#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১৭
‘কি বললেন ফাহাদ ভাইয়া? আরেকবার বলুন তো! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! সত্যি আপনি..??’
আমার কথায় ফাহাদ ভাইয়া হেসে ফেললেন। বললেন, ‘তনয়াকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। পছন্দ বললে ভুল হবে আমি ভালোবেসে ফেলেছি ওকে। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।’
ফাহাদ ভাইয়ার কথায় বেশ আশ্চর্য হচ্ছি। উনি তনয়াকে পছন্দ করেন? ভালোবাসেন?
‘ফাহাদ ভাইয়া আপনি ঠিক আছেন তো?’
‘না ইশারা আমি ঠিক নেই। সেদিন তোমার বান্ধবী আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছি। ওকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। প্লিজ হেল্প মি!’
‘তনয়া কি আপনাকে…??’
‘তা আমি জানি না। সেদিনের পর গত পরশু ওকে দেখেছিলাম শপিং মলে। আমাকে মুখ ভেংচে চলে গেছে। কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমায় পাত্তা দেয় নি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তনয়া মেয়েটা খুব শান্তশিষ্ট। কিন্তু একবার রেগে গেলে খবর করে ছাড়ে।
‘আচ্ছা ভাইয়া। আমি দেখি তনয়াকে বলে।’
ফাহাদ ভাইয়া হাসলেন। বললেন, ওর এড্রেসটা দিবে?
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই তিনি আবার বললেন, ‘না মানে আম্মু বিয়ের জন্য তোড়জোড় করছে। বাসায় হরতাল লেগে আছে। এড্রেস পেলে আরকি…’
আমি হেসে ফেললাম। বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
____________________
টেবিলে সাজিয়ে রাখা রিপোর্ট গুলো দেখতে দেখতেই ভাবনার জগতে ডুবে গেলো অরিদ্র। ভীষণ করে মন খারাপ তার। একটা সপ্তাহ হলো ইশারা বাড়ি চলে গেছে। সেদিন অরুনির সাথে সেই ঘটনার পর একটা বারও তার সাথে কথা বলে নি ইশারা। অরুনিকে সেদিন ইচ্ছে মতো বকে দিয়েছে অরিদ্র। ভয়ংকর ভাবে রেগে গিয়েছিলো সে। মেয়েটা তার ইশুবতীর সাথে এভাবে কথা বললো? কত সাহস মেয়েটার। পারলে মেয়েটাকে সে মেরেই ফেলতো। অরিদ্রের গর্জনে সেদিনই অরুনি বাড়ি ত্যাগ করেছিলো। যাওয়ার নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারে নি। সেদিনের পর ইশারাও তার সাথে কথা বলে নি। মোটে দুদিন সে বাড়িতে থেকেছিলো ইশারা। কিন্তু দুটো দিনই কঠোর ভাবে এড়িয়ে চলেছে তাকে। একটা কথাও বলে নি। এক সপ্তাহ ধরে সকাল সাজে কত গুলো কল করেছে সে! কিন্তু একটা কলও রিসিভ করে নি সে। তার ইশুবতী কি রেগে গেলো? ভয়ংকর ভাবে রেগে গেলো? ইশুবতী কি তাকে বুঝবে? সে তো চায় নি মেয়েটার সাথে কথা বলতে!
অরিদ্রের ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের উপর অভ্র নামটা জ্বলজ্বল করছে। অরিদ্র চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো অরিদ্র। চোখ জোড়া বন্ধ করে রিসিভ করে ফোনটা।
‘হ্যা, ভাইয়া বলো।’
‘অরিদ্র তুই বাড়িতে চলে আয় তো এক্ষুনি। ইমার্জেন্সি দরকার আছে।’
অভ্র থেকে কথাটা শুনে থমকে গেলো অরিদ্র। ইমার্জেন্সি দরকার মানে? ভাবির কিছু হলো না তো? সে ব্যস্ত হয়ে বললো,
‘কি হয়েছে ভাইয়া? কিসের ইমার্জেন্সি? ভাবির কিছু হয়েছে? কি হয়েছে?’
‘সিহার কিছু হয় নি। ও একদম ঠিক আছে। দরকারটা তোকে নিয়েই। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়। কুইক।’
বলেই ফোনটা রেখে দিলো। অরিদ্র হতাশ হলো।
বাড়িতে পৌঁছেই বেশ রমরমা পরিবেশ দেখে চমকে গেলো অরিদ্র। বাড়িতে কোন উৎসব লেগেছে নাকি? ভিতরে প্রবেশ করে ড্রইং রুমে মায়ের সাথে বসে থাকা মধ্যবয়সী মহিলাটিকে দেখে আরো বেশি চমকে গেলো অরিদ্র। এই মহিলা এ বাড়িতে কি করে? চারপাশে দৃষ্টি ঘুরাতেই উপরের সিঁড়িতে অভ্রকে দেখতে পায়। অভ্র হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। অরিদ্র সোজা উপরে রওয়ানা হয়। কিন্তু বাঁধা পায় মায়ের ডাকে।
‘অরিদ্র এদিকে এসো।’
অরিদ্র মায়ের মুখোমুখি হয়। ভদ্রমহিলা শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘উনি অরুনির মা মিসেস. মাহবুবা বেগম। অরুনির সাথে তোমার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন।’
মায়ের কথায় বিস্মিত হয় অরিদ্র। কি বলছেন মা এসব?
‘অরুনিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। এবার তোমার মতামত দাও। আমি ওকে এ বাড়ির ছোট বউ করে আনতে চাই।’
মায়ের কথায় অরিদ্রের শিরা উপশিরা শক্ত হয়ে এলো। মা কি বলছেন এসব? এতো কিছু ভাবার আগে তাকে একটা বার হলেও তো জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। তার মতামতটা তো জানার প্রয়োজন ছিলো। সে কি চায় তা তো বোঝার দরকার ছিলো মায়ের! তার ইশুবতী! সে তো তার ইশুবতীকে ভালোবাসে। ইশুবতী ছাড়া আর কাউকে আপন করতে পারবে না সে। সে তার ইশুবতীতে গভীর ভাবে আসক্ত। অন্য কাউকে আপন করতে পারবে না সে!
অরিদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘আমার মতামতটা তোমার আগে জানা উচিত ছিলো মা। আমি কি চাই তোমার আগে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছো? বেশ হাস্যকর তো!’
এতোক্ষণের রমরমা পরিবেশ শান্ত হয়ে গেলো। বিষন্নতার ছায়া বয়ে গেলো দুটি মানুষের মুখে। অরুনির মা আর অরিদ্রের মা দুজনেই একে অপরকে দেখতে লাগলেন। কি বললো অরিদ্র তাই বোঝার চেষ্টা করছেন। অরিদ্রকে রেগে যেতে দেখে অভ্র এগিয়ে এলো। মাকে শান্ত করে অরিদ্রকে বললো,
তোর সাথে কথা আছে উপরে আয়!
অরিদ্র রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলো।
.
‘অরুনিকে বিয়ে করতে তোমার কি সমস্যা অরিদ্র? অরুনি কি কম সুন্দর নাকি?নাকি পড়ালেখা? অনার্স ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। বয়সের কথা বলবে? ওর বয়স বিশ। যথেষ্ট বড় ও। কি সমস্যা তোমার?’
একটানে কথাগুলো বললো সিহা। অরিদ্র চুপ করে রইলো। অভ্র বললো,
অরিদ্র প্লিজ চুপ থাকিস না মানসম্মানের ব্যাপার। কি সমস্যা তোর?
অরিদ্র হতাশ হয়ে বললো, আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি!
অরিদ্রের কথায় বিস্মিত হলো দুজনেই। একে অপরকে দেখতে লাগলো।
‘মেয়েটা কে অরিদ্র? তুই কাউকে ভালোবাসিস কখনো বলিস নি তো! কতদিন ধরে?’ (অভ্র)
‘জানি না। তবে তাকে আমি অনেক ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি চাই। ওকে আমার খুব প্রয়োজন।’
অবাক হলো অভ্র। ‘কে সে?’ ছোট করে প্রশ্ন করলো অভ্র। অরিদ্রের উত্তরের অপেক্ষায়!
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শান্ত কণ্ঠে অরিদ্র বললো, ‘আমি ইশারাকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি আমি।’
অরিদ্রের কথা শুনে দুজনেই তাজ্জব বনে গেলো। কি বললো সে? ইশারাকে ভালোবাসে?
‘ফাজলামো করো না অরিদ্র! এখন ফাজলামোর সময় না।’ (সিহা)
অরিদ্র হাসলো। বললো,
‘আমি ফাজলামো করছি না ভাবি। আমি ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। তোমার বিয়েতে গিয়ে আমার চোখ আটকে গিয়েছিলো এক ছোট্ট মায়াবতীর উপর আমার ইশুবতীর উপর। তখনই প্রথম আমার ইশুবতীকে দেখেছি। এরপর থেকে তার প্রতি ভালো লাগা কাজ করতো। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা! শুধু ভালোবাসি না অনেক অনেক ভালোবাসা। তখন থেকেই মনে তার ছবি আঁকতে শুরু করি। তাকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। তাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করি।ও তো আমার নেশা। যে নেশায় আমি আসক্ত। যাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আমার প্রতিটি ক্ষণেই তাকে প্রয়োজন।
অরিদ্রের কথায় থমকে গেলো সিহা। কি বলছে ছলেটা?
অরিদ্র আবার বলতে শুরু করলো,
তোমার বিয়ে শেষে আমি ঠিক লন্ডনে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মনটা এই দেশেই রেখে গয়েছিলাম। তাকে একটু দেখার আকাঙ্ক্ষা আমার মনে সবসময়ই ছিলো। ওকে দেখার জন্য কত রাত ছটফট করেছি। কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি।যখনই তুমি বলতে তোমাদের বাড়িতে ফাংশন তখনই ছবি চাইতাম। সেই ছবিতে আমার বেহায়া চোখ দুটো তাকে খুঁজতো। আমার ইশুবতীর হাসি আমার কাছে বড্ড নেশালো। তার হাসিতেই নিজেকে হারাতাম।
সিহা শান্ত হয়ে গেলো। অরিদ্র আবার বলতে লাগলো,
‘জানো ভাবি লন্ডনে যতটা সময় ছিলাম ততটা সময় আমার কাছে সবচেয়ে বিষাক্ত ছিলো। আমার ইশুবতীকে বুকে পুষে বিদেশের মাটিতে দিন কাটাতে লাগলাম। সময় তো থেমে থাকে না। সময় কাটতে লাগলো। মাসের পর মাস এরপর বছর গেলো! মন খারাপটা তীব্র হলো। তার জন্য মন আনচান করা শুরু করলো। এদিকে সেমিস্টার পরীক্ষাও চলে এলো। হঠাৎ একদিন তুমি ফোন করলে সেদিন বলেছিলে ইশুবতী কাউকে ভালোবাসে। তার হাত ধরে ঘর ছেড়েছে ইশুবতী। বিশ্বাস করো ভাবি সেদিন মনে হয়েছিল আমি আর এই দুনিয়ায় নেই। আমার ইশুবতী অন্য কাউকে ভালোবাসে? সেদিন ভেবেছিলাম সেটাই হয়তো আমার শেষ দিন!’
‘আমি সবসময় চেয়েছি আমার ইশুবতী ভালো থাক। সে যেখানেই থাক ভালো থাক। সে তার ভালোবাসার মানুষটাকে ঘিরে থাক। আমার ভালোবাসা অপূর্ণ থাক। তারটা না হয় পূর্ণতা পাক!
সিহা থমকে গেলো। নিজের চোখে নোনাজল দেখে নিজেই বিস্মিত হলো।
‘এরপর শুরু করলাম নিজের সাথে যুদ্ধ। টিকে থাকার যুদ্ধ! ইশুবতীকে ভুলে যাওয়ার যুদ্ধ। কিন্তু এতো সহজে কি তাকে ভুলতে পারি? বেসামাল হয়ে গেলাম। পরীক্ষা হলো রেজাল্ট খুব খারাপ হলো। বাসা থেকে বকাবকি শুরু হলো। সব মিলিয়ে প্রচুর মানসিক যন্ত্রনার সম্মুখীন হলাম। আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদতে চেয়েছি কিন্তু পারি নি! আমি কাঁদতে পারি নি! বুকে হাজারো যন্ত্রনার পাহাড় বেয়ে বেরিয়েছি। আমাকে যুদ্ধ করতে হবে। আস্তে আস্তে নিজেকে সামলাতে হবে।’
অরিদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখ দুটো তার ভীষণ লাল।
‘আমি পেরেছি! ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়েছি। শুরু করেছি অন্যরকম জীবন। যেখানে কোন আবেগ থাকবে না। থাকবে না কোন অনুভূতি। শক্ত হয়ে যাবো আমি। তাই করলাম। ধীরে ধীরে শক্ত হলাম। স্টাডি কমপ্লিট। দেশে ফিরলাম। সবার সাথে হাসিখুশি দিন কাটাতে লাগলাম। কিন্তু কাউকে বলতে পারি নি দিন শেষে আমি একা! আমি নিঃস্ব। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছি আমি!’
‘হঠাৎ যখন শুনলাম ইশারার ডিবোর্স হয়ে গেছে তখন আরো বেশি অবাক হলাম। নিজের ভিতর হাহাকার শুরু হলো। আমার ইশুবতী কতটা কষ্ট পেয়েছে! আমার ইশুবতী কে কতটা কষ্ট দেয়া হয়েছে। আমার ইশুবতীকে কতটা যন্ত্রনা দিয়েছে। ভালোবাসার কষ্টটা কি তা আমার থেকে কে ভালো জানে বলো?? আমি তখন…তখন…’
অরিদ্র চুপ হয়ে গেলো।
‘এরপর তোমাদের বাড়ি গেলাম। আমার ইশুবতীকে দেখে থমকে গেলাম। আগের ইশুবতী আর এই ইশুবতীতে কত তফাৎ! আমার ইশুবতী শেষ হয়ে যাচ্ছে! ছটফট শুরু হয়ে গেলো আমার। ডিসিশন নিলাম যেভাবেই হোক ইশুবতীকে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসবো। তাকে আগের সেই দুরন্ত কিশোরীতে পরিণত করবো। এরপর যা হলো তা তো দেখেছোই!’
এরপর লম্বা শ্বাস ফেলে অরিদ্র বললো, ‘এই আমার অপূর্ণতার ভালোবাসার কাহিনী। ব্যর্থ প্রেমিকের ভালোবাসার কাহিনী! এ কাহিনীর শুরু আছে অন্তিম পাতা নেই!’
চলবে….
(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)