#অপরাজিতা
#২২তম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
রাজিতা ফ্রেস হয়ে ওর শাশুড়ীর রুমে গিয়ে দেখলো যে, উনি লাইট অফ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়েছে ভেবে দরজা চাপিয়ে চলে আসছিলো তখন ওর শাশুড়ী কথা বলে উঠল,
–“কে? রাজিতা? কখন আসলি তোরা? আয় ভেতরে আয়।”
রাজিতা লাইটটা জ্বালিয়ে বললো,
–“মা,এইতো একটু আগেই আসলাম। আপনার শরীর ভালো আছেতো? না মানে এই সন্ধ্যার দিকে শুয়ে আছেন যে৷ ”
তিনি শুয়া থেকে উঠে বসলেন। তারপর রাজিতাকে কাছে ডেকে বললেন,
–“হ্যাঁ, আমি ভালই আছি। তুই নেই আর বাসাটা ফাঁকা লাগছিলো। এইসময়টাতো তুই ছাড়া কাটতেই চায়না! অথচ আগে কি সুন্দর সময় কেটে যেতো। মানুষের অভ্যাসগুলো যে কখন পাল্টে যায় তা সে নিজেও বুঝতে পারেনা।”
রাজিতা উনার পাশে বসে পড়লো।
–“কিরে, তোর মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন? কিছু হয়েছে?”
–“না, একটু চাচ্চুদের ওখানে গিয়েছিলাম।”
–“তা ওখানে সবাই ঠিক আছেতো? ”
–“হ্যাঁ, সবাই ভালই আছে। এমনিই দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
–“হুম, মাঝেমধ্যে একটু যাবি, দেখবি ভালো লাগবে৷ আনানকেওতো বলে দিয়েছি যে, তোকে নিয়ে যেন মাঝেমধ্যে কোথাও একটু ঘুরতে যায়৷ আসলে ওর ঘুরাঘুরির অভ্যাস নেইতো! তুই বললেই পারিস কোথায় যাবি না যাবি। ”
–“আমিও তেমন একটা কোথাও ঘুরাঘুরি করিনা। ”
–“কেন? তোরও কি আনানের মতো ঘুরাঘুরি পছন্দ নয়?”
–“না, তা নয়৷ ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু…”
–“কোনো কিন্তু নয়, তোর সামনের পরীক্ষাটা শেষ হলেই দুজনে কোথাও থেকে ঘুরে আসবি। আনানকে এর আগেও বলেছি যে, মেয়েটাকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আয়৷ এই ঝামেলা! সেই ঝামেলা লেগেই আছে। এইবার পরীক্ষা শেষ হলে যতই ঝামেলা থাক, দুজনে কোথাও থেকে ঘুরে আসবি।”
–“আচ্ছা ঠিক আছে। আমাদের সাথে আপনিও যাবেন তাহলে। বাবাওতো আপনাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যায়না!”
–“পাগলী মেয়ের কথা শোনো! তোদের সাথে আমি গিয়ে কি করবো! আর আমার কি এখন ঘুরাঘুরির বয়স আছে! বল! তোদের-ইতো সময় ঘুরাঘুরির!”
রাজিতা ওর শাশুড়ীর আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
–“আচ্ছা মা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
–“বল। আমি না বলেছি, আমাকে নিজের মা ভেবে সব কথাই শেয়ার করতে পারিস।… মনটা খারাপ? আনান কি আবার কিছু বলেছে?”
–“না, তেমন কিছু নয়৷ আচ্ছা মা, আমি যদি আমার অতীতের কোনো বড় ঘটনা লুকিয়ে রাখি, আর সেটা এখন আপনাকে বলি, আপনি কি আমাকে ক্ষমা করবেন?”
–“কেন? কি হয়েছে? ”
–“না, আগে বলুন আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন কিনা?”
–“ক্ষমা করার মতো ভুল হলে অবশ্যই ক্ষমা করবো।”
–“আর যদি ক্ষমা করার মতো না হয়?”
–“তুই আমাকে মা হিসেবে যদি তোর অপরাধের কথা বলতে পারিস, মা হিসেবে আমি কি মেয়েকে ক্ষমা না করে পারি! আর মানুষ মাত্রই ভুল করে৷ কিন্তু প্রকৃত মানুষতো সেই যে তার অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, আর ভবিষ্যতে সে ভুল না করে।তুই যখন কাউকে মন থেকে ভালবাসবি তখন তার ঠিক-ভুল সব মেনে নিয়েই ভালবাসতে হবে। ধর, কাল তুই ভুল করেছিলি! আজ আমি ভুল করলাম! এটাইতো নিয়ম না? আজ যদি আমি তোকে ক্ষমা না করি, কাল আমি ভুল করার পর কি তোর থেকে ক্ষমার আশা করতে পারব?… আচ্ছা, এইবার বল তুই আমার থেকে অতীতের কি এমন লুকিয়েছিস? যা আমি ক্ষমা করতে পারব না!”
ওর শাশুড়ীর কথাগুলো শুনে রাজিতার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। আসলেইতো! ওতো এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি! একজন মানুষের অতীত নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি না করে বর্তমানটাকে গুরুত্ব দিতে হবে! আনান ওকে ভালবাসত কিনা সেটা বড় কথা নয়! কিন্তু এখন ও রাজিতাকে ভালবাসে কিনা সেটাই বড় কথা! আনানের সাথে যে ওর সারাজীবনের বন্ধন! এটাকে ও চাইলেও সহজেই ছিন্ন করতে পারবে না! ওর চাচার কাছে বা যেখানেই যাক না কেন দিনশেষে ওকে যে একজন প্রিয় মানুষ খুঁজে নিতেই হবে! যার সাথে ও মন খুলে কথা বলতে পারবে!সারাজীবন থাকতে পারবে! সবসময় পাশে পাবে! একা-একা যে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়না!
–“কিরে বল! আমি কথা দিচ্ছি, তুই যে ভুল-ই করে থাকিস না কেন আমি চাইবো তোকে ক্ষমা করে দিয়ে নতুন করে গ্রহণ করে নিতে!”
–“আসলে আমি দেখছিলাম যে, আপনি আমাকে কতটা ভালবাসেন৷ আমার এমন কোনো অতীত নেই, যা আপনাদের থেকে লুকাবো। আপনি কিছু মনে করেননিতো?”
–“পাগলী একটা! আমি জানতাম আমার রাজিতা এমন কিছু করতেই পারে না! ”
তিনি আরোকিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তখনি কলিংবেল বেজে উঠলো।
রাজিতার শশুর রুমে ঢুকতেই রাজিতা বের হয়ে আসলো।
রাজিতা রুমে ঢুকে দেখলো আনান ল্যাপটপে কাজ করছে। রাজিতাকে দেখে বলতে লাগলো,
–“কোথায় চলে গিয়েছিল? একটু রেস্ট নিলেই পারতে। সারাদিন যে ছুটাছুটি করেছো।”
–“আমি আসলে…”
–“আরকিছু বলতে হবেনা। আমি আর তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে তোমাকে বিব্রত করতে চাইনা। আমি জানি এখন তোমার মনের মধ্যে কি ঝড়-তুফান চলছে৷ আমি আর তোমাকে প্রেসার দিতে চাইনা। একটু রেস্ট নাও৷ মনটা একটু শান্ত হোক। তুমি ভেবেচিন্তে ডিসিশন নিও আমাকে ক্ষমা করবে নাকি শাস্তি দেবে। আমি কথা দিচ্ছি তোমার সব শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো৷ তোমার এই অবস্থা আমি আর দেখতে পারছি না। আমি এই রাজিতাকে দেখতে চাইনা! আমি একটা হাসি-খুশি রাজিতাকে দেখতে চাই।”
এটুকু বলেই আনান থেমে গেলো। রাজিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না৷ মানুষটা কি সত্যিই ওকে ভালো বাসে? নাকি এখনো সুবহার কথাই….
–“সরি, অনেক কথা বলে ফেললাম। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। তুমি রেস্ট নাও।”
কথাগুলো বলেই আনান ল্যাপটপ বন্ধ করে বের হতে যাচ্ছিলো। রাজিতা কান্না করতে-করতে আনানকে পিছন থেকে জাপটে ধরলো। কান্নার কারণে ও কোনো কথাই বলতে পারছে না।
আনান রাজিতার দিকে ঘুরে ওকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল,
–“আমি তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি। তোমার এই কষ্টটা দেখতে চাইনি বলেই এতদিন আমি নিজের বুকে সত্যের পাথরটা চেঁপে রেখেছিলাম। আজ সেই পাথরটা নামাতে পেরে আমার নিজেকে হাল্কা লাগছে৷ আমি তোমাকে এইভাবে দেখতে চাইনি। বিশ্বাস করো, শুধুমাত্র তুমি কষ্ট পাবে ভেবেই আমি এতদিনেও সত্যটা জানাতে পারিনি।”
–“কেন এখন কি আমি কষ্ট পাচ্ছিনা? ওই কষ্টটা না হয় আমি আরো আগেই পেতাম। কেন তুমি আমার থেকে সব লুকালে? কেন?”
–“আমি কথা দিচ্ছি, আর কোনোদিন তোমার থেকে কোনো সত্য লুকাবো না। আর নাতো তুমি আমার থেকে কিছু লুকাবে৷… আরেকটা কথা, সুবহা আমার অতীত ছিলো! অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। আমি মোটামুটি নিজেকে মানিয়েও নিয়েছিলাম সুবহাকে ছাড়া! তাই তুমি এটা ভেবো না যে, সুবহার ডুপ্লিকেট হিসেবে আমি তোমায় ভালবাসি! সুবহা আমার জীবন থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আল্লাহ ওকে আমার জন্য বানায়নি, আমাকেতো শুধু রাজিতার জন্যই বানিয়েছে! না হলে এভাবে আমি তোমাকে পেতাম? বলো? শুনেছি যে, আল্লাহ-তায়ালা নাকি স্ত্রীদেরকে তাদের স্বামীর বাম পাজরের হাড় দিয়ে বানিয়েছেন! সেই অনুযায়ী তুমি হচ্ছো আমার বাম পাজরের হাড়! তুমি ব্যাথা পেলে, কষ্ট পেলে আমারো যে তাই কষ্ট হয়! তুমি কি সেটা বুঝতে পারো না? ”
–“আমি বুঝতে চাই! সত্যি বলছি, আমি তোমাকে বুঝতে চাই, কিন্তু যতবার তোমাকে বিশ্বাস করতে যাই ততবার বিশ্বাসের সুতোয় টান পড়ে! আমি থমকে যাই! ভয় হয়! এই বুঝি বিশ্বাসের সুতোটা ছিড়ে গেলো! আর আমি হেরে গেলাম!”
–“তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে ভয় পাও! অথচ যারা তোমাকে বারবার আঘাত করছে তাদের কাছে ফিরে যেতে চাও কোন মুখে? আমাকে আরেকবার বিশ্বাস করো, সুযোগ দাও, আমি প্রমাণ করে দিবো যে, এই আনানের বুকে রাজিতার জন্য কতটা ভালবাসা জমে গেছে এই কয়দিনেই!”
–“আমি কোনো প্রমাণ চাইনা! আমি শুধু সারাজীবন তোমাকে আমার পাশে চাই৷ আশেপাশের সবকিছু থেকে বাঁচার জন্য একটা ঢাল চাই! কারণ, আমি যে বড্ড একা! ”
–“কে বলেছে তুমি একা? এতবড় জ্বলজ্যান্ত মানুষটাকে তোমার চোখে পড়ে না!”
রাজিতা আনানের বুক থেকে আস্তে-আস্তে মাথা তুলে কান্না বিজড়িত চোখেই হাসতে থাকে।
রাজিতার হাসিমুখ দেখে আনান নিজেও হেসে দেয়৷ আর বলতে থাকে,
–“একসাথে হাসি আর কান্নাকে কি যেন বলে! যা বাবাহ! ভুলে গেছি! তবে যে যাই বলুক না কেন, আমার রাজিতাকে এভাবেও অসাধারণ লাগছে! চোখটা ফুলে যে ঢোল হয়নি! এই যা বাঁচা! নইলে সবাই ভাবতো আমি তোমাকে মেরে-মেরে এই অবস্থা করেছি!”
আজ সারাদিন শেষে দুজনের মধ্যে আবার স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করতে লাগলো। দুজনের মুখের একফোঁটা হাসিই যেন সারাদিনের সব ঝড়-ঝাপটাকে আড়াল করে দিয়েছে।এখন ওদের হাসিমুখ দেখে কারো বলার উপায় নেই যে, একটু আগেও দুজনের মনে মেঘের পাহাড় জমে ছিলো!
সকালে বাথরুম থেকে বের হয়েই রাজিতাকে অনেক সুন্দর করে সাজতে দেখে আনান বলল,
–“আজ হঠাৎ এত সাজ-গোজ! আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা চলছে নাকি! আমিতো এমনিতেই তোমার রূপে ফিদা! আর ইমপ্রেস করতে চাইলেতো আমি হাওয়া হয়ে প্রকৃতিতে মিশে যাবো!”
রাজিতা আনানের দিকে না তাকিয়েই বলল,
–“তাহলে তুমি এটা বলতে চাইছো যে, আমার সুন্দর চেহারার জন্যই তুমি আমাকে ভালবেসেছো, তাইনা! আমার এই রূপ না থাকলে কি তুমি আমাকে আর ভালবাসবে না!”
–“বউয়ের সাথে যে মজা করে একটা কথা বলব তারও উপায় নেই! সে যে আমার থেকে দু-লাইন বেশি বুঝে আমিতো সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমারতো এখন মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় যে, আচ্ছা টিচার আমি নাকি তুমি!”
বলেই আনান হেসে উঠলো। ওর কথা শুনে রাজিতা নিজেও হেসে ফেললো।
–“হয়েছে! আর মজা করতে হবেনা। আজ যে ক্যাম্পাস থেকে ছোট খালামনির ওখানে যেতে হবে সেটা কি ভুলে গেছেন মিস্টার? ওখানে না গেলে মা তোমাকে আর আস্ত রাখবে না!”
–“আমারতো মনেই আছে৷ কিন্তু সেখানে যাওয়ার জন্য যদি তুমি এত সেজে থাকো তাহলে তোমার জন্য এক বালতি সমবেদনা! ”
–“কেন? আমার সাজার সাথে ওখানে যাওয়ার কি সম্পর্ক?”
–“ক্লাস শেষে তোমার এই সাজ আর সাজ থাকবে না মিসেস! ততক্ষণে তোমার মুখের বারোটা বেজে যাবে! তাই এখন এত সাজু-গুজু না করে ক্লাস শেষে ফ্রেস হয়ে যা করার করো!”
–“হয়েছে! তোমাকে আর লেকচার দিতে হবে না। এখানেই যদি সব লেকচার শেষ করে দাও, তো ক্লাসে গিয়ে কি হাওয়া খাবে নাকি! চলো এবার।”
নাস্তা শেষ করে দুজনে বেড়িয়ে পড়লো। আর আনানের মা ওকে বারবার মনে করিয়ে দিলো ওর ছোট খালামনিদের বাসায় যাওয়ার কথা। নতুন বউকে নেওয়ার জন্য উনি পাগল হয়ে গেছেন৷ রাজিতাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে আনানের ছোট খালার!
রাজিতা ভাবতে থাকে যে, আসলেই মানুষের জীবনটা কত অদ্ভুত! বিশেষ করে মেয়েদের জীবন! বিয়ে হলো, কি নিজের পরিবারটা পর হয়ে গেলো! আর সেই জায়গাটা দখল করে নিলো অন্যকারো পরিবার! যাকে সে কখনো চিনতোও না! জানতোও না! রাজিতার অবশ্য পরিবার থাকলেও পরিবারের বন্ধন কি তা উপলব্ধি করতে পারতো না! কিন্তু এখন পারছে, খুব ভালভাবেই পরিবারের বন্ধনটাকে উপলব্ধি করতে পারছে! এই বন্ধন ছিন্ন করার কোনো ইচ্ছে বা সাহস! কোনোটাই রাজিতার নেই৷ ও চায়ও না এই বন্ধন কোনোদিন ছিন্ন করতে! সবার এই ভালবাসা! মায়া! এসব যেন কখনো হারিয়ে না যায়! রাজিতা কি পারবে এসব আগলে রাখতে! কোনোকিছু পাওয়ার চেয়ে আগলে রাখাটা যে কত কঠিন! তা রাজিতা পুরোপুরি বুঝতে পারছে!
চলবে…..