অন্য বসন্ত পর্ব-০৬

0
48

#অন্য_বসন্ত ( ষষ্ঠ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
সেই ঘটনার পর দুটো দিন কেটে গেছে এরপর | এখন ঘড়িতে রাত পৌনে একটা বেজে গেছে | দীপ্তি তা ও জেগে বসে আছে নিজের ঘরে | কৃষ্ণেন্দু এখনো ফেরেনি অফিস থেকে | মা ও এই নিয়ে চিন্তা করছিলো অনেকক্ষণ ধরেই | মোবাইলে কলও করেছিল বেশ কিছুবার ওকে | তবে ফোনটা অধরাই থেকে গেছে | না , দীপ্তি ওর মায়ের মতন কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করে উঠতে পারেনি ! এখন যেরকম সম্পর্ক এসে দাঁড়িয়েছে ওদের , সেখানে ফোন কল হয়তো আর সম্ভব না নিজে থেকে | তবে ও মা কে চিন্তা করতে বেশি না দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘুমের একটা হালকা ডোজের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে | আসলে আলো তো হাইপার টেনশনের পেশেন্ট | তাই দীপ্তির ভয় হয় সব সময় মা কে নিয়ে | সেদিনের মতন কিছু না হয়ে যায় আবার একটা | তাই ইচ্ছে করে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে মা কে | কাল সকালে কৃষ্ণেন্দুকে দেখলে সব ঠিক হয়ে যাবে | কিন্তু মা কে যতই বোঝাক , ঘুম পারাক , কিন্তু কৃষ্ণেন্দু যতক্ষণ না ফিরছে ওর নিজের তো কিছুতেই শান্তি হচ্ছে না | অফিসে ফোন করেছিল এর মধ্যে দুবার | কিন্তু কৃষ্ণেন্দু না কি আজ রাত আটটায় বেরিয়ে গেছে অফিস থেকে | তাহলে এতক্ষন কি করছে ও ! দীপ্তি ঠিক বুঝতে পারছিলো না | ও নিজে আজকের স্কেডিউল ফিক্সড করেছিল কৃষ্ণেন্দুর | কোনো আলাদা মিটিং , কিছুই তো ছিল না আজ ! তাহলে কোথায় কৃষ্ণেন্দু ! প্রশ্নটা বার বার মনে এসে ভিড় করছিলো | আর অদ্ভুত একটা চিন্তা হচ্ছিলো ওর | ঠিক আছে তো ছেলেটা ! অনেকদিন তো ভালো করে কথাও হয় না ! ওর শরীর ঠিক আছে তো ! নার্ভের ওষুধগুলো ঠিকভাবে খাচ্ছে তো আজকাল ! এইসবই ভাবছিলো আনমনে , তখনই হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ কানে এলো | দীপ্তি হঠাৎ যেন চিন্তাটা থেকে বেরিয়ে এলো কৃষ্ণেন্দুর | যাক , তার মানে এসে গেছে | ভেবেই একটা হাসি এসে জমা হলো মুখে | আজ দীপ্তি আরেকবার চেষ্টা করবে কৃষ্ণেন্দুর সাথে কথা বলার | নিজে খাবার সাজিয়ে খেতে দেবে ওকে | যদি এইভাবে একটু চেষ্টা করে সব ঠিক হয় ! আগের মতন হয় ! এইসব ভেবেই ও নিচে নামলো দরজা খোলার জন্য | কিন্তু তার আগেই হরি এসে দরজাটা খুলে দিয়েছে কৃষ্ণেন্দুকে | কিন্তু কৃষ্ণেন্দু ড্রইং রুমে আসতেই দীপ্তির ওকে দেখে পা টা থমকে গেলো হঠাৎ | সমস্ত ভাবনাগুলো এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো মনে | কৃষ্ণেন্দু যে এইভাবে ওর সামনে এসে দাঁড়াবে ও কোনোদিনও ভাবেনি স্বপ্নেও | আজ এই ছেলেটার পা টলছে , নেশায় এমনভাবে চুর হয়ে আছে ও , যে ঠিকভাবে দাঁড়াতেও পারছে না নিজে | তৃষার কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে আজ | দীপ্তি এইসব দেখে কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছিলো না | কৃষ্ণেন্দু এইরকম ড্রিংক করে জীবনে প্রথম বাড়ি ফিরলো | তা ও একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে | এরপর আর কি বাকি থাকতে পারে ! এইসব ভেবেই ড্রইংরুমে দাঁড়িয়েছিল কয়েক মিনিট ও | এর মধ্যে তৃষা আর হরি মিলে কৃষ্ণেন্দুকে ওর ঘরে শুইয়ে এসেছে | তারপর তৃষা ওর চোখের সামনে দিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিলো | কিন্তু দীপ্তি এই মুহূর্তে আর চুপ থাকলো না | ও তৃষাকে থামিয়ে দিয়ে এই প্রথম নিজে থেকে বলে উঠলো কিছু | তৃষাও ভাবেনি , দীপ্তি ওকে এইভাবে ডিরেক্ট প্রশ্ন করতে পারে | তাই একটু অবাক হয়েছিল যখন দীপ্তির গলার আওয়াজ পেছন থেকে কানে এসেছিলো ওর ,
——— ” তোমরা কোথায় ছিলে এতক্ষন ? কৃষ্ণেন্দুকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে তুমি ?”
তৃষা প্রশ্নগুলো শুনে ফিরে তাকিয়ে দীপ্তিকে এক কথায় উত্তর দিয়েছিলো এবার , ———— ” নাইটক্লাবে গিয়েছিলাম | কেন ? এনি প্রব্লেম ?”
দীপ্তি এবার তৃষার খুব কাছে এসে ওকে উত্তরটা দিয়েছিলো | দৃঢ় অথচ শান্ত গলায় বলেছিলো , ———– ” প্রব্লেম নেই আমার কোনো | তবে তুমি যেই হারে কৃষ্ণেন্দুকে বদলে দিচ্ছ , যেইভাবে ওর ঠিক ভুল গুলোকে ওলোট পালট করে দিচ্ছ , ওকে দিনের পর দিন নিজের মতন বানিয়ে ফেলছো , তাতে আমার মনে হয় কৃষ্ণেন্দুর একদিন হঠাৎ নিজেকে আয়নায় দেখে ভীষণ প্রব্লেম হবে | ও আর চিনতে পারবে না নিজেকে | মেলাতে পারবে না ওই পুরোনো ছেলেটার সাথে | শেষ হয়ে যাবে ও | ”
দীপ্তির কথাগুলো শুনে তৃষা এবার হালকা হাসলো যেন আপনাআপনি | তারপর একটু অবাক হয়ে বললো , ——— ” তুমি সত্যি এম.বি.এ পড়েছো?দেখে মনে হয় না জানো | কিরকম সোশ্যিওলজির স্টুডেন্ট লাগে | আর খেলাটা একদম ভালোভাবে খেলতে জানো না তুমি | শুরু থেকে তো আমি একতরফাই খেলে গেলাম ! আর পর পর জিতেও যাচ্ছি | কৃষেন্দু দেখো , আজকাল ঠিক আমার মতন করে ভাবে | ইনফ্যাক্ট , আমি যা চাই , যেভাবে চাই , সেইভাবেই ভাবে | আর চিন্তা কোরো না | ওর হঠাৎ করে কোনো একদিন নিজেকে আয়নায় দেখে একদম কোনো প্রব্লেম হবে না জানো | কারণ কৃষ্ণেন্দু নিজের ‘পুরোনো আমি’ টা কে ততদিনে একেবারেই ভুলে যাবে | আর সেই গ্যারান্টি আজ আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম | এনিওয়েজ , গুড নাইট … আসি আজ |
ওহ , আর হ্যাঁ , আরেকটা কথা , সবাইকে সব সময় নিজের মতন ভেবো না | যার কোনো এম্বিশন নেই , গোল নেই লাইফে | যে একটা বোকা বোকা ফিলিংসের জন্য দিনের পর দিন একটা অফিসে একজন সাধারণ পি.এ হয়ে কাটিয়ে দিতে পারে ! কৃষ্ণেন্দু তোমার মতন না | ও নিজের জন্য সব সময় বেস্ট টা চায় | সবার ওপরে থাকতে চায় | আর সিলি ইমোশনকে বাদ দিয়ে বিজনেসটাকে বোঝে | আমি তো শুধু ওকে একটু গাইড করছি , আর একটু বেশি ভালো বিজনেসম্যান হওয়ার জন্য | মানবিকতার লেকচারটা আসলে ঠিক আসে না আমার | যাইহোক , বাই … ”
কথাটা বলেই তৃষা সেদিন চলে গেছিলো দীপ্তির সামনে থেকে | তবে দীপ্তি ওকে মুখে কোনো উত্তর না দিলেও এটা মনে মনে জানতো, যে একদিন সময় ঠিক উত্তরটা দিয়ে দেবে | তবে সেইদিন সব থেকে বেশি খারাপ লাগবে কৃষ্ণেন্দুর | নিজের অচেনা একটা রূপ দেখে হয়তো আঁতকে উঠবে ও | মেলাতে পারবে না নিজেকে একদম ! এই এতো বড়ো পৃথিবীতে হয়তো একা হয়ে যাবে ভীষণ | নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন কৃষ্ণেন্দুর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে দেখতে আজ দীপ্তির ঠিক এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিলো কেমন ! হাসি পাচ্ছিলো ভীষণ নিজের বোকামির ওপর | কি ভেবেছিলো আজ ও ! আরেকবার চেষ্টা করবে ! আরেকবার ওদের দুজনের জন্য ও কৃষ্ণেন্দুর সাথে কথা বলবে ! একসঙ্গে ডিনার করবে ! আরেকবার ! হয়তো সেই আরেকবারের আর কোনো সুযোগ নেই ওদের দুজনের মাঝে | হয়তো এখন শেষটুকুই বাকি আছে ব্যাস | দীপ্তি নিঃশব্দ ঘরে অন্ধকারের ভিড়ে চুপচাপ একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন অপেক্ষা করছিলো আজ , সেই শেষটা দেখার |

কখনো কখনো ভাবনার সঙ্গে জীবনটা মিলে যায় অদ্ভুতভাবে | দীপ্তি সেইদিন রাত্রে যেই শেষটার জন্য অপেক্ষা করছিলো চুপচাপ , সেই শেষটা হতে আর বেশি দেরি লাগলো না | আজ একুশে আগস্ট | অনেক বছর আগে এই দিনেই কৃষ্ণেন্দুর বাবা এই কোম্পানির ইনগ্রেশন করেছিল | আজ তাই খুব বড়ো একটা পার্টির ব্যবস্থা করেছে কৃষ্ণেন্দু | যদিও এই পার্টির ভেনু ডিসাইড থেকে , ডেকরেশন , ফুড , সব কিছুই তৃষা নিজের পছন্দ মতন এরেঞ্জ করেছে | দীপ্তি সাতদিন ধরে এইসব আয়োজনই দেখছিলো কিছু না বলে | তবে এইসবের মধ্যে একটা ব্যাপার সব থেকে বেশি যেটা চোখে লেগেছিলো ওর , যে এই পার্টির গেস্ট লিস্টে পরিতোষ জেঠু , নির্মাল্য জেঠুদের মতন কোনো এক্স এমপ্লয়িদের নাম নেই | যদিও এই কোম্পানিটা আজ ওদের জন্যই টিকে আছে | তা ও কেউ একবারও প্রয়োজন মনে করলো না আজকের দিনে ওদের একবার মনে করার, সামান্য সম্মানটুকু দেখানোর ! তবে দীপ্তি এই নিয়ে আর কাউকে কিছু বলতে যায়নি | এদের কাছে পুরোনোদের দাম নেই , এটা দীপ্তি বহুদিন আগে থেকেই বুঝে গেছে | আর কিছুদিন বাদে হয়তো দীপ্তি নিজেই এই পুরোনোদের লিস্টে নিজের নামটা লিখিয়ে নেবে ! আর আজকাল এই কোম্পানিতে ও একজন আউট সাইডার ছাড়া আর তো কিছুই নয় ! বিশ্বাস হয় না নিজেরই যে একটা সময় দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে রাত জেগে জেগে প্রেজেন্টেশন তৈরী করতো , সুতোর কোয়ালিটি থেকে মার্কেটিং , ছোট বড়ো সব ব্যাপারে কৃষ্ণেন্দু ওর সঙ্গে আলোচনা করে ডিসিশন নিতো ! আর এখন , কৃষ্ণেন্দুর কাছে দীপ্তি হলো একজন ইমোশনাল , বেহিসেবি মানুষ | যে বিজনেসের কিছুই বোঝে না ! যার কথা শুনলে এই বাজারে টিকে থাকা যাবে না | কথাগুলো ভেবে এই মুহূর্তে আনমনে একটা কষ্টের হাসি চলে এলো হঠাৎ মুখে | দীপ্তি কতগুলো পুরোনো গল্পের বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে এখন | সন্ধ্যের সময় পার্টি শুরু হয়ে যাবে | কিন্তু তাতে ওর কি ! দীপ্তি আজ বাড়িতে থাকবে | আর ওকে তো কেউ একবারও আলাদা করে পার্টিতে যাওয়ার কথা বলেনি ! তবে একদিকে না বলে ভালোই হয়েছে | এইসব জায়গায় মেকি লোকেদের সংখ্যা খুব বেশি | আর দীপ্তি না ড্রিংক করে , না তাদের মতন ফ্যাশনেবল ড্রেস পড়তে পারে , না বিদেশী একসেন্টে সাজিয়ে গুছিয়ে বাংলা বলতে পারে ! এইসব জায়গায় ওর মতন সাধারণ , মধ্যবিত্তর তকমা লাগা , একটু সেকেলে মানুষের খুব প্রয়োজন নেই | এইসব ভেবেই বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছিলো | তখনই হঠাৎ দরজায় টোকা | দীপ্তি চোখ ফেরাতেই কৃষ্ণেন্দুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো | ও হঠাৎ এই ঘরে কি করছে ! আজকে তো আরো সময় থাকার কথা না | এইসবই ভাবছিলো ছেলেটাকে দেখে , তখন কৃষ্ণেন্দু নিজে থেকেই বলে উঠলো , ————- ” কি করছিস তুই ? রেডি হোসনি কেন ? যাবি না পার্টিতে ?”
দীপ্তি কথাটা শুনে দু সেকেন্ড ভেবে উত্তর দিলো , ———— ” কেন ? কোনো কাজ আছে ?”
কৃষ্ণেন্দু এইরকম প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলো হঠাৎ ! তারপর কিছু না ভেবেই বলে উঠলো , ———- ” তোর কি মনে হয় , শুধু দরকার হলেই মনে করি তোকে ? ”
দীপ্তি এর উত্তরে হালকা হেসে বললো , ———— ” দরকারটাই তো আজকাল আর হয় না তোমার আমাকে ! এই বাড়িতে মাঝে মাঝে নিজেকে একটা ফার্নিচারের মতন লাগে | আর অফিসে তো এমনিও এখন আমার কথার দাম নেই বিশেষ | যাইহোক , কাজ না থাকলে আমার তোমাদের পার্টিতে না গেলেও চলবে | অনেকে আছে | যারা এখন খুব ইম্পর্টেন্ট | তাদের থাকাটাই আসল |”
কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো লাগলো হঠাৎ একটু | দীপ্তিকে এই পার্টির ব্যাপারে আসলে কিছুই এতদিন বলা হয়নি | আসলে তৃষা নিজে দ্বায়িত্ব নিয়ে সব এরেঞ্জমেন্ট করছে | ও কারোর ইন্টারফিয়ারেন্স চায় না | আর তৃষার বিজনেস ডিসিশনগুলো এই কোম্পানিকে এতটা প্রফিট এনে দিয়েছে ! যে আজকাল কৃষ্ণেন্দু ওকে কিছুতেই মুখের ওপর না বলতে পারে না | তবে দীপ্তিকে আজকের সন্ধ্যেতেও এইভাবে দূরে থাকতে দেখে কিরকম খারাপ লাগছে ওর ! মনে হচ্ছে এই নিঃস্তব্ধতার আড়ালে হয়তো পুরোনো সব কিছুই কিরকম শেষ হয়ে যাচ্ছে ওদের | তাই আজ বিকেলবেলা গিয়ে নিজে পছন্দ করে শাড়ি কিনে এনেছে একটা | দীপ্তি প্রথমে খেয়াল করেনি ওর হাতের প্যাকেটটা | এই কথাগুলো বলে হঠাৎ চোখে পড়লো ওর | তবে দীপ্তির কিছু বলার আগেই এবার কৃষ্ণেন্দু বলে উঠলো ,
————– ” তুই একটা সময় আমার সঙ্গে ভীষণভাবে ছিলিস | জানি , এখন আমার সঙ্গে তোর থিঙ্কিং , পয়েন্ট অফ ভিউ মেলে না বিশেষ | তোর ঠিক আর আমার ঠিকগুলো আলাদাই আজকাল | কিন্তু এটাও সত্যি , এই কোম্পানিটা আজ যেই জায়গায় , সেটার জন্য তোরও অনেক পরিশ্রম , রাত জাগা ছিল একটা সময়ের | আমি তোকে জোর করবো না আজ , তবে রিকুয়েস্ট করবো , এই ‘সেন টেক্সটাইলের’ জন্য আসিস আজ পার্টিতে , আমার সঙ্গে | আর এই শাড়িটা তোর জন্য এনেছিলাম | যদি ভালো লাগে , তাহলে এটা পড়েই আসিস |”
কথাটা শেষ করে কৃষ্ণেন্দু দীপ্তির সামনে শাড়িটা রেখে চলে গেলো এই মুহূর্তে | কিন্তু দীপ্তি কিছুতেই আর কোনো উত্তর দিতে পারলো না ওকে ! পুরোনো টান , পুরোনো ভালোবাসা এসে ঘিরে ধরলো আরেকবার দীপ্তিকে | আজও ‘না’ বলতে পারলো না ও | কৃষ্ণেন্দুর জন্য দিনটা সত্যি খুব বড়ো | তাই দীপ্তি শুধুমাত্র এই ছেলেটার মন রাখতে যাবে আজ পার্টিতে |পড়বে ওর কিনে দেয়া শাড়ি | আসলে ভালোবাসলে হয়তো এইরকমই হয় | যতই নিজের চারিদিকে ভীষণ শক্ত দেয়াল তুলে রাখা হোক না কেন , সেটায় সারাক্ষন আটকে থাকা যায় না | দীপ্তি তাই অনেকদিন বাদে আবার সাজলো কৃষ্ণেন্দুর জন্য | ভাঙা মন নিয়ে নতুনভাবে শুরু করার চেষ্টা করলো আরেকবার |

সেদিন এরপর কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গেই এসেছিলো দীপ্তি পার্টিতে | তবে বাড়ি থেকে ভেনু অব্দি পুরো রাস্তাটাই কিরকম চুপচাপ , কথাহীনভাবে কেটে গেলো দুজনের ! দীপ্তির এটা ভেবে অবাক লাগে মাঝে মাঝে , যে একটা সময় এরকমও ছিল , যখন ওদের মধ্যে এতো কথা , এতো গল্প ছিল , যে রাস্তাটা কখন শেষ হয়ে যেত ! বুঝতেই পারতো না কেউ | আর আজ এই রাস্তাটা যেন অন্তহীন বলে মনে হচ্ছে কেমন | দীপ্তির এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই সেদিন ওরা এসে হাজির হয়েছিল পার্টিতে | ফাইভ ষ্টার হোটেলের রুফ টপে তৃষা এরেঞ্জ করেছিল পার্টিটা | চারিদিকে ঝলমলে আলো , ওয়েটারদের ভিড় , ড্রিঙ্কস এর জন্য আলাদা একটা সেকশন , ওয়াইন শ্যাম্পেনের হালকা একটা গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে, তার মধ্যে দীপ্তির নিজেকে কিরকম আলাদা , একা মনে হচ্ছিলো আজ | মনে হচ্ছিলো এটা কি সত্যি ওর জায়গা ! কিসের জন্য এসেছে আজ এখানে ! কৃষ্ণেন্দু , এই অফিস , কোনো কিছুই কি আর ওর নিজের আছে ! এইসব ভাবনার ভিড়ে একটা কোনায় সবার থেকে আলাদা নিজের মতন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কেটে যাচ্ছিলো সন্ধ্যেটা | এর মধ্যে একবার অনিকেতের সাথে দেখা হয়েছিল ওর | একটু হাসি , গল্প হয়েছে কয়েক মিনিট | তবে আজ কি জানি কেন , কিছুতেই আর জোর করেও খুব কথা আসছে না ওর কারোর সঙ্গে | কিছু একটা ভেতর থেকে খুব লাগছে যেন ! ভাঙা কাঁচের টুকরোটা বিঁধছে ভীষণ মাঝে মাঝেই | কৃষ্ণেন্দুকে যখন তৃষার সঙ্গে হাসতে , কথা বলতে , আলাদা হয়ে যেতে দেখছে ভিড়ের মধ্যে , তখন মনে হচ্ছে এখানে ওর জায়গাটা কোথায় ! কেন নিজের ডিসিশনটা চেঞ্জ করে এলো আজ এখানে ! নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে এখন | এইসবের মধ্যেই ঘড়ির কাঁটাটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিলো সেদিন | তবে মিনিট সেকেন্ডটা হঠাৎ থমকে গেলো একটা ঘটনার পর | দীপ্তি সেদিন চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়েছিল নিজের মতন প্রথম থেকে | তবে কিছুক্ষন পরই পার্টিতে ডান্স শুরু হলো | অনেকেই ডান্স ফ্লোরে গিয়ে মিউজিকের তালে পা মেলাতে শুরু করলো আস্তে আস্তে | তবে এই সময়েই হঠাৎ একটা ঘোলা চোখ যে অনেক্ষন ধরে দীপ্তিকে দূর থেকে দেখছিলো মন দিয়ে , সেটা দীপ্তি খেয়াল করেনি একদম | কিন্তু সেই ঘোলা চোখের মানুষটা যখন মদের নেশায় টলতে টলতে হঠাৎ দীপ্তির কাছে এসে হাজির হলো , তখন দীপ্তির সম্ভিত ফিরলো | মিস্টার ভট্টাচারিয়া না ! লোকটার বয়স প্রায় ষাট তো হবেই | লাস্ট এক বছর ধরে ওদের রেগুলার ক্লায়েন্ট | তৃষার রিলেটিভও হয় মনে হয় দূর সম্পর্কের ! কিন্তু লোকটা হঠাৎ ওর দিকে এইভাবে এগিয়ে আসছে কেন ! বুঝতে পারছিলো না দীপ্তি | কিন্তু বুঝলো খুব পরিষ্কার ভাবে , যখন লোকটা হঠাৎ ওর খুব কাছে এসে আচমকা কিছু না বলেই ওর কোমড়টা ধরে নিলে শক্ত করে | আঙ্গুল দিয়ে সাপের মতন ওর কোমড়ে হাত বোলাতে শুরু করলো নিজে থেকে | ঘোলাটে নোংরা চোখ দিয়ে ওর শরীরটাকে মাপতে শুরু করলো নির্লজ্জভাবে | দীপ্তি যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো অদ্ভুত একটা ভয়ে | একটা লজ্জা , অস্বস্তি , জড়তা এসে ঘিরে ধরেছিলো ওকে | গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না কোনো এই নোংরা স্পর্শটাকে ফিল করে | তা ও কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে সামলে দীপ্তি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে উঠলো , ———- ” প্লিজ , কি করছেন কি আপনি ? ছাড়ুন আমাকে !”
মিস্টার ভট্টাচারিয়া ওর জোর করে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টাটায় সাড়া না দিয়ে এবার দু হাত দিয়ে দীপ্তিকে জাপ্টে ধরলো হঠাৎ | ওর ভারী শরীরটা দীপ্তির ওপর ফেলে দিলো যেন | দীপ্তি ওই শরীরটার ভারে ছটফট করতে শুরু করলো | চারিদিকের আঁধো অন্ধকার পার্টি লাইটে মনে হচ্ছিলো হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও| মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে | আর ওর আশেপাশের লোকজন নিজেদের নিয়ে এতোই মত্ত যে দীপ্তির এই হারিয়ে যাওয়াটা কেউ খেয়ালই করছে না | ওর দম বন্ধ হয়ে যাওয়া শরীরটাকে কেউ নোটিশই করছে না বিশেষ | দীপ্তি তাও গলার জোর বাড়িয়ে হাঁসফাঁস করতে করতেই বলে উঠলো আরেকবার , ———— ” কি করছেন আপনি ! ছাড়ুন আমাকে | ছাড়ুন বলছি |”
যদিও চারিদিকে এতো লাউড মিউজিক বাজছিলো যে চিৎকারটা আশেপাশের কেউই বিশেষ শোনেনি | আর এই সময় দীপ্তির কথাটাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে মিস্টার ভট্টাচারিয়া মদের নেশা জড়ানো গলায় বলে উঠলো , ———- ” লেটস ডান্স বেবি .. এনজয় দ্যা পার্টি .. এন্ড লেট্ মি এনজয় ইয়োর বডি টু … ”
দীপ্তি এই কথাটা শুনে যেন ভেতর থেকে কেঁপে উঠলো | দম বন্ধ হয়ে গেলেও মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে নিজের ওপর থেকে সরানোর জন্য ওই আঁধো অন্ধকারের মধ্যে ও প্রাণপন চেষ্টা করতে থাকলো | ভয় , ঘেন্নায় গলার আওয়াজটা বুজে এলো ওর | এই সময়েই হঠাৎ কেউ যেন মিস্টার ভট্টাচারিয়ার কলারটা ধরে আচমকা ওকে দীপ্তির ওপর থেকে টেনে নিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো ফ্লোরের মধ্যে | দীপ্তি দু সেকেন্ডের ভিড়ে নিজের ঘোরটা কাটিয়ে দেখলো ওর সামনে অনিকেত দাঁড়িয়ে আছে | রাগে মুখটা লাল হয়ে আছে ওর | তার মানে অনিকেতই ঠিক সময়ে এসে আজ ওকে আবার হেল্প করলো ! এতো বড়ো একটা বিপদ থেকে বাঁচালো ওকে ! কথাটা ভাবতেই তৃষার গলার আওয়াজ হঠাৎ কানে এলো | ও প্রায় চিৎকার করতে করতে ওদের সামনে এসে হাজির হয়েছে | মদের নেশায় টোলে পড়া মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে ফ্লোর থেকে তুলতে তুলতে ও বলে উঠলো অনিকেতকে ঝাঁঝালো ভাবে , ———— ” হাও ডেয়ার ইউ .. কি করে করলে তুমি এটা ? এতো সাহস তোমার ! আমাদের কোম্পানির একজন এতো বড়ো ক্লাইন্টকে তুমি এইভাবে ইনসাল্ট করলে !”
অনিকেত কথাটা শুনে দৃঢ় অথচ শান্ত গলায়ই বললো , ———– ” এই লোকটা যত বড়োই ক্লাইন্ট হোক না কেন ! ভীষণ নোংরা একজন মানুষ | দীপ্তির সাথে উনি অসভ্যতামি করছিলেন | আমি নিজে দেখেছি |”
অনিকেতের কথাটা মিস্টার ভট্টাচারিয়ার কানে আসতেই উনি হঠাৎ ভালো মানুষ সেজে বেশ প্রোটেস্ট করে বলে উঠলেন , ——– ” কে বললো এইসব ! আই জাস্ট আস্কড হার ফর এ ডান্স .. এটা অসভ্যতা !”
কথাটা শুনে অনিকেত এবার বেশ রাগের গলায়ই বলে উঠলো , ———- ” একদম মিথ্যা বলবেন না | আমি খুব ভালোভাবে দেখেছি আপনি ঠিক কি করছিলেন এতক্ষন !”
তবে অনিকেতের কথাটা শেষ হতেই তৃষা আবার সেই ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো , ———- ” তুমি দীপ্তির চোখে হিরো সাজার জন্য এইসব নাটক করছো পার্টিতে ! আমাদের এতো বড়ো একজন ক্লাইন্ট কে তুমি ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে ? লোয়ার ক্লাস হলে আসলে যা হয় | কখনো এইরকম পার্টিতে আসোনি | জানোই না এখানে কি হয় ! আর ডান্স করতে জিজ্ঞাসা করাকে কোনো অসভ্যতা করা বলে না | বুঝেছো |”
তৃষার কথাগুলো যেন ভেতর থেকে লাগলো দীপ্তির এই মুহূর্তে | ও লাস্টে ক্লাস তুলে কথা বললো ! আর অনিকেত আজ যা করেছে , সব দীপ্তির জন্য করেছে | তাও ওকে এইভাবে সবার সামনে অপমানিত হতে হচ্ছে ! কথাটা ভেবেই দীপ্তি আর চুপ থাকলো না | সমস্ত থমকে থাকা ভিড়ের মধ্যে এবার দৃঢ় গলায় বলে উঠলো তৃষাকে , ———— ” শুধু ডান্স এর জন্য জিজ্ঞাসা করাকে যে অসভ্যতা বলে না , এটা বোঝার সেন্স সব ক্লাসেরই থাকে | উনি তার থেকে অনেক বেশি কিছু করেছেন | আর আজ যদি অনিকেত না থাকতো , হয়তো আমার সাথে খুব খারাপ কিছু একটা হয়ে যেত |”
দীপ্তির কথাটাকে তৃষা বিশেষ পাত্তা না দিয়েই বললো এবার , ——— ” প্লিজ .. ক্লাস তো তোমারও নেই | একটা সিম্পল জিনিসকে তাই হ্যান্ডেল করতে পারো না ! আসলে কখনো আসোনি এইরকম পার্টিতে ! জানবে কি করে ! হুট্ করে একটা ভালো হাই স্ট্যান্ডার্ডের ছেলেকে পটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ , তার বাড়িতে থাকছো ! তবে এইসব করেও তো আর নিজের মিডলক্লাস নেচারটাকে ভুলতে পারবে না | এটাই তোমার প্রব্লেম আসলে |”
দীপ্তির কথাগুলো শুনে মুখটা যেন অন্ধকার হয়ে এলো সেই মুহূর্তে | লজ্জায় অপমানে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো মাটিতে | ততক্ষনে পার্টিটা কেমন যেন থমকে গেছে | ওদের এই কথা কাটাকাটি দেখতে লোকজন ভিড় জমিয়েছে ওই আলোআঁধারীর মধ্যে | তবে তৃষার কথাগুলো শুনে দীপ্তি কোনো উত্তর দেয়ার মতন অবস্থায় না থাকলেও অনিকেত রাগে লাল হয়ে বলে উঠলো ,
——— ” একদম দীপ্তির সঙ্গে এইভাবে কথা বলবেন না আপনি |কিছুক্ষন আগে যেটা দীপ্তির সাথে হয়েছে সেটা তো আপনার সাথেও হতে পারতো ! আর একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের ক্যারেক্টার এনালাইসিস করতে লজ্জা করছে না আপনার ! এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে আপনি নিজে কি মেন্টালিটির মানুষ | নইলে এই নোংরা লোকটাকে এইভাবে সাপোর্ট করতে পারতেন না ! আপনাদের মতন মানসিকতার লোকজনের জন্যই এই ধরণের লোকেদের সাহস বাড়ে নোংরামো করার | দীপ্তিকে কিছু বলার আগে আপনি নিজেকে ঠিকভাবে আয়নায় দেখে আসুন মিস তৃষা..”
অনিকেত কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো | তবে খেয়াল করেনি ও তখনও যে এই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দু এই ভিড়ের মাঝে এসে হাজির হয়েছে | একটা ইম্পর্টেন্ট ফোন কল এটেন্ড করার জন্য ও রিসেপশনে গেছিলো কিছুক্ষন আগে | তার মাঝে কি হয়েছে হঠাৎ ওর সত্যি জানা ছিল না ! পার্টিতে আবার ফিরে এসেই কৃষ্ণেন্দু দেখলো মিস্টার ভট্টাচারিয়ার এলোমেলো উস্কো খুস্ক চেহারা | আর কানে এলো অনিকেতের শেষ কথাগুলো | ভাবতে পারছে না একজন সাধারণ এমপ্লয়ি হয়ে ও কোথা থেকে এতো সাহস পায় তৃষার সাথে এইভাবে , এই টোনে কথা বলার ! কথাগুলো মনে হতেই কৃষ্ণেন্দুর মাথাটা গরম হয়ে গেলো | কৃষ্ণেন্দু তাই আচমকা ওই ভিড় কাটিয়ে কোনো কিছুর শুরু না জেনেই অনিকেতের ওপর প্রচন্ড চিৎকার করে উঠলো ,
————— ” তোমার এতো বড়ো সাহস ! তুমি আমাদের কোম্পানির একজন ম্যানেজিং হেডের সাথে এইভাবে কথা বলছো ! অনেকদিন তোমার অনেক কিছু সহ্য করেছি আমি | যেহেতু তুমি দীপ্তির বন্ধু | তবে আর না | তোমার মতন অভদ্র , অসভ্য ছেলের কোনো জায়গা নেই আমার কোম্পানিতে | খুব বড়ো ভুল করেছিলাম আমি তোমাকে এপয়েন্ট করে | তবে আর সেই ভুলটা কন্টিনিউ করবো না | এন্ড গেট আউট ফ্রম আওয়ার পার্টি ! রাইট নাও .. ”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো কৃষ্ণেন্দু | এই ভিড়ে ওর এইসব কথা শুনে অনিকেতের মতন দীপ্তিও যেন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড থমকে ! কৃষ্ণেন্দু শেষে অনিকেতের চাকরিটা কেড়ে নিলো ! বিশ্বাস হচ্ছিলো না দীপ্তির | কিন্তু দীপ্তি এই মুহূর্তে চুপ না থেকে জোর গলায় বলে উঠলো কৃষ্ণেন্দুকে , ————- ” তুমি কিছু না জেনে ভুল করছো কৃষ্ণেন্দু | এতক্ষন কি হয়েছে তুমি জানোই না | এই লোকটা , মিস্টার ভট্টাচারিয়া , উনি আমার সাথে নোংড়ামো করছিলো , মলেস্ট করছিলো আমাকে | অনিকেত যদি ঠিক সময়ে ওকে ঠেলে ফেলে না দিতো , তাহলে এটা চালিয়েই যেত উনি | আর এইসব দেখেই তৃষা আমাকে অনিকেতকে উল্টো পাল্টা কথা বলতে শুরু করে | আর সেই জন্যই !”
না , ওর কথাটাকে কমপ্লিট করতে না দিয়েই এবার মিস্টার ভট্টাচারিয়া আর তৃষা একসঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো যেন | মিস্টার ভট্টাচারিয়া রাগি রাগি মুখ করেই বলে উঠলো এবার , ————- ” অনেক্ষন ধরে শুনছি এইসব ফালতু কথা ! সব কিছুর একটা লিমিট আছে | একজন মেয়েকে পার্টিতে এসে ডান্স এর জন্য জিজ্ঞেস করাকে কি মলেস্ট করা বলে ! এইরকম মিডলক্লাস মাইন্ডের লোকজনকে আপনি নিজের পার্টিতে এনেছেন জানলে আমি কখনোই আসতাম না এখানে ! এইভাবে ডেকে অপমান করার কি আছে আমাকে ! আমি আপনাকে কত টাকার প্রফিট দিয়েছি খেয়াল আছে তো মিস্টার কৃষ্ণেন্দু | তারপরেও এই রকম ইনসাল্ট আপনার লোকজন আমাকে করবে ? এইরকম হলে তো আপনাদের সাথে কোনো বিজনেস রিলেশনই রাখা যাবে না !”
মিস্টার ভট্টাচারিয়ার কথাটা শেষ হতেই এবার একই সুরে তৃষাও বলে উঠলো কৃষ্ণেন্দুকে , ———— ” প্লিজ তুমি দীপ্তিকে বোঝাও | অলরেডি যথেষ্ট ইনসাল্ট হয়ে গেছে আমাদের | এরপর এই সিলি রিসনের জন্য বিজনেসের কোনো ক্ষতি হোক , সেটা আমি এলাও করবো না | আর মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে তো তুমি এক বছর ধরে চেনো | বয়স্ক একটা মানুষ ! উনি কখনো মলেস্ট করতে পারে কাউকে ? আসলে দীপ্তির এইরকম হাই সোসাইটি পার্টিতে আসার অভ্যেস নেই বলে সামান্য একটা ডান্সের জন্য জিজ্ঞেস করাকে ওর নোংরামি বলে মনে হয়েছে | এটা ওর মেন্টাল ব্লকেজ | আর ওর এখুনি মিস্টার ভট্টাচারিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে ম্যাটারটাকে এখানেই সল্ভ করে দেয়া উচিত , আমাদের বিজনেসের কথা ভেবে দীপ্তির এটা করা উচিত |”
তৃষার কথাগুলো যেন বিঁধছিলো দীপ্তিকে | এতো লোকের মাঝে এইভাবে অপমান একজন ওকে করতে পারে ! মানতে পারছিলো না যেন ! তবে এই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে ওর সব থেকে বড়ো ধাক্কাটা লাগলো | কৃষ্ণেন্দু দীপ্তিকে এতো কিছু শুনে খুব কঠিন গলায় বললো হঠাৎ , ———— ” সরি বল তুই মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে এখনই | দ্যাখ , তোর কোনো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে | এই রকম পার্টিতে একটা ডান্সের জন্য জিজ্ঞেস করাটা খুব নরমাল | আসলে আমারই ভুল ! তোকে এখানে আনার আগে এইসব বুঝিয়ে দেয়া উচিত ছিল | যাইহোক, তুই প্লিজ আর সিন্ ক্রিয়েট না করে সরি বলে দে মিস্টার ভট্টাচারিয়াকে এখনই | আর এই ম্যাটারটাকে শেষ কর এখানে | ”
দীপ্তি এর উত্তরে কিছুক্ষনের জন্য যেন নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো সবার সামনে | মানে ওর কথার কোনো দামই নেই কৃষ্ণেন্দুর কাছে ! ও এতো বড়ো একটা কথা বললো কৃষ্ণেন্দুকে , আর সেটা বিশ্বাস না করে কৃষ্ণেন্দু তৃষার কথা বিশ্বাস করলো আজ ! এতো কিছুর পর শেষে ওকে ঝুঁকতে বললো ! মিস্টার ভট্টাচারিয়ার মতন লোকের কাছে ক্ষমা চাইতে বললো ! এমনকি অনিকেতের চাকরিটা অব্দি নিয়ে নিলো ও | কথাগুলো ভেবে দীপ্তি কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো এই লোকের ভিড়ে | কিন্তু তারপর নিজেকে প্রথমবার ভীষণ কঠিন করে ও দৃঢ় গলায় কৃষ্ণেন্দুর চোখে চোখ রেখে উত্তর দিলো আজ , ————– ” আর আমি যদি সরি না বলি কৃষ্ণেন্দু ! তাহলে ? আমাকেও চাকরি থেকে বার করে দেবে ? না কি নিজের লাইফ থেকে ?”
কৃষ্ণেন্দুর মুখের ওপর দীপ্তি আরেকবার না বললো ! একটা সাধারণ ভুলকে ও স্বীকার করতে পারলো না ! এটা জেনেও যে মিস্টার ভট্টাচারিয়া ওদের কোম্পানির কত বড়ো একজন ক্লাইন্ট | কথাগুলো ভেবেই ও অবাক চোখে দীপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো , —————- ” তুই লাস্টে এইসব বলছিস ? জানিস আজকের দিনটা আমাদের কোম্পানির জন্য কতটা ইম্পরট্যান্ট ! আর মিস্টার ভট্টাচারিয়া একজন বয়স্ক লোক | তোর ভুল হচ্ছে | উনি কখনোই এইসব কিছু করতে পারেন না | তৃষা ঠিকই বলেছে , তোর এইসব পার্টিতে আসার অভ্যেস নেই বলে এটাকে একটা ইস্যু বলে মনে হয়েছে | আর তুই সরি বললে ছোট হয়ে যাবি না দীপ্তি ! আর তোর একটা ছোট্ট মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জন্য আমি আমার কোম্পানির এতো বড়ো একজন ক্লাইন্টকে হারাতে পারবো না , সরি |”
দীপ্তির কৃষ্ণেন্দুর বলা কথাগুলোকে সেদিন শেষ বারের মতন শুনলো | আজ ও সত্যি শেষ | ওর ভেতরের ফিলিংস , জমানো অভিমান , রাগ , কষ্ট , যন্ত্রনা , সব এই ছেলেটার ওপর শেষ | আজ আর কিছু ফিরে পাওয়ার নেই | কিছু হারানোর নেই | আজ শুধু পুরোপুরি শেষ করে দেয়া বাকি আছে | তাই দীপ্তি এবার কৃষ্ণেন্দুকে ভেজা চোখে আলতো হেসে উত্তর দিলো , ————– ” চিন্তা কোরো না | আমার জন্য তোমার কোম্পানির কোনো লস হবে না | কোনো ক্লাইন্ট যাবে না | কারণ আমি নিজে এই কোম্পানিটা আজ ছেড়ে দিলাম | আর তোমাকেও | আশা করি মিস্টার ভট্টাচারিয়ার আর এই কোম্পানির সাথে কাজ করতে কোনো প্রব্লেম হবে না ! কারণ যে ওনাকে মিসআন্ডারস্ট্যান্ড করে সবার সামনে অকারণে অপমান করেছে , সে নিজেই এই কোম্পানিটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে | যাইহোক , সরি , তোমার পার্টিটাকে এইভাবে ডিস্টার্ব করার জন্য | সিন্ ক্রিয়েট করার জন্য | আর হবে না কখনো এইরকম | ভালো থেকো |”
কথাটা শেষ করেই দীপ্তি এবার ঘুরে তাকালো | আলো আঁধারি রুফ টপের শেষ প্রান্তে দরজাটা | দীপ্তি আর কোনো কথা না বলে সেইদিকে এগিয়ে গেলো চুপচাপ | সব ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য | অনিকেতও আর এই মুহূর্তে দাঁড়ালো না ওখানে | ও নিজেও দীপ্তির সঙ্গে পা মেলালো | কৃষ্ণেন্দু এই সময় যেন নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো | বিশ্বাস হচ্ছিলো না দীপ্তি শেষে নিজের জেদটা বজায় রাখার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলো ! এমনকি সবার সামনে ওদের রিলেশনটাও ভেঙে দিলো ! এইসবই কি শুধুই একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ! না একটা অজুহাত মাত্র ! অনিকেতের সাথে নতুন করে সব কিছু শুরু করার অজুহাত ! কথাগুলো ভেবেই ও শেষবারের মতন বলে উঠলো দীপ্তিকে ,
————- ” তুই ভুল করছিস দীপ্তি ! তুই খুব বড়ো একটা ভুল করছিস | ”
কথাটা যেন বুকে এসে লাগলো দীপ্তির এই মুহূর্তে | ও থমকে দাঁড়িয়ে গেলো হঠাৎ সবার মাঝে | তারপর কৃষ্ণেন্দুর দিকে ফিরে তাকিয়ে একটাই উত্তর দিলো , ————- ” না , আমি ভুল করছিলাম , এতদিন ধরে | তোমাকে ভালোবাসার ভুল ! কিন্তু আর না | আজকে ভুলটা শুধরে নিলাম | আর এরপর কোনোদিনও আমি থাকবো না | ”
কথাটা বলেই দীপ্তি আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো ওখানে | পা দুটোকে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে এলো পার্টিটা থেকে | ওই দম বন্ধ করা পরিবেশটা থেকে | হয়তো সারা জীবনের জন্য কৃষ্ণেন্দুর কাছ থেকেও ! তবে কৃষ্ণেন্দু সেই মুহূর্তে এক পা ও এগোতে পারলো না ঠিক | দীপ্তি কি সত্যি সব শেষ করে দিলো ! ও কি সত্যি ছেড়ে চলে গেলো কৃষ্ণেন্দুকে ! আর এর কারণটা কি অনিকেত ! না কি ও নিজে ! শেষ প্রশ্নটা একবার উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেলো যেন | আর নিঃস্তব্ধতার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো কৃষ্ণেন্দু নিজে ভিড়ের মধ্যে , এই প্রথম একদম একলা হয়ে |
চলব।