#অপেক্ষারা
১২+১৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
ঈদের ছুটিতে শহুরে ছেলেমেয়েরা কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায়। এমন দৃশ্যই সচরাচর দেখা যায়। তবে সায়েমদের পরিবারে সবই উল্টো। খুব সম্ভবত এই প্রথম গ্রাম থেকে বাবা-মা শহরে আসছেন ছেলের সঙ্গে ঈদ করতে।
এর পেছনে অবশ্য যথাযোগ্য কারণও আছে। এই প্রথম সায়েম নিজের টাকায় কোরবানি দিচ্ছে। গরুও না-কি কিনবে নিজে দেখেশুনে। সব ভালো ভালো গরু আগেভাগেই ঢাকায় চলে আসে। যদিও তার বাবা-মা বেশ কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হাত শেষমেশ মেনেই নিয়েছেন।
এদিকে নাজের মনটা বেশ ভার হয়ে আছে। রোজার ঈদেও বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়নি তাকে। মা, রাজ্যের সব আত্মীয়-স্বজন, বান্ধবীদের ফেলে ঢাকায় বসে ঈদ করেছে সে। ওই করলার মতো তিতা ছেলেটা জীবন থেকে সমস্ত সুখ কেড়ে নিচ্ছে তার! তবে ভরসার কথা একটাই, এবার তার সঙ্গে কনা থাকবে। ওই মেয়েটা আশপাশে থাকলে আপনাআপনিই মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
কিছুদিন হলো নাজের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে? জঘন্যের চেয়েও অধম যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা। ঈদের ছুটির পরেই না-কি রেজাল্ট দেবে। ওই রেজাল্ট কার্ড হাতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। কিংবা তার চেয়েও ভালো, আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে। ওই বস্তু সায়েমের হাতে পড়লে সর্বনাশ! দেখা গেল রেজাল্ট দেখার পর, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পঁচিশ ঘন্টাই তাকে বইয়ের সামনে বসিয়ে রেখেছে।
নাজ আজ মহাব্যস্ত। সকাল সকাল সায়েম একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেছে। বাবা-মার আগমন উপলক্ষে কয়েকদিন ধরেই বাড়িটা গোছগাছ করা হচ্ছে। যে কাজগুলো বাকি আছে তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নাজকে। সে মনোযোগ দিয়েই কাজগুলো করছে, যেন অতি সূক্ষ্ম কোনো খুঁতও না থাকে।
বিয়ের পর এই প্রথম সায়েম তাকে সংসারের কোনো দায়িত্ব দিলো। বিয়ের প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল অথচ এখন পর্যন্ত সংসার জিনিসটা যে কী, তাই বুঝতে পারলো না নাজ। বুঝতে পারলো না যে তা ঠিক নয়, বুঝতে দেওয়া হয়নি। যতবারই আগ বাড়িয়ে কোনো কাজ করতে গেছে সায়েম ধমকের দিয়ে বলেছে, “এসব করার বয়স এখনও তোমার হয়নি। যাও পড়তে বসো!”
নাজদের বাড়ির বসার ঘরে একটা কমন বাথরুম আছে। কয়েকদিন ধরে সেই বাথরুমের এক কল নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ট্যাপ যতই ঘোরানো হচ্ছে পানি বের হচ্ছে না। এ বাড়ির দারোয়ান আবার সকল কাজের কাজি। তাকে যখন বলা হলো কল সরানোর জন্যে একটা মিস্ত্রী ডেকে আনতে, তখন সে গর্বের হাসি হেসে বলল, “মিস্ত্রী লাগবো না আফা, এইসব ছোটখাটো কাম আমিই পারি।”
এই মুহূর্তে দারোয়ান বাথরুমে কল সারাচ্ছে আর জরিনা রান্নাঘরে বসে তরকারি কুটছে। বাথরুম থেকে রান্নাঘরের দূরত্ব খুব একটা বেশি না, উচ্চস্বরে কথা বললে শোনা যায়।
দারোয়ান প্লাস দিয়ে কলটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “তুমি কইলাম জরিনা, কামটা ঠিক করলা না।”
জরিনা তরকারি কুটা বন্ধ করে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আবার কী করলাম নূরু ভাই?”
“এই যে আমি তোমারে বিল্ডিংয়ের কতগুলি বাড়িতে কাম দিলাম, আর তুমি সবার আছে আমার দুন্নাম করলা।”
“ছি ছি! আমি আফনের নামে দুন্নাম করমু কোন দুঃখে? কেডা কইছে এই কথা?”
“যার কওনের হেয় তো আর চুপ কইরা থাকবো না। কইছে এইটাই আসল কথা।”
“আফনের নামে দুন্নাম কইরা আমার লাভ কী?”
“হেইডা জানো তুমি। এই লাইগ্যাই মাইনসের উপকার করতে হয় না।”
“আমার নামে একটা মিথ্যা অপবাদ দিবেন না তো নূরু ভাই।”
“মিথ্যা অপবাদের কী দেখলা? দোতলার ভাবি নিজে আমারে কইসে তুমি আমারে নিয়া কী সব বইলা বেড়াও?”
“কী বলি, কন শুনি!”
দুজন স্বল্প-শিক্ষিত মানুষের ঝগড়া বেশ উপভোগ করছিল নাজ। তবে তার সেই উপভোগে বাঁধা সৃষ্টি করলো কলিংবেলের আওয়াজ। এই সময়ে এবার কে এলো? সায়েমের তো এখন আসার কথা নয়!
দরজা খুলতেই টুপি পরা একটা লোকের দেখা মিলল। লোকটা বলল, “ম্যাম একটা পার্সেল ছিল।”
নাজের মনে পড়লো কিছুদিন আগে অনলাইন থেকে কতগুলো বিছানার চাদর অর্ডার করেছিল। সেগুলোই ডেলিভারি দিতে এসেছে সম্ভবত।
নাজ বলল, “কত হয়েছে জানি?”
“ম্যাম টাকা তো আগেই পে করা হয়েছে।”
“কী? আমি তো পে করিনি।”
নাজ ভালো করে পার্সেলের ওপরের কাগজটায় চোখ বোলালো। এটা তো তার অর্ডার নয়! ভিন্ন একটা অর্ডার। সায়েম কি তবে কিছু অর্ডার করেছিল। নাহ্! এখানে তো নাজের নামই লেখা।
একটা কাগজে সাইন করে বক্সটা নিয়ে ভেতরে ফিরে এল সে। এই বক্স খোলা ঠিক হবে কিনা কে জানে? বহু সাতপাঁচ ভেবে ভয়ে ভয়ে খুলল সে। বক্সটা খুলতেই মুগ্ধতায় কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। একটা আকাশি রঙের শাড়ি, দুই ডজন চুড়ি, বড়ো এক জোড়া কানের দুল, একটা মুক্তার মালা, এক পাতা কালো টিপ আর অনেকগুলো চকলেট। সবই নাজের পছন্দের জিনিস।
কিন্তু এগুলো হঠাৎ কে পাঠালো তাকে? বক্সে নাম লেখা নেই, চিরকুট জাতীয় কিছুও নেই। তবে জিনিসগুলো দেখে মনে হচ্ছে কেউ একজন দূর থেকে নিজের মতো করে সাজাতে চাইছে নাজকে। কিন্তু সেই একজনটা কে?
হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। এটা নিয়ে পরে ভাবনা-চিন্তা করা যাবে। জিনিসগুলোকে আবার বক্সটাতে রেখে কাজে ফিরে গেল সে।
সন্ধ্যা মিলবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সায়েম বাড়ি ফিরে এলো। সঙ্গে একগাদা বাজার। বাজারগুলো ফ্রিজে রেখে সায়েম এসে বসলো ডাইনিং টেবিলে।
হাতঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল, “নাজ শোনো!”
“জি?”
“ম্যানারস তো মাশাল্লাহ কিছুই শেখোনি।”
“আমি আবার কী করলাম?”
“একটা মানুষ যখন বাইরে থেকে টাইয়ার্ড হয়ে ফিরে আসে তখন কী করতে হয় জানো? তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে হয়, চা খাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে হয়। এতদিন তো এসব কিছুই করোনি, এই কয়টা দিন বাবা-মাকে দেখানোর জন্যে হলেও কোরো প্লিজ।”
নাজ হঠাৎ ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। আসলেই এই ছোট ছোট বিষয়গুলো কখনো খেয়ালই করেনি সে। মানুষটা সারাদিন অফিসে খেটেখুটে বাড়ি ফেরে। ফিরে এসে নিজেই চা বানিয়ে খায়। কেন? নাজ কি পারে না নিজ থেকে তার এই কাজগুলো করে দিতে? নাজ ঠিক করলো কেবল বাবা-মাকে দেখানোর জন্যে নয়, এখন থেকে সে সবসময়ই সায়েমের এই কাজগুলো করে দিবে। সে যতই বলুক, “পড়তে বসো!” – নাজ তা গায়ে মাখবে না।
নাজ চট করে রান্না ঘর থেকে এক গ্লাস পানি এনে সায়েমের দিকে বাড়িয়ে দিল।
সায়েম গ্লাসটা নিতে নিতে বলল, “থ্যাংক ইউ।”
“বাবা-মায়ের সামনে থ্যাংক ইউ বলবেন?”
“কেন? সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যা কিছু নেই। তারা শুধু ভাববে এতগুলো দিন হয়ে গেল, ফর্মালিটি গেল না!”
“উফ! অতিরিক্ত কথা বলো তুমি। কাজের কথায় আসি…”
সায়েমকে থামিয়ে দিয়ে নাজ আঁতকে উঠে বলল, “আবার কী কাজ? দেখুন সারাদিন প্রচুর কাজ করেছি। আর পারবো না।”
“সারাদিন কী কাজ করলে সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।”
সায়েম ডায়নিং টেবিল থেকে লিস্টটা তুলে পড়তে শুরু করলো।
“সিলিং ফ্যানে জমে থাকা ধুলো?”
নাজ বলল, “জরিনাকে দিয়ে মুছিয়ে ফেলেছি।”
“বাথরুমের নষ্ট কল?”
“দারোয়ানকে দিয়ে ঠিক করিয়ে ফেলেছি।”
“ভেরি গুড। বিছানার রং ওঠা চাদর?”
“পাল্টে অন্য চাদর বিছিয়েছি।”
“আবার কোনো রং ওঠা চাদর বিছিয়েছো না-কি?”
“মোটেই না, সাদা ধবধবে নতুন চাদর। অনলাইন থেকে অর্ডার দিয়েছিলাম। যান গিয়ে দেখে আসুন!”
“বুঝেছি, বুঝেছি। দেখতে হবে না। আর, অ্যাস্ট্রে?”
নাজ সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলল, “ভেঙে ফেলেছি।”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই জিভে কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত বেচারার তিনটা অ্যাস্ট্রে ভেঙেছে নাজ।
অ্যাস্ট্রের অভাবে বাড়িতে বসে সিগারেট খেতে না পেরে যখন সায়েম নতুন অ্যাস্ট্রে কিনে আনে, তার পরপর সেটা ভেঙে যায় নাজের হাতে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
সায়েম ভ্রু কুঁচকে বলল, “ওয়াট? নাজ তুমি আবার আমার অ্যাস্ট্রে ভেঙেছো?”
নাজ আমতা আমতা স্বরে বলল, “আরে, আপনি ওটা এমন জায়গায় রেখেছিলেন যে হাত লাগতেই পড়ে গেল। আমার কী দোষ?”
“আর অ্যাস্ট্রেই কিনবো না। তোমার যন্ত্রণায় দেখছি সিগারেট খাওয়াই ছেড়ে দিতে হবে।”
নাজ বিড়বিড় করে বলল,“তাতে যদি যায় বদভ্যাসটা!”
“এই মেয়ে! বিড়বিড় করে কী বলছো?”
“কিছু না। আপনার লিস্ট শেষ হয়েছে?”
“না হয়নি। ফ্রিজের পুরনো সবজি-টবজি কী করেছ?”
“ফেলে দিয়েছি।”
“ছাতা পড়া চানাচুর?”
“খেয়ে ফেলেছি।”
“হ্যাঁ?”
“না মানে, ফেলে দিয়েছি। প্রমিজ!”
সায়েম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি নাজ। যেখানেই যাবে একটা না একটা অঘটন তোমাকে বাঁধিয়েই ছাড়বে! শোনো একটা কথা ক্লিয়ারলি বলে দিচ্ছি, আমার বাবা-মায়ের সামনে তোমার বিচ্ছুগিরি দেখাবে না। এই কয়েকটা দিনের জন্যে প্লিজ বিহেভ ইউরসেলফ।”
নাজ মুখ চেপে হেসে ফেলল।
“হাসছো কেন?”
নাজ এবার খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, “আপনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন আপনি সকলের অমতে নিজে পছন্দ করে আমাকে বিয়ে করেছেন। এখন তাদের সামনে আমাকে ভালোভাবে উপস্থাপন করে প্রমাণ করতে চাইছেন আপনার পছন্দই ঠিক ছিল। কিন্তু আসলে তো আর এমন কিছু হয়নি? বরং আমি যদি তাদের সামনে একটার পর একটা গন্ডগোল করি, তখন আপনি বড় গলায় বলতে পারবেন – দেখো কেমন মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছ আমাকে!”
সায়েম কয়েক মুহূর্তের সরু দৃষ্টিতে নাজের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “বিয়ে মানে কী জানো?”
“জি?”
“অবশ্য জানবেই বা কী করে, সেটা জানার বয়স হবার আগেই তো ধরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো। বিয়ে হলো একটা রেসপনসিবিলিটি, আর এখন আমার রেসপনসিবিলিটি তুমি। একটা মানুষ যদি হুট করে তোমার খুঁত ধরে ফেলে, তাহলে সেটা আমার খুঁতই ধরা হবে। বুঝতে পারছো।”
নাজ অসহায় গলায় বলল, “আপনার এই কঠিন কঠিন কথাগুলোর আগা-মাথা আমি কিছুই বুঝি না।”
সায়েম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “থাক, আর বুঝতে হবে না। যাও ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে জলদি উঠতে হবে।”
ঘরে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল নাজ। হুট করে মনে পড়লো সেই কুরিয়ারের বাক্সটার কথা। নাজ তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে আলমারি থেকে বের করলো বাক্সটা। প্রেরকের কোনো আলামতই পাওয়া গেল না। এ কেমন কথা? উপহারের সঙ্গে উপহারদাতার
চিরকুট-টিরকুটও তো থাকে, এখানে সেটাও নেই। অথচ বাক্সের ওপরে ঠিকই নাজের নাম আর এ বাড়ির ঠিকানা।
নাজের দৃঢ় বিশ্বাস ভুল করে এই বাক্সটা তার কাছে চলে এসেছে। এমন কোনো মানুষ তো নেই, যে তাকে এই চমৎকার উপহারগুলো পাঠাতে পারে। নাজ বাক্সটা সাবধানে আলমারির ওপরের তাকে তুলে রাখলো। একদিন সময় করে কুরিয়ার অফিসে গিয়ে জিনিসটা ফেরত দিয়ে আসতে হবে। আহারে! কেউ না কেউ নিশ্চয়ই প্রিয় মানুষের কাছ শাড়ি-চুড়ির অপেক্ষায় বসে আছে!
নাজের মধ্যে অস্বাভাবিক ব্যস্ততা কাজ করছে। একটু পর পর ঘর গোছাচ্ছে। সাজানো ফুলদানি আবার নতুন করে সাজাচ্ছে। সায়েম বাস স্টেশন থেকে তাদের আনতে গেছে, যেকোনো মুহূর্তে চলে আসবে। তার আজ প্রথমবারের মতো নিজেকে বিবাহিত বলে মনে হচ্ছে। বিয়ে মানেই তো নতুন একটা পরিবার পাওয়া। সায়েমের সঙ্গে এই শহরটাতে থেকে থেকে নিজেকে সেই নতুন পরিবার থেকে এতদিন বঞ্চিত করেছে নাজ।
হঠাৎই কলিংবেলের শব্দে সংবিৎ ফিরে পেল নাজ। দরজা খুলতেই সায়েমের মা, বাবা আর কনার দেখা মিললেও সায়েমকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
নাজ শাশুড়িকে কদমবুসি করে মধুর গলা বলল, “স্লামালিকুম খালা। ভালো আছেন?”
হাসনা বেগম ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম, এসব কোন দেশি অভ্যাস বৌমা? এখন তো তোমার বিয়ে হয়েছে না-কি? বিয়ের পরেও যে শাশুড়িকে খালা ডাকা যায় না, এসব তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে?”
নাজ কিছু না বলে কদমবুসি করলো সায়েমের বাবাকে। এই বেচারা আত্মভোলা মানুষ। তাকে বাবা ডাকা হোক, কিন্তু খালু – কোনোকিছুই তার ভাবান্তর হয় না।
তিনি আন্তরিক স্বরে বললেন, “বেঁচে থাকো, মা।”
কনা নাজকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের আর্তনাদ করে বলল, “কী অবস্থা দোস্ত!”
আবারও শোনা গেল হাসনা বেগমের হতাশ কণ্ঠস্বর, “এ কী কনা? তোদের আদব-কায়দা শেখাতে শেখাতে আমি বুড়ি হয়ে গেলাম। নিজের ভাবির সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে।”
কনা এবার গম্ভীর গলায় বলল, “ওহ সরি! তা দোস্ত ভাবি, আপনি কেমন আছেন?”
নাজ তার মতো গম্ভীর স্বরেই বলল, “ভালো আছি, দোস্ত ননদ।”
দুজনেই হাসনা বেগমের আড়ালে মুখ চেপে হেসে ফেলল।
হাসনা বেগম এবং শওকত সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসার ঘরের সোফায় বসেছেন। নাজ ফ্রিজ থেকে শরবতের গ্লাস বের করে তাদের সামনে রাখতে রাখতে বলল, “মা, শরবতটা খান। ভালো লাগবে।”
নিজের মা ছাড়া অন্য কাউকে কোনো মা-জাতীয় কিছু ডাকেনি নাজ। এই প্রথম শাশুড়িকে ‘মা’ ডাকতে মনের মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। কী আর করা!
শওকত সাহেব শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “বাহ্! বেশ ভালোই তো হয়েছে। কখন বানিয়েছ বৌমা?”
“এই তো! আপনারা আসার কিছুক্ষন আগে।”
কথাটা ডাহা মিথ্যা। এই শরবত নাজ বানায়নি। সে শরবত বানালে তা কয়েক হাজারবার মুখ বিকৃত করে তবেই খেতে হয়। শরবত আজ সকালে সায়েম বানিয়েছে।
নাজ মিষ্টি রিনরিনে গলায় বলল, “বাবা, পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
শওকত সাহেব কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই কনা বলে উঠল, “সমস্যা হলেই বা কী? এতে তোর কিছু করার আছে? এই যেমন ধর, রাস্তায় অনেকগুলো গর্ত ছিল। বাস একটু পর পর গর্তে পড়ে ঝাঁকি খেয়েছে। এখন তুই কি গিয়ে গর্তগুলো ঠিক করে দিয়ে আসবি?”
নাজ আর কনা দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠল। আর তখনই বাড়ির সদর দরজায় দেখা মিলল সায়েমের। নাজ অবাক হয়ে লক্ষ করলো সায়েম আর দারোয়ান দুজনের হাতেই চারটা করে ব্যাগ। এরা এতগুলো ব্যাগ নিয়ে বেড়াতে এসেছে? কী সাংঘাতিক!
সায়েম ব্যাগগুলো মেঝেতে নামিয়ে রাখতে রাখতে বিরক্ত গলায় বলল, “মা, বাড়ির টিভি, ফ্রিজ, আলমারি এগুলো বাদ রাখলে কেন? ওগুলোও সঙ্গে করে নিয়ে আসতে!”
হাসনা বেগম বিব্রত গলায় বললেন, “নিজের সংসার ছেড়ে আমি এমনিতেই কোথাও যাই না বাবা। দরকারি জিনিসগুলো যাতে হাতের কাছে পাওয়া যায়, এজন্যেই…”
কনা বলল, “দেখো না ভাইয়া, মা সাথে করে হাতপাখাটা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তুমিই বলো, তোমাদের বাড়িতে কি ফ্যান নেই?”
হাসনা বেগম বললেন, “সামনে ঈদ, কখন কোনটা কাজে লেগে যায়!”
“তাই বলে হাতপাখা? ঈদের সঙ্গে হাতপাখার সম্পর্ক কী?”
“আহ্! ভ্যাজর ভ্যাজর বন্ধ কর তো। বৌমা শোনো! শরবতটা ভালোই বানিয়েছ। কিন্তু আমাদের পেয়েছে চায়ের তৃষ্ণা। কড়া করে একটু চা করো দেখি!”
নাজের গা বেয়ে যেন শীতল স্রোত বয়ে গেল। এক জায়গায় জমে দাঁড়িয়ে রইল। নাজ যে চা বানাতে পারে না তা নয়, তবে নিজের বানানো চা নাজ নিজেকে পর্যন্ত খেতে দেয় না। ওই চা খেলে যেকোনো মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃতি পর্যন্ত ঘটতে পারে।
নাজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সায়েমের দিক। ছেলেটা মিটিমিটি হাসছে। কী সাংঘাতিক! সে আজ নাজকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করছে না তো?
(চলবে)