অবাধ্য পিছুটান পর্ব-৪৯ এবং শেষ পর্ব

0
193

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৪৯ ( শেষ পর্ব )

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

৫৪.
আঁধার ঘনিয়েছে চারদিকে। বিয়ে বাড়ির হইচই কলরব এই মুহূর্তে ফিকে হয়ে পড়েছে অনেকটা। তবে জোৎস্না রাত আজ, আঁধারে ঢাকা আকাশটায় গোল থালার ন্যায় রূপালী এক চাঁদ স্থান করে নিয়েছে। চারদিক সেজে উঠেছে চাঁদের মধুময় মিষ্টি আলোয়। তবুও ইরার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। পুষ্প সজ্জিত এক সুন্দর কক্ষে বসে রয়েছে মেয়েট। বাসর রাত আজ তার। অজানা ভয়, সংকোচ, সংসয় পুরো দিনই আজ ঘিরে রেখেছিল তাকে। তবে ভাবী, বান্ধবীদের হাসি ঠাট্টায় তখন এতটা ভয় টের পায়নি। কিন্তু এখন তো সে একা। কিছুটা সংকোচ নিয়েই চোখ ঘুরিয়ে রুমের চারদিকে তাকালো ইরা। আরুশের সাথে বিয়েটা অনেক আগে হলেও এই কক্ষে তাঁর এই প্রথম প্রবেশ। কক্ষে খুব বেশি আসবাবপত্রে পরিপূর্ণ নয়। শুধুমাত্র একটা খাট, একটা আলমারি, একটা টেবিল চেয়ার আর সোফা রাখা। খুব বেশি ফুল দিয়েও কক্ষটা সাজানো হয়নি, খুব সাদামাটা সাজ। তবে বিছানাটা পরিপূর্ণ করে রাখা হয়েছে লাল গোলাপের পাপড়ির দ্বারা। মধ্য বরবার আবার গোলাপের পাপড়ি দিয়েই দুটো অক্ষর বসানো হয়েছে A+E। ইরার পুরো কক্ষে নজর বুলানোর মধ্যেই হঠাৎ কর্ণে পৌঁছালো চেঁচামেচির আওয়াজ। সম্ভবত বাহিরে আরুশের কাজিন মহল বাসরের টাকা আদায়ের জন্য ধরেছে আরুশকে। ইরার মন প্রাণ কেমন অন্যরকম অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। শীতলতায় ছেয়ে গেল সর্বাঙ্গ। এমনিই এক হাত ঘোমটা টানা ছিল তার মস্তকে, সে ঘোমটাটা আরও একটু টেনে তার পরিধি বাড়িয়ে নিল।

আর বেচারা আরুশ! ভেবেছিলো তুর্যদের বাড়ি থেকে বউ নিয়ে এসেছে মানে বউ পেয়ে গেছে। এরপর আর কোনো বাঁধা বিপত্তি ছাড়াই বউকে আপন করে নিতে পারবে। কিন্তু তা আর হলো কই? এ বাড়িতে এসে বিয়ের নিয়ম কানুন পালন করতে করতেই তো অর্ধরাত। তারপর আবার এই কাজিন মহলের উৎপাত। টাকা ছাড়া কিছুতেই বাসরঘরে ঢুকতে দিবে না। একদম তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে ঘরের দরজায়। বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়লো আরুশের। কপাল কুঁচকে বলল,

-“আমার বাসর, আমার বউ। তোদের টাকা দেব কেন?”

কাজিন মহলের একজন সাথে সাথেই জবাবে বলল,

-“তোমার বাসর, তোমার বউ কিন্তু তালা তো আমাদের। টাকা দিবে না তালার চাবিও পাবে না। আজ বাসর রাতের মতো একটা সুন্দর রাতেও সারারাত কাটাও বউহীনা।”

আরুশ হতবাক হতে গিয়েও হলো না। অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সকলের পানে। তুর্যের থেকেও তো এরা ভয়ানক অধিক। তুর্য তো তবুও তাকে বউহীনা করেছিল আর এরা তো বউয়ের সাথে সাথে অর্থসম্পদের উপরেও ঝড় বইয়ে দিতে চাইছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল আরুশ। তবুও হাল ছাড়লো না বেচারা। আরও কিছুক্ষণ কাজিন সম্প্রদায়ের সাথে বাকবিতন্ডাতে জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের পরাজয় মেনে নিল। একদিকে এরা টাকা ছাড়া চাবি কিছুতেই দিবে না অন্য দিকে রাত তো তাদের জন্য বসে থাকবে না, সে হু হু করে বেড়ে চলছে। এরপরে দেখা যাবে বাসর রাত শেষ অথচ বউয়ের কাছাকাছি আর পৌঁছানো হলো না আরুশের। হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো আরুশ। অসহায় মুখভঙ্গিতে পকেট থেকে টাকা বের করে দিল কাজিন সম্প্রদায়ের হাতে। সাথে সাথে হইহই করে উঠলো সবাই আর সাথে বিনা বাক্যে কক্ষের চাবিটা তুলে দিল আরুশের হাতে। আরুশের চোখ জোড়া চক চক করে উঠলো চাবি পেয়ে। টাকার শোক ভুলে গেল মুহুর্তেই। টাকা যায় যাক, বউ তো পেয়েছে। আর দেরী করলো না বেচারা, এমনিই অনেক দেরী হয়ে গেছে। দ্রুত চাবি দ্বারা তালা খুলে ঢুকে পড়লো কক্ষের ভিতরে।

খট করে দরজা খোলার আওয়াজ কর্ণে পৌঁছাতেই কেঁপে উঠলো ইরার বক্ষস্থল। নড়েচড়ে উঠলো মেয়েটা, কেমন ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে বুকের ভিতরে। লজ্জা, লজ্জা লাগছে ভীষন। যতই মানুষটা পূর্ব পরিচিত হোক কিংবা বিয়েটা আগে হোক আজকের অনুভুতিটা তো একদম ভিন্ন। আজ তাদের দুজনের একান্তে প্রথম রাত। নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়ার প্রথম অনুভূতি আজ। ইরা হাঁসফাঁস করে উঠলো। নিজেকে গুটিয়ে নিল একটু। আরুশ কক্ষে প্রবেশ করে একবার তাকালো বিছানায় বসা তার স্ত্রীর পানে অতঃপর দরজাটা ভালোভাবে এঁটে দিয়ে আস্তে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বসলো তার পাশে। মেয়েটা বিশাল এক ঘোমটায় আড়াল করে রেখেছে নিজেকে। আরুশ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ইরার পানে। হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে ধরলো মেয়েটার ঘোমটাটা। সাথে সাথে কেঁপে উঠলো ইরা। আরুশ থামলো না তবুও, ধীরে ধীরে স্ত্রীর মস্তকে চড়ানো ঘোমটাটা টেনে তুললো উপরে। মেয়েটা চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিয়েছে। তিরতিরিয়ে কাঁপছে তার কোমল ওষ্ঠজোড়া। হাসলো আরুশ, পরম আবেগ নিয়ে মেয়েটার চোখে মুখে ফু দিয়ে বলল,

-“ভয় পাচ্ছো?”

ইরা পিটপিট করে চোখ দুটো খুললো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে আলতোভাবে ডানে বামে মাথা ঝাঁকালো, বুঝালো ভয় পাচ্ছি না। আরুশ আর বেশি ঘাটালো না মেয়েটিকে। পকেট থেকে একটা আংটি বের করে নিজ দায়িত্বে ইরার বাম হাতটা হাত টেনে নিল নিজের ভাঁজে। ইরা ইতস্তত করলো, নিজের হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলো। আরুশ ছাড়লো না স্ত্রীর হাত। বরং সযত্নে হাতের অনামিকা আঙ্গুলে পড়িয়ে দিল আংটিটা। ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,

-“তোমার স্বামীর তরফ থেকে তোমার জন্য প্রথম উপহার।”

ইরা লাজে মাথা নিচু করে ফেললো। আরুশ এক হাতে লাজে রাঙা স্ত্রীকে বুকে টেনে নিল। মেয়েটার চুলের ভাঁজে চুমু খেয়ে বলল,

-“ভালোবাসি।”

ইরা মুখ লুকালো আরুশের বক্ষে। লাজুক স্বরে বলল,

-“আমিও ভালোবাসি।”

৫৫.
সময় বয়ে চলেছে নিজের গতিতে। সে অপেক্ষা করে থাকে না কারো জন্য। চোখের পলকেই যেন কেটে গেল বেশ কয়েকটা বছর। সময় বদলেছে তার সাথে বদলে গিয়েছে চারপাশের পরিবেশ, মানুষ এবং সম্পর্কে। শহরের বুকটা আগের তুলনায় আধুনিক হয়ে উঠেছে আরও। ইরা সন্তান সম্ভবা। প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাস চলছে মেয়েটার। পিয়াসের সাথে রিদিরও বিয়ে হয়ে গেছে বেশ কিছু সময় পূর্বে। আর বাকি রইলো পৃথা আর তুর্য! তাদের ঘর আলো করে ইতমধ্যে চলে এসেছে এক পুত্র সন্তান। নাম রেখেছে তুর্ণ। দেখতে শুনতে কিছুটা মায়ের মতো হলেও চরিত্র তার হুবহু বাবার মতো। এ যেন তুর্যেরই আরেক সত্ত্বা।

****

রাত নেমেছে ধরনীতে। শহরের বুকটা ইতমধ্যে আলোকিত হয়ে উঠেছে কৃত্রিম সোডিয়ামের আলোয়। তুর্য সারাদিন পর বাড়িতে ফিরলো মাত্রই। বাবার আগমনী বার্তা ছোট্ট তূর্ণের কর্ণে পৌঁছাতেই সে কাঁদতে কাঁদতে ছুটলো সেদিকে। রাতের এই সময়ে ছেলেকে এভাবে কাঁদতে দেখে অবাক হলো কিছুটা। ভ্রু বাঁকিয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করলো,

-“কাঁদছো কেন বাবা? কি হয়েছে?”

চার বছরের তূর্ণ কান্না বিজড়িত কন্ঠেই জবাব দিল,

-“আমাকে মেলেছে।”

তুর্যের মুখশ্রী জুড়ে গম্ভীরভাব ফুটিয়ে তুললো সাথে সাথে। কন্ঠে কিছুটা ক্রোধ এটে বলল,

-“কে মে’রে’ছে আমার বাবাকে? কার এত বড় সাহস আমার বাবাকে মা’রে? একবার শুধু নাম বলো আমিও তাকে মে’রে দেব এক্ষুনি।”

তূর্ণ কান্না থামালো একটু। নাক টেনে টেনে বলল,

-“মাম্মাম মেলেছে।”

পৃথার নাম শুনে চুপসে গেল তুর্য। অবশ্য এ বাড়িতে তার বউ ব্যতীত তার ছেলের গায়ে হাত তোলার সাহস আর কেউ রাখে না এটা তার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। কিন্তু কথা সেটা নয়, কথা হলো এই মুহূর্তে ছেলের পক্ষ নিয়ে পৃথার নিকট “আ” মূলক ধ্বনি তুলতে গেলেও ছেলেসহ নির্ঘাত কক্ষছাড়া হতে হবে তাকে। আর তারপর ছেলে কেঁদেকেটে মাঝ রাতে হলেও মায়ের কক্ষে স্থান নিয়ে নিবে। কিন্তু তার ঐ “আ” মূলক ধ্বনি তোলার অপরাধে তাকে স্থান দেওয়া হবে না কোনোভাবেই, পুরো রাত বউহীনা অন্য কক্ষে কাটাতে হবে। তুর্য ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে বলল,

-“নিশ্চই তুমি কোনো দুষ্টুমি করেছো তাই মাম্মাম মে’রে’ছে। শুধু শুধু তো মাম্মাম তোমাকে মা’রা’র মানুষ নয়।”

তূর্ণের কান্না বন্ধ হয়ে গেল সাথে সাথে। বাবার পানে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,

-“তুমি মাম্মামকে ভয় পাও পাপা?”

তুর্য হাসলো। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

-“না বাবা। আমি তোমার মাম্মামকে ভয় পাই না তবে ভালোবাসি ভীষণ। তোমার মাম্মামকে যখন শক্ত কন্ঠে কিছু বলতে যাই তখন সেই কথা আমার হৃদয়েই আঘাত হানে সর্বপ্রথম তাই নিজের কষ্টের জন্য হলেও তোমার মাম্মামকে বলতে পারি না কিছু।”

বাপ ছেলের কথাপকথনের মধ্যেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো পৃথা। ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,

-“কি কথা হচ্ছে বাপ ছেলের?”

তূর্ণ চোখ বড় বড় করে তাকালো মায়ের পানে। নীরিহ মুখশ্রী নিয়ে বলল,

-“আমি কাঁদছিলাম তখন পাপা এসে পলেছিল। পাপা আমাকে বলল আমাল নাকি এখন একটা বোনের প্রলোজন। সবার বোন আছে শুধুমাত্র আমার একটা বোন নেই।”

পৃথা কটমট করে তাকালো তুর্যের পানে। আর তুর্য হতবম্ব নয়নে তাকিয়ে রইলো তার মাত্র চার বছরের ছোট্ট নাদুসনুদুস ছেলের পানে। এসব কথা সে কখন বলল? এই বোন প্রয়োজন বা কিছু এ ধরনের বাক্যের ধারে কাছেও তো সে যায়নি। আচ্ছা এই ছেলে তার তো? নাকি হাসপাতালে কোনোভাবে বাচ্চা বদলে টদলে গিয়েছিল। তুর্যের ভাবনা চিন্তার মাঝেই তার হৃদয় তীব্র বেগে চিৎকার করে উঠলো। প্রতিবাদের স্বরে বলল,

-“এ ছেলে তোরই। একদম তোর মতো চরিত্র পেয়েছে। কোনো ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন নেই। সারাজীবন তুই তোর বাপ মাকে জ্বালিয়ে মে’রে’ছি’স এবার তোর ছেলে তোকে জ্বালিয়ে মা’র’বে।”

( সমাপ্ত )

সবাই রেসপন্স করবেন