অবাধ্য পিছুটান পর্ব-১৪+১৫

0
166

অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১৪

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

আমতা আমতা করে আবার বলল,

-“একবার সত্যিটা বলে দিলেই তো হয়। সব ঝামেলা শেষ হয়ে যায়। এসব লুকোচুরি খেলার মানে কি স্যার?”

তুর্য হাসলো। গাড়ির সিটের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

-“বউয়ের সাথে লুকোচুরি খেলতে ভালো লাগছে আরুশ। বউটার বিভ্রান্তিকর মুখশ্রী হৃদয়ে প্রশান্তি দিচ্ছে।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল আরুশ। বিরবিরিয়ে বলল,

-“এই প্রশান্তি না আবার অশান্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়।”

আরুশের নিচু স্বরে বলা কথাগুলো তুর্যের কর্ণে ঠিকঠাকভাবে পৌঁছালো না। ভ্রু উঁচিয়ে সে শুধালো,

-“কিছু বললি?”

আরুশ এড়িয়ে যেতে চাইলো তুর্যকে। এই কথাগুলো শুনলে আবার কি না কি বলে আধপাগল লোকটা কোনো বিশ্বাস নেই তো। আরুশ কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখেই বলল,

-“তেমন কিছু না স্যার।”

১৮.
বিকালের তেজহীন সূর্য। দুপুরের ন্যায় আর প্রচন্ড গরম এবং তেজ ছড়াচ্ছে না সে। আবহাওয়াও বেশ সদয় আজ। মৃদু শীতল বাতাস বইছে চারপাশে। আবহাওয়ার এমন অনুকূল রূপ দেখে রিদি এসে জুটেছে পৃথাদের বাড়িতে। উদ্দেশ্য পৃথাকে নিয়ে বাইরে বেরুবে, কিছু কেনাকাটা করার আছে তার। প্রথমে পৃথা রাজি না হলেও রিদির জোরাজুরিতে না করতে পারলো না আর। দুই বান্ধবী একদম সেজেগুজে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। এখন শপিং এ যাবে তারপর একটু ঘুরবে, শেষে পড়ন্ত বিকালে গোধূলি লগ্নকে সাক্ষী রেখে ফুচকা খেয়ে বাড়িতে ফিরবে। তবে তাদের এই এত পরিকল্পনা টিকলো না খুব বেশিক্ষন। বসার কক্ষে আসতেই পরিকল্পনায় ভাটা লাগিয়ে দিল পিয়াস। ছেলেটা বসে ছিল বসার কক্ষের সোফাতেই। দুই বান্ধবীকে এত সেজেগুজে বেরুতে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো পিয়াসের। থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

-“কোথায় যাচ্ছিস?”

রিদি আর পৃথা থমকে দাঁড়ালো সাথে সাথেই। রিদি মেয়েটা জড়সড় হয়ে দাঁড়ালো পৃথার পাশেই। এমনি ভাই বাবারা যতই ভালোবাসা দিক না কেন সময়ে শাসন করতেও পিছপা হয় না তারা। তাছাড়া তার এক একটা ভাইয়ের যে শরীর ভর্তি ক্রোধ। পৃথা আমতা আমতা শুরু করলো। ভেঙে ভেঙে বলল,

-“এই বাইরে যাচ্ছিলাম একটু। রিদির কিছু কেনাকাটা করার আছে তো তাই।”

পিয়াস আড় চোখে তাকালো ভীত রিদির পানে। মেয়েটা তাকে অজানা কারনেই ভয় পায় সর্বদা। কখনও এই মেয়ের উপরে নিজের কোনো ক্রোধ প্রকাশ করেছে বা ক্রোধে দুই চারটা থাপ্পর মে’রে’ছে তাও তো নয়। তারপরও কেমন যেন মেয়েটা তার সম্মুখে আসলেই গুটিয়ে যায়। অন্যদের বেলায় তো বেশ প্রাণাচ্ছল চঞ্চল থাকে। তাহলে তার দোষটা কি? তাকে কেন ভয় পাবে? তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল পিয়াস। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-“চল আমিও যাব তোদের সাথে।”

পিয়াসের সাথে যাওয়ার কথা শুনে যেন আঁতকে উঠলো দুই রমনী। রিদি খামচে ধরলো পৃথার হাত। তাদের সাথে পিয়াস যওয়া মানে সকল পরিকল্পনাতে জল ঢালা। পিয়াস তাদের বাসা থেকে সোজা শপিং মলে নিয়ে যাবে সেখান থেকে আবার খেদিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসবে। কোথাও ঘোরাঘুরিও হবে না, আর ফুচকা খাওয়া তো হবেই না। পৃথা জ্বীহ্বা দ্বারা নিজের দুই ওষ্ঠ ভিজিয়ে নিল অতঃপর বলল,

-“তোমাকে যেতে হবে না ভাইয়া। আমরা দুই বান্ধবী তো আছিই। যাব আর চলে আসবো।”

পিয়াস এক পলক তাকলো বোনের পানে। অতঃপর রিদির পানে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

-“এর জন্যই তো আমাকে আরও বেশি করে যেতে হবে। এক গর্দভের সাথে যাচ্ছে আরেক গর্দভ।”

পৃথা আর রিদি অপমানিতবোধ করলো বেশ। তবে পিয়াসের মুখের উপরে আর কিছু বলার সাহস হলো না তাদের। অগত্যা পিয়াসের সাথেই শপিং এ যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো দুই নারী।

১৯.
একটু বাদেই কাছাকাছি একটা ছোট খাটো শপিং মলে এসে পৌঁছালো পিয়াস, রিদি এবং পৃথা। তারা শপিং মলে ঢুকতেই সেখানে এসে পৌঁছালো তুর্য এবং আরুশ। আরুশের উপরে সর্বদা পৃথার উপর নজর রাখার দায়িত্ব ছিল। সেই দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত অবস্থায় আরুশ যখন দেখলো পৃথা বাড়ি থেকে বের হচ্ছে চট জলদি সে খবরটা পৌঁছে দিল তুর্যের কানে। তুর্যও দেরী করেনি। কোনো রকমে তৈরী হয়ে পিছু নিয়েছে বউয়ের। ফলস্বরূপ এখন সে শপিং মলে। শপিং মলে ঢুকে পিয়াসকে বউয়ের সাথে দেখেই মেজাজটা চটে গেল ছেলেটার। কোথায় বউ একা আসবে। তার পিছু পিছু একটু ঘুরঘুর করবে। কিশোরী বয়সের ন্যায় নিজের বউ নামক মেয়েটাকে বিরক্ত করবে তা না। কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হতে আরেকজন এসে হাজির। তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে আরুশকে বলল,

-“এই আল বদ’রটা এখানে আমার বউয়ের সাথে কি করছে?”

আরুশ শুনলো তুর্যের প্রশ্ন তবে প্রতিউত্তরে বলল না কিছুই। আসলে এই আল ব’দর কেন এসেছে তা তো সেও জানে না। হয়তো বোনকে একা ছাড়তে চায়নি তাই এসেছে। তুর্য আড়াল থেকে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ঘুরঘুর করলো বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য কিন্তু সে সুযোগ আর এলো না। পিয়াসটা যেন আঠার মতো লেগে আছে মেয়েটার সাথে। তুর্যের মেজাজ বিগড়ালো আরও। আজ শুধুমাত্র বউটার মনের মধ্যে তাকে নিয়ে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে চায় না বিধায় পৃথার বাপ ভাইয়ের সাথে ঝামেলা করছে না নয়তো দেখিয়ে দিতো তুর্য কি জিনিস। এমনিই বউয়ের হৃদয়ে তার জন্য নেতিবাচক চিন্তা ভাবনার তো শেষ নেই। তুর্যের ভাবনার মধ্যেই পৃথারা এগিয়ে গেল বিল পরিশোধ করতে। আজকের মতো কেনাকাটা শেষ তাদের। বিল পরিশোধ করার সময়ে শপিং মলেরই একজন মহিলা কর্মচারী তড়িঘড়ি করে দৌড়ে এলো একটা প্যাকেট হাতে। জনবলে পিয়াস, পৃথা, রিদি তিনজন থাকলেও কর্মচারী নারীটি প্যাকেটটা এগিয়ে দিল পৃথার পানে। হাসি মুখে বলল,

-“ম্যাম এটা আপনার।”

পৃথা অবাক হলো। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভিতরে দেখলো একটা বেশ সুন্দর শাড়ি। কালো নরম জর্জেটের উপর সোনালী কারুকাজ খচিত। সুন্দরের সাথে সাথে শাড়িটা দামীও মনে হচ্ছে। তবে এমন কোনো শাড়ি পৃথা তো নেয়নি বা নেওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি। পৃথা অবাক কন্ঠেই বলল,

-“আমার মানে? আমি তো এই শাড়িটি কিনিনি।”

অল্প বয়সী নরীটি একগাল হাসলো। অত্যন্ত নম্র কন্ঠে বলল,

-“এটা আপনি কিনেননি ম্যাম এটা আমাদের তরফ থেকে আপনার জন্য উপহার। কয়দিন আগে বসন্ত গেল তো সেই উপলক্ষ্যেই আমাদের এখানে একটা অফার চলছে তিন হাজার টাকার উপরে কেউ শপিং করলে তাকে একটা শাড়ি গিফট করা হবে। সেই শাড়িটাই আপনি পেয়েছেন।”

মহিলা কর্মচারীর এহেন যুক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এলো পিয়াসের। পৃথার হাত থেকে শাড়িটা নিজের হাতে নিল সে। উল্টে পাল্টে দেখে বলল,

-“কিন্তু শাড়িটা দেখে তো মনে হচ্ছে তিন হাজারের থেকে অধিক দাম হবে।”

মেয়েটি আমতা আমতা করলো। কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,

-“আমি কি জানি? শপিং মল কতৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এটা।”

পিয়াস, পৃথা এবং রিদি বোধহয় বিশ্বাস করলো মেয়েটার কথা। রিদির মন খারাপ হলো। সে বলল,

-“তাহলে আমারটা কোথায়?”

-“ম্যাম আপনারা দুজন সম্ভবত মিলেমিশে তিন হাজার টাকার শপিং করেছেন তাই শাড়ি একটাই পাবেন।”

রিদি আর কিছু বলল না। যদিও শাড়িটা তার পছন্দ হয়েছিল কিন্তু যেহেতু সেটা পৃথার হাতেই প্রথম উঠেছে এবং তার বলে সম্বোধন করা হয়েছে তাই সে চুপ রইলো। তাছাড়া পিয়াসের সামনে এই শাড়ি শাড়ি নিয়ে ঝগড়া করার সাহসও তার নেই। নয়তো বান্ধবীর সাথে এক ছরটক ঝগড়া লাগিয়ে হলেও শাড়িটা নিতো সে। পিয়াস তাকালো রিদির মলিন মুখশ্রীর পানে। শাড়ি দেওয়া ঐ নারী কর্মীকেই বলল,

-“হুবহু এমন আরেকটা শাড়ি দিন আমাদের।”

-“জ্বী স্যার।”

ওষ্ঠ নাড়িয়ে কথাটা একবার আওড়িয়েই নারী কর্মীটি চট জলদি হুবহু একই রকম একটা শাড়ি এনে বাড়িয়ে দিল তাদের পানে। পিয়াস তাকালো রিদির দিকে। আদেশের সুরে বলল,

-“শাড়িটা নাও।”

রিদি নিল না শাড়িটা। আমতা আমতা করে বলল,

-“আমার লাগবে না।”

পিয়াস সাথে সাথে ধমকে উঠলো রিদিকে। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-“তোমার কাছে জিজ্ঞেস করেছি আমি? নিতে বলেছি নাও।”

রিদি আর না করার সাহস পেল না। এমনিও শাড়িটা সে নিতে চাইছিলো ভীষণভাবে শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে না না করছিল। যাক এ লোক ধমকটা তো কোনো কাজে এলো তার। অন্তত ধমকের বদৌলতে একটা সুন্দর শাড়ি পেয়েছে সে।

২০.
রাত বেড়েছে কিছুটা। চারদিক যদিও এখনও নীরব হয়ে ওঠেনি তবে অন্ধকার গ্রাস করেছে বেশ ভালোভাবেই।আকাশটাও বেশ মেঘলা। বিকালে অল্প বিস্তর শীতল হাওয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেলেও এখন টিপ টিপ বৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আবহাওয়া খারাপ থাকায় শিকদার বাড়ির সবাই আজ তাড়াতাড়িই নিজেদের রাতের খাবারের পাঠ চুকিয়ে যার যার কক্ষের দ্বার দিয়েছে।

পৃথা কক্ষে প্রবেশ করেই বিছানার উপরে রাখা বিকালে শপিং মল থেকে পাওয়া শাড়িটা হাতে তুলে নিল। দুই পা ফেলে গিয়ে দাঁড়ালো ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে। শাড়িটা গায়ে ফেলে দেখতে লাগলো কেমন কেমন লাগছে তার। শাড়িটা ভারী পছন্দ হয়েছে মেয়েটার। ভাগ্যিস আজ শপিং মলে গিয়েছিল সে নয়তো কত সুন্দর একটা শাড়ি মিস করে যেত। পৃথার শাড়িটা নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যেই বিছানার উপরে ফেলে রাখা তার মোবাইলটা বেজে উঠলো প্রবল ঝংকার তুলে। মেয়েটা বিরক্ত হলো। কে আবার এই সময়ে কল করেছে? পৃথা একরাশ বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে এলো বিছানার পানে। মোবাইলের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে অপরিচিত নাম্বার। একবার রিসিভ করবে না ভেবেও কলটা রিসিভ করলো সে। যদি কেউ কোনো প্রয়োজনে কল করে থাকে তখন? তবে কল ধরে মেয়েটা নিজের ভিতরকার বিরক্তি ভাব প্রকাশ করলো না। বরং নম্র কন্ঠে বলল,

-“আসসালামুয়ালাইকুম। কে বলছেন?”

সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠস্বর। সালামের জবাব দিয়ে সে বলল,

-“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি কে তা জানার আগে বলো তোমাকে এই বয়সে মোবাইল কে দিয়েছে?”

পৃথার কপাল কুঁচকে এলো। কে এই লোক এই মাঝ রাতে কল করে জবাবদিহিতা চাইছে। আর পৃথাই বা কেন অপরিচিত কাউকে কইফিয়ৎ দিবে? পৃথা চড়ম বিরক্তি নিয়ে বলল,

-“কে আপনি বলুন তো। আর এত রাতে কল করে এসব কি প্রশ্ন?”

-“আগে বলো তোমাকে এই বয়সে মোবাইল কে দিয়েছে?”

পৃথা চোখ মুখ খিচে বলল,

-“বাবা দিয়েছে।”

-“হ্যা তা তো দিবেই। তোমার রাজা’কার বাপটা আমার কপাল পোড়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে দেখছি।”

এই “রাজা’কার” এই টুকু শুনেই পৃথা বুঝে গেল কে হতে পারে এই লোক। দাঁতে দাত চাপলো পৃথা। কটমট করে বলল,

-“এই এই ব্রিটিশ লোক আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?”

তুর্য যেন মজা পেল পৃথার কথায়। রসিয়ে রসিয়ে বলল,

-“আকাশে বাতাসে আমার মনে।”

পৃথা তেতে গেল। এই আধ পাগল লোক তো হাত ধুয়েই তার পিছনে পড়ে গেছে। চাইছে টা কি এ? পৃথা ঝাঁঝালো কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

-“অসভ্য লোক আমাকে এত রাতে কল করেছেন কেন?”

তুর্য হাসলো। দাঁত দিয়ে নিচের ওষ্ঠ কামড়ে বলল,

-“প্রেম করতে। করবে আমার সাথে প্রেম?”

___

চলবে…..

অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১৫

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তুর্য হাসলো। দাঁত দিয়ে নিচের ওষ্ঠ কামড়ে বলল,

-“প্রেম করতে। করবে আমার সাথে প্রেম?”

পৃথা মুখ বাঁকালো। ভেংচি কেটে বলল,

-“আপনার মতো ব্রিটিশ, আধ পাগল লোকের সাথে প্রেম করার সাথে কচু গাছের সাথে গলায় দ’ড়ি দিয়ে কতক্ষন টানাটানি করবো তাও ভালো।”

তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। বেশ দৃঢ় কন্ঠে বলল,

-“কিন্তু প্রেম তো তোমার আমার সাথেই করতে হবে। আমি ছাড়া তোমার কোনো গতি নেই।”

পৃথা জ্বলে উঠলো। গর্জানো কন্ঠে বলল,

-“একদম বাজে কথা বলবেন না ব্রিটিশ পুরুষ। রাত বিরাতে একটা মেয়েকে কল করে এমন নির্লজ্জ মার্কা কথা বলতে লজ্জা করছে না আপনার? আপনাকে আমি ব্রিটিশ, আধপাগল ভেবেছিলাম এখন দেখছি চড়ম অসভ্যও বটে।”

-“আমি তোমার ভাবনার চেয়েও অধিক অসভ্য মুরগির বাচ্চা। ধীরে ধীরে টের পাবে।”

পৃথা ভেংচি কাটলো। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

-“আপনার সাথে আর কথা হলে তো টের পাবো। আপনার সাথে তো আমার আর কথাই হবে না।”

তুর্য নিঃশব্দে হাসলো। ছোট একটা শ্বাস ফেলে বলল,

– “আমাদের আবার দেখা হবে, কথা হবে।
এই বিশালতার আকাশের নিচে ছোট্ট একটা
ভালোবাসাময় ঘরে সুখময় সংসার হবে।”
– ( কলমে : সাদিয়া শওকত বাবলি )

তুর্যের বলা প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনলো পৃথা। হৃদয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি কড়া নাড়লো সাথে সাথেই। হৃদস্পন্দনও গাঢ় হয়ে উঠতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। তবে পরক্ষনেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো মেয়েটা। এই পুরুষ কেন এত রাতে তাকে কল করে এসব প্রেমময় বাক্য আওড়াচ্ছে? এ পুরুষ এখনও তার নিকট অপরিচিত মানবের কাতারেই পড়ে। দুজন দুজনের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা হয়ে ওঠেনি এখনও। খুব বেশিদিন হয়নি তাদের দেখা হয়েছে। তারপর থেকে একে অপরের শত্রুতাকেই বরণ করে নিয়েছিল দু’জন। হঠাৎ কি হলো মাত্র তিন চারটা দিন ধরে পরিবর্তন এলো এ পুরুষের ব্যবহারে। খুব করে ভালো ব‌্যবহার করছে পৃথার সাথে আবার সময়ে অসময়ে প্রমময় বাক্যবানে কাবু করার চেষ্টা চালাচ্ছে মেয়েটাকে। তাছাড়া একটু আগে কি সব বলল? কথাগুলোর শেষ লাইনে বেশ দৃঢ়তার সাথেই তো তুর্য নামক পুরুষটি তাকে জানান দিল,

-“ভালোবাসাময় ঘরে সুখময় সংসার হবে।”

পৃথার ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। তাদের সংসার কিভাবে হবে? কেন হবে? হুট করে এই অপরিচিত পুরুষের সাথে বিয়ে হবে তার? কোথা থেকে হুট করে উদয় হলো এই লোক? পৃথা কেমন হাঁসফাঁস করে উঠলো। বিভ্রান্তপূর্ণ কন্ঠে বলল,

-“আমি রাখছি। আপনি আমাকে আর কল করবেন না সাবধান।”

কথাটুকু বলেই মেয়েটা খট করে কেটে দিল কলটা। তুর্য হাসলো। মেয়েটাকে বিরক্ত এবং বিভ্রান্ত করতে বেশ ভালোই লাগছে তার। তুর্য ভাবলো আবারও কল করবে পৃথাকে, আর একটু বিরক্ত করবে। কিন্তু তার আগেই হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো আরুশ। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

-“স্যার ওরা এসে গেছে।”

তুর্য পিছন ফিরে তাকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

-“কারা এসে গেছে?”

আরুশ তাড়াহুড়ো শুরু করলো। হরবরিয়ে বলল,

-“শাহিন মির্জা যে আমাদের হাতে বন্ধী তা তার দলের লোকেরা জেনে গেছে ইতমধ্যে। তার লেজ ধরেই রাজশাহী পর্যন্ত পৌছে গেছে ওরা।”

মুহুর্তেই তুর্যের চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠলো। গম্ভীর কন্ঠে সে বলল,

-“সিকিউরিটি বাড়িয়ে দে। যেটাকে যেখানে পাবি তুলে নিবি। একটা গাধার বাচ্চাও যেন রাজশাহীর মাটিতে পড়ে না থাকে।”

২১.
সুদীর্ঘ এক রাত গড়িয়ে সকালের দেখা মিলেছে। রাতের নিস্তব্ধতায় ঘেরা শহরটা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়তে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। তবে এই ব্যস্ততার মাঝে ভ’য়ং’ক’র রূপ ধারন করে আজ হা’মলে পড়েছে কিছু ভ’য়ং’ক’র শ্রেণীর লোক সমাজ। সচরাচর রাজশাহীর এমন মফস্বল শহরে স’ন্ত্রা’স কিংবা গো’লা’গুলি’র মতো ঘটনা দেখা যায় না তেমন। তবে আজ গু’লি চলেছে। তীব্র বেগে গু’লি, চিৎকার চেঁচামেচি এবং জনগনের বাঁচার হাহাকারের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে চারদিকে। আরুশকে দেখা যাচ্ছে সেই ভীর পূর্ণ গো’লা’গু’লি’ম’য় স্থানে। কাউকে কল করে সে বলছে কিছু একটা।

কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই ভীর ঠেলে বেরিয়ে এলো পরিপুষ্ট, বলিষ্ঠদেহী কিছু জনসংখ্যা। তারা বেরিয়েই দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেল। অর্ধেক লোক জনগণকে নিরপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়ার কাজে লেগে পড়লো মুহুর্ত ব্যয় না করে আর বাকি অর্ধেক নিজেদের নিকট সংরক্ষিত ব’ন্দু’ক হাতে তুলে পাল্টা গুলি ছুড়লো দুর্বৃত্তদের উপরে।

তুর্য এতক্ষন গাড়িতে বসে বসে অবলোকন করছিল আশেপাশের পরিস্থিতি। গতকাল রাতেই সে বলেছিল এ দুরাত্মা গাধার বাচ্চা গুলোকে তুলে নিতে। কিন্তু আহাম্মক গুলো তা পারেনি। ফলস্বরূপ আজ এই গো’লা’গু’লি। শুধু শুধুই সাধারণ জনগনের উপর এই ভোগান্তি নেমে এলো। এগুলোর একটাকে দিয়েও যদি কোনো কাজ হয়। তুর্য বিরক্ত হলো ভীষণ। একটু ঝুঁকে পায়ের গোড়ালির কাছ থেকে বের করে আনলো লুকায়িত এক খানা ব’ন্ধু’ক। মুখে কালো মাস্ক চাপিয়ে সে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। দুর্বৃত্তদের নিশানা করে পরপর দুটো গুলি ছুড়লো। একটা গিয়ে লাগলো একজনের ডান পায়ে এবং অন্যটা অন্য একজনের হাতে। তুর্য আরেকটা গুলি ছুঁড়তে উদ্যত হতেই পাশ থেকে শোনা গেল অতি পরিচিত কন্ঠের চিৎকারের ধ্বনি। ছেলেটা কিছুটা চমকালো। পাশ ফিরতেই আবিষ্কার করলো পৃথাকে। মেয়েটা কেমন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে তার পানেই, পড়নে কলেজের পোশাক আর পিঠে ব্যাগ। মেয়েটা বোধহয় কলেজে যাচ্ছিলো। তুর্য বিচলিত হলো, হাতে ধরে রাখা ব’ন্দু’ক’টা লুকিয়ে ফেললো প্যান্টের আড়ালে। পৃথা ভীত হলো বেজায়। এমন কোনো পরিস্থিতিতে এর আগে সে পড়েনি কখনও। এই যে সত্যিকারে ব’ন্দু’ক তাও সে আগে দেখেনি কখনও। তাই তো হুট করে সম্মুখে এত গো’লা’গু’লি, রক্তপাত, আহ’ত, চিৎকার চেঁচামেচি, লোকজনের ছোটাছুটি দেখে ভীত হয়ে পড়েছে মেয়েটা। তার উপর আবার তার সম্মুখে দাঁড়িয়েই একটা লোক গু’লি চালাচ্ছে কি দক্ষতার সাথে। পৃথার ভীতির মধ্যেই সে লক্ষ্য করলো তার সম্মুখে দাঁড়ানো এতক্ষনের গু’লি চালানো লোকটা এগিয়ে আসছে তার পানেই। মেয়েটা ভীত হলো আরও। লোকটা তার পানে কেন যাচ্ছে? তাকে গু’লি চালাতে দেখে ফেলেছে বলে বলে কি মে’রে দিবে এখন? দিতেও পারে এদের বিশ্বাস নেই কোনো। পৃথা ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। কম্পিত কন্ঠে বলল,

-“আমাকে মারবেন না প্লীজ। আমার এখনও বিয়ে করা বাকি। আমি ম’রে গেলে আমার জামাইটা বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যাবে।”

পৃথার কথায় ভ্রু কুঁচকালো তুর্য। মেয়েটা আবোল তাবোল এসব কি বলছে? মাথা ঠিক আছে তো? তুর্য আরও তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেল পৃথার পানে।

পৃথার হাঁটু কাপলো ভয়ে। এমনিই মাথা ঠিক নেই তার। মৃত্যু ভয়ে কি থেকে কি বলছে সে নিজেও জানে না। নয়তো সজ্ঞানে থাকলে এমন পরিস্থিতিতে এমন উদ্ভট কথাবার্তা অন্তত তার মুখ দিয়ে বেরুতো না। পৃথা নিজের প্রাণ বাঁচাতে পালাতে চাইলো। কিন্তু পারলো না তার আগেই তাকে ধরে ফেললো তুর্য। পৃথার কলিজা কাঁপলো। তার ভাবনা মতে মৃ’ত্যু সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তার। নাহ আর পারলো না। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত ভয়, চাপ এবং চিন্তায় মেয়েটা জ্ঞান হারাতে সময় নিল না বেশিক্ষণ। ঢলে পড়লো তুর্যের বক্ষে। তুর্য অস্থির হলো। হৃদয়ে ঝড় উঠলো। কি হয়েছে তার ছোট্ট বউটার? তুর্য বিচলিত কন্ঠে ডাকলো বউকে। বলল,

-“পৃথা! এই পৃথা, কি হয়েছে? চোখ খোলো।”

পৃথা চোখ খুললো না। তুর্যের অস্থিরতা বড়লো। সে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে বসালো গাড়ির ভিতরে। অতঃপর নিজেও সিটে বসে মেয়েটার মাথা নিল কাঁধে। আলতোভাবে কয়েকটা চাপড় দিল বউয়ের নরম গালে। আবারও ডাকলো,

-“পৃথু! এই পৃথু।”

পৃথার হুশ নেই কোনো। কথা বলছে না। তুর্য অস্থিরতায় নিজের মুখ থেকে মাস্কটা খুলে ছুঁড়ে মারলো গাড়ির পিছনের দিকে। গাড়ির ভিতরে থাকা পানির বোতল থেকে অল্প পানি হাতে নিয়ে ছিটা মারলো পৃথার চোখ মুখে। তবুও মেয়েটা চোখ খুললো না। তুর্য ভেজা হাতেই আবার আলতোভাবে কয়েটা চাপড় দিল মেয়েটার গালে। ব্যগ্র কন্ঠে শুধালো,

-“কি হয়েছে? কথা বলো বউ।”

ওদিকে গো’লা’গু’লি’ও থেমে গেছে ততক্ষণে। তুর্যের লোকেরা দুর্বৃত্তদের পুরো দলটাকে ধরে নিয়েছে স্থান পরিস্কার করে দিয়েছে। পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ অনুকূলে। কেউ এসে হুট করে বলতে পারবে না এখানে একটু আগে এত বড় গো’লা’গু’লি হয়েছে। আরুশ এসে বসলো গাড়ির ড্রাইভিং সিটে। পৃথাকে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তুর্যকে উদ্দেশ্যে করে জিজ্ঞেস করল,

-“ম্যামের কি হয়েছে স্যার?”

তুর্য পৃথার পানে দৃষ্টি রেখেই জবাব দিল,

-“গোলাগুলি দেখে ভয় পেয়ে গেছে।”

থামলো তুর্য। চোখ মুখ শক্ত করে পরক্ষনেই বলল,

-“গাধার বাচ্চা গুলোকে ততক্ষণ পেটাবি যতক্ষন না জ্ঞান হারায়। আমার বউকে ভয় দেখানো। ওদের বাপের নামই আমি ভুলিয়ে দেব আজ আমি।”

কথাটা শেষ করেই আবার ব্যস্ত ভঙ্গিতে পানি ছিটিয়ে দিল পৃথার চোখ মুখে। মেয়েটা ক্ষানিক বাদেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো। সাথে সাথেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো আবার। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

-“আমাকে মা’র’বে’ন না দয়া করে। আমি কাউকে কিছু বলবেন না।”

তুর্য দুই হাতে নিজ বক্ষের সাথে আগলে নিল মেয়েটাকে। আদুরে কন্ঠে বলল,

-“কেউ মা’র’বে না তোমাকে। আমি আছি তো।”

পৃথা বোধহয় ভরসা পেল তুর্যের কথায়। উত্তেজনা কমলো কিছুটা। তবে যখনই মেয়েটা আবিষ্কার করলো সে তুর্যের বুকে লেপ্টে রয়েছে সাথে সাথেই ছিটকে দূরে সরে গেল। লাজে গাল দুটো লাল হয়ে গেল পৃথার। ছিঃ ছিঃ সে কি এতক্ষন এক পুরুষের শরীরের সাথে লেপ্টে ছিল? এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো পৃথা। আমতা আমতা করে বলল,

-“ওখানে একটা লোক গু’লি চালাচ্ছিলো তো। তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আর কি।”

তুর্য স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক মেয়েটা তাকে চিনেনি। চিনলে হয়তো ঝামেলা হতো অনেক। এমনিই তাদের সম্পর্কের ঠিক নেই কিছু। তার মধ্যে এই যদি পৃথা কোনো মতে জেনে যেত এই গো’লা’গু’লি’র মূল সে তবে আর এ জনমে বউকে পাওয়া লাগতো না। ভাগ্যিস মাস্ক পড়েছিল। ঐ মাস্কটাই আজ বাঁচিয়ে দিল।

২১.
রাতের আঁধারে ছেয়ে গেছে চারপাশটা। চারদিক নীরব হতে শুরু করেছে একটু একটু করে। শিকদার বাড়ির সবাই রাতের খাবার খেতে বসেছে ইতমধ্যে। পৃথা খাবার নিয়ে শুধু বসে রয়েছে, খাচ্ছে না মোটেই। চোখের সম্মুখে বার বার তার ভেসে উঠছে আজ সারাদিনের ঘটনাগুলো। সারাদিনের স্মৃতিচারন করতে করতে হঠাৎই মেয়েটার স্মরণে এলো তুর্যের কথা। অমন একটা ভ’য়ং’ক’র পরিস্থিতির মধ্য থেকে ঐ লোকটাই তো তাকে বাঁচিয়েছিল। আচ্ছা এই তুর্য চৌধুরী আসলে কে? কি তার পরিচয়? পৃথার হঠাৎ মনে এলো সেদিন ছেলেটা বলেছিল তার বাবা তুর্যকে চিনে। চিনতেও পারে। তাই হয়তো তুর্য কলেজে তার বাড়ির ঠিকানা খুঁজেছিল কিন্তু সে মনে মনে ভুল ধারণায় মজেছিল। তাছাড়া পৃথার নিকটও তুর্য চৌধুরী নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে। তবে কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছে না ঠিক। পৃথা চোখ তুলে তাকালো বাবার পানে। উৎসুক হয়ে ডাকলো,

-“বাবা!”

পলাশ সিকদার খেতেই খেতেই জবাব দিল,

-“কিছু বলবে?”

পৃথা কোনো ভনিতা ছাড়াই সরাসরি প্রশ্ন করলো,

-“তুর্য চৌধুরী কে বাবা?”

চলবে…..