অবাধ্য প্রেম পর্ব-৪৬+৪৭

0
638

#অবাধ্য_প্রেম
#পর্ব_৪৬
#নন্দিনী_নীলা

তিনতলায় নিবিড়ের কেবিন। আমি লিফট থেকে বের হলাম আবিরের সাথে। চঞ্চল দুটি চোখ নিবিড় কে দেখার জন্য ছটফট করছে আমি হাঁটছি দ্রুত গতিতে আবির আমাকে পেছন থেকে বাধা দিল।

‘ভাবি! প্লিজ তুমি এখানে একটু দাড়াও। আমি একটু দেখি ভাইয়া রুমে কেউ আছে কিনা। আম্মু আছে। পাশের ওই কেবিনে নেয়া হয়েছে তাদের থাকার জন্য। তিন দিন ধরে আম্মু এখানে আছে ভাইয়ার সাথে ভাইয়ার কেবিনে তো কাউকে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাইরে আম্মুর সাথে আমি থাকি। আমার একটা ফুপি আছে সে থাকে। তাদের সামনে তো তোমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আম্মু তোমাকে পছন্দ করে না। সেটা তো তুমি জানোই। তোমাকে এখানে দেখলে ক্ষেপে যাবে আমি দেখি তারা এখন কি করছে এখন তো দুপুরটা আমার মনে হয় তারা নিজের রুমে আছে।’

আমার পা থেমে গেল আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঠিকই তো আমার মনে ছিল না এখানে নিবিড়ের মা আছে। সে ত আমাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারে না‌। আমি সিঁড়ির কাছটায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
একটু পরে আবির এসে আমাকে বলল, ভাবি আসো আমি বাইরে থেকে আম্মুর কেবিনের দরজা আটকে দিয়ে এসেছি। ভাইয়া ঘুমাচ্ছে তুমি এখন যাও। নার্স নাই তুমি একটু দেখা কর গিয়ে।’

আবির আসলো না। আমি একাই নিবিড়ের কেবিন টার দিকে পা ফেলে এগোতে লাগলাম। কাঁপা কাঁপা পায়ে আমি কেবিনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাইরে থেকে কাঁচ এর দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরে নিবিড় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
মাথা ও পায়ে ব্যান্ডেজ করা। আমি আলতো হাতে দরজাটা আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে কেবিনের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছল ছল চোখে বেড এর দিকে তাকালাম। কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। তিন দিনেই গায়ের রংটা কেমন চাপা পড়ে গেছে রোগা হয়ে গেছে। কেমন বিধ্বস্ত লাগছে নিবিড় কে। প্রাণবন্ত হাসিখুশি মুখটা এমন শুকিয়ে আছে দেখতে একটু ভালো লাগছেনা। আমি খুব সাবধানে পা ফেলে নিবিড়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিবিড়ের দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছি। কান্না দলা পাকিয়ে আসছে আমার কিন্তু এখানে কাঁদা যাবে না নিবিড়ের ডিস্টার্ব হবে। নিবিড়ের এক হাতে ক্যানেলা লাগানো। এটা লাগালে যে ব্যথা করে প্রতিদিন হয়তো ইনজেকশন দেওয়া লাগে স্যালাইন দেওয়া লাগে এজন্য হয়ত রাখা হয়েছে। একবার আমার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল। মামা আমাকে হসপিটাল ভর্তি করেছিল হসপিটালে থাকতে হয়েছিল এক সপ্তাহ তখন আমাকে ইনজেকশন দেওয়া হতো প্রতিদিনের এজন্যই হাতে এই ক্যানেলা লাগানো ছিল ৭ দিনে। আমার হাতটা ফুলে গেছিল এত ব্যথা করত নিবিড়ের ও হয়তো অনেক কষ্ট লাগে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নিবিড়ের হাতটা স্পর্শ করলাম।
আমার চোখ বেয়ে এক ফোটা অশ্রু নিবিড়ের হাতের উপর পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি পানি মুছে নিলাম। নিবিড়ের হাতটা নড়ে উঠলো নড়াচাড়া করছে। আমি দ্রুত গতিতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।

আমি রুম থেকে বের হতে একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে দেখা হলো। পোশাক দেখে মেয়েটি নার্স বুঝলাম মেয়েটা আমার দিকে ব্রু কুঁচকে তাকাল আমি তাকে পাশ কাটিয়ে আসতে গেলে সে আমাকে কড়া গলায় বলল, ‘Who are you doing here?’

আমি নার্সের দিকে ঘুরে তাকালাম আশেপাশে আবিরকে দেখতে পারছেনা ও আমাকে রেখে কোথায় গেল। নার্সের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি এদিক ওদিক আবির কে খুঁজে যাচ্ছি।

এবার নার্স রাগান্বিত সুরে বলল, ‘বিনা পারমিশনে তুমি রুমে ঢুকেছো কেন? পেশেন্টের রুমে কারো ঢোকা নিষেধাজ্ঞা আছে আর তুমি লুকিয়ে ঢুকে পড়েছ। তোমার সাহস তো কম না। কে তুমি পেশেন্টের কি হও?’

এবার আমি কি বলবো? নিবিড়ের আমি কি হই? উনি আমার উত্তরের আশায় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু না বলাই উনি বিরক্ত হচ্ছেন। বিরক্তিকর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার খুব নার্ভাস লাগছে কি বলব বুঝতে পারছিনা। সেই মুহূর্তে আবিরের আবির্ভাব ঘটল সেখানে। আবির কে দেখে আমি চিন্তা মুক্ত হলাম। আবিরকে দেখেই নার্সটা অভিযোগ স্বরে বলল, ‘এই দেখুন কোথা থেকে একটা মেয়ে আসছে আপনার ভাইয়ের রুমে ঢুকে কি যেন করছিল। এখন বাইরে আমার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। কথা বলছে না। মেয়েটার মধ্যে ঘাপলা আছে। একে জেরা করেন।’

আবির নার্স কে বলল, ‘সেসব আপনাকে দেখতে হবে না। আপনি এখান থেকে যান ওনাকে আমি ভালো করেই চিনি।’

.
হসপিটাল থেকে বাসায় আসতে আসতে আমার চারটা বেজে গেলো। লিলিদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতেই লিলি আর রায়ানের সাথে দেখা হলো, দাঁড়িয়ে আছে রায়ানের সাথে বেড়াতে যাবে লিলি আমাকে গতকালই বলছিল। আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিল আমি রাজি হয়নি। দুজনের মাঝে আমি কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না। লিলি আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, ‘ ছোঁয়া এমন উদ্বিগ্ন হয়ে আছিস কেন? কেমন দেখা যাচ্ছে! কোথায় গিয়েছিলি! দুইবার তোর বাসায় গিয়ে কলিংবেল চেপে এসেছি। কিন্তু তুই তো নেই আমাকে একবার পর্যন্ত বলে যাস নাই কোথায় গেছিস!’

‘সরি রে, খুব তারাহুরার মাঝে বের হয়েছিলাম। এজন্য বলার সুযোগ পায়নি।’

‘এত তাড়াহুড়া করে কোথায় গিয়েছিলি? তোকে তো খুব চিন্তাগস্ত দেখা যাচ্ছে সারাদিন তো মনে হয় খাস নাই কিছু মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে।’

‘এখন বেড়াতে যাচ্ছিস যা ইনজয় কর। পরে বলব সবকিছু।’

লিলি আচ্ছা বলল আমি ভেতরে চলে গেল এলাম।

.
নিবিড় কে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা সত্যি হয়ে গেল। দিনটা আমি আর ভাল কাটাতে পারলাম না। নামাজের পরে শুধু নিবিড়ের জন্য দোয়া করলাম। আর কিছু করার নাই ওর কাছে তো আর আমি থাকতে পারবো না সেটা সম্ভাবনা। আল্লাহ তায়ালা আমার ভরসা। কিন্তু তারপরের দিন আমার জন্য কি অপেক্ষা করছিল আমি নিজেও বুঝতে পারি নাই। পরদিন সকাল সকাল আবির আমাকে কল দিয়ে জানায় হসপিটালে এখন আবির একা আছে। মা ফুপি নাকি বাসায় চলে গেছে একটানা এতদিন থাকার জন্য তারা খুব ক্লান্ত। বাসায় কি একটু রেস্ট নিয়ে দুপুরের পর আবার আসবে। আমি শুনেই তো খুশিতে লাফি উঠলাম। বললাম আমি তাহলে এখনি আসছি তুমি থাকো।
খুশিমনে আমি বাসা থেকে বের হলাম ঠিকই কিন্তু গেটের বাইরে আসতে আমার মুখ থেকে হাসিও উবে গেল আর ভয়ে দানা বাঁধলো। মামিকে বাসার সামনে দাঁড়ানো দেখে আমিতো থমকে গেলাম। মামীর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।

‘অনেক প্রেম করে বেড়ালি শান্তি মত ঘুরলি এবার তোর ডান কেটে আমি যদি না দিয়েছি তো….

আমি বললাম, ‘তুমি আমার খোঁজ কী ভাবে পেলে?’

মামি আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোর খোঁজ তো আমি সেই কবেই পেয়েছি। এতদিন ওই নিবিড়ের বাড়ি ছিলি। এখন আবার বান্ধবীর বাড়ি থাকিস। কিরে প্রেম করে কি বাড়ি ধরা খাইছিলি নাকি নাক কেটে বাসা থেকে বের করে দিছে মনে হয়।’

আমি জ্বলন্ত চোখে মামীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কি বলতে চাও তুমি?’

‘শোন তোর খোজ আমি অনেক আগেই পেয়েছি কিন্তু এতদিন নিবিড়ের জন্য আমি তোর কাছে আসিনি। ”

‘মানে?’ নিবিড়ের জন্য আসেনি মানে কি আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে মামীর দিকে ।

‘ শোন তোকে আমি এতো মানে বলতে পারব না। তোরে আমি জসিমের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলাম টাকার জন্য কারণ জসিম আমাকে অনেক টাকা দিতো। ওর সাথে তোরে বিয়ে দিলে। কিন্তু সেই টাকা যখন নিবিড় আমাকে দিচ্ছিল। তখন আর আমি তোর আর ওর প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তোকে তোর মত ছেড়ে দিয়েছিলাম নিবিড় বলেছিল তাই। ও তোকে নাকি ভালোবাসে ওর প্রতি তোর ভালোবাসার সৃষ্টি করার জন্য সময় চেয়েছিল আমি বলেছিলাম আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে তাহলে ওর সাথে তোকে বিয়ে দেবো কিন্তু তা করবে না। আগে তোর মনে ওর জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করবে তারপর নাকি বিয়ে করবে। তো মাসে মাসে যখন টাকা দিছিলাম আমি রাজি হয়ে যায় জসিমকে তোর খোঁজটা দেই না। কিন্তু ও শালা তো দুই মাস টাকা ঠিকই দিল কিন্তু এ মাসে এসেই ঘাপলা করেছে ৪-৫ দিন হয়ে গেল ওই ছোকরা আমারে টাকা দেয় না। আমার ফোন ধরে না। নিশ্চিত তুই পটে গেছিস এজন্য এখন আর আমাকে টাকা দেবে না ভাবছে আমাকে ৫ লাখ টাকার জায়গায় ও আমাকে দুই মাসে 50000 করে এক লাখ টাকা দিছে। এত কম টাকায় ওর কাছে আমি তোরে দেব অসম্ভব ঐ জসিম আমাকে বলেছে ৭ লাখ টাকা দেবে আজকেই তোর সাথে জসিমের বিয়ে হবে। ওই শয়তান পোলার লাগে তোর বিয়া আমি দিতাম না। তুই আমার ভাগ্নি তোর উপর আমার অধিকার আছে তোরে আমি জসিমের সাথেই বিয়ে দিমু।’

আমার মাথা যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। পায়ের তলা মাটি সরে গেছে। নিবিড় তো কিছু করেছে আমি তার কিছুই জানি না। নিবিড়ের সাথে মামির আবার কন্টাক্ট হয়েছে। ও কিভাবে মামীকে টাকা দিতে পারলো? ও কি আমাকে কিনতে চাচ্ছে টাকা দিয়ে। যে ভালবাসার ফুল ফুটতে যাচ্ছিল মনে সেটা যেন ধপ করে নিভে গেল। নিবিড়ের এহনো কাজে আমি খুবই আঘাত পেলাম‌। বুকটা আমার ছিড়ে যাচ্ছে কষ্টে কিভাবে পারল আমাকে না জানিয়ে মামিকে টাকা দিতে। আমি চোখ মুখ শক্ত করে মামীকে বললাম, ‘কে কি করেছে কার থেকে কিসের টাকা নিছ। সেইসব আমি কিছু জানি না। আমি আগে বলেছি তোমার আমার উপর কোন অধিকার নেই। যা অধিকার সব আমার মামা আমার উপর ।মামা যেহেতু চায় না আমি তোমার ইচ্ছায় চলি তাহলে আমি তোমার ইচ্ছায় চলবো। একদম আদিখ্যেতা অধিকার আমাকে দেখাতে এসে আমাকে বলি দেওয়ার চেষ্টা করবে না।’

‘তোকে এখন আমি নিয়ে যাব। আজ জসিমের সাথে বিয়ে দেবো। কে আটকাবে আমাকে। তোর আপন বলতে কেউ নাই আমরা ছাড়া। যতটুকু অধিকার আমাদেরই আছে তোর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেবার ও। আমাদের আটকানোর কারো ক্ষমতা নাই। যদি বিয়ে হয়ে যেত তাহলে হয়তো তোর স্বামীর অধিকার থাকতো কিন্তু যেহেতু এটা এখনো হয়নি এখনো তোকে আমি আমার ইচ্ছামত বিয়ে দিতেই পারি।’

আমার মস্তিষ্ক ফাকা লাগছে অধিকার কথাটা খুব যন্ত্রণা দিল আমাকে। এ অধিকার এর বড়াই করে মামী আমাকে বিক্রি করতে যাচ্ছে কোরবানির গরুর মত। এতটাই ফেললা না আমি। তার দেওয়া বলি আমি কেন গ্রহণ করব। অনেক কষ্ট করেছি আমি জসিমের মতো লম্পটকে বিয়ে করে সারা জীবন আর জ্বলতে পারবো না।

‘তোমার আমার উপর যেটুকু অধিকার মামি তার থেকেও অধিকারের মানুষ আমার জীবনে চলে এসেছে।’

মামী চমকালো তবু পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘যত যাই বলিস আজকে তোকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’

‘সত্যি বলছি মামি। আমি এখন অন্য একজনের স্ত্রী। নিবিড়ের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে দুই মাস আগেই। তুমি যদি এখন আমাকে কারো সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য ফোর্স কর। তাহলে আইনের হাত থেকে কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। নিবিড় কে তো চেনো তোমাকে ছেড়ে দেবে না ওর বউকে যদি তুমি আরেকজনের হাতে তুলে দাও। গার্লফ্রেন্ড হিসেবে আমাকে এতটা দিছে আর এখন আমি ওর ব‌উ তাহলে তোমার কি অবস্থা করবে ভাবতে পারছ। আর একজনের বউকে তুমি জোর করে আরেকজনের সাথে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছ তার বরের অনুপস্থিতিতে। নিবিড় এখন অসুস্থ তাই হয়তো তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আমার উপর অধিকার থাকা সত্ত্বেও কেন তোমাকে টাকা দিয়েছে। তোমার থেকেও তো নিবিড়ের আমার উপর অধিকার বেশি। তুমি চাইলে ও এখন আর আমার কিছু করতে পারবে না। হাজবেন্ড ওয়াইফ কে তুমি যদি আলাদা করতে চাও তাহলে আইন তোমাকে ছেড়ে দেবে তো। আর শোনো মামি নিবিড়ের আমার উপর অধিকার থাকা সত্ত্বেও তোমাকে কেন টাকা দিয়েছে আমি জানিনা। হয়তোবা তুমি আমার মামি বলি তোমাকে দয়া করেছে। এসব আমি জানতাম না। একবার যেহেতু জেনে গেছি নিবিড় কে তোমাকে আর একটা টাকা ও দিতে দেবোনা।’

#চলবে…..

#অবাধ্য_প্রেম
#পর্ব_৪৭
#নন্দিনী_নীলা

মামি পুলিশের ভয়ে চলে গেল। সে বিশ্বাস করে নিয়েছে নিবিড় এর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আর সে তো এটা জানেই নিবিড় আমাকে ভালোবাসে। যদি সুস্থ হয় সত্যি মামিকে জেলে পাঠায় সে ভয়ে আর আমার সামনে টিকতে পারেনি। থ্রেট দিতে পারেনি। মামি চলে যেতেই আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। অভিমানে চোখ দুটো আমার ছল ছল করে উঠলো। নিবিড় আমাকে টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করছে ভাবতে আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। যাকে ভালোবাসে তাকে কেন টাকা দিয়ে কিনতে যাবে? মামীদের কেন টাকা দেবে আমার জন্য! আমি কি বিক্রি করার বস্তু!

মামিকে তো বিয়ের নামে একটা মিথ্যে কথা বলে দিলাম‌। সেটা হয়নি আর কখনো সম্ভব হবে না। আমাকে যত দ্রুত সম্ভব এই শহর ছেড়ে পালাতে হবে। মনের ব্যথার অভিমান টুকু নিজের মনে চাপা রেখে আমি হসপিটালে এসে পৌঁছলাম।
আবির আমাকে দেখে এক গাল হাসলো, ‘ভাবি আমি বাইরে যাচ্ছি। কোন দরকার হলে আমাকে কল করবে। আর নার্সকে আমি বলে গেছি তোমাকে কেউ কিছু বলবেনা তুমি ভাইয়ার কাছে থাকো। ‘

‘নিবিড়ের পা কি ঠিক হবে না?’আমি মলিন মুখে জিজ্ঞেস করলাম।

আবির বলল, ‘টেনশন করো না। পা ভেঙে গেছে ঠিক কিন্তু ডাক্তার বলেনি যে পা আর ঠিক হবে না। পা ঠিক হবে কিন্তু সময় লাগবে অনেক। ভাইয়া হয়তো তিন মাসের মত হাঁটতে পারবে নিজের পায়ে। দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু ঠিক হবে।ভাই এখনও জানে না তার পা অচল হয়ে গেছে একটা। মাথা আঘাত পেয়েছিল এজন্য প্রচুর ব্লিডিং হয়েছিল রক্ত লাগছে। মাথার আঘাতের জন্য ভাইয়া ২ দিন আইসিতে ছিল। মাথায় আঘাতের ফলে বেশিরভাগ ব্রেনের চাপ পড়ে স্মৃতিশক্তি হারায়। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছে এত আঘাতের পর ও ব্রেনে তেমন চাপ পড়েনি। স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে আমরা সবাই তো এটা নিয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিলাম।’

আমি ভাবছি স্মৃতিশক্তি চলে গেলেই মনে হয় ভালো হতো। সেই স্মৃতি তে আমি থাকতাম না খুব ভালো হতো। যখন জানতে পারবে সে আর হাঁটতে পারে না তখন নিবিড়ের অবস্থা কি হবে‌। সেটা ভেবে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠছে।

আবির আবার বলল, ‘ ভাবি ভেতরে স্যুপ রাখা আছে ভাইয়াকে খাইয়ে দিও।’

‘ নিবিড় কি জেগে আছে?’

‘ ঘুম হয়ত কিন্তু ভেঙে যাবে খুব তাড়াতাড়ি।’

আমি নিবিড়ের কেবিনে গেলাম। অস্বস্তি লাগছে আজকে নিবিড় জেগে আমাকে দেখবে এটা ভেবে। কিন্তু তবুও আমি আজ থাকব। আজ নিবিড়ের পাশে বসলাম। নিবিড় আমাকে ওর জন্য হসপিটালে দেখলে ভাববে আমি ওর প্রেমে পাগল হয়ে এসেছি‌। আমি নিবিড়ের পাশে বসে নিবিড়ের ব্যান্ডেজ করা কপালে আঙুল ছুয়ে দিলাম। সামনে থেকে পেছনদিকে ফিরে আমি নিবিড়ের ভাঙ্গা ব্যান্ডেজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম ছলছল চোখে। চোখ মুছে আমি নিবিড় এর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।

নিবিড় ঘুমিয়ে ছিল হঠাৎ ঘুমের মধ্যে ওর মনে হলো ওর পাশে কেউ বসে আছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। ওর মাথায় স্পর্শ করছে
ও চোখ পিটপিট করে তাকালো। চোখের পাতা মেলতেই সামনে দৃশ্যমান হলো একটা পরিচিত প্রিয় মুখ। প্রিয় এক জোড়া চক্ষুদ্বয় অপলক চোখে ওর পানে তাকিয়ে আছে। কি গভীর সেই দৃষ্টি! চোখে কুলটিতে অশ্রু জমে আছে। মুখটা মায়াবী। ওকে ঘায়েল করা সেই শ্যামবর্ণ মেয়েটি। যে মেয়েটা ওকে সহ্য করতে পারেনা বলে সেই মেয়েটা ওর অসুস্থতায় ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাজারো দুশ্চিন্তা নিয়ে। এই চোখ মুখ বলে দিচ্ছে এই মেয়েটার মনে ওর জন্য প্রবল ভালোবাসার আছে সেই জানান দিচ্ছে।

এদিকে নিবিড় কে আচমকা তাকাতে দেখে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। চোখ সরিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। তা দেখে নিবিড় নিচু স্বরে বলল, ‘ উঠলে কেন? বসে থাক আমার পাশে। ভাল লাগছিল ত।’

আমি আবার বসে পরলাম নিবিড় এর পাশে।আর বললাম,’ আপনার কথা বলা বারণ আছে তাই একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারছি না। আমি চাচ্ছি না আমার জন্য আপনার ক্ষতি হোক‌!’

নিবিড় আমার কথা শুনে হাসল তারপর বলল, ‘ বাহ আমার জন্য এত চিন্তা। এবার অন্তত বলতে পারবে না তুমি নিবিড়কে ভালোবাসা না সহ্য করতে পার না।’

আমি বিরক্তিকর কন্ঠে বললাম,’ ফালতু কথা এবার দয়া করে অফ করেন। আপনার এত কথা বলা এখন ঠিক না।’

‘অসুস্থ হলে এত টেনশন করবা জানলে আগেও জেনে শুনে কয়টা এক্সিডেন্ট করতাম।’

আমি রাগান্বিত স্বরে বললাম,’ আপনি আর একটা কথা বললে আমি কিন্তু চলে যাব।’

নিবিড় অভিমান কণ্ঠে বললো, ‘আচ্ছা আর একটা কথা বলবো না। চুপচাপ শুধু তোমাকে দেখব।তুমি তবু যেও না। কতদিন পর প্রিয় মানুষটাকে দেখছি। তোমাকে দেখেই আমি যেন অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছি। এই কয়দিন কি অবস্থায় কেটেছে আমার চার দেয়ালে হসপিটালের বেডে।’

নিবিড়ের অসহায় মুখটার দিকে আমি এক নজর তাকিয়ে স্যুপের বাটে হাতে নিয়ে নিবিড়ের পাশে বসলাম। নিবিড় আমায় দিকে পলক হীন চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের যেন পলক ফেলছে না। অস্বস্তি লাগছে কিন্তু নাও করছি না অসুস্থ মানুষ বলে আমি আজকে আর এই তাকানোটা সহ্য করছি দাঁতে দাঁত চেপে।

‘হা করুন। আমাকে দেখে তো আর পেট ভরবে না। খেতে হবে, সুস্থ হতে হবে।’

‘পেট না ভরলে ও মন তো ভরবে।’

আমি বললাম, ‘ মন ভরা দিয়ে কি সুস্থ হতে পারবেন। হা করুন। ‘

নিজের হা করল আমি ওর মুখে খুব সাবধান সহিত স্যুপ ঢেলে দিলাম। শুয়ে থাকায় হয়তো নিবিড়ের খেতে কষ্ট হচ্ছে। কিছু করার নেই এত বড় আঘাতের পর মাথা তুলে বসার অনুমতি নাই। আর এটা ঠিক হবে না। দাঁড়াবে কবে জানিনা কিন্তু বসার অনুমতি হয়তো আরো কয়েকদিন পর পাবে।

নিবিড়ের মুখ খালি হতে আমি ওর মুখে স্যুপ ঢেলে দিচ্ছি ও কিছু বলতে চাচ্ছে আমার মনে হয়। কিন্তু আমি মনে হয় কথা টা আঁচ করতে পেরেছি কি জিজ্ঞেস করবে। তাই আমি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে খাবার দিয়ে মুখ দিয়ে আটকে দিচ্ছি তা দেখে নিবিড় এবার ডানহাতে আমার চামচ ধরে রাখা হাতটা চেপে ধরল। নিবিড়ের স্পর্শ হাতে পেয়ে আমি চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। চোখ মেলে তাকালাম নিবিড় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুনলাম তুমি নাকি আমাকে খুব মিস করেছ। আমার জন্য অনেক কেঁদেছো। আবির কে নাকি অনেক ধমকা ধমকি করেছো খবর দেয় নি বলে।’

আমি অপ্রস্তুত চোখে তাকালাম নিবিড়ের দিকে। নিবিড়ের মুখে দুষ্ট হাসি ছেলেটাকে হাসলে সুন্দর লাগে। প্রচুর রাগ হল আবিরের উপর এসব কথা বলার কি প্রয়োজন নিবিড় কে। আমি অস্বীকার করে বললাম, ‘মোটে না আমি আপনার জন্য কাঁদবো কেন? আমি তো খুব শান্তিতে ছিলাম এই কয়দিন। আপনার জ্বালা যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়নি। খুব শান্তিতে ছিলাম কোন প্যারা ছিল না! ‘

‘মিথ্যা বলছো তুমি তো আমার চিন্তায় ঘুমাতেই পারোনি। এই যে তোমার চোখের এই কালো দাগ তো বলে দিচ্ছে। আমার প্যারাগুলো তোমার কাছে ভালোবাসা। আমার সামনে তুমি বিরক্ত নাক মুখ কুঁচকে থাকো রাগী রাগী করে তাকাও আমার দিকে। কিন্তু আমার আড়ালে তুমি ঠিকই মুচকি হাসো, আনন্দিত হও খুশি হও।’

কথা বলতে বলতে নিবিড় কে আমি অর্ধেকের বেশি স্যুপ খাইয়ে দিছি। নিবিড় একটা দুইটা করে কথা বলছে। আমি ২-৩ বার মানা করেছি কিন্তু নিবিড় কথা বলছেই।

হঠাৎ নিবিড়ের চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। নিবিড় জানি কেমন ছটফট করতে লাগলো। নিবিড়ের ফর্সা মুখটা আচমকায় লাল হয়ে উঠলো। নিবিড় কষ্ট পাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কেন? আমি ব্যস্ত কন্ঠে নিবিড় কে জিজ্ঞেস করলাম,, ‘কি হলো আপনার? এমন করছেন কেন?’

নিবিড় কথা বলতে পারছে না তবু ও অনেক কষ্টে বলল, ‘ডাক্তার ডাকো মাথার ব্যথা করছে প্রচুর আমি সহ্য করতে পারছি না।’

আমি আঁতকে উঠলাম ভয়ের চোটে দৌড়ে আমি বেরিয়ে এসে ডাক্তারকে ডাকলাম অনেক কিন্তু কোন ডাক্তার বা নার্স কেউ এগিয়ে আসলো না। লাঞ্চ টাইম সবাই খেতে গেছে‌। আমি এক আয়া পেলাম। তার থেকে জানতে পারলাম ডাক্তার নাকি ক্যান্টিনে আছে। তাকে পাঠালাম আমি আবার নিবিড়ের কাছে আসলাম। এখানকার নার্স গুলো কেমন অকৃতজ্ঞ এভাবে পেসেন্ট একা রেখে সবাই খেতে চলে গেছে। কাছাকাছি থাকা উচিত ছিল তাদের। দরকার কাউকে পাওয়া যায় না। আমি নিবিড়ের কাছে এসে কান্না করে দিলাম। নিবিড়ের কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। কথা বলার জন্য এমন হচ্ছে হয়ত।

আমি কান্না গলায় বললাম, ‘ এত কথা কেন বললেন এখন কষ্ট পাচ্ছেন কত।’

ডাক্তার আসল দৌড়ে। ডাক্তার এর সাথে একটা নার্স এসেছে। ডাক্তার এসে নিবিড় কে একটা ইনজেকশন দিল। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখল আমি ছাড়া আর কেউ। ডাক্তার আয়াকে জিজ্ঞেস করল এই রুমের নার্স ক‌ই!
আয়া বলল জানে না। ডাক্তার বলল, ‘ পেশেন্ট এর খেয়াল না রেখে কোথায় হাওয়া হয়েছে উনি আসলে আমার কেবিনে পাঠাবি‌।’

আয়া মাথা নাড়াল। এবার ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ উনি কি বেশি কথা বলেছিল?’

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘ হ্যা। ডাক্তার নিবিড় কি সুস্থ আছে?’

‘ বেশি কথা বলার জন্য মাথায় চাপ পেরেছিল এজন্য ব্যাথা বেড়ে গেছিল। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে কমে আসবে। এখনি এত কথা বলা উচিত নয়। তাহলে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।’

‘ আমি মানা করতে ছিলাম শুনেনি। আমার জন্য এসব হয়েছে আমার এখানে আসা উচিত হয়নি সরি ডাক্তার।’

আমি হসপিটালের থেকে বেরিয়ে এলাম। আবিরের সাথে নিচে আমার দেখা হয়েছিল। ওকে বলেছি তোমার ভাইয়ার কাছে যাও তাকে ছেড়ে এক মিনিটের জন্য সরো না।

#চলবে…..