অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১১
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
আরুশকে দেখে চোখ ছোট ছোট করে বলল,
-“আপনি ঐ ব্রিটিশ লোকটার চ্যালা না?”
আরুশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিল। যেমন স্বামী তার তো তেমন বউই হবে। এটা মোটেই বিস্ময়কর কিছু নয়। তাছাড়া পৃথা ভুল কিছু তো আর বলেনি। তুর্য তো সত্যিই ব্রিটিশদের অন্তর্ভুক্ত। রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার ব্রিটিশগীরি। এতবছর পড়াশোনা এবং ব্যবসার সুবাদেও ইংল্যান্ডেই ছিল তুর্য। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো আরুশ। এখন আর নিজ কাজ ব্যতীত অন্যসব চিন্তা ভাবনার সময় নেই। ফ্ল্যাট থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন দেখে এসেছিল তুর্য ঘুমাচ্ছে। ছেলেটার ঘুম ভাঙার আগেই পৃথাকে নিয়ে তাকে ফ্ল্যাটে যেতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই দজ্জ্বাল মেয়েটা কি তার কথায় যেতে রাজী হবে? তুর্যের কথা শুনলেই তো সম্ভবত মুখের উপর নাকোচ করে দিবে। আরুশ তবুও আশা ত্যাগ করলো না। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
-“আপনি একটু আমাদের বাসায় আসবেন ম্যাম?”
আরুশের হঠাৎ এহেন কথায় কপালে ভাঁজ পড়লো পৃথার। তারা এখনও অপরিচিত একে অপরের নিকট। শুধুমাত্র এই মাঝে মধ্যে কিছু দূর্ঘটনা আর ঝগড়ায় তাদের সাক্ষাৎ। তাছাড়া ঐ ব্রিটিশ লোকটাও যে খুব একটা ভালো তা নয়। তার উপর তাকেও সে সহ্যই করতে পারে না। যদি সহ্য করতেই পারতো তবে কি আর সেদিন ওভাবে সকলের সম্মুখে থাপ্পর দিতে পারতো? সেদিনের কথা স্মরণে আসতেই মেজাজ বিগড়ালো পৃথার। হৃদয়ে জমে থাকা ক্রোধ ডাল পালা মেলে দিল। ঝাঁঝালো কন্ঠে মেয়েটা বলল,
-“ঐ ব্রিটিশ লোকটার বাসায় আর আমি? কখনও যাব না?”
আরুশ যেন আগে থেকেই জানতো পৃথা এমন কিছুই বলবে। সে নিজের গলার স্বর একটু নরম করলো। অনুরোধের স্বরে বলল,
-“প্লীজ চলুন না ম্যাম।”
-“কেন আপনার স্যারের আমাকে আরেকটা থাপ্পর মা’রা’র বাকি আছে নাকি?”
-“না মানে…”
আরুশকে আর বলতে দিল না পৃথা। তার কথার মাঝেই বলল,
-“পাগলা কু’কুরে কাম’ড়িয়েছে আমাকে যে আমি নিজে যেচে ঐ ব্রিটিশ লোকটার গুহায় প্রবেশ করবো? আমার কলেজ আছে। যাচ্ছি আমি।”
কথাটা বলেই পৃথা সম্মুখ পানে পা বাড়ালো। আরুশ তাড়াহুড়ো শুরু করলো। একটা বার যদি পৃথা এখান থেকে চলে যায় তারও নির্ঘাত উপরে চলে যাওয়ার টিকিটটা নিশ্চিত হয়ে যাবে। আরুশ হন্তদন্ত হয়ে পিছু নিল পৃথার। আর কোনো উপায় না পেয়ে চট করে বলল,
-“আসলে আমার স্যার খুব অসুস্থ তো তাই আপনাকে একটু আসতে বলেছিলাম আমাদের বাসায়। এছাড়া আর কিছু নয়।”
তুর্যের অসুস্থতার খবর শুনে পৃথা থমকে দাঁড়ালো। যতই শত্রুতা হোক একটা লোক অসুস্থ এ কথা শুনে নিশ্চই চলে যাওয়া কোনো বিবেকবান মানুষের কর্ম নয়। পৃথাকে দাঁড়াতে দেখে একটু সাহস পেল আরুশ। জ্বীহ্বা দিয়ে ওষ্ঠ ভিজিয়ে কিছুটা করুন কন্ঠে বলল,
-“আসলে আমরা এই রাজশাহী শহরে নতুন। কাউকেই চিনি না তেমন। কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই আমাদের এখানে। যতই ঝগড়া বিবাদ যাই হোক না কেন আমরা অল্প স্বল্প চিনলেও এখানে আপনাকেই চিনি শুধুমাত্র। তাই আর কি বলছিলাম আপনি যদি একটু আমার সাথে আসতেন ভালো হতো। স্যার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাসায় শুধুমাত্র আমি আর সেই ছিলাম। একা পুরুষ মানুষ কি থেকে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না তো তাই।”
কথাটা বলে একটু থামলো ছেলেটা। মলিন কন্ঠে বলল,
-“যাক আপনি যদি না আসতে চান তাহলে তো আর করার কিছু নেই। এমনিও স্যার আপনার সাথে খুব একটা ভালো ব্যবহার করেনি। দেখি আর কাউকে পাই কিনা। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।”
পৃথার খারাপ লাগলো আরুশের কথা শুনে। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ছেলেটার পানে। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করে মনে হলো ছেলেটা সত্যিই বলছে। হয়তো তার স্যার অসুস্থ। পোশাক আশাক, চোখ মুখেও বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে আরুশকে। তবে কি ঐ ব্রিটিশ লোকটা একটু বেশিই অসুস্থ? পৃথা আর না করতে পারলো না। যতই হোক লোকটা অসুস্থ। তুর্য হয়তো খারাপ লোক, ব্রিটিশ কিন্তু সে তো তা নয়। একজন মানুষ অসুস্থ, আর সাহায্য করার মতোও কেউ নেই শুনেও হাত পা গুটিয়ে কিভাবে বসে থাকবে সে? পৃথা রাজি হলো আরুশের সাথে যেতে। ঝামেলাহীন ভাবে বলল,
-“চলুন দেখি কি হয়েছে আপনার স্যারের।”
আরুশ খুশি হলো ভীষন। যাক অবশেষে বুদ্ধি কাজে লেগেছে, পৃথা রাজি হয়েছে। এর মানে এ যাত্রায় তার জীবনটা বেঁচে গেল। আরুশ উৎফুল্ল হয়ে পৃথাকে সাথে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলো। এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে চোখে পড়লো তুর্যের কক্ষের দরজা খোলা। আরুশ ভাবলো স্যারকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাক। নিশ্চই হঠাৎ করে বউকে দেখে চমকে যাবে সে এবং তার উপর খুশিও হবে। তাই আরুশ আর ইতি উতি না করে পৃথাকে নিয়ে সোজা তুর্যের কক্ষেই এলো। কিন্তু একি তুর্য কোথায়? বিছানা তো খালি। পৃথা আর আরুশ দুজনই আশেপাশে খুঁজতে শুরু করলো তুর্যকে। ওয়াশ রুমে থেকে মৃদু পানির শব্দ কর্ণে আঘাত হানলো তাদের। দুজনই নিশ্চিত হলো তুর্য ওয়াশ রুমে। এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো এর পরে। ওয়াশ রুমে বসে বেশ উচ্চস্বরে গান ধরলো তুর্য। নিজের বেসুরো কন্ঠে গাইতে শুরু করলো,
জীবনে শান্তি নাই রে, মনে শান্তি নাই রে
শান্তির বাপ তার মায়েরে নিয়ে বিলেত পালায়েছে এএ
আর আমার ঘরে রাখি গেছে ঘষেটি বেগম
সাথে রাখিছে মীর জাফর
শ্বশুর বাড়িতে রাজাকার
শান্তির বাপ আমারে ধ্বংস করিছে এএএএএ
ওওওও হেই হেই শান্তির বাপ আমারে ধ্বংস করিছে।
তুর্যের কন্ঠে এমন উদ্ভট মিলহীন বেসুরো গান শুনে মাথাটা ঘুরে উঠলো পৃথার। মেয়েটার খুব করে মনে পড়লো তার প্রিয় কার্টুন ডোরিমনের কথা। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে ডোরিমনের জিয়ান টিভি ছেড়ে তার ফাটা বাঁ’শ কন্ঠ নিয়ে তুর্যের উপর ভর করেছে। আর সে ঠিক ঐ ডোরিমন কার্টুনে জিয়ানের গান শোনার পর সবাই যেমন জ্ঞান হারাতো তেমনই জ্ঞান হারাবে হারাবে ভাব। তবে শেষ পর্যন্ত পৃথার জ্ঞানটা রক্ষা পেল, তুর্য তার বিখ্যাত গান থামালো। সাথে সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো মেয়েটার বক্ষভাগ থেকে। বাবাহ কি ঘুর্ণিঝড় নামক গানই না শেষ হয়েছে। তবে এত কিছুর মধ্যে মেয়েটা একটা জিনিস বেশ ভালো বুঝছে তুর্য কোনো অসুস্থ টসুস্থ নয়। এই বড় ব্রিটিশের চ্যালা ছোট ব্রিটিশ আরুশ তাকে মিথ্যা বলে এখানে নিয়ে এসেছে। যেমন জিয়ানের চাপে পড়ে নবিতা মিথ্যা বলে সিজুকা, সুনিও, ডোরিমন এবং অন্যদের নিয়ে আসতো তার গান শুনতে তেমনই এই চ্যাল্যাটাও তাই করেছে। পৃথা কটমট করে তাকালো আরুশের পানে। আরুশ ঢোক গিলল। মিনমিনিয়ে বলল,
-“আমি তো অসুস্থ দেখেই গিয়েছিলাম হঠাৎ সুস্থ হলো কিভাবে বুঝতে পারছি না।”
দুজনের কথাপকথনের মধ্যে ওয়াশ রুম থেকে তুর্যের ফাটা কন্ঠে আবারও নতুন গান ভেসে এলো। এবার সে আগের থেকেও জোরে গাইতে শুরু করলো,
-“আমি যুয়ান একটা হাঁসের বাচ্চা, মুরগির বাচ্চার সাথে আমায় বাবায় দিছে বিয়া। আমি যুয়ান একটা হাঁসের বাচ্চা, মুরগির বাচ্চার সাথে আমায় বাবায় দিছে বিয়া।”
গানটা গাইতে গাইতেই ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এলো তুর্য। আশেপাশে তার কোনো খেয়াল নেই। কোমড় অব্দি শুভ্র রঙা এক খানা তোয়াল দ্বারা আবৃত করে নিজ কন্ঠের গানের তালে তালে সে কোমড় দুলিয়ে যাচ্ছে। নগ্ন বক্ষে মুক্ত দানার মতো পানিতে বিন্দু বিন্দু পানি নিয়ে বিছানার নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো সে। শার্ট প্যান্ট সব বিছানার উপরেই রাখা। তুর্য গান গাইতে গাইতে বিছানার উপর থেকে এক খানা শার্ট হাতে নিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলো। তার মুরগির বাচ্চার মতো বউটা তার পানেই তাকিয়ে আছে গোল গোল চোখে। তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,
-“কি গো মুরগির বাচ্চা! আগে তো রাতের আঁধারে স্বপ্নে এসে আমার ইজ্জত লুট করতে। এখন দেখছি দিন দুপুরেও আমার ইজ্জত লুটের উদ্দেশ্যে চলে এসেছো।”
আরুশ শুনলো তুর্যের কথা। বেচারা বেশ বুঝলো তার স্যার পৃথাকে কল্পনা হিসেবে নিচ্ছে। তাকে এখনই তুর্যের ভুলটা ভাঙাতে হবে নয়তো পরে তার উপরেই আবার চোটপাট চালাবে। রুক্ষ কন্ঠে বলবে,
-“ব্যাটা মীর জাফরের বংশধর তুই আগে কেন বললি না ওটা কল্পনা নয় সত্যি। এখন তোর ম্যাম যে আমার সব দেখে নিয়েছে এর দায় ভার কে নিবে?”
আরুশ একটু এগিয়ে গেল তুর্যের পানে। গলার স্বর একটু বাড়িয়ে বলল,
-“স্যার ম্যাম আপনার কল্পনাতে আসেনি সত্যিই এসেছে।”
আরুশের কথায় ধ্যান ভাঙলো তুর্যের। ধরফরিয়ে উঠলো সে। এর মানে পৃথা তার কল্পনা নয়। সত্যিই মেয়েটা এখানে এসেছে। আর এই অবস্থায় তার সামনেও দাঁড়িয়ে আছে? সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠলো তুর্য। চট জলদি বলল,
-“আমার মুরগির বাচ্চা এখানে কেন?”
পরক্ষনেই আবার ছেলেটা দুই হাতে নিজের কোমড়ে জড়ানো তোয়ালেটা আঁকড়ে ধরলো। হরবর করে বলল,
-“ভাগ্যিস কোমড়ে তোয়ালেটা ছিল। নয়তো আমার মান ইজ্জত এতক্ষনে লজ্জায় গলায় দ’ড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতো।”
পৃথা হতবাক হলো। কি সব বলছে এই পুরুষ। মাথা টাথা কি সব গেছে নাকি? পৃথা অবাক কন্ঠেই বলল,
-“মান ইজ্জত গলায় দ’ড়ি দিতে পারে?”
তুর্য কপাল টান করে তাকালো পৃথার পানে অতঃপর বলল,
-“কেন ওদের তোমার মানুষ মনে হয় না?”
___
চলবে……