#অপরাজিতা
#১৯তম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
রাজিতা বের হয়ে যেতেই নিশাদ আনানকে বলতে লাগলো,
–“তুই রাজিতার থেকে ব্যাপারটা লুকোচ্ছিস কেন? দেখতে পাচ্ছিস না এই বিষয়টি নিয়ে ও কি পরিমাণ ঘাটাঘাটি করছে। সবটা জেনে গেলে তোকেই ভুল বুঝবে। সময় থাকতে সবটা ওকে জানিয়ে দে। এখনো দেরি হয়নি। পরে পস্তাতে হবে!”
নিশাদের কথাশুনে আনান বলল,
–“আমিতো ওকে এর আগে অনেকবার জানাতে চেয়েছি। কিন্তু ওর সামনে গেলেই ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। মনে হয় রাজিতা সবটা জানতে পারলে আমাকে ভুল বুঝবে! ”
–“ও কেন তোকে ভুল বুঝবে? তুই কাউকে ভালবাসতি! আর সে মারা গেছে! এতে তোর দোষটা কোথায়? ”
–“আমি কাউকে ভালবাসতাম এটা দোষের নয় হয়ত! সে মারা গেছে এটাও দোষের নয় হয়তো! কিন্তু..”
–“কিন্তু কি?”
–“সমস্যাতো একটাই! ওদের দুজনের চেহারায় অনেকটা মিল আছে! ”
–“আরে এতে প্রবলেটা কোথায়? বুঝিয়ে বলবি আমাকে?”
–“তুই কিছুই বুঝতে পারছিস না? সুবহা দেখতে রাজিতার মতো ছিলো, আর আমি সুবহাকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসতাম! এটা রাজিতা শুনে কি অতো সহজেই মেনে নিবে ভেবেছিস! ও এটা ভেবে বসে থাকবে যে, সুবহার মতো দেখতে বলেই আমি ওকে ভালো বেসেছি!”
–“সত্যিই কি তাই? না মানে সুবহার মতো দেখতে বলেই কি তুই রাজিতাকে বিয়ে করেছিস?”
–“নিশাদ! আর কেউ জানুক আর না জানুক! তুইতো জানিস যে, রাজিতাকে আমি কোন সিচুয়েশনে বিয়ে করেছি! তারপরেও তুই এটা কীভাবে বলতে পারলি!”
–“তুই আমার কাছেও লুকোবি? সত্যকে চাপা রাখতে হয়ন! কারণ তা নিজেই নিজের পথ খুঁজে নিয়ে একদিন না একদিন বেড়িয়ে আসে! ”
–“আমি মানছি যে, পা নষ্ট হওয়ার নাটকটা আমি রাজিতাকে পাওয়ার জন্যই করেছিলাম৷ হ্যাঁ, তখন সুবহার মতো দেখতে জন্যই আমি ওকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম! কিন্তু বিশ্বাস কর, এই কয়দিনেই আমি রাজিতাকে ভালবেসে ফেলেছি! সুবহার মতো দেখতে বলে নয়! আমি রাজিতাকেই ভালবেসে ফেলেছি! ও যখন আমার পাশে থাকে তখন মনে হয় পুরো পৃথিবীটাই আমার৷ ও যখন কথা বলে তখন মনে হয় যে, ওর এইকথা সারাজীবন শুনলেও একটুও বিরক্ত হবোনা। ওর মুখে হাসি দেখলে মনে হয় পুরো পৃথিবীটাই যেন আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে! আর ওর চোখে পানি দেখলে আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে! ”
–“তাহলে তুই ওকে সত্যিট কেন বলে দিচ্ছিস না?”
–“ভয়ে! রাজিতাকে আমি হারাতে পারবো না। সুবহাকে হারিয়েছি! এখন রাজিতাকে হারালে আমি বেঁচেই থাকতে পারবো না। সুবহার মৃত্যুর পর আল্লাহ হয়তো আমাকে রাজিতার জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছিলো! সুবহাকে হারিয়ে আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম! তুইতো দেখেছিস সব! ”
–“সব দেখেছি জন্যই বলছি। রাজিতাকে সব সত্যিটা বলে দে। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। ট্রাস্ট মি!”
–“আরে আমি কি কম চেষ্টা করেছি! কিন্তু রাজিতাকে হারানোর ভয় আমাকে কুড়ে-কুড়ে খায়! ওকে সবসময় চোখে-চোখে রাখি! মনে হয় যে,চোখের আড়াল হলেই বুঝি সুবহার মতো রাজিতাও আমার জীবন থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে। আর সুবহার কথা শুনলে ও হয়তো কাঁচের মতো টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে! আমি ওকে কোনো কষ্ট দিতে চাইনা! ”
–“কিন্তু ওর থেকে সত্যটা লুকিয়ে তুই আরো বড় ভুল করছিস! যেদিন ও পুরো সত্যটা জানতে পারবে সেদিন ও সত্য জানার থেকে বেশি কষ্ট কোনটায় পাবে জানিস?”
–“কোনটায় কষ্ট পাবে?”
–“তুই কাউকে ভালবাসতি সেটায় না যতটা কষ্ট পাবে, তারচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে এটা ভেবে যে, তুই ওর থেকে এতগুলো সত্য গোপন রেখেছিস!”
–“তুই আর আমি ছাড়া এই সত্যগুলো আর কেউ জানে না। বিলিভ মি! ”
–“কিন্তু তাই বলে তুই ওর কাছে গোপন রাখবি?”
কথাগুলো শুনেই আনান পাঁচ বছর আগের সময়টায় চলে গেলো….
নিশাদের এক কাজিনের বিয়েতে সুবহাকে প্রথম দেখে আনান। তখন সবে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স ভর্তি হয়েছে। সুবহাকে দেখেই আনান যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। সিঙ্গেল লাইফের অবসান ঘটাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিলো আনানকে। কারণ সুবহা অন্যান্য সাধারণ মেয়ের মতো ছিলো না। প্রেম-ভালোবাসা এসব নিয়ে ও ইন্টারেস্টেড ছিলো না। আর অনেক লাজুক প্রকৃতির ছিলো। কারো সাথে তেমন কথা বলতো না।
কিন্তু আনানের ভালবাসার কাছে হেরে গিয়ে সুবহাও আনানকে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু সেটা অন্যকাউকে জানাতে নারাজ ছিলো সুবহা। ও প্রেম করে শুনলে সবাই কি ভাববে! এটা ভেবেই গোপন রেখেছিলো ওদের রিলেশনশীপ।
চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে হতো আনানকে সুবহার সাথে। তারপরও ওদের সম্পর্কটা ভালই যাচ্ছিলো।
দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে যায়। সুবহার সাথে লুকিয়ে দেখা করাটা যেন আনানের নেশায় পরিণত হয়ে গেলো। আনানের ক্যাম্পাস থেকে সুবহার ক্যাম্পাস বেশি একটা দূরে ছিলো না জন্য প্রায় প্রতিদিন ওরা দেখা করতো।
সুবহা সব সময় একটাই স্বপ্ন দেখতো! আর সেটা হচ্ছে ওদের ভার্সিটিতে টিচার হিসেবে জয়েন করা। আনানের আবার টিচিং প্রফেশন অতোটা পছন্দ ছিলো না।
নিশাদ, আনান আর সুবহা ছাড়াও ওদের সম্পর্কটা আরো একজন জেনে যায়৷ আর সে ছিলো সুবহার একটা ফ্রেন্ড ফাহিম। ফাহিম ছিল অনেকটা দুষ্ট প্রকৃতির! সুবহার রিলেশন আছে শুনে ও সুবহাকে নিয়ে অনেক মজা করতে শুরু করে। ওর মতো চুপচাপ একটা মেয়েরও বয়ফ্রেন্ড আছে! এসব বলে হাসাহাসি করে। ফাহিম এটাও জানায় যে, ও সবাইকে জানিয়ে দেবে যে সুবহা ইন এ রিলেশনশিপ! আর তারপর থেকে ফাহিম সুবহাকে প্রচুর বিরক্ত করতো। যেখানে-সেখানে ফলো করতো। বিভিন্ন কথা শুনাতো! ওর আর আনানের ছবি তুলে সেগুলো দিয়ে সুবহাকে ভয় দেখাতো৷ যদিও ওদের তেমন কোনো ছবি ছিলো না যা লোকে দেখলে খারাপ ভাববে! তবুও সুবহা প্রচুর ভয় পেতো ফাহিমকে!
সুবহা চাইতো না যে, ওর ফ্রেন্ডরা কেউ ওর রিলেশন সম্পর্কে জানুক। খুব লাজুক টাইপের ছিলো। আনান ওকে অনেক বোঝায় যে, সবাইতো রিলেশন করে, সবাই জানে! ওদেরটা জানলেও কিছুই হবেনা! কিন্তু সুবহা তবুও মানতে চায়না!একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সুবহা যে এত সিরিয়াস হবে তা আনান কল্পনাও করতে পারেনি! তার উপর ফাহিমের বিরক্ত করা দিনদিন বাড়তেই থাকে!
সুবহার মৃত্যুর দিন আনানকে ফোন করে জানায় যে, ফাহিম ওকে ছাদে ডেকেছে, কি যেন বলবে। আনান ওকে মানা করে ফাহিমের সাথে দেখা করতে। ছেলেটাকে ওর সুবিধের মনে হয়না। কিন্তু সুবহা বলে যে, কিছুই হবেনা। সুবহা ফাহিমকে বুঝিয়ে বললেই শুনবে। কিন্তু সেইদিনের পর আনান আর সুবহার মিষ্টি কণ্ঠটা শুনতে পায়নি! ওর মিষ্টি মুখটা দেখতে পায়নি! সুবহার থেতলে যাওয়া মুখটিই আনানের স্মৃতির পাতায় সারাজীবনের জন্য সেটে যায়!
ফাহিমকে নিয়ে আনানের সন্দেহ ছিলো। তাই ফাহিমের নাম্বার যোগাড় করে পরিচয় গোপন রেখে আনান এটা বলে ধমকি দেয় যে, সুবহাকে যে ওই মেরেছে তা আনান জানে। ওকে এক লাখ টাকা দিলে প্রমাণগুলো ফাহিমকে দিয়ে দিবে।
আনানের ফোন পেয়ে ফাহিম ভয় পেয়ে যায়। ফাহিম এটাও জানায় যে, ও ইচ্ছে করে সুবহাকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়নি। কথা বলার এক পর্যায়ে ফাহিম সুবহার সাথে মজা করে যে, ওকে ছাদ থেকে ফেলে দিবে! কিন্তু সুবহা সেটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে ভয় পেতে থাকে। ওদের ছাদে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছিলো, আর সুবহা যেদিকে দাঁড়িয়ে ছিলো সেদিকে কোনো রেলিং ছিলো না। আর ভয় পেয়ে সুবহা পিছনে যেতে যেতে এতটাই পিছনে চলে যায় যে, যেখান থেকে ফেরার আর কোনো উপায় ছিলো না।
সুবহা পড়ে যেতেই ফাহিম তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে সরে পড়ে আর ভীড়ের মাঝে মিশে যায়। তাই ছাদে গিয়ে কেউ ওকে খুঁজে পায়না।
ফাহিমের কথাগুলো শুনেও আনান বিশ্বাস করতে পারে না।শেষমেশ ফাহিম জানায় যে আনানের সাথে দেখা করবে ও। আনানও রাজি হয়ে যায়। তবে ও জানায় যে, সুবহার যেখান থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে সেখানেই দেখা করবে!
ফাহিম নিজেই সিকিউরিটি গার্ডের থেকে চাবি নিয়ে আনানকে নিয়ে ছাদে চলে যায়। আনান মাস্ক পড়ে থাকায় ফাহিম প্রথমে ওকে চিনতে পারে না। কিন্তু একটু পরেই আনানকে চিনতে পারার পর ফাহিম আর আনানের মধ্যে তর্ক শুরু হয়ে যায়। সুবহার মৃত্যুর জন্য আনান ফাহিমকে দোষারোপ করতে থাকে৷ আর ফাহিম সেটাকে একটা দুর্ঘটনা বলে চেঁচাতে থাকে।
দুইজনের মধ্যে তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যায়৷ আনান ফাহিমকে ভয় দেখায় যে, সবাইকে জানিয়ে দেবে সেদিন সুবহার সাথে ছাদে ফাহিমও ছিলো৷ ফাহিম রেগে গিয়ে বলতে থাকে যে, সুবহাতো এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে, কিন্তু আনানকে ও নিজহাতেই মেরে ফেলবে! কেউ জানতেও পারবে না! সবাইকে এটা জানিয়ে দিলেই হবে যে, সুবহার আত্মহত্যা সহ্য করতে না পেরে সুবহার বয়ফ্রেন্ড ও সেইমভাবে আত্মহত্যা করেছে! বলেই হাসতে থাকে ফাহিম। আনান নিজেকে বাঁচাতে গেলে ফাহিম নিজেই নিচে পড়ে যায়!
ফাহিমকে নিচে পড়ে যেতে দেখে আনান ভীষণ ভয় পেয়ে যায়৷ সিকিউরিটি গার্ড ফাহিমের সাথে ওকে আসতে দেখেছে! ফাহিমের ফোনে ও কল করেছিলো! এগুলো ভাবতে ভাবতে ফাহিমের ফোনটা আনানের চোখে পড়ে। ফাহিমের ফোনটা হাতে নিয়ে আনান পালাতে থাকে।
সিকিউরিটি গার্ড শব্দ শুনে তার উৎপত্তি খুঁজতে থাকে। আর সেই সুযোগে আনান ওখান থেকে পালিয়ে আসে।
সিকিউরিটি গার্ড হয়তো নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে আনানের কথা গোপন রাখে। কারণ অতোরাতে তিনি কাউকে ছাদে কেন যেতে দিয়েছিলেন? এই প্রশ্নটার উত্তর উনার জানা ছিলো না। তারপর কারো ডেথ হয়ে গেছে! কেস যদি উল্টো উনার দিকেই আসে।আর নিউজে ফাহিমের বলা কথাগুলোই প্রকাশ হতে থাকে।
ফাহিমের মৃত্যুতে আনান এটা ভেবে প্রশান্তি পায় যে, সুবহার মৃত্যু যার জন্য হয়েছে সে আর এই পৃথিবীতে নেই!
আনান যেন প্রাণখুলে হাসতে ভুলে যায়, প্রাণখুলে কথা বলতে ভুলে যায়৷ সবসময় কেমন চুপচাপ থাকে৷ ওর মা-বাবা একমাত্র ছেলের ওইরূপ সহ্য করতে পারেনা। তখন নিশাদ উনাদের সবটা জানায়। সবটা জেনে উনারাও ভীষণ কষ্ট পায়!
আনান মাস্টার্স কম্পলিট করেই সুবহাদের ভার্সিটি মানে রাজিতাদের ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। নিজের জন্য নয়! সুবহার স্বপ্ন পূরণ করতে! পুরো দুইবছর কঠিন চেষ্টার পর আনান সফল হয়।
এরমধ্যে ওর বাবা-মা বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে, আনান রাজি হয়না। অবশেষে ওর বাবা ওর দাদুর শেষ ইচ্ছের কথা জানালে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আনান রাজি হয়ে যায়। মেয়েকেও দেখতে যায়না। ওর বাবাকে জানিয়ে দেয় যে, ওর দাদু যেহেতু ঠিক করে গেছেন যেমনি হোক ও বিয়ে করবে! ও বিয়েতে রাজি হয়েছে শুনে ওর বাবা-মা ভীষণ খুশি হন!
আনানের বিয়ে ঠিকঠাক হওয়ার দুইদিন আগে ওর ইন্টারভিউ ছিলো। আর ইন্টারভিউ দিয়ে ফেরার পথে ওর চোখে পড়ে রাজিতা। ক্ষণিকের জন্য ওর মনে হতে থাকে যে, ও সুবহাকে দেখতে পাচ্ছে! অনেক বছর পর ওর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে যা মিথ্যে নয়৷ একদম মন থেকে আসা প্রকৃত হাসি!
কিন্তু ওর মুখের হাসি নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। কেননা ও অলরেডি বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিয়েছে। রাজিতার খোঁজ নিয়ে যখন জানতে পারে যে, ও যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার-ই চাচাতো বোন রাজিতা। আনান তখন রাজিতা আর ওর পুরো পরিবারের খোঁজ খবর নেয়, কে কে আছে! কে কেমন! কিন্তু নিয়নের সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারেনা। কারণ ও দেশের বাইরে।
রাজিতাদের পুরো খোঁজ খবর নেওয়ার পর বিয়ের দিন আনান একটা রিস্ক নেয় রাজিতাকে পাওয়ার। আর পা নষ্ট হওয়ার নাটকটা করে যেন নিলা ওকে বিয়ে করতে মানা করে দেয়। আর নিলা মানা করে দিলে রিমি কখনো রাজি হবেনা, কারণ ও অলরেডি একজনকে ভালবাসে৷ তাহলে লাস্ট অপশন থাকবে রাজিতা! আনানও বিয়ে না করে আসবে না! আর পরিবারের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজিতা না করতে পারবে না!কিন্তু আনানের প্লানটা যে এভাবে কাজ করে যাবে তা ও ভাবতেও পারেনি! রাজিতাকে ও এত সহজেই পেয়ে যাবে! তাও আবার সারাজীবনের জন্য নিজের করে!
–“কি হলো? কিছুতো একটা বল। তুই না বলতে পারিস আমাকে বল! আমি ওকে পুরোটা বুঝিয়ে বলব! আমার বিশ্বাস, এখনও রাজিতাকে বুঝিয়ে বললেই ও বুঝবে। ”
নিশাদের কথায় অতীতের সাগর থেকে বর্তমানে ফিরে আসে আনান।
চলবে…….
#অপরাজিতা
#২০তম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
নিশাদের কথা শুনে আনান ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে এবং বলতে থাকে,
–“আমি রাজিতাকে পুরোটা বলতে পারি। কিন্তু পুরোটা শুনে ও যে আমাকে ভুল বুঝবেনা এর গ্যারান্টি কি তুই দিতে পারবি?”
নিশাদ কিছুটা আমতা-আমতা করে বললো,
–“দেখ আনান, আমার চেয়ে রাজিতাকে তুই বেশি চিনিস। এইকয়দিনে হলেও ওর সম্পর্কে তোর অনেকটা জেনে যাওয়ার কথা। তুই নিজেই ভেবে দেখ যে, এই কথাগুলো ও যদি তোর মুখ থেকে শোনে তাহলে কতটা কষ্ট পাবে! আর অন্যের মুখ থেকে শুনলে কতটা কষ্ট পাবে! একবার ভেবে দেখ! তাহলেই উত্তর পেয়ে যাবি!”
–“তুই বুঝতে পারছিস না নিশাদ! মাত্র ও একটা শকের মধ্য দিয়ে গেছে! এখন আরেকটা শক ও সামলাতে পারবে না! আচ্ছা আমাকে কয়েকটা দিন সময় দে, ওর মন ভালো হোক একটু, তখন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলবো!”
–“আঘাতের উপরে আঘাত দিলে সেটা বেশি ক্ষত নাও সৃষ্টি করতে পারে! কিন্তু মন ভালো হয়ে গেলে তুই এসব বলে ওর মন আবার খারাপ করতে চাচ্ছিস! আমারতো মনে হয় ও সুবহার মৃত্যুর ব্যাপারে সবটা জেনে গেছে। ওটাতো তখন একটা চাঞ্চল্যকর নিউজ ছিল! ফাহিমের মৃত্যুর পর আরো চাঞ্চল্যকর হয়ে উঠে। ঘটনাটা এ ভার্সিটির স্টুডেন্টদের জানা কোনো ব্যাপার-ই না। প্লিজ তুই ওকে যত দ্রুত সম্ভব বলে দে।”
–“আচ্ছা দেখা যাক৷ আর তোকে ধন্যবাদ হেল্প করার জন্য। রাজিতা নিলাকে জানাবে না, এটুকু ভরসা করতে পারিস।”
–“দেখ আনান, আজ আমি তোকে হেল্প করলাম ঠিক আছে৷ কিন্তু এই ঘটনার প্রভাব যদি আমার আর নিলার সম্পর্কের উপরে কোনো প্রভাব ফেলে আমি কিন্তু সেটা মেনে নিতে পারবো না। তোর মতো আমি অন্তত মিথ্যে কোনো বুনিয়াদের উপরে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইনা।”
–“ওকে। আমি কথা দিচ্ছি, যত দ্রুত সম্ভব রাজিতাকে সবটা সত্যি জানিয়ে দিবো।”
আনান কথাগুলো বলতেই নিশাদ যাওয়ার জন্য দরজা খুললো। কিন্তু দরজা খুলতেই নিশাদ পুরো পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লো! ওর হাত-পা যেন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
নিশাদকে হঠাৎ ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে আনান বললো,
–“কিরে! তুই ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? যাবি না?”
নিশাদ আনানের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে দরজার অপরপাশে থাকা মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,
–“তুমি? তুমি কখন এলে? নাকি তুমি যাওনি? তারমানে তুমি এতক্ষণ আমাদের সব কথা…..”
বলেই থেমে গেলো। আনানের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, নিশাদ কার সাথে কথা বলছে। আনান নিশাদের হাত সরিয়ে দরজাটা পুরোপুরি খুলে রাজিতার অশ্রুসিক্ত চেহারা দেখে চমকে উঠলো। নিশাদের মতো ও নিজেও বলে উঠলো,
–“তুমি……!”
রাজিতা কিছু বলতে যাবে তখন মালিহা কিছুটা দূর থেকে চেঁচিয়ে রাজিতাকে বলতে লাগলো,
–“কিরে তুই ক্লাসে আসছিস না কেন? স্যার ক্লাসে চলে এসেছে, তুই কল দিতে বলেছিলি, কল করছি তাও তুলছিস না! আরে ভাই ক্লাসটাতো অন্তত করবি!……ক্লাসের সময়টুকুও তাদের একসাথে থাকতে হবে! বাবারে ভালবাসা! আজকাল ক্লাস বাদ দিয়ে উনাদের ভালবাসা চলছে!”
শেষের কথাগুলো মালিহা আস্তে-আস্তে বললো। ও আরোকিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু পাশেই আনান আর নিশাদকে দেখতে পেয়ে চলে গেলো।
রাজিতা আনানের অফিসরুমের ভেতরে যেতেই নিশাদ চলে যেতে-যেতে বললো,
–“রাজিতা! তোমাকে শুধু একটা কথাই বলতে চাই, প্লিজ আনানকে ভুল বুঝোনা! ও তোমাকে অনেক ভালবাসে। ”
তারপর আনানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“আশা করি এখন আর এক্সট্রা সময় লাগবে না! আর কোনোকিছুই কিন্তু গোপন রাখবি না!”
কথাগুলো শেষ হতেই আনান বা রাজিতা কারো উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিশাদ দরজাটা ধাক্কা দিয়ে লাগিয়ে চলে গেলো।
এতক্ষণ রাজিতার ফোন ভাইব্রেট হয়ে যাচ্ছে অথচ নিশাদ বা আনান কেউ বুঝতেই পারেনি! রাজিতার ফোনটা আনানের টেবিলের উপর পড়ে আছে৷ রাজিতা ফোন নেওয়ার জন্যই আবার ফিরে এসেছিলো। আর ফিরে এসেই আনান আর নিশাদের কথাগুলো শুনতে পায়!
রাজিতা একটা কথাও বলছে না। ওর চোখ থেকে টপ-টপ করে পানি পড়ছে৷ কিন্তু কান্নার কোনো শব্দ হচ্ছে না। হাতের তালু দিয়ে যতবার চোখ মুছছে ততবার আবার গাল দুটো ভিজে উঠছে!
আনান কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ওর গলা শুকিয়ে গেছে৷ গলা ভেজানোর জন্য একটু পানি খেতে খেতে দেখতে পেলো যে রাজিতা টেবিলের উপর থেকে ওর ফোনটা হাতে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।
আনান তাড়াতাড়ি করে বললো,
–“দাঁড়াও! ”
রাজিতা দরজা খুলতে খুলতে বললো,
–“ফোনটা ফেলে রেখেই চলে গিয়েছিলাম। তাই ফোনটা নিতে এসেছিলাম। বুঝতে পারিনি তোমাদের পার্সোনাল আলাপ চলছিলো। বিরক্ত করার জন্য সরি!”
আনান রাজিতার হাত ধরে বলতে লাগলো,
–“রাজিতা প্লিজ! আমার পুরো কথাটা শোনো আগে৷ পুরোটা না শুনলে তুমি বুঝতে পারবে না!”
রাজিতা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে-যেতে বললো,
–“তোমার যা বলার পরে বলো। আমার ক্লাস আছে এখন।…..আর হ্যাঁ, আমার জন্য দাঁড়াতে হবে না। চলে যেতে পারো। আমি আজ ক্লাস শেষে ছোট-আম্মুদের ওখানে যাবো। মাকে ফোন করে বলে দিবোনে। ”
কথাগুলো বলেই আনানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রাজিতা বের হয়ে গেলো। আনান ধপ করে ওর চেয়ারে বসে পড়লো! ওর এখন কি করা উচিৎ না উচিৎ কিছুই বুঝতে পারছে না! রাজিতাতো ওর পুরো কথা শুনলোই না! কি করে পুরোটা বলবে!
রাজিতা ক্লাস শেষ করে বের হতেই দেখতে পেলো যে, আনান গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।রাজিতা কল্পনাও করতে পারেনি যে আনান ওর সাথে এমনটা করতে পারে। এতবড় সত্য ও রাজিতার থেকে কি করে লুকিয়ে রাখতে পারে! একবার অন্তত জানাতে পারতো পুরোটা৷ কিংবা ওর চাচাকেই সোজাসাপটা বলে দিতো যে, ও রাজিতাকে বিয়ে করতে চায়! নিলাকে নয়! তাহলেইতো রাজিতার সাথে ওর চাচি আর নিলার কোনো ভুল বুঝাবুঝি হতো না! আনান নিজে সবাইকে ধোঁকা দিয়েছে! নিজের বাবা-মা, রাজিতার পরিবার! রাজিতা! সবাইকে! ও এটা কি করে করতে পারলো! রাজিতা আস্তে-আস্তে আনানকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, আর তখনি ওর বিশ্বাসগুলো এভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দিলো!
এসব ভাবতে ভাবতে রাজিতা প্রায় আনানের সামনে চলে আসলো। কিন্তু আনানের সাথে কথা বলার বা ওর সাথে বাসায় যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই এখন রাজিতার নেই। ও ওর ফ্রেন্ডদের আড়ালে চলে গেলো যেন, আনান ওকে দেখতে না পায়। কিন্তু আনানের শকুনের চোখ এড়িয়ে বেশিদূর যেতে পারলো না রাজিতা।
আজ প্রথম আনান সবার সামনে থেকে রাজিতার হাত ধরে টানতে টানতে গাড়ি অব্দি নিয়ে গেলো। রাজিতার ফ্রেন্ডরা সব হাঁ করে ওদের দেখছে! আরো অনেকেই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাজিতা আনানের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। ও বুঝতে পারলো যে, সবার সামনে সিন ক্রিয়েট করাটা ঠিক হবেনা।
আনান নিজেই রাজিতাকে বলেছিলো যে, ক্যম্পাসে যেন ও আনানের থেকে একটু দূরে-দূরেই থাকে, কিন্তু আজ আনান নিজেই সেই রুলস ভঙ্গ করলো৷
রাজিতা চুপচাপ গাড়িতে উঠার পর ড্রাইভার গাড়ি ছাড়তেই রাজিতা ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“মিজান ভাই, আজ একটু চাচ্চুদের ওখানে যাবেনতো। আমার একটু দরকার আছে৷”
রাজিতার কথাশুনে আনান বলল,
–“না ! তুমি সোজা বাসায় চলো। আজ আর ওখানে যেতে হবেনা। ওখানে পরে গেলেও হবে।”
তারপর রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“তুমি আগে আমার পুরো কথাটা শোনো, তারপর তোমার যদি মনে হয় যে তুমি আমার সাথে যাবেনা, সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আজ তোমাকে আমার পুরো কথাটা শুনতেই হবে। প্লিজ!”
রাজিতা আনানের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল,
–“মিজান ভাই! গাড়ি থামান। আমি এখানেই নেমে যাবো। ”
বলেই গাড়ির দরজা খুলতে গেলে বাধ্য হয়ে মিজান গাড়ি থামালো।
গাড়ি থামাতেই রাজিতা দরজা খুলে বের হয়ে গেলো। আর আনানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“এই দুই-তিন দিন থেকে সারপ্রাইজ পেতে পেতে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আরো নতুন কোনো সারপ্রাইজ পেলে হয়তো আমার মাথাটা ফেটে যাবে! আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ! তোমার যা বলার পরে বলো। আমি এখন আর কোনো লোড নিতে পারছি না মাথায়!”
বলেই হনহন করে রাজিতা ওর চাচার বাসার দিকে হাটা শুরু করলো।
আনান মনে-মনে নিশাদকে গালি দিতে লাগলো। কারণ ওই বলেছিলো যে, আঘাতের উপরে আঘাত দিলে নাকি ওটা বেশি লাগেনা! কিন্তু আঘাতের পর বারবার আঘাত দিলে যে সেটা ভেঙে চুরচুর হয়ে যায় এটা বোধহয় ওর জানা ছিলো না।
রাজিতাতো চলে গেলো! আনান এখন কি করবে? রাজিতার পিছুপিছু ওর চাচার বাসায় যাবে? নাকি ওকে এখনকার মতো একা ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে যাবে? এসব ভাবতে থাকে। তখনি মিজান বলে উঠল,
–“উনার সাথে আপনার যাওয়া উচিৎ। একা-একা গেলে সবাই কি ভাববে!”
মিজানের কথা শুনে আনান যেন কূল খুঁজে পেলো! গাড়ি থেকে নেমে মিজানকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে রাজিতার পিছু যাওয়া শুরু করলো।
মিজানও গাড়িটা ওদের সাথে-সাথেই একটু-একটু করে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।
রাজিতা বুঝতে পারলো যে, আনান ওকে কথাগুলো না বলে শান্তি পাবেনা। রাজিতার পিছনে-পিছনে ওভাবে আনানের আসাটা দেখে অনেকেই ওদের দিকে উদ্ভট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ রাজিতার নিজের কাছেও অস্বস্তি লাগছে।
রাজিতা হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর পিছনে ফিরে আনানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“চলো, কোথাও একটা বসা যাক। তারপর তোমার সব কথা শোনা যাবে।”
রাজিতার কথায় আনান ওইরকম পরিস্থিতিতেও খুশি হয়ে গেলো৷ যেন গ্রীষ্মের দাবদাহের পর একফোঁটা বৃষ্টি পেয়েছে! রাজিতা ওর সাথে কথা বলতে রাজি হয়েছে!
আশেপাশে তেমন কোনো জায়গা দেখতে না পেয়ে আনান বলল,
–“চলো কোনো রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাক। তোমারতো ক্ষুধাও পেয়েছে নিশ্চয়ই। কিছু খেয়ে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় সব বলা যাবে।”
আনানের প্রস্তাবটা রাজিতার মন্দ মনে হলো না। কারণ আসলেই ওর ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে! আনান না বললে হয়ত বুঝতেই পারতো না। খাবারের কথা শুনতেই ক্ষুধাটা যেন আরো বেড়ে গেলো। সব কষ্ট সহ্য করতে পারলেও রাজিতা আবার ক্ষুধার কষ্টটা একদম সহ্য করতে পারেনা!
–“আচ্ছা ঠিক আছে। ”
বলেই রাজিতা আনানের সাথে গিয়ে গাড়িতে বসলো। তারপর ওরা পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে গেলো।
খাবার অর্ডার দেওয়া শেষ হলে রাজিতা এতক্ষণে আনানকে বলল,
–“আমি জানিনা তোমার আর বলার মতো কি আছে! তুমি বুঝতে পারছো না যে, তুমি শুধু আমাকে নয়, সবাইকে ঠকিয়েছো!”
আনান আশেপাশে লোকজন আছে দেখে একটু আস্তে করেই বলল,
–“দেখো রাজিতা এত লোকজনের মধ্যে মনে হয়না কথাটা তুমি ভালমতো বুঝতে পারবে। বাসায় চলো, ঠান্ডা মাথায় সব শুনবে।”
রাজিতা মলিন একটা হাসি দিয়ে বলল,
–“বাসা! কার বাসা! কিসের বাসা! ওসব কি আদৌ আমার প্রাপ্য! ”
–“প্লিজ রাজিতা! লোকজনের মধ্যে কোনো সিন ক্রিয়েট করো না। আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলতে চাই।”
–“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কোনো সিন ক্রিয়েট করবো না৷ তার আগে তুমি আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও।”
–“বলো, তুমি কি জানতে চাও। আজ আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো!”
–“তুমি নিলা আপুকে কেন ধোঁকা দিলে? ”
–“আমি কীভাবে নিলাকে ধোঁকা দিলাম? ”
–“তুমি আমাকে বিয়ে করবে না সেটা চাচ্চুকে বললেই পারতে। এতো নাটকের কি দরকার ছিলো?”
–“তখন তোমাকে দেখে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম! কি করব না করব বুঝতে পারছিলাম না। আর বিয়ের একদিন আগে এসে যদি আমি কনে চেঞ্জ করতাম তুমি নিজেই আমাকে মেনে নিতে না। বলো তুমি মেনে নিতে ব্যাপারটা? যে ছেলে তোমার আপুকে বিয়ে করতে চায় সে বিয়ের আগের দিন এসে যদি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সেটাকে তুমি কীভাবে নিতে?”
রাজিতা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো,
–“তাহলে সেদিন-ই আমাকে জানিয়ে দিতে। ”
–“তাহলে আজ হয়ত তোমার সাথে আমি কথাগুলো বলতেই পারতাম না। আমাকে বিশ্বাসতো দূরে থাক! আমার কোনো কথাই শুনতে না।”
–“এখন কি মনে হয়? আমি তোমার সব কথা শুনবো?”
–“আগে শোনো, তারপর বলো। আমি নিশাদকে যা বলেছি সেটুকু শুনে তুমি আমার বিচার করতে পারো না! পুরোটা শুনে তারপর তুমি আমার বিচার করো। তারপর তুমি আমাকে যা শাস্তি দেবে আমি তা হাসিমুখে মেনে নিবো! শুধু আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে যেও না। প্লিজ! আমি তোমাকে ছাড়া হয়তো বেঁচে থাকবো! তবে ভালো থাকবো না! প্লিজ রাজিতা!”
ততক্ষণে ওদের অর্ডার করা খাবার চলে এসেছে। রাজিতা খাওয়া শুরু করতে করতে বলল,
–“আমি খাওয়া শেষ করার আগেই তুমি তোমার সব কথা শেষ করবে৷ তারপর আমি দেখবো যে,তোমার কথাগুলো কতটা বিশ্বাসযোগ্য!”
“আচ্ছা” বলেই আনান রাজিতাকে সব বলতে শুরু করলো। একদম সুবহার সাথে দেখা হওয়ার শুরু থেকে রাজিতার সাথে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত!
আনানের কথাগুলো শুনে রাজিতা খাওয়া বাদ দিয়ে দিলো। পুরোটা শুনে রাজিতার খুব খারাপ লাগলো। তুচ্ছ একটা কারণে দু-দুটি জীবন অকালে ঝরে পড়েছে! সাথে আরেকজনের জীবনটাও তছনছ করে দিয়েছে। সুবহার মৃত্যু না হলে হয়তো আনান আজ রাজিতার সামনে এভাবে অপরাধীর মতো বসে ক্ষমা ভিক্ষা করতো না! সুবহা, ফাহিম আর আনান! তিনজনের জন্যই রাজিতার খুব কষ্ট হচ্ছে। সুবহার জায়গাটা ও দখল করে নিয়েছে ভাবতেই একদিক থেকে ওর খারাপ লাগলো, অন্যদিক থেকে আজ প্রথম রাজিতার নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মেয়ে মনে হলো যে, আনানের মতো এমন একজনকে ও জীবনে পেয়েছে!যে ওকে এতটা ভালবাসে! কিন্তু আনান এতদিন ওকে সত্যটা বলেনি ভাবতেই সব গলে যাওয়া পানিগুলো আবার বরফ হয়ে জমে গেলো৷ এতগুলো সত্য লুকানোর শাস্তিতো আনানকে পেতেই হবে! বিশেষ করে ওর চাচি আর নিলার সাথে যে ব্যবহার করেছে তার শাস্তিও পাওয়া উচিৎ! কারণ এখানে আনান এতগুলো সত্যি না লুকালে হয়তো উনারা আনান আর রাজিতার সাথে সেদিন ওমন ব্যাবহার করতো না।
রাজিতাকে চুপ থাকতে দেখে আনান বলতে লাগলো,
–“এখনতো পুরোটা শুনলে! এখনো কি মনে হয় পুরো দোষটাই আমার? নাকি পুরো দোষটাই কাউকে অনেক বেশি ভালবাসার? বলো?”
রাজিতা আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারি। তবে একটা শর্তে!”
–“কি সেই শর্ত? বলো? আমি তোমার ক্ষমা পাওয়ার জন্য যেকোনো শর্তে রাজি আছি!”
–“ছোট আম্মু আর নিলা আপুর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে৷ তারা যদি আপনাকে ক্ষমা করে তাহলেই আমি ক্ষমা করব!”
–“কিন্তু তুমি এখানে উনাদের টেনে আনছো কেন? উনারাতো তোমার খারাপ চায়?”
–“হ্যাঁ,টেনে আনছি! কারণ, উনারা আমার ভালো না চাইলেও খারাপ হয়তো চায়না! তবে প্রকৃতপক্ষে দেখতে গেলে উনাদের ধারণাটাইতো ঠিক ছিলো! আমার জন্যইতো তুমি নিলা আপুকে বোকা বানিয়েছিলে! তাই না? উনাদের বুঝিয়ে বললে হয়তো প্রথমে রাজি না হলেও পরে বুঝে-সুঝে যা করার করতো! পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না।আমার সাথে উনাদের সম্পর্ক হয়তো এতটাও খারাপ হতো না, যতট এখন হয়েছে! তাই আগে উনাদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিন! তারপর আমি ক্ষমা করব!”
কথাগুলো বলেই রাজিতা ওখান থেকে উঠে চলে গেলো৷
আনান ঠায় ওখানে বসে রইলো। রাজিতা ওর চাচি আর নিলাকে এরমধ্যে কেন আনছে তা ওর মাথায় আসছে না। ও বুঝতে পারছে না যে, উনাদের কাছে ও এখন কীভাবে ক্ষমা চাইবে! আবার ক্ষমা না চাইলে রাজিতাওতো ক্ষমা করবে না! আনান বুঝতে পারছে না যে, ওর এখন কি করা উচিৎ! আর কি করা উচিৎ নয়!
চলবে…..