#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓[২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ২৮
চারিদিকে রোদের উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে। সময়টা চৈত্র মাসের শেষের দিকে। তার মধ্যে বিরাজ করে ভিড় ভাট্টা। ভিড় দেশের একটা নিত্তদিনের সমস্যা হলেও ভিড়টা মোটেও তেমন নয়। ফাইনাল ইয়ারে পরীক্ষা। আয়ান আর ইশরা পরীক্ষায় অংশ নিতে এসেছে। মেইন প্রবেশদ্বারের বাইরে এমন ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইশরার পেট বেশ ফুলে উঠেছে। সাত মাসের সময় ফুলে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র দিয়ে নিজের উঁচু পেট টা ঢেকে নিল ইশরা। তবুও চারদিকের লোকজন কেমন বাঁকা চোখে তার দিকে অবলোকন করছে। সেই দৃষ্টিতে বিরাগী ইশরা। শুধু লোকদের উপর সে বিরক্ত নয়, আয়ানের উপরও। এতো উঁচু পেট নিয়ে কিছুতেই সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু তার কথনগুলোকে তোয়াক্কা করলো না আয়ান। ইশরা ফোঁস করে দম ছাড়লো। সে এখন আয়ানের বাহুডোরে। ভিড় ঠেলে ঠুলে ভেতরে এগিয়ে গেল আয়ান। মনুষ্যত্ব হীন মানসিকতার মানুষের মাঝে জ্ঞান বিচক্ষণ মানুষ গুলোও রয়েছে। তারা সরে দাঁড়ালো সামনে পথ থেকে। ঢিলেঢালা পথ দিয়ে নিমিষেই অতিক্রম করতে পারবে সেই পথ।
ফাঁকা ভার্সিটির মাঝে ইশরা আয়ানকে অনায়াসেই প্রবেশ করার অনুমতি প্রদান করা হলো। ইশরাকে বসিয়ে দিল তার কাঙ্খিত জায়গায়। আয়ানের সিট অন্যক্লাসে। প্রয়োজনীয় পানিসহ জিনিসপত্র ইশরার কাছে দিয়ে নিজের আসন গ্ৰহন করলো আয়ান।
ঘড়ির কাঁটা তখন পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে অবস্থান করছে। প্রথমে ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারলেও পরে ব্যর্থ হলো ইশরা। শরীরটা খারাপ লাগছে তার। ভেতরটা অস্থির অস্থির লাগছে। ইশরাল অবস্থা উন্নতির চেয়ে অবনতি লক্ষ্য করা গেল। খবর পৌঁছে দেওয়া হলো আয়ানের নিকট। ইশরার এমন অস্থিরতার সংবাদ আয়ানের কাছে পৌঁছাতেই পরীক্ষা ফেলে ছুটে এলো সে। ব্যাগ থেকে দুটো ট্যাবলেট আর পানির বোতল বের করে ইশরাকে খাইয়ে দিলো।
মাঝখানে কেটে গেল অনেকটা সময়। আয়ানের বুকে মাথা রেখে কলম চালাচ্ছে ইশরা। অনুগ্রহ হলো পরীক্ষায় অর্ধায়নরত প্রোফেসরের। ইশরা আয়ানের ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি। আয়ানের পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন ইশরার ক্লাসে।
সবই ভালোই চলছিলো। ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হয়ে পরীক্ষা শেষ হলো। তবে বিপত্তি ঘটল অন্য জায়গায়। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে হসপিটালের যাওয়ার উদ্দেগ হলো তারা। ইশরার অস্থিরতা না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই আয়ানের। সাথে ড্রাইভার নিয়ে এসেছিল। গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে গ্লাসে নক করলো কোনো রমনী। আয়ান কাঁচ খুলে দিলো। ৪২৯ ডিগ্রি বোল্ডের শখ খেল সে। সেই পূর্ব পরিচিত মুখ, কন্ঠস্বর, এটিটিউট, কথা বলার ধরণ। হাতের মাঝে কাঁচের চুড়ি গুলো রিনিক ঝিনিক বাজছে। হাত নাড়িয়ে ক্রমাগত বলে চলেছে..– “আয়ান আমার কথাগুলো শোন তুমি!”
আয়ানের একবার দৃষ্টি গোচর হতেই নয়নজোড়া সরিয়ে নিল। কাঁচ বন্ধ করে দিল। বিনিময়ে কাঁচে আঘাত করলো। অসন্তুষ্ট হয়ে পুনরায় কাঁচ নামিয়ে বলল..
— “কি চাই এখানে?”
— “আমাকে একটু লিফট দিবে আয়ান? প্রচন্ড দরকারী।”
আয়ান সামনের দিকে ঝুঁকে দরজা খুলে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে ঢুকলো দিবা। একসময় এই গাড়িতে দিবা যা ইচ্ছে তাই করতো আর আজ ঢুকতে পার্মিশন নিতে হচ্ছে। এটাই হয়তো নিয়তি।
দিবা ফন্ট সিটে বসলো। পেছনে ইশরার দিকে একবার নজর বুলিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পেটের দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। হয়তো এটাই নিয়তি, আজ ইশরার জায়গায় তার থাকার কথা ছিল।
গাড়ির গতি বাড়তে শুরু করলো ধীরে ধীরে লাগল। একসময় গাড়ি থেকে নেমে গেল দিবা। কিন্তু আয়ান ইশরার মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তিটি গেল না। প্রায় প্রায়ই তাদের মাঝে কারণে অকারণে ঝগড়া হতো। অভিমান করতো ইশরা। আয়ান তাকে বকতো আবার তার অভিমান ভাঙিয়ে দিতো। দিনগুলো ভালোই চলছিল। ইশরার তখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। মন খারাপ করে বসে ছিল ইশরা। আয়ানের কাছে তার ছোট আবদার ছিলো, আজকে বাইরে ঘুড়তে যাওয়ার। কিন্তু ছোট আবদার টা অপূর্ণ রেখে অফিসের কাজে চলে গেছে আয়ান। তাই নিজের অবুঝ মনের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে ইশরা।
নদীর তীরে পাঁচ ফুট প্রশস্ত ব্রিজ অবস্থিত। সেই ব্রিজের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছে ইশরা। শীতের হাওয়া গুলো আঁচড়ে পড়ছে শরীরে। জায়গাটা মোটামুটি নিরিবিলি। মনে খারাপের সময় নিরিবিলি পরিবেশ বেশ ভালো লাগে তার। হাতে গোল আলুর চিপস্। আসার সময় ফুটপাত থেকে কিনে এনেছে। অনেক দিন পর খেতে বড্ড ইচ্ছে করল তার। ব্রিজের রেলিং এ হাত রেখে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ালো ইশরা। বড় বড় লঞ্চ, ইস্টিমার যাচ্ছে বিধায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে। তার এই ভাবনার পথে চোখ আটকে গেল নির্জন গাছের ঝোপঝাড়ে। পেছন থেকে একটি ছেলেকে একদম আয়ানের মতো লাগছে। আয়ানের এখানে আসার কারণ বুঝতে ব্যর্থ হলো সে। কয়েক কদম এগিয়ে গেল সেদিকে। এবার সিউর হলো ছেলেটি আর কেউ নয় আয়ান। এক মুহুর্তের জন্য হাঁসি ফুটলেও মিলিয়ে গেল পরক্ষণে। তার পাশে লাল জামা পরিহিতা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরো কিছুটা এগিয়ে যেতেই অভিমানে জমানো পাহাড়-টা শিলায় পরিনত হলো। ব্যালেজ হারিয়ে গেল শরীরের। পাশের সবুজ শেওলা জন্মানো গাছটি ধরে সামলে নিল। বিনিময়ে হাত থেকে খসে পড়লো পার্সব্যাগটা। মৃদু শব্দে ধ্যান ভাঙল দুজনের। ফিরে চাইলো ইশরার দিকে। এমন নির্জন জায়গায় ইশরাকে অনুমান করতে পারে নি আয়ান। আয়ানের অবাক চাওনিতে দূর্বল হাসলো ইশরা। নয়নজোড়া তখন ছলছল করছে। কাতর কন্ঠস্বর নিয়ে বলল..
— “স্যরি, আমি জানতাম না, এখানে তোমরা আছো। তাহলে ভুলেও এদিকটায় আসতাম না।”
উল্টো হাঁটা ধরলো ইশরা। পা দুটো বরফের কাঁচার মতো ঠেকছে ইশরার কাছে। যাকে গতিশীল করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভব হচ্ছে না তার দ্বারা। তবুও কিছুটা দূরে গেল। আয়ান ছুটল ইশরার পিছুপিছু। ইশরার শক্তিহীন হাতটা ধরে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু থামলো না ইশরা, ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। এবার নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে প্রশ্ন ছুঁড়ল আয়ান..
— “ইশু কি হয়েছে তোমার? এই অবস্থায় এখানে কি করছো তুমি?”
— “এমনিই এসেছিলাম। আগেই তো স্যরি বলেছি আয়ান।”
— “কি সব বলছো তুমি ইশু? তুমি যেটা মিন করছো, আমি তেমন কিছু বুঝাতে চাইনি। আমি বোঝাতে চাইছি, এই অবস্থায় তুমি বাড়ি থেকে কেন বের হয়েছো? যদি কিছু হয়ে যেত?”
তাচ্ছিল্যের হাসলো ইশরা। কষ্টগুলো চাপা রেখে বলল..
— “আমার কিছু হলে তোমার কোনো যায় আদোও আসতো আয়ান? বরংচ খুশি হতে তুমি। আচ্ছা বলো তো, আয়রাকে জন্ম দিতে চেয়ে কি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধ করে ফেলেছি?”
— “কিসব বলছো তুমি ইশু?”
— “মিথ্যা বলছি বুঝি? তাহলে কোথায় গেল তোমার সেই কেয়ারিং গুলো? কেন আমার উপর দয়া করছো? এই মেয়েটাকে বিয়ে করে নিলেই পারতে। শুধু শুধু কেন রক্ষ..
আর উচ্চারণ করতে পারল না ইশরা। ভুবন ভোলানো চড় পড়লো ইশরার গালে। অধর কামড়ে ধরলো ইশরা
হয়তো এটাই তার প্রাপ্ত। পরক্ষণেই দৃঢ় বাঁধনে মুড়িয়ে নিল আয়ান। উঁচু পেটে কারণে পুরোপুরি পারল না, তবে যতোটা সম্ভব হয়েছে ঠিক ততোটা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কাঁধে বিন্দু বিন্দু জলকণা পড়তেই হুস ফিরলো আয়ানের। ইশরাকে ছাড়ল। নয়নজোড়া মুছিয়ে দিল। আদুরে গলায় বলল..
— স্যরি ইশুপাখি, আম স্যরি। এভাবে প্লীজ বলো না। আমি সহ্য করতে পারি না। আমার কাছে তুমিই সব।
ছাড়িয়ে নিল ইশরা। বলল..
— “হয়তো কখনো বাসতে, তবে তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে পাহাড় সমান অভিমান রয়েছে। যেগুলো বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।
বলতে পারবে, পরীক্ষার পর কবে তোমার সাথে মন খুলে কথা হয়েছিলো। কবে একটু সময় দিয়েছিলে আমাকে? গভীর রাতে বাড়িতে ফিরতে। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে। খাবার খাইয়ে দিয়ে ঘুমাতে বলতে। সকালে ঘুম থেকে জাগার পর তোমাকে আর কোথাও দেখতাম না আয়ান, টেবিলের উপর খাবার সাজানো থাকতো। নিজের কাজ সেরে দুপুরে আন্টি এসে খাবার দিয়ে যেত, আয়রার কথা ভেবে খেয়ে নিতাম। তার সাথে তেমন কথা হতো না। বাবা অসুস্থ তার সেবা করতে করতে মায়ের কথা বলার সময় হয়ে উঠে না। মাঝে হয় সপ্তাহে একবার। কোথাও ঘুড়তে নিয়ে যেতে চাইতে না। এভাবে একাকিত্বে কাটত দিনগুলো। তোমাকে বাধ্য করা কেয়ারিং গুলোতে বিরক্ত হয়ে গেছিলাম। খেয়ে দেয়ে চুপ করে শুয়ে থাকতাম। কিন্তু ঘুমাতাম না, অভিনয় করতাম। কিন্তু তুমি বুঝতে না। অভিনয় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তাম। বালিশ ভিজে যেত আমার। ঘরের বাইরে বেরুনো বন্ধ। আমার জীবনটা একটা জেলখানার সমান হয়ে গেছে।
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)
#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::২৯
ঘন কালো অন্ধকারে আবৃত হলো বিকেলের মেঘমুক্ত আকাশ। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগলো ধীরে ধীরে। ইশরার কষ্টে সঙ্গি হতে এসেছে তারা। ইশরাও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে শব্দহীন কাঁদছে।
আয়ান মাথা নত করে রইলো। ইশরা অভিযোগ গুলো তাকে পিড়া দিচ্ছে। নিজের কাজকে গুরুত্ব দিতে দিতে প্রিয় মানুষটির প্রতি অবহেলা করেছে। বৃষ্টির ফোঁটা কিছুটা বাড়তেই হুস ফিরলো তার। কাতর কন্ঠস্বর নিয়ে বলল..
— “ইশু বৃষ্টি হচ্ছে, বাড়িতে চল। ভিজে যাচ্ছিস।”
— “একটু ভিজতে চাই আয়ান। জলকণার সাথে নিজের কষ্টগুলো বিসর্জন দিতে চাই। জ্বর আসুক, কাতর করে দিক আমাকে। দিক..
বিনিময়ে হাত জোড়া শূন্যতায় মেলে দিল ইশরা। আয়ান কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অতঃপর ইশরার বাহু চেপে ধরলো! হালকা কন্ঠে বলল..
— “ইশু জেদ ধরিস না। চল এখান!”
ধীরে ধীরে আয়ানের হাতটা বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিল। আয়ানের নয়নে নয়ন যুগল বন্ধ করে কাতর কন্ঠে বলল..
— “শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরবে আমায়? শেষবারের আবদার..
আয়ান দৃঢ় বাঁধনে জড়িয়ে নিল ইশরাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো..– “আম স্যরি, ইশুপাখি।”
ধীরে ধীরে হাতের বাঁধন আলগা করে সরে এলো তার। আয়ানের হাতটা মুঠোয় পুড়ে নিল ইশরা। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরে ছেড়ে দিলো হাতখানা। এগিয়ে গেল ব্রিজের রেলিং এর কাছে। দম বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল..
— “ক্ষমা করে দিস আয়ান। নিজের সাথে প্রিন্সেসকে সাথে নিয়ে গেলাম। ভালো থাকিস, যত্ন নিস।”
আয়ানের সবটা বোধগম্য হতে বেশ সময় পেতে হলো। কিন্তু তাল আগেই ঘটে গেল অঘটন। রেলিং এর উপরে উঠে ঝাঁপ দিলো। শেষ মুহূর্তে আয়ান ইশরার হাত ধরে ফেলল। একহাত রেলিং এ ঠেকিয়ে অন্যহাত দিয়ে পেঁচিয়ে নিল ইশরাকে। কিন্তু আভিমানী ইশরা, সে তোয়াক্কা করলো না। আয়ানের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আয়ান যেন দূর্বল হয়ে পড়ছে ক্রমশ। বলল..
— “ইশু কি করছিস তুই? আমার হাতটা ছাড়িস না। আমাকে এই পৃথিবীতে একা করে হারিয়ে যাস না। এতো শাস্তি আমার প্রাপ্ত নয়। আমি সবটা তোকে খুলে বলল। প্লীজ ইশু..
ইশরার কর্ণপথে আয়ানের আর্তনাদ পৌঁছালো না। সে নিজের কাজে ব্যস্ত। আয়ান অসহায় হয়ে পড়লো। শেষ চেষ্টা হিসেবে বলল..
— “ইশু এমন করিস না। আয়রা আমাদের সন্তান, ভালোবাসার অস্তিত্ব। তুই কিভাবে পারবি আমাদের অস্তিত্ব শেষ করে দিতে। মা হয়ে এমন সার্থপর হস না, ইশুপাখি।”
ইশরার হুস ফিরল। অনুসূচনায় পূর্ণ হলো সে। মা হয়ে কিভাবে নিজের সন্তানকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো। আয়ানের অপর পাশে জড়িয়ে ধরলো। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা একটা মেয়ের ওজন আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো নয়। তিন গুন ওজন বেড়ে যায়। আয়ানের কষ্ট হয়ে গেল। হাতজোড়া বারবার ছুটে যাচ্ছে। ইশরা রেলিং এ হাত ঠেকালো। পা ঠেকালো ব্রিজের উপর। আয়ান ইশরার হাত পেঁচিয়ে ধরে হোসফোস করতে করতে বলল..
— “আয়ান, প্লীজ আমাকে তোল। আমি আমার প্রিন্সসকে পৃথিবী দেখাতে চাই। তার কাছে অপরাধী মা হতে পারবো না।”
ইশরা আয়ানের কাঁধে হাত রাখলো। আয়ান ইশরার কোমর জড়িয়ে উঠিয়ে নিয়ে আসলো ঠিকই কিন্তু বিপত্তি ঘটল অন্য জায়গায়। নিভে যেতে বসেছিলো আয়ানের অস্তিত্ব।
আয়ান নিজের ব্যালেন্জ হারিয়ে ফেললো। আচম্বিতে বিকট শব্দে ইশরার মাথা গিয়ে বাড়ি খেল রেলিং এর সাথে। রেলিং এ বাড়ি খেয়ে আবার পেছনের রেলিং এ আঘাত খেল। অতঃপর মাটিতে পড়ে পেটে আঘাত পেল। দুহাতে পেট চেপে আর্তনাদ করে উঠলো সে। মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। পেটের ভেতর থেকে ক্রমাগত ছোট আয়রা আঘাত করে চলেছে। চুল চেপে ধরলো সে। বিরবির করে মৃদু শব্দে আয়ান আয়ান বলে চেঁচিয়ে উঠলো।
আয়ান ছুটে এলো ইশরার দিকে। ইশরার এমন অবস্থায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। ভেতরকার শক্তি সঞ্চয় করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। কাঁপা কাঁপা হাতজোড়া মাথায় রাখল। চাঁপা কন্ঠে বলল..
— “ইশু, এই ইশুপাখি। কষ্ট হচ্ছে তোর।”
পরক্ষণেই হাত ধরে টেনে বুকে জড়িয়ে নিল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আয়ান। ইশরার নয়নজোড়া গ্ৰথণ তখন যন্ত্রনাদায়ক কাতরে। বিরবির করে বলল..
— “আ-য়া-ন। প্রিন্সসকে প্লীজ বাঁচা। প্লীজ বাঁচা। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অপরাধী মা হতে চাই না। ”
আয়ান বুক থেকে সরিয়ে নিল ইশরাকে। পেটে আঘাতের ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত রক্ত ধারা বইতে শুরু করেছে। আয়ান সময় নিলো না। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার আগেই আয়ান উঠে দাঁড়ালো। হালকা ঝুঁকে ইশরাকে পাঁজাকোলে তোলে দৌড়াতে শুরু করলো। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে দৌড়াতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আয়ানকে। তবুও থামলো না সে।
হসপিটালের করিডোরে প্রানপণে দৌড়াচ্ছে আয়ান। তার কোলে জ্ঞানহীন অবস্থায় রয়েছে ইশরা। আয়ানের চিৎকারে লোকজন জড়োসড়ো হয়ে গেছে এক জায়গা। ইশরাকে নেওয়ার সাথে সাথেই অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে নেওয়া হলো তাকে। আয়ানের শার্টের বেশ খানিকটা অংশ রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে। বাকি অংশ বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লো আয়ান। বাড়িতে জানানো দরকার সবাইকে। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে ডায়াল করলো তিথির কন্টাক্ট নাম্বারে। রিসিভ হলো না। ব্যর্থ হয়ে তনয়ার ফোনে ডায়াল করল। রিসিভ হয়ে ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই বলতে শুরু করল..
— “ত-নু, ইশু। আমার ই-শু”
_______________
রাত তখন গভীর। বাইরের বৃষ্টির দেখা নেই। শান্ত পরিবেশ। বৃষ্টি পরে যেমন আবহাওয়া বিরাজ করে, ঠিক তেমন। করিডোরে বসে আছে সকলে। আয়ানের পড়নে সেই রক্তমাখা শার্টটা রয়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে সে। গুড়িয়ে গেছে। শক্ত শূন্যতায় ভুগছিলো ইশরা। অন্যদিকে মাথায় বুকে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। ইশরাকে বাঁচানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ডাক্তারের কাছে। ইশরাকে বাঁচাতে চাইলে ছোট আয়রাকে বাঁচাতে পারবে না। ইশরা বাঁচলেও ভবিষ্যতে এ কি হবে জানা নেই তাদের। ইশরার শেষ কথাটা ছিলো,
— “আ-য়া-ন। প্রিন্সসকে প্লীজ বাঁচা। প্লীজ বাঁচা। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অপরাধী মা হতে চাই না।”
তাই ইশরার ইচ্ছে পূরণ করতে বেবী কে বাঁচানোর চেষ্টা করছে ডাক্তার। অপারেশন থিয়েটারের উপরের লাল রঙের বাতিটা বন্ধ হয়ে গেল। আয়ান গতিহীন, অবশ পা-জোড়া টানতে টানতে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। বেরিয়ে এলো সবুজ ড্রেস পরিহিত এক জন ডাক্তার। কিছু জানার নেই তার। আয়ানের কাঁধে চপল মেরে ভেতরে যেতে বলল!
আয়ান দূর্বল পায়ে ভেতরে এগিয়ে গেল। ছোট একটা মেয়ে ইশরার পাশে শুয়ে আছে। শুভ্র রঙের কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে তাকে। আয়ান হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো সেখানে। একজন নার্স এসে ছোট প্রিন্সেসকে আয়ানের কোলে তুলে দিল। আয়ান এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল ছোট সোনার দিকে। অবিকল ইশরার মতো দেখতে সে। বড় বড় ডাগর ডাগর পাপড়ি যুক্ত আঁখি জোড়া দিয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ান নিজের তর্জনী আঙুল এগিয়ে দিতেই আদো আদো হাতে পেঁচিয়ে ধরলো প্রিন্সেস। খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সে। বাকি সবাই তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। একদম সেই হাঁসি। আয়ান অধর ছুয়ে দিল আয়রার ললাটে। দূর্বল কন্ঠে বলল..
— “ইশু এই ইশুপাখি। দেখ তোর আগে আমি প্রিন্সেসকে ছুঁয়ে ফেলেছি। তুই বকবি না।
আমি তো তোকে অপরাধ মুক্ত করে দিলাম। তাহলে কেন ফিরে আসবি না। ভালো থাকিস পাখিটা।
সত্যি টা একবার শুনে নাহয় আমাকে এতোবড় শাস্তি দিতি। মেনে নিতাম। কিন্তু নিঃস্ব করে কেন দিলি।”
আয়ান কেঁদে উঠলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। অম্বু ধারা গড়িয়ে পড়লো আয়রার হাতের উপর।
তারপরে কেটে গেছে কয়েকটা সেকেন্ড, কয়েকটা মিনিট, কয়েকটা মুহুর্তে, কয়েকটা দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর। আয়ান এখন আর কাঁদে না। খুব সুখে আছে তারা। প্রিন্সেসকে নিয়ে খুশি আছে সে। তবে মুখের সেই মায়াবী হাসিটা নেই। গম্ভীর থাকে সবসময়। সবার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে।
আয়রার পাঁচ বছর। স্কুলে পড়ে সে। তার স্কুলে যেমন খুশি তেমন সাজো, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে সে। তার পড়নে লাল রঙের ইশরার শাড়িটা। হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। নয়নে মোটা করে কাজল রেখা। মায়ের সমস্ত অলঙ্কার তার দখলে। আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো নিজেকে। তাকে দেখতে অবিকল ইশরার ছবির মতো। কিন্তু ইশরার মতো এতো উঁচু পেট নেই। ফোঁস করে দম ছাড়লো সে। সে মায়ের মতো সাজবে, মানে সাজবেই। কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করে একটা ওরনা মুড়িয়ে নিলো। সেটা পেটের ভেতরে দিয়ে এক লাফ দিল। পরক্ষণেই খুলে পড়ে গেল নিচে। ঠোঁট উল্টে বলল..
— “মাম্মা তুমি যদি থাকতে। তাহলে আমি তোমার কাছে জিজ্ঞেস করতাম যে তোমার এতোবড় পেটে কি কি আছে?”
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)