অন্য বসন্ত পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
138

#অন্য_বসন্ত ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
এই রকম শরীর নিয়ে কোথায় গেলো ছেলেটা ! এরপর যদি কিছু হয়ে যায় ওর ! না , আর যেন ঠিক ভাবতে পারলো না দীপ্তি | কৃষ্ণেন্দু ঠিক আছে | কিছু হয়নি ওর | কথাগুলো যেন নিজের মনে বলেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো এখন | এরপর প্রায় দু ঘন্টায় ওর কল লিস্টে যতজন চেনা বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন ছিল কৃষ্ণেন্দুর , প্রত্যেকের নাম্বার ট্রাই করে দেখলো দীপ্তি | কিন্তু সবার কাছ থেকে উত্তরে একটা ‘না’ ই শুনতে হলো ওকে | কৃষ্ণেন্দু চেনা পরিচিত কারোর বাড়িই যায়নি ! দীপ্তি কথাগুলো শুনে যেন কিছু বুঝতে পারছে না এখন | কাল রাত থেকে তাহলে কোথায় আছে কৃষ্ণেন্দু ! আচ্ছা , ও কলকাতার বাইরে কোথাও যায়নি তো ? না কি দেশের বাইরে ! তাহলে নিশ্চই কোনো ট্রেন টিকিট , অথবা এয়ার টিকিট কাটবে নিজের ! এর উত্তর তো ওর পার্সোনাল এসিস্টেন্টই দিতে পারে | কথাটা মনে হতেই দীপ্তি এবার কৃষ্ণেন্দুর নতুন এসিস্টেন্ট বিমলদাকে কল করলো | ওর একাউন্ট ডিটেলসও বিমলদা হ্যান্ডেল করে | খুব সহজে খোঁজ নিয়ে বলে দিতে পারবে কৃষ্ণেন্দু কোনো টিকিট কেটেছে কি না ! এইসব ভেবে একটু যেন আশা জেগেছিলো মনে ওর | ছেলেটার একটা খোঁজ পাওয়ার আশা | তবে কিছুক্ষনের মধ্যে সেটাও শেষ হয়ে গেলো | বিমলদা খোঁজ নিয়ে ফোনে জানালো যে কৃষ্ণেন্দুর নামে কোনো ট্রেনের টিকিট , কোনো এয়ারটিকিট , কিছুই বুক হয়নি ! ব্যাংকের একাউন্টগুলোতেও চেক করেছেন উনি | কৃষ্ণেন্দু একটা টাকাও কোনো ব্যাংক একাউন্ট থেকে উইড্র করেনি | আর সব থেকে বড়ো কথা , যেটা শুনে দীপ্তির আরোও সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো , কৃষ্ণেন্দুর গাড়িটা কাল রাত থেকেই অফিসের পার্কিং এ রাখা | ও নিজের গাড়িও নিয়ে যায়নি সঙ্গে | দীপ্তি এতো কিছু জানার পর সত্যি কিরকম নিশ্চুপ হয়ে গেলো | তার মানে কৃষ্ণেন্দু ইচ্ছে করেই ওর কোনো হদিশ না রাখার জন্য গাড়িটা পর্যন্ত নিয়ে যায়নি | দীপ্তি এরপর আর ঠিক কিছু ভাবতে পারলো না এই মুহূর্তে ! যে নিজেই নিজের খোঁজ দিতে চায় না , তাকে কি করে ফিরিয়ে আনবে দীপ্তি ! কথাটা মনে আসতেই এই প্রথম আলো ওর কাছে এসে নিঃস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো হঠাৎ , ———- ” আমি জানতাম , এইরকমই কিছু একটা হবে | অনেকদিন আগে থেকে জানতাম | কৃষ্ণেন্দু বদলে গিয়েছিলো দীপ্তি | নইলে রোজ রাতে এসে ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও দিনের পর দিন এই বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো না ছেলেটা ! কিন্তু তুই সেইসব কিছুই দেখেও দেখিসনি কখনো | তুই তো না চিনেই থাকতে চেয়েছিলিস | তাহলে আজ কেন খুঁজছিস ? আজ তো আর এইসবের দরকার নেই | ”
দীপ্তি এই সময়ে মায়ের কথাগুলো শুনে যেন থমকে গেলো | চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো কিরকম ওর | প্রচন্ড জল এসে ভিড় করলো সেখানে | দিনের পর দিন দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুকে এভয়েড করেছে | ওর সাথে কথা বলেনি | ওকে বাড়ির বাইরে দেখে কত সময় নিজের ঘরের জানলার পর্দাটা টেনে দিয়েছে মুখের ওপর ! কোনোদিনও আর ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেনি | এমন কি কালকেও , যখন কৃষ্ণেন্দু শেষবার ওকে বললো , আর কখনো দেখা না হওয়ার কথা ! তখনও দীপ্তি বুঝলো না কিছু ! একবার ফিরে দেখলো না ওকে ! কালও যদি দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুর সাথে কথা বলতো , তাহলে হয়তো আজ এইসব কিছুই হতো না ! ছেলেটা ওদের সঙ্গে থাকতো | ঠিক থাকতো | কথাগুলো ভেবে কিরকম দিশেহারা লাগছে যেন ওর | না , এইভাবে চুপচাপ বসে থাকলে হবে না | দীপ্তিকে কৃষ্ণেন্দুকে খুঁজে বার করতেই হবে | এইভাবে ওর জন্য কেউ চলে যেতে পারে না ! এমনিতেই অনেকটা টাইম পার হয়ে গেছে ! এখন দুপুর একটা বাজে | দীপ্তি পুলিশ স্টেশন যাবে এখন | মিসিং রিপর্ট লেখাতে | পুলিশ খুঁজলে ঠিক পেয়ে যাবে ছেলেটাকে | কথাগুলো ভেবেই ও চোখের জলটা মুছে কিছুটা শক্ত করলো নিজেকে | তারপর ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো ,
————— ” আমি এইভাবে কাউকে হারিয়ে যেতে দেব না ! আমি পুলিশ স্টেশন যাচ্ছি | যে করেই হোক , আমি কৃষ্ণেন্দুকে খুঁজে বার করবো | এইভাবে কোনো কিছু শেষ হয় না !”
কথাগুলো বলেই দীপ্তি আর অপেক্ষা করলো না | বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে | কিন্তু আলোর যেন এই মুহূর্তে কিরকম শেষ লাগছে ভেতর থেকে | মনে পরে যাচ্ছে কৃষ্ণেন্দুর সেই থমকে থাকা চেহারা , ওর স্থির দুটো চোখকে | এবার কৃষ্ণেন্দুকে খুঁজে পাওয়া এতো সহজ হবে না আর ! দীপ্তি না এরপর কৃষ্ণেন্দুর নিথর শরীরটা না পায় কোথাও থেকে ! কথাটা ভেবেই ভয়ে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে চারিদিকটা আজ আলোর |

যাইহোক ,এরপর সেদিন দীপ্তি অনেকক্ষণ ধরে বসেছিল পুলিশ স্টেশনে | মিসিং কমপ্লেন করার পর পুলিশ যত রকমভাবে চেষ্টা করা যায় করেছে ! তবে দীপ্তির ভেতরটা কেঁপে উঠলো তখনই , যখন শহরের সমস্ত হাসপাতাল গুলোতেও খোঁজ নিতে শুরু করলো পুলিশ | আজ এই শহরে দুটো সুইসাইড কেস পাওয়া গেছে | একজন যে রেলে কাটা পড়েছে , তার রিলেটিভস এর খোঁজ পাওয়া গেলেও , যেই ছেলেটা গঙ্গায় ডুবে মারা গেছে , তার কোনো আইডেন্টিটি প্রুফ পাওয়া যায়নি | ছেলেটার বয়স না কি ওই ঊনত্রিশ ত্রিশের মতন | কথাটা শুনেই দীপ্তির ভেতরটা শুকিয়ে এসেছিলো সেই মুহূর্তে | তারপর পুলিশ যখন বললো বডি আইডেন্টিফিকেশন এর জন্য যেতে হবে , তখন দীপ্তির কিরকম মাথাটা ঘুরে গেলো হঠাৎ | ও বুঝতে পারছিলো না যে জীবন ওকে এইরকম একটা দিনে কি করে নিয়ে এলো ! কখন কৃষ্ণেন্দুর ওপর রাগ , খারাপ লাগাটা ওর এই পর্যায়ে চলে গেলো , যে সেই ছেলেটার শেষ ডেকে আনলো ও ! আর কি করবে এরপর , যদি গিয়ে দেখে ওই গঙ্গায় ভেসে ওঠা ছেলেটা কৃষ্ণেন্দুই ! কিভাবে বাঁচবে তারপর ! কি করে ক্ষমা করবে নিজেকে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন হসপিটালের মর্গে এসে পৌঁছেছিল দীপ্তি | কিন্তু লাশঘর অব্দি যেতে হয়নি ওকে | একটা প্যাকেটে যেই ছেলেটা মারা গেছে , তার ঘড়ি চেন আর পার্স নিয়ে আগে দীপ্তিকে দেখানো হয়েছিল | সেটার দিকে প্রথমে দীপ্তি ভয়ে তাকাতে না পারলেও , কয়েক মিনিট বাদে যখন চোখ খুলে দেখেছিলো , তখন যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস আপনাআপনিই চলে এসেছিলো ওর | না ,এগুলো কৃষ্ণেন্দুর ঘড়ি , পার্স এইসব কিছুই না | আর সব থেকে বড়ো কথা , কোনোদিনও কৃষ্ণেন্দু গলায় কোনো চেন পড়তো না ! তাই এই ছেলেটা আর যে ই হোক , ওর চেনা কৃষ্ণেন্দু না | তার মানে এখনো সম্ভাবনা আছে | কৃষ্ণেন্দুর ঠিক থাকার সম্ভাবনা | ওর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা | সেদিন এই ভাবনাটা নিয়েই ও বেরিয়ে এসেছিলো হসপিটাল থেকে | তবে এরপর যেন আর শরীর চলছে না ওর | হাত পা সব অবশ হয়ে যাচ্ছে | কি করবে এখন ! রাত বারোটা বাজে | কোথায় খুঁজবে এখন ছেলেটাকে ! এই এতো বড়ো পৃথিবীতে যদি কেউ আড়াল হয়ে থাকে , তাহলে তাকে বার করবে কি করে দীপ্তি ! কিছুতেই যেন ভেবে পাচ্ছিলো না আজ | কিরকম নিস্তেজ হয়ে তাই রাস্তার বেঞ্চটায় বসে পড়েছিল ও | মনে হচ্ছিলো শুধু একবার , একবার একটা সুযোগ ছেলেটা দেবে না ওকে ! কথা বলার সুযোগ ! আর একবার কাছে আসবে না ওর ! মানছে , ও অনেকদিন অনেক কঠিন হয়ে থেকেছে ! কিন্তু ভালোবাসতো বলেই তো অভিমানটা অতটা গাঢ় ছিল | রাগ কষ্ট , সব কিছু অতো বেশি ছিল ! কিন্তু ও কি সত্যি বলেছিলো চলে যেতে ! কৃষ্ণেন্দু বুঝলো না কেন , অভিমানের আড়ালে থাকা আসল কথাগুলো ! সেদিন এইসব ভাবনার মাঝেই চোখটা কিরকম ঝাপসা হয়ে আসছিলো দীপ্তির | জল জমছিল চোখে বার বার | মনে হচ্ছিলো , শুধু একটা ঠিকানা চাই ওর | যে করেই হোক , একটা ঠিকানা | যেখানে কৃষ্ণেন্দু আছে | সেদিন এই ভাবনার ভিড়েই হঠাৎ একটা বাস চলে গেলো ওর সামনে দিয়ে রাস্তায় | বাসটার ওপর বড়ো বড়ো করে লেখা বালিগঞ্জ, বেহালা , শ্যামবাজার , ধর্মতলা | দীপ্তি জলে ভেজা চোখে যেন আনমনেই নামগুলো পরে ফেললো সেদিন | তবে বালিগঞ্জ নামটা দেখে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা কথা মাথায় এলো হঠাৎ ওর | কৃষ্ণেন্দুর পুরোনো বাড়ি বালিগঞ্জে না ! ও ওর মা বাবার সঙ্গে তো ওখানেই থাকতো ! দীপ্তির মনে পড়ে গেলো , এক্সিডেন্টের পর যখন কৃষ্ণেন্দু খুব ডিপ্রেসড ছিল , তখনও কাউকে কিছু না বলে একলা একলা ওই ফাঁকা বাড়িটায় গিয়ে বসে থাকতো | কিন্তু তারপর তো প্রায় চোদ্দ পনেরো বছর কেটে গেছে | কৃষ্ণেন্দু যদিও ওর সামনে , মায়ের সামনে কখনো আর ওই বাড়ির কথা বলতো না কিছু ! কিন্তু এটা তো হতেই পারে , আজও সবার আড়ালে কৃষ্ণেন্দু ওই বাড়িতেই আছে | ভেবেছে এতো পুরোনো এড্রেস , কেউ আর মনে রাখবে না ! কথাটা ভেবেই দীপ্তি আবার যেন হাতে পায়ে শক্তি ফিরে পেলো | তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো ও | তারপর রাস্তার ভিড়ে একটা হলুদ ট্যাক্সি কোনোমতে দাঁড় করিয়ে বালিগঞ্জের ঠিকানাটা বলে উঠলো | এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে , এই ঠিকানাটাই হয়তো ওর শেষ আশা | এখানে গিয়েও যদি কৃষ্ণেন্দুকে খুঁজে না পায় , তাহলে হয়তো সত্যি হারিয়ে ফেলবে ছেলেটাকে | কথাটা মনে যেন বেহিসাবি ভাবে ভিড় করতে শুরু করেছে এখন | এই চলন্ত রাস্তাগুলোর মধ্যে যেন শুধু ওই চেনা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে আজ | মনে হচ্ছে দীপ্তি সত্যি কার থেকে পালাতে চাইছিলো এতদিন ! কাকে ভুলে থাকার জন্য শহর ছাড়ার কথা ভাবছিলো ! যে ওর মনে আছে , তাকে ! দীপ্তির ছায়ার মতন কৃষ্ণেন্দু | দীপ্তি পৃথিবীর যেই প্রান্তেই যাক , ওই শান্ত চোখের ছেলেটাকে যখন তখন দেখতে পাবে ও, চোখ বন্ধ করে , চোখ খুলে ! শুধু ছবিটা ভাসবে ওর সামনে | আজ যদি কৃষ্ণেন্দু এইভাবে হারিয়ে না যেত , তাহলে হয়তো এতো বড়ো সত্যিটা বোঝাই হতো না কখনো ! সারা জীবন একটা মিথ্যে চেষ্টা নিয়ে বেঁচে থাকতো দীপ্তি ! কৃষ্ণেন্দুকে ভোলার চেষ্টা | এই রাস্তার ভিড়ে যেন আনমনেই কথাগুলো মনে হলো ওর | আর এইসব চিন্তার মাঝেই ওই বেহালার গলিটার সামনে এসে ট্যাক্সিটা থামলো এখন | দীপ্তি আর অপেক্ষা না করে ভাড়া মিটিয়ে প্রায় দৌড়ে গেলো ওই অন্ধকার গলিটার ভেতরে | তারপর সেই পুরোনো রং ওঠা , সাদা , অন্ধকার , মৃতপ্রায় বাড়িটার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ | দীপ্তির এই মুহূর্তে যেন পা-টা আরেকবার অবশ হয়ে এলো | কৃষ্ণেন্দু এখানে আছে তো ! কথাটা ভেবে ও আস্তে আস্তে বাড়ির দরজার সামনে এগিয়ে গেলো | তবে এই মুহূর্তে হঠাৎ মনে যেন একটা সস্তি এলো কিরকম | দরজায় কোনো তালা দেয়া নেই | যদি কেউ বাড়িতে না থাকতো , তাহলে তো দরজাটা তালা বন্ধ থাকতো ! কথাটা ভেবেই দীপ্তি এবার ধাক্কা দিলো দরজায় | দু তিন বার ধাক্কাতেই বুঝলো দরজাটা ভেতর থেকে দেয়া | তার মানে ও যা ভেবেছিলো তাই | কৃষ্ণেন্দু এই বাড়িতেই আছে | কথাটা মনে হতেই একটু যেন শান্তি পেলো ভেতরে | কিন্তু দরজাটা সেই মুহূর্তে বার বার ধাক্কা দিলেও ভেতর থেকে যখন কেউ খুললো না , কোনো আওয়াজ এলো না , তখন যেন আরেকবার একটা হারাবার ভয় এসে জড়ো হলো মনে | দীপ্তি এই সময়ে কি করবে ভেবে না পেয়ে রাস্তা থেকে একটা ইট তুলে পাশের জানালাতে মারলো | কাঁচের টুকরোগুলো এতে ছন্নছাড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে | দীপ্তি এবার ওই ভাঙা কাঁচের জানলায় কোনো রকমে নিজের হাত ঢুকিয়ে ভেতরের ছিটকিনিটা খুললো | তারপর ওই খোলা জানলা দিয়েই ভেতরে ঢুকলো বাড়ির | কিন্তু এবার তো আরো থমকে গেলো ও ! পুরো বাড়ি ভর্তি অন্ধকার এখানে | একটা অদ্ভুত বদ্ধ গন্ধ চারিদিকে | ফার্নিচারগুলো অব্দি সব চাদর দিয়ে মোরা, ধুলোর আস্তরণে ঢাকা | এখানে কেউ থাকতে পারে না কি ! বছরের পর বছর মনে হয় এই বাড়িটায় কেউ আসেনি | কৃষ্ণেন্দু কি এর মধ্যে রয়েছে ! কথাটা ভেবেই যেন কিরকম আঁতকে উঠলো ও | না , আর দেরি করলে হবে না | দীপ্তি নিজের মোবাইলের টর্চটা অন করে এবার এই অন্ধকার বাড়িতেই চিৎকার করতে শুরু করলো প্রাণপনে | ‘কৃষ্ণেন্দু’ , ‘কৃষ্ণেন্দু’ বলে ডাকতে শুরু করলো নিজের সমস্ত গলার জোর দিয়ে | যদি ছেলেটার কানে ওর আওয়াজটা গিয়ে পৌঁছয় ! যদি একবার ওর ডাকে কৃষ্ণেন্দু সাড়া দেয় ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই ভেজা চোখে দীপ্তি এই অন্ধকার বাড়িটার ভেতরে এগিয়ে যেতে থাকলো এক পা এক পা করে | কিন্তু কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পরই ওর পা দুটো কিরকম আটকে গেলো | মোবাইলের আলোটা এই মুহূর্তে দূরে পড়ে থাকা কৃষ্ণেন্দুর ওপর কিরকম ঠিকরে পড়লো যেন ! একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে পড়েছিল কৃষ্ণেন্দু | একেবারে নিস্তেজ হয়ে | দীপ্তির দৃশ্যটা দেখে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো হঠাৎ | ও কৃষ্ণেন্দু বলে চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে ওই অন্ধকার ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকা কৃষ্ণেন্দুকে আঁকড়ে ধরলো | ওর নিস্তেজ শরীরটায় এখনো হালকা শ্বাস পড়ছে | দীপ্তি এটা খুব কাছে এসে বুঝতে পারলো | কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর হাত গুলো, শরীর সব ঠান্ডা হয়ে গেছে কিরকম | ও কি তার মানে অনেকক্ষণ ধরে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে এখানে ! কথাটা ভেবেই দীপ্তির যেন আর মাথা কাজ করছে না ঠিক | ও কৃষ্ণেন্দুর গালগুলোতে মারতে শুরু করলো হঠাৎ, ওর ঠান্ডা হাতটা ঘষতে শুরু করলো নিজের হাতে | বার বার নিজের মনেই ওকে ডেকে উঠলো এলোমেলোভাবে। ‘ কৃষ্ণেন্দু প্লিজ ওঠো ‘, ‘ প্লিজ চোখ খোলো, কথা বলো আমার সাথে ‘, কথাগুলো যেন অস্থির হয়ে বলে উঠলো দীপ্তি। কিন্তু এতো কিছু করেও কৃষ্ণেন্দুর কোনো সাড়া পেলো না আজ |
কিন্তু এই মুহূর্তে হঠাৎ ওর কৃষ্ণেন্দুর নার্ভের প্রব্লেমটার কথা মনে পড়ে গেলো | এতদিন এতো অভিমানের ভিড়ে ওর সত্যি এই নিয়ে কিছু মনে ছিল না ! হঠাৎ মনে হলো কৃষ্ণেন্দুকে মনে না করালো তো ও কোনোদিন নিজের ওষুধগুলো ঠিকভাবে খেত না ! আর এতদিন এতো টেনশন , এতো ঘটনার জন্য এমনিতেও ভীষণ স্ট্রেস গেছে| তাহলে কি সেইসব থেকেই এইভাবে সেন্সলেস হয়ে গেছে ছেলেটা ! না কি ও আর নেই ! কথাটা যেন না চাইতেও মনে এসে ধাক্কা দিলো দীপ্তির | অন্ধকার ঘরটা যেন আরো বেশি অন্ধকার হয়ে এলো এই মুহূর্তে |
না , এটা হতে পারে না | দীপ্তি আরেকবার কথাটা নিজের মনে বলে উঠলো | ডক্টর চ্যাটার্জি , কৃষ্ণেন্দুর নার্ভের ডাক্তার , উনি এখন কোথায় আছেন ! কোন নার্সিং হোমে ! ওনার কাছেই যেতে হবে | কথাটা ভেবেই দীপ্তি মোবাইলে ডক্টর চ্যাটার্জির নাম্বারটা ডায়েল করলো | তিনটে রিং হওয়ার পরই উনি ফোনটা ধরলেন , দীপ্তি এবার যেন কিছুটা এলোমেলো হয়েই বলে উঠলো ,
———- ” আপনি কোথায় আছেন এখন স্যার ? কৃষ্ণেন্দুর কোনো সেন্স নেই | আমি জানি না ও কখন থেকে সেন্সলেস | আমি বুঝতে পারছি না এখন কি করবো !”
ডক্টর চ্যাটার্জি কথাটা শুনে একটু অবাক হয়েই বললো , ———- ” সেন্সলেস ! কি হলো হঠাৎ ? ওষুধগুলো কন্টিনিউ করলে তো এরকম হওয়ার কথা না ! যাইহোক , তুমি তোমার এড্রেসটা আমায় এস.এম.এস করো | আমি লাইফ কেয়ার নার্সিং হোমে আছি | আমি এম্বুলেন্স পাঠাচ্ছি | ”
কথাটা শেষ হতেই দীপ্তি আর দেরি না করে ওর লোকেশনটা ম্যাসেজ করে দিলো ডক্টর চ্যাটার্জিকে | তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই এম্বুলেন্স এসে হাজির হলো বালিগঞ্জের বাড়িতে | এই মুহূর্তে দীপ্তি খুব শক্ত করে কৃষ্ণেন্দুর হাতটা ধরে বসেছিল যেন | এখন এই নিস্তেজ কৃষ্ণেন্দুকে দেখে কিরকম নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে ওর | মনে হচ্ছে প্রত্যেকদিন কৃষ্ণেন্দু একটু একটু করে কিরকম ফ্যাকাসে , ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলো দীপ্তির সামনে ! ও রোজ সেটা খেয়াল করতো অফিসে | কিন্তু একবারও সেই সময় মনে হলো না গিয়ে জিজ্ঞাসা করার কথা ছেলেটাকে ! কি হয়েছে ওর ! কেন এরকম উইক হয়ে যাচ্ছে দিন দিন ! এতো কিসের রাগ ছিল কৃষ্ণেন্দুর ওপর , যে এতটা অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো দীপ্তি ! কথাগুলো মনে হতে হতেই সেইদিন নার্সিং হোমে চলে এসেছিলো এম্বুলেন্স | এরপর ওই নীল সাদা পর্দা , ওষুধের ভিড়ে , স্যালাইনের চ্যানেল আর অক্সিজেন মাস্কের আড়ালে ঢেকে গিয়েছিলো ছেলেটা | দীপ্তির সেদিন হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ যেন কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলোই কানে বাজছিলো কেমন | তাহলে কাল এই চলে যাওয়ার কথাই বলছিলো ও ! এইভাবে পুরোপুরি সরিয়ে নেয়ার কথা লিখেছিলো চিঠিতে | যাতে না কৃষ্ণেন্দু কখনো কারোর কাছে যেতে পারে , না কেউ কোনোদিনও কৃষ্ণেন্দুর কাছে আসতে পারে ! কথাটা ভেবেই যেন থমকে গেলো দীপ্তি | চোখে অনেক পুরোনো স্মৃতি , পুরোনো ভালোবাসা , পুরোনো টান জল হয়ে এসে জমা হলো | এতগুলো বছর ধরে যাকে রোজ ভালোবেসেছে ও , তাকে আজ এইভাবে দেখতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ | শুধু মনে হচ্ছে একবার , যদি একবার কৃষ্ণেন্দু চোখ খুলে তাকাতো , ওর নিস্তেজ ঠান্ডা শরীরটায় আবার চেতনা ফিরে আসতো ! আরেকবার যদি দীপ্তি কৃষ্ণেন্দুকে আঁকড়ে ধরার সুযোগ পেতো , তাহলে কোনোদিনও আর যেতে দিতো না ওকে | আগলে রাখতো নিজের কাছে সেই পুরোনো সময়ের মতন | শক্ত করে ধরে থাকতো ওর হাতটা | সেদিন এই ভাবনাগুলোর ভিড়ে দীপ্তি চুপচাপ বসে পড়লো করিডোরের বেঞ্চটায় | ভেজা চোখ , এলোমেলো চেহারা , আর চারদিকে ছড়িয়ে থাকা একাকিত্বের আস্তরণে দীপ্তির মনে হচ্ছিলো এইভাবেই কি গল্পটা শেষ হয়ে যাবে ওদের ! আর ফিরে পাবে না ওই হাতটা ! আর ছুঁতে পারবে না ওকে ! সেদিন দীপ্তির এই একাকিত্বের আড়ালে আলো এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ | তখন রাত তিনটে বাজে | দীপ্তির আর ফোন করে খবর দেয়ার মতন অবস্থা ছিল না ঠিক | ডক্টর চ্যাটার্জিই আলোকে ফোন করে সবটা বলেছিলো | তারপর প্রায় রুদ্ধশ্বাসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনোরকমে একটা ট্যাক্সি ধরে ও লাইফ কেয়ার নার্সিং হোমে এসেছে | কিন্তু দীপ্তিকে এই মুহূর্তে করিডোরে এইভাবে একা বসে থাকতে দেখে আর রেগে থাকতে পারলো না মেয়েটার ওপর | আলো জানে , দীপ্তি আজ সকাল থেকে পাগলের মতন খুঁজেছে কৃষ্ণেন্দুকে | যেই ভালোবাসাটা এতদিন ওর মনে থিতিয়ে ছিল কোথাও , আজ কৃষ্ণেন্দুকে হারিয়ে সেই ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েছে দীপ্তি | সেই জন্যই তো এতো বড়ো শহরে , এতো লোকের মাঝে , এতো অলিগলির ভিড়ে ঠিক খুঁজে বার করেছে কৃষ্ণেন্দুকে | সেই জন্য আলো আজ দীপ্তির কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো শক্ত করে | কৃষ্ণেন্দুকে এইভাবে হসপিটালে পড়ে থাকতে দেখে যে দীপ্তি ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে , এটা আলো জানে |
সেদিন মা কে পেয়ে দীপ্তি হঠাৎ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল যেন | এতদিনের এতো জমা কষ্ট , নিজের ওপর রাগ , কৃষ্ণেন্দুকে হারানোর ভয় , সব কিছুর জন্য ডুকড়ে কেঁদে উঠেছিল ও মায়ের কাছে | আঁকড়ে ধরেছিলো মা কে শক্তভাবে | আলো সেদিন দীপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে গলায় বলে উঠেছিল , ———– ” সব ঠিক হয়ে যাবে | এবার সব ঠিক হবে | দেখিস |”
কিন্তু দীপ্তি বোঝেনি মায়ের কথা মিলবে কি না এরপর ! গল্পটা পূরণ হবে কি না আর ! তাই ভাঙা গলায় বলেছিলো সেই মুহূর্তে , ——— ” আমার তোমার কথা শোনা উচিত ছিল মা| কৃষ্ণেন্দু বদলে গেছিলো | ভীষণ বদলে গেছিলো | আমি জানি না কতক্ষন ধরে ও ওই বাড়িটায় পড়েছিল ঐভাবে ! আমি কখনো ওকে এইভাবে দেখবো ভাবিনি ! অন্ধকার একটা ঘরে , ওই নোংরা ফার্নিচারের মধ্যে , ধুলোর মাঝে ও পড়েছিল | আমি যদি না যেতাম মা ! তাহলে কি হতো ! তাহলে তো হসপিটাল টুকু আনারও আর দরকার হতো না ! ঐভাবে একা একা , সবার আড়ালে কৃষ্ণেন্দু শেষ হয়ে যেত ! কি করতাম তখন আমি! আর আজ যা কিছু হয়েছে, সব আমার জন্য হয়েছে। এত রাগ আমার! এই একটা মাস ছেলেটার সামনে থেকেও আমি ওর সাথে কোনো কথা বলিনি। ও রাতের পর রাত অফিসে থাকতো, বাড়ি ফিরতো না, ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া অব্দি করতো না। সেই সব জেনেও আমি চুপ ছিলাম! একবারও কাজের বাইরে কোনো কথাই বলিনি ! এমনকি কৃষ্ণেন্দু যদি কথা বলতেও আসতো, আমি ওকে থামিয়ে দিতাম। মুখের ওপর বুঝিয়ে দিতাম যে ওর কোনো অস্তিত্বই নেই আমার জীবনে! এতটা শাস্তি দিলাম আমি ওকে! এতটা! একবারও ভাবলাম না যে আমরা ছাড়া ওর কেউ নেই। ছেলেটাকে এতটা একা করে দিলাম আমি! কিভাবে! কিভাবে আমি এত বড় ভুল করলাম! ”
কথাগুলো বলতে বলতে নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল দীপ্তি। মনে হচ্ছিল যেন নিজের হাতে কৃষ্ণেন্দুর কাছে যাওয়ার সমস্ত রাস্তাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে ও। এবার হাজারবার ছেলেটার নাম ধরে ডাকলেও কেউ সাড়া দেবে না! কৃষ্ণেন্দু আর সত্যিই আসবে না কখনো ওর কাছে।
কিন্তু দীপ্তির কথাগুলো শুনে এবার আলোর চোখেও জল এসে জমা হয়েছিল | কিন্তু তাও এই মুহূর্তে দৃঢ় গলায়ই দীপ্তিকে বলেছিলো ও , ———— ” আমি জানি তোর ভুল হয়েছে | কৃষ্ণেন্দু প্রথমে ভুল করেছিল , আর তুই শেষে ভুল করেছিস | কিন্তু ভুল দুজনেরই ছিল | তবে তুই যখন ওকে খুঁজে পেয়েছিস আবার , তখন কৃষ্ণেন্দুও তোকে এতো সহজে ছেড়ে যেতে পারবে না ! এটা আমি জানি | আমি বলছি , সব ঠিক হয়ে যাবে | আবার আগের মতন হয়ে যাবে | কৃষ্ণেন্দু সুস্থ হয়ে যাবে। ”
না , দীপ্তি এরপর আর কিছু বলতে পারেনি মা কে | শুধু মায়ের বিশ্বাসটায় বিশ্বাস করেছিল নিঃশব্দে | কৃষ্ণেন্দু ওকে এই ভাবে মাঝ রাস্তায় একা রেখে চলে যাবে না | ঠিক ফিরে আসবে | দীপ্তি যেন জোর করেই কথাগুলো বলে উঠলো মনে মনে |

তবে এরপর প্রায় চব্বিশ ঘন্টা বাদে কৃষ্ণেন্দুর অল্প সেন্স এসেছিলো| ও ঘোরের মধ্যে দীপ্তির নামটাই বার বার ডেকে উঠছিল। সেই জন্য নার্স এসে দীপ্তিকে কৃষ্ণেন্দুর কাছে যেতে বলেছিল। দীপ্তি এরপর কিছুক্ষণের ভিড়ে কৃষ্ণেন্দুর কাছে যখন পৌঁছেছিল, ছেলেটার নিস্তেজ শরীর, ভীষণ ক্লান্ত ফ্যাকাসে মুখটাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কেমন। এই একটা দিনেই ছেলেটার কি অবস্থা হয়েছে! এই তো সেদিন সকালেও অফিসে কৃষ্ণেন্দু ঠিক ছিল। কথা বলছিল ওর সাথে। দীপ্তি জেনে শুনে ছেলেটাকে এতটা হার্ট করে ফেললো! সেদিন এই ভাবনার ভিড়ে দীপ্তি আলতো পায়ে কৃষ্ণেন্দুর কাছে এসে ওর হাতটা শক্ত করে ধরে ছিল। কৃষ্ণেন্দু এই মুহূর্তে আলতো করে চোখ খুলে অক্সিজেন মাস্কের ওপার থেকে বলেছিল জড়ানো স্বরে,
————–” তুই যাসনি? ”
আসলে ওর যেন মনে হচ্ছিল একটা স্বপ্ন দেখছে। চারিদিক আবছা হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।
দীপ্তি এই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠেছিল, ——” কোথাও যাইনি আমি। আর কখনও কোথাও যাবো না। তোমার সাথেই আছি। কিচ্ছু হবে না কৃষ্ণেন্দু তোমার। একদম ঠিক হয়ে যাবে। ”
কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা ধরে এসেছিল ওর কান্নায়। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু আবার কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। তবে এরপর ছেলেটার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল ভীষণ। দীপ্তির হাতটাকে শক্ত করে ধরে ও একটু শ্বাস নেয়ার জন্য ছটফট করছিল একটা সময়ে। দীপ্তি এই মুহূর্তে নিজেও যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিল কিরকম। সুস্থ ছেলেটার এ কি অবস্থা করলো নিজের রাগ অভিমানে অন্ধ হয়ে গিয়ে! একবার ফিরে তাকালো না! একবার কৃষ্ণেন্দুর এই ফ্যাকাসে চেহারা খেয়াল করলো না! একবার নিজে থেকে জিজ্ঞেস করলো না, কেমন আছো!

সেদিন এই ভাবনার ভিড়ে দীপ্তি সেই পুরো সময়টা কৃষ্ণেন্দুর সাথেই ছিল। ইচ্ছে করে ভীষণ শক্ত করে হাতটা হাতটা ধরে রেখেছিল কৃষ্ণেন্দুর | আসলে ভয় হচ্ছিলো আজ | মনে হচ্ছিলো দীপ্তি এই হাতটা ছেড়েছিলো বলেই তো আজ ওরা দুজনে এইরকম একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে , যেখানে কৃষ্ণেন্দু ঠিকভাবে শ্বাস টুকু অব্দি নিতে পারছে না ! একটা অক্সিজেনের মাস্ক ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে ! এরপর যদি হাতটা ছেড়ে দেয় , তাহলে আর থাকবে না কৃষ্ণেন্দু | তাই নিজের সবটা দিয়ে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল ছেলেটাকে| কিন্তু এসব ভাবনার মাঝেই অবশেষে ছেলেটা একটু স্টেবল হয়েছিল। প্রায় দেড় দিন কঠিন লড়াই এর পর শ্বাসকষ্ট কমেছিল। জ্ঞান এসেছিল।
কিন্তু এই অন্ধকার থেকে চোখ খুলে ছেলেটা সেই মুহূর্তে দীপ্তিকে দেখে কেমন থমকে গিয়েছিল যেন ! আসলে ওই অন্ধকার বদ্ধ ঘরটা ছাড়া আর কিছুই মনে ছিল না ওর | সেদিন অফিস থেকে সোজা ওদের সেই পুরোনো বাড়িটায়ই তো গিয়েছিলো | শরীর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছিলো এরপর | জল তেষ্টা পাচ্ছিলো ভীষণ | তবে ও ইচ্ছে করেই নিজের ফোনটা সুইচ অফ করে দিয়েছিলো সেই সময়ে | ভাবছিলো এইভাবে আস্তে আস্তে পুরোপুরি একা হয়ে যেতে যেতে যদি এখন মৃত্যু নেমে আসে চোখে , তাহলেই বেঁচে যাবে| আসলে এই অন্ধকার , এই ধুলোময় বাড়ি , এই একলা জীবনই তো ওর সত্যি | যেই দুটো মানুষ ওর নিজের ছিল , ওকে আগলে রেখেছিলো , আজ তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে | এমন কি শহর ছেড়ে চলে যাবে বলে ঠিক করেছে | শুধু ওকে যাতে আর দেখতে না হয় তাই | এরপর তো আর কিছু নেই বাকি ! আর এইভাবে বাঁচতে পারবে না ও | এইভাবে অনেকের ভিড়ে আর একলা হয়ে থাকতে পারবে না | তাই ইচ্ছে করেই লাস্ট দু মাস ধরে নার্ভের ওষুধগুলো খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো নিজের | যদিও এতদিন একটু হলেও আশা ছিল ! দীপ্তি ঠিক ওর কাছে ফিরবে | ওর হাতটা ধরবে | হয়তো ওকে এইভাবে শেষ হতে দেবে না ! কিন্তু কালকের রেজিগনেশন লেটার , ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার খবরটা যেন কৃষ্ণেন্দুকে ভেতর থেকেই শেষ করে দিলো হঠাৎ | এমনিই কদিন ধরে শরীর খুব খারাপ ছিল | তবে কাল যেন আর উঠে দাঁড়ানোর মতনও শক্তি ছিল না ওর | তাই কোনোরকমে ওদের পুরোনো বাড়িটায় পৌঁছে কৃষ্ণেন্দু যেন নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলো আস্তে আস্তে | ওই একাকিত্বের ভিড়ে , অন্ধকারের মধ্যে কখন যে ও চোখ বন্ধ করেছিল , ঠিক মনে নেই | তবে এই মুহূর্তে এইসব ছাড়া যেন কিছুই ঠিক আর ভাবতে পারছে না ! ওই অন্ধকার ঘর ছেড়ে মনে মনে বেরিয়ে আসতে পারছে না কৃষ্ণেন্দু! তবে দীপ্তি ওর এইসব ভাবনার ভিড়ে এসে হাতটা ধরলো হঠাৎ এই নিঃস্তব্ধতায়। তারপর ভাঙা গলায় বললো,
———— ” তুমি গেলে কেন ওই বাড়িতে ঐভাবে !আর তোমার শরীর এতটা খারাপ ছিল, তারপরেও ফোনটা সুইচ অফ করেছিলে কেন ? আমি যদি ঠিক সময়ে খুঁজে না পেতাম তাহলে !”
কথাগুলোকে আর যেন ঠিকভাবে শেষ করতে পারলো না দীপ্তি; তার আগেই গলাটা ধরে এলো ওর কান্নায়। তবে খেয়াল করলো কৃষ্ণেন্দু চুপ এখনও। কিছু যেন বলার নেই ওর! শুধু চোখ দুটো জলে ভর্তি। দীপ্তি বুঝলো এতগুলো দিন ধরে এত কঠিন থাকার ফল এটা! কৃষ্ণেন্দুকে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলেছে ও। এত দূরের করে রেখেছে দিনের পর দিন যে ছেলেটা আজ এইভাবে চুপ হয়ে গেছে ওর সামনে। কথাটা ভেবেই দীপ্তি আবার বলে উঠলো,
—-” প্লিজ কৃষ্ণেন্দু, আর চুপ থেকো না! প্লিজ কিছু একটা বলো। আমি জানি, আমি এতদিন ধরে অনেক বেশি হার্ট করে ফেলেছি তোমাকে! কিন্তু প্লিজ, এর জন্য এইভাবে চুপ হয়ে যেও না!”
কথাগুলো বলতে বলতে দীপ্তি এবার কেঁদে ফেললো কেমন। কৃষ্ণেন্দু সেটা দেখে একটু সময় নিয়ে নিজের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে কিছুটা স্থির গলায় বললো,
—-” আমি ফিরতে চাইনি আর! সত্যি। আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম, মা বাবার কাছে! আসলে আর একা থাকতে ইচ্ছে করছিল না। আর পারতামও না এতগুলো ভুল নিয়ে বেঁচে থাকতে! তাই ইচ্ছে করেই ওই বাড়িটাতে! ”
কথাগুলো শুনে দীপ্তি ঠিক কি বলবে বুঝতে পারেনি! তবে কৃষ্ণেন্দু যে আর বাঁচতে চায় না, সেটা বুঝেছিল ভীষণভাবে। তাই সেই মুহূর্তে ওর কথার মাঝেই হঠাৎ জড়িয়ে ধরেছিল কৃষ্ণেন্দুকে খুব শক্ত ভাবে। শব্দহীন হয়ে বলতে চেয়েছিল
‘ ভালোবাসি ‘ ।
কৃষ্ণেন্দু এই মুহূর্তে এই স্পর্শটা পেয়ে কেমন অবাক হয়ে গেছিল যেন! যেই দীপ্তি এতদিন ধরে এত দূরে সরিয়ে রেখেছিল ওকে, সে আজ নিজে থেকে কেন কাছে এলো! কেন আঁকড়ে ধরলো হঠাৎ! কথাটা ভাবতেই দীপ্তি এবার নিজের মনেই বলে উঠেছিল কৃষ্ণেন্দুকে,
—–” কোন ভুল নেই তোমার! কিচ্ছু হয়নি। সব কিছু সেই আগের মতনই আছে। আমি, মা আমরা আছি তো তোমার সাথে! বিশ্বাস করো, তুমি একা নও। আর আমরা আবার একসাথে থাকবো। আর কখনো একা হবে না তুমি! আমি কোনদিন আর রাগ করবো না! কোনদিন কথা বন্ধ করে থাকবো না! আই প্রমিজ.. কিন্তু তুমি প্লিজ আর এইসব কথা বোলো না কখনো! প্লিজ এতটা হার্ট কোরো না আর নিজেকে, প্লিজ!”
কথাগুলো বলতে বলতে দীপ্তি কান্নায় ভেঙে পড়লো সেই মুহূর্তে। কৃষ্ণেন্দুর এবার স্তম্ভিত ফিরলো যেন! আসলে এই মেয়েটাকে এইভাবে কাঁদতে দেখলে আজও ওর সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায় কেমন। তাই নিজের কষ্টগুলোকে ভুলে গিয়েই কিছুটা ঘাবড়ে বলে উঠলো,
———– ” তুই কাঁদছিস কেন এইভাবে ? মরিনি তো ! দ্যাখ , ঠিক আছি | আচ্ছা সরি | আমার ভুল | আমি গেছিলাম ওই বাড়িতে , কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে তাই | রিয়ালি সরি | ”
দীপ্তি এসব শুনে কৃষ্ণেন্দুর হাতটা আরো শক্ত করে ধরে ভেজা গলায়ই বলে উঠলো , ——— ” না , আমি সরি | আমি অতোটা রুডলি ব্যবহার করেছি বলেই যেতে বাধ্য হয়েছিলে তুমি | আমার ভুল | আসলে আমি পুরোনো কথাগুলো , পুরোনো ঘটনাগুলো এতো বেশি করে মনে রেখেছিলাম ! সেই জন্য নতুন করে কিছু যেন ভাবতেই পারতাম না ! ”
কৃষ্ণেন্দু এই কথার উত্তরে ওর চোখের জলটা আলতো করে মুছিয়ে দিয়ে বললো কিছুটা স্থির গলায় , ———— ” পুরোনো ঘটনাগুলো তো ভোলার মতন ছিলও না দীপ্তি | আমি যদি তোর জায়গায় থাকতাম , আমিও হয়তো পারতাম না | ”
দীপ্তি এই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে নিস্পলক দৃষ্টিতে বলে উঠলো , ———— ” কেন এরকম হলো কৃষ্ণেন্দু ! কেন আমরা দুজনে দুজনের সাথে এরকম করলাম ! এতটা কষ্ট দিলাম ! কাল যদি কিছু একটা হয়ে যেত তোমার ; আমি কি করতাম তাহলে ! আমিও আর বাঁচতাম না! কাল সারাদিন ধরে পুলিশ স্টেশনে, হসপিটাল গুলোতে, এমনকি মর্গে অব্দি যেতে হয়েছে! আমার মনে হচ্ছিল আমি নিজের ভুলের জন্য হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে! আর কোনদিন তোমাকে দেখতে পাবো না! কথা বলতে পারবো না! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল দীপ্তি কেমন অস্থির ভাবে। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু ওর মুখে এই শেষ কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিয়েছিল সেদিন। আসলে বুঝতে পেরেছিল দীপ্তির ঠিক কতটা কষ্ট হয়েছে কাল, কৃষ্ণেন্দুকে ওই অবস্থায় দেখে! তাই ওর মনটাকে একটু হালকা করার জন্যই দু সেকেন্ড চুপ থেকে একটু জোর করে হেসে বলে উঠেছিল ,
———- ” হয়নি তো কিছু আমার | আর আমি জানি , আমি মাটির নিচে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলেও , তুই ঠিক আমায় মাটি খুঁড়ে খুঁজে বার করতিস | আর দুজনেই ভুল করেছি যখন , তখন কাটাকুটি হয়ে গেছে | এরপর একসঙ্গে ঠিক কাজটা করবো |”
কথাটা শুনে দীপ্তি এবার নিজে থেকেই বলে উঠেছিল আলতো স্বরে,
——” আমরা নতুন করে আবার সব কিছু শুরু করতে পারি না কৃষ্ণেন্দু? বিয়ে করে একটা নতুন জীবনের শুরু!”
কথাটায় কৃষ্ণেন্দু এবার সত্যি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল যেন! দীপ্তির মুখের কথায় ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না ওর; সেই জন্য নিজের মনেই আরেকবার জিজ্ঞেস করে ফেললো,
—–” সত্যি! তুই সত্যি নিজের পুরো লাইফটা আমার সাথে কাটাতে চাস?”
এই প্রশ্নে দীপ্তি চোখে জল নিয়েই বললো,
—–” হ্যাঁ। আমি সব সময় তোমার সাথে থাকতে চাই। সারাক্ষণ।”
কথাটা শুনে কৃষ্ণেন্দু এই মুহূর্তে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো দীপ্তি কে। এতদিনের সমস্ত দূরত্ব ভেঙে আগলে ধরলো ওকে ভীষণভাবে।
দীপ্তির মুখেও এবার হাসি | এতক্ষণের কালো মেঘ কাটিয়ে মিষ্টি একটা হাসি | মনে হলো যেন অনেকদিন বাদে হঠাৎ অনেক রং নিয়ে একটা রামধনু এসে দেখা দিয়েছে ওর সামনে | এতো ভুলের পর , এতো বৃষ্টির পর , একটা নীল আকাশ ধরা দিয়েছে ওর কাছে | এক ঝাঁক রোদ এসে যেন জমা হয়েছে সেখানে | এই মুহূর্তে আলোও করিডোর থেকে কেবিনের মধ্যে এসে হাজির | কৃষ্ণেন্দু আর দীপ্তিকে আগের মতন হাসতে দেখে আলোর মুখেও একটা হাসির রেশ এখন | ও জানতো , কেউ কাউকে না হারালে তার থাকার গুরুত্বটা হয়তো এইভাবে বোঝে না | এই হারিয়ে যাওয়ার পর একে অপরকে ফিরে পেয়ে কৃষ্ণেন্দু আর দীপ্তি কখনো সেই পুরোনো ভুলগুলো আর করবে না | কথাটা ভেবেই আলো এগিয়ে গেলো ওদের দিকে | কৃষ্ণেন্দুরও ফ্যাকাসে মুখটায় আলো মা কে দেখে একটা অদ্ভুত শান্তি এলো যেন | আলো এবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো চুপচাপ | চোখটা হঠাৎ ভিজে এলো যেন কৃষ্ণেন্দুর অজান্তেই | এই স্পর্শটাই তো কতদিন ধরে মনে করতো ও ! এই মানুষটাকে তো নিজের মায়ের মতনই ভাবে | তাই খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো হাতটা আবার |

এরপর ভিড়ে ঠাসা কলকাতা শহরে আবার বসন্ত নেমে এলো কেমন | ঝরা পাতার ভিড়ে , দুটো মন এক হয়ে গেলো যে! আর এক ফাল্গুনে মালা বদল , সিঁদুর দান , সাত পাকে বাঁধা সবটাই হলো | আর একটা হারিয়ে ফিরে পাওয়ার গল্প পরিণতি পেলো |

—————— ( সমাপ্ত ) ———————-