অন্য বসন্ত পর্ব-০৮

0
49

#অন্য_বসন্ত ( অষ্টম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
সেদিন এই সব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই কখন বৃষ্টি ভেজা শহরে রাত নেমে এসেছে , কৃষ্ণেন্দু খেয়াল করেনি | গঙ্গার ধারের একটা বেঞ্চে ও অনেক্ষন ধরে বসেছিল নিজের ঘোরে | এইরকম একটা দিন যে কোনোদিন ওর জীবনে আসবে ,যখন সব কিছু অগোছালো , হাতটা একেবারে খালি হয়ে যাবে , কৃষ্ণেন্দু এটা কোনোদিনও ভাবেনি ! আজ নিজেকে চিনতে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে আসলে ওর | হঠাৎ যেন নিজের খারাপ , অহং এ আচ্ছন্ন চেহারাটা খুব পরিষ্কারভাবে দেখে ফেলেছে ও ! তাই আরো এলোমেলো লাগছে | ছন্নছাড়া লাগছে নিজেকে | মনের জ্বালা যদি বৃষ্টিতে ভিজে মেটে , তাই ও সেই বিকেল থেকে এখানে বসে ! তবে এবার উঠতে হবে | এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছে | জানে না এই দিনগুলোর ভিড়ে নিজের মানুষরা ঠিক কতটা দূরে সরে গেছে ওর ! কিন্তু আর না | আর সময় নষ্ট করলে চলবে না আজ | কৃষ্ণেন্দুকে দীপ্তি , আলো মা , এদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে ! ফেস করতে হবে ওদের | যদিও জানে না গিয়ে কি বলবে ! কি উত্তর দেবে ওর সেদিনের ব্যবহারের জন্য ! কি উত্তর দেবে এই দু মাস একবারও ফোন না করে , কোনোরকম যোগাযোগ না করে থাকার জন্য ! কিন্তু তা ও যাবে | কৃষ্ণেন্দু জানে , ও যেই ভুলগুলো করেছে , তারপর একটা সরি কোনোদিনই যথেষ্ট হবে না , সব কিছু ঠিক করার জন্য ! কিন্তু সামনে গিয়ে তো দাঁড়াতেই হবে | চোখ মেলাতে পারুক কি না পারুক ! এই ভেবেই কৃষ্ণেন্দু সেদিন প্রায় রাত দশটার পর এসে হাজির হয়েছিল দীপ্তিদের বাড়ির সামনে | ওই পুরোনো একতলা বাড়িটা দেখে যেন ও কয়েক সেকেন্ড এর জন্য থমকে গেছিলো হঠাৎ ! মা বাবা মারা যাওয়ার পর আলো মা যদি ওকে নিজের সাথে না নিয়ে আসতো , অতো যত্ন করে আগলে না রাখতো , তাহলে কি আজ বেঁচে থাকতো কৃষ্ণেন্দু ! অনেকদিন আগেই হয়তো হারিয়ে যেত এই পৃথিবী থেকে ! আর কৃষ্ণেন্দু তার বদলে কি ফিরিয়ে দিলো ! অপমান | এতো তীব্র অপমান , যে এক রাতের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হলো ওদের ! কথাটা ভেবেই চোখটা আবার নিচে নেমে গেলো ওর | তবে কয়েক মুহূর্তে নিজেকে সামলে কৃষ্ণেন্দু এরপর দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলো | তারপর চোখটা বন্ধ করেই কলিংবেলটা বাজালো |

এতো রাতে ওদের বাড়িতে কে এলো হঠাৎ ! কথাটা কলিং বেলের আওয়াজটা পেতেই মাথায় এলো হঠাৎ | তাই নিজের ঘর থেকে একটু কৌতূহল নিয়েই বেরিয়ে এলো সেদিন দীপ্তি ড্রইং রুমে | ততক্ষনে মা দরজাটা খুলে দিয়েছে | দীপ্তি কয়েক পা এগিয়ে দরজার সামনে আসতেই থমকে গেলো কেমন ! আলোও চুপচাপ মূর্তির মতন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে | আর কৃষ্ণেন্দু থমথমে দৃষ্টিতে দীপ্তির দিকে নিঃস্পলকভাবে তাকিয়ে এখন | দীপ্তি এই দৃশ্যটা দেখার জন্য আজ একদমই তৈরী ছিল না ! যেই মুখটা সময়ের আড়ালে হারিয়ে যাবে ভেবেছিলো , সে যে হঠাৎ না চাইতেই আবার সামনে এসে দাঁড়াবে , দীপ্তি এটা ভাবেনি | তাই কয়েক সেকেন্ড ও নিজেও থমকে ছিল এই মুহূর্তটায় | তবে এই মুহূর্তের ঘোরটা কাটতেই দীপ্তির ভেতরে একটা ধাক্কা লাগলো কেমন ! ও তো চায় না আর এই ছেলেটাকে নিজের সামনে দেখতে | একদমই চায় না | কথাটা ভেবেই ও নিজেকে ফিরিয়ে নিলো , ঘরে চলে যাওয়ার জন্য | তবে আরেকবার থমকে গেলো ওই পুরোনো গলার আওয়াজটা শুনে | কৃষ্ণেন্দু ওকে ডেকে উঠলো সেই মুহূর্তে | ও এখনো দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে | আলো মা দরজা খুলে ওকে দেখে একটু যেন চমকেই গেছিলো আজ ! আগের সেই হাসিটা আর ছিল না মুখে কৃষ্ণেন্দুর জন্য | কৃষ্ণেন্দুও কিছু বলতে পারেনি | এতো ভুলের পর কি বলা যায় , ও সত্যি জানে না | এই সময়েই দীপ্তি এসে ওকে দেখেই আবার ফিরে যাচ্ছিলো | কিন্তু আজকের যাওয়াটা দেখে কৃষ্ণেন্দু কিছুতেই আর নিজেকে আটকাতে পারলো না | ও যেন আপনাআপনিই দীপ্তিকে ডেকে ফেললো কিছু না ভেবেই | তবে অবাক হয়ে গেলো এতকিছুর পরও দীপ্তি আজ ওই ডাকটাকে না শুনে থাকতে পারলো না ! ঘুরে তাকালো ওর দিকে আরেকবার | তারপর কয়েক পা ফেলে ওর কাছে এগিয়ে এলো | তার মানে কি দীপ্তির মনে এখনো ওর জন্য জায়গা আছে ! কথাটা ভেবে কৃষ্ণেন্দুর মনে যেন একটু আশা জড়ো হলো হঠাৎ | ফিরে পাওয়ার আশা | আর সেই জন্যই ও বলে উঠলো এলোমেলোভাবে , ——- ” দীপ্তি ! সেদিন ভুল হয়ে গিয়েছিলো ! আমি বুঝিনি ! আমি…. ”
না, কথাটাকে আর শেষ করতে পারলো না কৃষ্ণেন্দু | ওর চোখে চোখ রেখেই আচমকা কিছু না বলে দীপ্তি দরজাটা বন্ধ করে দিলো মুখের ওপর | কানে এসে বাজলো যেন সেই বন্ধ দরজার আওয়াজটা | কৃষ্ণেন্দু কিছুক্ষন খুব অবাক হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো ওই দরজার সামনে | বুঝতে পারছিলো না যে এইভাবে দীপ্তি ওকে উত্তর দেবে | কিছু না বলেও , এতো কিছু বুঝিয়ে দেবে | কৃষ্ণেন্দু যে ওদের জীবনে আর কোথাও নেই ! ওর সঙ্গে কোনো কথা , কোনো শব্দই আর বাকি নেই ! এটা বুঝিয়ে দেবে | সেদিন কৃষ্ণেন্দু এরপরও যেতে পারেনি ওই বাড়িটার সামনে থেকে | আজ সব হারিয়ে নিঃস্ব লাগছে নিজেকে | শুধু মনে হচ্ছে যদি একবার ওই দরজাটা খোলে ! যদি কেউ কোনো কথা বলে ওর সঙ্গে ! যদি কোনোভাবে ওর চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা এই ভয়ঙ্কর নিঃস্তব্ধতাটা কেটে যায় আজ কোনোভাবে ! এই ভেবেই সেদিন সারা রাত ওই ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে ও এক টানা দাঁড়িয়ে ছিল ওই বাড়িটার সামনে | কিন্তু আজ আর কেউ ওর কাছে আসেনি | ওকে ডেকে আর কেউ ঘরে নিয়ে যায়নি | আর এই অন্তহীন অপেক্ষার মধ্যেই কলকাতায় আর একটা সকাল এসে উঁকি দিয়েছিলো | কৃষ্ণেন্দু তখনও কিরকম নিষ্প্রাণ ভাবে দাঁড়িয়েছিল বাড়িটার সামনে | কিসের আশায় , ও নিজেও জানে না ! সেই সময়েই দরজা খুলে হঠাৎ আলো বাইরে এলো | কৃষ্ণেন্দু ওর আলো মা কে দেখে আরেকবার যেন অল্প প্রাণ ফিরে পেলো | আবার আশাটা জাগলো বুকের মধ্যে | তাহলে কি এক রাতের অপেক্ষার পর আলো মা ওকে ডেকে নিতে এসেছে ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই আলো ওর সামনে এসে বলে উঠলো ,
———– ” তুই কি সারা রাত দাঁড়িয়েছিলিস এখানে ? কেন ! ”
আলোর কথায় ও কি উত্তর দেবে আবার ঠিক বুঝতে পারলো না | কেন দাঁড়িয়েছিল সেই কারণটা বললে কি আবার সব আগের মতন হয়ে যাবে ! আবার কি সেই হারানো জায়গাটা নিজের ফিরে পাবে কৃষ্ণেন্দু ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও আনমনে আলোর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো | আজ এই অগোছালো জীবনে এই হাতটার খুব দরকার ওর | কথাটা ভেবেই জল নেমে এলো চোখে হঠাৎ | মা বাবা মারা যাওয়ার পরও আলোর কাছে ও ঠিক এইভাবেই কাঁদতো | কিন্তু সেদিনের মতন আলো আজ আর ওকে সামলাতে পারলো না ! কিছু সময় বাস্তব এমনভাবে জীবনে চলে আসে , যখন কঠিন হতেই হয় | চাইলেও আর তাকে পুরোনো জায়গা ফিরিয়ে দেয়া যায় না | কথাটা আলো জানতো বলেই বলে উঠলো আলতো গলায় ,
————- ” কৃষ্ণেন্দু , এখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আর কিছু হবে না | কিছু দরজা সারা জীবনের জন্যই বন্ধ হয়ে যায় | দীপ্তি আমাকে নিজের মুখে কখনো কিছু বলেনি , যে সেদিন রাতে ঠিক কি হয়েছিল | আমি অনিকেতের কাছে শুনেছিলাম | খারাপ লেগেছিলো ভীষণ | তবে এই দু মাসে দীপ্তি কখনো আর তোর নামটাও বলেনি আমার সামনে | এটাই সত্যি | আমি চাই না , তুই শুধু শুধু নিজের সময় , নিজের শরীর নষ্ট করে এইখানে এইভাবে আসিস | কারণ আমি জানি , এসেও কোনো লাভ হবে না | আর তোর তো বিজনেস আছে | আমি জানি তুই চাইলেই ভালো কোনো মেয়ে পেয়ে যাবি | আর আমরা তোর জীবনে একটা সময় অব্দি ছিলাম | যতদিন দরকার ছিল | এই দু মাসে অন্তত এইটুকু বুঝেছি , যে এই দরকারটাও এখন নেই সেইরকম | তাই প্লিজ আর এখানে আসিস না | আর আমি চাই , তুই খুব ভালো থাক | ব্যাস |”
কথাটা বলেই আলো কৃষ্ণেন্দুর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে চলে যেতে যাচ্ছিলো | কিছু শেষ তো এইভাবেই হয় | তবে কৃষ্ণেন্দু এই সময় খুব দৃঢ় গলায় বলে উঠলো হঠাৎ ,
———— ” আমি এইভাবে পারবো না থাকতে | তোমাদের ছাড়া | আমি জানি , অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে ! হয়তো কোনোদিনই সেটা আমি ঠিক করতে পারবো না।কিন্তু তা ও আমি আসবো | রোজ আসবো এখানে | রোজ অপেক্ষা করবো | যদি তোমরা দরজাটা খোলো কখনো ! যদি দীপ্তি আরেকবার আমার সাথে কথা বলে ! পুরোনো সময়টা যদি কখনো ফিরে আসে আমার কাছে ! আমি আমার সারা জীবন দিয়ে অপেক্ষা করবো সেই সময়টার জন্য |”
কথাটা শেষ করে কৃষ্ণেন্দু আর দাঁড়ালো না | রাস্তাটাকে খালি করে দিয়ে চলে গেলো আলোর সামনে থেকে | তবে আলো স্পষ্ট বুঝতে পারলো , এই যাওয়াটা আসল যাওয়া নয় | কৃষ্ণেন্দু আবার আসবে | বার বার আসবে | চেনে ও ছেলেটাকে ! জানে ওর এই দৃঢ় গলার আওয়াজকে | যতক্ষণ না পুরোপুরি ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে , ততদিন অব্দি আসবে কৃষ্ণেন্দু | কিন্তু আলো তো নিজের মেয়েকেও চেনে | ওর ঠান্ডা বরফ হয়ে যাওয়া মনটাকে চেনে | ওর ওই শব্দহীন নিঃস্তব্ধতা যে কতটা তীব্র , আলো জানে | তাই ভয় হচ্ছে একটা আজ কিরকম ! কৃষ্ণেন্দুর অপেক্ষা কোনোদিনও শেষ হবে তো ! না কি এই অপেক্ষার আড়ালেই সব কিছু শেষ হয়ে যাবে ওর ! প্রশ্নগুলো যেন ভেতর থেকে এসে ধাক্কা মারছে আলোকে | আর উত্তরহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সকালটা !

দূরত্ব এমন একটা জিনিস , যেটা সব সময় রাস্তা দিয়ে মাপা যায় না | রাস্তা কম হলেও মনের দূরত্ব যখন বাড়ে , তখন সেই কাছের মানুষটার কাছে পৌঁছনোটা অসম্ভব হয়ে যায় | কৃষ্ণেন্দুর আজকাল এই কথাটা ভীষণভাবে মনে হয় | যখন ও রোজ রাতে গিয়ে দীপ্তিদের বাড়ির সামনেটায় দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষন ! নিস্পলক দৃষ্টিতে দীপ্তির ঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে , একবার ওর দেখা পাওয়ার আশায় ! তখন খুব মনে হয় | দীপ্তি সেই সময় আনমনে যদি কখনো জানলার কাছে চলেও আসে , কৃষ্ণেন্দুকে দেখেই সরে যায় ভেতরে , অথবা পর্দাটা টেনে দেয় নিজে থেকে | কথা বলা তো দূরে থাক , কৃষ্ণেন্দুকে আজকাল দীপ্তি দেখেও অদেখা করে দেয় | কোনো অচেনা মানুষকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে যেরকম কারোর কিছু আসে যায় না , দীপ্তিরও যেন ঠিক কৃষ্ণেন্দুকে ওদের বাড়ির বাইরে দেখলে ওরকমই মনে হয় ! এইভাবে নিঃস্তব্ধতার ভিড়ে আস্তে আস্তে দুটো মাস কেটে গেছে শহর থেকে | কৃষ্ণেন্দু এই সময়ের ভিড়ে কিরকম একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে | যার জীবনে শুধু একটা অফিস আছে | সে সেখানে রোজ যায় , কাজের মধ্যে হারিয়ে ফেলে নিজেকে ইচ্ছে করেই | তারপর ধীরে ধীরে রাত নাম শহরে | রাস্তাঘাট ক্লান্ত হয়ে যায় | কৃষ্ণেন্দু সেই ক্লান্ত রাস্তা পেরিয়ে অফিস থেকে ওই পুরোনো ঠিকানাটার সামনে এসে দাঁড়ায় | জানে , এই বাড়িতে ওর আর ঢোকা হবে না ! কিন্তু তা ও এই বাড়িটাকে দেখলে মনে হয় , নিজের কিছু একটা আছে | হয়তো তারা এখন রেগে | অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে | কিন্তু একদিন ঠিক সেই অভিমান গলবে | একদিন ঠিক আবার ওর জীবনে সব কিছু আগের মতন হয়ে যাবে | ওই নিজের মানুষগুলো ফিরে আসবে ! এই ভাবনার ভিড়েই এক দু ঘন্টা অদ্ভুতভাবে কেটে যায় কৃষ্ণেন্দুর | একা নিঃস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থেকে | কখনো পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় , তো কখনো কালো মেঘ ভরা আকাশে , বৃষ্টি মাথায় নিয়ে |

তারপর হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগে যেন | ভেতর থেকে শেষ বলে মনে হয় নিজেকে | তখন কৃষ্ণেন্দু ওর বাংলোতে ফেরে | ঘর ভর্তি ফার্ণিচারেরা যেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করে শুধু | নিজেকেও সেই লোকহীন , শব্দহীন বাড়িটায় ওই ফার্নিচারগুলোর মতনই লাগে , প্রাণহীন | তারপর কোনোদিন ইচ্ছে হলে খায় , কোনোদিন খায় না | বদলে অনেক সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেয় অনেকগুলো একসঙ্গে | একটা ওষুধেও আজকাল কাজ হয় না | কিছুতেই চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে না এমনিতে | নেশা , বা ওষুধ , কিছু একটা লাগেই চোখ বন্ধ করার জন্য | তখন মাঝে মাঝে মনে হয় , যদি এই চোখটা আর না খোলে ! রাতটা আর শেষ না হয় ! তাহলে কি দীপ্তি আর আলো মা ফিরবে ! ওকে শেষ দেখা দেখতে ! তখন কি রাগ ভাঙবে ওদের ! পৃথিবীতে না হলেও ওদের মনে নিজের জায়গাটা করে নিতে পারবে কৃষ্ণেন্দু আরেকবার !

এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই ঘুমের ওষুধের পাতা অথবা এলকোহলের নেশা কাজ করে দেয় ওর অজান্তে এরপর | কিরকম নিস্তেজ হয়ে যায় কৃষ্ণেন্দু অনেকক্ষনের জন্য | সম্পর্ক থাকে না তখন আর ওই যন্ত্রনাগুলোর সঙ্গে ওর | কিন্তু একটা সময় আবার ওষুধ এলকোহলগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয় | না চাইতেও চোখ খুলতে হয় তখন | এমন একটা দিন দেখতে হয় , যেখানে শুধু একাকিত্ব আর বিষন্নতা ছাড়া আর কিছু বাকি নেই ! তারপর আবার কাজ খুঁজতে শুরু করে কৃষ্ণেন্দু | কাজের ভিড়ে নিজের মনটাকে আড়াল করার চেষ্টা করতে শুরু করে আরেকবার |

এইসবের মাঝেই সেদিন একটা ঘটনা ঘটেছিলো | বেস্ট ইয়ুথ আইকন এর একটা অ্যাওয়ার্ড কৃষ্ণেন্দুকে এবার দেয়া হয়েছে একটা নিউজ চ্যানেল থেকে | এতো কম বয়সে এইরকম একটা সাকসেসফুল বিজনেস রান করাচ্ছে ও ! মিডিয়ার নজর তো থাকবেই ওর ওপর | তবে সেদিন আনমনে টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে সেই অ্যাওয়ার্ড শো এর লাইভ টেলিকাস্ট দেখে আলো যেন থমকে গেলো হঠাৎ | স্ক্রিনের ওপারে কৃষ্ণেন্দু স্টেজে উঠে এওয়ার্ড নিচ্ছে , সেই দৃশ্যটা দেখে ! আপনাআপনিই মুখে একটা হাসি চলে এলো ওর | সেই সময়েই আবার ওই এওয়ার্ড শো এর এঙ্কর কৃষ্ণেন্দুকে বলে উঠলো নিজে থেকে , যেন ও কিছু লাইন বলে অডিয়েন্সের জন্য | কৃষ্ণেন্দু তো একটা ইন্সপিরেশন আমাদের নিউ জেনারেশনের কাছে | এতো কম বয়সে এতটা সাকসেস কি করে পেতে পারে লোকজন , সেই নিয়ে যদি কৃষ্ণেন্দু কিছু বলে ! আলো এবার টিভির ওপারে আরোই স্তব্ধ হয়ে গেলো | ছেলেটাকে তো নিজে আগলে রেখেই মানুষ করেছিল একটা সময়ে | সে আজ এতো বড়ো একটা অনুষ্ঠানে সম্মানিত হচ্ছে ! ভেবেই আনন্দ হচ্ছিলো ভীষণ | আর কৃষ্ণেন্দু এই এই আনন্দের ভিড়েই মাইকটা হাতে নিয়ে বলে উঠলো সেদিন , কিছু অন্য কথা | ও এই সম্মানটা পেয়েও থমথমে মুখে উত্তর দিলো , ————— ” সরি , কিন্তু আমি কারোর ইন্সপিরেশন হতে পারি না | আমি সেইরকম মানুষ নোই | হ্যাঁ, শুধু সাকসেস দিয়ে বিচার করলে হয়তো আমি ভীষণ ভালো একজন বিজনেসম্যান , কিন্তু জীবন দিয়ে বিচার করলে আমি একেবারে নিঃস্ব একটা মানুষ | আমি ঠিক সময়ে আমার নিজের লোকেদের ইম্পর্টেন্সটা বুঝিনি | তাদের এত কষ্ট দিয়েছি , এতো ভুল করেছি, যে আজ ওই নিজের মানুষগুলো আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে | আসলে ভীষণ বেশি কেরিয়ার , ব্যবসা , লাভ ক্ষতির হিসাব নিয়ে ভাবতাম একটা সময়ে , যে নিজের লোকগুলোর কথা ভাবতেই ভুলে গেছিলাম | মনে হতো ,এরা তো আছেই ! এরা তো থাকবেই ! টেকেন ফর গ্রান্টেড ধরে নিয়েছিলাম এই সম্পর্কগুলোকে কেমন | আর সেই জন্য একদিন সব শেষ হয়ে গেলো | খালি হয়ে গেলো একদম হাতটা | শুধু টাকা , ব্যবসা , আর সাকসেস ছাড়া , একটাও নিজের লোক পরে রইলো না আমার কাছে | তাই সবাইকে বলবো , ডোন্ট বি লাইক মি .. আমি হয়ে কোনো লাভ নেই | বরং নিজের মতন হও | কেরিয়ারের সঙ্গে নিজের লোকগুলোকেও সময় দাও | তাহলে জীবনে আসল সাকসেসটা পাবে |”
কথাগুলো শেষ করেই ও ধীরে ধীরে নেমে গেলো স্টেজটা থেকে | শো এর এঙ্কর থেকে অডিয়েন্স , সবাই কিরকম চুপ হয়ে গেলো ওর উত্তরটা শুনে ! কেউই বুঝতে পারছিলো না এই কথাগুলো শুনে ঠিক কিভাবে রিয়্যাক্ট করা যায় ! আর এদিকে আলোর মুখের হাসিটাও কিরকম হঠাৎ মিলিয়ে গেলো টিভির এপারে | কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো যেন ভেতরে গিয়ে লাগলো ! বুঝতে পারলো সেই মুহূর্তে , যে ছেলেটা ভালো নেই | ওর অন্ধকার মুখ , ওর থমকে থাকা দুটো চোখ যেন সব বলে দিলো আলোকে | সেই সময়েই হঠাৎ খেয়াল করলো ড্রইং রুমের দরজায় দীপ্তি দাঁড়িয়ে | ও কি তাহলে টিভিতে কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো শুনছিলো এতক্ষন ! প্রশ্নটা আলোর মনে আসতেই দীপ্তি দরজাটা খালি করে নিজের ঘরে চলে গেলো কিছু না বলে | তবে সেই মুহূর্তে আলোও আর চুপ করে থাকতে পারলো না যেন | ও আজ প্রথম দীপ্তিকে কৃষ্ণেন্দুর ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য ওর ঘরে এলো |
সেদিন ওই মুহূর্তে সন্ধ্যে নেমে এসেছিলো কলকাতায় | দীপ্তি জানলার কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল একা একা | মা যে ঘরে এসেছে , প্রথমে খেয়ালই করেনি ! গলার আওয়াজটা শুনে খেয়াল হলো | আলো এই মুহূর্তে এসে সোজাসুজিই দীপ্তিকে জিজ্ঞাসা করে উঠলো আস্তে গলায় , ——— ” কৃষ্ণেন্দুর ইন্টারভিউটা দেখছিলিস তুই টিভি তে ? ”
দীপ্তি প্রশ্নটা শুনেও চুপ রইলো | কিছু সময় উত্তর দেয়ার মতন কোনো কথা থাকে না আসলে | আলো এই নিঃস্তব্ধতার ভিড়েই বলে উঠলো এবার ,
———– ” মানুষ বদলায় দীপ্তি | পরিস্থিতি অনেক সময় ভুলগুলোকে বুঝিয়ে দেয় | কৃষ্ণেন্দু দু মাস ধরে রোজ আমাদের বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে ! ঝড় জল বৃষ্টি সব কিছুর মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকে কতদিন ! শুধু একটু কথা বলতে চায় তোর সঙ্গে, ব্যাস | আর আজ যেইভাবে এতগুলোর লোকের সামনে নিজের ভুলটা স্বীকার করলো ছেলেটা , তারপরও কি এটা বুঝতে পারছিস না , যে ও সত্যি বদলে গেছে | ও বুঝতে পেরেছে নিজের ভুলগুলো | ”
দীপ্তি সেদিন মায়ের কথাগুলো শুনেও কয়েক সেকেন্ড চুপ ছিল | তবে এইসবের পর তো আর নিরুত্তর হয়ে থাকা যায় না ! তাই ও দৃঢ় গলায়ই এবার বলে উঠলো আলোকে ,
———- ” কিন্তু এই নিয়ে আমার তো কিছু করার নেই মা | আমিও নিজের ভুলটা বুঝে গিয়েছি | দিনের পর দিন আমার থেকে পুরোপুরি আলাদা , একটা স্বার্থপর হিসাবি মানুষকে ভালোবেসে , সঙ্গে থেকে যেই ভুলটা করেছিলাম , সেটাকে বুঝে গিয়েছি | আর কোনোদিন আমার পক্ষে ওই ভুলটা রিপিট করা সম্ভব হবে না | আর কৃষ্ণেন্দুর ভালো খারাপ থাকাতে আমার কোনো হাত নেই | আমি কাউকে বলিনি আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে ! তাই প্লিজ আমাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু বোলো না | ”
কথাগুলো শেষ করেই দীপ্তি এবার ল্যাপটপটা খুলে বসলো খাটে | হয়তো মায়ের আরো কোনো প্রশ্ন থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যই এই মিথ্যে ব্যাস্ততাকে আঁকড়ে ধরলো ও | আলো নিজেও বুঝতে পারলো দীপ্তির এই আড়ালটা | তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ঘরটা খালি করে দিয়ে চলে গেলো | তবে দীপ্তির এই মুহূর্তে না চাইতেও কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো কানে বেজে উঠলো হঠাৎ ! ও কি সত্যিই নিজের ভুলগুলোকে বুঝেছে ! কথাটা যেন একবার আনমনে মনে এসেই মিলিয়ে গেলো কেমন | বুঝলেই বা কি ! যেটাকে একটা সময় নিজের হাতে দিনের পর দিন ধরে ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে , সেই কাঁচগুলোকে আর জুড়বে কি ভাবে ! চাইলেও আর এটা সম্ভব নয় |
পরবর্তী পর্ব পোস্ট হবে কাল। আর এইরকম গল্প উপন্যাস পড়ার জন্য পেজটিকে ফলো করুন, শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে। আপনারা পাশে থাকলেই লেখাগুলো এগিয়ে যাবে ধীরে ধীরে। )
চলববে।