গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৩৬
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
তুর্য চোখে হাসলো। চোখ মেরে বলল,
-“খোঁজ নিয়ে দেখো তুমি ঠিক যতটা লজ্জা পাচ্ছো না ওরা তোমার এই লজ্জার থেকেও অধিক আমাদের নিয়ে ভেবে ফেলেছে।”
পৃথা কটমট করে তাকালো তুর্যের পানে। লোকটার মুখটা কি দিয়ে বানানো হয়েছে কে জানে! সর্বক্ষন উল্টা পাল্টা নির্লজ্জ ধাঁচের কথা বেরুতেই থাকে। তার বাপ মা খুঁজে খুঁজে এই নির্লজ্জ লোকটাকেই পেয়েছিল তার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য? দশ বছর বয়সে যখন বিয়ে দিয়েছে তখন একজন ভালো, সুশীল, ভদ্র ছেলের সাথে বিয়ে দিতো। তা না একটা অসভ্য, বর্বর লোকটাকে গছিয়ে দিয়েছে তার মতো এক কিশোরীর সাথে। পৃথা দাঁতে দাঁত চাপলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“আজেবাজে কথা বন্ধ করে ছাড়ুন আমাকে। মা সেই কখন খেতে ডাকছেন।”
তুর্য ছাড়ালো না পৃথাকে। দুষ্টু হেসে বলল,
-“বিয়ে করেছি সাত বছর অথচ বউকে একটা গাঢ় চু’মু খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আমার। আজ যখন একটা সুযোগ পেয়েছি, উড়ন চন্ডী বউটাও পোষ মেনে কাছে এসেছে তখন এভাবে ছেড়ে দেব? না, কখনও না। জীবন থাকতে না।”
থামলো তুর্য। ওষ্ঠ গোল করে আবার বলল,
-“শুধুমাত্র একটা চু’মু’ই তো। খেতে দাও না বউ। বেশি সময় নেব না মাত্র ত্রিশ মিনিটেই শেষ করবো পাক্কা প্রমিস।”
পৃথা বিষম খেল। চোখ বড় বড় করে তাকালো তুর্যের পানে। ত্রিশ মিনিট ধরে মাত্র একটা চু’মু খাবে তাও বেশি সময় না? সবচেয়ে বড় কথা হলো, ত্রিশ মিনিট ধরে চু’মু খেলে সে বাঁচবে? দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাবে তো। পৃথা হতবাক কন্ঠে বলল,
-“ত্রিশ মিনিট মাত্র? আর ত্রিশ মিনিট ধরে একটা চু’মু! আপনি কি মানুষ?”
তুর্য কপালে ভাঁজ ফেললো। বেশ গুরুত্বপূর্ণ অভিপ্রায় নিয়ে বলল,
-“২০১৩ সালে থাইল্যান্ডের পাটায়া শহরে এক দম্পতি টানা ৫৮ ঘন্টা ৩৫ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড অর্থাৎ প্রায় তিনদিন একে অপরকে চু’মু খেয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম চুম্বনের রেকর্ড করেছিল। সেখানে আমি বিয়ে করেও প্রায় সাত বছর “চু’মু অনাহারে” কাটানোর পর বউকে মাত্র ত্রিশ মিনিট ধরে একটানা চু’মু খেতে চেয়েছি। এই সময়টা কি তোমার নিকট খুব বেশি নাকি?”
পৃথা বিস্মিত হলো। টানা ৫৮ ঘন্টা ৩৫ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড এত লম্বা চু’মু ছিল? কোন দম্পতি এই চু’মু খেয়েছে? তারা মানুষ তো নাকি অন্য কোনো গ্রহের প্রানী মানুষের রূপ ধরে পৃথিবীতে হানা দিয়েছে? পৃথা বিস্মিত সুরেই প্রশ্ন করলো,
-“এরা কি এই প্রায় তিন দিন খাওয়া দাওয়া ছেড়ে চু’মু খেয়েছিল? ওদের পেটে ক্ষুধা লাগেনি? গলায় পানির পিপাসা লাগেনি? ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি? আচ্ছা ওরা বেঁচে আছে তো?”
তুর্য মাথা ঝাঁকালো। বিশ্বাসের সহীত বলল,
-“অবশ্যই বেঁচে আছে। এখন তুমিও আমাকে এক খানা চু’মু দিয়ে বাঁচিয়ে দাও।”
কথাটা বলে থামলো তুর্য। ভাবুক ভঙ্গিতে আবার বলল,
-“ত্রিশ মিনিট একদম কম হয়ে গেছে। দীর্ঘ সাত বছর চু’মু অনাহারে থাকার পর আমার অন্তত এক টানা সাত দিন চু’মু খাওয়া উচিৎ। নয়তো এই চু’মু’র দুনিয়ায় আমার মান ইজ্জত বলে আর কিছু থাকবে না।”
পৃথা হতবাক হলো। চু’মু’র দুনিয়া আবার কোন দুনিয়া! বাপের জন্মে তো এই নাম শোনেনি সে। লোকটা কি পাগল টাগল হলো নাকি ? অবশ্য এ নতুন করে আর কি পাগল হবে। এ তো আগে থেকেই পাগল, বদ্ধ উন্মাদ।পৃথার ভাবনার মধ্যেই তুর্য নিজের প্রথম চু’মু খাওয়ার প্রস্তুতি নিল। ধীর গতিতে নিজের ওষ্ঠ এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলো মেয়েটার ওষ্ঠের নিকট। ভরকে গেল পৃথা। হৃদয়ে কড়া নাড়লো সাত দিনের চু’মু’র প্রসঙ্গটা। প্রথম ত্রিশ মিনিট চু’মু’র ব্যাপরটা শ্রবনেই তো তার মাথা ঘুরে উঠেছিল তার আর এখন সাত দিন? পৃথার মাথা ঘুরে উঠলো। এই চু’মু খেতে গিয়ে নিশ্চিত তাকে উপরে চলে যাওয়ার টিকিট কাটতে হবে। তারপর বাংলাদেশের পেপার পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল গুলো বড় বড় করে তাদের শিরোনামে লিখবে
-“চুমু খেতে গিয়ে মৃ’ত্যু তুর্য এবং পৃথা নামক এক দম্পতির।”
ব্যস মান ইজ্জত সব মাটিতে। জীবন থাকতে তো এই ব্যাটার জ্বালায় মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি লাগতো মিনিটে মিনিটে। এই যেমন একটু আগে ইরার সম্মুখে লেগেছিল। তারপর যদি আবার চু’মু খেতে গিয়ে মৃ’ত্যু হয় তাহলে মান ইজ্জত পেপার, পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলে গড়াগড়ি খাবে। উপরে বসে বসেও এই লোককে বিয়ে করার জন্য কপাল চাপড়াতে হবে পৃথার। নিজের কল্পনায় নিজেই শিউরে উঠলো পৃথা। দ্রুত নিজেকে তুর্যের বাঁধন থেকে মুক্ত করতে ব্যস্ত হলো। কিন্তু পারলো না। তুর্যের মতো অমন এক হাতির মতো মানবের শক্তির সাথে পৃথার মতো পিঁপড়ার কি পেরে ওঠা সম্ভব নাকি? তবে নিজেকে ছাড়াতে তো হবেই নয়তো নির্ঘাত সাত দিনের চু’মু’তে টিভি চ্যানেলের শীর্ষে চলে যাবে। পৃথা আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরালো, হুট করেই নিজের পা দ্বারা আঘাত করলো তুর্যের পায়ে। আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে উঠলো তুর্য। অসাবধানতাবশত হাতের বাঁধনটাও আলগা হলো। ব্যস এই সুযোগ। পৃথা নিজের দুই হাত তুলে ধাক্কা মারলো তুর্যকে। সব দিক মিলিয়ে টালমাটাল হারালো বেচারা, নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পেরে ঠাস করে বসে পড়লো মেঝেতে। তুর্য যেন মেঝেতে নয় আকাশ থেকে পড়লো মাত্রই। বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
-“বউ তুমি আমাকে ফেলে দিলে? এক প্রকার মা’র’লে আমাকে? তাও কি একটা চু’মু খেতে চেয়েছি সেই অপরাধে?”
কথাটা বলেই তুর্য নিজের কপাল চাপড়াতে শুরু করলো। আহাজারি করে বলল,
-“আল্লাহ! কি কলিযুগ এলো রে দুনিয়ায়। বউ একটা চু’মু খেতে চাওয়ার অপরাধে শেষ পর্যন্ত মা’র’লো আমাকে। এই মুখ আমি এখন আমি লোকসমাজে কিভাবে দেখাবো? কিভাবে?”
প্রথম তুর্যকে পড়ে যেতে দেখে খারাপ লেগেছিল পৃথার। সে এত জোরেও ধাক্কা মা’রে’নি যে পড়ে যাবে তবুও পড়েছে। একটু সহানুভূতিও দেখাতে চেয়েছিল মেয়েটা স্বামীর প্রতি কিন্তু এই মুহূর্তে এর কথা শুনে সহানুভূতি তো দূরে থাক আরেকবার জোরেশোরে ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। পৃথা কটমট করে তাকালো তুর্যের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“নাটকবাজ একটা।”
তুর্যের আহাজারি বাড়লো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
-“ছিঃ ছিঃ বউ তুমি আমাকে এত বড় একটা অপবাদ দিতে পারলে? আমি নাটকবাজ!”
পৃথা হতাশ হয়ে তাকালো তুর্যের পানে। এই লোক ঠিক কোন ধাতু দিয়ে বানানো সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। তবে এর সাথে এই মুহূর্তে আর কিছু বলে হয়তো লাভ হবে না কোনো। সে যাই বলুক না কেন তা নিয়ে এই লোক টানা হেঁচড়া করতে করতে ঢাকা থেকে রাজশাহী নিয়ে যাবেই যাবে। পৃথা আর কথা বাড়ালো না। কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
-“ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন তাড়াতাড়ি।”
৩৯.
সময় গড়িয়েছে কিছুটা। ইতমধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ সবার। খাওয়ার পরে সবাই যার যার কক্ষে চলে গেলেও ইরা, তুর্য, পৃথা, তারেক এবং তৌফিক বসে রয়েছে বসার কক্ষেই। অল্পস্বল্প গল্প গুজবে মত্ত হয়েছে তারা। এর মধ্যেই আরুশ কোথা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলো বসার কক্ষের ভিতরে। দুই হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-“স্যার! স্যার আমি এসেছি?”
আরুশের কন্ঠ শ্রবন হতেই উপস্থিত সকলে তাকালো তার পানে। হাঁটুতে হাত দিয়ে এখনও হাপাচ্ছে ছেলেটা। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মুখশ্রীতে তার ক্লান্তি ভাব স্পষ্ট। পরিশ্রমের দরুন নাকের ডগায়, কপালে মুক্ত দানার ন্যায় বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্বের দেখা মিলছে। ছেলেটার পোশিবহুল শক্তপোক্ত দেহে জড়ানো শার্টটাও ঘামে ভিজে লেপ্টে রয়েছে দেহের সাথে। সকলেই আরুশকে এই অবস্থায় দেখে কিঞ্চিৎ চকিত হলো। পৃথা অবাক কন্ঠেই বলল,
-“একি আরুশ ভাই আপনার এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা থেকে দৌড়ে এসেছেন।”
আরুশ ঢোক গিললো। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-“তার থেকে কম কিছু করিনি। পুরো দুই কিলোমিটার রাস্তা দৌড়ে এসেছি।”
আরুশের কথা শেষ হতে না হতেই ইরা এক গ্লাস পানি নিয়ে দাঁড়ালো আরুশের সম্মুখে। তাড়া দিয়ে বলল,
-“পানিটা খেয়ে নিন আরুশ ভাই, তারপর কথা বলবেন।”
ইরার কন্ঠ শুনে চোখ তুলে তাকালো আরুশ। ওষ্ঠে ফুটে উঠলো তার সূক্ষ্ম হাসির রেখা। যাক এত দৌড়ে একটু তো উপকার পাওয়া গেল। আরুশ তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ইরার হাত থেকে পানির গ্লাস নিতে নিতে বলল,
-“ধন্যবাদ।”
ঐ যে পানি খুশি হয়ে পানি নিল ঐ পর্যন্তই। সে পানি আর খাওয়া হলো না বেচারার। তার আগেই তুর্য ঝড়ের গতিতে এসে পানির গ্লাসটা ছিনিয়ে নিল আরুশের হাত থেকে। অতঃপর সেই হতেই আবার এক বোতল মিনারের ওয়াটার ধরিয়ে দিল। ইরার পানে তাকিয়ে বলল,
-“আরুশ আবার মিনারেল ওয়াটার ছাড়া খায় না। ওর গলায় এলার্জি আছে তো তাই।”
আরুশের চেহারা অসহায় ভাব ফুটে উঠলো। তুর্য যে ইচ্ছে করে তার সাথে এমনটা করেছে তা বুঝতে বাকি নেই তার। না পারছে ছেলেটা কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। এই প্রথম সে নিজের প্রেয়সির হাতে একটু কিছু পেয়েছিল। তাও সহ্য হলো না এই লোকটার। আরুশ রাগে দুঃখে মিনারেল ওয়াটারের বোতল খুলে গলায় পানি ঢাললো। মনে মনে তুর্যকে অভিশাপ দিয়ে বলল,
-“অন্যের প্রেমে ব্যাগরা দিস তো। দেখবি তোর বউও তোকে পাত্তা দিবে।”
৪০.
রাত নেমেছে ধরনীতে। দিনের উজ্জ্বল সূর্যটা ডুবে গিয়েছে অনেক আগেই। শহরের বুকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে কৃত্রিম সোডিয়ামের আলোয়। তুর্য আজ আর নিজের কাজে যায়নি। বেশ অনেকটা দিন পর আজ একটু ব্যস্তহীনভাবে সময় কাটাতে চাইছিল বউয়ের সাথে। কিন্তু সে কপাল কি আর তার আছে? সে ঘরে বসে রয়েছে বউয়ের সাথে একটু একাকী সময় কাটানোর জন্য। আর তার বউ বাইরে বাড়ির মানুষের সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত। ঐ যে বসার কক্ষ থেকে হাসাহাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তুর্যের মেজাজ গরম হলো। বাড়ির লোকজন তো তার কথা ভাবেই না আর তার বউটাও না। তুর্য গলা উঁচু করলো। চড়া গলায় ডাক দিল,
-“পৃথা! পৃথা।”
তুর্য ডাকতে না ডাকতেই এক মগ কফি হাতে কক্ষে প্রবেশ করলো পৃথা। তুর্যর পানে কফির মগ এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছেন কেন? বাড়ির মানুষ শুনে কি বলবে?”
তুর্য কফির মগটা হাতে নিল। থমথমে কন্ঠে বলল,
-“আমি যে বাড়িতে আছি সে খেয়াল আছে তোমার? কই এতদিন পর স্বামী বাড়িতে আমার চারপাশে একটু ঘুরঘুর করবে আমাকে জ্বালাবে তা না কোথায় না কোথায় গিয়ে বসে আছো।”
-“বসার রুমে ছিলাম সবার সাথে।”
তুর্য কফির মগে চুমুক দিতে দিতেই বলল,
-“তা আমি জানি।”
পৃথা কিঞ্চিৎ সময় চুপ রইলো। একটু উসখুস করে বলল,
-“আপনার সাথে একটা কথা ছিল।”
-“কি?”
-“আমি রাজশাহী আব্বু আম্মুর কাছে যেতে চাইছিলাম একটু।”
থামলো পৃথা আবার বলল,
-“কিছুদিন পরই তো টেস্ট পরীক্ষা তারপর এইচএসসি। এরপর আর সময় পাবো না যাওয়ার তাই এখনই আপনি যদি একটু দিয়ে আসতেন ভালো হতো।”
তুর্য থমকে গেল দিল। গোল গোল দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। হতবাক কন্ঠে বলল,
-“এখনও অব্দি আমার বউকে চু’মু খাওয়ার হলো না, বউয়ের সাথে বাসর করা হলো না এর মধ্যে বউ বাপের বাড়ি যেতে চাইছে?”
চলবে…..
গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৩৭
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
তুর্য থমকে গেল দিল। গোল গোল দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। হতবাক কন্ঠে বলল,
-“এখনও অব্দি আমার বউকে চু’মু খাওয়ার হলো না, বউয়ের সাথে বাসর করা হলো না এর মধ্যে বউ বাপের বাড়ি যেতে চাইছে?”
পৃথা একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো তুর্যের পানে। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“আপনি কি ভালো হবেন না? সব সময় শুধু বাজে কথা।”
তুর্য হাতের কফির মগটা পাশের টেবিলে রাখলো। ঐ কফির স্বাদ পৃথার বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা শুনেই উড়ে গেছে। তুর্যের মুখশ্রী থমথমে হলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-“সে তুমি যাই বলো না কেন বাসর ছাড়া আমি আমার বউকে ছাড়বো না। তার উপর আবার ও বাড়িতে সব রা’জাকা’র, আল ব’দ’র, আল শাম’সে ভরপুর। পরবর্তীতে যদি ওরা জোর করে আমার বউকে আটকে রাখে।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। তুর্যের কথাগুলো সে গুরুত্বের সাথে নিবে নাকি লাগাম ছাড়াভাবে নিবে ঠিক বোধগম্য হলো না। লোকটা গুরুত্বপূর্ণ কথাতেও যে ধরনের শব্দের ব্যবহার করে তাতে তা গুরুত্বপূর্ণের তালিকায় ফেলা যায় না। পৃথা এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপরে বসলো। কিছুটা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“তাদের জোর করে আমাকে আটকে রাখার প্রয়োজন হবে না। আমি নিজেই আসবো না আর এখানে। একটা অ’স’ভ্য নি’র্ল’জ্জ পুরুষ।”
তুর্য পাত্তা দিল না পৃথার কথায়। ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
-“আগে একটু যাই তোমার বাপের বাড়িতে যেতে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল এখন তাও নেই। বাপ, মা, ভাইদের দেখার ইচ্ছে হলে বলো খবর দিচ্ছি কিন্তু তোমাকে ও বাড়ি পাঠিয়ে আবারও বউ হারা হওয়ার ঝুঁকিটা আমি আপাতত নিতে চাইছি না।”
পৃথা বিষন্নভরা দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। ম্লান কন্ঠে বলল,
-“সেদিন হুট করে অভিমানের বশে আপনার সাথে চলে এসেছিলাম। বন্ধু, বান্ধব, আত্মীয় স্বজন কারো থেকে বিদায় পর্যন্ত আনিনি। কারো সাথে আর আর কথাও হয়নি। তাছাড়া ইদানীং বাবা মা আর ভাইয়াদের জন্য আমার মন কেমন করছে আমার, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কতদিন দেখি না বাবা, মা, আর ভাইয়াদের।”
তুর্যের কন্ঠস্বর নরম হলো। এগিয়ে গিয়ে বসলো পৃথার পাশে। কোমল কন্ঠে বলল,
-“আমার কাজের চাপটা একটু কমুক, ছুটি পাই। তারপর তোমাকে নিয়ে রাজশাহী যাব বউ। ততদিন একটু ধৈর্য্য ধরো।”
পৃথাও আর তেমন কথা বাড়ালো না বিষয়টা নিয়ে। চোটপাট কিংবা জোর জবরদস্তি করলো না। এই কয়দিন তুর্যের ব্যস্ততা সে দেখেছে। রাত নেই দিন নেই ছেলেটা নিজের কাজের পিছনে ছুটেছে সর্বক্ষন। যদিও পৃথা বলতে পারতো যে,
-“আপনার যাওয়ার দরকার নেই, অন্য কেউ দিয়ে আসুক।”
কিন্তু পৃথার হৃদয়ই এ বাক্যে সায় দেয়নি। ইদানীং তার সবচেয়ে বড় অভ্যাস তুর্য নাম পুরুষটা। মানুষটাকে ছাড়া এক মুহুর্তও যেন বহুবছর মনে হয় পৃথার। এই যে আগে তুর্যের যে উদ্ভট কথাগুলোর জন্য বিরক্ত হতো এখন সেই কথাগুলোই ভালো লাগে। সারাদিনের হাজারটা চিন্তা, ক্লান্তি তু্র্যের ঐ উদ্ভট কথাগুলোর সম্মুখে এসে ফিকে পড়ে যায়। প্রাণ খুলে তখন হাসতে ইচ্ছে হয়। পৃথার ছোট্ট হৃদয়টা তুর্য নামক ঐ বলিষ্ঠ পুরুষটাকে আজকাল অনুভব করে। মেয়েটার বয়স কম। বাবা মা ভাইরা কখনও তাকে পুরুষ স্বান্নিধ্যে যেতে দেয়নি ততটা। সব সময় আগলে রেখেছে, হয়তো ছোট বেলার ঐ বিয়েটার কারনেই তারা পৃথাকে নিয়ে ভয়ে ছিল। সে যাই হোক এক কথায় বলা যায় তুর্যই তার জীবনে আসা ভালোবাসাময় প্রথম পুরুষ। যার সাথে মেয়েটা এতটা প্রেয়ময় বাক্যালাপে জড়িত হয়েছে, এতটা কাছাকাছি এসেছে। যার দরুন তুর্যের প্রতি পৃথার অনুভূতি তৈরি হতে সময় নেয়নি বেশি। তাছাড়া বিয়ে নামক এক পবিত্র বন্ধন তো রয়েছেই। যে বন্ধনের জেরে বিয়ে না মেনে, বিয়ের আসর ত্যাগ করে, এত বছর দূরে থেকেও ফিরে আসতে হয়েছে তুর্যকে সেই বন্ধনের টান পৃথার মধ্যেও তো আছে। ইদানীং পৃথার মন তুর্যের ভালো মন্দের জন্য চিন্তা করে। তুর্যের জন্য উতালা হয়, তুর্যকে একটা নজর দেখার জন্য ছটফট করে। মানুষটাকে একটা বার জড়িয়ে ধরার জন্যও ছটফট করে পৃথার হৃদয়। আচ্ছা এই অনুভূতির নাম কি? এই অনুভূতিই কি তবে ভালোবাসা? জানে না পৃথা। তবে সে এইটুকু জানে তুর্য নামক ঐ পুরুষটার মধ্যে সে বাজেভাবে আঁটকে গেছে। তাকে ছেড়ে বের হওয়ার আর উপায় নেই। পৃথার ভাবনার মধ্যেই তুর্য হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো। বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল,
-“আমার ভীষন বুকে ব্যথা হচ্ছে বউ।”
পৃথা চমকালো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তুর্যের পানে। ছেলেটাকে বুকে হাত দিয়ে থাকতে দেখে হৃদয় কাঁপলো। এই মাত্রই তো একদম ঠিক ছিল লোকটা। কত কি বলল, এর মধ্যে হঠাৎ কি হলো? অস্থির হলো পৃথা। বিচলিত কন্ঠে বলল,
-“বেশি ব্যথা হচ্ছে? কোথায় ব্যথা হচ্ছে দেখি? আমাকে দেখান।”
তুর্য বুকে হাত দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,
-“আমার বোধহয় হার্ট অ্যা’টা’ক হয়েছে বউ। হার্টের মধ্যে কেমন করছে।”
থামলো তুর্য। নিঃশ্বাস আটকে থেমে থেমে আবার বলল,
-“উফফফ কি চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে বুকের মধ্যে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি বোধহয় আজকেই শেষ।”
শেষ! মানে কি? পৃথা আরও অস্থির হলো। দুমড়ে মুচড়ে উঠলো তার কলিজাটা। সত্যিই যদি হার্ট অ্যাটাক করে মানুষটা তখন কি হবে। আজকাল তো আর রোগ শোকের কোনো বয়স নেই। যখন ইচ্ছে হানা দেয়। পৃথার ভয় জাগলো। হারানোর ভয়ে দিশেহারা হয়ে উঠলো মেয়েটা। ব্যাকুল হয়ে বলল,
-“আপনার কিচ্ছু হবে না। আমি এখনই আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”
কথাটা বলেই পৃথা তড়িঘড়ি করে নামতে শুরু করলো বিছানা থেকে। তুর্য তৎক্ষণাৎ হাত টেনে ধরলো পৃথার। আগের ন্যায় বুকে হাত দিয়েই বলল,
-“কারো কাছে নিতে হবে না। তুমি শুধু আমার ঠোঁটে একটা গাঢ় চু’মু খাও তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পৃথা ভরকে গেল প্রথমে। তবে পরক্ষনেই পুরো ঘটনা মস্তিষ্কে হানা দিতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠলো মেয়েটার। তার মানে এই লোকটা এতক্ষন নাটক করছিলো তার সাথে? আর সে কতটা ভয় পেয়েছিল। এখনও বুকটা কাঁপছে দুরু দুরু। পৃথার রাগে, দুঃখে এই মুহূর্তে কান্না পেয়ে গেল। লোকটা এতটা বর্বর কেন? ছলছল করে উঠলো মেয়েটার চোখ দুটো। তুর্য চমকালো। পৃথার চোখে পানি কেন? সে কি কোনোভাবে পৃথাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে? বিচলিত হলো তুর্য। দ্রুত নিজের অভিনয় বাদ দিয়ে উঠে বসলো সে। অস্থির কন্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
পৃথা তুর্যের নিকট থেকে দূরে সরে গেল। দুই হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলো নিজের। অভিমানী কন্ঠে বলল,
-“আপনার সাথে আর কোনো কথাই নেই আমার। আপনি আপনার মতো থাকেন আর আমি আমার মতো। আপনাকে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে। একটা মিথ্যাবাদী, শ’য়’তা’ন লোক।”
তুর্য বোধহয় বুঝলো পৃথার কথাগুলোর মানে। সে এগিয়ে গেল মেয়েটার পানে। আদুরে কন্ঠে বলল,
-“তুমি কি সবটা সত্যি ভেবে নিয়েছিলে? আমি তো মজা করছিলাম। স্যরি আমি বুঝতে পারিনি তুমি এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়বে।”
পৃথা মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। অভিমানী কন্ঠে আবার বলল,
-“আপনাকে কিছু বুঝতে হবে না। শুধুমাত্র দূরে থাকুন আমার থেকে। আর কথাও বলবেন না আমার সাথে।”
তুর্য হাসলো। স্ত্রীর অভিমানে তার বিচলিত হওয়ার কথা থাকলেও প্রশান্তি অনুভব করলো। পৃথা তাকে নিয়ে ভেবেছে, তার একটু অভিনয়ে দিশেহারা হয়েছে এর থেকে সুখকর আর কি হতে পারে? পৃথার কথা অনুযায়ী নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ালো না তুর্য। বরং নিজের দুই হাত বাড়িয়ে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো স্ত্রীকে। আদুরে কন্ঠে বলল,
-“তোমার থেকে দূরে সরে থাকা এ জীবনে হয়তো আমার সম্ভব নয় বউ। আর কথা না বলে থাকা তো অসম্ভবের উপরেও অসম্ভব। আমার বউয়ের সাথে আমি কথা না বলে কিভাবে থাকবো?”
অভিমানের মধ্যে প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্য পেলে অভিমান প্রথম পর্যায়ে বাড়ে বই কমে না। পরবর্তীতে হয়তো প্রিয় মানুষের আদর ভালোবাসায় একটু একটু করে কমে যায়। পৃথার অভিমানটাও ঠিক তেমন আকারই ধারন করলো। হাত চালিয়ে তুর্যের থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো নিজেকে। তুর্য ছাড়লো না। হুট করেই সে প্রশ্ন করে বসলো,
-“ভালোবাসো আমায়?”
পৃথা থমকে গেল। হৃদয়ে কম্পন ধরলো তার। ভালোবাসা! সত্যিই কি সে ভালোবাসে তুর্যকে? যদি ভালো নাই বাসতো তবে তার হৃদয়ে তুর্যকে নিয়ে এই অনুভূতিগুলো কিসের? পৃথা চোখ তুলে তাকালো তুর্যের পানে। তুর্য আলতোভাবে চু’মু খেল স্ত্রীর ললাটে। মৃদু কন্ঠে আবার শুধালো,
-“ভালোবাসো আমায়?”
পৃথা ড্যাব ড্যাব করে কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো তুর্যের পানে। অতঃপর ওষ্ঠ ফাঁক করলো কিছু বলার উদ্দেশ্যে কিন্তু বলতে আর পারলো না। তার আগেই বিছানায় ফেলে রাখা তুর্যের মোবাইলটা বেজে উঠলো প্রবল ঝংকার তুলে। তুর্য বিরক্ত হলো। বউয়ের সাথে এত সুন্দর একটা মুহূর্তে আবার কে বিরক্ত করে? অবশ্য সব সময় এমনই হয়। পোড়া কপাল তার। বউয়ের একটু সান্নিধ্যে গেলেই পুরো পৃথিবী বিপক্ষে চলে যায়। তার জীবনের একটু ভালো মুহুর্তও সহ্য হয় না কারো। মনের মধ্যে এক রাশ বিরক্তি নিয়েই নাম্বার না দেখেই কলটা ধরলো সে। পৃথার পানে দৃষ্টি রেখেই বলল,
-“হ্যালো, আসসালামুয়ালাইকুম। কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না তবে মুহুর্তেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠলো তুর্যের। পৃথাকে ধরে রাখা হাতটাও আলগা হলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-“আসছি আমি।”
কথাটা বলেই কল কাটলো তুর্য। পৃথাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বাসায় পড়া টিশার্ট আর ট্রাউজার শরীরে নিয়েই পা বাড়ালো বাইরের দিকে। যেতে যেতে পৃথাকে বলল,
-“আমার আসতে দেরী হতে পারে। ঘুমিয়ে পড়ো তাড়াতাড়ি।”
আগে কখনও পৃথা পিছু না ডাকলেও আজ কেন যেন মেয়েটা পিছু ডাকলো তুর্যের। হুট করেই বলল,
-“শুনুন।”
তুর্য থমকে দাঁড়ালো। পিছু ফিরে বলল,
-“বলবে কিছু?”
এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো পৃথা। ইতস্তত করে বলল,
-“তাড়াতাড়ি ফিরবেন। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো।”
তুর্যের হৃদয়ে শিহরণ জাগলো। প্রশান্তিতে ভরে উঠলো মন প্রাণ। এতদিন প্রতিবার কাজে বের হওয়ার আগে পৃথার মুখ থেকে যে বাক্যটা শোনার জন্য ছটফট করতো সে, আজ ঠিক সেই বাক্যটাই শোনার সৌভাগ্য তার হলো। পৃথার কথার পরিপ্রেক্ষিতে তুর্যের ভীষণভাবে বলতে ইচ্ছে হলো,
-“অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে যেও তুমি।”
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বাক্যটা কন্ঠে ধারন করতে হৃদয় সায় জানালো না। হৃদয় চাইলো পৃথা তার অপেক্ষায় থাকুক। নিজের কাজ শেষে বাড়ি ফিরে বউটাকে তার অপেক্ষায়রত থাকতেই দেখুক। তুর্য আবার পিছন ঘুরে এগিয়ে এলো পৃথার পানে। একটু ঝুঁকে মেয়েটার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
-“আসছি আমি।”
চলবে…..