অপেক্ষার বসন্ত পর্ব-০৬

0
265

#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০৬

অর্নি ফোন কেটে সিদ্ধান্ত নিলো রুমানা লোকেশন দিলে সে সেখানে যাবে। তাকে দেখতে হবে কি হচ্ছে এসব।

ইন্সপেক্টর রুমানা একটু পর তাকে ফোন ট্র্যাক করে লোকেশনটা পাঠিয়ে দিলো।অর্নি রুমানার মেসেজ পেয়ে অবনিকে বললো:আপু আমার একটা কাজ আছে। আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে।তোমরা খালামনির খেয়াল রেখো।
_আচ্ছা যাও।
_ওকে আসি।

অর্নি তার খালামনির কেবিনে গিয়ে একবার দেখে আসলো।তিনি ঘুমাচ্ছেন তাই আর ডাকলো না তাকে। তারপর দ্রুত পায়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলো। নিজের গাড়িটা সাথে নেয়নি সে।যদি তার গাড়িটা দেখে তাহলে তাকে চিনে ফেলবে।কারণ অর্নি আরাফকে ফলো করতে চাইছিল।আরাফকে নজরে রাখতে পারলে জুঁই ঠিক ধরা খেয়ে যাবে।তাই এখন আরাফ তার মূল শিকার। কিন্তু আরাফকে তা বুঝতে দেওয়া যাবে না।যদি জানতে পারে তাহলে উল্টো অর্নির উপর সে রেগে যাবে। হাসপাতালের গেইট থেকে একটা রিকশা নিলো অর্নি। রুমানার দেওয়া লোকেশন হলো একটা রেস্টুরেন্ট।আরাফ আর যায় করুক তার মায়ের এই অবস্থায় সে কখনো একটা মেয়ে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাবে না।তাই লোকেশন অনুযায়ী সে যাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। কিছুতেই পথ ফুরাচ্ছে না। অনেক্ষণ অপেক্ষা করলো সে। কিন্তু এতে করে সময় চলে যাচ্ছে। এখন যদি জুঁই আর আরাফ চলে যায় ওখান থেকে তাহলে তার সব প্রচেষ্টা বৃথা হয়ে যাবে।তাই ভাড়াটা মিটিয়ে সে রিকশা থেকে নেমে গেলো।

রিকশা থেকে নেমে এক প্রকার দৌড়ের গতিতে সে যাচ্ছে।কোনো দিকে না তাকিয়ে হাঁটছে। অনেক কষ্ট কোনোরকম রেস্টুরেন্টে পৌঁছালো সে। কিন্তু সে ঢুকতেই দেখলো জুঁই আর আরাফ বেরিয়ে যাচ্ছে। জুঁই অনেকটা দ্রুত গতিতে বের হচ্ছে।আরাফ আস্তে হাঁটছে কিন্তু জুঁই আরাফকে রেখে দ্রুত গতিতে নেমে তার গাড়িতে উঠে পড়লো।অর্নি জুঁইয়ের কাণ্ডে অবাক হয়ে গেলো।সে আসার সাথে সাথে জুঁই কেনো চলে যাচ্ছে? তাছাড়া জুঁই জানলো কি করে অর্নি তাকে ট্র্যাক করে এখানে এসেছে?অর্নির এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে নিজের মাথাটা নিজেই ফাটিয়ে দিক।এতো ঝামেলা আর ভালো লাগে না তার। একবার মন চায় সব ছেড়ে দিয়ে সে তার মতো করে বাঁচুক। নতুন করে স্বপ্ন দেখুক। কিন্তু চাইলেও সে পারে না আরাফকে ভুলতে। আবার ছুটে আসতে মন চায় আরাফের কাছে।কোনো এক অদৃশ্য টান তাকে সবসময় আবদ্ধ করে রাখে আরাফের কাছে।

খানিকক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকলো এক পাশে। আস্তে আস্তে নিজেকে কন্ট্রোল করলো।একটু পর মাথায় আসছে একটা বড় ভুল করে ফেললো সে।রাগের বশে সেন্সে ছিল না জুঁইয়ের গাড়ির নম্বরটা নিতে। তখন তাকে ফলো করা কোনো ব্যাপার হতো না।তাই আবার ছুটলো দ্রুত গতিতে। জুঁই এখনো বেশিদূর যায়নি। হয়তো সামনের জ্যামটায় ঠিকই সে আটকে যাবে আর অর্নি তার গাড়ির নম্বরটা নিতে পারবে।তাই রেস্টুরেন্টের গেইট থেকে আরেকটা রিকশা নিলো সে। রিকশা ওয়ালা মামাকে বললো:মামা একটু দ্রুত চালান। আমার তাড়া আছে।
তিনিও বেশ চেষ্টা করছেন দ্রুত গতিতে চলার।অর্নি ঠিকই আগের জায়গায় জ্যামে এসে আটকে গেলো।তার মানে জুঁই এখনো আছে এখানে।সে তো আর উড়ে যেতে পারবে না। আবারো আগের মতো ভাড়াটা মিটিয়ে রিকশা থেকে নেমে সে।নেমে ধীর গতিতে হেঁটে হেঁটে সব গাড়ি পর্যবেক্ষণ করছে অর্নি। কয়েকটা গাড়ি চেক করতে করতে জুঁইয়ের গাড়িটা পেলো। আস্তে আস্তে গিয়ে তার গাড়ির নম্বরটা নিলো সে। তারপর খুশি মনে আবার হাঁটা দিলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। এই যাত্রায় একেবারে সফল না হলেও ব্যর্থ তো হয়নি সে। মনে সাহস রেখে বাকি কাজগুলো করতে হবে তাকে।

হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ইন্সপেক্টর রুমানাকে আবার ফোন দিলো অর্নি।সে প্রথমে রিসিভ করেনি। হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত আছে এই ভেবে অর্নি আর ফোন দিলো না। একটু পর রুমানা ফোন ব্যাক করলো।অর্নিও সাথে সাথে রিসিভ করলো ফোনটা।
_সরি ম্যাম। আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম।
_ইটস ওকে। সমস্যা নেই। একটা গাড়ির নম্বর দিচ্ছি।ওটা কার নামে রেজিষ্ট্রেশন করা আছে সেটা বের করে আমাকে দিতে হবে। একটু দ্রুত করার চেষ্টা করো।
_ওকে ম্যাম।
অর্নি এবার ফোন কেটে দিলো।আরাফ এখনো হাসপাতালে আসেনি।তার তো এতোক্ষণে চলে আসার কথা? কোথায় গেলো তাহলে সে?অর্নি ভাবছে এসব। হঠাৎ আরাবি এসে তাকে বললো: তোমাকে আব্বু ডাকছে।
অর্নি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো:কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে?
_এমনে ডাকছে হয়তো।
_আচ্ছা যাচ্ছি।
অর্নি বসা থেকে উঠে আরাফের বাবার কাছে গেলো।
_খালু আমাকে ডেকেছেন?
_হুম। কোথায় গিয়েছিলে মা?
আরাফের বাবার প্রশ্নে অর্নি থতমত খেয়ে গেলো। একটু থেমে বললো: অফিসের একটা কাজ ছিল।
_তোমার যদি অফিসের কাজে সমস্যা হয় তুমি যেতে পারো। এখানে তো আমরা সবাই আছি। তুমি শুধু শুধু এক্সট্রা প্রেশার নিবে কেনো?
_না না। আমার কোনো প্রেশার হচ্ছে না।
_তোমার সাথে একটা কথা ছিল। আগেই বলতাম কিন্তু তোমার খালামনির এই অবস্থা হয়ে যাওয়ার কারণে আর বলার সুযোগ হয়নি।
_জি বলুন।
_তুমি আর আরাফ দুজনেই ম্যাচিউর। যথেষ্ঠ বোধশক্তি দুজনের আছে বলে আমি মনে করি। তাহলে ডিভোর্সের মতো এমন একটা সিদ্ধান্ত তোমরা দুজনে মিলে নিতে গেলে কেনো? আমরা সবাই তোমাদের গুরুজন। আমাদের তো একবার জানাতে পারতে।
অর্নি কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না।আরাফের বাবা আবারো বলা শুরু করলেন:দেখো, আমার ছেলেটা গোল্লায় গেছে তা আমি খুব ভালো করে রিয়েলাইজ করতে পেরেছি। তুমি যদি আমাদের বলতে সমস্যাটা কোথায় আমরা তো একটু বুঝতে পারতাম।কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছো?
_আমি তাহলে কি করতে পারি? উনি চায় জুঁইয়ের সাথে নতুন জীবন শুরু করতে। জুঁইয়ের সাথে থাকলে ভালো থাকবে। আমি কেনো মাঝখানে থেকে তাদের ঝামেলা করবো?
_তোমার মনে হয় আরাফ ওই মেয়েটার সাথে ভালো থাকবে? মেয়েটা একটু আগে আমার সামনে কিভাবে বিহেভ করেছে তুমি দেখেছো?
_আপনার ছেলের তো তবু তাকে ভালো লাগছে।
_আত্নীয়-স্বজন জানতে পারলে কি হবে?

অর্নি কিছু বলতে যাবে তখনি একজন ডাক্তার এসে আরাফের বাবাকে ডাক দিলো। তিনিও ডাক পেয়ে সোজা চলে গেলেন।অর্নি একটু দাঁড়ালো সেখানে তারপর আরাবিরা যেদিকে আছে সেখানে চলে গেলো। তাদের পাশে গিয়ে বসতেই দেখলো আরাফ বসে আছে এক পাশে। হয়তো অর্নিকে তার বাবা ডাকার পর সে এসে পৌঁছেছিল।অর্নি তাকে দেখে একপলক তাকালো।তার চোখে চিন্তার স্পষ্ট একটা ছাপ আছে। অর্নি বসতেই আরাফ সামনে তাকালো। তাকে বসতে দেখে বললো:এই তোর সাথে কথা আছে আমার।চল আমার সাথে।
আরাফের কথায় অর্নি একবার তার দিকে তাকালো আবার অন্যদের দিকে তাকালো। তারপর কি মনে করে প্রশ্ন করলো: কোথায় যাবো?
_তোকে আসতে বলেছি আর তুই আসবি।ব্যাস।এতো প্রশ্ন করিস কেন?
অর্নি এবার উঠে দাঁড়ালো।সে জানে আরাফকে মানানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।তাই হার মেনে নেওয়ায় ভালো। শান্ত গলায় বললো “চলেন।”

আরাফ উঠে একপাশে গেলো আর অর্নিও তার পেছন পেছন গেলো।আরাফ শান্ত গলায় বললো: তুই কি আমাকে ফলো করে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলি?

আরাফের প্রশ্নে অর্নি বেশ অবাক হলো।আরাফ জানলো কি করে এসব?সে তো আরাফ দেখতে পায়না এমন করে গিয়েছিলো।আরাফ তাকে দেখেনি সেটা অর্নি সিউর। তাহলে আরাফ জানলো কি করে? নিশ্চয় কেউ তাকে বলে দিয়েছে।অর্নির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সে আবারো প্রশ্ন করলো:কিরে জবাব দিচ্ছিস না কেন?
_না মানে হ্যাঁ।আমি একটা কাজে ওই দিকটায় গিয়েছিলাম। আপনাকে ফলো করে নয়।
_সত্যি বলছিস?
_হ্যাঁ সত্যি বলছি। আপনি জানলেন কি করে?
_জুঁই ফোন দিয়ে বললো তুই আমাদের ফলো করতে গিয়েছিস।
_জুঁই কি চোর যে তাকে আমি ফলো করবো?
আরাফ কথাটার জবাব দিলো না। শুধু বললো:দেখিস উল্টাপাল্টা কাজ করে কোথাও ফেঁসে যাবি না।বয়স কম তোর।বুঝে-শুনে কাজ করবি।

অর্নি কিছু বললো না শুধু মাথা নাড়লো।আরাফ একবার তার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো আবারো।আরাফ যতো খারাপ হোক তার একটা ভালো গুণ আছে।সে অর্নিকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে। হয়তো নিজের চেয়েও বেশি।কথায় আছে, ভালোবাসার পূর্বশর্ত বিশ্বাস। কিন্তু তাদের মাঝে বিশ্বাস তো আছে।ভালোবাসাটা কি আসতে পারে না দুজনের জীবনে? দু’জন কি দুজনকে সবকিছু দিয়ে আগলে রাখতে পারে না?

আরাফের বাবা ডাক্তারের সাথে কথা বলে এসে জানালেন আগামীকাল যদি সবকিছু ঠিক থাকে তাহলে মিসেস আরমিনকে ডিসচার্জ করা হবে।এতো কষ্টের মাঝেও একটা খুশির খবর পেয়ে অর্নির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শুধু সে নয় সবার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।

একটু পর ইন্সপেক্টর রুমানা ফোন দিলো।অর্নি খুশি মনে ফোনটা রিসিভ করলো কোনো ভালো খবর পাবে এই আশায়। কিন্তু তার খুশি মনটা আর পুরো মাথাটা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য রুমানার একটা কথায় ইনাফ।
_ম্যাম গাড়িটা ডঃ পারভেজ আলমের নামে রেজিষ্ট্রেশন করা আছে।
_উনার সকল ইনফরমেশন বের করে আমাকে দিবেন। কোথায় থাকেন এখন, কোন হাসপাতালে আছেন সব তথ্য লাগবে।
_ওকে ম্যাম।

রুমানা ফোন কেটে দিলো কিন্তু অর্নি এখনো ফোনটা কানে ধরে আছে।তার মাথা কাজ করছে না। ডঃ পারভেজ আলম তো জুঁইয়ের হাসবেন্ড।আরাফের সব বন্ধু বা ক্লাসমেটদের অর্নি মুটামুটি চিনে। সেই সুবাদে পারভেজকেও সে চিনে।অর্নির জানা মতে জুঁই আর পারভেজের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাহলে পারভেজের গাড়ি জুঁই কেনো ব্যবহার করবে? কোনো মানুষ কি তার এক্সকে নিজের গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ দিবে?এমন মানুষ কি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়?তার মানে কি জুঁই আরাফকে সব কথা মিথ্যা বলেছে এতো দিন?যদি জুঁইয়ের সাথে পারভেজের সম্পর্ক ঠিক থাকে তাহলে জুঁই অর্নি -আরাফের মাঝে জড়াতে চাইছে কেনো?তার লাভটা কি এতে?

চলবে…