#অপেক্ষারা
৩১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“বলিস কী? তার মানে তোর জামাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে?” হতবাক গলায় বলল তুষি।
লাইব্রেরির নির্জনতায় বসে নোটগুলো গোছাচ্ছিল নাজ। হুট করে তুষি কোত্থেকে যেন এসে একটার পর একটা প্রশ্ন করে জেনে নিল পুরো ঘটনা।
নাজ শুকনো গলায় বলল, “উনি একজনকে ভালোবাসেন।”
“আরে বাবা একই তো কথা! তুই শিউর?”
“হুঁ।”
“কবে থেকে?”
“চার বছর ধরে।”
“কী? চার বছর ধরে? এক মিনিট, এক মিনিট তার মানে তোদের বিয়ের আগ থেকেই এসব চলছে?”
নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “তাই তো মনে হয়।”
“আমার মাথায় না কিছুই খেলছে না। প্রেমিকাই যদি থাকে তাহলে তোকে বিয়ে করতে গেল কেন?”
“এটা তো সেই ভালো বলতে পারবে।”
তুষি হতবিহ্বল গলায় বলল, “তুই এতটা নির্বিকার কীভাবে থাকতে পারছিস? সে একসঙ্গে দুইটা মেয়েকে ঠকাচ্ছে। ব্যাপারটা যেমন তুই এতদিন জানতি না তেমনি ওই মেয়েটাও নিশ্চয়ই জানে না যে তার বিয়ে হয়ে গেছে।”
নাজ হাই তুলতে তুলতে বলল, “আমাকে আর ঠকাচ্ছে কোথায়? তার সঙ্গে তো আমার ডিভোর্সই হয়ে যাবে।”
“এই নাজ! মেয়েটা কে রে?”
“জানি না।”
“আরে গাধা এটাও জানিস না? চল এক কাজ করি। মেয়েটাকে খুঁজে বের করি।”
নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “কী দরকার তুষি?”
তুষি রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “তোর দরকার না থাকলেও আমার আছে। মেয়েটারও জানা দরকার যে সে প্রতারিত হচ্ছে। তোর জামাইয়ের সঙ্গে ফেসবুকে অ্যাড আছে?”
“এতদিন ছিল। বিয়ের পরপর আমিই রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। এখন আনফ্রেন্ড করে দিয়েছি।”
“খুব ভালো করেছিস! এমন একটা মানুষকে ফ্রেন্ড লিস্টে রাখার কোনো মানে হয় না। কিন্তু তার ফ্রেন্ড লিস্টটা কি পাবলিক?”
“জানি না।”
“তোর ফোনটা দে তো।”
“আবার ফোন দিয়ে কী করবি?”
“আহ্ দে তো!”
তুষি নাজের ফোন থেকে সায়েমের ফেসবুক আইডি বের করে একটা স্ক্রিনশট তুলে সেটা পাঠিয়ে দিল নিজের মোবাইলে।
নাজ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “ক্লাসে যাবি না?”
“এত গুরুত্বপূর্ণ একটা রিসার্চে বসতে হবে আর তুই আছিস তোর ক্লাস নিয়ে!”
“বেশিক্ষণ লাইব্রেরিতে থাকিস না, ম্যাম তোকে দেখলে রেগে যাবেন।”
নাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে এল ক্লাসে। ভাবনা-চিন্তা করার ক্ষমতা তার প্রায় হারিয়েই গেছে। কয়েকদিন আগে হলেও আগ্রহ নিয়ে তুষির সঙ্গে খুঁজতে বসে যেত সায়েমের ভালোবাসার মানুষটাকে। তবে এখনকার মানসিক পরিস্থিতি তাতে সায় দিচ্ছে না। কী দরকার অযথা ঝামেলায় জড়াবার।
আনোয়ারা ম্যাডামের ক্লাস। তিনি কোনো একটা জরুরি কাজে গেছেন, ক্লাসে আসতে পনের মিনিট দেরি হবে। ম্যাম অবশ্য বলে গেছেন এই পনের মিনিট সকলকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে। সেই নির্দেশ রীতিমত অমান্য করেই সকলে হইচই-চেঁচামেচিতে মগ্ন।
নাজ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোনো কাজ ছাড়া শুধু শুধু বসে থাকা কষ্টকর। হঠাৎ মনের অজান্তেই তার হাতটা চলে গেল খাতার শেষ পাতায়। একটা পেনসিল নিয়ে কী যেন আঁকছে মেয়েটা। একটা সময় নাজ প্রচুর ছবি আঁকতো। খাতার পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে যেত, অথচ তার ছবি আঁকা শেষ হতো না।
আমাদের সমাজটা এমন, সাধারণের থেকে কেউ ভিন্ন কিছু করলেই তাকে নিষ্কর্মার দলে ফেলে দেওয়া হয়। ছবি আঁকাটা নিছক সাধারণের থেকে ভিন্ন। তাই নাজকেও সমাজের সেই মানুষগুলোর কটূক্তির শিকার হতে হলো।
মামী-চাচী জাতীয় কেউ বাড়িতে বেড়াতে এলেই বাবা-মায়ের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলত, “মেয়েটার দিকে এবার একটু নজর দাও। সারাদিন আঁকিবুকি করলে চলবে? লেখাপড়ায়ও তো ভালো করতে হবে।”
মেয়েটা যে চমৎকার ছবি আঁকে, তা কারোর নজরে পড়ল না। গুণগুলো এড়িয়ে কেবল নাজের ত্রুটি আর ব্যর্থতা খুঁজতেই ব্যস্ত তারা। আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ প্রায় একই রকম, সমাজ বৈচিত্রতা সহ্য করতে পারে না। তাই ব্যতিক্রম কাউকে দেখলেই তাকে টানতে চায় নিজেদের দলে।
নাজের বয়স তখন এতটাই কম ছিল, যে বুঝতেই পারেনি ওই মানুষগুলো তার ভবিষ্যত নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নয়। নাজের লেখাপড়ায় ভালো করা বা না করাতে তাদের কিছুই আসে যায় না। কোনো একদিন লেখাপড়ায় ভালো করে ফেললেও ওই মানুষগুলো ব্যস্ত হয়ে যাবে নাজের অন্য ত্রুটি খুঁজতে।
তার চিত্রকর্ম সকলের অপছন্দের বলে আঁকাআঁকিটাই বন্ধ করে দেয় নাজ, বাবা অবশ্য বহুকার আঁকতে বলেছিলেন। নাজ শোনেনি। আজ বহু বছর পর আঁকতে বসলো, তবুও একটুকুও ভুল হলো না তার। কয়েক মিনিটের মাথায় একটি মেয়ের মুখশ্রী এঁকে ফেলল। যদিও পেনসিলে আঁকা সাদাকালো এক ছবি মাত্র, তবুও মনে হচ্ছে মেয়েটি যেন জীবন্ত। চোখেমুখে তার অদ্ভুত এক মায়া কাজ করছে।
নাজ খাতাটা বন্ধ করতে যাবে, তখনি তার পাশ থেকে বিস্মিত গলায় ক্লাসের একটা মেয়ে বলে উঠল, “ওয়াও নাজনীন! এটা তুমি এঁকেছ?”
নাজ মনে মনে খানিকটা চমকে গেল। বোধহয় আশা করছিল এই মেয়েটাও তার আত্মীয়-স্বজনদের মতো ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখমুখ বিকৃত করে বলে উঠবে, “এসব কী এঁকেছো? যাও পড়তে বসো।”
আকস্মিক এই প্রশংসা হজম করতে কিছুটা সময় লাগলো তার।
ফিকে হাসি হেসে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল।
মেয়েটা তার অপর বান্ধবীকে ছবিটা দেখিয়ে বলল, “দেখ দোস্ত! নাজনীন কী সুন্দর ছবি আঁকতে পারে।”
“তাই তো! নাজনীন তোমার তো উচিত প্রফেশনাল শিল্পীদের মতো ক্যানভাসে পেন্টিং করা।”
নাজদের কলেজটা বিখ্যাত হাবিজাবি পরীক্ষার জন্যে। সারাবছর একটার পর একটা হাবিজাবি পরীক্ষা চলতেই থাকে। এতে না-কি পড়াশোনার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় না, আবার পরীক্ষা দেওয়ার একটা অভ্যাসও গড়ে ওঠে।
তেমনই এক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে গত সপ্তাহে। বিশ মার্কের শর্ট টেস্ট। ম্যাডাম ক্লাসে এসেই সেই পরীক্ষার খাতাগুলো দিলেন। চিরকাল কোনো পরীক্ষার খাতা পেয়েই নাজ পাতা উল্টে-পাল্টে দেখেছে কত নম্বর কাটল, কোথায় কোথায় ভুল হলো।
তবে আজ একেবারেই ভিন্ন চিত্র। কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল খাতাটার দিকে। টিচার একটা নম্বরও কাটতে পারেনি? কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
ম্যাডাম নাজের কাছে এসে নিচু গলায় বললেন, “তোমার ইমপ্রুভমেন্ট দেখে আমরা খুবই খুশি নাজ।”
নাজ স্বভাবসুলভ হেসে বলল, “থ্যাংক ইউ ম্যাম।”
“এবছর কি নতুন করে কোনো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছো?”
“না ম্যাম, আমি নিজেই পড়ি।”
“পরীক্ষার খাতা পড়ে যা বুঝলাম, তুমি অনেক ক্রিয়েটিভ। মন দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাও, ইনশাল্লাহ এইচএসসিতে অনেক ভালো করবে।”
“দোয়া করবেন ম্যাম।”
আগে স্যার-ম্যাডামদের ক্ষুদ্রতম প্রশংসা নাজের জন্যে ছিল গর্বের বিষয়ে। কলেজসুদ্ধ সবাইকে গর্ব করে বলে বেড়াত। অথচ আনোয়ারা ম্যাডামের এত বড় একটা প্রশংসা আজ মোটেও বিগলিত করলো না তাকে।
ক্লাস শেষে সে এসে বসলো ক্যান্টিনে। পরের ক্লাসটা দশ মিনিট পর। এই সময়টুকু কোনোভাবে পার করে দিতে পারলে হয়। নাজের জীবনটাই আজকাল কাটছে সময় পার করতে করতে। সায়েমের কথা ভেবে মনটা যখন যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে, নাজ তখন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আর তো কেবল একটা বছর। এরপর মানুষটাকে রোজ রোজ চোখের সামনে দেখতেও হবে না, কষ্টও থাকবে না। একটা বছর কোনমতে কাটিয়ে দাও।”
তুষি হুট করে এসে ধড়মড় করে নাজের পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে বলল, “পেয়েছি!”
নাজ সরু গলায় বলল, “কী পেয়েছিস?”
“এই দেখ!”
তুষির তার মোবাইলটা নাজের হাতে ধরিয়ে দিল। মোবাইল স্ক্রিনে ভাসছে অসম্ভব রূপবতী এক মেয়ের ফেসবুক আইডি। নাজ নামটা পড়লো, হুমায়রা হাসান অদিতি।
নাজ জিজ্ঞাসু গলায় বলল, “কে এটা?”
“এখনো বুঝতে পারছিস না? এই ছবিটা দেখ!”
তুষি এবার অদিতি নামের ওই মেয়েটার আইডি থেকে আরেকটা ছবি বের করলো। ছবিটা একনজর দেখতেই রীতিমত চমকে গেল নাজ। কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো নিজেকে সামলাতে। ছবিটাতে অদিতি আর সায়েম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, তাদের দুজনের মুখই হাসসৌজ্জ্বল। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত, সায়মকে এতটা খুশি কোনদিনও দেখেছি নাজ। যতটা না দেখছে এই ছবিতে।
হঠাৎই নাজের মনে হলো, পাশাপশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেই পারে। ছবি তুললেই কি প্রেম হয়ে যায় না-কি?
নাজ ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “তুই এত শিওর হচ্ছিস কী করে?”
“শোন নাজ, আমি কখনো আন্দাজে কথা বলি না। প্রপার রিসার্চ করেই বলছি।”
“মানে?”
“ভালো করে রেখ, এই মেয়েটার রিসলেশনশিপ স্ট্যাটাস ইন অ্যা রিলেশনশিপ। তাও আবার ঠিক চার বছর আগে থেকে। আর তোর জামাই কবে থেকে প্রেম করছে?”
নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “চার বছর আগে থেকে…”
“শুধু এটাই নয়, তার লক্ষণ আছে। ভালো করে দেখ, তার প্রতিটা পোস্টে মেয়েটা কমেন্ট করে। আগে কখনো খেয়াল করিসনি।”
নাজ না-সূচক মাথা নাড়ল।
তুষি উৎফুল্ল গলায় বলল, “এতেও যদি তোর মন না ভরে তাহলে আরও একটা লক্ষণ আছে। এই মেয়েটা আর তোর জামাই একই কোম্পানিতে চাকরি করে। আগে এই মেয়েটা ঢাকাতেই ছিল এখন ট্রান্সফার হয়ে চিটাগংয়ে চলে গেছে। চিটাগংয়েও এই কোম্পানির ব্রাঞ্চ আছে। তুই-ই বল, এ যদি তোর জামাইয়ের প্রেমিকা না হয় তাহলে কে হবে?”
নাজ চুপ করে রইল।
“এখন তোর মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, চার বছর ধরে প্রেম করলে মাঝখানে তোকে আবার বিয়ে করতে গেল কেন। এ নিয়েও আমি একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছি।”
“কী দাঁড় করিয়েছিস?”
“হাইপোথিসিস! হাইপোথিসিস মানে হলো কোনো ঘটনার প্রস্তাবিত বিবরণ।”
“তা তোর হাইপোথিসিসটা কী?”
“মনে কর চার বছর ধরে দুজনে প্রেম করছে। হঠাৎ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দুজনের মনোমালিন্য হয়, মনোমালিন্যটা ব্রেকআপ পর্যন্ত গড়ায়। ব্রেকআপ হয়ে গেলে তোর স্বামী মহোদয় জেদের বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে রাজি হয়। এদিকে তাদের পছন্দ করা মেয়েটা আবার যায় পালিয়ে। সেকেন্ড অপশন হিসেবে তোকে তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। তোর জামাইয়ের ইগো হলো হার্ট। সে কি এতটাই ফেলনা নাকি? যাকে বাবা-মা এনে দেবে, তার সঙ্গেই সারাজীবন কাটিয়ে দেবে? তার পুরনো প্রেম আবার জেগে উঠলো। কেমন লাগলো আমার হাইপোথিসিস?”
নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “দারুণ! পড়াশোনায় এতটা মাথা খাটালে আজ তুই আমাদের ফার্স্ট গার্ল হতি তুষি।”
তুষি ভ্রু কুঁচকে বলল, “ঠাট্টা করবি না। এক্ষুনি এই অদিতি না ফদিতিকে ম্যাসেজ পাঠা। বল কীভাবে ওই বদ লোকটা তোদের দুজনকে একসঙ্গে ঠকাচ্ছে।”
“আমি সেসব কিছুই করছি না।”
তুষি চোখদুটো কপালে তুলে বলল, “মানে কী? তুই ম্যাসেজ পাঠাবি না?”
“উহুঁ।”
“কিন্তু কেন নাজ?”
“আমি ভীষণ ক্লান্ত। এসব আর ভালো লাগছে না। একই দুঃখে আর কতদিন দুঃখী থাকবো। আমার নিজেরও তো একটা জীবন আছে না-কি?”
“তাই বলে লোকটাকে তুই শাস্তি দিবি না?”
নাজ মলিন কণ্ঠে বলল, “কাউকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই নাজ। ওপরে বসে একজন সবকিছু দেখছেন, শাস্তি দেওয়ার হলে তিনিই দেবেন।”
আজ আর সায়েম নাজকে কলেজ থেকে নিতে আসেনি। নাজই বারণ করে দিয়েছে। অ্যাকসিডেন্টের পর সেরে উঠে আজই প্রথম অফিসে ফিরেছে মানুষটা। তার ওপরে আবার নাজকে নিতে আসলে শরীরের ওপর বাড়তি ধকল যাবে।
মানুষের মন কতোটা বেহায়া তাই না? এত কিছুর পরেও মনের এক সূক্ষ্ম কোণে পরম মমতায় মানুষটার প্রতি ভালোবাসা লালন করছে নাজ। মানুষটার যাতে কোনো কষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখছে। তবে সবটাই মনে মনে। বাস্তবে সে এক যন্ত্রমানবী। এমন ভাব করে যেন পৃথিবীর কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারে না তার হৃদয়কে।
কলেজ থেকে ফেরার পথে স্টেশনারির দোকানে ঢু মারল নাজ। আজকাল কেন জানি ভীষণ ছবি আঁকতে ইচ্ছে হচ্ছে। চোখের সামনে একটা পর একটা দৃশ্য ভেসে উঠছে। দৃশ্যগুলো যেন পেনসিলে বন্দী করে রাখতে না পারলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।
ক্লাসের ওই মেয়েটার কথামত কতগুলো ক্যানভাস কিনলো নাজ। ক্যানভাসের সঙ্গে তার স্ট্যান্ড। নতুনদের জন্যে সবথেকে ভালো রং না-কি অ্যাক্রিলিক। আবার ছবি আঁকার জন্যে আলাদা এক ধরনের পেনসিলও ব্যবহার করা হয। দোকানদারের কাছ থেকে জেনেশুনে প্রয়োজনীয় সকল খুঁটিনাটি জিনিসই কিনে ফেলল নাজ। কিছুটা বাড়তি খরচ হয়ে গেল, হোক!
বাড়িতে ফিরে যত দ্রুত সম্ভব রান্নাবান্না সেরে ক্যানভাসের সামনে বসলো নাজ। ভালোই হলো! মনটাকে ব্যস্ত রাখার নতুন এক উপায় পাওয়া গেছে।
ছয় ঘণ্টা লাগিয়ে অতি উচ্চমার্গীয় একটা ছবি এঁকে ফেলল নাজ। ছবিটা প্রথমবার দেখে কিছুই বোঝা যাবে না, দ্বিতীয়বারে কিছুটা বোঝা গেলেও পুরোপুরি যাবে না। সম্পূর্ণটা বোঝা যাবে তৃতীয়বারে। নিজের সৃষ্টির দিকে নিজেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাজ।
ছবিতে একটা মেয়ে বসে আছে তার বিছানার ওপরে। তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে পিঠ। মেয়েটার ঘর আর পাঁচটা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মতোই। মাথার ওপরে সিলিং ফ্যান, দেওয়ালে ঝুলছে ক্যালেন্ডারের পাতা। বিছানার পাশের সাইড টেবিলে পানির জগ, গ্লাস। সবই ঠিক আছে তবে মেয়েটা তার বিছানায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রথমবার এই ছবি যে দেখবে সে মনে মনে ভাববে, আঁকিয়ে নির্ঘাত পাগল। ঘরের মধ্যে নদী এলো কোত্থেকে? পরে অবশ্য কয়েকবার চোখ বোলালে ঠিকই বুঝতে পারবে, ওটা নদী নয়। মেয়েটার অশ্রুগুলো গিয়ে জমা হয়েছে কাল্পনিক সেই নদীতে।
ক্যানভাসটা ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখলো নাজ। ঠিক করলো, এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে ছবিটা নিয়ে যাবে না। ইচ্ছাকৃতভাবেই ফেলে রেখে যাবে। একদিন এই সংসারে আসবে সায়েমের ভালোবাসার মানুষটা।
প্রথমদিন বাড়িটা ঘুরে দেখতে দেখতে অবাক গলায় বলবে, “ওমা! এই অদ্ভুত ছবিটা কে এঁকেছে?”
সায়েম অবাক গলায় বলবে, “তাই তো? এটা কোত্থেকে এলো? দাঁড়াও, এক্ষনি সরিয়ে ফেলছি।”
“থাক, সরিও না। দেখতে ভালোই লাগছে।”
তাদের সুখের সংসারের এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকবে নাজের জমে থাকা অশ্রুগুলো।
(চলবে)
#অপেক্ষারা
৩২ (বোনাস পর্ব)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
দেখতে দেখতে এ বছরটাও কেটে গেল। সতেরো বছর এগারো মাস বয়সী যে বালিকাকে সায়েম বিয়ে করে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল তার বয়স এখন কুড়ি। বিয়ের দুটো বছর কেটে গেছে। প্রথম বছরটা যেন জাদুকরী ছিল, দ্বিতীয়টা তেমনই ভয়ঙ্কর। তবুও বছরটা যে পার করে আসতে পেরেছে, এতেই নাজ খুশি।
আজ নতুন বছরের প্রথমদিন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আতশবাজি দেখছে নাজ। প্রবল এই শীতেও তার গায়ে কোনো সোয়েটার নেই। চাইলেই ছুটে গিয়ে ঘর থেকে সোয়েটারটা আনা যায়, তবে আলসেমি লাগছে তার। কাঁপতে কাঁপতেই তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। শহরটা আজ উৎসবে সেজে উঠেছে।
তাদের পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে দুই বোন ফানুস ওড়াচ্ছে। একটু পর পর বিচিত্র কারণে ঝগড়া বাঁধছে তাদের মধ্যে। ওদের কর্মকান্ড দেখতে ভালোই লাগছে।
হঠাৎই কেমন যেন ভয় হতে লাগলো তার। নতুন বছরটা চলে এসেছে। কয়েক মাস বাদেই তার এইচএসসি পরীক্ষা। ভয়টা অবশ্য পরীক্ষার নিয়ে নয়। সায়েম বলেছিল, তার পরীক্ষার পরপরই ডিভোর্স হয়ে যাবে দুজনের। এই হিসাবে আর মাত্র কয়েকটা মাস।
আজকাল কেমন যেন হয়ে গেছে নাজ। অতীতের সেই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হাসিখুশি মেয়েটার চোখেমুখে আজ কেবলই মলিনতার রেখা। কোনো কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করতে পারে না। সুখের সংবাদে হাসে না, দুঃখে কেঁদেকেটে অস্থিরও নয়। সবকিছুতেই মেয়েটা থাকে নির্বিকার।
একই ছাদের নিচে থেকে পরস্পরের সঙ্গে দীর্ঘদিন কথা না বলে থাকা যায় না। নাজ আর সায়েম প্রয়োজনে একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা ঠিকই বলে। নাজ যখন কথা বলে, তখন তার গলার স্বরে থাকে না কোনো রাগ, থাকে না না পাওয়ার আক্ষেপ।
এই তো সেদিন, নাজ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি না ইদানিং সবকিছু ঝাপসা দেখছি, লেখা পড়তে পারছি না। কী হতে পারে বলুন তো!”
“সে কী? আমার দিকে তাকাও! আমাকেও দেখতে পাচ্ছ না?”
নাজ তার দিকে তাকিয়ে বিরস গলায় বলল, “আপনাকে দেখতে পাচ্ছি, তবে লেখা পড়তে পারছি না।”
সায়েম উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কাল বিকেলে রেডি হয়ে থাকবে। অফিস থেকেই ফিরেই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।”
পরদিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানা গেল চোখদুটো আসলেই গেছে। উত্তল লেন্সের চশমা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। দোকান থেকে নাজ নিজেই চমৎকার একটা চিকন ফ্রেমের চশমা পছন্দ করলো। সেদিন ওই চশমার দোকানেই অনেকদিন পর প্রথমবার নাজের সঙ্গে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলল সায়েম।
“চোখদুটোর এ অবস্থা করলে কী করে?”
নাজ থমথমে গলায় বলল, “জানি না। বই পড়তে পড়তে সম্ভবত।”
“একটা বছর যেভাবে পরিশ্রম করলে, বইগুলো তো সব তোমার মুখস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। এত পড়ার কী আছে?”
“আপনি তো এটাই চেয়েছিলেন।”
নাজের এই কথাটার জবাব দিতে পারলো না সায়েম। আসলেই তো! যে মেয়েটাকে সে “পড়তে বসো, পড়তে বসো!” বলে ক্লান্ত হয়ে যেত, সেই মেয়েটাই আজ সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে বসে থাকে।
ঘরের ভেতর থেকে সায়েমের গলার স্বর ভেসে এলো, “নাজ এসো!”
টেবিলের ওপর ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানির প্লেট। মাঝেমধ্যে শখের বশে এটাসেটা রান্না করার অভ্যাস আছে সায়েমের। আজ অফিস থেকে ফিরে অনেকক্ষণ যাবত ইউটিউব থেকে রেসিপিটা শিখেছে।
নাজ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলেন। দুপুরের রান্না তো ছিলোই।”
“রেসিপিটা নতুন শিখেছি। খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে!”
নাজ চামচে তুলে বিরিয়ানি খেয়ে ফিকে হাসি হেসে বলল, “অনেক ভালো হয়েছে।”
মনে মনে ভাবলো, মানুষটার সংসারে যে আসবে সে নির্ঘাত অনেক ভাগ্যবতী। চিরকাল এমন চমৎকার একটা মানুষের আশেপাশে বসবাস করার সৌভাগ্য সকলের হয় না। তার যেমন হয়নি।
নাজ বহুকষ্টে নিজের মনকে বুঝ দিয়েছে, সায়েম অন্য কাউকে ভালোবাসে তাতে কী আসে যায়? সে সায়েমকে ভালোবাসে এটাই বড় কথা। ভালোবাসা ভাগাভাগি করে নিলেই তার প্রকৃত আনন্দ পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ যদি সেই ভালোবাসার ভাগ না চায়, তবে কী আর করা? কেবল ভাগাভাগিতেই নয়, মাঝে মাঝে দূর থেকে ভালোবেসেও এর আনন্দ উপভোগ করা যায়।
মানুষ মরে গেলেও ভালোবাসাটা নিয়ে মরে না। ভালোবাসা বেঁচে থাকে অনন্তকাল, অদৃশ্য হয়ে ভাসতে থাকে পৃথিবীর বাতাসে। নাজের ভালোবাসাটাও না হয় সেভাবেই বেঁচে থাক। ক্ষতি কী?
পরের তিনটি মাস পরীক্ষার জন্যে অমানবিক পরিশ্রম করলো নাজ। ঘুমের কয়েক ঘন্টা বাদে দিনে পুরোটা সময়েই তাকে দেখা গেল পড়ার টেবিলে। কখনো নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বইয়ের দিকে, কখনো আবার গোটা গোটা অক্ষরে কিছু একটা লিখছে খাতায়। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে, অনেক বড় একটা মানুষ হতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ তাকে তাচ্ছিল্য করার সাহস না পায়।
নাজ ঠিক করেছে, এইচএসসি পাশ করে সে ময়মনসিংহে ফিরে যাবে না। ঢাকাতেই কোনো একটা মেয়েদের মেসে থাকবে। হলে সুযোগ পেলে তো কথাই নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেলে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছা আছে তার। ভবিষ্যতে নিজেকে বড় একজন উদ্যোক্তা হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখে নাজ।
ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত একটা। রাতটা পোহালেই সেই কাঙ্ক্ষিত এইচএসসি পরীক্ষা। প্রথম পরীক্ষাটা বাংলা প্রথম পত্র। পড়ার টেবিলে বসে ক্রমাগত বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছে মেয়েটা। শেষ মুহূর্তের রিভিশন আর কী।
হঠাৎ সায়েম তার ঘরে এসে ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “নাজ? এখনো জেগে আছ?”
নাজ ইতস্তত করে বলল, “ওই, রিভিশন দিচ্ছি।”
“আর পড়তে হবে না, ঘুমিয়ে পড়ো।”
“কী বলছেন! সকালে পরীক্ষা, না পড়লে কী করে হবে?”
“সারাবছর অনেক পড়েছ। রাতে ঘুম না হলে পরীক্ষার হলে মাথা ঠান্ডা থাকবে না।”
“কিন্তু…”
সায়েম মিনতির স্বরে বলল, “তুমি তো আমার কোনো কথাই শোনো না নাজ। অন্তত এ কথাটা শোনো।”
মানুষটার এই সরল আবেদনকে না করতে পারলো না নাজ। সঙ্গে সঙ্গে উঠে এল চেয়ার ছেড়ে।
নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “আমি ফোনে অ্যালার্ম দিয়েছি, তবুও আপনি সকালে আমাকে ডেকে দেবেন?”
“হুঁ দেবো, তুমি নিশ্চিতে ঘুম দাও তো।”
ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েও শান্তি মেলেনি সায়েমের। তাই সুস্থ হয়ে আবারও নতুন করে শেখা শুরু করে দেয়। প্রতিটা ছেলেই বোধ হয় ছোট বেলায় খেলনা গাড়ি দিয়ে খেলতে খেলতে স্বপ্ন দেখে একদিন তার নিজের গাড়ি হবে। সায়েমও তার ব্যতিক্রম নয়।
গত মাসেই নিজের দীর্ঘদিনের সেই স্বপ্নটাকে অবশেষে সত্যি করে ফেলল নাজ। তার গাঢ় নীল রঙের জাগুয়ার এক্সজেএল পোর্টফোলিও যখন রাস্তায় নামে, তখন মনে হয় সেই যেন এই সড়কের রাজা। এই গাড়ি উঠতে অবশ্য বেশ ভয়েই লাগে নাজের। এই মানুষটার ড্রাইভিংয়ের ওপর ভরসা করা যায় না। কখন অন্য আরেকটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে হাত-পা ভেঙে ফেলবে তার ঠিক আছে?
তবুও আজ বেশ নির্ভয়েই গাড়িতে উঠে বসলো নাজ। মানুষটা গত দেড় বছরে নিজেকে ভালোই গুছিয়ে নিয়েছে। গাড়ি কিনেছে, ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছে। ব্যাংক ব্যালেন্সও নিশ্চয়ই ভালো পর্যায়ে। এই সাজানো গোছানো জীবনে তার ভালোবাসার মানুষটা না জানি কত সুখে থাকবে। সায়েম নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিলেও নাজকে করে তুলেছে এলোমেলো। কোনো মানে হয়?
নাজ একদৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
সায়েম গাড়ি চালাতে চালাতে সহজ গলায় বলল, “ভয় করছে নাজ?”
“উহুঁ।”
“কেন?”
নাজ দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে বলল, “কারণ আমি জানি পরীক্ষাটা খুবই বাজে হবে। আমি হারতে অভ্যস্ত। বোধ হওয়ার পর থেকে কেবল হেরেই এসেছি। এই পরীক্ষা নতুন করে আর কী-ই বা হারতে শেখাবে।”
“সারাবছর পড়াশোনা করে কেউ হারার কথা বলে?”
নাজ চুপ করে রইল।
সায়েম আবারও বলল, “শোনো নাজ, এইচএসসিকে এইচএসসি ভাববে না। জীবনে তো কত পরীক্ষা দিয়েছ, ভাববে এটা তেমনই একটা পরীক্ষা। তোমাকে যে গোল্ডেন এ প্লাস পেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। শুধু চেষ্টা করবে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করতে।”
সায়েমের এই কথাগুলোর মাঝেই বিচিত্র এক ঘোরের মধ্যে চলে গেল নাজ। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল গাড়ির লুকিং গ্লাসে পড়া মানুষটার প্রতিচ্ছবির দিকে। একবার ইচ্ছা হলো বলতে, “আরেকটু কথা বলুন না। আপনি বলবেন আর আমি শুনবো। প্লিজ!”
(চলবে)