অপেক্ষারা পর্ব-২৪+২৫

0
558

#অপেক্ষারা
২৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

বাড়িসুদ্ধ আত্মীয়-স্বজনেরা গম্ভীর ভঙ্গিমায় আলোচনায় বসেছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সায়েম। ছেলেটা এতগুলো মানুষকে অগ্রাহ্য করে কী করে ঢাকায় ফিরে গেল, তাই ভেবে পাচ্ছে না সকলে। এসব আলোচনায় অংশ নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাই নাজ আর কনা একপ্রকার পালিয়েই এসেছে শিউলিদের বাড়িতে।

নাজ, কনা, শিউলি আর মালা – এই চারটি মেয়ে একত্র হলেই এলাকার মানুষের জন্যে বিভীষিকার সৃষ্টি হয়। একত্রে এরা কতো কান্ড যে বাঁধিয়েছে তার হিসাব নেই। মানুষের সাইকেলের চাকা পাংচার করে দেওয়া, বাচ্চাদের লবণমেশানো চকলেট খেতে দেওয়া, কেউ তাদের একজনের সঙ্গে একটু খারাপ আচরণ করলেই তাকে কাঁদায় ফেলে দেওয়া – সকল প্রকার উদ্ভট কাজের রেকর্ড আছে এই চারজনের নামে।

বর্তমানে তারা পা ভাঁজ করে বসে আছে শিউলির বিছানায়। শিউলির মা রাশেদা খাতুন একগাদা পিঠাপুলি নিয়ে এলেন।

নাজ স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলল, “এসবের কী দরকার ছিল খালা?”

রাশেদা খাতুন আন্তরিক গলায় বলল, “দরকার ছিল না মানে? কতগুলো দিন পরে তোমাকে দেখলাম। আমি তো শিউলিকে প্রায়ই তোমার কথা বলি।”

“তাই না-কি? কী বলেন?”

“বলি দেখ, মেয়েটা বিয়ে-শাদি করে কত সুখে আছে। বিয়ের ব্যাপার যত তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলা যায় ততই মঙ্গল। লেখাপড়া তো বিয়ের পরেও করা যায়, কী বলো মা?”

নাজ বহুকষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, “ঠিক বলেছেন খালা। আমি তো বলি, এই শীতেই ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিন শিউলিকে।”

“এইটাই তো সমস্যা মা! ভালো ছেলে কই পাই? সবার তো আর তোমার মতো রাজকপাল নেই।”

শিউলি এ প্রসঙ্গ থেকে মুক্তি পেতে হুট করে বলে উঠল, “মা! নাজকে তোমার সেই বিখ্যাত নাড়ু খাওয়ালে না?”

রাশেদা খাতুন আঁতকে উঠে বললেন, “দেখেছিস! একদম ভুলে গেছি। নাজ মা, তুমি পিঠা খাও আমি নাড়ু নিয়ে আসছি।”

তিনি ব্যস্ত পায়ে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।

নাজ হাসতে হাসতে বলল, “আহা! বেচারীকে পাঠিয়ে দিলি কেন? ভালোই তো লাগছিল তোর বিয়ের আলাপ করতে।”

শিউলি শুকনো মুখে বলল, “হয়েছে, তোকে আর ঘটকালি করতে হবে না।”

“শিউলি?”

“হুঁ?”

“তোর কী হয়েছে? মুখটা এমন শুকনো দেখাচ্ছে না?”

শিউলি ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই কি ঢাকায় গিয়ে আমার চেহারাটাও ভুলে গেছিস? আমি এমনই দেখতে।”

“মোটেও ভুলিনি, বললেই হলো আমি এমনই দেখতে। নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ঘটেছে।”

শিউলি কিছু বলতে যাবে তখনই মালা বলে উঠলো, “কী আবার হবে? যেদিন থেকে প্রেম করতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই চেহারার এই দশা। দু মিনিট পর পর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া করে আর মুখটা প্যাঁচার মতো করে রাখে।”

নাজ বলল, “ছি ছি শিউলি! আমি তো ভেবেই পাই না তোর প্রেম করার কী দরকার? এটা প্রেম করার বয়স হলো?”

শিউলি আহত গলায় বলল, “নিজে বিবাহিত মহিলা হয়ে আমাকে প্রেম করতে নিষেধ করছিস?”

“আরে বাবা, বিবাহিত হওয়া আর প্রেম করা তো এক জিনিস নয়। বিয়ে হলো সারাজীবনের ব্যাপার, প্রেম-ট্রেম মানেই টাইম ওয়েস্ট।”

“এই কনা, তোর ভাবিকে জ্ঞান দিতে বারণ কর তো!”

কনা কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বলল, “কী যে বলিস শিউলি! ভাবি মানুষ, এভাবে অসম্মান করতে পারি?”

নাজ বাদে সকলে একযোগে খিলখিল করে হেসে উঠলো।

নাজ সরু গলায় বলল, “হয়েছে? এবার কাজের কথায় আসি? এই মালা, শিউলির বয়ফ্রেন্ডটা কেমন রে?”

“বাজে, বিশ্রী, ফালতু, জঘন্য, স্টুপিড একটা ছেলে! এবছর এইচএসসি দেবে। যেমন লেখাপড়ায় বাজে, তেমনই চেহারার দশা। দেখে মনে হয় যেন একবছর গোসল করেনি।”

শিউলি ধমকের সুরে বলল, “চুপ কর তো মালা! শিহাব অনেক ভালো ছেলে।”

“শিহাব তো নয়, যেন রিহাব!”

নাজ কৌতূহলী গলায় বলল, “তুই দেখছি বেচারাকে দেখতেই পারিস না। কাহিনীটা কী?

কনা বলল, “কাহিনী হলো শিহাব ভাই একদিন মালাকে মুটি বলেছিল?”

“কী বলেছে?”

“মুটি! শিহাব ভাই একদিন বলেছিল আমাদের সবাইকে ফুচকা খাওয়াবে। মালা তখনও কলেজের ভেতরে, আমরা ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করছি। শিহাব ভাই হঠাৎ করে শিউলিকে বলে উঠলো, তোমার মুটি বান্ধবীটা তো এখনো এলো। আর মালা ঠিক তখনি দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের পেছনে। কথাটা শোনার পর থেকেই শিহাব ভাই ওর চোখের বিষ।”

মালা রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “এত ভাই ভাই করছিস কেন? তোর কোন মায়ের পেটের ভাই ওই রিহাব?”

শিউলি আহত গলায় বলল, “শিহাব কিন্তু ওই ঘটনার পর তোকে বহুবার সরি বলেছে। তবুও তুই বেচারাকে প্রতিনিয়ত অপমান করে যাচ্ছিস।”

“আমার কাছে ওসব সরি-টরির কোনো মূল্য নেই!”

নাজ বলল, “তাহলে তোর সঙ্গে ওই রিহাব… মানে শিহাব ভাইয়ের ঝগড়া হয়নি?”

শিউলি বলল, “ঝগড়া হতে যাবে কেন? আমরা একসঙ্গে ভালোই আছি।”

“তাহলে মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেন?”

শিউলি ব্যথিত দৃষ্টিতে মালা আর কনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরাই বল, আজ বালা স্যার কী করেছে।”

“বালা স্যার? সেটা আবার কে?”

মালা আগ্রহ নিয়ে বলল, “অক্ষয় কুমারের বালা চরিত্রটার কথা মনে আছে?”

“হ্যাঁ।”

“আমাদের কলেজে নতুন এক স্যার এসেছে। কমবয়সী, কিন্তু মাথার সব চুল পড়ে গেছে। আবার ইয়া বড় এক গোঁফ রাখে। হুবহু অক্ষয় কুমারের বালা চরিত্রের মতো দেখতে। তাই আমরা আড়ালে ডাকি বালা স্যার।”

নাজ হাসতে হাসতে বলল, “তোরা পারিসও! সেই কোন যুগের বালা চরিত্র, সেটাকে এখনো মনে রেখে বসে আছিস?”

“মনে ছিল না তো! স্যারকে দেখে মনে পড়েছে।”

“তা বালা স্যার কী এমন করলো যে আমাদের পরীর মতো বান্ধবীটা মুখ ভোঁতা করে বসে আছে?”

মালা সতর্ক কণ্ঠে বলল, “প্রথম প্রথম বালা স্যার শিউলিকে খুব পছন্দ করতো বুঝলি। শিউলির কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতো, পরীক্ষার হলে হাজারবার দেখাদেখি করলেও কিছু বলতো না। কিন্তু একদিন বালা স্যার রিহাবের সঙ্গে দেখে ফেলে শিউলিকে। সেদিন থেকে বেচারীকে একেবারে সহ্যই করতে পারে না।”

“বলিস কী?”

“হুঁ! আজকাল কথায় কথায় শিউলিকে ধমক দেয়। কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে কড়া গলায় বলে, লেখাপড়া ছেড়ে মানুষের বাড়ি কাজ নাও। আজ তো সে সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।”

“মানে?”

“আজ অবজেক্টিভ পরীক্ষার সময় শিউলি একটু দেখাদেখি করছিল। এমন দেখাদেখি তো সকলেই করে। স্যাররা ধরে ফেললে প্রথমবারে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। দ্বিতীয়বার ধরে ফেললে সতর্ক করে তার তৃতীয়বারে খাতা তুলে নেয়। তাই না?”

“হ্যাঁ।”

কনা গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, “কিন্তু বালা স্যার আজ প্রথমবারেই শিউলির খাতা তুলে নিয়ে গেছে। খাতা ফেরত দিয়েছে বিশ মিনিট পর। বেচারি তো সবগুলো অবজেক্টিভ দাগাতেই পারলো না।”

নাজ হতভম্ব হয়ে বলল, “এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল আর তোরা হাত গুটিয়ে বসে আছিস?”

শিউলি হতাশ গলায় বলল, “তো কী করবো? আজকাল কলেজ নিয়মকানুন নিয়ে বেশ কড়াকড়ি করে। উল্টাপাল্টা কিছু করতে গেলেই সাসপেনশন খাবো।”

“তোরা এই কলেজে পড়িস তাই সাসপেনশন খাবি, কিন্তু আমি তো আর এই কলেজের ছাত্রী নই।”

“মানে?”

“বালা স্যারের বাড়ি চিনিস তোরা?”

“চিনি তো। কিন্তু কেন?”

নাজ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “চল, তোদের মজা দেখাই।”

নাজের কথাটায় সকলে যেন আশার আলো দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে তারা উঠে দাঁড়িয়ে নাজের পিছু পিছু বাড়ির বাইরে চলে এল। শিউলিদের বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। পায়ে হেঁটে গেলে কয়েক মিনিট লাগে মাত্র। সকলে আবারও গল্পে মেতে উঠে পৌঁছে গেল বাজারে।

নাজ অপরিচিত এক দোকানে গিয়ে দুই ডজন ডিম কিনলো।

মালা অবাক গলায় বলল, “এতগুলো ডিম দিয়ে কী হবে নাজ?”

“বললাম না, মজা হবে।”

কনা থমথমে গলায় বলল, “আমার ভাইয়ার টাকাগুলো এভাবে নষ্ট করছিস?”

“তোর ভাইয়া আমাকে টাকা দেয়ই নষ্ট করার জন্যে, চল তো এখন বালা স্যারের বাড়িতে।”

তারা চারজনে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বালা স্যারের বাড়ি। বাড়িটা তেমন আহামরি কিছু নয়। মাথার ওপরে রঙিন টিনের ছাদ আর সামনে প্রশস্ত উঠান। গ্রামের আর পাঁচটা সাধারণ সচ্ছল বাড়ির মতোই। বাড়ির উঠানে একশ পাওয়ারের একটা বাল্ব ঝুলছে। সেই বাল্বটাকে তাক করেই একটা ডিম ছুঁড়ে মারলো নাজ।

তার নিশানার প্রশংসা করতেই হয়। ডিমটা সোজা গিয়ে পড়ল বাল্বের ওপরে। ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে গেল জিনিসটা। নাজ শিউলির দিকে ডিমগুলো বাড়িতে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নে! মনের যত রাগ আছে সব ছুঁড়ে মার।”

নাজের কথা মতোই শিউলি ওই বাড়ির দিকে একটা একটা করে ডিম ছুঁড়ছে আর একটু একটু করে মনে জমে থাকা সকল রাগও পানি হয়ে যাচ্ছে। শিউলির দেখাদেখি এবার কনা আর মালাও ডিম ছুঁড়ছে। এতটা আনন্দ যেন তারা জীবনেও পায়নি।

নিমিষেই ভেঙে পড়লো বাড়ির জানালার ছয়টা কাঁচ। পুরো উঠান ডিমে ডিমে ছেঁয়ে গেল। অবশেষে দেখা গেল বালা স্যারকে। সম্ভবত বেচারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চোখ ডলতে ডলতে উঠানে এসে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, “কী হচ্ছে এসব?”

সঙ্গে সঙ্গে তারা লুকিয়ে পড়লো ঝোঁপের আড়ালে। নাজ আচমকাই কী যেন মনে করে উঠে দাঁড়ালো। বালা স্যারেকে লক্ষ করে ছুঁড়ে মারলো শেষ ডিমটা। এবারও নিশানায় এতটুকুও ভুল হলো না। ডিমটা সোজা গিয়ে পড়লো স্যারের টেকো মাথার ওপরে।

এখানে আর এক সেকেন্ডও থেকে কাজ নেই। তারা চারজন এক নিঃশ্বাসে ছুটে পালালো।

বালা স্যারের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে আসতেই শিউলি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, তোকে বলে বোঝাতে পারবো না দোস্ত। তুই এসেই আমার মনটা ভালো করে দিলি। এবার কিন্তু কিছুতেই তোকে ঢাকায় ফিরে যেতে দিচ্ছি না।”

নাজও হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এরপর কেউ কিছু বললেই আমাকে জানাবি, মুখটা গোমড়া করে বসে থাকবি না। গোমড়া মুখে তোকে খুবই বিশ্রী দেখায়।”

মালা বলল, “শুধুই শিউলির বেলায়ই বিশ্রী দেখায় তাই না? আর ওই রিহাব যে আমাকে মুটি বলল, তার বেলায় কিছুই না?”

“কী ভেবেছিস ছেড়ে দেব না-কি রিহাবকে?”

শিউলি আঁতকে উঠে বলল, “তোর মাথায় আবার কী চলছে নাজ?”

“সেটা কাল সকালেই দেখতে পাবি। এমন শিক্ষা দেব তোর রিহাবকে, জীবনেও কাউকে মুটি বলবে না।”

“দোস্ত প্লিজ! এটা না করলে হয় না? আরে বাবা, শিহাব তো ঠাট্টা করছিল।”

“মালাকে নিয়ে ঠাট্টা করার অধিকার কে দিয়েছে ওকে? শোন শিউলি, আমার বান্ধবীদের কেউ বিরক্ত করলে আমি কিন্তু তাকে ছেড়ে দেব না। সে যেই হোক।”

কনা উৎসুক গলায় বলল, “ওর বাড়িতেও কি ডিম ছুঁড়ে মারবি নাজ?”

“আরে না! সবার বাড়িতে একই জিনিস ছোঁড়া বোরিং ব্যাপার। কাল সকাল সকাল তোরা কয়েক বালতি দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা জোগাড় করবি, ওই ব্যাটার বাড়ির সামনে ফেলে আসবো।”

আগ্রহ আর উত্তেজনায় মালা আর কনার চোখদুটো চকচক করে উঠলো। শিউলি অনবরত তাদের কাছে কাকুতি মিনতি করে যাচ্ছে, তবে তাতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না।

অতিথিদের প্রস্থানের পর বাড়িঘর গোছগাছ করতে করতে বেশ অনেক রাত হয়ে গেল। আয়েশা বেগম লক্ষ করলেন নাজ চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে বসার ঘরজুড়ে। মেয়েটার মধ্যে বিচিত্র এক অস্থিরতা লক্ষ করলেন তিনি।

আয়েশা বেগমের কাছে আজ মনে হচ্ছে, মেয়েটা যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। এইতো, কয়েকটা দিন আগেও তার চোখেমুখে শিশুসুলভ চঞ্চলতা দেখা যেত। এখন আর দেখা যায় না। বিয়ের পরে কি সব মেয়েই এভাবে বদলে যায়?

আয়েশা বেগম স্বাভাবিক গলায় বললেন, “কীরে নাজ? ঘুমোবি না?”

চমকে ওঠার মতো কোনো কথা নয় এটি। তবুও নাজ ভয়ঙ্করভাবে চমকে উঠলো। যেন এমন কথা সে জীবনে শোনেনি।

নাজ অস্থির গলায় বলল, “হ্যাঁ? এখনই ঘুমাবো?”

“ওমা! এখনই আবার কী? বারোটা বাজতে চলল?”

নাজ ভড়কে উঠে ঘড়ির দিকে তাকালো। কই? বারোটা তো এখনো বাজেনি, কয়েক মিনিট বাকি আছে!

“কীরে নাজ? কী হলো?”

নাজ বহুকষ্টে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, “কিছু না মা, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”

“তুই ঘুমোবি না?”

“না মা, আমার কাজ আছে।”

“এত রাতে কী এমন কাজ?”

“তুমি বুঝবে না।”

“আমি আরও ভাবলাম, আজ বহুদিন পর মা-মেয়ে একসঙ্গে ঘুমোতে যাবো। সারারাত জেগে গল্প করবো।”

নাজ ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “এদিকে আমি টেনশনে মরে যাচ্ছি, আর তুমি আছ তোমার গল্প নিয়ে!”

আয়েশা বেগম চিন্তিত গলায় বললেন, “কীসের টেনশন রে মা?”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “বললাম তো বুঝবে না! আমাকে বিরক্ত কোরো না তো মা।”

ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটা। নাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই কাঁটার দিকে। অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে তার সমস্ত অন্তরাত্মা। বুকের ধুকপুক এতটাই বেড়ে গেছে যেন পৃথিবীর সকলের কাছে পৌঁছে যাবে সেই আওয়াজ।

মানুষটা কি চিঠিটা পড়ে দেখছে? পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলেছে সেই চিঠি না-কি যত্ন করে তুলে রেখেছে বুকপকেটে? কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। নাজের মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করে জ্বলে উঠছে। ইচ্ছা করছে জাগতিক সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে।

সায়েমের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত দেড়টা বেজে গেল। তার সারা দিনটা বলতে গেলে কেটেছে বাসের ভেতরই। ঢাকা শহরের চিরচেনা যানজট ঠেলে বাসায় যে পৌঁছাতে পেরেছে, এই অনেক। বেচারা এখন ভীষণ ক্লান্ত, কোনমতে ফ্রেশ হয়ে ঘুমোতে পারলে বাঁচে।

হঠাৎ মনে পড়লো নাজের সেই কাগজের কথা। কাগজটার ভাঁজ খুলতেই চোখে পড়লো দীর্ঘ এক চিঠি। সম্বোধনহীন চিঠি, অবশ্য এটাই তো স্বাভাবিক। নাজ তো আর তাকে কিছু ডাকে না, চিঠিতে সম্বোধন করবে কী বলে?

এতসব লেখা পড়ার মতো তিল পরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট নেই সায়েমের মাঝে। ক্লান্তিতে চোখদুটো শিসার মতো ভারী হয়ে আসছে। তবুও মেয়েটা এত করে বলে দিয়েছে বলেই পড়তে শুরু করলো। আর পড়তে পড়তেই তার চোখমুখ থেকে ক্লান্তি দূর হয়ে ক্রমেই চলে এল ভিন্ন এক অনুভূতি।

চিঠিটা এরকম –

আপনার ওপর আমার ভীষন রাগ হচ্ছে জানেন। রাগে পুরো পৃথিবীটা চুরমার করে ফেলতে ইচ্ছা করছে। এত সহজেই আজকের দিনটা কথা ভুলে গেলেন? দাঁড়ান, মনে করিয়ে দিচ্ছি। এক বছর আগে ঠিক এই দিনে, নাবালিকা একটি মেয়েকে বিয়ে করে সারাজীবনের জন্যে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন আপনি। এবার মনে পড়েছে?

এই এক বছরে আপনার জীবনে আমার অস্তিত্ব কতটুকু প্রতিষ্টা করতে পেরেছি জানি না। আপনার মনে কতটুকু জায়গা করে নিতে পেরেছি, কিংবা আদৌ পেরেছি কিনা তাও জানি না। আপনার মনের খবর আমি জানবো কী করে, আমি তো জানবো আমার মনের খবর।

এতগুলো দিনে কি টের পেয়েছেন, কতটা ভীতু মেয়ে আমি? অন্ধকারে ভয় পাই, রক্ত দেখলে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাই। আমাকে আপনি কী করে সহ্য করেন বলুন তো? এতটা ভীতু হওয়া সত্ত্বেও মনে প্রচুর সাহস সঞ্চয় করে লিখতে বসেছি। লেখাটা পছন্দ না হলে কোনদিনও উত্তর দিতে হবে না। চাইলে আপনার স্বভাবমতো আমাকে দুয়েকটা ধমকও দিতে পারেন। তবুও দিনশেষে আমার মনের কথাগুলো তো আর অজানা থাকবে না আপনার।

আমি কোনো ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না জানেন। একজনের দিকে তাকিয়েছিলাম, এক বছর আগে। চোখদুটো এখনও তারই দিকে আটকে আছে। আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে নিজেকে সামলে রাখতে, আমাদের মাঝে যে সূক্ষ্ম দেয়াল তৈরি করেছেন আপনি, তার অপরপ্রান্তে থাকতে। কিন্তু পারি না। কেবলই ইচ্ছে হয়, দেয়াল টপকে ওপারে চলে যেতে।

সব দোষ আপনার! আমি তো গ্রামের আর পাঁচটা সাধারণ ডানপিটে মেয়ের মতোই ছিলাম। হুট করে আপনি এসেই আপনার চঞ্চল হৃদয়টাকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিলেন। নিজের উপস্থিতিতে সম্পূর্ন ভিন্ন এক জগতে নিয়ে গেলেন আমায়। যে জগতে একমাত্র আপনি ছাড়া আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

আপনি কি জানেন, হাসলে আপনাকে কতোটা সুন্দর লাগে? যদিও খুব কম হাসতে দেখছি, তবুও যতবারই দেখেছি মোহিত হয়ে রয়েছি। মনে হয়েছে যেন এর থেকে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না। হয়তো কখনো খেয়াল করেননি, আপনার গলার স্বর, আপনার ছায়া, আপনার পায়ের আওয়াজ – সবকিছুরই মধ্যেই আমি মিশে আছি। আমার অস্তিত্ব আপনাকে ছাড়া অপূর্ণ।

প্রথম দিকে আপনাকে করলার মতো তিতা একটা মানুষ বলে হতো। মনে হতো তিতা এই মানুষটা এসে আমার পুরো জীবনটাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। আসলেই তো ধ্বংস করেছেন। এমন তীব্রভাবে ধ্বংস করেছেন, যে আপনি বাদে কোনোকিছু ভাবার সাধ্য অবশিষ্ট নেই আমার মাঝে। আশেপাশে যাই দেখি, তাতে আপনাকে খুঁজে বেড়াই। মনে হয় যেন সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে গিয়ে আপনাকেই স্পর্শ করবে।

যে কথাটা বলার জন্যে বহুকাল ধরে অপেক্ষা করে আছি, যে কথাটা বলার জন্যে দীর্ঘ এই চিঠি – সে কথাটা বলেই ফেলি তাহলে। লিখতে বসে আমার হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে। বুক ধুকপুক করছে। আপনি যখন পড়ছেন, তখনও নিশ্চয়ই মায়ের বাড়িতে দুশ্চিন্তায় ছটফট করছি আমি।

কথাটা হলো, আমি আপনাকে ভালোবাসি সায়েম। মনের অজান্তে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে। শুধুমাত্র আপনাকে পেলে জীবনে আর কোনো চাওয়া থাকবে না আমার। একটাবার ভালোবাসবেন আমাকে?

ইতি,
আপনার এফএম রেডিও

(চলবে)
#অপেক্ষারা
২৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“এসবের মানে কী নাজ?” গম্ভীর গলায় বলল সায়েম।

মোবাইল স্ক্রিনে সায়েমের নামটা ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নাজের হৃদস্পন্দন যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল। মুহূর্তের মাঝে হাজারটা ভাবনা এসে বাসা বাঁধলো তার মস্তিষ্কে। সায়েম ফোনে কী বলতে পারে ভাবনাগুলো সে সংক্রান্তই। তবে মানুষটা যে এমন কিছু বলতে পারে তা হয়তো ছিল নাজের ভাবনারও বাইরে।

তাই ভড়কে গিয়ে বলল, “জি?”

সায়েম ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “কোন সাহসে এসব হাবিজাবি লিখেছো তুমি?”

নাজ চুপ করে রইল। এসব কী হচ্ছে? সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন? নাজ জানতো মানুষটা চিঠি পড়েই তাকে ফোন করবে। তাই ফোনে মানুষটা কী বলবে সেই কথাগুলোও মনে মনে সাজিয়ে রেখেছিল নাজ। কিন্তু সে ফোনে যে এতটা রাগ নিয়ে কথা বলবে তা ছিল নাজের কল্পনার অতীত। এবার সে কী করবে?

সায়েম আবারও বলল, “না চুপ করে থাকবে না, উত্তর দাও। এসবের মানে কী? এটাও কি তোমার লাইব্রেরিতে তেলাপোকা ছেড়ে দেওয়ার মতো কোনো জোক?”

নাজ আঁতকে উঠে বলল, “না!”

“তাহলে? একচুয়ালিই লিখেছো?”

সায়েম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বলল, “ভালোবাসা মানে জানো তুমি? বাংলা সিনেমা থেকে দুয়েকটা লাইন লিখে শেষে জুড়ে দিলে আমি আপনাকে ভালোবাসি – ভালোবাসা এতটাই সোজা?”

নাজের গলা পর্যন্ত কান্না এসে গেছে। ইচ্ছে করছে ফোনটা কেটে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। যেখানে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।

তবুও বহুকষ্টে নিজেকে সামলে গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “সিনেমার কোনো লাইন তো লিখিনি। যা লিখেছি সবই আমার নিজের কথা।”

“নিজের কথা? হতেই পারে। তোমার বয়সটাই এমন, করো ওপরের ইনফাচুয়েশন জন্মানো বড় কোনো ব্যাপার নয়। তাই বলে তোমার দুই দিনের মোহকে ভালোবাসা বলে চালিয়ে দেবে?”

‘দুই দিনের মোহ’ কথাটা ঝনঝন করে বেজে উঠলো নাজের কর্ণকুহরে। এতটা মানুষের জীবনের সবথেকে মূল্যবান অনুভূতিকে কেউ এতটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখতে পারে?

নাজের খুব বলতে ইচ্ছা করছে, “আমি না নয় নাই জানলাম ভালোবাসার মানে। আপনি জানেন? কখনো ভালোবেসে দেখেছেন কাউকে?”

নাজ বলতে পারলো না। নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল অপরপ্রান্তে থেকে আরও কিছু শোনার আশায়।

সায়েম পরিষ্কার গলায় বলল, “আমার কাছে কখনো মনে হয়নি যে আমাদের সম্পর্কটা ভালোবাসার দিকে এগোতে পারে। তুমি নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে, তবুও এতটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পারো যে তোমার আমার সম্পর্ক আর পাঁচটা সাধারণ স্বামী-স্ত্রীর মতো নয়। আমাদের বিয়েটাও স্বাভাবিকভাবে হয়নি।”

নাজ হুট করে অন্যরকম গলায় বলল, “আমি রাখি হ্যাঁ? অনেক রাত হয়ে গেল।”

অপরপ্রান্তে থেকে এবার আর কোনো উত্তরের অপেক্ষায় রইলো না নাজ। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কেটে দিলো। তার হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। চিন্তা করার ক্ষমতা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমচকাই মানুষটা তাকে এক কৃষ্ণগহ্বরে ফেলে দিয়েছে তাকে, সে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর থেকে গভীরে।

মাথার ভেতরে সূক্ষ্ম এক ধরনের যন্ত্রণা শুরু হয়েছে এবং ক্রমেই বাড়ছে। এই যন্ত্রণা আরও বাড়বে, দীর্ঘ দিন ভোগাবে তাকে। বাবা চলে যাওয়ার পর ঠিক এভাবেই মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে ছিল তার।

নাজ কখন যে ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পেছনের পুকুরঘাটে এসে বসেছে, নিজেই খেয়াল করেনি। সময়টা যেন থেমে গেছে তার জন্যে। প্রবল ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে নাজ তাকিয়ে রইল পুকুরের জলের দিকে। আজ পূর্ণিমার রাত। অনিন্দ্য সুন্দর চাঁদটা ঠিক মাথার ওপরে। সম্ভবত এই প্রথমবার পুকুরের জলে চাঁদের প্রতিফলন মোহিত করে তুলল না তাকে।

একটু আগে যা ঘটে গেল সবই কী তার কল্পনা না-কি বাস্তব? কল্পনায় তো কত কিছুই দেখে নাজ, এটাও যদি সেই কল্পনার কাতারে পড়ে যায় তাহলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে?

ভোর ছয়টা একান্ন। অন্ধকার ঘরে চোখদুটো বুজে শুয়ে আছে নাজ। সারা রাত এক মুহূর্তের জন্যেও চোখদুটো বন্ধ হয়নি তার। চোখের ভেতরে কেমন যেন জ্বালাপোড়া হচ্ছে। আশেপাশে কেউ পেঁয়াজ কাটতে বসলে যেমন জ্বালাপোড়া করে, ঠিক সেরকম। নাজ ঘুমোতে চাইছে, কিন্তু পারছে না।

হুট করে তার ঘরে এলো কনা। তার মধ্যে ফুর্তি ফুর্তি আমেজ।

কনা নাজের বিছানায় বসে উৎফুল্ল গলায় বলে উঠল, “দোস্ত উঠে পড়! মিশনে নামতে হবে তো!”

নাজ যন্ত্রের মতো উঠে বসতে বসতে অন্যমনস্ক গলায় বলল, “কী হয়েছে?”

“বহুকষ্টে পাঁচ বালতি অবর্জনা জোগাড় করেছি।”

“ওহ! জোগাড় করেছিস না?”

“হ্যাঁ! জলদি উঠে আয়, আটটার মধ্যে বাড়ি থেকে শিহাব বেরিয়ে যাবে। তার আগেই কাজটা সারতে হবে।”

নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “আমার যেতে ইচ্ছা করছে না, তোরা যা।”

“আমরা যাবো মানে? সব প্ল্যান করলি তুই, আর তোরই কিনা যেতে ইচ্ছা করছে না?”

“না ওই… শরীরটা খারাপ লাগছে। তোরা যা, মজা কর।”

“কিছুই বুঝলাম না। কাল রাত পর্যন্ত তো ভালোই ছিলি, হুট করে কী হলো? কেউ কিছু বলেছে?”

নাজ আঁতকে উঠে বলল, “না! কে কী বলবে? আমার মাথাটা ধরেছে আর কী। একটু ঘুমাই, তাহলে বোধ হয় ভালো লাগবে।”

কনা গম্ভীর গলায় বলল, “সকাল সকাল দিনটাই মাটি করে দিলি!”

“সরি দোস্ত।”

“গেলাম আমি। ভালো কথা, মা তোকে দুপুরে আমাদের সঙ্গে খেতে বলেছে।”

নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “কেন?”

“কেন মানে? ওটা তোর শ্বশুর বাড়ি নাজ! মাথার যে কটা তার অবশিষ্ট ছিল সেগুলোও কি ছিঁড়ে গেছে না-কি?”

কনা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল নাজ। পৃথিবী ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে তার। একমাত্র ঘুমই বোধহয় জাগতিক সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে পারে মানুষকে।

নাজের ঘুম ভাঙলো বেলা এগারোটায় মায়ের ডাকে।

আয়েশা বেগম উদ্বিগ্ন গলায় ডাকলেন, “কীরে নাজ! আর কতো ঘুমাবি? বেলা হয়ে গেছে, এবার ওঠ।”

একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলো নাজ। এতটা সময় সে ভালোই ছিল। সত্যটা আর আশেপাশের মানুষগুলোর মুখোমুখি হতে একেবারেই ইচ্ছে করছে না তার। আজীবনের জন্যে ঘুমিয়ে থাকার ব্যবস্থা থাকলে ভালোই হতো।

নাস্তার টেবিলে আয়েশা বেগম কোমল স্বরে বললেন, “এত বেলা করে ঘুমোলি কেন মা?”

নাজ বিরস গলায় বলল, “রাতে ভালো ঘুম হয়নি।”

“রাত জেগে পায়চারি করলে তো এমনই হবে। রাতে কী এমন কাজ ছিল তোর?”

“এত প্রশ্ন কোরো না তো মা। ভালো লাগছে না।”

“আচ্ছা করবো না। এটা খেয়ে দেখ!”

আয়েশা বেগম নাজের দিকে একটা আচারভর্তি প্লেট এগিয়ে দিলেন। নাজ কোনো প্রশ্ন না করে বাধ্য মেয়ের মতো আচার মুখে দিলো।

“ভালো হয়েছে না?”

“হুঁ।”

“আমাদের এলাকার দুস্থ আর বিধবা মেয়েরা বানিয়েছে। নতুন আচারের ব্যবসা শুরু করেছে বুঝলি। মেয়েগুলো আচার ভালোই বানায়, তবে ব্যবসা জানে না বলে কিছু করতে পারছে না। আমার তো ওদের উদ্যোগ খুবই ভালো লেগেছে, মাঝে মধ্যেই ওদের কাছ থেকে আচার কিনে আনি। অসহায় মেয়েগুলো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, এমন সাহস কটা মেয়ের থাকে বল?”

নাজ চুপ করে রইল।

“কীরে? শুনছিস আমার কথা?”

“শুনছি।”

“তোর শাশুড়ি ফোন করেছিল। বারবার বলে দিয়েছে যেন দুপুরের আগেই তোকে পাঠিয়ে দিই। গোসল করে আয়, তোকে আজ নিজের হাতে সাজিয়ে দেব।”

“সাজিয়ে দিতে হবে কেন?”

“শোনো মেয়ের কথা! বিয়ের পর প্রথমবার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিস, একটু সাজগোজ করবি না?”

“আমি তো আর বিশ্বসুন্দরী নই যে সকলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।”

“তোর কী হয়েছে নাজ? এমনভাবে কথা বলছিস কেন?”

“আমি এমনই।”

নাজ আশা করেছিল শ্বশুর বাড়িতে এসে দেখবে একরাশ আত্মীয়-স্বজনের ভীড় জমেছে। তার ধারণা সঠিক হলো না। বাড়ির মানুষগুলো বাদে বাড়িতে কেবল রয়েছে পাশের বাড়ির বাচ্চা একটি মেয়ে। বাচ্চা মেয়েটির সঙ্গে কনা ঘর সাজাচ্ছে। রান্নাঘরে হাসনা বেগম রান্না করছেন নাজের পছন্দের সব খাবার।

হাসনা বেগমকে আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে কড়া একজন শাশুড়ি। যার জীবনের মূল লক্ষই হলো পুত্রবধূর ভুল ধরা। তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি তার ঠিক উল্টো। নাজকে মনে মনে প্রচন্ড স্নেহ করেন। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশ করতে সংকোচ বোধ করেন। হাসনা বেগম সেই দলেরই এক বিশিষ্ট সদস্য।

নাজ নিশ্চুপ ভঙ্গিতে রান্নাঘরে গিয়ে বসলো তাঁর পাশে।

হাসনা বেগম হাড়িতে খুন্তি নাড়তে নাড়তে বললেন, “বৌমা তোমাকে যে মোটা একটা ডায়েরি আনতে বলেছিলাম, এনেছ?”

নাজ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “হুঁ।”

“আমি প্রতিদিন যা যা রাঁধবো, সেগুলোর রেসিপি সুন্দর করে ডায়রীতে লিখে রাখবে। তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো আবার কারও ভরসায় বসে থাকো না, নিজেরাই ইন্টারনেট থেকে রান্না শিখে ফেল। আরে বাবা, মা-খালাদের রেসিপির ওপরে কিছু আছে না-কি?”

হাসনা বেগমের কোনো কথাই সম্ভবত পৌঁছালো না নাজের কর্ণকুহরে। মাথাটা ভনভন করছে। হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনে। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর তাকে পেতেই হবে।

নাজ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “মা? আমার একটা উপকার করতে পারবেন?”

“কী উপকার বৌমা?”

“আপনার ছেলেকে ফোন করে বলবেন, যেন এই শুক্রবার এসে আমাকে নিয়ে যায়?”

হাসনা বেগম বিস্মিত গলায় বললেন, “সে কী বৌমা? সবে গতকাল এলে, শুক্রবারেই চলে যাবে?”

নাজ ইতস্তত করে বলল, “আসলে মা… কলেজে একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে।”

“কী এমন কাজ?”

“প্রাক্টিকাল পরীক্ষা। পরীক্ষাটার কথা আমি একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ সকালে আমার বান্ধবী ফোন করে মনে করিয়ে দিল। কথাটা যদি আপনার ছেলেকে বলি তাহলে উনি আবার রাগ করে বসবেন। আপনি বললে তো আর রাগ করতে পারবে না। বলবেন মা? প্লিজ?”

হাসনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বলতে তো হবেই। পরীক্ষা বলে কথা। পুরো মাসটা থাকার কথা ছিল, আমি তো কত কিছু ভেবে রেখেছিলাম!”

দীর্ঘ একটা সপ্তাহ কেটে গেল। সময়টা এক সপ্তাহ হলেও নাজের কাছে যেন অনন্তকাল। এই সময়ের ওপরে ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। কেন যে মানুষ চাইলেই অতীতে ফিরে যেতে পারে না। অতীতে ফিরে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে সেই চিঠি, কিংবা তারও আগে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। যখন ওই মানুষটা তার জীবনে আসেনি।

কেন আসতে গেল সায়েম তার জীবনে? নাজ তো ভালোই ছিল নিজের সাজানো গোছানো জীবনটা নিয়ে। কেন এসে তার সব এলোমেলো করে দিল সে?

আজ শুক্রবার। এই কয়েকটা দিন নাজ শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। এই মুহূর্তে নাজ তার ঘরে বসে ব্যাগ গোছাচ্ছে। সায়েম সকাল সকাল এসেই রাগারাগি করছে মায়ের সঙ্গে।

“মা! এতগুলো ব্যাগ কীসের?”

হাসনা বেগম বললেন, “ব্যাগভর্তি আমাদের ক্ষেতের তরি-তরকারি, গাছের নারকেলও রয়েছে।”

আমি বিরক্ত গলায় বলল, “তরকারি-টরকারি কি ঢাকায় পাওয়া যায় না? এতদূর থেকে টেনে নিয়ে যেতে হবে কেন?”

“নিজেদের ক্ষেতের তরকারির মর্ম তুই কি বুঝবি? বৌমা বুঝবে। এগুলোর কিছুই তোর জন্যে দিইনি বুঝলি, দিয়েছি বৌমাকে।”

প্রতিবারের মতো এবারও সায়েমের উপস্থিতি আন্দোলিত করে তুলল নাজের সমস্ত হৃদয়টাকে। একবার মনে হচ্ছে, তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে তার সামনে গিয়ে মনে জমে থাকা সকল প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিতে।

জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে, “আমার জীবনটাকে শেষ করে দিয়ে আপনি তরকারি নিয়ে ঝগড়া করছেন?”

(চলবে)