অপেক্ষারা পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
565

#অপেক্ষারা
২৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

মানুষ নিজের চোখদুটো দিয়েই পৃথিবীকে দেখে, নিজের মস্তিষ্ক জুড়েই তার এলোমেলো সব ভাবনাগুলোর বিচরণ, নিজের মন দিয়েই মানুষ অনুভব করে সহনীয়-অসহনীয় অনুভূতিগুলো। এমনটা যদি না হতো?

নাজের প্রবল ইচ্ছা হয়, নিজের অনুভূতিগুলো এক মুহূর্তের জন্যে হলেও সায়েমকে অনুভব করাতে। করিয়ে জিজ্ঞেস করতে, “দেখুন! কতোটা ভালোবেসেছি আপনাকে। এমনটা ভালো কেউ কোনোদিন বাসতে পারবে?” জীবনটা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে ওই মানুষটা তাকে ভালোবাসবে এমন আশা করা অর্থহীন। নাজ সে আশা করেও না। তার কেবল একটাই চাওয়া – মানুষটা জানুক তার ভালোবাসা দুদিনের মোহ নয়।

আচ্ছা, এই ভালোবাসা জিনিসটা আসলে কী? মনসমুদ্রের উত্তাল কোনো ঢেউ না-কি পৃথিবীর জটিলতম সমীকরণ। হাজার বছর চেষ্টা করেও যে সমীকরণের সমাধান বের করা কষ্টসাধ্য। ভালোবাসা শ্রেষ্টতম অনুভূতিগুলো এনে জড়ো করে মনের মাঝে, আবার একই ভালোবাসা মনটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলতে সক্ষম। কী হতো, এই ভালোবাসা জিনিসটা পৃথিবীতে না থাকলে?

প্রকৃতি অতি সহজে কাউকে ভালোবেসে ফেলার ক্ষমতা দেয়নি। আবার অতি সহজে মন থেকে ভালোবাসাটাকে দূর করার শক্তিও দেয়নি। নাজ যেমন প্রথমদিনেই সায়েমকে ভালোবাসেনি, বেসেছে ধীরে ধীরে মনের অজান্তে। তেমনি এখন প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওই মানুষটাকে ভালোবাসা থেকে মনকে বিরত রাখতে পারছে না।

ভালোবাসা ব্যাপারটা যদি এতই জটিল হয়ে থাকে, তাহলে মানুষ অবলীলায় কী করে বলতে পারে ‘ভালোবাসি’? মানুষ কাকে ভালোবাসবে তা কি প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়? তা নাহলে আটশ কোটি মানুষের এ পৃথিবীতে দুটো মানুষ কেন পরস্পরকেই ভালোবাসে?

মোবাইলের রিংটোনের শব্দে নাজের সাতপাঁচ ভাবনায় ছেদ পড়ল। আশেপাশের মানুষগুলো
আজকাল বড্ডো অসহ্য লাগে। কোনো এক অদৃশ্য চাদরে নিজেকে আড়াল করতে পারলে ভালো হতো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করে নাজ বিরস কণ্ঠে বলল, “বল কনা।”

কনা উত্তেজিত গলায় বলল, “হ্যালো নাজ! কী ব্যাপার? কাল সারারাত তোর ফোন বন্ধ ছিল কেন? আমি আর মালা কম করে হলেও তিন কোটি বার ফোন করেছি তোকে।”

নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাতে আর চার্জ দেওয়া হয়নি।”

“তোর ফোন বন্ধ হয়ে গেছে আর তুই সারারাত চার্জ দিসনি? আগে তো ফোন ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতি না!”

“এখন পারি। তুই কিছু বলবি?”

“বলবোই তো। শুধু শুধু তো আর ফোন করিনি।”

“কী বলবি।”

“শিউলির বিয়ে!”

“বাহ! ভালো তো।”

নাজ কথাটা এমনভাবে বলল যেন সে খবরটা আগেভাগেই জানতো। নিজের সবথেকে ঘনিষ্ট বান্ধবীর বিয়ের সংবাদে মোটেও উচ্ছ্বসিত হলো না সে।

কনা হতবিহ্বল হয়ে বলল, “এই নাজ? তুই বুঝতে পারছিস? শিউলির বিয়ে হতে যাচ্ছে!”

নাজ হাই তুলতে তুলতে বলল, “না বোঝার কী আছে? কার সঙ্গে বিয়ে?”

“কার সঙ্গে আবার? শিহাব ভাইয়ের সঙ্গে! তার বাবা আগামী মাসে পোস্টিং হয়ে চিটাগং চলে যাচ্ছে। একবার পোস্টিং হয়ে চলে গেলে আর কোনোদিন দেখা হয় না হয়, সেজন্যে শিহাব ভাই আগেভাগেই শিউলিকে প্রপোজ করেছে। বউ নিয়ে একেবারে চিটাগংয়ে যাবে। আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে নাজ! তোর আনন্দ হচ্ছে না?”

“হচ্ছে। কবে বিয়ে?”

“আগামী মাসের তিন তারিখে। সময় কিন্তু বেশি নেই। তুই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে আয়। এখানে অনেক কাজ। আমি আর মালা কতিদিক সামলাবো বল তো?”

বিয়েতে গিয়ে আনন্দ-উল্লাস করার মতো মনের অবস্থা এই মুহূর্তে নাজের নেই। তার নিজের ভালোবাসাই যেখানে মানুষের কাছে তাচ্ছিল্যের বিষয়, সেখানে অন্যের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার দৃশ্য মোটেও সুখকর কিছু নয়।

নাজ শুকনো গলায় বলল, “আমি যেতে পারবো না। সামনের মাসে আমার ক্লাস টেস্ট।”

কনা বিস্মিত গলায় বলল, “সামান্য ক্লাস টেস্টের জন্যে তুই শিউলির বিয়েতে আসবি না? পাগল-টাগল হয়ে গেলি না-কি নাজ?”

“না রে। সত্যিই এবার সিরিয়াসলি পড়াশোনা করতে হবে। ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি।”

“তাই বলে তুই শিউলির বিয়েতে আসবি না? তুই না এলে তো মেয়েটা বিয়েই করবে না!”

“তোরা আমার হয়ে ওকে বুঝিয়ে বলিস প্লিজ। আমি সত্যিই যেতে পারবো না।”

এই একই জগতের মাঝে কোটি কোটি ভিন্ন জগত রয়েছে। একেকটা জগত একেক মানুষের মস্তিষ্কে গড়ে ওঠা। সেই জগতে কেবল ওই একটা মানুষেরই বসবাস। নাজ এতকাল এমন এক জগতে বসবাস করে চলছিল যেখানে সে সায়েমকে অসম্ভব ভালোবাসে। ওই মানুষটাও তাকে তার মতো করেই ভালোবাসে।

তবে আচমকাই প্রকৃতি তাকে সেই জগত থেকে টেনে বের করে অন্য এক জগতে এনে ফেলেছে। যে জগতে তার প্রতি ওই মানুষটার এক বিন্দুও ভালোবাসা নেই। সেও চেষ্টা করছে ভালোবাসা নামক যা কিছু আছে, সবই মন থেকে তাড়িয়ে দিতে। কখনো পারছে, কখনো পারছে না।

নাজ বারবার নিজের মনকে বোঝাচ্ছে, মানুষটা যখন একবার বলে দিয়েছে যে সে তাকে ভালোবাসে না, তার মানে বাসে না। কোনো কালে বাসবেও না। জোরাজুরি করে আর যাই হোক, কাউকে ভালোবাসতে বাধ্য করা যায় না। তাই যে করেই হোক এই নতুন জগতটাতে অভ্যস্ত হতে হবে তাকে। কষ্ট হলেও ভালোবাসাটাকে মন থেকে দূর করতেই হবে।

নাজ বুকশেলফ থেকে পাঠ্যবইগুলো বের করে আনলো। অযত্নে বইগুলোতে ধুলো জমে গেছে। হিসাববিজ্ঞানের বইগুলো কেবল পরীক্ষার আগেই খুলে দেখা হয়। নাজ একটা কাপড় এনে যত্ন সহকারে বইগুলো মুছে ফেলল। মনটাকে ব্যস্ত রাখার একমাত্র উপায় হলো লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়া। ব্যস্ত থাকলেই কেবল সকল দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলে থাকতে পারবে সে।

লেখাপড়া করে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। সমাজে সায়েম যতটা প্রতিষ্ঠিত, তার থেকেও বেশি প্রতিষ্ঠিত হতে হবে নাজকে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ তাকে দূরে সরিয়ে রাখার সাহস না পায়।

কলিংবেল বাজল, জরিনা এসেছে। ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে ঢুকতেই তার চোখদুটো উঠে গেল কপালে।

হতবাক গলায় বলল, “ওহ্ আল্লাহ! আফা এতসব রান্না কেডা করছে?”

“আমি করেছি। খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে।”

জরিনা অবিশ্বাসে চামচে করে চিংড়ি মাছের ঝোল তুলে মুখে দিয়ে বলল, “ভালোই তো হইছে আফা, কিন্তুক লবণ একটু কম হইছে। সত্যই আফনে রাঁনছেন?”

“কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না?”

“হ, তয় আফনে এইসব কোত্থেইকা শিখলেন?”

“ইউটিউব থেকে।”

“হেইডা আবার কী আফা?”

“তোমাকে বুঝতে হবে না। শোনো জরিনা, কাল থেকে তুমি শুধু তরকারি কেটেকুটে দেবে। রান্নাবান্না আমিই করবো।”

জরিনা এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চিংড়ি মাছের দিকে। এক বছর ধরে নাজকে চেনে সে। এই এক বছরে একটা বারও তাকে চুলার আশেপাশে দেখা যায়নি। আজ হঠাৎ কী এমন হলো, যে সে নিজ আগ্রহে রান্না করেছে?

ইদানিং নাজ কোনো কারণ ছাড়াই জেদ করছে। তবে জেদটা যে কার ওপরে করছে বোঝা যাচ্ছে না। সারাজীবন নিজেকে চিনে এনেছে নাজনীন হক নামে। বাবার পদবী পাল্টে ফেলার ইচ্ছা তার কোনোকালেই ছিল না। এজন্যেই বিয়ের পরও নিজেকে নাজনীন হক হিসেবেই পরিচয় দিয়ে এসেছে।

তবে গতকাল আচমকাই কী যেন মনে করে ফেসবুকে নিজের নাম পাল্টে লিখল, নাজনীন চৌধুরী। আরও ভালো হতো নাজনীন সায়েম চৌধুরী লিখতে পারলে।

নাম পাল্টে ফেলা, রান্না বান্না করা – এসব কিছুই সায়েমকে নতুন করে মুগ্ধ করার জন্যে করছে না নাজ। করছে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে। সাজানো গোছানো এই সংসারটা চিরকাল তার থাকবে না। তবে যতদিন থাকবে, নাজ তার দায়িত্বগুলো ঠিকঠাকভাবে পালন করতে চায়।

অফিস থেকে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে আবার বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সায়েম। এই সময়টুকু নাজের জন্যে সবথেকে ভয়াবহ। আগে সারাটাদিন অপেক্ষা করে থাকত কখন সায়েম অফিস থেকে ফিরবে, আর কখন সে সারাদিনের জমে থাকা কথাগুলো একেক করে বলবে। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। মনের কথাগুলো মনেই জমে থাকে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে মানুষটা। এই দূরত্ব যেদিন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে, সেদিন নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে নাজ।

রাত নয়টার কাছাকাছি, নাজ মনোযোগ দিয়ে জটিল একটা হিসাব সমাধানের চেষ্টা করছে। কোনদিকে কোনো খেয়াল নেই। আগে পড়তে বসলেই বারবার হাতটা চলে যেত মোবাইলের ওপরে। কিন্তু আজ সে মোবাইলটাই অসহায়ের মতো পড়ে আছে টেবিলের এক কোণে।

হুট করে ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই বুক ধক করে উঠল তার। সায়েম ফোন করেছে। একই ছাদের নিচে বাস করে যে মানুষটা তার সঙ্গে কথা বলে না, সে এত রাতে ফোন করছে কেন?

“হ্যালো?”

ফোনটা রিসিভ করতেই এক প্রচন্ড স্রোত নাজ শিরদাঁড়া প্রকম্পিত করে বয়ে গেল। সায়েমের মোবাইল থেকে ফোনটা করা হলেও অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটা সায়েম নয়, অন্য কেউ।

নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “কে?”

অপরপ্রান্ত থেকে উদ্বিগ্ন এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “নাজনীন বলছেন?”

“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?”

“তাড়াতাড়ি স্কোয়ার হসপিটালে চলে আসতে পারবেন?”

“মানে? কেন?”

“সায়েম রোড অ্যাকসিডেন্ট করেছে।”

নাজের হৃদস্পন্দনের গতি যেন মুহূর্তেই কয়েক হাজারগুণ বেড়ে গেল, চারিদিকে নেমে এলো অন্ধকার। সে এখন কী করবে? আচ্ছা, মানুষটা ঠিক আছে তো? এতগুলো দিন মনে মনে মানুষটাকে কম ভর্ৎসনা করেনি। তবে তার কিছু হয়ে গেলে নাজ যে বেঁচে থাকতে পারবে না।

(চলবে)

#অপেক্ষারা
২৯+৩০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

বাসা থেকে স্কোয়ার হসপিটাল বেশ দূরেই বলা চলে। যে মেয়েটা দিনের বেলাতেই একা একা বের হবার সাহস পায় না, সে রাতের অন্ধকারে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে হসপিটালে। নাজের দুকান দিয়ে গরম বাষ্প বের হচ্ছে, সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মানুষটার মুখটা। মানুষটার কোনো ক্ষতি হয়ে যাক, এমনটা তো নাজ কখনো চায়নি!

বারবার নিজেকে দোষারোপ করছে নাজ। কী হতো সেই চিঠি না লিখলে? অপকাশিত ভালোবাসার প্রকাশ কোনদিনও না করলে? তাহলেই বোধ হয় ভালো হতো। সবকিছু থাকতো আগের মতো। মানুষটা নিজেকে আড়াল করে রাখতে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়তো না, তাকে এড়িয়ে চলার জন্যে সারাদিন বাড়ির বাইরেও থাকতো না। অ্যাকসিডেন্টটাও হতো না।

ওই ভদ্রলোক আরেকবার সায়েমের নম্বর থেকে ফোন করে বলেছিল তাকে তিনতলায় রাখা হয়ে। কেবিন নম্বর ৩০৬। নাজ উদভ্রান্তের মতো ছুটে গেল সেদিকে। কেবিনের সামনে পৌঁছাতেই দেখা মিলল লম্বা-চওড়া এক ব্যক্তির, বয়স সম্ভবত সায়েমের মতোই, চুলগুলো কোকড়ানো। এতটা সময় বসেই ছিল।

নাজকে দেখেই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আপনি নাজনীন?”

নাজ অস্ফুটস্বরে বলল, “জি।”

“আমি আশফাক, সায়েমের বন্ধু। আমিই আপনাকে ফোন…”

আশফাককে থামিয়ে দিয়ে নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “উনি কোথায়?”

“ভেতরে। ভয়ের কিছু নেই, হাতটা ফ্র্যাকচার হয়েছে আর মাথায় কিছুটা চোট পেয়েছে। ডক্টর কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। এখন ঘুমাচ্ছে।”

“আমি কি একবার উনার আছে যেতে পারি? প্লিজ!”

এই অসময়ে ভিজিটরদের রোগীর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় না। আশফাক বহুকষ্টে ডিউটি ডক্টরকে রাজি করিয়ে পাঁচ মিনিটের জন্যে নাজের কেবিনে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিল।

ঘরটায় খুব একটা আলো নেই। একটা মাত্র জিরো পাওয়ারের বাল্ব। তাতে অবশ্য দেখতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। সায়েমকে একনজর দেখতেই কেঁপে উঠল নাজের সমস্ত অন্তরাত্মা। তাকে বেডে শুইয়ে রাখা হয়েছে। এক হাতে সেলাইন চলছে, অন্য হাতটা প্লাস্টার করা। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। কয়েক মুহূর্ত একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নাজ। এক বিন্দু নড়ার শক্তি যেন তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। মানুষটাকে যে এভাবেও দেখতে হবে, কোনোদিন ভাবতে পেরেছিল সে?

চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। নাজ বহুকষ্টে সাহসী মেয়ের মতো নিজেকে সামলে রেখেছে। কাঁদলে যদি তার ঘুম ভেঙে যায়? ছোট ছোট পা ফেলে বেডের পাশে থাকা চেয়ারটায় গিয়ে বসলো নাজ।

নাজ একবার বলতে ইচ্ছা হলো, “এই শুনুন! অনেক হয়েছে, এবার উঠে পড়ুন। আপনকে এভাবে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না।”

বললেই বা কী হবে? কথাগুলো তো আর পৌঁছাবে না তার কর্ণকুহরে। নিজের অজান্তেই নাজের হাতদুটো চলে গেছে সায়েমের ডান হাতের ওপরে। দুহাত দিয়ে তার হাতটাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো নাজ। যদি এখন মানুষটার ঘুম ভেঙে যায়, ঘুম ভেঙে দেখে নাজ এভাবে তার হাতটা ধরে আছে, তাহলে কী হবে? নির্ঘাত প্রচন্ড এক ধমক দেবে নাজকে। দিক গিয়ে! তবুও এই হাতটা আর ছাড়া যাবে না।

নিজের সমন্ধে এক ভয়ঙ্কর অনুধাবন করলো নাজ। সেটা হলো যাই হয়ে যাক না কেন, মন থেকে কোনোদিনই মানুষটার প্রতি ভালোবাসা দূর হবে না তার। সে যতটাই দূরে সরিয়ে রাখুক, যতটাই তাচ্ছিল্য করুক। সারাটাজীবন মনের মাঝে এই প্রগাঢ় ভালোবাসা নিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে না।

কয়েক মিনিট পর একজন নার্স এসে মিষ্টি গলায় বললেন, “ম্যাম এবার আপনাকে বাইরে যেতে হবে। পেশেন্টের অসুবিধা হচ্ছে।”

কোনো প্রতিবাদ না করেই বেরিয়ে এল নাজ। নিঃশব্দে এসে বসলো কেবিনের বাইরের ওয়েটিং সেকশনে। তার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বিচিত্র এক ঘোরের জগতে চলে গেছে মেয়েটা।

আশফাক হঠাৎ নিচু গলায় বলে উঠল, “আপনি ঠিক আছেন?”

“হুঁ।”

নাজের গলা পর্যন্ত কান্না এসে গেছে। বহুকষ্টে তা চেপে রাখছে। আশফাক তাকে সহজ করার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইছে তবে কথা খুঁজে পাচ্ছে না। তবে তাকে দীর্ঘক্ষণ ইতস্তত করতে হলো না। একটা সময় নিরবতা ভঙ্গ করল নাজ নিজেই।

“কী করে হলো এসব?”

আশফাক ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “সায়েমকে আমি কয়েকদিন যাবত গাড়ি চালানো শেখাচ্ছি। নিজের গাড়ি যখন কিনবে, তখন না-কি ড্রাইভার রাখবে না। নিজেই ড্রাইভ করবে। গাড়িটা আজ সায়েমই চালাচ্ছিল, হঠাৎ গাড়ির সামনে একটা পিকআপ এসে পড়ল। ব্যাটার মন কোথায় ছিল কে জানে, ব্রেক কষতে দেরি করে ফেলল আর…”

নাজ তাকে থামিয়ে দিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, “থাক, আর বলতে হবে না। আমি একটু আসছি হ্যাঁ?”

নাজ আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে উঠে এল। গন্তব্য তার জানা নেই। তবে নির্জন একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে প্রাণ খুলে কাঁদতে কোনো বাঁধা নেই।

হাঁটতে হাঁটতে জনমানবশূন্য একটা করিডোর।শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো নাজ। এগুলো কী ঘটে যাচ্ছে জীবনে? পরপর ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো কি কোনোদিন জানবে, কতটা ক্ষত-বিক্ষত তারা করেছে নাজের হৃদয়কে?

নিঃশব্দে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে নাজ। চোখদুটো দিয়ে বহমান এই স্রোতের ধারা যেন কোনোদিন শেষ হবার নয়। কীসের এত কান্না নাজ বুঝতে পারছে না। মানুষটার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বলে না-কি সে কোনোদিন তাকে ভালোবাসা বন্ধ করতে পারবে না এই যন্ত্রণায়? বড্ড অসহায় লাগছে আজ নিজেকে।

হঠাৎ কী যেন মনে করে হ্যান্ডব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে ফোন করলো শাশুড়িকে। এত রাতে নাজের ফোন দেখে অপরপ্রান্তে থাকা হাসনা বেগমও সম্ভবত আঁতকে উঠেছেন। তাই তো একটা রিং বাজতেই রিসিভ করলেন তিনি।

নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “মা?”

হাসনা বেগম উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “নাজ? কী হয়েছে মা, তুমি কাঁদছো কেন?”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “আপনার ছেলেটা এমন কেন মা?”

হাসনা বেগম চিন্তিত গলায় বললেন, “সায়েম? কী করেছে সায়েম? বৌমা তুমি শান্ত হও, এভাবে কাঁদছো কেন?”

“সব দোষ আপনার ছেলের। আমি আর সহ্য করতে পারছি না মা। আপনি অবশ্যই তাকে বলবেন যেন নিজের খেয়াল রাখে। আমার কথার কোনো মূল্য তো তার কাছে নেই, আপনার কথায় যদি কাজ হয়।”

“তুমি একটু খুলে বলবে বৌমা? কী হয়েছে?”

“উনি আজ অ্যাকসিডেন্ট করেছেন।”

হাসনা বেগম আঁতকে উঠে বললেন, “ওহ আল্লাহ! অ্যাকসিডেন্ট? এসব তুমি কী বলছো বৌমা? সায়েম অ্যাকসিডেন্ট করেছে? কীভাবে?”

“গাড়ি চালানো শিখতে গিয়ে। কে বলেছিল উনাকে গাড়ি চালানো শিখতে? সব কিছুর ওপরে তার রাগ দেখাতে হবে। হয়তো গাড়ির ওপরেও রাগ দেখাতে গিয়েছিল। গাড়ি তো আর মানুষ নয়, সে কেন শুধু শুধু তার রাগ সহ্য করবে।”

“ও এখন কোথায়?”

“হসপিটালে। ডক্টর ঘুমের ওষুধ দিয়েছে, ঘুমাচ্ছে।”

অপরপ্রান্ত থেকে অস্ফুটস্বরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। মায়েরা তো এমনই হয়। সন্তান যত দূরেই থাক না কেন, মায়ের মনটা সর্বক্ষণ তার জন্যে ব্যাকুল হয়ে থাকে।

নাজ চোখের জল মুছতে মুছতে যথাসম্ভব পরিষ্কার গলায় বলল, “আপনি কাঁদবেন না তো মা। উনি সুস্থ হয়ে উঠলে কড়া গলায় বকবেন। যেন জীবনে কোনোদিন গাড়ি চালাতে না যায়। পারবেন না?”

ফোনে কথা শেষ করে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলো নাজ। আজ ভারী শীত পড়েছে, কানদুটো কনকন করছে। গায়ে জড়ানো চাদরটা দিয়ে কানদুটো ঢেকে ফেলল। কী যেন মনে করে আজ সন্ধ্যায় চোখে কাজল পড়েছিল নাজ। কাঁদতে কাঁদতে সেই কাজল লেপ্টে একাকার অবস্থা।

নাজ আবার ফিরে এলো আগের জায়গায়। আশফাক লোকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে কেবিনের সামনে পায়চারি করছে।

নাজকে দেখতে পেয়ে তার কাছে এসে বলল,
“আমি তো আরেকটু হলে আপনাকে খুঁজতে যাচ্ছিলাম।”

নাজ স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি ঠিক আছি ভাইয়া। আপনি বাড়ি ফিরে যাবেন না?”

“কী যে বলেন? সায়েমের এই অবস্থা! তাছাড়া আপনাকে এভাবে একা রেখে আমি যেতে পারি?”

“আমার কোনো অসুবিধা হবে না।”

“আমারও কোনো অসুবিধা হবে না। বাসায় মা চিন্তা করত, একটু আগেই ফোন করে বলে দিয়েছি।”

নাজ চুপ করে রইল। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

আশফাক বলল, “আপনি বোধহয় সারারাত জেগেই কাটাবেন, চলুন ক্যান্টিন থেকে কফি খেয়ে আসি।”

“আমি কিছু খেতে পারবো না।”

“আমার কথা বিশ্বাস করুন, কফিটা খেলে ভালো লাগবে।”

আশফাকের কথা বিশ্বাস করে নাজ সত্যি সত্যিই ক্যান্টিনে চলে গেল। রাত প্রায় বারোটায় কাছাকাছি তবুও ক্যান্টিনে লোকজন গিজগিজ করছে। সকলের চোখেমুখেই বিষাদ আর প্রিয়জনের জন্যে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

শীতের মধ্যে কফিটা বেশ ভালোই লাগছে। নাজ কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে।

হঠাৎ করে সহজ গলায় বলে উঠল, “আপনারা অনেক দিনের বন্ধু, তাই না?”

আশফাক আগ্রহ নিয়ে বলল, “হুঁ। সেই ভার্সিটি থেকে। তারপর কাকতালীয়ভাবে একই অফিসে চাকরি।”

নাজ অন্যরকম গলায় বলল, “উনার যে কোনো বন্ধু থাকতে পারে তাই ছিল আমার ধারণার বাইরে।”

“আসলেই! আমার নিজের কাছেও মাঝে মাঝে বেশ অবাক লাগে। ভার্সিটিতে ওকে সারাক্ষণই দেখতাম চুপচাপ বইয়ে মুখ গুজে বসে আছ। যেখানে ওর বয়সী ছেলেমেয়েরা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত, সায়েম ব্যস্ততা ছিল পড়াশোনা নিয়েই।”

“তাহলে আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো কী করে?”

“সে এক মজার কাহিনী। ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত আমাদের সেভাবে কথা হয়নি। ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার দিন আমাদের দুজনেরই দেরি হয়ে যায়। এদিকে আবার ভার্সিটির সামনে রিকশাওয়ালার সঙ্গে আমার বাঁধে তুমুল ঝগড়া। আমার কাছ এক হাজার টাকার নোট আর রিকশাওয়ালার কাছে নেই ভাঙতি। শেষে সায়েম নিজেই এসে আমার রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিল। শুধু তাতেই ক্ষান্ত হয়নি। আমাকে প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, রিকশায় করে পরীক্ষা দিতে এসেছেন, সঙ্গে ভাঙতি রাখবেন না? সেই থেকে আজ পর্যন্ত ওর ধমক খেয়েই আসছি।”

“বাহ! ভার্সিটির বন্ধুর সঙ্গে এখন আবার একই অফিসে কাজ করছেন। এমন ভাগ্য কজনের থাকে?”

“ব্যাপারটা অবশ্য কাকতালীয় নয়। পাশ করার পর বহু খোঁজাখুঁজি করেও আমি চাকরি পাচ্ছিলাম না। সায়েমই ওর অফিসে চাকরিটা জোগাড় করে দেয়।”

নিজের ব্যর্থতার গল্প অনেকেই বলতেই চায় না। কিংবা বললেও চোখমুখে থাকে প্রবল সংকোচ। অথচ আশফাকের মধ্যে সেসব কিছুই দেখা গেল না। বেশ অকপটেই বলে ফেলল চাকরি না পাওয়ার ঘটনা।

“তাহলে তো নিশ্চয়ই আপনারা বেশ ভালো বন্ধু।”

“তা তো বটেই। আসলে সায়েমের সঙ্গে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা ধৈর্য্যের ব্যাপার। ছেলেটা বড্ড চাপা, নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখবে।”

“আপনার কাছেও আড়াল করে রাখে?”

“একমাত্র আমার কাছেই আড়াল করে না। পৃথিবীটা হাতেগোনা দুয়েকজনের সঙ্গে সায়েম নিঃসংকোচে কথা বলতে পারে। সৌভাগ্যবশত আমি তাদের একজন।”

নাজ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “আরেকজন কে?”

আশফাক বুঝতে না পেরে বলল, “সরি?”

“না মানে, বললেন না উনি হাতেগোনা দুয়েকজনের সঙ্গে নিঃসংকোচে কথা বলতে পারেন। একজন তো আপনি, তাহলে অন্যজন কে সেটাও নিশ্চয়ই জানবেন।”

আশফাক কিছুটা ধাঁধায় পড়ে গেল। যেন প্রশ্নটার উত্তর তার জানা আছে, তবে কীভাবে উত্তর দিতে হবে জানা নেই।

নাজ বলল, “উনি তো আপনার কাছে কিছুই আড়াল করে না। উনি আমাদের বিয়ের কথাটা আপনাকে বলছেন? কীভাবে পাকেচক্রে বিয়েটা হলো!”

“হ্যাঁ, বলেছে।”

“তাহলে তো উনার কিছুই আপনার কাছে অজানা নেই। আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো ভাইয়া? প্লিজ উনাকে কিছু বলবেন না!”

আশফাক অনিশ্চিত গলায় বলল, “কী প্রশ্ন?”

নাজ ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “উনি কি কাউকে ভালোবাসেন?”

ভয়াবহভাবে হকচকিয়ে গেল আশফাক। নাজ যে এমন একটা প্রশ্ন করে বসবে তা ছিল তার কল্পনারও বাইরে।

“উনি যে কাউকে ভালোবাসেন এ ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিশ্চিত। আপনাকে জিজ্ঞেস করছি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে জিজ্ঞেস করছি। আমি ভ্রমের মধ্যে বাঁচতে চাই না। প্লিজ বলুন না! আপনি তো সবটাই জানেন। উনি কি কাউকে ভালোবাসেন?”

নাজের জোরাজুরিতে আশফাক মুখ ফসকে বলেই ফেলল, “হ্যাঁ।”

কয়েক মুহূর্তের নিরবতা বয়ে গেল। নাজ যেন বুঝতে পারেনি কথাটার মানে, এখনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। অবশেষে বুঝতে যখন পারলো, চাপা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার মধ্যে থেকে।

নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “কবে থেকে?”

“আমার মনে হয় কী…”

“আপনি বলুন না কবে থেকে!”

“প্রায় চার বছর তো হলো।”

নাজ ভারী কণ্ঠে বলল, “কে সে? আপনি দেখেছেন তাকে?”

“হ্যাঁ দেখেছি কিন্তু …”

“চার বছর? মেয়েটা অনেক সুন্দরী তাই না? কী করে সে? আপনাদের অফিসেই চাকরি করে?”

“আপনি প্লিজ শান্ত হোন। আমার মনে হয় না সায়েমের পার্সোনাল বিষয়ে ওর পারমিশন ছাড়া কিছু বলা উচিত হবে। আই এম সরি।”

মুহূর্তেই নাজ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না আসলে আই এম সরি। আমার এভাবে জিজ্ঞেস করা উচিত হয়নি। কিছু মনে করবেন না।”

ভালোবাসার মানুষটার ভালোবাসা না পাওয়া কষ্টকর। তবে সেই মানুষটার ভালোবাসায় অন্য কারোর অধিকার এই তথ্য তার থেকে ঢের বেশি কষ্টকর। তবে অদ্ভুত ব্যাপার, নাজের কষ্ট হচ্ছে না। কষ্ট পেতে পেতে যে মানুষটা পাথর হয়ে যায়, সে আবার নতুন করে কষ্ট পাবে কী করে?

চার বছর ধরে যদি আরেকটা মানুষকে ভালোবেসেই থাকে, তবে এই বিয়ের কী মানে? হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। তবে কোনো প্রশ্নই আর সায়েমকে করবে না সে। সায়েম কেন, কাউকেই করবে না। যন্ত্র যেভাবে কমান্ড পেলে চলে, সেভাবেই চলবে সে। আর তো মোটে দেড় বছর, ডিভোর্সটা তো এরপর হয়েই যাবে। সায়েম কী যেন বলেছিল, “তুমি তোমার রাস্তায়, আমি আমার রাস্তায়।”

এখন থেকেই নিজের রাস্তায় চলতে শিখতে হবে। যে জিনিস কোনোদিন পাবার নয়, তাতে অভ্যস্ত হওয়ার মানে হয় না। তবুও বেহারা মনটা বারবার বলছে, “আমি আজও তাকে ভালোবাসি, এই মুহূর্তেও বাসি। চিরকাল এভাবেই বেসে যাবো।”

সায়েমের ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। ডাক্তার এসে চেকআপ করে গেছেন। আশফাক এতটা সময় ছিল। সায়েম তার চিরাচরিত ধমক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। কেবিনে এখন কেবল তারা দুটো প্রাণী। নিজেকে ব্যস্ত রাখার অজুহাতে নাজ গভীর মনোযোগ দিয়ে সায়েমের ওষুধের নামগুলো পড়ছে।

সায়েম অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, “কখন এসেছ তুমি?”

মানুষের কণ্ঠস্বর যেন হৃদয়ে তীক্ষ্ণ শূলের মতো বিঁধে গেছে। এই কণ্ঠস্বরের প্রতি সেই কবে থেকে আসক্ত নাজ। এই কণ্ঠস্বর যে কোনোদিন তার হবে না ভাবতেই শিউরে উঠলো নাজ।

তবুও নিজেকে প্রাণপণ সামলে নাজ শুকনো গলায় “রাতেই।”

“রাতে আবার একা একা আসতে গেলে কেন?”

“কারণ কাগজে কলমে একমাত্র আমারই আশার অধিকার আছে। পৃথিবীতে কাগজ-কলমের শক্তি অনেক বেশি। আপনি অবশ্য চাইলে অন্য কাউকে এখানে ডেকে আনতে পারেন। আপনার ফোনটা তো ভেঙে গেছে, আমারটা আছে? নম্বর ডায়াল করে দেব?”

বেশ অনেকটা সময় চুপ করে থেকে সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “ইউ হেট মি, ডোন্ট ইউ?”

নাজ উত্তর দিলো না, হাসল। তবে সেই হাসিটার মধ্যেই যে কত চাপা বিষন্নতা লুকিয়ে আছে, সায়েম কোনোদিন জানবে না।

“ওষুধটা খেয়েই মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন।”

“এখন ফোনে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।”

“ইচ্ছা না করলেও বলতে হবে। বেচারী কাল সারারাত জেগে আপনার জন্যে দোয়া করেছেন।”

কথাগুলো নাজ ঠিকই বলেছে তবে তার মধ্যে কোনো আবেগ নেই। যেন কেউ তাকে বোতাম চেপে কথাগুলো বলতে বলেছে, তাই সে বলছে। হাসিখুশি সেই মেয়েটা আজ সত্যিই আবেগশূন্য এক রোবোট পরিণত হয়ে গেল।

(চলবে)