অপেক্ষারা পর্ব-৩৯+৪০

0
578

#অপেক্ষারা
৩৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আজ সাতদিনের ছুটি শেষ নাজকে নিয়ে ঢাকায় ফিরলো সায়েম। এই কটা দিনে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেমে আসেনি দুজনের চোখে। পার্টিতে আসা আত্মীয়-স্বজনদের বড় একটা অংশ তাদের বাড়িতেই থেকে গেছে। কেউ দুদিন, কেউ চারদিন আবার কেউ কেউ তো এখনো রয়ে গেছে।

বাড়িতে অফুরন্ত ঘর নেই যে সকলের জন্যে আলাদা আলাদা বিছানার ব্যবস্থা করা হবে। তাই বাধ্য হয়েই দশ-বারোজনকে থাকতে হয়েছে একটা ঘরেই। তাতে অবশ্য আত্মীয়-স্বজনদের আনন্দে কোনপ্রকার ব্যাঘাত ঘটেনি। ব্যাঘাত ঘটেছে সায়েমের ঘুমের। নাজের কিছুটা অভ্যাস থাকলেও এতগুলো মানুষের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না সায়েমের। রাতগুলো কেটেছে উঠানে পায়চারি করেই।

নাজ আশা করেছিল কতগুলো নির্ঘুম রাত্রির পর ঢাকায় ফিরেই নিস্তেজ হয়ে পড়বে সায়েম। ঘরে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দেবে। তবে সেসব কিছুই হলো না। ক্লান্তির কোনো লক্ষণই দেখা মিলল না ছেলেটার মধ্যে।

বরং উৎফুল্ল গলায় বলল, “নাজ! দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমরা বাইরে যাবো।”

“বাইরে থেকেই তো এলাম। আবার কোথায় যাবো?”

“বিয়ের পর তো একসাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়াই হয়নি। আজ যাবো।”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “তাই বলে এখনই? একটু রেস্ট তো নিতে দেবেন!”

“এত রেস্ট নিয়ে কী হবে? আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি, আই ওয়ানা সি ইউ ইন টেন মিনিটস।”

অগত্যা একপ্রকার বাধ্য হয়েই কোনমতে ফ্রেশ হয়ে গাড়িতে এসে বসলো নাজ। বাধ্য হয়ে বললে অবশ্য সামান্য ভুল হবে। ঘুরতে যাবার কথা শুনতেই মনটা লাফিয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিনের সাধ তার, প্রিয় মানুষটার হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াবে শহরের আনতে কানাচে।

ড্রাইভিং সিটের পাশে বসতে বসতে নাজ আগ্রহী গলায় বলল, “কোথায় যাবো আমরা?”

জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করলো না সায়েম। তার মুগ্ধ চোখদুটো স্থির হয়ে আছে নাজের মুখশ্রীর দিকে।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নাজ নিচু স্বরে বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

এই প্রশ্নটারও জবাব এলো না। সায়েম এক নিমিষেই হাত বাড়িয়ে খুলে ফেলল নাজের চুলের কাটা। ঘন কালো চুলগুলো বাঁধন থেকে ছাড়া পেয়ে যেন নিজের সবটুকু গর্ব তুলে ধরলো সায়েমের কাছে।

সায়েম নাজের খুব কাছে এসে তার কানের সঙ্গে ঠোঁটদুটো মিশিয়ে বলল, “খোলা চুলেই তোমাকে দারুণ লাগে। আরেকবার যদি চুল কেটেছ, সোজা চিড়িয়াখানার রেখে দিয়ে আসবো!”

মানুষটার দিন দিন কী যে হচ্ছে! নাজকে লজ্জার সাগরে ডুবিয়ে না মারা পর্যন্ত বোধহয় শান্তি মিলবে না তার।

ব্যস্ত এই নগরীতে মানুষ ক্রমশ ছুটে চলে প্রয়োজনের তাড়নায়। নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবনের ছোট ছোট আনন্দকে তাচ্ছিল্য করতে দ্বিধা বোধ করে না কেউই। বই পড়া মানুষকে দিতে পারে জীবনে শ্রেষ্ঠতম আনন্দের স্বাদ। কিন্তু এখনকার যান্ত্রিক জীবনে মানুষের বই পড়ার সময় কোথায়? তবুও এই ব্যস্ত নগরীর বুকে হাতেগোনা যে কজন বইপ্রেমী বেঁচে আছে, তাদের একমাত্র ঠিকানা বাতিঘর।

বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাত তলায় অবস্থিত বিশাল এক বইয়ের দোকান। দোকান বললে ভুল হবে, বলা উচিত বইয়ের রাজ্য। হাজার হাজার বই সুসজ্জিত করে রাখা আছে তাকে তাকে। প্রতিটা লেখকের বই আবার আলাদা আলাদা তাকে। সাহিত্যের বইগুলো একদিকে, বিজ্ঞানের বইগুলো একদিকে আবার ইংরেজি বইগুলো আরেকদিকে। হালকা সোনালী আলোর আভায় চারিদিক ছেয়ে আছে। বইগুলো এমনভাবে সাজানো যেন দেখলেই ডজন খানেক কিনে ফেলতে ইচ্ছে হবে।

শুধু বই কেনাই নয়, আছে পড়ার ব্যবস্থাও। বাতিঘরের একদিকে চেয়ার-টেবিল পাতা। কয়েকজন অতি মনোযোগী পাঠককে সেখানে দেখা গেল বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকতে। সায়েম ঠিক করছে এই শহরে তার যতগুলো প্রিয় জায়গা আছে, সবগুলোতে আজ নিয়ে যাবে নাজকে। প্রিয় জায়গার তালিকায় বাতিঘরের স্থান সবার ওপরে বলেই সর্বপ্রথম এখানে এসেছে তারা।

নাজ চোখেমুখে প্রবল বিস্ময় নিয়ে বলল, “এটা কি লাইব্রেরি?”

সায়েম বাঁকা হাসি হেসে বলল, “কেন? তেলাপোকা ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা আছে?”

নাজ ফিক করে হেসে বলল, “কী যে বলেন? এখানে তেলাপোকা পাবো কোথায়?”

“এটা বুকস্টোর। এখন পছন্দ করে কয়েকটা বই চয়েজ করে ফেলো তো! শুধু পাঠ্যবই মুখস্ত করলেই ভালো ছাত্রী হওয়া যায় না।”

নাজ বেছে বেছে হুমায়ূন আহমেদ এবং আনিসুল হকের লেখা কতগুলো উপন্যাস নিলো। সায়েম নিলো হাবিজাবি কীসব ইংরেজি উপন্যাস। বিয়ের পর থেকে যতবারই তার হাতে বই দেখছে, সবগুলোই ছিল ইংরেজিতে লেখা। ছেলেটা ঘন্টার পর ঘন্টা ইংরেজি বই পড়ে কী করে যে জানে? নাজের তো এক নাগাড়ে বিশ মিনিট পড়লেই মাথা ধরে যায়। বাংলার মতো প্রশান্তি পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় আছে না-কি?

কেনাকাটার পর্ব শেষে দুজনে এসে বসলো বারান্দায়। বারান্দাটা বাতিঘরের পেছনে। এখানেও রয়েছে নির্জনে নিচু কতগুলো সোফায় বসে বই পড়ার সুযোগ। ভেতরের মতো বারান্দাটাও ছোট ছোট পাথরের মূর্তি আর টবভর্তি ফুলগাছে সুসজ্জিত।

সায়েম তার কেনা ইংরেজি বইগুলোর মধ্যে থেকে একটা বের করে কয়েক পাতা বের শোনালো নাজকে। বইটির নাম ‘The Fault In Our Stars’। পুরোটা সময় তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল নাজ। সায়েমের কণ্ঠস্বরে প্রখর একটা নেশালো ভাব লুকিয়ে আছে। একবার শুনলে শত জনম কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে কেবল এই ধ্বনি শুনেই।

“I don’t believe that everybody gets to keep their eyes or get sick or whatever. But everybody should have true love, and it should last at least as long as your life does.”

নাজ চোখ পিটপিট করে বলল, “এর অর্থ কী?”

“একটা গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাওয়া মেয়ে এই সামান্য অর্থটুকু বুঝতে পারবে না?”

“বুঝতে ঠিকই পারবো। কিন্তু আপনি যেভাবে দ্রুতগতিতে ব্রিটিশদের মতো উচ্চারণ করেন, বোঝার উপায় থাকে?”

অনিন্দ্য সুন্দর কতগুলো মুহূর্ত সেখানে কাটিয়ে তারা গেল সিনেপ্লেক্সে। সায়েমের আরেক পছন্দের জায়গা। একটি ভালো সিনেমা কয়েক ঘন্টার জন্যে মানুষকে নিয়ে যায় সম্পূর্ন ভিন্ন এক জগতে। দীর্ঘদিন নিজের ছাপ ফেলে রাখে তার মনে। হলের বাইরে এলইডি স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে সিনেমার নাম আর শো টাইম।

সায়েম আগ্রহ নিয়ে বলল, “ব্ল্যাক অ্যাডামস এসে গেছে? নাজ, চলো এটাই দেখি।”

নাজ থমথমে গলায় বলল, “মোটেও না! আমি ইংলিশ সিনেমার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝি না।”

“আমি বুঝিয়ে দিবো, সমস্যা কোথায়?”

“শুনুন, আপনার ব্রিটিশগিরি আমার সঙ্গে চলবে না। এর থেকে বরং চলুন এই সিনেমাটা দেখি।”

নাজ আঙুল তাক করে দেখালো একটা বাংলা সিনেমার পোস্টার। সায়েম সরু চোখে দেখল, সিনেমাটার নাম ‘লুকোচুরি’। পোস্টারে দুই যুবক-যুবতী দুই দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

সায়েম অসহায় গলায় বলল, “কেমন হবে কে জানে!”

“অনেক ভালো হবে। আমি ট্রেইলার দেখেছি, পুরো বলিউড লেভেলের সিনেমা। আমার কথা মিলিয়ে নেবেন!”

সিনেমা শুরু হয়েছে, নাজ হ্যান্ডব্যাগ থেকে চশমাটা বের করে নাকের ডগায় লাগিয়ে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে রূপালী পর্দার দিকে। এদিকে সায়েম একরাশ বিরক্তি নিয়ে পপকর্ন চিবোতে চিবোতে কাহিনীটা বোঝার চেষ্টা করছে। কাহিনী যদিও যথেষ্ট সাদামাটা তবুও যেন মাথার তিন ফুট ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

সিনেমায় নায়ক নায়িকা একে অপরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। একদিন নায়ক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ তাকে অজ্ঞান করে গাড়িতে উঠিয়ে নেয় এক শিল্পপতি কন্যার ভাড়া করা গুন্ডা। অজ্ঞান অবস্থাতেই নায়কের হাতে নিজেকে আংটি পরিয়ে এনগেজমেন্ট সারে সেই শিল্পপতির কন্যা। এনগেজমেন্টের পর নায়িকাকে নানাভাবে হুমকি-ধামকি দেয় নায়ককে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে। শেষমেষ নায়ককে কে পাবে এটাই কাহিনী। কাহিনী যেন এগোচ্ছে কচ্ছপের গতিতে। মিনিট দশেক পর পরই নায়ক নায়িকা পার্কে, স্পিডবোটে, রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গান গাইছে।

কেমন গা ছমছমে পরিবেশ চারিদিকে। হলে তারা বাদে হাতেগোনা কয়েকটা মানুষ। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। বিশ্বমানের এই সিনেমা তো আর সকলের জন্যে নয়। সিনেমা হলগুলো চিরকালই সর্বোচ্চ পাওয়ারে এসি ছেড়ে রাখে। শীতে নাজের হাড় হিম হয়ে আসবার উপক্রম।

সায়েম ভ্রুযুগল সামান্য কুঞ্চিত করে বলল, “এই তোমার বলিউড লেভেলের সিনেমা?”

নাজ তৎক্ষণাৎ অপরাধীর ন্যায় বলে উঠল, “আরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম না-কি সিনেমাটা এত বাজে হবে?”

নাজের কথার মাঝেই পর্দায় করুণসুরে আরেকদফা গান গেয়ে উঠলো নায়ক।

“ডিসগাস্টিং! চলো বেরিয়ে যাই, এই জিনিস আর সহ্য হচ্ছে না।”

“আহা, দেখি না শেষমেশ কী হয়!”

কোনো সিনেমা যত বাজেই হোক না কেন, তা একবার শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারে না নাজ। তাই সায়েমকেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই সহ্য করতে হবে আড়াই ঘন্টার এ অত্যাচার।

প্রগাঢ় ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত শরীর জুড়ে। একে তো সারারাত বাস জার্নি করে বাড়ি ফিরেই ছেলেটার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে যাওয়া, তার ওপরে আবার এই অখাদ্য সিনেমা – সবমিলিয়ে অতিষ্ট উঠেছে নাজ। মনে তীব্র ইচ্ছা জেগেছে নিজেকে প্রশান্তির সাগরে ডুবিয়ে দিতে।

প্রশান্তির ওই সাগরটার খোঁজেই হয়তো মনের অজান্তে নিঃশব্দে মাথা রাখলো সায়েমের কাঁধে। বিরক্তি কেটে নিমিষেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেল ছেলেটার মনে। এই বাচ্চা মেয়েটার মধ্যে কী আছে কে জানে? কেবলমাত্র নিজের উপস্থিতিতেই এলোমেলো করে তোলে তাকে।
হঠাৎই এক দুষ্টু বুদ্ধি এসে ভর করলো সায়েমের মস্তিকে।

ঘাড়ে এক হিমশীতল হাতের স্পর্শ পেল নাজ। মনে মনে চমকে উঠলেই মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। মানুষটা তার ঘাড়ে হাত রেখেছে, রাখতেই পারে। নাজকে স্পর্শ করার অধিকার তো একমাত্র তারই।

তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই নাজ বুঝতে পারলো ব্যাপারটা কেবল হাত রাখা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নেই। আলতো স্পর্শে তার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে সায়েম। তবে তার নির্বিকার দৃষ্টি ঠিকই সিনেমার পর্দায়। ভাবটা এমন যেন কিছুই হয়নি।

ক্রমেই নাজের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। ভয়ঙ্কর এক শিহরণ খেলে বেড়াচ্ছে তার শরীরে। বারবার চেষ্টা করছে মানুষটার অবাধ্য আঙ্গুলগুলো উপেক্ষা করে সিনেমায় মনোযোগ দিতে। তবে নাজ ভালো করেই জানে সেই চেষ্টায় সফল হওয়া দুর্সাধ্য।

নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে সায়েমের কাঁধ থেকে মাথা তুলে বসলো নাজ। সায়েমও যেন তড়িৎ গতিতে সরিয়ে ফেলল হাতটা।

তার দিকে তাকিয়ে চোখ নাজ বলল, “এসব কী হচ্ছে?”

সায়েম নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বলল, “কোন সব?”

“আপনি জানেন না কোন সব?”

“না তো! ঠিক মনে পড়ছে না। মনে করিয়ে দাও তো।”

আর কিছুই বলতে পারলো না নাজ। লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠা মুখটা লুকিয়ে তাকালো অন্যদিকে। মানুষটা ইচ্ছা করেই অনবরত লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে তাকে।

সিনেমা শেষ হওয়ার পর রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করে সায়েম তাকে নিয়ে এল সবুজঘেরা নির্জন এক জায়গায়। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। নাম না জানা কতশত গাছের আনাগোনা এখানে! পায়ের নিচে ঘন সবুজ ঘাসের ছড়াছড়ি। গাড়ি থেকে নামতেই প্রশান্তিতে চোখ দুটো জড়িয়ে গেল নাজের।

স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে ঘাসের ওপরে বেড়াচ্ছে ছুটে সে। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রেয়সীর এই উচ্ছ্বাসের দৃশ্য দেখছে সায়েম। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে বিচিত্র এক হাসির আভা। গম্ভীর ছেলেটাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে ঘোরে ডুবিয়ে রাখছে মেয়েটা।

ছোটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে নাজ ফিরে এলো সায়েমের কাছে।

উৎফুল্ল গলায় বলল, “সকাল থেকে এত ঘোরাঘুরি না করে এখানেই এলেই ভালো হতো!”

সায়েম শান্ত গলায় বলল, “তোমার পছন্দ হয়েছে?”

“অনেক পছন্দ হয়েছে! জায়গাটা এত সুন্দর!”

সায়েম গর্বিত গলায় বলল, “আমার পছন্দের সব জায়গাগুলোই সুন্দর। বাংলাদেশের সবথেকে সুন্দর দৃশ্য হলো শ্রীমঙ্গলের চা বাগান থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য। একবার তোমাকে সেখানেও নিয়ে যেতে হবে।”

নাজ হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল, “আমাকে নিয়ে এতকিছু ভেবে রেখেছেন?”

“ভাবতে হবে না?”

নাজ তার কণ্ঠস্বরে অদৃশ্য এক রহস্য জড়িয়ে বলল, “কিন্তু আমাকে কি একটা বারও জিজ্ঞেস করেছেন, আমার ভবিষ্যতে আমি আপনাকে দেখি কি-না?”

নাজের আকস্মিক একথায় কিছুটা ধাঁধায় পড়ে গেল সায়েম। বুঝতে পারছে মেয়েটা নির্ঘাত কোনো দুষ্টুমির ছলে মেতেছে, তবে দুষ্টুমিটা ঠিক ধরতে পারছে না।

“মানে?”

“মানে ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে আপনাকে দেখে অন্য কাউকেও তো দেখতে পারি।”

কথাটা শেষ করার আগেই খিলখিল করে হেসে উঠলো নাজ। মানুষটার ধাঁধায় পড়ে যাওয়া মুখটা ছিল দেখার মতো। এবার বোঝো! নিজের কথা নিজের কাছেই ফিরে এলে কেমন লাগে!

সায়েম বাঁকা হাসি হেসে বলল, “তাই না? এদিকে এসো, আমিও দেখি সেই অন্য কেউটাকে!”

সঙ্গে সঙ্গে সায়েম নাজের হাতটা ধরে এক হ্যাঁচকা টানে নিজের খুব কাছাকাছি নিয়ে এল তাকে। আলতো স্পর্শে জড়িয়ে ধরলো তার কোমর। মানুষটা এমন আকস্মিক কান্ডে দারুণভাবে হকচকিয়ে গেল নাজ।

ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন হাসিটা রেখেই নাজ ভয়ার্ত গলায় বলল, “এই না! সরি, সরি সরি! এবারের মতো ছেড়ে দিন, আর কখনো আপনার সঙ্গে ফাজলামি করবো না।”

সায়েম ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “আপনি যে খুব সহজে ছাড়া পাচ্ছেন না!”

নেশাক্ত দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে সায়েম। নাজ নামের এই নেশায় যে সে বহু বছর ধরে আসক্ত। ওই চাহনীর দিকে চোখ পড়তেই পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা যেন একসঙ্গে এসে ঘিরে ধরলো নাজকে। চোখমুখ খিঁচে সায়েম নামের স্রোতটা সেদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকেই বয়ে চলছে সে।

আরও একটু শক্ত করে নাজের কোমর আঁকড়ে ধরে নিজেকে খুব কাছাকছি নিয়ে এলো। তিলপরিমাণ ফাঁকা জায়গা অবশিষ্ট নেই এই নর-নারীর মাঝে। মুখের ওপর আছড়ে পড়া সায়েমের অস্বাভাবিক গতিশীল একেকটা নিঃশ্বাস একটু একটু করে বাড়িয়ে তুলছে নাজের হৃদস্পন্দন। মনে হচ্ছে মানুষটা আজ তাকে লজ্জায় মেরেই ফেলবে।

আচমকাই সায়েমের মুখ ডুবে গেল নাজের গলায়। মেয়েটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। এ রূপে সায়েম কোনোদিন তার কল্পনাতেও আসেনি। প্রবল শিহরণের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে জমে দাঁড়িয়ে আছে নাজ। এক ফোঁটা নড়বার শক্তিও যেন হারিয়ে গেছে।

সায়েমের ঠোঁটের সম্মোহনী স্পর্শগুলো ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে তার সমস্ত গলায়। সায়েম মুখ তুলে আবারও তাকালো নাজের দিকে। নাজের দিকে বললে ভুল হবে, তার দৃষ্টি আটকে আছে মেয়েটার ঠোঁটের দিকে। চুম্বকের ন্যায় ওই ঠোঁটদুটো সায়েমকে টানছে নিজের দিকে। একটা মুহুর্তও অপচয় না করে সায়েম অগ্রসর হলো সেই চুম্বকের ডাকে সাড়া দিতে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নাজ সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো বুজে ফেলল।

ঘোরে সংবিৎ হারিয়ে সায়েম একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে নাজের ঠোঁটের দিকে। আচমকাই বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো নাজের চশমা। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসে চশমাটা আর খুলে রাখা হয়নি।

ঘোর কেটে এক রাশ অসহায়ত্ব এসে বিরাজ করলো সায়েমের চোখেমুখে। ছেলেটার সেই চেহারা দেখে হেসে কুটি কুটি হলো নাজ। সায়েম এবার বিরক্ত হয়ে তড়িৎ গতিতে সেই চশমা খুলে রেখে দিল গাড়ির ছাদের ওপরে।

সায়েম দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “এবার তোমাকে কে বাঁচাবে?”

নাজ হাসির রেশটা ঠোঁটে রেখেই বলল, “এত অসভ্য কেন আপনি?”

“আমি অসভ্য? আমার অসভ্যতা তো আপনি কিছুই দেখেননি ম্যাডাম!”

আবারও সেই নেশালো ভঙ্গি ফিরে এলো সায়েমের মাঝে, একটু একটু আবারও করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। নাহ্! এবার মানুষটাকে আটকাতেই হবে!

নাজ বিস্মিত গলায় আকাশ পানে তাকিয়ে বলল, “ওমা! দেখুন একটা গোলাপী কাক!”

আবারও ঘোর কেটে যাওয়ায় সায়েম বিরক্ত গলায় বলল, “ওয়াট?”

এই সুযোগে ছেলেটার আড়ষ্ট হাতের বাঁধন থেকে কোনমতে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে পালালো নাজ। সায়েমও সময় অপচয় না করে তার পিছু নিলো।

ছুটতে ছুটতেই গাড়ি থেকে বেশ দূরে চলে এসেছে তারা। হঠাৎই অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে নাজ ধুম করে বসে পড়লো মাটিতে। শক্ত করে ডান পায়ের গোড়ালি চেপে ধরলো।

সায়েমও তার মুখোমুখি বসতে বসতে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কী হলো নাজ?”

নাজ গলার স্বর প্রাণপণ স্বাভাবিক রেখে বলল, “কিছু হয়নি!”

“কই দেখি!”

“আহা! কিছু হয়নি তো!”

নাজের হাজারটা বারণ অমান্য করে একপ্রকার জোরপূর্বকই গোড়ালি থেকে তার হাতটা সরিয়ে ফেলল সায়েম। কাঁটা জাতীয় কিছু একটা বিঁধে রয়েছে সেখানে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল সায়েমের চোখের সামনেইউ। দৃশ্যটি যেন প্রখরভাবে আন্দোলিত করে তুলল তার হৃদয়কে।

সেই কাঁটা বের করার জন্যে সাবধানে হাত বাড়ালো সায়েম। এক টানে সেটা বের করতেই গলগল করে রক্তের আরেক স্রোত বেয়ে পড়লো। অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে নাজ খামচে ধরলো সায়েমের শার্ট। মেয়েটার এই ব্যথার্ত মুখটা যেন নিমিষেই চুরমার করে ফেলল তার অন্তরাত্মাকে।

হেঁটে হেঁটে নাজকে আর গাড়ির কাছে যেতে হলো না। সায়েম নিজেই গাড়িটা চালিয়ে তার কাছে নিয়ে এলো, অতিরিক্ত যত্নে গাড়িতে বসালো। ছেলেটার চোখেমুখে স্পষ্ট, দুশ্চিন্তা আর অপরাধবোধ। মেয়েটাকে আজ এখানে না নিয়ে এলেই হতো! শুধু শুধু ব্যথা পেল বেচারি।

রক্তক্ষরণ ইতোমধ্যেই কিছুটা বন্ধ হয়েছে। গাড়িতে সবসময় একটা টাওয়েল থাকে। সেটাই দিয়েই ক্ষতস্থান শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে সায়েম। ব্যথাটাও একেবারে নেই।

নাজ স্বাভাবিক গলায় বলল, “এখনই চলে যাচ্ছি? আরেকটু থাকি না!”

সায়েম ধমকের সুরে বলল, “জাস্ট শাট আপ! এত বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট বাঁধিয়েছে, আবার বলে আরও থাকবে!”

“আমি ব্যাথা পেয়েছি আর আমাকেই ধমকাচ্ছেন?”

“তো কাকে ধমকাবো? এতটা ইরেসপন্সিল কী করে হতে পার তুমি নাজ? এভাবে খালি পায়ে কেউ ছোটাছুটি করে? কে বলেছিল স্যান্ডেল খুলে রাখতে?”

মনে মনে ভালোই বিস্মিত হচ্ছে নাজ। কিছুক্ষণ আগের সায়েম আর এই সায়েম কী একই মানুষ? অমন রোমান্টিক মুড থেকে কেউ এত সহজে কী করে রাগী রূপ ধারণ করতে পারে?

চিরকাল সায়েমের রাগটাকে ভীষণ ভয় করে এসেছে নাজ। ছেলেটা রাগ করলেই ভয়ে তটস্থ হয়ে বুকটা ধক করে উঠত। তবে আজ সেসব কিছুই হচ্ছে না। বরং ভেতরে ভেতরে হাসিই পাচ্ছে। এই রাগটা তো তার ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। তবে এই ক্রুব্ধমূর্তিতে তাকে বেশিক্ষণ থাকতে দেওয়া যাবে না। নাজও দেখতে চায়, সে কতটা সময় আর রাগ ধরে রাখতে পারে!

নাজ আহ্লাদী কণ্ঠে বলল, “শুনুন!”

নাজের এই আহ্লাদভরা কণ্ঠ একেবারেই বিগলিত করতে পারলো না সায়েমের ক্রোধকে। ভ্রু কুঁচকে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেটা।

নাজ আবারও বলল, “শুনুন না!”

সায়েম গম্ভীর গলায় বলল, “শুনতে পারবো না নাজ। ড্রাইভ করছি।”

“রাগ করেছেন?”

এমন মায়াভরা কণ্ঠে কেউ “রাগ করেছেন?” বললে রাগটা ধরে রাখার উপায় আর অবশিষ্ট থাকে না। সায়েমের সকল রাগও যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। তবে বাইরে থেকে সেটা বুঝতে দিলো না তাকে। রাজি ভাবটা ধরেই রাখলো।

নাজ মিষ্টি গলায় বলল, “আপনার রাগ কমিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি?”

“কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না। চুপ করে বসে থাকো।”

“উহু! আমি আর আপনার কোনো কথা শুনবো না। আপনার রাগ কমিয়েই ছাড়বো।”

মনে মনে লম্বা এক শ্বাস নিলো নাজ। ভয়ঙ্কর এক কাজ করতে যাচ্ছে সে। কাজটা করার পর যদি লজ্জার সাগরে ডুবে মরেও যায়, তবুও কোনো আক্ষেপ থাকবে না। ধীরে ধীরে নিজের সিট থেকে অগ্রসর হলো সায়েমের দিকে।

আলতো করে ছোট্ট এক চুমু এক দিলো তার গালে। মেয়েটার এমন আকস্মিক কান্ডে হকচকিয়ে গেল সায়েম। আবারও তার আশেপাশের সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে নাজ। নিজেকে সামলে রাখতে না ব্রেক কষলো। হৃদস্পন্দন এতটাই বেড়ে গেছে যে চোখদুটো বুজে কয়েকবার দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে হলো।

অবশেষে নাজের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হেসে বলল, “এই বাচ্চা মেয়েটার এত সাহস আসে কোথা থেকে? এর একটা শাস্তি তোমাকে পেতে হবে নাজ।”

মুহূর্তেই লজ্জার মেঘগুলো কেটে গিয়ে একরাশ ভয়ে ঢোক গিললো নাজ। না জানি মানুষটা আবার কী শাস্তি দেয়!

হসপিটালের ইমারজেন্সি বিভাগ নিয়ে নাজের পায়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনলো সায়েম। এতটুকু একটা ক্ষতর জন্যে আবার হসপিটালে এসে ব্যান্ডেজ করাতে হয়? গ্রামের বনে-বাঁদাড়ে দাপিয়ে বেড়ানো মেয়ে নাজ। এমন ব্যথা জীবনে যে কত পেয়েছে তার হিসাব নেই। ব্যথা পেয়েছে, আবারও সেরেও গেছে। তবে সায়েমের এই ব্যস্ততা আর উদ্বিগ্নতা দেখে মনে হচ্ছে যেন নাজ কোমল এক ফুল, সেই ফুলের একটি পাপড়িও যদি ছিঁড়ে যায় তবে মহাসংকটে পড়ে যাবে পৃথিবী।

হসপিটাল থেকে সায়েম তাকে নিয়ে গেল এক জাপানিজ রেস্টুরেন্টে। নাজ ভেবে পায় না বাঙালি সংস্কৃতিতে চমৎকার সব খাবার থাকা সত্ত্বেও মানুষকে কেন জাপানিজ খাবার খেতে হবে? এত আধুনিক হয়ে লাভটাই বা কী? বাঙালি মাছ-ভাতের সঙ্গে কিছুর তুলনা হয় না-কি?

খাবার তেমন সুবিধার না হলেও জায়গাটা চমৎকার। শান্ত এক পরিবেশ ছেয়ে আছে পুরো জায়গাটায়। পিয়ানোর মৃদু সুর কানে ভেসে আসছে। অসম্ভব সুন্দর একটা দিন পাড় করলো দুজনে। এতটা সময় একসঙ্গে, একে অপরের আশেপাশে কখনো কাটানো হয়নি। বিয়ের পর থেকেই হয় সায়েম সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই চলে গেছে অফিসে, কিংবা বাড়িতেই থাকলেও সেই অদৃশ্য দেওয়ালের কাছে পরাজিত হয়ে এই মানব-মানবী থেকেছে আলাদা আলাদা ঘরে।

বাড়ি ফিরেই নাজ ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে। হঠাৎ অনুভূত হলো কেউ একজন শক্ত করে চেপে ধরেছে তার ডান হাতটা। সেই ‘কেউ একজন’টা হওয়ার সাধ্য পৃথিবীতে সায়েম ছাড়া আর কারও নেই।

সায়েম নিচু কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, “কোথায় যাচ্ছ?”

নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “আমার ঘরে।”

“আমার ঘর মানে? আজ থেকে আমিই তোমার ঘর।”

নাজকে আর কোনো কিছু ভাবার বা বলার সুযোগ না দিয়ে সায়েম নিমিষেই তাকে কোলে তুলে নিলো। নাজের সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো। এই মানুষটা আবার তাকে কোলেও তুলতে পারে? লজ্জায় রক্তিম মুখটা কোনমতে লুকিয়ে রাখলো সায়েমের বুকে।

সায়েম তাকে নিয়ে এল নিজের ঘরটায়। কোলে রেখেই কনুইয়ের স্পর্শে সুইচ টিপে লাইট নিভিয়ে দিলো।

নাজ হঠাৎ আঁতকে উঠে বলল, “লাইট নেভালেন কেন? মনে নেই, আমি অন্ধকারে ভয় পাই?”

সায়েম তার কানে ঠোঁট লাগিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল, “কোনো ভয় নেই, আমি আছি না!”

আজকের এই রাতটা দুজনের জন্যেই তীব্র রহস্যময়তার চাদরে ঘেরা। সারাটাদিন যেন সায়েম নাজকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে, সারা রাত ঘুরে বেড়ালো নতুন এক জগতে। যে জগত কেবলই ভালোবাসাময়। নিজেকে বাঁচাবার কোনোই ইচ্ছে নেই নাজের। সায়েমের সঙ্গে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে নতুন এই জগতে। এই রাতের পর সত্যি সত্যিই তার অন্ধকারের ভয় কেটে গেল।

(চলবে)

#অপেক্ষারা
৪০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

কাকডাকা ভোরে ঘুম ভেঙে গেল নাজের। ঘুমজড়ানো চোখে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, কাঁটায় কাঁটায় ছয়টা বাজছে। এত সকালে তো কোনোদিন তার ঘুম ভাঙে না, তবে আজ ভাঙলো কেন? সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝেই নাজ নিজেকে আবিষ্কার করলো সায়েমের বুকে। ছেলেটা তার আড়ষ্ট হাতের বাঁধনে আগলে রেখেছে তাকে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার!

মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল গত রাতের ঘটনা। লজ্জায় নাজের চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। এতটা লজ্জা বেচারি এ জীবনে পায়নি। আজ এই মানুষটার সামনে দাঁড়াবে কী করে ভাবতেই আরেকদফা লজ্জার স্রোত বয়ে গেল তাকে প্রকম্পিত করে।

নাজ সাবধানে সায়েমের হাতটা সরিয়ে ফেলল। উঠতে যাবে, ঠিক তখনি টের পেল পরিচিত ওই হাতের স্পর্শ। চোখের পলকে সায়েম তাকে টেনে এনে আবারও ফেলল নিজ বুকে।

ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “কোথায় পালাচ্ছো?”

নাজ লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে কম্পিত স্বরে বলল, “পালাচ্ছি না তো!”

সায়েম তাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল, “এখন উঠতে হবে না, শুয়ে থাকো।”

এক ফোঁটাও নড়ার শক্তি পেল না নাজ। নিঃশব্দে গুটিশুটি মেরে পড়ে রইল তার প্রিয় মানুষটার বুকে। সায়েমের প্রশান্ত হৃদয়ের ধ্বনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে নাজ। এই হৃদস্পন্দনে জাদুকরী একটা ব্যাপার একটা। যতবারই কানে বেজে ওঠে, ভিন্ন এক জগতে হারিয়ে যায় নাজ।

আবার যে কখন একরাশ ঘুম এসে আঁকড়ে ধরলো, নাজ নিজেই টের পেল না। ঘুম ভাঙলো ঘণ্টা দুয়েক পর, সায়েমের ডাকে।

সায়েম নাজকে আলতো ধাক্কা দিয়ে কোমল স্বরে বলল, “এই যে ম্যাডাম! উঠে পড়ুন, আর কত ঘুমাবেন?”

সঙ্গে সঙ্গে নাজ ধড়মড় করে উঠে বসলো। যেন পৃথিবীতে মহাপ্রলয় এসে গেছে, এক্ষনি না উঠলে বড় কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। আচমকা ঘুম ভাঙায় কিছু বুঝতে না পেরে নাজ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। মেয়েটার সেই চাহনী দেখে সায়েম মনে মনে হেসে উঠলেও তা প্রকাশ করলো না।

ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই নাজ চমকে উঠে বলল, “এত দেরি করে ফেললাম! আমাকে ডাকবেন না?”

সায়েম দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “এখন থেকে ডাকছি? প্রায় ঘন্টা খানেক তো হলোই। যেভাবে নাক ডেকে ঘুমাও তুমি!”

নাজ আহত গলায় বলল, “কী যা তা বলছেন? আমি মোটেও নাক ডাকি না।”

“নাক যে ডাকো না, তুমি জানলে কি করে? মানুষ তো আর নিজের নাক ডাকা শুনতে পায় না।”

“বুঝতে তো পারে। তাছাড়া নাক ডাকা ব্যাপারটা আমার পার্সোনালিটির সাথে যায় না।”

“দাঁড়াও! একদিন কায়দা করে তোমার নাক ডাকা রেকর্ড করে রাখবো। তাহলেই টের পাবে নিজের পার্সোনালিটি কেমন।”

নাজ সরু চোখে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। ছেলেটা বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে। এই দৃশ্য দেখে তার রাগ যেন আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ভেবেছিল ঘুম থেকে উঠে লজ্জায় সায়েমের সামনেই দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু হলো তার ঠিক উল্টো! কী প্রয়োজন ছিল সকাল সকাল তাকে এভাবে রাগিয়ে দেওয়ার?

নাজ রাগে গজগজ করতে করতে পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে। সে চলে যেতেই হাসিটা আর চেপে রাখতে পারলো না সায়েম। মেয়েটার রাগে ফুলে থাকা মুখটা দেখার জন্যে হলেও প্রতিদিন একবার করে তাকে রাগিয়ে দিতে হবে।

গোসল সেরে ফিরে এসেই নাজ দেখতে পায় টেবিলে নাস্তা সাজানো। কী সর্বনাশ! সায়েম এতসব করলো কখন? রান্নাঘর থেকে খুন্তি নাড়ানাড়ির আওয়াজ আসছে। এতকিছুর পরেও আবার কী রাঁধছে ছেলেটা?

ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে যেতেই নাজ দেখলো সায়েম অতি যত্ন নিয়ে সাবধানে ওমলেট বানাচ্ছে। তার এই ওমলেট সত্যিই দারুণ হয়। ডিমের মধ্যে মিহি করে কাটা পেঁয়াজ কুচি, টমেটো, লবণ আর গোলমরিচ। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে ধনিয়া পাতাও দেওয়া যায়। তবে সেটা নির্ভর করে ইচ্ছের ওপরেই।

নাজ ব্যস্ত গলায় বলল, “আপনি শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলেন কেন?”

সায়েম কোমল স্বরে বলল, “ভাবলাম, সকাল সকাল আমার বউটার একটু যত্ন নিই।”

নাজের লজ্জারাঙা মুখটা মনের অজান্তেই হেসে উঠল। জীবনে কত সকালই তো এসেছে, তবে আজকের মত সুন্দর সকাল আর আসেনি।

দীর্ঘ ছুটি শেষে আজ অফিসে ফিরেছে সায়েম। তার মতো কাজপাগল মানুষ টানা আটদিন অফিসে যায়নি, ব্যাপারটা যেন অষ্টম আশ্চর্য! নিজের কর্মকান্ডে ক্রমশ নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে সায়েম। এই কোম্পানি থেকে তার কাছে চাকরির অফার এসেছিল এমবিএ পাশ করার আগেই। সেই থেকে আজ অবধি কতগুলো বছর পাড় হয়েছে। সাধারণ এমপ্লয়ি থেকে সে আজ হয়েছে কোম্পানির সিইও। আগে ওপরমহলের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতো, আজ নিজেই ওপরমহলে বসে সকলকে নির্দেশ দিচ্ছে। এতগুলো বছরে কোম্পানির নির্ধারিত ছুটি ছাড়া একটি দিনও নিজ থেকে ছুটি নেয়নি সায়েম। এবারই প্রথম।

অফিসে যাওয়ার আগে বাড়ির মূল দরজার সামনে নাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সায়েম। নিমিষেই এক অদৃশ্য হাহাকার নিজের উপস্থিতির জানান দিলো নাজের হৃদয়জুড়ে। মানুষটা আগেও তো বহুবার তাকে একা রেখে অফিসে গেছে। কই? তখন তো এমনটা অনুভূত হয়নি।

নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “সাবধানে যাবেন, আর পৌঁছেই আমাকে ফোন করে জানাবেন।”

সায়েম তার দিকে তাকিয়ে অন্যরকম গলায় বলল, “আর কিছু?”

“হুঁ।”

“কী?”

“আমাকে বেশি বেশি মনে করবেন।”

মৃদু হাসি ফুটে উঠলো সায়েমের ঠোঁটে। পরমুহূর্তেই সেই ঠোঁটের সম্মোহনী স্পর্শ গিয়ে পড়লো নাজের কপালে।

সায়েম বেরিয়ে যেতেই ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নাজ। এতদিন সকালটা কাটতো পড়াশোনার মাঝেই। তবে আজ কী করবে বেচারি? কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই তার চোখদুটো পড়লো গতকাল কেনা বইগুলোর ওপর। প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটজুড়ে। বই পড়তে পড়তে এমন বাজে অভ্যাস হয়ে গেছে, যে পড়া ছাড়া অন্যভাবে সময়টা পাড় করার কথা কল্পনাও করা যায় না।

নাজ বারান্দায় গিয়ে বসলো হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার আছে জল’ বইটি নিয়ে। এই বইয়ের ওপর নির্মিত সিনেমা সে আগেই দেখেছে। বেশ অনেক জায়গাতেই সিনেমার সঙ্গে বইয়ের মিল নেই। তবুও পড়তে গিয়ে বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে এই সিনেমায় অভিনয় করা অভিনেতাদের মুখ। নাজ চিরকালই উপন্যাস পড়তে গিয়ে নায়িকার চরিত্রে নিজেকে কল্পনা করে। আজও দিলু হিসেবে নিজেকেই কল্পনা করতে চাইছে, কিন্তু বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওই অভিনেত্রীর মুখটাই। কোনো মানে হয়?

বেলা এগারোটা বাজার একটু আগেই জরিনা চলে এল। নাজকেও বই ছেড়ে উঠতে হলো। নাজ এফএম রেডিও হলে এই মেয়েটা একটা আস্ত রেডিও স্টেশন। কথা বলে মাথা ধরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। তার কথার ভীড়ে বই পড়া তো দূরের কথা, পড়ার কথা চিন্তাও করা যায় না।

ঝাল ঝাল গরুর মাংস আর পোলাও না-কি সায়েমের ভীষণ পছন্দের। নাজ ঠিক করেছে তার প্রিয় মানুষটার প্রিয় খাবারগুলো আজ নিজ হাতে রাঁধবে। ভাবনা অনুযায়ী রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ছে আর ফোনের লাইনে থেকে অপরপ্রান্ত থেকে সকল নির্দেশনা দিচ্ছে তার শাশুড়ি মা।

হাসনা বেগম বিজ্ঞ গলায় বলল, “পেঁয়াজ ভাজা হয়েছে বৌমা?”

“হচ্ছে মা।”

“পেঁয়াজের রং লালচে বাদামি হয়ে এসেছে?”

নাজ চোখদুটো ছোট ছোট করে বলল, “লালচে বাদামি আবার কী?”

“কিছুটা লালচে আবার কিছুটা বাদামি। ভালো করে খেয়াল করলেই বুঝতে পারবে।”

নাজ ভালো করে খেয়াল করে দেখেও কিছুই বুঝতে পারলো না।

তাই জরিনাকে ডেকে বলল, “জরিনা দেখ তো, হয়েছে কিনা?”

জরিনা কিছুটা সময় হাড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “না আফা, আরেট্টু ভাজন লাগবো।”

“মা জরিনা বলছে এখনো হয়নি।”

হাসনা বেগম চিন্তিত গলায় বললেন, “কিছুই তো বুঝতে পারছি না বৌমা। এতক্ষণ সময় লাগার তো কথা না।”

“দাঁড়ান মা! আমি কনার মোবাইলে ভিডিও কল দিচ্ছি। নিজেই দেখুন কী অবস্থা।”

ভিডিও কল দিতেই সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে গেল হাসনা বেগমের কাছে। এতটা সময় নাজের চুলার আঁচ কমানো ছিল বলেই রান্না হতে এতটা সময় লাগছিল। দেখে দেখে বাকিটা নির্দেশনা খুব সহজেই দিতে পারলেন তিনি।

“এবার দুই চামচ টক দই দাও বৌমা।”

“দুই চামচ? কিন্তু মা ইউটিউবে তো এক চামচই দিয়েছে।”

হাসনা বেগম কঠিন গলায় বললেন, “এটা তোমার ইউটিউবের রেসিপি নয় বৌমা, আমার রেসিপি। যা বলছি তাই করো তো।”

ভাগ্যিস ইন্টারনেট জিনিসটা ছিল। না হলে মাইলের পর মাইল দূরত্বে থাকা একজন কাউকে এত সহজে রান্না শেখাতে পারতো?

মশলা কষিয়ে মাংস সিদ্ধ হওয়ার অপেক্ষা করছে নাজ। এখন আর অপরপ্রান্তে হাসনা বেগমের বসে থাকার প্রয়োজন নেই। শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নাজ এসে বসলো টিভির সামনে। রান্না হতে হতে আরও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। সময়টুকু না হয় টিভি দেখেই কাটানো যাক!

হঠাৎই নাজের ফোনটা বেজে উঠলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে তুষির নাম। একটা সময় ছিল, প্রতিদিন মেয়েটার সঙ্গে দেখা হতো। আহারে! আজ কতদিন হয়ে গেল দুজনের দেখা নেই। প্রিয় বন্ধুগুলো হয়তো চোখের সামনে দিয়ে এভাবেই একটু একটু করে হারিয়ে যায়।

ফোন রিসিভ কানে এল তুষির ব্যস্ত গলা, “নাজ? তুই কই?”

“বাসায়। আর কোথায় থাকবো?”

“বাসায় মানে ঢাকার বাসায়?”

“হুঁ!”

“আমি তো ভেবেছিলাম ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি চলে গেছিস। তুই-ই তো বলেছিলে রেজাল্ট বের হবার পরপর বাড়ি ফিরে যাবি।”

আমমনেই হেসে উঠলো নাজ। প্রকৃত ঘটনা তুষি জানতে পারলে তাকে পচানোর কোনো সুযোগই হাতছাড়া করবে না।

তুষি বিরক্ত গলায় বলল, “আবার হাসছিস কেন?”

“কিছু না, এমনি। তুই কিছু বলবি?”

“বলবোই তো! শোন আমি একটা কোচিং সেন্টারে নাম লেখাতে এসেছি। কোচিং সেন্টারটা আমাদের কলেজের কাছেই। তুই কি ভর্তি পরীক্ষার জন্যে কোচিং করবি?”

“হ্যাঁ, ভালো জায়গায় চান্স পেতে হলে করতে তো হবেই।”

“তুই অবশ্য কোচিং-টোচিং না করলেও ভালো জায়গাতেই চান্স পাবি।”

“কী যে বলিস! আমি জীবনে অনেক স্টুডেন্টকে দেখেছি যারা সারাজীবন লেখাপড়ায় ভালো হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা ইউনভার্সিটিতে চান্স পায়নি।”

“বুঝেছি বুঝেছি! তাহলে তোর নামটাও লিখিয়ে রাখলাম। শুনেছি এই কোচিং সেন্টারটা অনেক ভালো।”

“ঠিক আছে, লিখিয়ে রাখ।”

নাজের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে বিদায় নিলো জরিনা। খাওয়ার পুরোটা সময় তার মুখে লেগে ছিল নাজের রান্নার প্রশংসা। অল্প কিছু দিনেই রান্নার হাত পাকিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। কে বলবে, এই মেয়ে একদিন পানি গরম করা ছাড়া কিছুই পারতো না?

দুপুরের এই সময়টা বড্ড আলসেমিতে কাটে নাজের। সারাটা সকাল জরিনার সঙ্গে গল্পে গল্পে কেটে যায়। তবে এই সময়টাতে করার মতো তেমন কিছুই থাকে না। থাকলেও করতে ইচ্ছে হয় না। বইটাও এখন আর পড়তে ইচ্ছা করছে না। বিচিত্র এক ক্লান্তি আঁকড়ে ধরে রেখেছে তাকে। ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে, তবে ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না। নাজের এই এক অদ্ভুত অভ্যাস। মাঝে মাঝে চোখে প্রবল ঘুম নেমে আসে কিন্তু ঘুমানোর ইচ্ছে হয় না। আবার মাঝে মাঝে ঘুমাতে ইচ্ছে হয় ঠিকই কিন্তু ঘুম আর পায় না। নিজের এসব পাগলামিতে নিজেই হেসে ওঠে নাজ।

হঠাৎই মোবাইলে কনার ফোন এল। যাক! পরবর্তী কয়েকটা মিনিট আনন্দেই কাটানো যাবে।

ফোন ধরতেই কনা উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল, “দোস্ত! সর্বনাশ হয়ে গেছে!”

নাজ চিন্তিত গলায় বলল, “কী হয়েছে?”

“সর্বনাশ হয়েছে!”

“আরে বাবা সর্বনাশটা কী সেটা বলবি তো!”

“তুই দেখিসনি এখনো?”

নাজ অনিশ্চিত গলায় বলল, “কী দেখবো? ঝেড়ে কাশ তো কনা!”

“ভাইয়ার আইডিতে যা, নিজেই দেখতে পেয়ে যাবি।”

সায়েমের নাম শুনতেই বুকটা ধক করে কেঁপে উঠলো নাজের। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! একে তো কনা বলছে সর্বনাশ হয়েছে, আবার সর্বনাশের কারণও না-কি লুকিয়ে আছে তার আইডিতে। মানুষটার কিছু হয়নি তো?দুশ্চিন্তার কালো মেঘগুলো এসে জড়ো হলো নাজের চোখে মুখে।

ফোন কেটে চিন্তিত ভঙ্গিতে ফেসবুকে ঢুকলো নাজ। মানুষটা খুঁজতে তার আইডি পর্যন্ত যেতে হলো। নিউজ ফিডের শীর্ষেই দেখা মিলল তার। মুহূর্তেই দুশ্চিন্তার কালো মেঘগুলো কেটে গিয়ে পাহাড় সমান বিস্ময় আর লজ্জা এসে ভর করলো তার চেহারায়।

সায়েমের নতুন কভার ফটোতে নাজের ছবি! গতকাল সবুজঘেরা ওই জায়গায় খালি পায়ে নাজের ছোটাছুটি করে বেড়ানোর ছবি। মানুষটা আবার এই ছবি কখন তুলল? ভালো করে ক্যাপশনের দিকে চোখ পড়তেই মুগ্ধতার এক প্রবল স্রোত শিরদাঁড়া প্রচম্পিত করে বয়ে গেল। ক্যাপশনে লেখা –

“More that you say, the less I know
Wherever you stray I follow.”

-Taylor Swift

মানুষটা দিন দিন কী হচ্ছে যাচ্ছে? গতকাল সারাটা দিন নাজের কাছে নিজেকে সম্পূর্ন নতুন এক রূপে উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত হয়নি, আবার আবার গোটা পৃথিবীকে সেই নতুন রূপের জানান দিচ্ছে? সে কী বোঝে না, তার এমন কর্মকান্ডে এই বাচ্চা মেয়েটা লজ্জায় তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে?

বিকেলের দিকে আবারও চায়ের কাপ হাতে বইটা নিয়ে বসলো। গল্পটা মোটামুটি ইন্টারেস্টিং পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকল প্রধান চরিত্ররা গিয়েছে পাখি শিকারে। হুমায়ূন আহমেদ সত্যিই ছিলেন শব্দের জাদুকর। অতি তুচ্ছ বিষয়কেও এমন সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতেন, পড়তেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায় মনে।

পড়তে পড়তেই আবারও ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা আজ একটু পর পরই বেজে উঠছে? ঘটনা কী? পৃথিবীসুদ্ধ সকলের কি আজ একসঙ্গে নাজের কথা মনে পড়েছে?

বিরক্তি নিয়ে ফোনের দিকে তাকালো ভেসে ওঠা নামটা দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। ফোন করেছে শিউলি। মেয়েটার সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। বিয়ে করে ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামে চলে গেছে প্রায় এক বছর হলো। মনে মনে অনুতপ্ত হয় উঠল নাজ। তারই উচিত ছিল একবার ফোন করে মেয়েটার খোঁজ খবর নেওয়া। মাঝে মাঝে আমরা নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি, যে অতি আপনজনদের খোঁজ নেওয়ার সময়টুকুও পাই না।

ফোন রিসিভ করেই নাজ উৎফুল্ল গলায় বলল, “শিউলি! কী খবর দোস্ত?”

অপরপ্রান্ত থেকে শিউলি আন্তরিক গলায় বলল, “এই তো চলছে দোস্ত! তুই কেমন আছিস?”

“অবশেষে মনে পড়লো আমার কথা? বিয়ে-শাদি করে দেখছি আমাদের ভুলেই গেছিস!”

“তুই খুব মনে রেখে বসে আছিস বুঝি? তোর এত কী ব্যস্ততা যে আমার বিয়েতে আসার সময় পর্যন্ত হলো না?”

নাজ অপরাধীর ন্যায় বলে উঠল, “সরি দোস্ত! একবার দেখা হোক, আমি সব খুলে বলবো।”

“হয়েছে, হয়েছে। নিজের হয়ে আর সাফাই গাইতে হবে না। শোন, তোকে ফোন করেছি কনগ্রাচুলেশনস জানাতে। তোর রেজাল্টের খবর পেয়ে কী যে খুশি হয়েছি! আমি জানতাম, একদিন তুই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবি।”

নাজ বিনয়ী গলায় বলল, “থ্যাংক ইউ! আমার থেকে অবশ্য উনার কৃতিত্বই বেশি। উনি না থাকলে হয়তো পড়ালেখাটাই চালিয়ে যেতে পারতাম না। জানিস, বিয়ে পরপর এক মুহূর্তও আমাকে টাইম পাস করতে দেখলে ভ্রু কুঁচকে বলত, পড়তে বসো।”

শিউলি কিছুটা সময় চুপ করে থেকে অন্যমনস্ক গলায় বলল, “তুই অনেক লাকি নাজ।”

“আমার কথা বাদ দে। তুই কেমন আছিস বল। কনা বলল, এবার না-কি পরীক্ষা দিসনি। ঘটনা কী?”

“বাড়িতে যা পরিস্থিতি, তাতে আমাকে বইয়ে মুখ গুজে পড়ালেখা করা মানায় না রে।”

“মানে?”

শিউলি ক্লান্ত গলায় বলল, “আমার শাশুড়ি আম্মার লিভার সিরোসিস ধরা পড়েছে। টানা ছয় মাস বিছানায় পড়ে আছে বেচারি। একা একা খেতে পারে না, ওয়াশরুমে যেতে পারে না। এমন কঠিন সময় আমি যদি উনার সেবা-যত্ন না করি তাহলে কে করবে বল? পরীক্ষা তো এক বছর পরেও দেওয়া যাবে।”

“ওহ। চিকিৎসা করাচ্ছিস ঠিকমত?”

“করাচ্ছি তো। ডাক্তার অপারেশন করতে বলেছে। শিহাবের আবার এদেশের ডাক্তারদের ওপর ভরসা নেই। ওর ইচ্ছা সিঙ্গাপুরে নিয়ে অপারেশন করাবে।”

“সিঙ্গাপুরে যেতে হবে কেন? আমাদের দেশে কি আধুনিক চিকিৎসার অভাব পড়েছে?”

“সেটাই তো ওকে বোঝাতে পারি না। এতগুলো টাকা একা হাতে জোগাড় করতে বেচারা একেবারে হিমশিম খাচ্ছে। আমি আবার এদিকে মাকে বললাম, কয়েকটা গয়না বিক্রি করে টাকা পাঠাতে।”

নাজ ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “কী আশ্চর্য! তোর শাশুড়ির অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে খালাম্মার গয়না বিক্রি করতে হবে কেন?”

শিউলি সঙ্গে সঙ্গে বলল, “সমস্যা কোথায়? মা যেমন আমার, শাশুড়িও তো আমার। ওই গয়নাগুলো তো আলমারিতেই পড়ে থাকে। টাকাগুলো পেলে শিহাবের উপকার হবে।”

“শিউলি?”

“হুঁ?”

“তুই ভালো আছিস তো?”

“ওমা! ভালো থাকবো না কেন? কী যে বলিস নাজ!”

সন্ধ্যা নামার খানিক বাদেই কানে ভেসে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত কলিংবেলের আওয়াজ। দরজা খুলে সায়েমের মুখটা দেখতেই দিনের সকল আলসেমি, বিরক্তিগুলো মুছে গেল। এদিকে ক্লান্ত হয়ে ফেরার পর নাজের হাসিটাই যেন সায়েমের জন্যে খুলে দিল প্রশান্তির দার।

সায়েম প্রায় প্রতিদিনই অফিস থেকে ফেরে একগাদা বাজার নিয়ে। নাজ বারবার বলে, ফ্রিজে যথেষ্ট বাজার আছে। রোজ রোজ বাজার করার প্রয়োজন নেই। কথাগুলোকে যেন কানেই নেয় না সায়েম। তার কথা হলো, অফিস থেকে ফেরার সময় সংসারের জন্যে বাজার করতে তার ভালো লাগে। ফ্রিজে কী আছে না আছে সেটা তো আর তার দেখবার বিষয় নয়।

সায়েম ফ্রেশ এসে বসলো বসার ঘরে। টিভির সামনে বসে অনবরত চ্যানেল ঘোরাচ্ছে। মানুষটার এই এক বদভ্যাস। দেখবে কিছুই না, পুরোটা সময় টিভির সামনে বসে চ্যানেল ঘোরাবে।

নাজ কফি বানিয়ে তার সামনে রাখতে রাখতে বলল, “শখ করে বাজার করবেন ভালো কথা, তাই বলে একটু দেখেশুনে জিনিসপত্র কিনবেন না?”

এমন প্রশ্নের পর শ্রোতার উচিত পাল্টা প্রশ্ন করে জিজ্ঞেস করা, “কেন?” যার উত্তরটা হবে উক্ত প্রসঙ্গ তোলার কারণ। কিন্তু সায়েমের কাছ থেকে তেমন কোনো প্রশ্নই পাওয়া গেল না।

তাই নাজ নিজে থেকেই আবারও বলল, “বেগুন যা এনেছেন, সবগুলো কানা। এমন বেগুন দেখলে কাল জরিনা আমাকে নির্ঘাত ঝাড়ি দেবে।”

কানা বেগুন আবার কী? বেগুনের কি চোখ আছে যে সে কানা হবে? মাঝেমধ্যে কথার ফাঁকে নাজ এমন কয়েকটা আঞ্চলিক শব্দ ঢুকিয়ে দেয়, যেগুলো মাথার ছয় ফুট ওপর দিয়ে চলে যায়। সায়েম এবারও কিছু বলল না, নাজকে রীতিমত উপেক্ষা করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল টিভির দিকে।

নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “এই যে! কী হলো আপনার? শুনছেন আমার কথা?”

সায়েম এবার নাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওহ! আমাকে বলছিলে?”

“আপনি ছাড়া এখানে আর কে আছে?”

সায়েম ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি আড়াল করে বলল, “এমন এই এই করলে বোঝা যায় না-কি কাকে ডাকছো? ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমার একটা নামও আছে।”

নাজ জড়সড় ভঙ্গিতে বলল, “তো? আপনাকে আমি নাম ধরে ডাকতে পারি?”

“চিঠিতে তো ডেকেছিলে!”

চিঠির কথা মনে পড়তেই লজ্জায় চোখদুটো গিয়ে পড়লো মেঝের দিকে। লেখার সময় বারবার মনে হচ্ছিল ছেলেটাকে নাম ধরে ডাকা উচিত হচ্ছে না। ইশ! কেন যে সেদিন কালি দিয়ে ঘষে কেটে দেয়নি তার নামটা! হঠাৎই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এসে ভর করবো?

নাজ খানিকটা সময় ভেবে বলল, “কোন চিঠি যেন? আমার ঠিক মনে পড়ছে না।”

সায়েম বাঁকা হাসি হেসে বলল, “তাই না? আমার কাছে এসো, মনে করিয়ে দিচ্ছি।”

সায়েম নাজের হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে বসালো নিজের কোলে। আচমকা সায়েমের এমন কান্ডে চোখদুটো ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম হলো মেয়েটার। নাজ খেয়াল করলো সায়েমের অবাধ্য ঠোঁটদুটো ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে তার দিকে।

তাই সতর্ক কণ্ঠে বলল, “এই না! এখন কোনো দুষ্টুমি না!”

“সমস্যা কোথায়? আমাদের বাড়িভর্তি লোকজনও নেই যে তুমি কারো দেখে ফেলার অজুহাত দেবে।”

“আপনাকে নিয়ে আর…”

সায়েম নাজের ঠোঁটদ্বয়ের ওপরে আঙুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “কীসের আপনি হ্যাঁ? আমি কি বাইরের কেউ যে সারাদিন আপনা-আপনি করতে হবে?”

ঠোঁটের ওপর মানুষটার শীতল হাতের স্পর্শ, তার ওপরে আবার অমন নেশালো চাহনী – ক্রমশই ভিন্ন এক জগতে হারিয়ে যাচ্ছে নাজ। মুহূর্তেই নিঃশ্বাসের গতি অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেল।

নাজের মুখের ওপরে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলোকে কানে গুজে দিতে দিতে সায়েম বলল, “শোনো নাজ, তুমি দীর্ঘদিন আমার সঙ্গে বাইরের মানুষের মতো কথা বলে এসেছ আমি সহ্য করেছি। এখন থেকে কিন্তু এগুলো সহ্য করবো না।”

নাজ গলার স্বর বহুকষ্টে স্বাভাবিক রেখে বলল, “কষ্ট করে সহ্য করে নিন, কারণ আমি কিছুতেই আপনাকে তুমি-টুমি ডাকতে পারবো না।”

(চলবে)