গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_২৮
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
অসহায় কন্ঠে বলল,
-“এর নাম ভারত চীন বর্ডার না রেখে ভারত বাংলাদেশ বর্ডার রাখা যায় না বউ? ভারত বাংলাদেশ বর্ডার হলে মাঝে মধ্যে তাও দুই চার পয়সা ঘুস দিয়েও বর্ডার পেরুনোর সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ভারত চীন বর্ডারে নো নো চান্স। সোজা গু’লি করে খুলি উড়িয়ে দিবে।”
পৃথা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
-“গু’লি করে আপনার খুলি উড়াতে পারবো কিনা জানি না। তবে এ কক্ষ থেকে ঠিক বেরিয়ে যেতে পারবো। এই কোলবালিশ ভেদ করে এদিকে আসার চেষ্টা করলে সোজা রুমের বাইরে চলে যাব বলে দিলাম।”
তুর্য চোখ মুখ কুঁচকালো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
-“তুমি তো দেখছি ভারত চীনের বর্ডারের থেকেও ভয়ংকর বউ।”
পৃথা গায়ে মাখলো না তুর্যের কোনো কথা। এ বান্দা সর্বদাই এমন আজগুবি সব কথা বলবে এ আর নতুন কি? মেয়েটা আর সময় নষ্ট করলো না। তুর্যকে একটা ভেংচি কেটে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে বলল,
-“আজেবাজে কথা রেখে ঘুমাতে দিন এখন।”
তুর্যও আর কথা বাড়ালো না। বউয়ের পানে একবার অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুয়ে পড়লো কোলবালিশের এপাশে। তবে ঘুমালো না তূর্য। বউকে পাশে রেখে কি আর তার মতো পুরুষের ঘুমানো সম্ভব নাকি? এতদিন পর বউকে পাশে পেয়ে শরীরে প্রেমের জোয়ার বইছে বেচারার। তুর্য বেশ কিছুক্ষণ সময় ঘুমের ভান ধরে মটকা মেরে পড়ে রইলো বিছানায়। অতঃপর পৃথার আর কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে উঠে বসলো। উঁকি দিয়ে দেখলো পৃথা সত্যিই ঘুমিয়েছে কিনা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তো মনে হচ্ছে মেয়েটা ঘুমিয়েছে। তবুও তুর্য নিজের হাত বাড়িয়ে পৃথার নাকের কাছে ধরলো।ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করলো ঘুমিয়েছে কিনা। না এবার তো মনে হচ্ছে সত্যিই ঘুমিয়েছে। তুর্য আস্তে ধীরে তার আর পৃথার মধ্যাকার কোলবালিশটা সরিয়ে দিল। অতঃপর খুব সাবধানে শুয়ে পড়লো পৃথার গা ঘেঁষে। ইসসস কি মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে তার বউয়ের শরীর থেকে অথচ এই মেয়েটা কিনা তাকে দূরে রাখতে চেয়েছিল। তুর্য আলতোভাবে পৃথার কোমড়ে হাত দিল। টেনে নিয়ে মিশিয়ে নিল নিজ বক্ষের সাথে। আলতোভাবে পৃথার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-“ভারত চীনের বর্ডার কেন? চীনের মহা প্রাচীর তুলে দিলেও তো আমাকে আমার বউয়ের থেকে আলাদা করা যাবে না।”
কথাটা বলেই ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো তুর্য। পৃথাকে লুকিয়ে নিল বুকের মধ্যখানে। অতঃপর চোখ বন্ধ করে পাড়ি জমালো ঘুমের দেশে।
২৯.
সময় গড়ালো কিছুটা। সকালের সূর্যটাও তার তেজ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রখরতা ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে। চারপাশ থেকে আজানের সুমিষ্টি ধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। হয়তো জোহরের আজান পড়েছে। সারারাত জার্নি করে এসে ভোরের দিকেই তো ঘুমিয়েছিল পৃথা আর তুর্য। তাই বাড়ির কেউও আর ডাকেনি তাদের। তবে জোহরের আজানের ধ্বনি কর্ণে পৌঁছাতেই ঘুম ভাঙলো তুর্যের। পিটপিট করে চোখ খুলতেই চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো পৃথার ঘুমন্ত মুখশ্রী। কি স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে। তুর্য হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলো। তার কতদিনের স্বপ্ন ছিল এভাবে বুকের ভিতরে বাচ্চা বউটাকে নিয়ে ঘুমাবে, আবার জেগে উঠেও দেখবে বউটার মুখশ্রী। আজ সে স্বপ্ন বুঝি পূরণ হলো। তুর্য পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটার পানে। ঘুমানোর দরুন নাক, গাল, চোখ, কেমন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তুর্যের লোভ লাগলো। ইচ্ছে হলো একটু ছুঁয়ে দিতে। ছেলেটা এ পর্যায়ে নিজের ইচ্ছেটাকে দমন করলো না। হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিল বউয়ের, নাক, গাল , ওষ্ঠ। তবে এতেও বুঝি তার তৃষ্ণা মিটলো না তার। হৃদয়টা আরও কিছু চাইলো। নিষিদ্ধ চাওয়ারা তরতরিয়ে জাগ্রত হলো। তুর্য একটু ঝুঁকলো পৃথার পানে। হতে বাড়িয়ে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল মেয়েটার নাক, কপাল এবং গালে। এরপর! এরপর আবার সেই ওষ্ঠ। আগের বার এই ওষ্ঠে চু’মু খেতে গিয়েই ধরাটা খেয়েছিল। এবারও যদি ধরা খায় তবে আর রক্ষে নাই। বউ সোজা রুম ছেড়ে দিবে। তুর্য একবার ভাবলো চু’মু খাবে না কিন্তু মনটাকে কোনোভাবেই দমাতে পারলো না সে। চু’মু খাবে না খাবে না করেও চ’ট করে একটা চু’মু খেল পৃথার ওষ্ঠে। মেয়েটা কোনোভাবে টের যাতে না পায় তাই অতি দ্রুত সরে এলো। ঝুঁকি না নিয়ে কোলবালিশটা আবার রেখে দিল পৃথা আর তার মাঝে খানে। অতঃপর মৃদু কন্ঠে ডাকলো মেয়েটাকে,
-“বউ, ও বউ।”
পৃথা নড়েচড়ে উঠলো একটু তবে পুরোপুরি উঠলো না। তুর্যও আর ডাকলো না। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে আর একটু ঘুমাক। তুর্য বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে একটা সবুজ রঙা পাঞ্জাবী জড়ালো তার শক্তপোক্ত ফর্সা শরীরে। অতঃপর টুপি মাথায় রওনা হলো মসজিদে।
৩০.
পৃথার ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়ির কাঁটায় প্রায় দুপুর দুইটা বেজেছে। ঘুমের ঘোরে চোখ বন্ধ রেখেই বিছানায় উঠে বসলো সে। ফোলা ফোলা চোখ মুখে তাকালো পাশে। দেখলো কোলবালিশটা একদম যথাস্থানেই আছে। আর তুর্যও কক্ষে নেই। যাক অন্তত ছেলেটার একটু তো সুবুদ্ধি হয়েছে এই কোলবালিশটা পেরুনোর চেষ্টা করেনি। হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলো পৃথা। হঠাৎ কক্ষে টানানো দেয়াল ঘড়িটার পানে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ তার। ২ টা বেজে গেছে! এত সময় ঘুমিয়েছে সে। আর কেউ ডাকলোও না। পৃথা তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। নতুন বাড়ি, নতুন মানুষ, তার উপর নতুন বউ। সে যদি এভাবে ঘুমিয়ে থাকে তাহলে কিভাবে হয়? সবাই কি ভেবেছে কে জানে। পৃথা হন্তদন্ত হয়ে ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। একটু শান্ত মনে জোহরের নামাজটা আদায় করলো। অতঃপর শরীরে জড়ানো থ্রী পিসের ওড়নাটা মাথায় ভালোভাবে জড়িয়েই বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে। কিন্তু একি বাড়ির সবাই কোথায়? পৃথা শরীরে জড়ানো ওড়নাটা আরেকটু টেনেটুনে ঠিক করলো, তাকালো আশেপাশে। ভোরেও তো এ বাড়িতে ভরপুর মানুষ দেখলো এখন কই সব? হঠাৎ পাশের এক কক্ষ থেকে টুংটাং আওয়াজ ভেসে এলো পৃথার কর্ণে। হয়তো ওখানেই কেউ আছে। আওয়াজ গুলো অনুসরণ করেই সে কক্ষের পানে গেল মেয়েটা। দেখা মিললো তাহমিনা বেগমের। সম্ভবত এটা ডাইনিং কক্ষ। টেবিল, খাবার দাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারদিকে। কক্ষে অন্য কারো উপস্থিতি অনুভব করতেই তাহমিনা বেগম সেদিকে ফিরে তাকালেন। পৃথাকে দেখে একগাল হেসে বললেন,
-“উঠে পড়েছিস? আয় বস এক সাথে খাবো আমরা।”
পৃথা এগিয়ে গেল দাঁড়ালো টেবিলের পাশে। বসবে নাকি বসবে না দ্বিধায় আছে। কেমন ইতস্তত লাগছে তার। আর তুর্যটাও বা কোথায়? ঘুম থেকে উঠে তো একটাবারের জন্যও দেখা মিললো না তার। কোথাও কি বেরিয়েছে? তাহমিনা বেগমের কাছে জিজ্ঞেস করবে? না না কি না কি ভাবে আবার। পৃথার ভাবনার মধ্যেই তাহমিনা বেগমের কন্ঠস্বর ভেসে এলো আবার। ভ্রু কুঁচকে তিনি বললেন,
-“কি হলো বস।”
পৃথা ইতস্তত করলো। চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
-“এই তো বসছি আন্টি।”
তাহমিনা বেগম চোখ গরম করে তাকালেন পৃথার পানে। শাসিয়ে বললেন,
-“এই আন্টি কি রে? মা বলবি মা।”
পৃথা তাকালো শ্বাশুড়ির পানে। মানুষটা কত ভালো। এই টুকু সময়েই কেমন আপন করে নিয়েছে। পৃথার এই মুহূর্তে সুফিয়া বেগমের কথা ভীষনভাবে মনে পড়লো। তার মা কেমন আছে? ঠিক আছে তো? নাকি কান্না কাটি করছে তার জন্য? কাল থেকে একটা খোঁজ খবরও নেওয়া হয়নি। পৃথার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। তবে তা তাহমিনা বেগমের নজরে আসার আগেই লুকিয়ে ফেললো। তাহমিনা বেগম খাবারের প্লেট দিলেন পৃথার সম্মুখে। খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললেন,
-” মা বলে ডাকবি তো?”
পৃথা দ্বিরুক্তি করলো না। মাথা নাড়িয়ে হ্যা সম্মতি দিল। তাহমিনা বেগম হাসলেন। তাড়া দিয়ে বললেন,
-“খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। সেই কখন খেয়েছিস।”
পৃথা উসখুস করলো। হৃদয়ে হানা দিল তুর্য খেয়েছে কিনা। হাজার হলেও এটা তুর্যের বাড়ি। তার মারতেই পৃথা এসেছে এখানে। তার খোঁজ খবর নেওয়াটা অবশ্যই পৃথার কর্তব্য। কিন্তু সরাসরি প্রশ্নটা করতেও কেমন ইতস্তত লাগছে। শেষে একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“বাড়ির সবাই খেয়েছে?”
-“হ্যা সবাই খেয়ে নিয়েছে। শুধুমাত্র বাকি আছে তুই, আমি আর তোর গুনধর স্বামী।”
তুর্য খায়নি শুনে পৃথারও আর খেতে ইচ্ছে হলো না। তবে নিজের মনের ইচ্ছেটা শ্বশুরির নিকট কর জানাতে পারলো না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্লেটে হাত রাখলো সে। ঠিক তখনই পৃথার পিছন থেকে ভেসে এলো এক ভারী কন্ঠস্বর। গম্ভীর কন্ঠেই বলল,
-“আমাকে রেখেই খেতে বসে গেছো? এত পাষান হতে পারলে তুমি বউ?”
তুর্যের কন্ঠ কর্ণে পৌঁছাতেই পিছন ঘুরে তাকালো পৃথা। অমনি যেন থমকে গেল মেয়েটা। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল দ্রুত। তুর্য পাঞ্জাবী পড়েছে আজ, আবার মাথায় টুপি। এই মুহূর্তে পৃথার চোখে এই পুরুষকে সবচেয়ে স্নিগ্ধ লাগছে। যদিও এর আগে একবার পাঞ্জাবী পড়া অবস্থায় তুর্যকে দেখেছে পৃথা কিন্তু এত খেয়াল করেনি। তখন তা শাড়ি আর পাঞ্জাবী ছেড়ার তালে ছিল। তাছাড়া তখন মাথায় টুপিও ছিল না। পৃথার ভাবনার মধ্যেই তুর্য মাথার টুপিটা খুলে পকেটে ঢুকালো। একটু এগিয়ে এসে ধপ করে বসে পড়লো পৃথার পাশে। একটু ঝুঁকে বলল,
-“আমাকে কি একটু বেশিই সুন্দর লাগছে বউ?”
চলবে…..
____
গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_২৯
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
একটু ঝুঁকে বলল,
-“আমাকে কি একটু বেশিই সুন্দর লাগছে বউ?”
পৃথা থতমত খেয়ে গেল তুর্যের প্রশ্নে। তৎক্ষণাৎ মাথা নুইয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো খাবারের থালায়। তুর্য আর একটু গা ঘেঁষে বসলো পৃথার পানে। মেয়েটার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“মুরগির বাচ্চার জামাই হাঁসের বাচ্চার সুন্দর তো হওয়ারই কথা তাই না বউ?”
পৃথা আড় চোখে তাকালো তুর্যের পানে। বিরবিরিয়ে বলল,
-“হাঁসের বাচ্চা না ছাই। আপনি আস্ত একটা ব্রিটিশের বাচ্চা।”
পৃথা কথাগুলো বিরবিরিয়ে বললেও তুর্য শুনে নিতে কষ্ট হলো না তেমন। কাছাকাছিই বসে ছিল দুজন। তুর্য সাথে সাথেই পৃথার বলা বাক্যের বিরোধীতা করলো। কন্ঠ খাদে রেখেই বলল,
-“তুমি ভুল বললে বউ, আমি মোটেও ব্রিটিশের বাচ্চা নই। আমি আস্ত একটা ঘষেটি বেগমের বাচ্চা।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই তাহমিনা বেগম খাবার দিলেন তুর্যকে। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
-“নামাজে গিয়েছিস সেই কখন। এখন ফেরার সময় হলো তোর? বাড়ির সবার খাওয়া দাওয়া সেই কখন শেষ।”
মায়ের কথা শুনে সোজা হয়ে বসলো তুর্য। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
-“মসজিদে পুরোনো কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল তাই আসতে আসতে একটু দেরী হয়েছে।”
তাহমিনা বেগম তাকালেন ছেলের পানে। কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
-“তোর বন্ধু বান্ধব মানেই তো সব গু’ন্ডা মা’স্তা’ন। ওগুলোর সাথে আবার এত কথা কিসের?”
তুর্যের মুখশ্রী থমথমে হলো। মায়ের পানে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বলল,
-“ওরা মোটেও গু’ন্ডা মা’স্তা’ন নয় মা। ওদের মতো ভালো ছেলে তুমি এ তল্লাটে আর একটাও পাবে না।”
তাহমিনা বেগম মুখ বাঁকালেন। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
-“একদম তোর মতো ভালো। হাড়ে হাড়ে যার বাজ্জাতগীরি। ”
মায়ের কথার প্রেক্ষিতে তুর্যও মুখ বাঁকালো। ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
-“ঘষেটি বেগমের ছেলে হয়ে যদি হাড়ে হাড়ে বাজ্জাতগীরি না থাকে তবে তোমার নামই তো ডুববে মা।”
তাহমিনা বেগম ফুঁসে উঠলেন। দুই হাত দিয়ে টেবিলে থাপ্পর মেরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তাহমিনা বেগমের হাতের আঘাতে কেঁপে উঠলো টেবিলটা, পৃথা হকচকিয়ে উঠলো মুহুর্তেই। এতক্ষন চুপচাপ মা ছেলের ঝগড়া দেখছিলো সে। চেয়েও দুজনের মধ্যে বলতে পারছিলো না কিছু। এই টুকু সময়ে এই মা ছেলেকে সে যতটুকু সময়ই দেখেছে ততটুকুই সময়ই দেখেছে শুধু ঝগড়া করতে। তবে এখন মনে হচ্ছে এদের থামানো প্রয়োজন। নয়তো ঝগড়া বেশিদূর গড়িয়ে যেতে পারে। এখানে আর কেউ নেই ও যে সে এই মা ছেলের ঝগড়া থামাবে। পৃথা নিজের সাথে যুদ্ধ করেই মুখ খুললো। আমতা আমতা করে করে বলল,
-“আ…”
বাকিটুকু আর বলল না। একটু আগেই তো তাহমিনা বেগম তাকে “মা” ডাকতে বলেছিল। এখন যদি আবার আন্টি ডাক শুনে আবার রেগে যান। এমনিই ভীষণ রেগে আছে মহিলা। যদিও হঠাৎ একজন প্রায় অপরিচিত নারীকে মা বলতে ইতস্তত লাগছে পৃথার তবুও উপায় নেই। এই মা ছেলেকে থামাতে হলে নিজের ভিতরের ইতস্ততবোধকে গলা টিপে মা’র’তে হবে। পৃথা এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। ঢোক গিলে বলল,
-“মা আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনার ছেলে তো একটু এমনই তা তো অবশ্যই আপনি জানেন।”
তাহমিনা বেগম তাকালেন পৃথার পানে। ক্রোধ চেপে হঠাৎ হাসলেন তিনি। দ্রুত চেয়ারে বসে বললেন,
-“তুই আমাকে মা বলে ডেকেছিস? কি শান্তি লাগছে আমার।”
কথাটা বলে একটু দম ফেললেন তিনি। ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও তুর্যর পানে তাকালেন তিনি। শক্ত কন্ঠে বললেন,
-“আজ শুধু ওর মুখে মা ডাকটার জন্য বেঁচে গেলি তুই। নয়তো এক চড়ে তোর দাঁত ফেলে দিতাম আমি।”
তুর্য চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মায়ের পানে। চোখে মুখে বিষন্ন ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল,
-“কিন্তু আমি তো তোমাকে উঠতে, বসতে, ঘুমাতে এমনকি ছোট বেলায় ওয়াশরুমে গিয়েও মা মা বলে ডাকতাম। কই কখনও তো আমাকে এইটুকু বালি পরিমাণ ছাড় দিলে না।”
তাহমিনা বেগম মুখ বাঁকালেন। তুর্যের কথার প্রেক্ষিতে উত্তর দিল না কোনো। উল্টো বাটি থেকে মুরগির একটা রান তুলে দিলেন পৃথার প্লেটে। আড় চোখে তুর্যের পানে তাকিয়ে বললেন,
-“তাড়াতাড়ি খেয়ে নে মা। আশেপাশে তো আর চিল শকুনের অভাব নেই কোনো। দেখা গেল কখন আবার তোর প্লেটের দিকে নজর দিয়ে দিল।”
তুর্য তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের পানে। তার মা যে চিল শকুন বলতে তাকেই বুঝিয়েছে তা সে বেশ বুঝতে পেরেছে। তবে প্রতিউত্তরে বলল না কিছুই। শ্বাশুড়ি বউমা জোট বেঁধেছে বাধুক। সেও তার শ্বশুরকে নিয়ে জোট বাঁধবে। তারপর সবাইকে হেনস্থা করবে। কিন্তু কথা হলো তার ঐ রা’জা’কা’র শ্বশুর তার সাথে জোট বাঁধতে রাজি হবে তো? ভারী চিন্তার বিষয়। তুর্য গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়েই নিজের খাবার প্লেটে হাত দিল। রা’জা’কা’র শ্বশুরকে বাগে আনার পরিকল্পনা করতে করতেই খেতে শুরু করলো।
৩১.
দুপুর গড়িয়ে সময়টা এখন প্রায় বিকালের পথে। সূর্যটাও এখন তার তেজ কমিয়ে দিতে শুরু করেছে অল্প অল্প করে। বাড়ির সব মানুষও দুপুরের বিশ্রাম শেষ করে উঠতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই আরুশ হঠাৎ কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো তুর্যদের বাড়িতে। তবে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি। তাড়াহুড়ো করে ঢুকতে গিয়ে দরজার সাথে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে মেঝেতে। ধপাস করে একটা আওয়াজ হলো সাথে সাথে। বসার কক্ষে খুব বেশি জনমানবের সমাগম না হলেও ইরা, তারেক আর তুর্যের ছোট চাচি সাথী বেগম ছিলেন। হঠাৎ করে কারো পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে ফিরে তাকালো তারা। আরুশকে মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে চোখ বড় বড় হলো তিন জনেরই। বুঝতে বাকি রইলো না এখানে কি হয়েছে। দ্রুত তারা ছুটে গেলো বেচারা আরুশের পানে। ইরা ব্যস্ত হয়ে শুধালো,
-“আরে আরুশ ভাই! আপনি পড়ে কিভাবে গেলেন?”
পরপর সাথী বেগমও মুখ খুললেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন,
-“বেশি ব্যথা পেয়েছো? কোথাও ব্যথা পেয়েছো দেখি দেখি?”
আরুশ অপ্রস্তুত হলো, সাথে লজ্জাও পেল ভীষন। ইসসস কি এক বিদঘুটে ঘটনা ঘটে গেল তার সাথে। পড়লো তো পড়লো এদের তিন জনের সামনে এসেই পড়তে হলো? এত বড় শক্তপোক্ত একজন যোয়ান ছেলে হয়ে কিনা জনসম্মুখে এবাবে আছাড় খেল? মান ইজ্জত আর রইলো না বোধহয়। এতদিন তো শুধু তুর্যের নিকটে তার কোনো মান ইজ্জত ছিল না এখন তুর্যের বাড়ির লোকের সম্মুখেও। না না এভাবে নিজের মান ইজ্জত হারাতে দেওয়া যায় না। তুর্য জোরপূর্বক হাসলো। নিজের মান ইজ্জতটা এবারের ন্যায় বাঁচাতে বলল,
-“আমি পড়িনি তো। একটু ব্যায়াম করছিলাম আর কি?”
কথাটা শেষ করেই তড়িঘড়ি করে মেঝেতে পুশ-আপ দেওয়া শুরু করলো আরুশ। মুখে মুখে আবার গুনলো,
-“এক, দুই, তিন…..”
আরুশের এমন কান্ডে হতবাক হয়ে পড়লো সাথী বেগম, ইরা এবং তারেক তিনজনই। তারা স্পষ্ট শুনলো পড়ে যাওয়ার শব্দ। তবে কি ভুল শুনেছে তারা? তারেক হতবাক কন্ঠেই শুধালো,
-“বাড়িতে এত জায়গা থাকতে আমাদের দরজার সম্মুখেই আপনার পুশ-আপ দিতে ইচ্ছে হলো আরুশ ভাই?”
আরুশ পুশ আপ দেওয়া বন্ধ করলো। ভ্যাবলার মতো হেসে বলল,
-“তোমাদের দরজাটা ভারী সুন্দর। দেখলেই ইচ্ছে করে দুই চারটা পুশ-আপ দেই। তাই পুশ – আপ দিচ্ছিলাম আর কি।”
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো আরুশ। সাথে সাথেই ব্যথায় কাকিয়ে উঠলো সে। কোমড়ে বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছে তবে বুঝতে দিল না উপস্থিত কাউকে। কোনো রকমে কোমড়টা চেপে বলল,
-“তুর্য স্যারের সাথে জরুরী কাজ আছে। উনার কাছে যাই আমি ঠিক আছে।”
কথাটা বলেই তড়িঘড়ি করে পা বাড়ালো বাড়ির ভিতরের দিকে। কোনো মতে এদের সম্মুখ থেকে কেটে পড়লো আর কি।
***
তুর্য আর পৃথা নিজেদের কক্ষেই ছিল। খেয়েদেয়ে একটু শুয়েছিল আবার। আর তাদের মাঝে খানে তো সেই ভারত চীনের বর্ডার হিসেবে কোল বালিশ আছেই। তুর্য এপাশ ওপাশ করলো কয়েকবার অতঃপর মাথা তুলে উঁকি দিল পৃথার পানে। মেয়েটা শুয়ে আছে অন্যদিকে মুখ করে। চুলগুলো খুলে ছড়িয়ে রেখেছে বালিশের উপরে। তুর্য কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে চেয়ে রইলো সে চুলের পানে অতঃপর কিছু একটা ভেবে উঠে বসলো বিছানায়। খুব সাবধানে পৃথার কিছু চুল এনে পেঁচিয়ে নিল নিজের টিশার্টের বোতামের সাথে। সচরাচর টিশার্টে বোতাম দেখা না গেলেও খুব ভাগ্য করে তুর্যের এই টিশার্টের গলার নিকট নকশা হিসেবে দুটো বোতাম ছিল। সে বোতামের সাথেই বুদ্ধি করে ছেলেটা আটকে নিল বউয়ের চুল। পোড়া কপাল বেচারার। ঐ নাটক সিনেমার মতো নিজে থেকে তো আটকাবে না তাই জোর করেই আটকাতে হচ্ছে এখন। তবুও বউয়ের কাছাকাছি যাওয়া তার চাই ই চাই। একটু কাছাকাছি না গেলে, দুজনের মধ্যে দুই চারটা বাক্য বিনিময় না হলে তাদের সম্পর্কটা সহজ কিভাবে হবে? তাই ভাগ্য সহায় না হলেও তুর্য নিজের সহায় নিজে হচ্ছে। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে তুর্য নিজের টিশার্টের বোতামের সাথে পৃথার চুল আটকালো। অতঃপর পৃথার পানে একবার তাকিয়ে বিছানা থেকে উঠে যেতে উদ্যত হলো। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে পৃথার কন্ঠস্বর ভেসে এলো। মেয়েটা কন্ঠে “আহহ” মূলক ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে উঠে বসলো। তুর্যের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। সে তো আগে থেকেই জানতো এমন কিছুই হবে। এমন কিছু হওয়ার জন্যই তো উঠে দাঁড়িয়েছে সে। তবুও অবুঝের মতো ভান ধরে তাকালো পৃথার পানে। অস্থির কন্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে বউ?”
পৃথা নিজের চুল অনুসরন করে তাকালো। অতঃপর বলল
-“আপনার টিশার্টে আমার চুল আটকেছে। ”
তুর্যও তাকালো সে চুলের পানে। দ্রুততার সাথে বিছানায় বসলো সে। পৃথার চুলে হাত দিয়ে বলল,
-“ইসস কিভাবে আটকালো? ব্যথা পেয়েছো নিশ্চই। দাঁড়াও আমি এক্ষুনি খুলে দিচ্ছি।”
কথাটা বলে নিজের উদ্যেগেই টিশার্ট থেকে পৃথার চুল ছাড়াতে ব্যস্ত হলো তুর্য। পৃথাও আর কিছু বলল না। সে চুল খোলা রেখেছিল বলেই তুর্যের টি শার্টের বোতামে আটকেছে এতে তো আর তুর্যের কোনো দোষ নেই। সে আরও চুল ছাড়ানোর জন্য কতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর তুর্য! সে চুল ছাড়ানোর বাহানা দিয়ে একটু একটু করে আগাতে শুরু করেছিল বউয়ের পানে। কিন্তু শেষে গিয়ে বাঁধা প্রাপ্ত হলো ঐ ভারত চীনের বর্ডার নামক কোলবালিশের নিকটে। তুর্যের মেজাজ গরম হলো। এই ভ’য়ং’ক’র বর্ডারটার জন্য সে শুধু যেতে পারছে না বউয়ের নিকট। তুর্য ইচ্ছে করেই পৃথার চুল ধরে বেশ জোরে সোরে টান দিল। পৃথাও সাথে সাথে “আহহ” করে ধ্বনি তুললো। তুর্য আবার অস্থির হওয়ার ভান ধরলো। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,
-“স্যরি স্যরি আবার ব্যথা পেলে।”
থামলো তুর্য। কোলবালিশটার পানে তাকিয়ে বলল,
-“এই কোলবালিশটার জন্য আমাদের দূরত্ব একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। তাই আমি চুল ছাড়াতে গেলেই তুমি চুলে ব্যথা পাচ্ছো। এটাকে সরিয়ে দেই?”
পৃথা তাকালো তুর্যের পানে। আসলেই কোলবালিশটার কারনে তাদের দূরত্ব বেশি হয়ে যাচ্ছে। তাই হয়তো ব্যথা পাচ্ছে। পৃথা সরল মনে বলল,
-“আচ্ছা।”
তুর্যের বুকটা ফুলে উঠলো। অবশেষে সে এই ভারত চীনের বর্ডারটা সরাতে পারবে। তুর্য কটমট করে তাকালো কোলবালিশটার পানে। চড়ম ক্রোধ নিয়ে আগাছার মতো কোলবালিশটা ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। অতঃপর কোলবালিশটার পানে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
-“ব্যাটা বদমাইশ। আমার আর আমার বউয়ের মাঝখানে এসেছিলি? দেখ এখন আমরা আমে দুধে মিলে গেছি আর তুই আটি হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিস।”
চলবে…..