থেকে।”

নিশান্ত বলল,” শশশ, কেউ দেখে ফেলার আগে জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলা ভালো। নয়তো পরে তুমিই বকা খাবে।”

অবন্তীর ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে সে কেবল এপাশ-ওপাশ করছে। আসলে তার ভয় লাগছে। ভয়টা সানভীকে নিয়েই। যদিও সানভীকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সে কিইবা করতে পারবে? মিসেস দিলারা তার পাশে শুয়ে আছেন। মনে হয় ঘুমিয়েও পড়েছেন। হঠাৎ হিসহিস আওয়াজ শুনে অবন্তী কেঁপে উঠল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে নিশান্ত। পর্দার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে অবন্তীকে ডাকছে সে। অবন্তী খুব অবাক হলো। বিরক্ত হওয়ার ভাণ করে বলল,” কি ব্যাপার?”

নিশান্ত বিড়বিড় করে কি যেন বলল। অবন্তী তা শুনতে পেল না। সে সাবধানে বিছানা ছেড়ে নিচে নামল। দরজার কাছে আসতেই নিশান্ত বলল,” আমার মাংকিটা খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি একটু দেখোতো এই ঘরেই কোথাও আছে।”

” এই ঘরে তোমার মাংকি থাকবে কি করে?”

” থাকতেও তো পারে। একটু খুঁজে দেখো না!” নিশান্ত বাচ্চাদের মতো আবদার করছে। অবন্তী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুঁজতে লাগল। দশ সেকেন্ডের মাথায় পেয়েও গেল। বালিশের নিচেই ছিল। সে বানরটা নিয়ে নিশান্তর কাছে এলো,” এটা না তোমার ছোটবেলার? এখনও ঘুমানোর সময় এইটা লাগে?”

নিশান্ত বানরটা প্রায় ছিনিয়ে নিল। হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল,” অফকোর্স লাগে। যতদিন আমি বিয়ে না করছি, ততদিন এইটা আমার বউ। সবসময় আমার সাথেই থাকবে।”

” বউ? শেষ পর্যন্ত বানর?’

অবন্তী এমনভাবে হাসছে যেন কোনো কৌতুক শুনেছে। নিশান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল,” হাসছো কেন?”

” কিছু না।”

“এদিকে আসো। সিরিয়াস একটা কথা বলবো।”

” কি কথা?”

” বাইরে আসো তারপর বলছি।”

” কি এমন কথা যে এইখানে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না?”

” বললাম তো, সিরিয়াস কথা। এইখানে দাঁড়িয়ে বললে নানু শুনে ফেলবে।”

অবন্তী মিনমিন করে বলল,” কত ঢং যে দেখবো!” বলতে বলতে সে বাইরে এলো। নিশান্ত তাকে হতভম্ব করে দিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। অবন্তী এমন কিছু আশা করেনি। তার নিশ্বাস থেমে গেল। চোখ গোলাকৃতি ধারণ করল। শরীর অসাড় হয়ে গেল। সে কি স্বপ্ন দেখছে? নিশান্ত কিছু একটা বলতে নিয়েও থামল। অবন্তী এভাবে কাঁপছে কেন? তার অবস্থা দেখে নিশান্ত চুপ করে গেল। ছোটবেলায় একবার সে অবন্তীকে বলেছিল,” আমি কিন্তু বড় হয়ে তোমাকে বিয়ে করবো অবন্তী। তুমি রাজি না থাকলেও করবো।”

এই কথা শুনে অবন্তীর সে কি কান্না! বিয়ে তখন তার কাছে ভয়ংকর ব্যাপার। আচ্ছা, এখনও কি অবন্তী কাঁদবে? নিশান্ত নিজেকে সামলে নিল। যে কথা বলার ছিল সেটা বলতে পারল না। তবে অন্যকিছু বলল। অবন্তীর কানের কাছে মুখ নিয়ে সে ফিসফিস করে বলল,” আই মিসড ইউ।”

তারপর একবারও পেছনে ফিরে না তাকিয়ে চলে গেল। অবন্তীর দৃষ্টি স্তিমিত, শরীরটা এখনও মৃদু কাঁপছে। কেমন আচ্ছন্নের মতো নিজের মাথায় হাত রাখল সে। নিশান্ত তার চুলে দু’টো ফুল গুঁজে দিয়ে গেছে। একটু আগেই যে ফুল দু’টো বাগানের গাছ থেকে পাড়তে চেষ্টা করছিল সে, এগুলো সেই ফুল। অবন্তীর চেহারায় লজ্জার একটা আভা খেলে গেল। ত্বরান্বিত হলো হৃৎস্পন্দন। কেমন অস্থির অনুভূতি হচ্ছে। সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, তার চোখে অশ্রু। দুঃখের নয়, এই অশ্রু তীব্র আনন্দের।

চলবে