অবাধ্য পিছুটান পর্ব-১০

0
450

অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১০

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

১৩.
হোটেল ছেড়েছে তুর্য। আর কতদিন হোটেলে থাকা যায়? তাছাড়া এ তো কোনো দর্শনীয় স্থানের হোটেল নয়। যে জানালাটা খুললে মন প্রাণ জুড়িয়ে যাবে,স্নিগ্ধ শীতল বাতাস এসে আবেসিত করবে তাকে। এটা শহরের বুকে রাত কাটানোর জন্য হোটেল। যেখানে জানালা খুললে গরম বায়ু, অযাচিত কোলাহল, যানবাহনের প্যা পো ধ্বনির উৎপাত পাওয়া যায়। যদিও উচ্চমানের পরিপাটি এক সুন্দর হোটেলে ছিল তুর্য তবুও দিনের পর দিন এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না তার। তাছাড়া এখন যেহেতু রাজশাহীর বুকে বউয়ের দেখা পেয়েছে তখন এখানে তাকে থাকতে হবে বেশ অনেকটা দিনের জন্য। আর তো উপায় নেই। প্রথম দিকে বউয়ের দেখা পেয়েও তাকে না চিনে যে ভুলগুলো করেছে তার সংশোধন করতে হবে এখন। বউকে মানাতে হবে, তাকে নিজের প্রেমে ফেলতে হবে, তার প্রণয় উপলব্ধি করাতে হবে। সব মিলিয়ে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন তুর্যের। তাই তো রাজশাহীতে বাসা ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছেলেটা। ঢাকায় নিজেদের ব্যবসার কাজ বাপ চাচাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে কিছু দিনের জন্য। তারপরও এখানে বসে যতটা তদারকি করা সম্ভব সে করবে। আর মাঝে মাঝে খুব প্রয়োজনে হলে স্বল্প সময়ের জন্য ঢাকায় যাবে।

১৪.
রাজশাহীতে ইতমধ্যে বাসা ভাড়া নিয়ে ফেলেছে তুর্য। পৃথাদের বাড়ির কাছাকাছিই রেখেছে বাসাটা তবে দুই তিনটা ঘরের পরে। পাছে যদি তার রা’জা’কা’র শ্বশুরটা কোনোভাবে দেখে নেয় তাকে তখন দেখা যাবে দলবল নিয়ে তাকে এ বাসা থেকে উচ্ছেদ করতে চলে এসেছে। তুর্য এই মুহূর্তে কোনো ঝামেলা চাইছে না, শ্বশুর বাড়ির সাথে তো একদমই নয়। তাই একটু দূরে দূরেই বাসাটা রেখেছে সে।

আজ সন্ধ্যার দিকেই তুর্য উঠেছে সে বাসায়। যদিও ব্যাচেলর মানুষ থাকবে ততকিছু গুছানোর নেই। যতটুকু প্রয়োজনীয় ফার্নিচার কিনেছিল তাও ঐ ফার্নিচারের দিতে যে ছেলেপেলে এসেছিল তারাই গুছিয়ে দিয়ে গেছে। আর বাদ বাকি গুছানোর জন্য তো আরুশ আছেই। তুর্য আর ঐ গুছ গাছের দিকে মনযোগ না দিয়ে বিশাল আকারের তিনটা প্যাকেট নিয়ে বসলো মেঝেতে। আরুশ কপাল কুঁচকালো। পুরো ফ্ল্যাটের জন্য তেমন আসবাবপত্র কিনলো না তুর্য অথচ বেশ হম্বিতম্বি করে জনবল দ্বারা এই বড় বড় প্যাকেটগুলো অনালো। কি আছে প্যাকেটগুলোর মধ্যে? আরুশের হৃদয়ে সন্দেহ জাগলো। সন্দিহান কন্ঠে সে শুধালো,

-“এর ভিতরে কি আছে স্যার?”

তুর্য আরুশের কথা শুনেও যেন শুনলো না। কোনো উত্তর না দিয়ে সে বেশ গুরুত্ব সহকরে খুললো প্রথম বড় প্যাকেটটা। সাথে সাথেইপ্যাকেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো এক নরীর চিত্র। আরুশের ভ্রু কুঁচকে এলো। এ কার ছবি? তাছাড়া ছবিটি দেখেও তো বেশ পুরোনো দিনের কোনো নারী চরিত্র মনে হচ্ছে। চিত্রকর্মের আদলও বেশ পুরোনো, আজকালকার যুগের ন্যায় রঙিন এবং খুব নিখুঁত নয়। আগের দিনের চিত্রশিল্পীদের জ্যামিতিক প্যাটার্ণে ন্যায় আঁকা এ চিত্রকর্ম। আরুশ ভিতরে ভিতরে কৌতুহল অনুভব করলো। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-“এ কার ছবি স্যার?”

তুর্য দুই হাত দ্বারা চিত্রকর্মটা দেয়ালে লাগাতে লাগাতে জবাব দিল,

-“আমার মায়ের বংশের পূর্ব নারী ঘসেটি বেগমের চিত্র এটা।”

আরুশ অবাক হতে গিয়েও অবাক হলো না। তুর্যের আচার আচরন কথা বার্তা সব কিছুর সাথেই সে বেশ পরিচিত। এ বান্দার দ্বারা যে সব কিছু সম্ভব তা সে জানে। সেখানে এই সমন্য ঘসেটি বেগমের চিত্রকর্ম আর কি?

ঘসেটি বেগমের ছবিটা দেয়ালে টানিয়ে পরের আরেকটা প্যাকেট খুললো তুর্য। এবার প্যাকেট থেকে একজন পুরুষের চিত্রকর্ম বেরিয়ে এলো। এই পুরুষের চিত্রও এই যুগের বলে মনে হচ্ছে না কোনো ক্রমেই। আগের ঘসেটি বেগমের চিত্রের ন্যায়ই আঁকা। আরুশ আবারও কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলো,

-“এটা কার ছবি স্যার?”

এবার তুর্য ফিরে তাকালো আরুশের পানে। দুই হাতে চিত্রটা আরুশের সামনে ধরলো। অতঃপর বলল,

-“তোর তো একে চেনার কথা আরুশ। ভালো করে দেখ। চোখ নাক মুখ সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখ। দেখবি ঠিক চিনে যবি।”

আরুশ বিশ্বাস করলো তুর্যর কথা। বড় বড় চোখ করে সে তাকালো ছবিটার পানে। নিশ্চই এ ব্যক্তি ইতিহাস খ্যাত কোনো পুরুষ মানুষ হবে যাকে আরুশের চেনার কথা। ইতিহাস খ্যাত ব্যক্তিদের ছাড়া তো আর তেমন কারো চিত্রকর্ম তৈরী করা হতো না তৎকালীন সময়ে। আরুশ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো ছবিতে থাকা পুরুষকে। বেশ কিছুক্ষণ নানা ভাবে সে চেষ্টা চালালো লোকটাকে চেনার। কিন্তু ফলাফল শূন্য। আরুশ মাথা চুলকে বলল,

-“কে এটা? আমি চিনতে পারছি না স্যার।”

সাথে সাথে নাক মুখ কুঁচকে ফেললো তুর্য। নাক ছিটকে বলল,

-“ছিঃ আরুশ তোকে নিয়ে তো আমার এবার লজ্জা হচ্ছে। তুই কিনা শেষে নিজের পূর্ব পুরুষদের চিনতে পারছিস না। কেমন ছেলে তুই?”

আরুশ অবাক হলো, সাথে সাথে কিছুটা লজ্জাও পেল। এই পুরুষ কিনা তার পূর্ব পুরুষ অথচ সে চিনে না? আরুশের মনে মনে খারাপ লাগলো ভীষন। সে নিজ বংশের পূর্বপুরুষদের চিনে না অথচ তার পূর্ব পুরুষদের তুর্য চিনে। এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে ভাই? তবুও আপাতত আরুশ লজ্জা গিলে খেল। তার এই পূর্বপুরুষকে অবশ্যই চিনতে হবে তাকে। নয়তো পরবর্তীতে আবার কেউ হুট করে এসে এই ছবি দেখিয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে লজ্জায় পড়তে হবে। আরুশ জ্বীহ্বা দিয়ে নিজের ওষ্ঠ ভেজালো। জানার আগ্রহ নিয়ে তুর্যকে শুধালো,

-“এর নাম কি স্যার? এ আমার কোন পূর্ব পুরুষ?”

তুর্য যেন এবার মহা বিরক্ত হলো। আরুশের দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ছবিটা দেয়ালে লাগাতে উদ্যত হলো। কপাল কুঁচকে জবাব দিল,

-“এটা মীর জাফর। তোর কলিজার বন্ধনের পূর্ব পুরুষ।”

আরুশ হতাশ হলো। নিজের উপর নিজে বেশ বিরক্ত হলো। এ তো জানা কথা ছিল যে তুর্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ উত্তর দিবে না। কিন্তু তুর্যের চরিত্র সম্পর্কে জানার পরও এ কথা তার মাথায় কেন এলো না? ধূর আর কিছু সে জিজ্ঞেসই করবে না তুর্যকে। পাগল লোকের সব পাগলামী কথা বার্তা। আরুশের ভাবনার মধ্যেই তৃতীয় নাম্বার প্যাকেটটা খুললো তুর্য। তার ভিতর থেকেও বেরিয়ে এলো এক পুরুষের ছবি। তবে এ ছবিটা আগের গুলোর মতো পুরোনো নয়। যদিও এটা কোনো অংশেই চিত্রকর্ম বলে মনে হচ্ছে না। এটা ক্যামেরা বন্ধি কোনো ছবি মনে হচ্ছে। আরুশ জিজ্ঞেস করবে না করবে না ভেবেও কৌতুহলী হয়ে পড়লো। কোনো কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করে ফেললো,

-“এটা কার ছবি?”

তুর্য দেয়ালে ছবিটা লাগালো। ছবির পানে দৃষ্টি রেখেই বলল,

-“হবে কোনো এক রা’জাকা’রের। আমার রা’জা’কার শ্বশুরটার ছবি সংগ্রহ করতে পরিনি তাই আপাতত অন্য একজন রা’জাকা’রের ছবি টানিয়ে দিয়েছি। তবে শ্বশুরের ছবি সংগ্রহ করতে পারলে এ ব্যাটার স্থানে শ্বশুরের ছবিটাই লাগিয়ে দেব নিশ্চিত থাক।”

আরুশ ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। সে জানতো এমন কিছুই তুর্যর মুখ থেকে বের হবে। তারপরও কেন জিজ্ঞেস করে নিজের কান নষ্ট করলো কে জানে। আরুশ মাঝে মাঝে ভেবে পায় না, সৃষ্টিকর্তা এ তুর্য নামক প্রাণীকে কি দ্বারা সৃষ্টি করেছে। এর আগা গোড়া সবটাই আদ্ভুত কথাবার্তা এবং কার্যক্রম দ্বারা ভরপুর।

তুর্য ছবি গুলো দেয়ালে টানিয়ে হুট করেই করে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো ফ্লোরে। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে হঠাৎ করেই আবার উঠে বসলো। আরুশের পানে তাকিয়ে বেশ ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,

-“আমার নতুন ঘর, নতুন সংসার। বউকে এনে তো অন্তত একটা বার দেখানো প্রয়োজন তাই না আরুশ?”

অরুশ সাথে সাথে তাল মেলালো তুর্যের কথায়। তার হ্যা তে হ্যা মিলিয়ে বলল,

-“জ্বী স্যার। ম্যামকে ছাড়া আপনার এ ঘর একদম অসম্পূর্ণ কিন্তু।”

আরুশের কথা শুনে চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো তুর্যের। আনন্দের সহীত সে বলল,

-“তাহলে তোর ম্যামকে নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।”

আরুশ ভরকালো। আমতা আমতা করে বলল,

-“আমি কিভাবে আনবো?”

তুর্য চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আরুশের পানে। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“তা আমি কি জান? তুই যখন বললি আনা প্রয়োজন তখন নিয়ে আসবি। কিভাবে আনবি তা তুই জানিস।তবে আগামীকাল সকালের মধ্যে আমার বউকে আমি আমার বাসায় চাই নয় তো তোকে আমি ঠুস করে গু’লি করে ঠাস করে উপরে পাঠিয়ে দেব।”

কথাটা বলেই তুর্য উঠে দাঁড়ালো। আরুশকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধুপ ধাপ পা ফেলে নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে প্রস্থান ঘটালো। আরুশ বেচারা আবেগে ফ্লোরে বসে পড়লো ঠাস করে। কি বিপদে পড়লো সে। কে বলেছিল তাকে তুর্যের হ্যা তে হ্যা মিলাতে? আজ তুর্যের কথায় যদি সে তাল না মিলাতো তবে এত বড় একটা বিপদে তো পড়তে হতো না। এখন সে কিভাবে পৃথাকে নিজেদের বাড়িতে আনবে? ভয়ং’কর স্বামীর দ’জ্জ্বা’ল বউকে কিভাবে বাগে আনবে? এমনিই মেয়ের যা তেজ!

১১.
সুদীর্ঘ এক রাতের সমাপ্তি ঘটিয়ে সকালের দেখা মিলেছে। সূর্যের ফুটফুটে আলোয় ভরে উঠেছে চারপাশ। আরুশের কাল রাতে ঘুম হয়নি একটুও। গতকাল সারা রাত শুধু এই চিন্তায় চিন্তায়ই কেটেছে যে পৃথাকে এ বাসায় কিভাবে আনবে। আর যদি না আনতে পারে তাহলে তুর্য যদি সত্যি সত্যি তাকে ঠুস করে গু’লি করে ঠাস করে উপরে তুলে দেয় তখন কি হবে? তুর্য নামক ঐ প্রাণীর না আছে মুখের উপর কোনো বিশ্বাস আর না আছে হাতের উপর কোনো বিশ্বাস। চিন্তায় চিন্তায় আরুশের প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। তাই তো সে সকাল সকালই নেমে দাঁড়িয়েছে বাসার সম্মুখে রাস্তার কাছে। এই পথ দিয়েই তো পৃথা কলেজে যাবে। যদিও সে জানে পৃথার কলেজে যেতে এখনও অনেক দেরী কিন্তু যাবে তো। আরুশ কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না। সে যে সময়ে গেটে দাঁড়াবে তার আগেই যদি পৃথা চলে যায় তখন কি হবে? তাই তাড়াহুড়ো করে ঘরের পোশাক অর্থাৎ থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট এবং টিশার্ট জড়িয়েই উসকোখুসকো চুলে হাজির হয়েছে গেটের সম্মুখে। বারবার পৃথাদের বাসার দিকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। আবার একটু পর পর চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারী করছে।আরুশকে এভাবে পাগলের ন্যায় পায়চারী করতে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো ঐ বাড়িরই দাড়োয়ান। অর্ধবয়স্ক দাড়োয়ান দুই চোয়ালের সাহায্যে পান চিবুতে চিবুতে আরুশকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো,

-“আপনে কেডা?”

আরুশ আমতা আমতা করে জবাব দিল,

-“জ্বী নতুন এসেছি।”

-“ওহ।”

এইটুকু বলে আর দাড়োয়ান বলল না কিছুই। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই প্রস্থান করলো। আরুশ আরও কিছুক্ষণ অতিবাহিত করলো পৃথার অপেক্ষায়। অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। ঐ তো আসছে মেয়েটা। সাদা কলেজ ড্রেসে নিজেকে আবৃত করে মাথায় হিজাব পেঁচিয়ে। আরুশ সময় ব্যয় করলো না একটুও। ব্যস্ত পায়ে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো পৃথার সম্মুখে। হাসিমুখে বলল,

-“আসসালামুয়ালাইকুম ম্যাম।”

হঠাৎ রাস্তার মাঝে কেউ পথ আটকাতে বিরক্ত হলো পৃথা। কপাল কুঁচকে সে তাকালো সম্মুখ পানে। আরুশকে দেখে চোখ ছোট ছোট করে বলল,

-“আপনি ঐ ব্রিটিশ লোকটার চ্যালা না?”

চলবে…..