অবাধ্য পিছুটান পর্ব-৩৮+৩৯

0
426

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৩৮

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

একটু ঝুঁকে মেয়েটার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

-“আসছি আমি।”

কথাটা বলেই পরপর কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল তুর্য। আর পিছু ফিরে তাকালো না।‌ বাড়ি থেকে বের হতে হতে পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করলো। স্ক্রীন ঘেটে কল লাগালো আরুশকে। গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

-“ওদিকের কি অবস্থা আরুশ?”

ওপাশ থেকে আরুশের বিচলিত কন্ঠস্বর শোনা গেল। কোনো প্রকারে ছেলেটা নিজের কন্ঠনালি ভেদ করে বলল,

-“অবস্থা ততটা ভালো নয় স্যার। ইতমধ্যে আমাদের ৫ জন কর্মী বাজেভাবে আহত হয়েছে।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। ছোট করে বলল,

-“আসছি আমি। ততক্ষণে ওদিকটা সামলে রাখ।”

কল কাটলো তুর্য। দ্রুত নিজের গাড়ি বের করে চেপে বসলো তাতে। চোখ মুখ শক্ত রেখে ছুটে চললো গন্তব্যে।

৪০.
কিছুটা সময় অতিবাহিত হলো। রাতের গভীরতা বাড়লো আরও। সেই সাথে দিনের আলোয় ঘেরা উজ্জ্বল প্রাকৃতি যেন কালো আঁধারে ঢাকা পড়লো। সেই আঁধারময় রজনীকে উপেক্ষার কাতারে ফেলে তুর্য তার গাড়িটা দাঁড় করালো গাছপালায় ঘেরা এক জঙ্গলের সম্মুখে। এমনি দিনের আলোয় এই পুরো জঙ্গল নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকলেও রাতের আঁধারে তা জমে ওঠে। পরিনত হয় মা’দ’ক/ ই’য়া’বা/ গা’জা/ হে’রো’ই’ন ব্যবসায়ীদের আখরায়। রাতের আঁধারে কালো জগতের রমরমা ব্যবসা চলে এখানে। আর এই কালো জগতের মূল হোতা ছিলেন শাহীন মির্জা। তাকে তিনশত চার ডিগ্রীতে যখন ডিম থেরাপি দেওয়া হলো তখন নিজ থেকেই এ আস্তানার কথা স্বীকার করেছেন কতৃপক্ষের নিকট। আরুশও তথ্যটা পাওয়ার পর সময় ব্যয় করেনি। নিজ দায়িত্ব পালনে নিজেদের বাহিনীর স্বল্প কিছু জনবল নিয়ে এসেছিল অ’প’রা’ধী’দে’র ধরার নে’শা’য়। কিন্তু বুঝতে পারেনি শাহীন মির্জা ধরা পড়ার পরে এরাও আগের থেকে হিংস্রতা নিয়ে তৈরি হয়ে ছিল। নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। তাই আরুশ তার বাহিনী নিয়ে আক্রমন চালানোর সাথে সাথে জঙ্গলে উপস্থিত দুরাত্মারাও পাল্টা আক্রমণ চালায় তাদের উপরে। রাতের আঁধারকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গলের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। যার দরুন আরও বিপাকে পড়তে হয়েছে আরুশকে। রাতের আঁধারের সুযোগ নিয়ে কে কোথা থেকে আক্রমণ করছে তাও বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক। তাই তো শেষ পর্যন্ত উপায় না পেয়ে কল করেছিল তুর্যকে।

তুর্য নিজের গাড়ি থামানোর সাথে সাথে আরও কয়েকটা গাড়ি এসে থামলো তার গাড়ির পিছনে। সেখান থেকে প্রসাশনিক খাকি পোশাক পরিহিত বেশ কিছু জনমানবের আবির্ভাব ঘটলো। তুর্য সজাগ দৃষ্টিতে তাকালো চারপাশে। আদেশের সুরে বলল,

-“জঙ্গলের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলুন। একটাও যাতে এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পালাতে না পারে।”

থামলো তুর্য। পরপর আবার আদেশের সুরে বলল,

-“বাকিরা আমার সাথে আসুন।”

নিজের কথা শেষ করেই সম্মুখ পানে অর্থাৎ জঙ্গলের ভিতর দিকে পা বাড়ালো তুর্য। সাথে সাথেই আদেশ মোতাবেক তার সাথে আসা বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যরা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো জঙ্গল জুড়ে আর বাকিরা পিছু নিল তুর্যের। ইতমধ্যে আরুশদের সাথে যুদ্ধ চালিয়েই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল স’ন্ত্রা’সী দল। তার উপর আবার তুর্যের নিয়ে আসা অতিরিক্ত বাহিনী। পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনতে সময় লাগেনি বেশি। এতক্ষন আরুশ যাদের নিয়ে বিপাকে ছিল। তুর্য এসেই অল্প সময়ে এক একটাকে ধরে বসিয়ে দিয়েছে। তবে এইটুকুতেই কি বিপদ শেষ তাদের? হয়তো শেষ নয়। তুর্য জঙ্গলের মধ্য বরাবর দাঁড়িয়ে তাদের হাতে ধরা পড়া স’ন্ত্রা’সী’দে’র উদ্দেশ্যেই বলছিল কিছু। তাদের এই কালো ব্যবসা সম্পর্কে টুকটাক তথ্য নেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল উপস্থিতভাবে। আরুশও তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলো চারিদিকটা। হঠাৎ জঙ্গলের এক ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো স’ন্ত্রা’সী’দে’র মধ্যে লুকিয়ে থাকা একজন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই স’ন্ত্রা’সী রোগা পটকা ছেলেটা তার এক হাত দ্বারা পিছন থেকে চেপে ধরলো তুর্যের গলা আর অন্য হাতে ব’ন্দু’ক নিয়ে ধরলো তুর্যের কপালে। হরবরিয়ে বলল,

-“আমাদের লোকগুলোকে এক্ষুনি এই মুহূর্তে ছেড়ে দে। নয়তো গু’লি করে এটার খুলি উ’ড়ি’য়ে দেব।”

আকস্মিক এমন আক্রমণে চমকে উপস্থিত গেল সকলে। কোনো লুকিয়ে থাকা স’ন্ত্রা’সী যে হুট করে এভাবে তাদের স্যারের উপরেই আক্রমন করে বসবে তা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারেনি। বাহিনীর সকলের মধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো মুহুর্তেই। এক প্রকার ভয়ে দিশাহারা হয়ে সকলে বন্দুক তাক করলো ঐ দুরাত্মা স’ন্ত্রা’সী’র পানে। আরুশ ঢোক গিললো। স’ন্ত্রা’সী’র পানে নিজের হাতে থাকা ব’ন্দু’ক’টা ধরে রেখেই বলল,

-“স্যারকে ছেড়ে দে। নয়তো তোর প্রাণ নিয়ে ফেরা হবে না বলে দিলাম।”

ছেলেটা যেন আকাশের চাঁদ পেল। যাক শেষ পর্যন্ত একটা ভালো কাজ তো করেছে। ধরেছে তো ধরেছে, এদের বসকেই ধরেছে। এই বসকে পুঁজি করেই এ যাত্রায় বাঁচা যাবে হয়তো। বসের প্রাণের ভয়েই এরা তাদের ছেড়ে দিবে। ছেলেটা ভিতরে ভিতরে আরও সাহস পেল। শক্ত করে চেপে ধরলো তুর্যের গলা। সকলকে শাসিয়ে বলল,

-“ব’ন্দু’ক নিচে নামা, নয়তো ভালো হবে না কিন্তু। ওদের বসের জীবনের শেষ ঘন্টা এখানেই বাজিয়ে দেব।”

কেউ কিছু বলা বা বন্দুক নিচে নামানোর আগেই চেঁচিয়ে উঠলো তুর্য। কটমট করে বলল,

-“এই! এই বেয়াদব এভাবে গলা জড়িয়ে ধরছিস কেন? তুই কি আমার বউ লাগিস নাকি হতচ্ছাড়া? গলা ছাড় বলছি।”

থামলো তুর্য। নাক মুখ কুঁচকে আবার বলল,

-“তোর মতো রোগা পটকা ব’লদ শিয়ালকে বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে আমি? আমার কি রুচির দুর্ভিক্ষ লেগেছে নাকি? আমার ঘরে সুন্দরী বউ আছে। আর আমার গলা ধরার অধিকারও একমাত্র তার। গলা ছাড় ব’লদ শিয়াল।”

এমন একটা ভীতিকর পরিস্থিতিতেও তুর্যের এহেন লাগাম ছাড়া কথায় ভরকে গেল সবাই। এই পরিস্থিতিতেও এমন কথা কারো কন্ঠে আসতে পারে ধারনা ছিল না কারো। কেউ হাত থেকে ব’ন্দু’ক ফেলবে কি! এমন কঠিন মুহুর্ত এসেও তুর্যের এমন বেফাঁস কথায় আহম্মক বনে দাঁড়িয়ে রইলো সকলে। স’ন্ত্রা’সী নামধারী ছেলেটাও প্রথমে ভরকে গিয়েছিল কিঞ্চিৎ পরিমানে তবে পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিল সে। তার এখন এই একটাই বাঁচার পথ।‌ ভরকে গিয়ে এই পথও যদি হারিয়ে ফেলে তবে সারাজীবন অন্ধকার এক কুঠুরিতে কাটাতে হবে, আর নয়তো ম’র’তে হবে। ছেলেটা ঢোক গিললো। নিজেকে ধাতস্থ করে শক্ত কন্ঠে বলল,

-“একদম চালাকি নয়। আমার সাথে চালাকি করছিস?”

তুর্যের চোখ মুখে নিরীহ আভা ফুটে উঠলো। ঠোঁট উল্টে বলল,

-“আমার শ্বাশুড়িকে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে ঐ রা’জা’কার শ্বশুরটাকে বউ ছাড়া করবো। আমার শ্বশুরের পয়দা করা দুইটা ষাড় আল ব’দ’র, আল শা’ম’স সহ সব সম্পত্তি ও তোর নামে লিখে দেব। তবুও আমার গলা ছাড়। আমার বউ এমনিই ভ’য়ং’ক’র ধাঁচের মহিলা। তুই আমার গলা ধরেছিস জানতে পারলে আমার গলাই টি’পে দিবে।”

থামলো তুর্য। অনুনয়ের সুরে আবার বলল,

-“বন্দুক মাথায় একটা কেন পাঁচটা ধর। তবুও ভাই গলাটা এখন ছাড়।”

এই কঠিন এক মুহুর্তে এসেও এমন প্রহসনমূলক বক্তাব্য! তুর্যের এহেন লাগাম ছাড়া কথা শুনে আরুশের ইচ্ছে হচ্ছে এই জঙ্গলেরই কোনো এক শক্তপোক্ত গাছের সাথে নিজের মাথাটা টাক মেরে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতে। এটা মানুষ নাকি ভিনগ্রহের কোনো প্রানী? নাহ এই লোক ভালো হবে না কোনোদিন। যদি ভালো হতো তবে এমন একটা সময়ে এসেও এই ধরনের কথা বলতে পারতো না। আচ্ছা এর কি নিজের জীবনের মায়াও নেই? পরিবারের চিন্তা নেই? নাহ এখন তাকেই কিছু করতে হবে নয়তো যেকোনো সময়ে বিপদ ঘটে যেতে পারে। যতই হোক তুর্য তার স্যার, এতদিন এই লোকটার সাথে আছে। যতই রাগ, অভিমান, বিরক্তি থাকুক না কেন ভালোবাসাও আছে। আরুশ অধৈর্য্য ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকালো। জঙ্গলের মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতার মধ্যে এক খানা মোটা লাঠি চোখে পড়লো তার। সকলের অগোচরে সে লাঠিটা হাতে তুলে নিল আরুশ। অতঃপর খুব সাবধানে লাঠি হাতে গিয়ে দাঁড়ালো তুর্য এবং ঐ স’ন্ত্রা’সী’র পিছনে। এর মধ্যেই তুর্য আবার চেঁচিয়ে উঠলো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

-“না না তুই আমার মাথায় ব’ন্দু’কও ধরতে পারিস না। বউয়ের সাথে এখনও আমার বাসর সাড়া হয়নি। কুড়ি পঁচিশটার মতো টিয়া পাখির ছানার মতো বাচ্চাও পয়দা করা হয়নি। আমাকে এখনই মে’রে ফেলতে পারিস না তুই। ব’ন্দু’ক নিয়ে দূরে সর হত’চ্ছাড়া।”

স’ন্ত্রা’সী ছেলেটা তুর্যের কথায় ভরকাবে না, ভরকাবে না করেও ভরকে গেল। নিজের মাথায় ব’ন্দু’ক নিয়ে এমন অদ্ভুত সব কথা কেউ বলতে পারে? তুর্যের কথায় আহাম্মক বনে গেল ছেলেটা, হাত আলগা হলো বেচারার। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগালো তুর্য। সময় ব্যয় না করে তাৎক্ষণিক কুস্তিগীরদের ন্যায় বাহু চেপে ধরলো স’ন্ত্রা’সী ছেলেটার। নিজের মাথার উপর থেকে তুলে এনে আছড়ে ফেললো সম্মুখে মাটিতে। এদিকে একই সময়ে আরুশও স’ন্ত্রা’সী ছেলেটার মাথার উপরে আঘাত হানলো হাতের মোটা লাঠিটা দ্বারা। কিন্তু হায়! ছেলেটা সরে যাওয়ার আঘাতটা গিয়ে লাগলো তুর্যের মাথায়। বারিটা বেশ জোরেশোরেই লেগেছে। মুহুর্তেই ঝিমঝিম করে উঠলো বেচারার মাথাটা। চোখের সম্মুখে ঝাপসা হয়ে যেতে শুরু করলো ধীরে ধীরে। সম্মুখে ফেলা স’ন্ত্রা’সী’টা’কে তার বাহিনীর লোকদের পাকরাও করতে দেখে মাথাটা চেপে ধরলো তুর্য। ঢুলু ঢুলু পায়ে তাকালো পিছন ফিরে। আবছা দৃষ্টিতে দেখলো লাঠি হাতে বেয়াক্কেলের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে আরুশ। নিমেষেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তুর্যের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“একবার বেঁচে ফিরি, তারপর তোকে আমি দেখে নেব মীর জাফরের বংশধর।”

কথাটা বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তুর্য। আরুশ আঁতকে উঠলো। আহাম্মকের ন্যায় একবার তাকালো হাতের মোটা লাঠি টার পানে আরেকবার তাকালো মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকা তুর্যের পানে। এটা সে কি করে ফেললো? ভালো করতে গিয়ে হলো খারাপ। রাগে দুঃখে এই মুহূর্তে কান্না পাচ্ছে বেচারার। তার সাথেই কেন সব সময় এমন হয়। লজ্জায় সকলের সম্মুখে এখন কাঁদতেও পারছে না। এখানে এত বড় প্রসাশনিক বাহিনী, স’ন্ত্রা’সী’দে’র সম্মুখে কান্না করা তার মতো এক অফিসারকে মানায় না। আরুশ হাতের লাঠি ফেলে দিল। দ্রুত দৌড়ে গেল তুর্যের নিকটে। সকলকে আদেশ দিল সন্ত্রাসীদের গাড়িতে তুলতে আর তার সাথে তুর্যকে ধরে গাড়িতে তুলে দিতে। লোকটাকে হাসপাতালে নিতে হবে এখনই। যদিও সুস্থ হয়েই আরুশের জীবন নিয়ে টানাটানি লাগাবে তার জন্য তো আর এভাবে ফেলে রাখা যাবে না একে। তাছাড়া দোষটাও আরুশের। তার একটু খেয়াল করে, সাবধানতা অবলম্বন করে আঘাত করা উচিৎ ছিল। এমন এক বেয়াক্কেল মূলক কাজ অন্তত তার দ্বারা মানায় না।

চলবে…..

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৩৯

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

আরুশ সময় ব্যয় করেনি। তুর্যকে নিয়ে অতিদ্রুত শহরের এক নাম করা হাসপাতালে ছুটে এসেছে, ভর্তি করেছে তাকে। আসার পথে গাড়িতেই তুর্যের পরিবারকে কল করে জানিয়েছে তুর্য সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ব্যস সেই রাতেই পরিবারের সকলে মিলে হানা দিয়েছে হাসপাতালে। তাহমিনা বেগম ইতমধ্যে কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। যত যাই হোক তার ছেলে তো তুর্য, নারী ছেড়া ধন তার। আর তাছাড়া তুর্যের সাথে যে ঝগড়া বিবাদটা সর্বদা লেগে থাকে ওটা তো সত্যি সত্যি ঝগড়া নয়, ওটা তাদের মা ছেলেরই ভালোবাসার একটা অংশ। সকলের ভালোবাসা প্রকাশের ধরন তো আর এক হয় না। তেমনি তাদেরও মা ছেলের ভালোবাসা প্রকাশের ধরনটা একটু ভিন্ন।

পৃথাও এক কোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে লাগাতার। তুর্য দূর্ঘটনার কবলে পড়েছে এই সংবাদ শ্রবণেই তো মেয়েটার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়েছিল। বুকের ভিতরে থাকা কলিজাটা যেন দুমড়ে মুচড়ে উঠেছিল। এতদিন যে পুরুষের উপরে বিরক্ত ছিল আজ সেই পুরুষকে হারানোর ভয়ে দিশেহারা হয়ে উঠেছে মেয়েটা। ঐ যে কথায় আছে না “মানুষ কাছে থাকলে মর্ম বোঝে না, দূরে গেলে ঠিক মর্ম বুঝে নেয়।” পৃথা এতদিন যে তুর্যের মর্ম একটুও বোঝেনি তেমন নয় সে এতদিনও বুঝেছে। তবে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে সন্দিহান ছিল। তুর্যের জন্য তার ভিতরে জাগ্রত হওয়া অনুভূতিকে ঠিক কি নাম দিবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তবে আজ তুর্যের এই দূর্ঘটনার পরে পৃথার সকল সংশয়, সকল সন্দেহ দূর হয়েছে। মেয়েটা বেশ বুঝতে পেরেছে সে ভালোবাসে তুর্যকে, ভীষণ ভালোবাসে। তুর্যকে হারিয়ে সে বাঁচতে পারবে না, কিছুতেই না। এই যে এখন তুর্যের এই সামান্য এক দুর্ঘটনাতেও হৃদয়ে ব্যথা উঠেছে পৃথার, নাজুক হয়ে উঠেছে মেয়েটা। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। ছুটে গিয়ে একবারের জন্য হলেও জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে ঐ তুর্য নামক পুরুষকে। কিন্তু আজ সে অসহায়, ভীষণ অসহায়। এতদিন তুর্য তাকে বারংবার কাছে টানতে চেয়েছে অথচ সে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর আজ সে নিজে তুর্যের কাছে যেতে চাইছে কিন্তু পারছে না। পৃথার হৃদয় ব্যাকুল হলো, একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো তুর্যের কেবিনের সম্মুখে। কেবিনের স্বচ্ছ কাঁচ গলিয়ে তাকালো ভিতরে। সাথে সাথেই মেয়েটার হৃদয়টা ছটফটিয়ে উঠলো। আঁখিদ্বয় ভরে উঠলো অশ্রুকনায়। সারাক্ষণ ছটফট করে সকলকে জ্বালিয়ে মা’রা ছেলেটা কেমন নিথর হয়ে শুয়ে আছে হাসপাতালের শুভ্র রঙা বিছানায়। যদিও ডাক্তার বলেছে তেমন গুরুতর চোট লাগেনি, কালকের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে কিন্তু মন যে মানছে না। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসলে, ভালোবাসার মানুষটার একটু ব্যথাও যে সহ্য করা কষ্টকর। পৃথা হাত উঠিয়ে আলতোভাবে আলতোভাবে রাখলো কেবিনের স্বচ্ছ কাঁচের উপরে। ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,

-“ভালোবাসি প্রিয়।”

****

আরুশ হাসপাতাল করিডোরের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপভাবে। ভিতরে ভিতরে তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ সে। এমন একটা কাজ কিভাবে করলো সে? এত বড় একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তা হয়ে এই টুকু সাবধানতা তার অবশ্যই অবলম্বন করা উচিৎ ছিল। সে ঠিক কাকে মা’র’ছে পর্যবেক্ষণ করে নেওয়া উচিৎ ছিল। আজ তার হাতে লাঠির বদলে ব’ন্দু’ক’ও তো থাকতে পারতো। যদি সে নিজের ব’ন্দু’ক’টা চালাতো স’ন্ত্রা’সী’র উদ্দেশ্যে এবং সেই ব’ন্দু’কে’র গু’লি লাগতো তুর্যের শরীরে তখন কি হতো? যেখানে তাদের ডিপার্টমেন্ট তাদের বিন্দু বিন্দু বিষয়গুলোর উপরেও লক্ষ্য রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়, সর্বক্ষন চোখ কান খোলা রেখে চলতে শিখায় সেখানে সে কিভাবে এত বড় একটা ভুল করে ফেললো? সে ভুলের অনুশোচনা তো আছেই সাথে আরও যোগ হয়েছে তুর্যের ভয়। এ ব্যাটা একবার সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে অসুস্থ বানিয়ে ছাড়বে। তেজপাতা করে ছাড়বে আরুশের শান্তশিষ্ট জীবনটা। জ্ঞান হারানোর আগে তুর্যের বলা শেষ কথাটা বার বার স্মরণে আসছে আরুশের।

-“একবার বেঁচে ফিরি, তারপর তোকে আমি দেখে নেব মীর জাফরের বংশধর।”

এই একটা বাক্য স্মরণে আসলেই তো আরুশের বুকটা ধরফরিয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে তুর্যের উদম কেলানি খাওয়ার ভয়ে জর্জরিত হয়ে পড়ছে বেচারা। আরুশের আকাশ পাতাল ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ ইরা এগিয়ে এলো তার পানে। কিছুটা অবাক কন্ঠেই বলল,

-“একি আরুশ ভাই! আপনার হাত কেটেছে কিভাবে?”

ইরার কন্ঠে আরুশ নিজের চিন্তা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। হাতের পানে তাকিয়েই চমকে উঠলো সে। সত্যিই তার হাত কেটেছে। কনুই থেকে বেশ অনেকটা ছুলে গেছে। রক্তও শুকিয়ে আছে হাত জুড়ে। হয়তো ঐ জঙ্গলে স’ন্ত্রা’সী’দে’র আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের সময় হয়েছিল কিন্তু নিজেদের যুদ্ধ চালাতে চালাতে এ দিকটা খেয়ালই করেনি। আর তারপর তো আবার তুর্যকে নিয়ে ছোটাছুটি। হাতের পানে তাকানোর দিকে খেয়াল আছে নাকি। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো আরুশ। কন্ঠটা স্বাভাবিক রেখেই বলল,

-“ঐ এক্সিডেন্টের সময় সম্ভবত কেটেছে। তুর্য স্যারের সাথে ছিলাম তো।”

ইরা অস্থির হলো। বিচলিত কন্ঠে বলল,

-“ইসস কতখানি কে’টে’ছে। আর আপনি কিনা সেই কা’টা হাত নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন? চলুন ডাক্তারের কাছে চলুন।”

আরুশ সাথে সাথেই অসম্মতি জানালো ইরার এ প্রস্তাবে। জোরপূর্বক হেসে বলল,

-“একটু খানিই তো কেটেছে। এ এমনিই সেড়ে যাবে, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না।”

ইরা সাথে সাথেই প্রতিবাদ করলো আরুশের কথার। বিরোধীতা করে বলল,

-“এটা আপনার কাছে একটু কাঁটা? কতখানি কেটে গেছে। আবার বলছেন ডাক্তারের কাছে যাবেন না? চলুন বলছি।”

আরুশ তবুও বাঁধা দিচ্ছিল ইরাকে। শেষমেষ মেয়েটা উপায় না পেয়ে নিজের এক হাত বাড়িয়ে ধরলো আরুশের ভালো হাতটা। শাসিয়ে বলল,

-“আর একটা কথাও বলবেন না। আপনার হাত অল্প কেটেছে নাকি বেশি তা আমি বুঝে নেব। আপনি আসুন আমার সাথে।”

ইরার আকস্মিক এমন স্পর্শে কেঁপে উঠলো আরুশ। এটাই তার প্রেয়সির থেকে প্রথম স্পর্শ। কেমন শিহরন জাগলো হৃদয়ে। তার থেকেও ভালো লাগলো ইরার এই জোর করা, অধিকার দেখানো। আরুশের হৃদয়টা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। ইরার উপরে আর একটা কথাও বলল না সে। শুধুমাত্র মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে চললো ইরার পিছু পিছু। মেয়েটা তাকে টেনে নিয়ে ঢুকলো এক‌ কেবিনে। এত রাতে এই অল্প স্বল্প চিকিৎসার জন্য ডাক্তার খুঁজে না পাওয়া গেলে একজন নার্সের শরনাপন্ন হলো তারা। নার্স মহিলাটি তার চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে বসলো আরুশের পাশে। নিজের মতো করে ঔষধ লাগাতে শুরু তার হাতে। তবে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই আরুশের। সে এখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ইরার পানে। আরুশকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকালো মেয়েটা। এক ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো,

-“সমস্যা কি? আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

অপ্রস্তুত হলো আরুশ। সাথে সাথে দৃষ্টিতে নত করলো সে। আমতা আমতা করে বলল,

-“এমনিই।”

৪১.
ভোরের আলো ফুটেছে। রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে পুরো শহর। তুর্যের জ্ঞান ফিরেছে মাত্রই। ঘুমের ইনজেকশনের গুনে বেশ অনেকক্ষণ বেহুঁশের মতো পড়ে ছিল সে। জ্ঞান ফিরতেই পিট পিট করে চোখ খুললো তুর্য। চোখের সম্মুখে দৃশ্যমান হলো হাসপাতালের শুভ্র রঙা ছাদটা। ছেলেটা তৎক্ষণাৎ আবার চোখ বন্ধ করে নিল। একটু নড়েচড়ে উঠতেই অনুভব করলো ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে ভীষণ আবার হাতেও উপরেও ভারী ভারী ঠেকছে। তুর্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পাশে। আবার চোখ মেলতেই চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো প্রেয়সির ঘুমন্ত মুখশ্রী। পৃথা তার হাতের উপরে মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তভাবে ঘুমিয়ে আছে। তুর্যের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। কি স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে। ঘাড়ে এবং হাতে ব্যথা অনুভব করলেও হাতটা আর সরালো না সে। নিজ স্ত্রীকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেওয়ার জন্য হাতটা আরও ছড়িয়ে দিল। আর অন্য হাত দ্বারা বিলি কেটে দিতে শুরু করলো স্ত্রীর চুলের ভাঁজে। এর মধ্যেই একজন নার্স সকালের চেকআপের উদ্দেশ্যে ঢুকলেন কেবিনের দরজা থেকে। তুর্যকে চেয়ে থাকতে দেখেই সে হাসি মুখে বললেন,

-“উঠে গেছেন….”

এই টুকু বলতেই তাকে হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল তুর্য। ফিসফিসিয়ে বলল,

-“আস্তে কথা বলুন আমার স্ত্রী ঘুমাচ্ছে।”

নার্স মহিলাটি হাসলেন। তিনিও তুর্যের মতোই ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-“স্ত্রীকে ভালোবাসেন ভীষণ?”

তুর্য লাজুক হাসলো। উপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

-“হুম।”

নার্স মহিলাটি আর কথা বাড়ালেন না। নিজের মতো করে তুর্যের চেকআপ করে চলে গেলেন কেবিন থেকে। তবে কেবিনে চুপ থাকলেও কেবিনের বাইরে গিয়ে আর চুপ রইলেন না। তুর্যের বাড়ির সকলকে জানিয়ে দিলেন তুর্যের জ্ঞান ফেরার কথা। ব্যস আর কে শোনে কার কথা। আরুশ ব্যতীত সকলে হুরমুরিয়ে ঢুকতে শুরু করলো তুর্যের কেবিনে। সকলের টুক টাক শব্দ কর্ণে পৌঁছাতেই ঘুম ভেঙে গেল পৃথার। সাথে সাথেই মেয়েটা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়লো। রাতে খুব বড় মুখ করে সবাইকে বলেছিল সে তুর্যের কাছে থাকবে, স্বামীর সেবা করবে। অথচ সেই কিনা ঘুমিয়ে পড়লো। পৃথা এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। ওয়াশ রুমের দোহাই দিয়ে দ্রুত কেটে পড়লো সকলের সম্মুখ থেকে। পৃথা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই তুর্য কটমট করে তাকালো সকলের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বিরবিরিয়ে বলল,

-“সব শ’ত্রু! সব শ’ত্রু’র দল আমার। বউটার সাথে একটু ভালো মুহুর্ত কাটাচ্ছিলাম তাও সহ্য হলো না কারো।”

_________

চলবে।