#অন্য_বসন্ত ( প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
( প্রথম অধ্যায় )
অন্যদিনগুলোর মতন সেইদিনও কৃষ্ণেন্দুর কাজের ব্যস্ততা তুঙ্গে | প্রজেক্ট রিপোর্টটা শেষ করতে হবে আজই | এগারোটার আগে তো অফিস থেকে বেড়োতেই পারবে না | ঠিক এই সময়ই একটা ফোন , দীপ্তির নাম্বার ভাসছে স্ক্রিনে | কি ব্যাপার ! হঠাৎ এই সময় কল করছে কেন ! কথাটা ভেবেই ফোনটা ধরলো , আর ওপার থেকে শুনতে পেলো দীপ্তির বেশ ভারী হয়ে যাওয়া গলার আওয়াজ , ——— ” মার্ হঠাৎ খুব শরীর খারাপ হয়ে গেছে , কি করবো বুঝতে পারছি না | প্লিজ তাড়াতাড়ি এস | ”
না , আর কথাটাকে কোনোরকম কমপ্লিট না করেই দীপ্তি এবার হুট্ করে ফোনটা কেটে দিলো এই মুহূর্তে , আর কৃষ্ণেন্দুর চারিদিকটা যেন অন্ধকার হয়ে এলো হঠাৎ | ব্যাস , আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে , কিছু না ভেবে , সব কাজ , প্রজেক্ট রিপোর্ট , সবকিছুকে সেই অবস্থায়ই ফেলে কৃষ্ণেন্দু ছুটলো বাড়ির দিকে | অফিসের বাইরে পার্কিং এরিয়া থেকে গাড়িটা বার করেই হাই স্পিড ধরলো | তারপর চলন্ত রাস্তা দিয়ে আধ ঘন্টার রাস্তা অলমোস্ট পনেরো মিনিটে পার করে , দুটো সিগন্যাল ভেঙে , ট্র্যাফিক পুলিশের হাত থেকে নিজেকে কোনো মতে বাঁচিয়ে বাড়ির সামনে এসে যখন গাড়িটাকে দাঁড় করালো , তখন ঘড়িতে রাত ন-টা | কিন্তু আর এক সেকেন্ডও টাইম ওয়েস্ট না করে কৃষ্ণেন্দু গাড়ি থেকে নেমেই ডাক্তারের নাম্বারটা ডায়েল করলো ! কি জানি কি হয়েছে আলো মায়ের ! অনেকদিন ধরেই হাই প্রেসার | তার জন্যই কি শরীরটা খারাপ হলো ! এইসব হাজার চিন্তার ভিড়েই কানে ফোনটা নিয়ে ও বাড়ির কলিংবেলটা বাজিয়েছিল সেইদিন | কিন্তু দীপ্তি এসে বাড়ির দরজাটা খুলতেই অন্য দৃশ্য ! বাড়ি ভর্তি লোক , আলো মা, সবাই হাসি মুখে এখন ওর দিকে তাকিয়ে | টেবিলে রাখা একটা বার্থডে কেক , আর দেয়ালে ঝোলানো রঙিন কাগজে মোড়া ‘হ্যাপি বার্থডে কৃষ্ণেন্দু’ লেখাটা কেমন জ্বলজ্বল করে ওকে জানিয়ে দিচ্ছে ও কি লেভেলের বোকা বনেছে আজ ! কথাটা বুঝতে পেরেই রাগ আর আনন্দ দুটো মিলিয়ে একটা অদ্ভুত এক্সপ্রেশন তৈরী হলো ওর মুখে ! তবে দীপ্তি সেই এক্সপ্রেশনের মাঝেই বলে উঠলো একটু আলতো স্বরে , ———- ” রিয়ালি , রিয়ালি , রিয়ালি সরি আজকের জন্য | কিন্তু কি করবো বলো ? এইভাবে না ডাকলে কি আসতে নিজের জন্মদিনের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে ! এজ ইউজুয়াল তো ভুলেই গেছিলে ক্যালেন্ডারে এই দিনটাও থাকে যেটা একটু স্পেশ্যাল ! ”
না , এইসব লাইন শুনে কৃষ্ণেন্দু চাইলেও রাগটা দেখাতে পারলো না মেয়েটার ওপর কিছুতেই ! আর দীপ্তির ওই সরল হাসিটা দেখার পর কোনোভাবেই ওর ওপর রেগে থাকা যায় না যেন ! ছোট থেকেই | তাই একটু সময় নিয়ে অল্প হেসে উত্তর দিলো কৃষ্ণেন্দু , ———– ” সেই , আমি ভুলে গেলেও তো রক্ষা নেই | তুই তো শুধরোবি না | ব্ল্যাকমেল করে , কোনো না কোনোভাবে প্ল্যান করে কেকটা আমাকে কাটিয়েই ছাড়বি | আজ তো অলমোস্ট আমার জেলই হয়ে যেত ! দুটো সিগন্যাল ভেঙে এসেছি | আলো মাও শেষে তোর সঙ্গে মিলে গেলো ? ”
কথাটা শুনে কৃষ্ণেন্দুর আলো মা এবার বেশ জোর দিয়ে বললো , ———- ” তো কি করবো ? তুই তো নিজের ব্যাপারে কিছু মনে রাখবি না | তাই আমিও দীপ্তির সঙ্গে মিলে গেলাম | ”
মায়ের সাপোর্ট পেয়ে এবার দীপ্তিও বেশ তেজ দেখিয়ে বললো , ———- ” বেশ করেছি মিথ্যে বলেছি | আর জেল হয় তো নি ! হলে আমি উকিল দিয়ে ছাড়িয়ে আনতাম | যাইহোক , কেক কেটে এবার আমাদেরকে উদ্ধার করো | দয়া করে | বাড়ি ভর্তি লোক , সবাই ওয়েট করছে অনেক্ষন ধরে |”
কৃষ্ণেন্দুর সত্যি এরপর আর বলার মতন কিছু উত্তর নেই | এই মেয়ের সাথে কথায় অন্তত ও কোনোদিনও জিততে পারবে না | তাই চুপ করে কেক কাটাতেই মন দিলো | কিন্তু কৃষ্ণেন্দু মনে মনে জানে , সেই প্রত্যেকবারের মতন এইবারও জন্মদিনের কেকটা এই মেয়েটা নিজে হাতেই বানিয়েছে | তারপর কৃষ্ণেন্দুর সমস্ত বন্ধুদের ইনভাইট করা , খাবারের ব্যবস্থা , পায়েস রান্না , ওর জন্য পুজো দেয়া , সব করেছে নিয়ম মেনে, চুপচাপ , কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে | তাই এতো কিছুর বদলে দুটো সিগন্যাল ভাঙাটা এমন কোনো বড়ো ব্যাপার নয় | বরং অনেক কম এই এতো আয়োজনের তুলনায় |
আসলে কৃষ্ণেন্দু আর দীপ্তি সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধু | কৃষ্ণেন্দুর যখন ১৬ , তখন একটা একসিডেন্টে হঠাৎ ওর মা বাবা দুজনে একসঙ্গে মারা গিয়েছিলো | খবরটা শুনে সেদিন যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল ওর মাথায় | চারিদিকে একটা গভীর কালো অন্ধকার ছড়িয়ে গিয়েছিলো কয়েক মুহূর্তেই | আবছা ভাবে সেই অন্ধকারে নিজের মা বাবার মুখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না সেই সময়ে কৃষ্ণেন্দু | ভাবতে পারছিলো না যে এরপর কিভাবে বাঁচবে ! কিভাবে উঠে দাঁড়াবে ! কিভাবে দিনগুলোকে কাটাবে নিজের ! সেইদিন ওই গভীর , গাঢ় অন্ধকারে হয়তো কৃষ্ণেন্দু হারিয়েই যেত যদি না আলো মা এসে শক্ত করে ওর হাতটা ধরতো | কৃষ্ণেন্দুর মায়ের অনেক পুরোনো বন্ধু ছিল আলো | খুব কম বয়সে বিধবা হয়ে যাবার পর কৃষ্ণেন্দুর বাবা মা দুজনেই আলোকে নানারকম ভাবে সাহায্য করেছিল | একটা স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া থেকে শুরু করে ওর ছোট্ট মেয়ে দীপ্তির অনেক দ্বায়িত্ব নিজে থেকে ভাগ করে নিয়েছিল ওরা | খারাপ সময়ে যখন সবাই দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায় , তখন একমাত্র কৃষ্ণেন্দুর বাবা মা এসে দাঁড়িয়েছিল আলোর পাশে | যেদিন ওদের মারা যাওয়ার খবরটা আলো পেয়েছিলো , সেইদিন ওরও কেমন নিঃস্ব মনে হয়েছিল নিজেকে , আর আনমনে শুধু একটা মুখই ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে , কৃষ্ণেন্দুর মুখ | ওকে সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখছে আলো | হাসিখুশি মিষ্টি একটা ছেলে | এতো বড়ো ধাক্কাটা সামলাবে কি করে ! যেন কিছুতেই ভাবতে পারছিলো না আলো সেইদিন | তাই খবরটা পেয়ে প্রায় ছুটেই গিয়েছিলো কৃষ্ণেন্দুদের বাড়ি , ওর হাতটা শক্ত করে ধরতে | ওকে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে না দিতে | তারপর অনেক লড়াই করেছে ও কৃষ্ণেন্দুর জন্য | কৃষ্ণেন্দুর কাকারা তো প্রথমে উঠে পরে লেগেছিলো | ওর বাবার কোম্পানি ,টেক্সটাইলের বিজনেসটাকে কি করে নিজেদের নামে করে নেবে , এই প্ল্যানিং করছিলো শুধু ! তার জন্য কৃষ্ণেন্দুর কাস্টাডি নেয়ার নাম করে কেসও করেছিল দু বছর ধরে | তবে আলো হাল ছাড়েনি | যারা বেঁচে থাকতে একবারও কৃষ্ণেন্দুদের কারোর খোঁজ নিলো না , তারা যে মারা যাওয়ার পর কেন এতো আপন হতে চায় , সেটা খুব ভালো করে বুঝেছিলো ও | তাই প্রায় আগলে রেখেছিলো কৃষ্ণেন্দুকে নিজের কাছে | উকিল দিয়ে কেস লড়েছিল দু বছর | আসলে জানতো এইসময় যদি ছেলেটাকে ওর কাকাদের হাতে তুলে দেয় , তাহলে হয়তো কোনোভাবে কৃষ্ণেন্দুকে সাইন করিয়ে নেবে প্রপার্টি , বিজনেসের পেপারগুলোতে | তারপর সব কিছু নিজেদের নামে করে নেবে ওরা ! আবার এই সময়ে তো কৃষ্ণেন্দুর একটা নার্ভের প্রব্লেমও শুরু হয়েছিল | মা বাবার হঠাৎ মারা যাওয়ার ট্রমাটাকে ও কিছুতেই একসেপ্ট করতে পারছিলো না যেন | নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যেতে শুরু করেছিল ওর | সেন্সলেস হয়ে হঠাৎ হঠাৎ পরে যেত | কোনো রকম মেন্টাল স্ট্রেস , টেনশন কিছুতেই নিতে পারতো না নিজের মধ্যে | নার্ভগুলো কেমন নিস্তেজ হতে শুরু করেছিল ওই ট্রমাটার পর | তখন অনেক যত্ন করে , অনেক ভালোবাসা দিয়ে আলো ওকে আগলে রেখেছিলো | নিজের ছোট্ট দু কামরার ফ্ল্যাটে এনে রেখেছিলো কৃষ্ণেন্দুকে | অনেক ট্রিটমেন্ট , কাউন্সিলিংয়ের পর ঠিক করেছিল ছেলেটাকে | আর সেইসবের মাঝে ওর কাকারাও অবশেষে কেসে হেরে গিয়েছিলো , অনেক প্ল্যানিং প্লটিং করার পরেও | কিন্তু যাইহোক, এরপর আর কৃষ্ণেন্দুও কখনো নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেনি | বালিগঞ্জের ওই বিশাল বাড়িটা শুধু স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই ছিল না ওর কাছে ; যেখানে গেলে শুধুই মন খারাপ হয়, পুরোনো দিনগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে !
আর অদ্ভুতভাবে এই মাঝের দু বছরে আলো কে কেমন মা বলার অন্যরকম একটা অভ্যাস তৈরী হয়ে গিয়েছিলো কৃষ্ণেন্দুর | এছাড়াও দীপ্তির সাথে সব খারাপ লাগা , ভালো লাগাগুলোকে শেয়ার করে নেয়ার অভ্যাসটাও হয়ে গিয়েছিলো রোজের জীবনে | কোনো কারণ ছাড়াই , কোনো কিছু না ভেবেই , এই দুটো মানুষ কেমন একটা ফ্যামিলি হয়ে গিয়েছিলো নিজের | যাদের ছেড়ে অন্য বাড়িতে যাওয়া তো দূরে থাক , একটা দিনও না দেখে থাকা যায় না !
যাইহোক এইসবের পর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে এম.টেক কমপ্লিট করে কৃষ্ণেন্দু এম.বি.এ পড়েছিল মন দিয়ে | কারণ ও জানতো , বাবা মারা যাওয়ার পর যেই ব্যবসাটা আস্তে আস্তে অলমোস্ট শেষ হতে শুরু করেছিল , সেটার হাল শক্ত করে ধরতে হবে ওকে | ‘সেন টেক্সটাইল’ কে কিছুতেই শেষ হতে দিতে পারবে না কৃষ্ণেন্দু | বাবা অনেক পরিশ্রম করে বিজনেসটাকে সেট করেছিল | সেটাকে একটা জায়গায় পৌঁছে দিতেই হবে ওকে ! এই স্বপ্নটাকে চোখে নিয়েই যেন একে একে দিনগুলো পার করছিলো নিজের | তবে এই স্বপ্নটাকে সত্যি করার জন্য একটা মানুষকে কৃষ্ণেন্দু সব সময় নিজের সঙ্গে পেয়েছে যদিও | ওর এসিস্টেন্ট কাম কনসালটেন্ট কাম এডভাইজার ,কাম বেস্ট ফ্রেন্ড দীপ্তি | মেয়েটা ওর মতনই এম.বি.এ পড়ে বেমালুম বড়ো বড়ো কোম্পানির জব অফারকে একসেপ্ট না করে একদম ডিরেক্ট এসে জয়েন করেছিল কৃষ্ণেন্দুর কোম্পানিতে | যদিও কৃষ্ণেন্দু অনেক আপত্তি করেছিল প্রথমে | ওর কোম্পানির অবস্থা এই সময় যথেষ্টই খারাপ | মাত্র কুড়ি জন এমপ্লয়ির একটা ছোট টিম নিয়ে ব্যবসা চালায় ও | এক কথায় স্টার্ট আপ ই বলা যেতে পারে , কারণ বাবা মারা যাওয়ার পর এই কোম্পানি সামান্য কিছু ছোট ছোট কাজ ধরে বেঁচে ছিল, ওই পর্যন্তই | কিন্তু কে শোনে কার কথা ! দীপ্তি একরকম জেদ করেই নিজের এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা টাইপ করিয়েছিলো কৃষ্ণেন্দুকে দিয়ে | ও এই শুরুর দিনগুলোতে কিছুতেই কৃষ্ণেন্দুকে একা ফেলে রেখে কোথাও যাবে না | তাই স্যালারির এমাউন্ট , বড়ো চাকরির অফার , সব ছেড়ে ও এসে দাঁড়িয়েছিল কৃষ্ণেন্দুর পাশে | এখনো ভাবলে কথাটা খুব অদ্ভুত লাগে কৃষ্ণেন্দুর | এই হিসাবি পৃথিবীতে যে কি করে এরকম দুটো মানুষ পেয়ে গেলো জীবনে , যারা মন থেকে ওর জন্য ভাবে , মন থেকে পাশে থাকে , এটা ঠিক যেন স্বপ্নের মতন মনে হয় মাঝে মাঝে | ওই এক্সিডেন্টের পর ওর তো হারিয়ে যাওয়ারই কথা ছিল ! নিজের লোকহীন হয়ে বাঁচার কথা ছিল | কিন্তু তার বদলে নতুন একটা ফ্যামিলি পেয়ে গেলো কেমন ! নতুন একটা ঠিকানা খুঁজে পেলো নিজের জন্য | নতুন দুটো মানুষ পেলো জীবনে | যাদের ছাড়া ওর লাইফ একদম ইনকমপ্লিট ; পুরোপুরি নিঃস্ব যাকে বলে |
যাইহোক , সেইদিনের বার্থডে পার্টি তো খুবই আনন্দসহকারে কেটেছিলো এরপর | কিন্তু সেটা শেষ হতেই কৃষ্ণেন্দুর মুখ ভার | গেস্টরা চলে যাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই ল্যাপটপ খুলে বসেছিল ছেলেটা | প্রজেক্ট রিপোর্ট তো তৈরী করাই হয়নি ! আর কালকে প্রেজেন্টেশন | তার মানে আজ হয়ে গেলো রাতের ঘুম শেষ ! সারা রাত জেগে কাজ করতে হবে এখন ! এইসবই ভাবছিলো , তখনই ওর ঘরে দীপ্তি বিনা নোটিশে হাজির , হাতে ওর নার্ভের ওষুধগুলো নিয়ে | একটু যেন বিরক্ত হয়েই বললো ও , ——— ” সত্যি কৃষ্ণেন্দু ! কখনোও তো নিজের ওষুধগুলো মনে করে খাবে না কি ? সারাক্ষন কাজ নিয়ে একটা মানুষ কি করে থাকে কে জানে !”
কৃষ্ণেন্দু এবার একটু ছন্নছাড়া হয়েই উত্তর দিলো , ———- ” সেই ! রাখ তুই তোর ওষুধ এখন | প্রজেক্ট রিপোর্ট কমপ্লিট করা বাকি আমার ! আজ আমি শেষ ! কালকে প্রেজেন্টেশন এ গিয়ে যে কি করবো কে জানে ! প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে আমার এখন | প্লিজ , এখন কোনো ওষুধ খেতে পারবো না আমি ! আগে কাজটা কমপ্লিট করি , তারপর সব হবে |”
দীপ্তি এবার আলতো হেসে একটা অন্য কথা বলে উঠলো হঠাৎ ,————- ” তুমি একবারও নিজের মেলবক্সটা খুলে দেখেছো সন্ধ্যের পর থেকে ?”
কৃষ্ণেন্দু এই প্রশ্নটা শুনে একটু অধৈর্য্য হয়েই বললো , ————— ” মেলবক্স খুলবো ! কেন ! কি হয়েছে আবার ? কোনো ইম্পর্টেন্ট মেল্ আসার কথা ছিল না কি ? লাস্ট বিকেলে চেক করেছিলাম | কিছু ইম্পর্টেন্ট এমন ছিল না তো !”
কৃষ্ণেন্দুর এতগুলো কথা শুনে এই মুহূর্তে দীপ্তিও একটু অধৈর্য্য হয়ে বললো , ———— ” সত্যি বাবা ! এতো প্রশ্ন করো কেন বলো তো সব সময় ! খুলে দেখোই না একবার মেলবক্সটা ! হয়তো কিছু ইম্পর্টেন্ট খুঁজে পেয়েও যেতে পারো |”
কথাগুলো সত্যি কোনো মানে খুঁজে পেলো না কৃষ্ণেন্দু ! তবে দীপ্তির মুখের ওপর কোনো ব্যাপারে আজ অব্দি তো না বলতে পারেনি ও , তাই মেলবক্সটা খুলে দেখতেই হলো | কিন্তু নিজের মেলবক্স এ যে আচমকা এখন এরকম একটা সারপ্রাইজ খুঁজে পাবে কৃষ্ণেন্দু , এটা একদম ভাবতে পারেনি ও, দু সেকেন্ড আগেও ! প্রজেক্ট রিপোর্ট এর পিডিএফ রেডি করে দীপ্তি ওকে সেই এক ঘন্টা আগে মেল্ করে দিয়েছে | কৃষ্ণেন্দু সেটা এখন দেখতে পেলো ! ও আলতো একটা হাসি নিয়েই বলে উঠলো এবার , ——— ” এখন বুঝতে পারছি ! এই জন্য সারা রাত তোর ঘরে আলো জ্বলছিল কাল ! তুই তার মানে রাত জেগে রিপোর্ট তৈরী করছিলিস ! আর এতকিছুর পরও সকালবেলা আমার জন্য নিশ্চয়ই উপোস করে পুজো দিয়েছিস ? আর কেকটা যে নিজে বানিয়েছিলিস সেটা তো খেয়েই বুঝেছি | এতো কিছু এরেঞ্জমেন্টস করলি তুই ! কেন এতকিছু করিস আমার জন্য বল তো ? ”
দীপ্তি এই এতো প্রশ্নের উত্তরে অন্য একটা কথা বলে উঠলো অল্প হেসে এখন , ———– ” জানি না | পরে কোনো একদিন ভেবে বলবো | কিন্তু এবার ওষুধগুলো খেয়ে নাও ? প্লিজ !”
না , এরপর আর ওষুধগুলোর দিকে তাকিয়ে না বলতে পারেনি কৃষ্ণেন্দু | চুপচাপ অর্ডারটা ফলো করেছিল ব্যাস | তবে সেই মুহূর্তে নিস্পলক দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড দীপ্তির দিকে না তাকিয়েও আর থাকতে পারলো না কৃষ্ণেন্দু ! এই মেয়েটা যে কি করে ওর কিছু না বলতেই ওর সব দরকার অদরকারের কথা জেনে যায় কে জানে ! এই প্রজেক্টটা আসলে খুব ইম্পর্টেন্ট ছিল প্রথম থেকেই ওদের জন্য | ছোট প্রজেক্ট হলেও সাকসেসফুলি ইন টাইম লোয়েস্ট বাজেটে কমপ্লিট করেছে কৃষ্ণেন্দুদের টিম এটা | হয়তো কালকের প্রেসেন্টেশনের পর এই ‘আগারওয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ’ এর কাছ থেকে তাই আরও বড়ো প্রজেক্ট গ্র্যাব করতে পারবে ওরা ! রিসেন্টলি শুনেছে আগারওয়ালদের হলদিয়ায় নতুন একটা ফ্যাক্টারীর ওয়ার্কার্সদের জন্য দশ হাজার শার্টের অর্ডার আছে | যদি ওই অর্ডারটা কৃষ্ণেন্দুরা পেতে পারে , তাহলে হয়তো আর কিছুটা স্টেপ এগিয়ে যাবে কোম্পানি ! এইসবই ভাবছিলো আনমনে | তবে তখনি হঠাৎ এই এলোমেলো ভাবনার ভিড়ে দীপ্তিকে দেখে ওর অন্য একটা কথা মনে পড়ে গেলো | তাই একটু মজা করেই কথাটা জিজ্ঞাসা করে উঠলো এখন কৃষ্ণেন্দু, ———— ” আচ্ছা , প্রজেক্ট রিপোর্ট তো বুঝলাম | কিন্তু এইবার জন্মদিনে কোনো গিফ্ট দিলি না তো আমাকে ! না কি কেকটাই গিফ্ট ?”
কথাটা শুনে দীপ্তির মুখে হালকা হাসি | ও একটু আস্তে গলায় এবার বলে উঠলো , ———– ” টেবিলের ড্রয়ারটা একবার খুলে দেখো ? হয়তো আরেকটা নতুন কিছু খুঁজে পেলে !”
কৃষ্ণেন্দু এবার সত্যি অবাক হয়ে গেলো ! আরেকটা সারপ্রাইজ না কি ! কথাটা ভেবেই ও ওর বইয়ের টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে থমকে গেলো হঠাৎ ! সেই অনেকদিন আগের পছন্দ করা রিস্ট ওয়াচটা এখানে এলো কি করে ! প্রায় তিন চার মাস আগে শপিং মলে গিয়ে এই ঘড়িটা দূরে ডিসপ্লেতে দেখে খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো ওর | দীপ্তিও ছিল সঙ্গে | তাহলে কি সেই কথাটা মনে রেখেই খুঁজে খুঁজে এই ঘড়িটা এনে হাজির করেছে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও ঘড়িটা হাতে নিয়ে এবার আনমনে বলে উঠলো , ———- ” স্পিচলেস ! কি করে এতো কিছু মনে রাখিস তুই আমার ব্যাপারে ! এইভাবে তো আমারও নিজের ব্যাপারে কোনো কিছু মনে থাকে না ! সত্যি !”
দীপ্তির মুখে এবার চওড়া হাসি | ঠিক এই এক্সপ্রেশনটাই দেখতে ও খুব ভালোবাসে কৃষ্ণেন্দুর মুখে | একটা অদ্ভুত অবাক হয়ে যাওয়া বাচ্চা ছেলের মতন মুখটা হয়ে যায় ছেলেটার এরকম সময়ে | যাইহোক , তবে চুপচাপ তো আর এই এক্সপ্রেশনের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না | তাই একটু ভেবে বলে উঠলো , ———– ” আসলে আমি সেইদিনই কিনে নিয়েছিলাম ঘড়িটা | বলিনি তোমাকে | রেখে দিয়েছিলাম আজকের জন্য | পছন্দ হয়েছে তো ?”
কৃষ্ণেন্দুর মুখে এবার মিষ্টি একটা হাসি | ও আর এক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে উত্তর দিলো , ——– ” খুউউব পছন্দ হয়েছে | বেস্ট গিফ্ট এটা |”
দীপ্তির মুখেও এই মুহূর্তে হাসি | হয়তো এই উত্তরটার অপেক্ষায়ই বসেছিল আজ সারাদিন ধরে | এখন দিনটাকে কমপ্লিট বলে মনে হচ্ছে | আসলে এই ছেলেটার এই হাসি মুখটা খুব দামি দীপ্তির কাছে | কবে থেকে এরকমটা হলো সেটা ওর নিজেরই ঠিক ভালোভাবে মনে নেই ! কৃষ্ণেন্দু যেদিন সব হারিয়ে ওদের বাড়িতে প্রথম এসেছিলো , হয়তো তখন থেকেই ! না কি এতো বছর ধরে একসঙ্গে থাকতে থাকতে , খারাপ ভালো সময় আর মুহূর্তের ভিড়ে , দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুর জন্য ভাবতে শুরু করেছে মন থেকে ! সেই দিনক্ষণের হিসাব ও নিজেও ঠিকভাবে জানে না | তবে শুধু এইটুকু জানে , এই ছেলেটা ওর সমস্তটা জুড়ে আছে | ও ভালো থাকলেই দীপ্তি ভালো থাকে | ও হাসলেই দীপ্তির মুখে আপনাআপনিই বিনা কারণে হাসি চলে আসে | ওর মন খারাপ হলে দীপ্তির চারিদিকটাও কেমন অন্ধকার হয়ে যায় না চাইতেই | যদিও এতো কথা শুধু ভাবনার আড়ালেই থেকে গেছে মনে , বছরের পর বছর ধরে | শব্দ দিয়ে সাজিয়ে কখনো বলে উঠতে পারেনি কৃষ্ণেন্দুকে এতকিছু | তবে হয়তো কিছু না বলেও বুঝিয়ে দিয়েছে নিজের মনটাকে রোজ ! আর কৃষ্ণেন্দু তো ওকে ওর মতন করে চেনে | তাহলে হয়তো ওর না বলা শব্দগুলোকেও বোঝে , নিঃশব্দে ! তাই তো দীপ্তিকে কেমন আগলে আগলে রাখতে চায় নিজের কাছে | রোজের মতন একই প্রশ্ন করে ওঠে বার বার , ———– ” যদি কখনোও কোনো ভুল হয়ে যায় , ছেড়ে চলে যাবি না তো ? থাকবি তো আমার সঙ্গে এইভাবে ?”
আজকেও যেমন এই গিফ্টটা হাতে নিয়ে এই একই প্রশ্ন করে উঠলো ছেলেটা আনমনে ! আর দীপ্তিও ওর সেই চেনা উত্তরটাই দিলো একই রকমভাবে এই মুহূর্তে ,
———- ” তুমি ভুল করার মতন মানুষ না , বুঝলে | তাই ছেড়ে যাওয়ারও কোনো প্রশ্ন আসে না | যাইহোক ঘুমিয়ে পড়ো এবার | আসলাম |”
কথাটা বলে আজও না বলা কথাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে দীপ্তি চলে গেলো ঘরটা খালি করে কৃষ্ণেন্দুর| তবে অদ্ভুত একটা ভালো লাগার রেশ রয়েই গেলো ওর মনে এই মুহূর্তে | কৃষ্ণেন্দুকে ভালোবাসার যেই রেশটা সারাক্ষন থাকে নিজের সঙ্গে ! অকারণেই |
চলবে।