অবাধ্য পিছুটান পর্ব-৪০+৪১

0
178

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৪০

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

৪১.
সময়ের কাঁটা ঘূর্ণায়মান। সে ঘুরতে ঘুরতে সকালের সময় পেড়িয়ে বিকালের দিকে গড়িয়েছে। তুর্যের মাথার চোট ততটা গাঢ় না হওয়ায় তাকে হাসপাতাল থেকে সসম্মানে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে ইতমধ্যে। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটা দিন পর্যবেক্ষণে থাকতে বলেছিল কিন্তু তুর্য রাজী হয়নি। এই হাসপাতাল, এখানকার ঔষধ ঔষধ গন্ধ এসব বারবারই অপছন্দের তালিকায় তার। তাই একটু তড়িঘড়ি করেই হাসপাতাল ছেড়েছে ছেলেটা। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই যে এতটা সময় তুর্যের জ্ঞান ফিরেছে অথচ সে আরুশের খোঁজ করেনি একবারও। তবে কি মাথায় চোট পেয়ে চোট পাওয়ার কারনটাই ভুলে গেছে নাকি মনে মনে বড়সড় কোনো পরিকল্পনা আটছে, ভেবে পাচ্ছে না আরুশ। ভয়ে আর বেচারা তুর্যের সম্মুখে একটা বারের জন্যও যায়নি। লুকিয়ে চুরিয়ে ছ্যা’কা খাওয়া প্রেমিকের মতো দূর থেকে দেখেছে তার স্যারকে। যদিও দুই একবার সাহস করেছিল, ভেবেছিল একটাবার তুর্যের সাথে দেখা করে মাফ চেয়ে নিবে তবে পরক্ষণেই আবার ভয়ে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে। বলা তো আর যায় না, পরে দেখা যাবে সে মাফ চাইতে তুর্যের কাছে গেল আর তুর্য প্র’তি’শো’ধ নিতে তার মাথা ফা’টি’য়ে এই হাসপাতালেরই কোনো এক বিছানায় শুইয়ে দিল। তখন কি হবে? তার থেকে কয়েকটা দিন যাক। তুর্য আর একটু সুস্থ হোক এবং এই ঘটনাটাও কিছুটা ভুলুক তারপর না হয় তার সম্মুখে যাওয়া যাবে।

৪২.
রাতের আঁধার ঘনিয়েছে। দিনের উজ্জ্বল সূর্যটা বিদায় নিয়ে প্রাকৃতিকে বিলিয়ে দিয়েছে আঁধারের মাঝে। ব্যস্ত শহরটা সেজে উঠেছে কৃত্রিম সোডিয়ামের আলোয়। তুর্য আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছে নিজ কক্ষের বিছানায়। একটু পরপর আবার অধৈর্য্য ভঙ্গিতে দরজার পানে উঁকি ঝুঁকি মে’রে দেখছে পৃথা আসছে কিনা। সেই যে মেয়েটা কক্ষ থেকে বেরুলো আর এলো না। হাসপাতালে তো নিজ পরিবারের জনগোষ্ঠীর কৃপায় বউয়ের মুখটা পর্যন্ত ভালোভাবে দেখার সুযোগ পায়নি তুর্য। তারপর এলো বাড়িতে, ভেবেছিল এখানে এসে অন্তত বউয়ের সাথে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবে। গতকাল রাতে অর্থাৎ মাথা ফা’টা’র আগে পৃথার সাথে তার কথা বলার যতটুকু সৌভাগ্য হয়েছিল তাতে তুর্য এই টুকু অন্তত বুঝেছিল পৃথার হৃদয়ে তার জন্য অনুভূতির সঞ্চার ঘটেছে। তবে তখন তাড়াহুড়োতে থাকায় এ বিষয়ে পৃথার সাথে আর কথা বাড়াতে পারেনি বেচারা‌। হন্তদন্ত হয়ে ছুটেছে জঙ্গলে। আর তারপর হাসপাতাল। তুর্যের জ্ঞান ফেরার পরে যখনই এই বিষয়টা আবার তার মাথায় হানা দিয়েছে তখন থেকেই সে উতলা হয়ে উঠেছে পৃথার সাথে একটা বার একান্তে কথা বলার জন্য। সে যা ভেবেছে সেটাই সঠিক কিনা নিশ্চিত হতে দিশেহারা হয়ে উঠেছে তুর্যের হৃদয়। অথচ তার পরিবারও তাকে একটু শান্তিতে বউয়ের কাছে থাকতে দিচ্ছে না। আর বউ তো বউই, পাষান মহিলা একটা। যতটা পারছে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তুর্যের ভাবনা চিন্তার মাঝেই পৃথা হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ঢুকলো কক্ষে। এগিয়ে গিয়ে প্লেটটা বিছানার উপরে তুর্যের সম্মুখে রেখে বলল,

-“খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি। এরপর ঔষধ আছে আপনার।”

তুর্য একবার তাকালো খাবার প্লেটের দিকে পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি ঘুরালো পৃথার পানে। বেশ‌ স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,

-“খাইয়ে দাও।”

পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

-“কেন আপনার হাতে কি হয়েছে? নিজের হাতে খেয়ে নিন।”

তুর্য ঠোঁট উল্টে দিল। বাচ্চাদের মতো করে বলল,

-“আমি অসুস্থ বউ।”

পৃথার কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় আরও কুঁচকে এলো। আঁখিদ্বয় ছোট ছোট করে সে বলল,

-“মাথায় ফেটেছে। হাত দুইটা তো ঠিকঠাক একদম সোজা লাঠির মতো আছে। তাহলে নিজের হাত দিয়ে খেতে সমস্যা কি?”

তুর্য চোখে মুখে বিষন্ন ভাব ফুটিয়ে তুললো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

-“এই অবস্থাতেও তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করছো বউ? আমার মতো এক অবলা স্বামীর জন্য তোমার কি একটুও মায়া লাগছে না? এতটা পাষান তুমি কিভাবে হচ্ছো বউ? ঐ সিনেমার নায়িকাদের মতো আমার অসুস্থতায় তোমার বুকটা কি একটুও কেঁপে কেঁপে উঠছে না?”

তুর্যের এমন অভিনয় মিশ্রিত বাক্য শ্রবণে বিরক্ত হলো পৃথা। আবার মায়াও লাগলো ভীষণ। যতই হোক তুর্য অসুস্থ। মাথা ফাটলেও সেটা তো অসুস্থতাই, কতটা র’ক্ত গতকাল তার মাথা থেকে গড়িয়েছে পৃথা স্বচক্ষে তা অবলোকন করেছে। ঐ র’ক্তে’র কথা স্মরণে আসতে এবার সত্যিই মেয়েটার বুক কেঁপে উঠলো। প্রিয় পুরুষের জন্য হৃদয় হাহাকার করে উঠলো হৃদয়। আর পৃথা না করতে পারলো না তুর্যের মুখের উপরে। যদিও এভাবে হুট করে একজন পুরুষকে খাইয়ে দিতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছে মেয়েটার তবুও হাত বাড়িয়ে সে খাবার প্লেটটা হাতে তুলে নিল। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,

-“আসুন খাইয়ে দিচ্ছি।”

তুর্যের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। পৃথার পানে একটু এগিয়ে বসলো সে। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

-“দাও তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাও বউ।”

পৃথা কোনো দ্বিরুক্তি করলো না, ছোট ছোট লোকমা করে চুপচাপ খাইয়ে দিতে শুরু করলো তুর্যকে। তুর্যও ভদ্র বাচ্চাদের মতো খেয়ে নিতে লাগলো বউয়ের হাতে। আবার মাঝে মাঝে পৃথাকে খাওয়ারও আদেশ দিল। পৃথা হাসলো। হৃদয়ের কোনে এক মুঠো প্রশান্তির স্থান দিয়ে সেও খেয়ে নিতে শুরু করলো তুর্যের সাথে সাথে।

****

সময় গড়ালো কিছুটা। যদিও এখনও তেমন রাত নয়। ঘড়ির কাঁটায় টিক টিক করে জানান দিচ্ছে কেবল রাত্রি নয়টা। চারদিকটা এখনও দিনের আলোর ন্যায়ই কোলাহল পরিপূর্ণ। পৃথা তুর্যকে খাইয়ে দাইয়ে ঔষধ খেতে বলে তখন প্লেট নিয়ে চলে গিয়েছিল নিচে। সবটা গুছিয়ে, সকলের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে কেবলই ফিরেছে আবার কক্ষে। দরজা গলিয়ে কক্ষের ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেল তুর্য চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। পৃথা টা টু কোনো শব্দ করলো না। নিঃশব্দে এগিয়ে গেল তুর্যের পানে, বসলো তার পাশে। কি সুশ্রীই না লাগছে এই পুরুষের ঘুমন্ত মুখশ্রীটা, যেন কোনো নিষ্পাপ বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। অথচ জেগে থাকলে ব্রি’টিশ’গী’রিতে সকলকে হার মানিয়ে ফেলে‌। মুখ থেকে সারাক্ষণ বু’লে’টে’র ন্যায় লাজ লজ্জাহীন বাক্য ছুঁড়তেই থাকে। পৃথা হাসলো স্বামীর ঘুমন্ত মুখশ্রী দর্শনে। কেন যেন ভীষণ ইচ্ছে হলো হাত বাড়িয়ে প্রিয় পুরুষটার গাল দুটো একটু ছুঁয়ে দিতে। সর্বদা লজ্জায় নিজের ইচ্ছাকে দমন করলেও আজ আর তেমনটা করলো না। নিজের উষ্ণ হাত দ্বারা স্পর্শ করলো তুর্যের এক গাল। সাথে সাথেই যেন ঝংকার তুললো মেয়েটার হৃদয়ে, বিদ্যুৎ খেলে গেল সর্বাঙ্গ জুড়ে। তবুও পৃথা নিজের হাত সরিয়ে নিল না। আলতোভাবে স্পর্শ করতে শুরু করলো স্বামীর পুরো মুখটা জুড়ে। হঠাৎ করেই তার স্মরণে এলো সেদিনের কথা, একটা চু’মু’র জন্য সেদিন কতই না পাগলামী করেছিল তুর্য। পৃথার হৃদয়ে অদ্ভুত অনুভূতি জাগ্রত হলো। ইচ্ছে হলো এবার তুর্যকে একটা চু’মু দিয়েই দিতে। মস্তিষ্ক তার এই ইচ্ছের বিরোধীতা করলেও হৃদয় সায় জানালো। পৃথার হৃদয় স্পষ্টভাবে বলল,

-“তুর্য তার স্বামী। একজন স্বামীকে তার স্ত্রী চু’মু দিতেই পারে তাতে দোষের তো কিছু নেই। তাছাড়া ছেলেটা এখন ঘুমিয়ে আছে। চু’মু দিলেও টের পাবে না।”

পৃথা আর তেমন ভাবলো না। নিজের ইচ্ছেকে পরিনতি দিতে একটু ঝুঁকে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো তুর্যের কপালে। ঠিক তখনই ধপ করে চোখ মেলে তাকালো তুর্য। হকচকিয়ে উঠলো পৃথা। তড়িৎ গতিতে ছিটকে দূরে সরে গেল। মুহুর্তেই লজ্জায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো তার চোখ মুখ জুড়ে। ইসস এই পুরুষের ঠিক এখনই চোখ মেলে তাকাতে হলো? আর একটু পর চোখ খুললে কি হতো? লজ্জা , সংকোচ, ভয়ে হাঁসফাঁস করে উঠলো পৃথা। ইচ্ছে হলো এখনই ছুটে পালাতে। আর সে করলোও তাই। তুর্য কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।

এর এদিকে বেচারা তুর্য! চড়ম বিস্ময় আর বিরক্তিতে বেহুঁশের মতো পড়ে রয়েছে বিছানাতেই। এতক্ষনও সে জেগেই ছিল। শুধুমাত্র বউয়ের মতিগতি বোঝার জন্য একটু ঘুমের ভান ধরে পড়েছিল। তারপর বউ যা শুরু করলো। রীতিমত তার ধৈর্য্য, সহ্য ক্ষমতার বাঁধ ভেঙে দিচ্ছিলো। তারপরো বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে চোখ বন্ধ করে পড়েছিল শুধুমাত্র বউয়ের একটু ভালোবাসা পেতে। কিন্তু তাও শেষ পর্যন্ত আর পারলো না। পৃথার নরম ওষ্ঠের স্পর্শ পেতেই আপনা আপনি খুলে গেল চোখ দুটো। কেন খুললো? এই মুহূর্তে নিজের চোখের উপরে নিজেই বেজায় বিরক্ত তুর্য। ইচ্ছে তো করছে থাপ্পড় মেরে নিজের চোখ দুটো নিজে খুলে নিতে। কি হতো আর কিছুক্ষন পর চোখ দুটো খুললে? তাহলে হয়তও বউয়ের ওষ্ঠের আরও দুই চারটা চু’মু কপালে জুটতো। তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল,

-“আগে ভাবতাম পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষগুলোই আমার শত্রু। কিন্তু না এখন দেখছি নিজের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো আরও বড় শত্রু। বে’ই’মা’ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আমার খাস, আমার পড়িস আবার আমার সাথেই নেম’কহা’রামি করিস।”

****

রাত ১২ টার অধিক। বাড়ির মানুষ ইতমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায় সবাই। চারদিকটাও ধীরে ধীরে নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যায় শহরের বুকে প্রজ্জ্বলিত হওয়া আলো গুলোও এখন নিভে গেছে অনেকটা। তুর্য অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারী করছে নিজ কক্ষে। পৃথা এখনও ঘরে ফেরেনি। সেই যে লজ্জায় কক্ষ থেকে দৌড়ে পালালো আর তার দেখা নেই। তুর্য আরও কিছুটা সময় নিয়ে অপেক্ষা করলো পৃথার। শেষে অধৈর্য্য হয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়লো কক্ষ থেকে। আশেপাশে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে পা বাড়ালো ইরার কক্ষের পানে। বাড়িতে বসবাসকারী পুরুষদের কক্ষে তো আর যাবে না মেয়েটা। আর অন্যান্য যারা আছে ইরা ব্যতীত বাকি সবাই জোড়ায় জোড়ায় কপোত কপোতী। তাদের কক্ষেও যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে পৃথা ইরার কক্ষেই আছে। তুর্য গিয়ে দাঁড়ালো ইরার কক্ষের সম্মুখে। হাত উঠিয়ে আলতোভাবে টোকা দিল কক্ষের দ্বারে। প্রথম বারে দরজা না খুললেও দ্বিতীয়বারে দরজা খুললো ইরা। সম্মুখে না তাকিয়েই বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,

-“এত রাতে কি সমস্যা?”

তুর্য তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো ইরার পানে। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“তোর ভাবী তোর কাছে?”

তুর্যের কন্ঠস্বর শ্রবণেই কেঁপে উঠলো ইরা। একটু আগে চোখ জুড়ে থাকা ঘুম ঘুম ভাবটা উবে গেল নিমেষেই। চোখ বড় বড় করে সে তাকালো তুর্যের পানে। আমতা আমতা করে বলল,

-“জজজ্বী ভাইয়া। তখন এসেছিল, পরে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক ডাকা ডাকির পরও ওঠেনি।”

থামলো ইরা। আবার বলল,

-“আমি এখনই তুলে দিচ্ছি ভাবীকে। একটু দাঁড়াও।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তুর্য। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“তার প্রয়োজন নেই। তুই শুধু দরজা থেকে সরে দাঁড়া।”

তুর্যের আদেশ আসতেই ইরা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। তুর্য আর সময় নষ্ট না করে লম্বা লম্বা কদমে কক্ষের ভিতরে ঢুকে পড়লো। বিছানা কাছে গিয়ে খুব সাবধানে কোলে তুলে নিল পৃথাকে যাতে তার ঘুম ভেঙে না যায়। অতঃপর বউয়ের ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বলল,

-“কোথায় আমি অসুস্থ তাই বউ সেবা করবে তা না। এই রাত বিরাতে বউকে কোলে নিয়ে আমার দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।”

চলবে…..

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৪১

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

[ প্রাপ্তবয়স্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

৪৩.
ভোরের আলো ফুটেছে। রাতের নীরবতায় ঢাকা শহরটা একটু একটু করে ব্যস্ত হয়ে পড়তে শুরু করেছে। যানবাহনের টুক টাক প্যা পো ধ্বনি ভেসে আসছে ইতমধ্যেই। পৃথা নিশ্চিন্ত চিত্তেই ঘুমাচ্ছিলো এখনও। তবে তার এই সুখের ঘুমে হঠাৎ ভাটা পড়লো এক অদ্ভুত আওয়াজে। কেমন দ্রিম দ্রিম করে কানের কাছে বেজে যাচ্ছে আওয়াজটা। পৃথার ঘুম ভাঙলো। তবে সে চোখ না খুললো না। আঁখিদ্বয় বন্ধ রেখেই বোঝার চেষ্টা করলো ঐ আওয়াজের উৎসটা। একি শুধু যে আওয়াজ আসছে তা তো নয়, একটু পর পর তার মাথাটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে। তবে কি শহরে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে? হতেই পারে। ঢাকা তো ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। পৃথার হৃদয় কাঁপলো। এই ভূমিকম্পের মতো দূর্যোগের সময় কিনা সে ম’রা’র মতো ঘুমাচ্ছে! বাড়ির মানুষ জনের কি অবস্থা কে জানে? ধপ করে চোখ জোড়া খুলে ফেললো মেয়েটা। তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েই অনুভব করলো সে উঠতে পারছে না, কারো শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়ে রয়েছে তার ছোট খাটো দেহটা। পৃথা চমকালো, তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে সম্মুখ পানে তাকাতেই চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো তুর্যের ঘুমন্ত মুখশ্রী। মেয়েটা দ্বিতীয় দফায় আবারও চমকালো। একি সে এই কক্ষে তুর্যের নিকট কিভাবে এলো? তার স্পষ্ট মনে আছে গতরাতে সে ইরার সাথে ইরার কক্ষে ঘুমিয়েছিল। তবে কি তুর্য তার ঘুমের মধ্যে গিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে? আসতেই পারে। এর দ্বারা কোনো কিছু অসম্ভব তো নয়। লজ্জাহীন ব্রিটিশ পুরুষ একটা। পৃথার আকাশ পাতাল ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ খেয়ালে এলো একটু আগের দ্রিম দ্রিম আওয়াজটার কথা। ঐ আওয়াজটা তাহলে কোথা থেকে আসছিলো? মেয়েটা সরু দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের বক্ষ পানে। নিঃশ্বাসের সাথে কেমন ওঠা নামা করছে ছেলেটার বক্ষস্থল। তবে কি এই দ্রিম দ্রিম আওয়াজটাও এখান থেকে আসছিলো? পৃথা কৌতুহলবশত আবারও মাথা রাখলো তুর্যের বক্ষে, কান পেতে শুনলো স্বামীর হৃদস্পন্দনের শব্দ। সাথে সাথেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটার মুখশ্রী। ঐ দ্রিম দ্রিম আওয়াজটা এখান থেকে অর্থাৎ তুর্যের বক্ষ থেকে আসছিলো। আর সে কিনা কি ভেবে বসেছিল। একদম ভূমিকম্প পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। পৃথা আর উঠলো না তুর্যের বক্ষ থেকে। মাথা এলিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে শুরু করলো স্বামীর হৃদস্পন্দনের আওয়াজ। হঠাৎ মেয়েটার স্মরণে এলো গতকাল রাতের চু’মু’র ব্যাপারটা। ঐ চুমু খেয়েই তো পালিয়েছিল সে। পৃথার লজ্জা বাড়লো আরও। লাজে আড়ষ্ঠ হয়ে তুর্যের বক্ষ থেকে মাথা তুললো। এখনই তাকে পালাতে হবে এখান থেকে নয়তো একবার তুর্যের ঘুম ভাঙলে তাকে লজ্জায় মাটির মধ্যে ঢুকে যেতে হবে। পৃথা আস্তে ধীরে নিজের কোমড় থেকে তুর্যের হাতটা সরাতে চাইলো। তা তো পারলোই না, উল্টো তুর্য আরও শক্ত করে কোমড় চেপে ধরলো পৃথার। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

-“কি সমস্যা কি? সকাল সকাল এমন যু’দ্ধ লাগিয়েছো কেন? ঘুমুতে দাও একটু।”

পৃথা ভরকালো, সাথে অপ্রস্তুতও হলো বেশ। এই লোকটার ঘুম কি সর্বদা সঠিক সময়েই ভেঙে যায়? কাল কত সাহস করে, কতটা অনুভূতি নিয়ে একটু চু’মু খেতে গিয়েছিল ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে যায় এই ব্রিটিশ লোকটার। আবার আজ এখনও তেমনটাই ঘটলো। পৃথা নিজেকে তুর্যের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে পালানোর পরে ঘুম ভাঙলে কি সমস্যা হতো? তা না। মেয়েটা তুর্যের কথাকে উপেক্ষা করেই আবারও নিজেকে মুক্ত করতে উদ্যত হলো। হাঁসফাঁস করে বলল,

-“আপনি যতক্ষন ইচ্ছে ঘুমান। আমাকে তো উঠতে দিন।”

তুর্য নিজের চক্ষুদ্বয় বন্ধ রেখেই জবাব দিল,

-“আমি যতক্ষন না উঠবো তুমিও উঠতে পারবে না। সুতরাং চুপচাপ আমার বুকে শুয়ে থাকো।”

পৃথা অবাক হলো। কপাল কুঁচকে বলল,

-“এ কেমন কথা? আর তাছাড়া আমার কাজ আছে ছাড়ুন আমাকে।”

তুর্য তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না কোনো। একটু সময় নিয়ে হুট করে পৃথাকে ঝাপটে ধরে ঘুরিয়ে নিল। নিজেদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজের শরীরটা ছেড়ে দিল পৃথার শরীরের উপরে, মুখ গুঁজলো মেয়েটার ঘাড়ে। ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

-“তোমার সব কাজ এখন আমার সাথে। আমি ব্যতীত তোমার কোনো কাজ নেই।”

আকস্মিক তুর্যের এমন প্রগাঢ় স্পর্শে কেঁপে উঠলো পৃথা। ছেলেটার উষ্ণ নিঃশ্বাসের ছোঁয়া ঘাড়ে পড়তেই শিরশিরিয়ে উঠলো সর্বাঙ্গ জুড়ে। তবে এই অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হলো না খুব বেশিক্ষণ। তার আগেই চেঁচিয়ে উঠলো মেয়েটা। গলা বাড়িয়ে বলল,

-“আল্লাহ গো এটা হাতি নাকি মানুষ! আপনার এই হাতির মতো দেহ সরান আমার উপর থেকে নয়তো আমার চ্যাপ্টা হয়ে যেতে সময় লাগবে না বেশি।”

তুর্য শুনলো পৃথার কথা, কুট করে একটা কামড় বসিয়ে দিল মেয়েটার ঘাড়ে। অতঃপর সেই স্থানেই নাক ঘষতে ঘষতে বলল,

-“আমার ভার বহন করার অভ্যাস করে নাও জান। এরপর থেকে এই ভারই তোমাকে বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন।”

পৃথার কান গরম হলো। ছিঃ কি নির্লজ্জ কথা বার্তা। এ লোকের মুখে কি কিছু আটকায় না? পৃথা নিজের দুই হাত দিয়ে তুর্যকে সরিয়ে দিতে চাইলো। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

-“অ’স’ভ্য নি’র্ল’জ্জ পুরুষ একটা। উঠুন আমার উপর থেকে।”

তুর্য পৃথার ঘাড় থেকে মাথা তুললো। প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ পানে তাকিয়ে হুট করেই বলল,

-“ভালোবাসি বউ।”

পৃথা থমকালো। হৃদয়ে এক অজানা প্রশান্তি অনুভব করলো যেন। এর আগেও দুই এক বার এই মানুষটার কন্ঠে ভালোবাসি শব্দটা শুনেছে পৃথা। তবে এমন অনুভূতি হয়নি কখনও। তাহলে আজ কেন হলো? সেও তুর্যকে ভালোবাসে বলে? হয়তো তাই। পৃথা আড়চোখে তাকালো তুর্যের পানে। মৃদু কন্ঠে বলল,

-“ধন্যবাদ।”

তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

-“ভালোবাসি বললে ধন্যবাদ দিতে হয়?”

পৃথা ঠোঁট টিপে হাসলো। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে বলল,

-“সবকিছুর উত্তর দেওয়ার জন্যও একটা সঠিক সময়ের প্রয়োজন।”

-“সেই সঠিক সময়টা কবে আসবে?”

-” অতি শীঘ্রই।”

তুর্য হাসলো, একটু ঝুঁকে গেল পৃথার পানে। মেয়েটার ওষ্ঠের নিকট নিজের ওষ্ঠ নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল

-“আমি অপেক্ষায় রইলাম। তবে এখন আমার একটা চু’মু প্রাপ্প। তাছাড়া কাল রাতের একটা ধার বাকিরও ব্যাপার আছে তো।”

পৃথা আড়ষ্ঠ হলো। সে ঠিক জানতো এই লোক ঘুম থেকে উঠেই গতকালকের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করবে। পৃথা ইতস্তত করলো। আমতা আমতা করে বলল,

-“একদম না। আপনার বাসী মুখে একদম উল্টা পাল্টা কাজ করার চেষ্টা করবেন না।”

তুর্যের মুখশ্রী থমথমে আকার ধারন করলো। বেশ গুরুত্বের সাথে বলল,

-“চু’মু খাওয়ার ক্ষেত্রে আমি ঐ বাসী টাসী মানতে পারবো না। সকাল বিকাল দুপুর যখন ইচ্ছে আমি আমার বউকে চু’মু খাবো।”

কথাটা বলেই তুর্য আরেকটু এগিয়ে গেল পৃথার ওষ্ঠের পানে। দু’জনের ওষ্ঠ যখন প্রায় ছুঁই ছুঁই, তখন হুট করেই পৃথা দুই হাতে চেপে ধরলো নিজের ওষ্ঠ। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

-“একদম অ’স’ভ্য’তা’মো করার চেষ্টা করবেন না।”

তুর্য মুখ ফুলালো। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“ঠিক আছে চু’মু খাবো না। তোমাকে চু’মু খেতে আমার বয়েই গেছে। আমি শুধুমাত্র গত রাতের ধার বাকিটা শোধ করতে চাইছিলাম এই যা।”

পৃথা মুখে হাত রেখেই জবাব দিল,

-“আপনার ধার বাকি শোধ করার দরকার নেই। সুরুন আমার উপর থেকে।”

তুর্য আর দ্বিরুক্তি করলো না। থমথমে মুখ নিয়ে উঠে বসলো পৃথার উপর থেকে। মেয়েটা যেন এতক্ষনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ওষ্ঠ থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসলো সে। আর এটাই ছিল তার চরম ভুল। পৃথা উঠে বসতেই তাকে ঝাপটে ধরলো তুর্য। নিজের দুই হাত দ্বারা মেয়েটার দুই হাত শক্ত করে ধরে বলল,

-“এবার চু’মু না খেয়ে তুমি যাবে কই বউ?”

পৃথা হকচকালো। চোখ বড় বড় করে বলতে চাইলো কিছু একটা। কিন্তু সে সময় পেল না বেচারী। তার আগেই তুর্য শব্দ করে বাচ্চাদের ন্যায় এলোপাথাড়ি চু’মু খেতে শুরু করলো পৃথার মুখ জুড়ে। মেয়েটা অতিষ্ট হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। একে তো ঐ শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহ দ্বারা তুর্য তাকে ঝাপটে ধরে আছে। তার মধ্যে মুখটাকেও শান্তি দিচ্ছে না। চেঁচিয়ে উঠলো পৃথা। গলা বাড়িয়ে বলল,

-“অ’স’ভ্য নি’র্ল’জ্জ পুরুষ। ছাড়ুন আমাকে।”

তুর্য ছাড়লো না। উল্টো পৃথার মুখ বন্ধ করতে এবার বেচারীর নরম কোমল ওষ্ঠ দুটোও দখল করে নিল নিজে ওষ্ঠ দ্বারা। বিন্দু মাত্র সময় ব্যয় না করে পরম যত্মে শুষে নিতে শুরু করলো সে ওষ্ঠের মধুসুধা। চরম উন্মাদনায় নিজ ওষ্ঠের প্রবল ঘর্ষনে দিশেহারা করে তুললো পৃথাকে। শিউরে উঠলো মেয়েটা। কেঁপে উঠলো তার বক্ষস্থল। এই প্রথম কোনো পুরুষ এতটা গাঢ়ভাবে ছুঁয়ে দিয়েছে তার ওষ্ঠ। হৃদয়ে কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতির সঞ্চার হলো। এ কেমন অনুভূতি? এ কেমন অদ্ভুত ভালো লাগা? ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লো পৃথা। পরম আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিজেও সায় জানালো তুর্যের কার্যে।

৪৪.
সময় গড়ালো। সকালের সময়টা কেটে দুপুরের দিকে পা বাড়াতে শুরু করেছে ইতমধ্যে। সূর্যটাও তার প্রখরতা ছড়িয়ে মাথার উপরে চলে এসেছে প্রায়। অথচ আরুশের দেখা নেই কোনো। সেই জঙ্গলে জ্ঞান হারানোর আগে যে আরুশকে দেখেছিল তুর্য তারপর আর একটা বারের জন্যও পাওয়া যায়নি ছেলেটার। তুর্য ঠিক বুঝতে পারছে ভয়ে বেচারা তার সম্মুখে আসছে না। তাই বলে তো আর কাজের প্রতি ঘাফেলতি করা যাবে না। ঐ জঙ্গলে তারপর কি হলো? ওরা মুখ খুলেছে কিনা। আর কি কি তথ্য পাওয়া গেল অনেক কিছুই জানার আছে তুর্যের। তুর্য আর সময় নষ্ট করলো না। নিজে থেকেই কল করলো আরুশকে।

আরুশ নিজের অফিস কক্ষেই বসা ছিল, ভাবছিলো তুর্যের কথা। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতেই কিছুটা চমকে উঠলো বেচারা। টেবিল থেকে তড়িঘড়ি করে মোবাইলটা তুলে হাতে নিতেই দেখতে পেল তুর্যের নাম্বার। ভরকে গেল আরুশ। এ আবার কল করেছে কেন? নিশ্চই প্র’তি’শো’ধ নিতে। কলটা কি সে ধরবে? না ধরলেও তো আবার চেতে যাবে। তার থেকে বরং কলটা ধরাই যাক। অন্তত কি বলতে চায় সেটা তো শোনা প্রয়োজন। আরুশ ধরলো কলটা। মোবাইলটা কানের কাছে নিয়ে আমতা আমতা করে বলল,

-“আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।”

-“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছিস?”

-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি স্যার?”

তপ্ত ছাড়লো তুর্য। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“তোর হাতের মোটা লাঠির বারি খেয়ে এখনও বেঁচে আছি কিন্তু তুই আমাকে একটা বারের জন্যও দেখতে এলি না? এতটা পাষান কবে থেকে হলি আরুশ?”

আরুশের কিছুটা খারাপ লাগা কাজ করলো। সত্যিই তো তুর্যের অসুস্থতার কারন সে। অথচ একটা বারের জন্যও সে দেখতেও গেল না তুর্যকে। এটা নিশ্চই অমানবিক কার্যের মধ্যেই পরিগণিত। কিন্তু সেও তো ভয় পেয়েছিল ভীষন তাই যায়নি। জ্বীহ্বা দ্বারা নিজের ওষ্ঠ ভেজালো বেচারা। অপরাধীর কন্ঠে বলল,

-“আসলে স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। ঐ স’ন্ত্রা’সী’টা’র হাত থেকে আপনাকে বাঁচাতে গিয়ে ভুলবশত হয়ে গেছে। মাফ করে দিন স্যার।”

_________

চলবে…..