#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪০ক]
____________________
” আমার কোন মেয়ে নেই।আমার কোন মেয়ে ছিল না।”
তীব্র অভিমান এবং রাগ নিয়ে কথাটি বললেন অনুর বাবা বেলায়েত।দোলন ঝাপসা চোখে তাকালেন বেলায়াতের দিকে নিজের স্বামীর জেদ সম্পর্কে তিনি অবগত যখন একবার বেলায়াত অনুকে বের করেছে তখন কোন মতে এই মেয়েকে বাড়িতে তুলবে না।তিনি আগেই সন্দেহ করেছিলেন অনুর কোথাও কোন সম্পর্ক আছে সবচেয়ে বড় কথা যখন আঁচ করতে পেরেছেন রাসেলের সঙ্গে মেয়েটার কিছু চলছে তখনি স্বামীকে সতর্ক করলেন।ভালো ঘর দেখে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।কিন্তু তার আগেই তাদের সব জল্পনা কল্পনায় ভাটা পড়লো।
” এ যে আপনার রাগের কথা তা আমি বুঝতে পারছি।আমাদের ছেলে কি আপনার মেয়ের জন্য যোগ্য নয়?সবচেয়ে বড় কথা তারা দুজন দুজনকে পছন্দ করেছে তারা তাদের ভালো বুঝেছে এর মাঝে…”
” আমার মেয়ে কোন খেলনা চেয়ে বায়না করেনি যে তাকে আমি সঙ্গে সঙ্গে এনে দেবো এটা তার সারাটা জীবনের প্রশ্ন।মাফ করবেন আমি আপনাদের সাথে আত্মীয়তা করতে চাই না। ”
মাহমুদা মাথা নোয়ালেন ঈশানের দিকে তাকালেন আড় চোখে।ছেলেটা কেমন শক্ত মুখ করে তাকিয়ে আছে সম্মুখে থাকা মানুষগুলোর দিকে।
” আমাদের পরিবার আমাদের ছেলের একটা কারণ দেখান যা আপনার মেয়ের অযোগ্য।”
” রাসেল ছেলেটা কী আপনার নিজের সন্তান?সে তো আপনার নিজের সন্তান নয়।আদৌ তার জন্ম পরিচয় ঠিক আছে নাকি….”
” হয়েছে।অনেক হয়েছে এবার দয়া করে চুপ করুন আঙ্কেল।”
ঈশানের অনুরোধে থমকে গেলেন বেলায়েত।রাগে ক্রমশ ফুঁসছে ঈশান।রাসেলকে নিয়ে কেউ কোন কথা বললেই চামড়ায় জ্বলন ধরে ঈশানের, সেখানে তার জন্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছে!ঈশান দাঁড়িয়ে পড়লো কিঞ্চিৎ হেসে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
” সময় দিলাম চব্বিশ ঘণ্টা। ঠিক শেষ সময়ে আপনাদের মতামত চাইবো আশা করি এই মতামত ইতিবাচক হবে আর হতেই হবে।”
১০৩.
মায়ের কোলে মাথা রেখে নিশ্চুপ শুয়ে আছে ঈশা।সুলতানা খুটিয়ে খুটিয়ে মেয়েকে দেখছেন হাতে পায়ের ব্যান্ডেজগুলোর দিকে তাকালে কলিজায় মোচড় দেয়।দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে অনুর চুলে হাত বুলিয়ে তিনি বলেন,
” ঈশু মাকে সত্যি কথা বলবি?”
“বলো।”
” ঈশান ভালো তো?তুই সুখে আছিস তো?”
” হ্যাঁ ভালো।ওই বাড়ির প্রত্যকটা মানুষ ভালো শুধু ঈশানের ফুফু ছাড়া।”
” ফ..ফুফু কেন তিনি ভালো নন?”
” কথায় কথায় আমাকে বিভিন্ন ভাবে অপমান করেন।আর ঈশান কি করে করে জানো?পালটা অপমান করে দেয় উনাকে।ঈশান সারাক্ষণ আমায় তার চোখে চোখে রাখে।”
” কেন রাখে তুই বুঝিস না?নিশ্চয়ই ঈশানের কু-কর্ম নিয়ে কিছু বলে কি না সেই জন্য তোকে চোখে চোখে রাতে।”
” কু-কর্ম?ঈশানের ব্যপারে আমার সব জানা আর ওর কাজিনকে রেপ করার বিষটি মিথ্যা আম্মু।লিজা নিজে আমাকে তার সম্পর্ক বলে।যা যা বলে এসব শুনলে তোমার গা গুলিয়ে উঠবে।”
” মা আমার মন ভালো সায় দিচ্ছে না।তুই বরং নিজের জীবনটাকে আলাদা সাজিয়ে নে।”
” আলাদা সাজাবো?কি বলতে চাও তুমি?এসব আমার শুনতে ভালো লাগছে না আমি গেলাম।”
ঈশা পা খুড়িয়ে চলে গেলো নিজের রুমে।ঈশান ল্যাপটপ হাতে বসে বসে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে।অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিনা ঈশা জানে না তবে ছেলেটার মুখের ভাব ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে।
” আপনি কী ব্যস্ত?”
” না গো কাছে আসো।মুড খারাপ হয়ে গেছে নাকি?আন্টি কিছু বলেছে?”
ঈশা নীরবে ঈশানের পাশে বসলো।হাতের ল্যাপটপটা দূরে সরালো ঈশান।ঈশাকে টেনে নিলো আরো কাছে।
” পায়ে ব্যথা করছে?”
” না।”
” অনু কোথায়?”
” ফোনে কার সাথে যেন ঝগড়া করছে নিশ্চয়ই রাসেল ভাইয়ার সাথে।”
” ফাদার ইন ল আজ কি করেছে জানো?অয়নকে ইচ্ছা মতো শাসিয়ে এসেছে।আমি তার সাথেই ছিলাম তবে নীরব দর্শক হয়ে।আশা করছি আর সাহস করবে না তাছাড়া আমি তো আছি।”
ঈশা চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ব্যান্ডেজ করা পায়ের দিয়ে।ঈশান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এই মুহূর্তে আর কথা বলার ইচ্ছে শক্তি নেই নিগূঢ় নিশ্চুপ অনুভব করাই শ্রেয়।আচমকা নড়ে চড়ে উঠলো ঈশান ঈশার হাত চেপে বলে,
” আজ একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটেছে তোমার চাচাজান আমার অফিসে এসেছে কেন জানো?”
” কেন?”
” টাকার জন্য।”
” দিয়েছেন?”
” পা গ ল নাকি?তোমার বাবাকে সাক্ষি রেখে আশি লক্ষ টাকা মেরে দিয়েছিল সেদিনের কথাগুলো তো ভুলে যাওনি।তোমার চাচার সাথে আমার ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল আমরা একে অপরের পার্টনার ছিলাম।তোমার চাচা একটু বেশি অহংকারি মানুষ ছিলেন টাকাকে গাছের পাতার মতো উড়িয়েছেন।যখন ব্যবসায় ধরা খেল তখন আমাকে বলল পর্যাপ্ত টাকা দিতে সে নাকি ঘুরে দাঁড়াবেই আর আমার টাকাও শোধ করবে।প্রচন্ড বিশ্বাস করতাম তাকে তাই তো নিঃসন্দেহ এতগুলো টাকা দিয়েছিলাম।উনি তো আমার টাকা ফিরিয়ে দিলেনি না বরং পালিয়ে গেলেন।জানো আমি সেই দিনগুলো কতটা জটিলতায় কাটিয়েছি?ব্যাংক লোন সহ অনন্য দেনায় আমি তো দেউলিয়া হওয়ার পথে ছিলাম তোমার চাচাকেও খুঁজে পাইনি তাই বাধ্য হয়ে তোমার বাবাকে ধরেছি।”
“চাচার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।রাখতেও চাই না অহংকারে মাটিতে পা পড়েনা তার।”
” আমি তাকে অফিসে দেখেই মিষ্টির অর্ডার বললাম।বেশ আরাম করে মিষ্টি খাইয়ে শেষে প্রকাশ করলাম তোমার আমার বিয়ের কথা।যদি এমন একটা গন্ডোগোল না হতো তোমায় আমি পেতাম?”
ঈশান চট করে চুমু খেলো ঈশার গালে ঈশা হাসলো নিঃশব্দে।
“ঈশা আমাদের বিয়ের কথা শুনে তার মুখটা শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেছে।”
” আমার অনুর জন্য চিন্তা হচ্ছে মেয়েটার জীবনে এভাবে বিপদ বয়ে এলো।”
” তুমি এই নিয়ে কোন চিন্তাই করবে না।অনুর ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে সে বলেছে ব্যপারটা দেখছে আর যদি সে রাজি করতে না পারে তবে আঙুলটা বাঁকাতে হবে।”
” কী করবে তুমি?”
” অনুর ভাইয়ের কর্মক্ষেত্রে একটু সুতা নেড়ে দেবো তারপর দেখবে অনুর বাবা তো দূরের কথা তার পুরো বংশ সোজা হয়ে যাবে।উনারা অহেতুক জেদ ধরে বসে আছেন।তাদের একটাই জেদ অনুর পছন্দ করা কোন ছেলেকে জামাই হিসেবে মেনে নেবেন না।”
১০৪.
সময়টা চোখের পলকে পেরিয়ে গেলো।এই সময়টুকু কার জন্য কেমন ছিল অনুর জানা নেই তবে তার কাছে যুদ্ধের ময়দানের চেয়েও কম মনে হয়নি।প্রায় চারদিন কসরতের পর অনুর পরিবার রাজি হয়েছে রাসেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে।অনু ফিরে গেছে তাদের বাড়ি তবে কেউ তার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে একটা কথাও বলছে না।যতটুকু কথা বলার অনুর চাচী এসে বলছেন।আজ মেয়েটার গায়ে হলুদ।মাহমুদার ইচ্ছে ছিল দুই ছেলের একসাথে বড় করে বিয়ের আয়োজন করবেন তবে তা আর হলো কই?অনুর পরিবারের অনিচ্ছায় কোন কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না।তবুও ছেলের কথা স্বল্প আয়োজনে মেয়ে বিদায় করছেন বেলায়েত।হলুদের অনুষ্ঠান করা হয়েছে অনুদের ফ্লাটের ছাদে।হলুদ শাড়ি পড়ে মুখটা ছোট করে বসে আছে অনু।তার কাজিন সদস্যরা এটা ওটা বলে হাসানোর চেষ্টা করছে তবে তার মুখে রা নেই।ঈশা পড়েছে ফ্যাসাদে, একদিকে দেওরের বিয়ে অন্যদিকে একমাত্র প্রিয় বন্ধুর বিয়ে কোন দিকে যাবে সে?হলুদ পাঞ্জাবি পরনে হাতা গুটিয়ে ঈশার সামনে দাঁড়ালো দিহান।অনুর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ঈশাকে বলে,
” এই বাদরটা সারাদিন দাঁত কেলিয়ে থাকে আজ মুখে স্কচটেপ মেরেছে কেন?”
” তুই জানিস না তার মনের অবস্থা?”
” রাখ তো।বাঙালি বাবাগুলার এই এক দোষ কখনো ছেলে মেয়ে পছন্দ করা পাত্র পাত্রী তারা মানতে চায় না।কেন চায় না এই সাইন্স বোধহয় আদৌ আবিষ্কার হয়নি।এই অনু আগে পরে যা হবার হবে এখন এঞ্জয় কর।বিয়ে একবারি করছিস অনুষ্ঠানো একবারি হবে বুঝলি?”
দিহানের কথা শুনে অনু হেসে ফেললো।সত্যি সত্যি তার এখন ভালো লাগছে মনে হচ্ছে মনের কোণে সাহস সঞ্চয় হয়েছে।ঈশা আগাগোড়া পরখ করলো দিহানকে দিহানের হাত টেনে সে বলে,
” বিশ্বাস কর তোকে এত সুন্দর লাগছে যদি অবিবাহিত হতাম এক্ষুনি তোকে বিয়ে করে ফেলতাম।”
” তো এখন কর কে কী বারাণ করেছে?অবশ্য তোর জামাই যা চিজ আমার হাড্ডিগুড্ডি কোন দেশে পা চা র করবে সে নিজেও ধারণা করতে পারবে না।মাফ কর তোকে বিয়ে করার স্বাদ নেই।”
.
” তোর মাথা ঠিক আছে?আমাকে সং সাজাতে উঠে পড়ে লেগেছিস কেন?”
“তোকে বোরকাটা পরতে বলেছি পর।এক্ষুনি পরবি।”
ঈশানের নির্দেশে বোরকাটি হাতে তুলে নিলো রাসেল।আজ ছেলেদের বাড়ির সবার পোশাকের রঙ নির্ধারিত হয়েছে সবুজ অপরদিকে মেয়ে পক্ষের হলুদ।সেই হিসেবে রুমা রাসেলকে একটি সবুজ রঙের বোরকা এনে দেয় পড়ার জন্য আর এর মূল উদ্দেশ্য হলো গায়ে হলুদে রাসেলকে তারা নিয়ে যাবে সবার আড়ালে।এতক্ষণ যাবৎ ঈশান রাসেলকে এই বোরকাটি পরাতে জোর কসরত করছে কিন্তু রাসেল এতে কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না।
” ঈশান দয়া কর আমার ইজ্জত ফালুদা করিস না।আমি বোরকা পরতে পারবো না।”
” তোর বিয়ে ক্যান্সেল করে দিবো।পর এক্ষুনি বোরকা পর।অবশ্য তুই যে খাম্বা জাতি বুঝে ফেলবে বোরকার আড়ালে এটা আস্ত একটা ব্যাটা মানুষ।”
” তাই তো বলছি পরবো না।”
” না তুই পরবি তোকে পরতেই হবে।”
.
বর যাত্রী থেকে খুব একটা বেশি মানুষজন আসেনি।যেহেতু বিয়ের আয়োজন ঘরোয়া হচ্ছে তাই পরিবারে কাছের সদস্যরাই এসেছে।অতিথি আসতে দিহান কাজে লেগে গেলো ঈশান ঈশাকে পেয়ে হাত টেনে নিয়ে যায় ছাদের এক কোণে।
” এত সুন্দর লাগছে কেন?আল্লাহ আমি শেষ।”
” এখন প্রেম প্রেম পেয়ে লাভ নেই চলুন স্টেজের দিকটা সামলাই।”
” না একটা দিব বেশি না।প্লিজ একটা দি?”
” দিয়ে কোন লাভ নেই যে পরিমানে মেকাপ লাগিয়েছি আপনার সাংঘাতিক লেভেলের চুমুতে আমার সব মেকাপ কেকের মতো গলে যাবে।ছাড়ুন এক্ষুনি আমার হাত ছাড়ুন।
বাধ্য হয়ে ঈশান ছেলে দিলো ঈশার হাত।ঈশা এক ছুটে চলে গেলো স্টেজের সামনে।রুমার পাশে বোরকা পরা একটি মেয়েকে দেখে ভ্রু যুগল কুচকে গেলো ঈশার।
” রুমাপু উনি কে?”
” আ..আমার খালা শ্বাশুড়ি।”
রসগোল্লার ন্যায় বড় বড় চোখ করে পর্দার আড়ালে তাকালো রাসেল।রেদোয়ান তার পাশে বসে ঠোঁট চেপে হাসছে।রাসেলকে আগাগোড়া সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছে তার চোখ দুটোও নিকাবের সাহায্যে ঢাকা আর তাই তো তাকে চিনতে পারলো না ঈশা।আজকের হলুদ অনুষ্ঠানে লিপি আসেনি তবে লিজা একটি লেহেঙ্গা পরে এসেছে এতদিন ওয়েস্টার্ন পোশাকে দেখলেও আজ মেয়েটাকে একটু সাজসোজ্জায় দেখে চমকে গেল ঈশা।মন্দ লাগছে না বরং নজর কাড়া সুন্দর লাগছে!
” তোমাকে সুন্দর লাগছে লিজা আপু।”
” থ্যাংস।তোমাদের এদিকে ছেলেগুলো কেমন যেন।”
ভ্রু কুচকে এলো ঈশার।সন্দিহান কণ্ঠে লিজাকে বলে,
” কেমন?”
” বুঝবে না তুমি, যাও।”
ঈশা চলে গেলো।অনুকে একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়ালো বাকি রইলো রাসেল।রুমা তাকেও পাঠালো অনুকে হলুর ছোঁয়াতে।রাসেলের উচ্চতায় সকলের মনে সন্দেহের বাতি জ্বলে যায় যতই হোক গঠন রীতির দিক থেকে তাকে আলাদা সনাক্ত করাই যায়।অনুর পাশে চেপে বসলো রাসেল।মোজা পরা হাতে একটু হলুদ তুলে ছুঁয়ে দিলো অনুর গালে।দিহানের মনে সন্দেহ জাগলো সে চুপিচুপি রাসেলের পাশে গিয়ে নিকাব টেনে ধরতেই রাসেল চিল্লিয়ে বলে,”টানে কে রে?” তৎক্ষনাৎ হা হয়ে গেল অনুর মুখ।আশেপাশে সবাই তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলো।দিহানের সন্দেহটাই ঠিক ছিল বোরকা পরা ব্যক্তিটি রাসেল। তাই তো সে দেরি করলো না একে একে টেনে খুললো সব।অনু আবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মাথায় হাত দিয়ে রাসেলের দিকে চোখ পাঁকিয়ে সে বলে,
” লাজ লজ্জার মাথা খেয়েছো?”
” আমি এসব করিনি ঈশান আর রুমা আপু বাধ্য করেছে।”
১০৫.
কক্ষের দ্বার রুদ্ধ করে অনেকক্ষণ যাবৎ ফোনে ঝগড়া করে যাচ্ছে লিজা।ফোনের অপর পাশের ব্যক্তিটি নিশ্চয়ই কোন ভীনদেশি।বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে তালে তাল মিলিয়ে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটির সাথে বোঝাপড়া করছে সে তবে প্রতিবার ব্যর্থ মেয়েটা।তার ব্যর্থার প্রমাণ দিচ্ছে লিজার মুখের অঙ্গভঙ্গি।
” সিড বাড়াবাড়ি করো না।তুমি আমায় ভুল বুঝছো।”
” কিসের ভুল?অলরেডি তিনজন ছেলের সাথে তোমার ছবি পেয়েছি।প্রতিটা আপত্তিকর ছবি ছিল।তুমি আমায় ঠকিয়েছো লিজা।এর মূল্য তোমায় দিতেই হবে।”
” সিড আমায় বিশ্বাস করো একটু বিশ্বাস করো আমি সত্যি তোমায় ভালোবাসি।”
” আমিও বাসি আমি আমার কাজকে,পরিবারকে ভালোবাসি তারপর ভালোবেসেছিলাম তোমায়।জীবনে অনেকটা গুরুত্ব দিয়েছি তোমায় কিন্তু দিন শেষে এভাবে ঠকালে।”
” তুমি জানতে আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল কিন্তু এখন এসব উঠছে কেন?”
” উঠছে কারণ….”
অতি দ্রুত ফোন কাটলো লিজা।দ্রুত ফোনটা ছুড়লো বিছানায়।অনন্য বয়ফ্রেন্ডের চেয়েও সিডের প্রতি লিজার মায়া প্রখর।চলমান কয়েকজনের সাথে এখন আর সম্পর্ক রাখার ইচ্ছে নেই আপাতত সিড হলেই তার চলবে।কিন্তু এই ছেলেটা মাঝ পথে এসে ঝামেলার সৃষ্টি করলো!বেশি বাড়াবাড়ি করলে একেও রাখা যাবে না।যত দ্রুত সম্ভব এই দেশ ছাড়তে হবে এখানে বড্ড দম বন্ধ লাগে লিজার।
করাঘাতে ধ্যান ভাঙলো লিজার।দ্রুত নিজেকে পরিপাটি করে দরজা খুলতে দেখতে পেলো আবিদ শাহরিয়ারকে।
” কিছু বলবে মামা?”
” হুম।”
” ভেতরে আসো।”
আবিদ চুপচাপ প্রবেশ করলেন কক্ষে।লিজা দ্বাররুদ্ধ করে দাঁড়ালো তার মামার মুখোমুখি।আবিদ শাহরিয়ার এক পলক লিজার দিকে তাকিয়ে বলেন,
” আমার ছোট ছেলের বিয়েটাও সম্পূর্ণ হবে।রইলে বাকি তুমি এবার পছন্দ মতো ছেলে দেখে বিয়ে করে নেওয়া উত্তম।অন্তত লিপি যেন আমাকে আজীবন খোঁটা দিতে না পারে তার মেয়েকে বানের জলে ভাসিয়ে দিয়েছি। আমি আমার ছেলের চেয়েও তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম লিজা, তোমাকে বিশ্বাস করে আমি ঠকে গেলাম।আমার ছেলেটা এত বছর রইলো দূরে দূরে সত্যিটা যদি তোমার জানানোর হতো এত বছরেও জানালে না কেন?”
” ঈশানের সংসারে আমি ঝামেলা চাই না।সবচেয়ে বড় কথা আমি ঈশানকেই চাই না।মমের জেদ ঈশানের সংসারে ঝামেলা পাঁকাবে কিন্তু এসব থামা জরুরি।আমি আগেই বলতে চেয়েছি সত্যটা মমের কারণে বলতে পারিনি।তিনি প্রতি বার আমাকে আ ত্ম হ ত্যা র হুমকি দেন।”
” জানো আমার মন কি চাইছে?তোমাদের দুটো চড় লাগিয়ে বের করতে মন চাইছে।খবরদার লিজা আমার ছেলেদের সংসারে যেন কোন অশান্তি না হয় যে ঝামেলা তোমরা সৃষ্টি করেছো তা তোমরাই শেষ করবে।
#চলবে___
#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪০খ]
______________________
” আপনার ছেলে আমার মেয়ের জীবন শেষ করেছে আর এখন আপনি করছেন।আমাদের কথা দিয়েছিলেন ভাইয়া সেই কথা রাখতে বাধ্য আপনি।”
” কথা দিয়েছিলাম তবে ভুল বিষয়ে দিয়েছিলাম এখন ফিরিয়ে নিচ্ছি।”
” ভাইয়া আমার মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন আপনারা।একজন মায়ের অভিশাপ কখনো বিফলে যায় না।”
” তোমার মেয়ের জীবন কী ধ্বংস করেছি আমরা?তুমি বিয়ে করেছিলে রাস্তার একটা ছেলেকে যার ছিল না কোন বংশ পরিচয় আর না ছিল বাড়ি ঘর।আব্বা আম্মা ত্যাজ্য করেছিল তোমায়।বাচ্চাটা বড় না হতে বাবা হারালো সেই ভাসমান জীবন থেকে কূলে এনেছিলাম আমি।একটা সুন্দর জীবনে যতটু প্রয়োজন সবটা দিয়েছি আর এখন বলছো তোমাদের ধ্বংস করেছি?তবে বেরিয়ে যাও এক্ষুনি বেরিয়ে যাও।অনেক তো হলো ভুল বোঝাবুঝির নাটক এবার আমি আমার স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখী হতে চাই।”
লিপি চমকে গেলেন।আড় চোখে তাকালেন তার ভাইয়ের দিকে।হঠাৎ কি কারণে আবিদ শাহরিয়ারের এত পরিবর্তন জানা নেই তার।এভাবে যদি চলতে থাকে তবে এতদিনে যাবৎ পরিকল্পিত ঘটনা গুলো একে একে ভেস্তে যাবে।
” ভাইয়া খোঁটা দিয়ে দিলেন!এভাবে যে বলতে পারবেন কোনদিন আশা করিনি।”
” আমিও আশা করিনি ত… ”
আবিদ শাহরিয়ার থেমে গেলেন।আজ ছোট ছেলের বিয়ে এই মুহূর্তে কোন ঝামেলা চান না তিনি।সবকিছু সুষ্ঠ ভাবে সম্পূর্ণ হোক দেশ ছেড়ে যা করার করা যাবে।বাড়ির নতুন বউদের সামনে সম্মান হানি করার কোন মানে নেই।
১০৬.
বিয়ে নিয়ে অনুদের পরিবারের বড়দের কোন আগ্রহ নেই বললেই চলে।সবার আচরণে প্রতিবার গলা ধরে আসছে মেয়েটার।কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে ক্ষণে, সে তো ভাবেনি এমন কিছু হবে পরিবার তাকে এক নিমিষে পর করে দিল!ঈশা বার বার সান্ত্বনার বানী গাইছে ‘সবটা ঠিক হয়ে যাবে’ আদৌ কি ঠিক হবে?যতটুকু পারা যায় ঈশা তার সর্বোচ্চটা দিয়ে অনুকে সাহায্য করে গেছে।মেয়েটার মন খারাপের সঙ্গী হলো ঈশা। আজকের পর এই সম্পর্কের নতুন নাম হবে একে অপরের জা হবে।পার্লার থেকে ফিরে চুপচাপ বসে আছে অনু বর যাত্রী এসেছে বলে সবাই বেরিয়ে গেছে।
বর বেশে উপস্থিত রাসেল তার শুভ্র মুখশ্রীতে মিশে আছে লজ্জার হাসি।ঈশান তার পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে তাকিয়ে আছে ঈশার পানে।মেয়েটা আজ আবার গেটে দাঁড়িয়েছে ঈশান নিশ্চয়ই বউয়ের প্রতি গলে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বসবে ভাবতেই পেটে মোচড় দিলো রাসেলের।
” আপনারা এখানে কেন দাঁড়িয়েছেন?আমাদের মুক্ত হস্তের দান গ্রহণ করার জন্য?”
ঈশানের কথায় ঠোঁট বাঁকালো ঈশা।হাতের কাচিটা ঘুরিয়ে বলে,
” কথা সামলে বলুন ভাইয়া।আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি আপনার ভাইকে সাদরে গ্রহণ করতে, বরণ করতে আর আপনি কিসব বলছেন।”
” ভাইয়া!ভাইয়াটা কে?”
” কেন আপনি?”
” আমি তোমার ভাইয়া হই?এই ফা জি ল মেয়ে এসব কী বলো?”
” এতকিছু শুনতে চাই না।আমাদের একটা দাবি আছে।”
” শুনতে চাই না তোমাদের দাবি।শুরুতেই মন মে রে দিয়েছো।”
” আরে শুনুন।”
” না শুনবো না।”
” ঈশান বাড়াবাড়ি করছেন।আমার সাথে রাগারাগি করলে কিন্তু আপনাদের গেটেই ঢুকতে দিব না।”
” কি করবে জান?বলো কি করবে?”
ঈশান কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলো ঈশার কাছে।ঈশা দু’কদম পিছিয়ে যেতেই লাল ফিতার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়লো ঈশান তার পিছু পিছু প্রবেশ করলো ছেলে পক্ষের সকলে।মেয়েপক্ষের সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে অপরদিকে ছেলেদের আনন্দ উল্লাসের মিছিল চলছে।রেগে গিয়ে ঈশানের গায়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করলো ঈশা তার হাত টেনে ধরলো ঈশান মেয়েটা এতটাই ক্ষেপে গেছে যে তার দু’চোখ ইতোমধ্যে জলে ঝাপসা হয়ে গেছে।
” আপনি এটা ভালো করলেন না ঈশান।আমায় আপনি দুঃখ দিলেন।”
” রাগ করে না জান।এই রে কেঁদে ফেলছে তুমি কান্না করলে আমার ভালো লাগবে?কত টাকা চাই বলো? আমার সব তোমার যা লাগবে দিয়ে দেবে।”
” আপনার টাকা আমার চাই না আমি তো রাসেল ভাইয়ের টাকা নিতে চেয়েছি।অনুর বিয়ের গেট ধরা আমার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।”
” আমরা অনুকে আবার বিয়ে দেব তুমি আবার গেট ধরবে।”
” কি বললেন আপনি”
” না না কিছু না।আমি গেলাম।”
.
অবশেষে বিয়েটা পরিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হলো।ঈশাদের বাড়ি ফেরা হলো সন্ধ্যার পর।অনুর সাথে সাথে ঈশাও শ্বশুর বাড়ি ফিরে এসেছে।
হঠাৎ মেয়ে চলে আসায় ঘরটা বড্ড ফাঁকা লাগছে মুজাহিদ হাসানের ঈশাকে এতবার ফোন করার পরেও ধরছে না তাই বাধ্য হয়ে ফোন করলো ঈশানকে।মুজাহিদ হাসানের ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসলো ঈশান।গম্ভীর্য ভাবটা কাটিয়ে একটু হাস্যরসে বলে,
” আসসালামু আলাইকুম ফাদার ইন ল ভালো আছেন?”
” আমার মেয়ে কোথায়?”
” এমন ভাবে বলছেন আমি যেন আপনার মেয়েকে কি ড ন্যা প করেছি।সালামটা নিয়ে একটু ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে কি মেয়ের কথা জানা যেত না?”
” তুমি কী লন্ডনে আছো?নাকি ইতালিতে আছো?তোমাকে দু’ঘন্টা আগেও আমি দেখেছি।আমার মেয়ে কোথায় সেটা বলো তখন থেকে ফোন করেই যাচ্ছি সে ফোন তুলছে না।”
” আপনার কাছে একটা বিচার আছে।ভালো হয়েছে ফোন দিয়েছেন না হলে আমি নিজেই দিতাম।”
” কী বিচার?”
” আপনার মেয়ে আমার সাথে কথা বলছে না।জেদ দেখিয়ে বসে আছে, প্লিজ ফাদার কিছু একটা করুন।প্রায় ছয় ঘন্টা সে আমার সাথে কথা বলছে না।বিশ্বাস করবেন না আপনি আমি এখনি দুই কেজি কমে গেছি দেখুন আমার চোখটা দেবে গেছে,গালটা ভেঙ্গে গেছে, হৃদটা শুকিয়ে আছে।”
” কি করেছো ঈশার সাথে?সে রেগে আছে কেন?”
” অনুর বিয়ের গেটে টাকা তুলতে গেছিলো তখন একটু গন্ডোগোল হয় আর টাকা তুলতে পারেনি সে।ঈশাকে আমি বলেছি আমার সব তো তোমার টাকা যত লাগে নাও কিন্তু আপনার মেয়ে এখনো রেগে আছে।ওইতো ফাদার আপনার মেয়ে আমাকে ভেংচি কেটেছে।আমি স্পষ্ট ভাষায় বলছি, এসব আমি মানতে পারবো না।আমার অনাগত সন্তানরা এসব মানবে না।আপনার নাতি-নাতনীরা তাদের মায়ের এসব কিছুতেই বরদাস্ত করবে না।”
” আরে এখানে নাতি-নাতনী এলো কোথা থেকে?
” দেখুন ফাদার ইন ল আমার সোজাসাপটা হিসেব আপনি যদি আপনার মেয়েকে না মানাতে পারেন আমি আপনাকে আজ সারারাত বিরক্ত করবো,বাড়িতে ঢিল ছুড়বো।মাদার ইন ল’কে আপনার ব্যপারে উলটা পালটা বলে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়ে ছাড়বো।”
” তুমি বেশি কথা বলো।ঈশাকে ফোনটা দাও।”
ঈশান দ্রুত উঠে গিয়ে ঈশাকে ফোন দিলো।স্কিনে মুজাহিদ হাসানের নাম্বারটা দেখে চুপচাপ ফোন হাতে তুললো ঈশা।
” বলো বাবা, তুমি ঠিক আছো?”
” জামাই কি বলছে তুমি নাকি তার সাথে কথা বলছো না।”
” ইচ্ছে হলে বলবো।তোমায় আবার বিচারো দিয়েছে!”
” না বিচার দেয়নি মা বরং হু ম কি দিয়েছে।থাক রেগে থেকো না কথা বলো।বেচারা নাকি শুকিয়ে যাচ্ছে দেখা গেলো শুকাতে শুকাতে উড়ে যাবে সৌরজগতে।”
১০৭.
রাত বাড়লো সেই সাথে সকলের ব্যস্ততা ধীরে ধীরে কমলো।দুই দিন পর বৌভাত অনুষ্ঠান হবে তাই তো আজ আর তেমন চাপ নেই।ঈশা,ঈশান,রুমা, শ্রেয়া,রেদোয়ান দাঁড়িয়ে আছে রাসেলের কক্ষের সামনে।আর রাসেল জানে তাকে এখন কি করতে হবে এরা ভদ্র ভাবে ডা কা তি করতে নেমেছে।
” প্রিয় দেওরজি ‘টাকা ঢালুন আর দরজা খুলুন’ এই শ্লোগানে আজ আমরা মাঠে নেমেছি।”
ঈশার কথায় কিঞ্চিৎ হাসলো রাসেল।গা ঝেরে হেঁয়ালি স্বরে বলে,
” আমার কাছে কোন টাকা নেই।কয়েক দিন আগে ঈশান আমার টাকা মে রে দিয়েছে।আপাতত আমি গরিব ফকির ফতুর।”
রাসেল গা ঝারা দিয়ে কথাটি বলে ঈশানের দিকে তাকালো।ঈশান গালে হাত বুলিয়ে বলে,
” এই রাসেল তুই কি আজ রাতটার জন্য সিরিয়াস না?তোর মনে কি কোন ভয় ডর নাই?তুই চিনস না আমারে?”
” হুমকি দিচ্ছিস লাভ নাই।প্রয়োজনে আজ বাইরে ঘুমাবো তারপরেও তোদের একটা টাকাও দেব না।”
রাসেলের দৃঢ়তার কাছে সকলে ঝিমিয়ে গেল।টাকা উসুল করার কোন আশার আলোই তো পাওয়া যাচ্ছে না।হেরে যাওয়া সৈন্যর ন্যায় মাথা ঝুকলো ঈশান।
” ঠিক আছে দিতে হবে না।এই দরজা থেকে সরো সবাই।”
ঈশানের নির্দেশে একে একে সবাই সরে দাঁড়ালো দরজা থেকে। সবার পাংশুটে মুখখানী দেখে রাজ্য জয়ের হাসি হাসলো ছেলেটা।বীর বেশে প্রবেশ করলো নিজের কক্ষে।সকলের মুখের উপর ধাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে কোমড়ে হাত ঠেকিয়ে হাসলো রাসেল।লাল ফুলের গালিচা পেরিয়ে বিছানায় বসলো এবং হাস্যজ্বল চোখে তাকালো লাল ওড়নায় ঢেকে থাকা প্রেয়সীর পানে মেয়েটা লজ্জায় নিংড়ে আছে।রাসেল এমনটা তো আশা করেনি ধূর্ত অনু কি না লজ্জা পাচ্ছে আশ্চর্য!তবুও মনে মনে খুশি সে বউ যদি লজ্জা না পায় তবে কীসের বউ?
” অনু গো, ও আমার অনুরূপী।”
আদুরে সুরে অনুকে ডাকলো রাসেল মেয়েটা আচমকা নড়েচড়ে উঠেছে।রাসেল এবার ঘুরে বসলো ধীরে ধীরে সরিয়ে দিলো অনুর মুখে ঢেকে থাকা লাল ওড়নাটা।সিলেবাসের বাইরে প্রশ্নে এলে যেমন চমকে যায় তেমনি চমকে গিয়ে বিকট চিৎকার করে উঠলো রাসেল।এক লাফে বিছানা থেকে নেমে তাকিয়ে থাকে বউয়ের পানে।
” নাজমুল তুই!”
আবেগের দুনিয়া থেকে ছিটকে পড়লো রাসেল।শাড়ি পরা অনুর পরিবর্তে বন্ধু নাজমুলকে দেখে কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠলো সেই সাথে হতবাক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ।নাজমুল শাড়ির কুচি ধরে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দরজা খুললো।নাটকীয় ভঙ্গিমায় শাড়ির আঁচল বুকে টেনে ভেংচি কেটে তাকালো রাসেলের পানে।সবার মুখে হাসির ঝলক।তবে সবাই মিলে রাসেলকে বোকা বানালো!ঈশান ভাব নিয়ে এগিয়ে এলো রাসেলের সম্মুখে।
” কেমন দিলাম বন্ধু?”
” ঈশান তুই আমার সাথে এমনটা করতে পারলি?”
” আমি সব পারি।”
ঈশান এগিয়ে গেলো, ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকা ছোট্ট স্পাই ক্যামেরাটি হাতে তুলে নিলো।রাসেলের কাছে এগিয়ে এসে বলে,
” সব রেকড হয়েছে তুই যদি টাকা না দিস আগামীকাল সবাই দেখবে তোর স্পেশাল বাসর।”
” তুই বন্ধু নাকি শত্রু?”
” আমি স্বার্থ বাদী।তোর বউ আমাদের আমানতে আছে।তবে আমাদের একটা শর্ত আছে।”
” কি শর্ত?”
” আমরা সবাই মিলে দুই দিনের ট্যুর দিব সব খরচ তোর।”
” যাহ দিলাম সব খরচ।কবুল বলে বউ এনেছি সেই বউ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিস তোরা।”
” উলে বাবুতা ইমোশনাল কথা বার্তা বলে লাভ নাই।যাহ আর ডিস্টার্ব করবো না তোর বউ তোর কাছে দিয়ে যাচ্ছি।”
নাজমুল টেনে টুনে শাড়িটা খুলে ছুড়ে ফেললো রাসেলের গায়ে।বেচারা রাসেল অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
১০৮.
আবিদ শাহরিয়ার যেমন ঠান্ডা মাথার লোক তেমনি রেগে গেলে তার রাগের মাথায় নেওয়া একেকটি সিদ্ধান্ত কতদূর গিয়ে গড়ায় তার ইয়াত্তা নেই।লিজা এবং তার মার কোন খরচ বহন করবেন না আবিদ শাহরিয়ার যদি লিজা ঈশাদের বাড়ি গিয়ে সত্যটা প্রকাশ না করে।তিনি দুজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন এত বছর যাবৎ ঠকিয়ে আসার জন্য একটা না একটা শাস্তি তাদের প্রাপ্যই।
লিজা কি করবে ভেবে পেল না এই মুহূর্তে মামার কথা শোনা ছাড়া আর কোন পথ বাকি নেই।
ভয়ে ধুকপুক ধুকপুক ধ্বনি তুলছে লিজার বুকে।ঈশাদের ফ্লাটে এসে তিন চারবার ডোর বেল বাজানোর পরেও দরজা খুললো না কেউ।এদিকে লিপিকে মিথ্যা বলে এসেছে সে সবকিছুর সমাধান দরকার।তবে লিপি যদি জানতে পারে লিজা সবাইকে সত্যটা প্রকাশ করছে এই মেয়েকে যে তিনি আস্ত রাখবে না তা আর বলতে বাকি নেই।বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ অপেক্ষার পর দরজা খুললেন সুলতানা লিজাকে দেখতে পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন তিনি।
” তুমি!”
” আন্টি ভেতরে আসবো?”
” আসো।তোমার আম্মু আসেনি?”
” না আসেনি।আমি একাই এসেছি একটি দরকারে।”
” হঠাৎ কি দরকার?”
লিজা ঝটপট বসে পড়লো সোফায়।তাকে বসতে দেখে মুখোমুখি বসলেন সুলতানা নিজেও।সাহস সঞ্চয় করে একে একে সব সত্যিটা প্রকাশ করলো লিজা তার কথায় কোন মিথ্যা ছিল না জটিলতা ছিল না লিপির ষড়যন্ত্র নিজের জীবনের প্রতিটি পর্যায় পর্যায়ক্রমে বর্ণনা দিল সে।সুলতানা ছিলেন নিশ্চুপ নির্বাক। নিরিবিলি পরিবেশে কিছুটা সময় পর আচমকা চপেটাঘাতের শব্দ হলো।লিজা গালে হাত বুলিয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো সুলতানার দিকে।চড়টা একটু বেশি জোরে পড়ে গেল না!
” বের’হ রাস্তার মেয়ে বের’হ বলছি।”
” আন্টি..”
” কে আন্টি?বের’হ তুই।আমার কিন্তু ভীষণ রাগ হচ্ছে বেরিয়ে যেতে বলেছি।”
” আপনি আমাকে মা র লে ন কোন সাহসে?”
” তুই যাবি না?তুই তর্ক করিস।আবার আমার সাহসের কথা জানতে চাস!দাড়া তোর জন্য গরম খুন্তিটা নিয়ে আসি।”
সুলতানা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন তিনি সত্যি সত্যি রান্নাঘর থেকে খুন্তিটা নিয়ে এলেন লিজার সামনে।এই মহিলাকে এই মুহূর্তে মোটেও বিশ্বাস করতে পারছে না লিজা আর তাই তো হাতের পার্সটা নিয়ে কোন মতে বেঁচে ফিরেছে সে।
#চলবে__
#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪১ ক]
______________________
“এখানে কেন ফোন করেছো?কাকে বাবা বলছো তুমি?তোমার কোন বাবা নেই।”
” বাবা এভাবে রাগ করে থেকো না।আমি অন্যায় করেছি বকো তাই বলে..”
” অযথা বকবকের সময় আমার কাছে নেই ফোন রাখো।ও হ্যাঁ এই বাড়িতে আসার দরকার নেই,না আসলে বেশি খুশি হব।”
একরাশ অভিমান নিয়ে ফোন কাটলেন অনুর বাবা বেলায়েত।অপর প্রান্তে অনু ঝাপসা চোখে চেয়ে রইলো দূর আকাশের পানে।কানে এখনো ফোনটা ধরে আছে।গলাটা কেমন ধরে এসেছে।বিয়ের দিন সকালে তাকে কাঁদতে হলো এতটাই হতভাগিনি সে।তবে কি নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করা এই জগৎ এর সবচেয়ে বড় ভুলের মধ্যে একটি?বাবা আমাকে পর করে দিল।অনু কান্নায় ভেঙে পড়লো।হাতের ফোনটা একটা আছাড় দিয়ে নিজের রাগ কিছুটা সংযত করলো তবে লাভ কী হলো?এখন ফোনটার জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে।
” কাঁদছো কেন?”
রাসেলের কণ্ঠে নড়েচড়ে উঠলো অনু।কান্না লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে অকপটে বলে,
” কই কাঁদছি।”
রাসেল মুখোমুখি হলো মেয়েটার।চোখের পানি মুছে বলে,
” নতুন বউ সাত সকালে কান্নাটা তার বেমানান।যে কারণেই হোক কাঁদতে পারবে না।”
” আব্বু আমাকে ওই বাড়ি যেতে বারণ করেছে।আমি তাদের পর হয়ে গেলাম।”
” বেশ তুমি যাবে না।যেতে চাইলেও আমি যেতে দেব না।তুমি সুখে থাকবে এতটাই সুখে থাকবে যে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে ভালোবেসে ভুল করোনি।”
অনু প্রত্যুত্তর করলো না।নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো রাসেলের পানে।অনু রাসেলের ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে স্বল্প স্বরে বলে,
” তুমি চুল শুকাওনি কেন?ঈশান ভাই এবার কিন্তু মজা নেবে।গতকালের চমকটা কেমন ছিল?”
” আমার ইমোশন নিয়ে খেলেছো তোমরা।জানো কতটা এক্সাইটেড হয়ে ঘোমটা তুলেছিলাম নাজমুলকে দেখে আমার কলিজাটা ছি ড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছিলো।”
” এসব ঈশান ভাইয়ার পরিকল্পনা আমরা শুধু তার আদেশ মোতাবেক কাজ করেছি।”
” উনি তো আসল নাটের গুরু।সুযোগ পেলে মশাইকে বাদর নাচ নাচিয়ে ছাড়বো হুহ।”
.
বিয়ের আনন্দের রেশ এবার কিছুটা হলেও ফিকে হয়েছে।আগের ন্যায় পড়াশোনায় মন বসিয়েছে ঈশা।অনু আর ঈশা মিলে ক্লাস শেষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে।যদিও রাসেল আজ তাদের বাসায় পৌঁছে দেবে বলেছিলো তবে তা নাকচ করেছে ঈশা।কেক তৈরির কিছু সরঞ্জাম কিনতে একটি দোকানে প্রবেশ করে তারা।ঈশা অনু সাথে টুকটাক আলোচনা করে একে একে প্রয়োজনীয় পন্য ক্রয় করছিল হঠাৎ কানে আসে চিরচেনা কণ্ঠ।অবিশ্বাস্য চোখে পাশে তাকাতে চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।
” এই ঈশা!”
” ভাবি!”
অয়নের প্রাক্তন স্ত্রী এগিয়ে এলো ঈশার কাছে।তাকে খুশিতে জড়িতে ধরে কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। তিনি ভাবতে পারেননি ঈশার দেখা পাবে।
” তুমি এখানে কেন ভাবি?তোমার তো কোন খোঁজ খবরি ছিল না।তোমার সম্পর্কে খোঁজ জানতে চেয়েও পাইনি ”
” ডিভোর্সের পর আমি আমার বাড়ি ফিরে গেছিলাম।ভাগ্যিস সেলাই জানতাম আর তার মাধ্যমেই যা রোজগার হতো নিজের খরচ চালাতাম।আমার পোড়া কপাল এই পোড়া কপালির ভাগ্যে কি আর সুখ জুটে?তবে আমি এখন ভালো আছি বেশ ভালো আছি।”
“এভাবে বলো না।দুঃখের পর সুখে মিলবে।তুমি এখানে যে?”
” কিছু দরকারে এসেছি।তুমি তো ভীষণ সুখে আছো তাই না?ঈশান ভাইয়া তোমায় চোখে হারায়।”
ঈশা চমকে গেলো।উনি কি করে জানলেন ঈশানের কথা?
” তুমি কী করে জানলে ভাবি?”
” তোমার বর আমাকে দোকান নিয়ে দিয়েছে।সেই দোকানের সেলাইর কাজ চলে, কারিগর তিনি নিজেই জোগাড় করে দিয়েছেন।কেন তুমি এসব জানো না?”
” কই না তো।ঈশান আমায় কখনো কিছু জানায়নি।তোমাকে সে কীভাবে চেনে?”
“অয়ন নাকি তোমার সাথে কী কী করেছে?তুমি নাকি আমার কথা তাকে বলেছো ঈশান চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে আমায় খুঁজে বের করেছে।অয়নকে যে কি ড ন্যা প করেছে সেসব তো আমি জানতাম।বারণ করেনি ইতরটাকে আরো বেশি চটকালে খুশি হতাম।বাদ দাও ছ্যা চ ড়াটার কথা। তোমার বাবা মা ভালো আছেন?”
“ভালো আছে ভাবি।চলো আমাদের বাসায় খেয়ে দেয়ে তারপর যাবে।”
” এই নানা সময় নেই।ভালো থেকো আমার জন্য দোয়া করো যেন এবার অন্তত জীবনটা মন মত হয়।”
.
বাড়ির বউদের নিয়ে এত আহ্লাদ চোখে সয়না লিপির।এত কিসের আহ্লাদ?মাহমুদা অনুর সাথে তার অতীতের গল্প করছিলো মেয়েটা ধ্যান জ্ঞান সবটা ঢেলে দিয়েছে তার কথায়।অপদিকে লিপি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে আক্রোশ নিয়ে লিজাটা কোথায় গেল?তাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।এই মেয়েটা কি এখানে এসেও বয়ফ্রেন্ড পাতিয়ে ফেলেছে!ভাবতেই বড্ড রাগ লাগলো লিপির।সন্ধ্যার পর নাস্তা শেষে যে যার কক্ষে ফিরেছে।ঈশান সবে মাত্র বাড়ি ফিরলো মাহমুদার সাথে আলাপ সেরে নিজের কক্ষের দিকে গেলো।অনু বসে বসে শুনছিলো মাহমুদার একেরপর এক অতীতের কথা।আবিদ শাহরিয়ার অদূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন বাড়ির ছোট বউ আর শ্বাশুড়িকে।এদের মেলবন্ধনটা একটু আহ্লাদের অপরদিকে ঈশা হলো দায়িত্ববান গোছগাছ স্বভাবের মেয়ে।অনুর কাজ চারদিকে ছোটাছুটি করা এটা ওটা বলে সবাইকে হাসাতে থাকা। রাসেল মাঝে মাঝে অনুকে চোখ রাঙায় বউদের মতো একটু থাকো না।কিন্তু কে শুনে কার কথা।
” আন্টি তুমি এই বাদরটার সাথে কী করছো?তুমি জানো সে এখন এখানে কেন বসে আছে?”
মাহমুদা পিটপিট চোখে তাকালেন রাসেলের দিকে।অনু দ্রুত উঠে গিয়ে বসলো মাহমুদার পেছনে।
” কি হয়েছে রেগে গেলি কেন?”
” আমি বললাম সন্ধার পর পড়তে বসাবো এইজন্য এখানে এসে পালিয়েছে।কত্ত বড় ফাঁকিবাজ ভাবা যায়।”
রাসেল চোখ রাঙিয়ে তাকালো অনুর পানে।মাহমুদা এবার ভীষণ চটে গেলেন রাসেলকে ধমক দিয়ে বলেন,
” তুমি আমার সামনে ওঁকে চোখ রাঙাও এত সাহস তোমার!পড়বে না অনু, যাও এখান থেকে।”
” আন্টি আশকারা দিও না প্লিজ ত…”
” আমি যতদিন দেশে আছি পড়তে হবে না ওঁর।তুমি তোমার রুমে যাও কথায় কথায় বউকে শাসন দেখানো মনে হচ্ছে লায়েক হয়ে গেছো।বিয়ের হাওয়া এখনো কেটেছে?কাটেনি এখনি পড়াশোনা।”
” কিচ্ছু বলবো না আমি,যাওয়ার সময় এই বাদরকে নিয়ে যাবে তোমার সাথে।”
” কাল রাতে তুমি বলেছো আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না।আম্মু আমায় নিতে আসবে তুমি তাদের বারণ করেছো আমায় ছাড়া নাকি তোমার চলে না,আর এখন বলছো আমায় নিয়ে যেতে!”
শেষোক্ত বাক্যটি বলে ভ্রু নাচালো অনু।তার কথায় ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো রাসেল।মাহমুদা গলা ঝেরে কেশে উঠলেন।মনে মনে অনুকে গা ধা উপাধি দিয়ে দ্রুত উক্ত স্থান ত্যাগ করলো রাসেল।
.
” একটা মানুষের জীবনে পড়াশোনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?তার স্বামীর থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ?”
ঈশান আড় চোখে তাকালো ঈশার পানে।মেয়েটা অঙ্কের সমাধনে ব্যস্ত ঈশানের কোন কথা এই মুহূর্তে কানে ঢোকানোর ইচ্ছে নেই তার।ঈশা ভাবে এই ছোঁচা লোকটা সারাদিন পেছনে পড়ে থাকে অফিসে গিয়েও তার দুইদন্ড শান্তি নেই।
” ও ঈশা।”
” আপনি আপনার কাজ করুন আমাকে আর এক ঘন্টা সময় দিন।”
” এক মিনিটো দেব না।বই বন্ধ করো ভালো লাগছে না দূর।”
ঈশান ঈশার হাত টেনে ধরতে ভীষণ রেগে গেল ঈশা।দাঁতে দাঁত চেপে ঈশানকে ধমক দিয়ে বলে,
” আমার কিন্তু ভাল্লাগছে না বলে দিলাম।বললাম তো এক ঘন্টা।”
” তুমি আমায় রাগ দেখাও।থাক তোমার পড়াশোনা গেলাম আমি।”
ঈশান বেশ রাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে।মনে মনে ভয় লাগলো ঈশার এই ছেলের বিশ্বাস নাই যদি সত্যি সত্যি রেগে যায় তবে কী হবে!
১১০.
ঈশাকে রেখে ঈশার বাবার সঙ্গে আড্ডায় মেতেছে ঈশান।রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেলো এখনো কেউ বাড়ি ফিরলো না।দুজনে মেতেছে দাবার খেলায়।ক্লাবে তাদের হৈচৈ দেখে আশেপাশের মানুষজন দেদারসে কানাকানি করছে এরা নাকি শ্বশুর জামাই ভাবা যায়!তাদের দেখে তো মনে হয় এরা বন্ধু।
” ফাদার ইন ল আমি যদি জিতে যাই আপনাকে জম্পেশ একটা ডেয়ার দেবো।”
” তুমি জিতবে?এত সহজ নয়। মুজাহিদ হাসানকে দাবায় টক্কর দেওয়ার মতো খেলোয়াড় তুমি হওনি বাছা।”
” দেখা যাক কি হয়।”
দুজেনের মাঝে টান টান উত্তেজনা চলতে থাকে।ঈশান আজ কোমড় বেঁধে যেন মাঠে নেমেছে কিছুতেই তাকে হারাতে পারছেন না মুজাহিদ হাসান।নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েও ঈশানের কাছে অবশেষে হেরে গেলেন তিনি।ঈশান দাঁত কেলিয়ে তাকালো তার দিকে,
” কি বললাম না হারিয়ে ছাড়বো।এবার আমার ডেয়ার নিন।”
” তোমায় আমি বিশ্বাস করি না।উল্টা পালটা ডেয়ার দিলে আর কোনদিন খেলবো না তোমার সাথে।”
” এত ভয় পাচ্ছেন কেন?আমি বলি শুনুন আপনার ডেয়ার হলো, মাদার ইন ল’কে ফোন করবেন এবং বলবেন, ওগো সুলু আই লাভ ইউ।”
থমকে গেলেন মুজাহিদ হাসান।লজ্জায় গলা ঝারলেন তিনি।কিন্তু এই ঈশান তো নাছোড়বান্দা সে মুজাহিদ হাসানকে ফোন করিয়েই ছাড়লো।সুলতানা ফোন ধরেই একটা ধমক দিলেন মুজাহিদ হাসানকে,
“এত রাত হয়ে যাচ্ছে বাড়ির বাইরে কেন তুমি?ইদানীং আড্ডা জমিয়েছো বাইরে ঘর সংসার তো ভুলেই যাচ্ছো।”
” আসছি, আসছি আমি।একটা কথা বলতে ফোন করেছি।”
” কি কথা?”
” স..ইয়ে মানে সু..”
কণ্ঠ রোধ হলো তার।ঈশান মুখোমুখি বসে একের পর এক ইশারা করেই যাচ্ছে কিন্তু লজ্জায় মুখ থেকে কথা বের হলো না মুজাহিদ হাসানের।ঈশান পাশ থেকে স্বল্প সরে বলে,
” ফাদার যা বলছি তাই করুন না হলে আমি কিন্তু এখন মাদারকে ফোন করে বলবো আপনি অফিসের এক সুন্দরী কলিগের সাথে রেস্টুরেন্টে আছেন।”
” টেনে একটা চড় দেবো বেয়াদব ছেলে।আমাকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো হচ্ছে তো?ঠিকাছে আমিও দেখবো।”
ঈশান পুনরায় হাসলো।ফোনের অপরপাশ থেকে পুনরায় ধমক দিলেন সুলতানা।মুজাহিদ হাসান লজ্জায় মরি মরি অবস্থায় বলেই ফেললেন,
“এত বছরেও বলবো বলে বলা হয়নি, সুলু আই লাভ ইউ।”
তৎক্ষণাৎ ফোন কাটলেন মুজাহিদ হাসান।বুকটা তার ধড়ফড় ধড়ফড় করছে আচ্ছা এখনি কি তার স্ট্রোক হবে?নাকি শ্বাস রুদ্ধ হয়ে মা রা যাবেন।প্রিয়তমাকে ভালোবাসি বলা কি এতই দুঃসাহসিক কাজ!
.
ঈশানকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছে ঈশা কিন্তু এই ছেলে একবারো ফোন তুলেনি।ঈশার আজ বুঝতে বাকি নেই ঈশান ভীষণ রেগে গেছে এই ছেলের রাগ ভাঙাবে কী করে?মনে মনে ফন্দি আটলো সে।রাত এগারোটার পরে দ্রুত শাড়ি পরে সেজেগুজে ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়লো।ঈশান বাড়ি ফিরলো রাত একটার আগে।রুমের লাইন জ্বালাতে তৎক্ষণাৎ নজর যায় বিছানায় ঈশার পানে।এই মেয়েটা এখন সেজেছে কেন?শাড়ি পরলো কেন?খোলা চুল এলোমেলো বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছুটা ঈশার মুখে এসে হুটোপুটি খাচ্ছে।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল ঈশান তবে নিজের অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিল না সে।দ্রুত ফ্রেশ হয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো ঈশার থেকে দুরত্ব নিয়ে।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে আজ সে মেয়েটাকে ছুঁয়েও দেখবে না থাকুক সে তার পড়াশোনা নিয়ে।রাত বাড়লো ধীরে ধীরে ঈশানের চোখে ঘুম নেই ঘুম থাকবে কী করে?চোখের সামনে ফুটন্ত ফুল তার নজর কাড়ছে তার গায়ের সুবাস তাকে মাতাল করছে এসব তো মানা যায় না।নিজেকে সংযত করলো ঈশান।আরেকটু চেপে শুতে ঈশা নড়ে চড়ে এগিয়ে এলো তার কাছে।ঈশানের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে আছে নিজের প্রতিজ্ঞা আজ তার সাথে ছলনা করছে।বার বার মন বলছে প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে দে,কিন্তু ঈশান নিজের জেদের কাছে হার মানবে না।ঈশা পুনরায় নড়ে চড়ে শুলো ঘুমের ঘোরে অতিদ্রুত ঈশানের বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরলো।ব্যস ঈশান তছনছ হয়ে গেল।ভেঙ্গে গেল তার সেই প্রতিজ্ঞা।দু’হাত আপনা আপনি চলে গেলো ঈশার মাথায়।মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের ভেতরের সত্তাকে ধমকালো সে।
” এত দেরিতে এলেন কেন?”
ঈশার প্রশ্নে চমকে গেল ঈশান।মেয়েটা মিটিমিটি হাসছে।
” তুমি ঘুমাওনি?”
” হুহ।”
” উঠলে যে?”
” আমায় কেমন লাগছে?”
” আমার ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙ্গে দিয়েছো আর কী বলবো?”
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ঈশা।ঈশানের গাল টেনে বলে,
” আমি কি করেছি?”
” ভদ্র হতে চেয়েছিলাম ঠিক আগের মতো অভদ্র করে দিয়েছো।”
” যদি বলি আমার অভদ্র ঈশানকেই লাগবে।”
” সত্যি?”
ঈশা প্রত্যুত্তর করার আগেই তার ওষ্ঠে হামলে পড়লো ঈশান।ঈশার নিজের গালে এবার নিজে দুটো চড় মারতে মন চাইলো, কে বলেছে পাকনামি করতে?
১১১.
সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত ঈশান অফিসের কাজ সামলে দ্রুত বাড়ি ফিরলো সে।আজ রাতে তাদের দেশের বাইরে থেকে পাঁচজন অতিথি আসবে।ছেলেদের এই দলটা বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে চায় বলে জানিয়েছে ঈশানকে আর তাতে একটু ঈশানের সাহায্য চাই তাদের।ঈশান বারণ করেনি তাদের সম্পর্কে টুকটাক খোঁজ নিয়ে আসতে বলেছে।যদিও এই ব্যপারে সবাই জানে কেউ বারণ করেনি ভীনদেশী অতিথিরা যেন এই দেশ থেকে কোন খারাপ অভিজ্ঞতা না নিয়ে ফেরে সেই জন্য সকল ব্যবস্থা করেছে ঈশান।তাদের থাকতে দেওয়া হবে রাসেলের সেই ফ্লাটে।সময় হয়ে এসেছে এয়ারপোর্ট থেকে তাদের রিসিভ করার জন্য রাসেলকে পাঠানো হয়েছে।
ইতোমধ্যে লিপি যা আন্দাজ করেছে লিজা আবিদ শাহরিয়ারকে সত্যটা প্রকাশ করেছে আর লিপি এখন তা শতভাগ নিশ্চিত কিন্তু মেয়েটাকে হাতে নাতে ধরা প্রয়োজন।সন্দেহের ভিত্তিতে ঝামেলা বাড়ালে জল অন্য দিকে গড়িয়ে পড়বে।তার সন্দেহকে সত্যতা দিলো সুলতানা সন্ধ্যায় তিনি ফোন করে লিপিকে একগাদা কথা শুনিয়েছেন।সুলতানার সাথে তর্কে পেরে উঠলেন না লিপি তাই বাঁধ্য হয়ে ফোন কেটে ধরলো লিজাকে।
” তুই কোন সাহসে আমার কাজে বাঁধা দিস?এতদিন যাবৎ কি শিখিয়ে আসছি তোকে?দশ পুরুষের সাথে রাত কাটানোর স্বাদ এখনো মিটেনি?তোর মতো রাস্তার মেয়েকে কে বউ করবে?ঈশানের গলায় ঝুলিয়ে দিলে আমি বাঁচতাম।”
” ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দাও আমাকে আমার মতো।”
” এমন মা র মা র বো মুখে বুলি ফোটানোর শক্তি থাকবে না।”
” ঈশানের মাঝে কী আছে হ্যাঁ?কী আছে?আমায় একবার বিশ্বাস করো সিড ছেলেটা ঈশানের থেকেও বড়লোক তাছাড়া ও ঈশানের মতো অতটা চালাক নয় যে ভাবে বলবো সেই ভাবে নাচবে।”
” সারাদিন সিড সিড আর সিড।শুন এসব বিলেতি ছেলেদের আমি বিশ্বাস করি না।”
” একবার তো করে দেখো।তোমার ভাইপোর প্রতি আমার ইন্টারেস্ট জাগে না।বিদেশিতে অভ্যস্ত দেশীটা কেমন কেমন জানি লাগে ত…”
লিপি আচমকা চড় বসিয়ে দিলো লিজার লাগে।মেয়েটার চুল টেনে দেয়ালে বেশ কয়েকবার মাথাটা ঠুকে দিয়ে বলেন,
” অজাতের বংশ তুই রাস্তার মেয়ে বিষ খেয়ে ম র।”
লিপি চলে গেলেন।বসার ঘর থেকে হইচই আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।সেই আওয়াজে নিজেকে দ্রুত সামলে কক্ষের বাইরে গেল লিজা।সুলতানার পাশাপাশি দাঁড়াতে পাঁচজন সুপুরুষকে দেখে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ।লহমায় থমকে গেছে তার পৃথিবী,এতো হতে পারে না কখনোই না।এই ছেলেগুলো এখানে কী করছে তাও আবার একসাথে!এরা সবাই লিজার বর্তমান বয়ফ্রেন্ড। সিড সহ অনন্যারা লিজার দিকে তাকিয়ে কুটিল হাসলো।ভরা মজলিশে আচমকা জ্ঞান হারালো লিজা।
#চলবে__
#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪১খ]
_____________________
আবিদ শাহরিয়ারের অতি আদরের ভাগনি লিজা।মেয়েটার অল্প কিছু হলেই তিনি চিল্লিয়ে সারা বাড়ি মাথায় করে রাখতেন।লিজার অল্প স্বল্প ব্যথাতেও আবিদ শাহরিয়ার অবস্থা এমন হতো যেন তিনি নিজে ব্যথা পাচ্ছেন।একটি মেয়ের শখ ছিল তার কিন্তু ঘরে এলো পুত্র সন্তান।তাই তো লিজাকে নিয়ে তার এত আহ্লাদ।এত বিশ্বাস,ভালোবাসা,মর্যাদা,গুরুত্বের মাঝে লিজা এতদিন যাবৎ প্রতারণা করে এসেছে!মানতে বড্ড কষ্ট হয় আবিদের তাই তো আজ লিজার চেতনা হারানো নিয়ে তার কোন অতিশয় আগ্রহ দেখা গেল না।লিজার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে জ্ঞান ফিরলো তার লিপি কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে নিয়ে গেলেন তার কক্ষে।বাড়ির বাকি সদস্যরা ভীষণ অবাক হঠাৎ অতিথিদের দেখে কী এমন হলো যে জ্ঞান হারাবে?
মুজাহিদ হাসানের মনে সন্দেহের বীজ রোপিত হলো।তিনি পাঁচ ভীনদেশীর মুখোমুখি বসলেন।সবাই তাদের পরিচয় দিল নিঃসন্দেহে ছেলেগুলো অনেক বড়লোক ঘরের তা আর বুঝতে বাকি নেই।মুজাহিদ হাসান সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,
” তোমরা ঈশানকে চিনলে কী করে?”
সিডের পাশে বসা হাস্যজ্বল ছেলেটির নাম এলমার।মুজাহিদ হাসানের প্রশ্নে সে বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে,
” আমার আঙ্কেল আর ঈশান শাহরিয়ার পূর্ব পরিচিত।বিজনেস পার্টনার বলা চলে।আমি দেশে আসতে চাইলে তিনি আমায় ঈশান শাহরিয়ারের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।”
” তোমরা এসেছো এতে আমরা ভীষণ খুশি।তোমাদের বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন ঈশানকে বলছি তোমাদের রুম দেখিয়ে দেবে।তারপর নতুন বাসায় শিফট করবে।”
অনু কিচেনে দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোকে দেখছিলো।মুজাহিদ হাসানের সাথে ইংলিশে বলা এতগুলো কথার মাঝে একটি কথাও তার মাথায় ঢুকলো না।এরা হ য ব র ল কী বলেছে?মুজাহিদ হাসানো কি দক্ষতার সাথে বললেন।তবে এলমার নামক ছেলেটাকে ভীষণ মনে ধরেছে অনুর এত আদুরে ছেলেটিকে দেখেই মন চায় গাল টিপে দিতে।অনুর চাহনি সুবিধার লাগলো না রাসেলের কাছে। সে দ্রুত এগিয়ে এসে দাঁড়ালো অনুর সম্মুখে।
” তুমি ওদিকে মনোযোগ দিয়ে কী দেখছো?”
হকচকিয়ে উঠলো অনু।কি বলবে না কি করবে ভেবে পেলো না সে।রাসেলের চাহনি প্রখর এই ছেলেটা কী বুঝে ফেলেছে?
” কি হলো কথা বলছো না কেন?”
” না মানে ছেলেগুলোকে দেখো কিসব ইংরেজিতে হাবিজাবি বলছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
” ওহ, এসব বুঝতে তোমাকে গরুর ডিম খেতে হবে এখন তো তুমি ঘোড়াম ডিম খাও।”
বিদ্রুপের হাসি হেসে চলে গেলো রাসেল।অপরদিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল অনু।গরুর ডিম হয়!গরু তো দুধ দেয়।
১১২.
এতটা লম্বা জার্নির পর দেহটা বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে সবার।সিড শাওয়ার শেষে চুপচাপ পিঠ ঠেকিয়ে বিছানায় বসলো।শরীরের থেকেও মনটা বেশি গুটিয়ে গেছে তার।লিজাকে দেখার পর সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।ধনি পরিবারের ছেলে সিড ছোট বেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি যেমন ঝোক ছিল তেমনি সর্বদা ফুটবলের প্রতি অসীম ঝোক ছিল।বাবার ব্যবসায় মাঝে মাঝে হাত লাগাতো সে, ব্যবসার বিভিন্ন পরিকল্পনায় তার অসাধারণ বুদ্ধিতে যে কেউ প্রশংসা করতে বাধ্য ছিল।তাদের ব্যবসার প্রতিটা পার্টনার সিডকে ভীষণ ভালোবাসতো।এত সব প্রশংসা,সম্মানের ভীড়ে যে কেউ হয়তো খুশিতে গর্বে ভরে যেত।কিন্তু সিড এসবে বড্ড নীরব।ছেলেটা সবসময় নীরবতাকে ভালোবাসতো শোরগোল,হৈচৈ স্থান তার কোন কালেই পছন্দের না।তার আনাড়ি জীবনে প্রেম আসা দুঃসহ, মেয়েদের সাথে কথা বলতেই তার কেমন লজ্জা লাগে আর সেখানে তার সমবয়সী কয়েকজন বন্ধুরা নিজেদের দেহ মন সবটা কতজন মেয়ের কাছে বিলিয়ে দিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।
এই নিশ্চুপ ছেলেটার জীবনেও এক পাশলা বৃষ্টির ন্যায় আচমকা প্রেম এসেছিলো।উলটে পালটে দিয়েছে তার জীবনের সবকিছু।নিজেকে যতটা ভালোবেসেছিল তার চেয়েও বহু গুনে ভালোবেসে ফেলেছে প্রেয়সীকে।বন্ধুর জন্মদিন পার্টিতে প্রথম দেখেছিলো লিজাকে মেয়েটাও যেন সেদিন সিডকে টার্গেট করে এসেছে।আগ বাড়িয়ে সিডের সাথে কথা বলা,ডান্স করা, ড্রিংকস করা,সবটা লিজা সেচ্ছায় করেছে।সরল সহজ জীবনে আবির্ভাব ঘটে এক জটিল মেয়ের।লিজা যখন যেভাবে পেরেছে সিডকে ব্যবহার করেছে টাকা,দামি দামি গিফট কোন কিছুতেই কার্পণ্য করেনি ছেলেটা।লিজাকে ভেবেছিলো বিশুদ্ধ, নিষ্পাপ যার দেহের প্রতিটি ভাজে ভাজে একমাত্র সিডের ছোঁয়া থাকবে।লিজাকে বিয়ের উদ্দেশ্যে নিজের খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে।হায় আফসোস সেদিন যখন জানতে পারলো লিজা প্রতারক এক মুহূর্তের জন্য ভেঙ্গে পড়েছিল সিড।লিজার বন্ধুরাই লিজার নামে সব কুকীর্তি ফাঁস করে দেয়।সিড একে একে প্রমাণ জোগাড় করে ধীরে ধীরে জানতে পারে একাধিক ছেলের সাথে লিজার সম্পর্কের কথা।অনেক ছেলের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখে মেজাজটা খিঁচে যায়।তবুও লিজাকে সরাসরি কিছুই জানায়নি সে।ছেলেটা ভাঙা মন নিয়ে বেশ কিছুদিন প্রেমের নাটক চালিয়ে গেছে,লিজা সবসময় তার পরিবারকে হাইড করেছে কিন্তু এবার সিড নানান বাহানায় তার বাংলাদেশের অবস্থান জেনে নেয়।সেদিন লিজা বলেছিল তার কাজিন ঈশান শাহরিয়ারের বিয়ে উপলক্ষ্যে দেশে এসেছে।ঈশান শাহরিয়ার সম্পর্কে টুকটাক বলেছিল লিজা তবে সিড ধীরে ধীরে ঈশান শাহরিয়ার সম্পর্কে সব তথ্য বের করে।এলমার সবচেয়ে বেশি তথ্য দিয়ে সাহায্য করে তাকে।
লিজার বর্তমানে থাকা বাকি চারজনকে বাংলাদেশে আসার জন্য রাজি করায় সিড।যদিও প্রথমে কেউ রাজি ছিল না কারণ তাদের জীবনে মেয়ে আসবে যাবে এটা বড় কোন ইস্যু নয়।তবে সিড তাদের সম্পূর্ণ খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দেয়, এখানে শুধু তারা লিজাকেই ধরবে না একটা দেশ ভ্রমণ করবে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতেই পারে না।একে একে বাকিরাও রাজি হয় এক ঢিলে দুই পাখি মা রা যাকে বলে।
” তোমার মন খারাপ সিড?দেখো এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।আমরা যে কারণে এসেছে সে কাজটা করতেই হবে।”
” আমি ভেঙ্গে পড়ছি না এলমার।আমি শুধু ক্লান্ত যাই হোক প্রতারকটাকে কখন শায়েস্তা করবে?”
” এখন নয় ডিনার শেষে।”
” ঠিক আছে।”
.
এই দেশের খাদ্যাভ্যাসের সাথে ভীনদেশি ছেলেগুলো সহজে মানিয়ে নিতে পারবে না।তেল, মসলা, ঝাল তারা একটু কম পছন্দ করে।যেহেতু মাহমুদার এই সম্পর্ক ধারণা আছে তাই একাই সব রান্না করছেন তিনি।তার হাতে হাতে কাজ করছিলেন ঈশা এবং অনু।ঈশান কিছুক্ষণ পর পর ঈশাকে দেখে যাচ্ছে এর পেছনেও অবশ্য একটা কাহিনী আছে ছেলেগুলো একবার দেখে ঈশা মনের ভুলে ঈশানের সামনে বলে বসেছে, “এই ছেলেগুলো এত ফর্সা কেন?এক টানা তাকিয়ে থাকলে আশেপাশে সবকিছু আঁধার আঁধার লাগে!”
ঈশার মুখে এমন কথায় হকচকালো ঈশান।দ্রুত ঈশাকে টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে যায় সে।মেয়েটার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে দ্রুত চোখ মুছতে বলে।ঈশানের এমন ব্যবহার ঠিক মাথায় ঢুকলো না ঈশার।ঈশান ফিসফিস করে কিছু বলছে এবং ঈশার চোখে ফু দিচ্ছিলো।বিরক্ত হয়ে ঈশা এক পর্যায়ে ঈশানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,
” কী সমস্যা বলবেন তো।”
” অনেক বড় সমস্যা।তোমায় আমি কি করি?আজ নিচে যেও না।”
” কেন যাব না?”
” তুমি তো এমন মেয়ে নও অন্য ছেলেদের দিকে নজর দাও।এই ঈশা মনে কি চলছে আমায় বলো।”
ঈশানের কণ্ঠে মিশে আছে অস্থিরতা।চরম অবাকের মাঝেও ফিক করে হেসে ফেললো ঈশা।ঈশানের চুলে হাত বুলিয়ে সে বলে,
” নজর দিলাম কই?এটাকে নজর বলে না।আপনি পাগলামো কেন করছেন?”
” তুমি শুধু আমার দিকে তাকাবে ঠিক আছে?কাল থেকে রূপচর্চা করবো বউয়ের মন ঘুরে যাচ্ছে দূর ভাল্লাগে না।”
ঈশান আপন মনে বকবক করতে করতে বেরিয়ে গেলো।ছেলেটার কাণ্ডে খিলখিলিয়ে হাসছিলো ঈশা।আড়ালে সেই হাসি দেখলো ঈশান।ভাব গম্ভীর ছেলেটার এসব হেঁয়ালি আচরণ করার একমাত্র কারণ ঈশার সহজ হওয়াটা।ম্যাচিউর ব্যক্তিদের পছন্দ করে ঈশান, ঈশা যথেষ্ট ম্যাচিউর কিন্তু তার দু’একটা ইম্যাচিউর কাণ্ডে সম্পর্কে হাস্যরস বাড়ে,ঈশান কখনো ভাবেনি জীবনে একটা পর্যায়ে এসে তাকে এমন পাগলামো করতে হবে।
.
” এই তোমরা এখানে কী করছো?”
আবিদের আগমনে সতর্ক হলো ঈশা এবং অনু।দুজনে টুকটাক কাজ করছিলো।শ্বশুরের সাথে এখনো সহজ হতে পারেনি তারা।শ্বশুর মানুষটা কেমন মুখটা কালো করে ঘুরে বেড়ায়।ঈশা মাথার ঘোমটা টেনে বলে,
” সালাদ কাটছিলাম।আপনার কিছু প্রয়োজন?”
” না।তুমি কি করছো?”
অনুর দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।অনু কপট হেসে বলে,
” এইতো সব পরিষ্কার করছি।”
আবিদ শাহরিয়ার কিছুক্ষণ চুপ রইলেন।তাকিয়ে পরখ করলেন দুই পুত্র বধূর কার্যক্রম।আচমকা তিনি দুজনকে প্রশ্ন করলেন,
” তোমাদের স্বামীর পছন্দের খাবারের নাম কী?”
এমন সোজা প্রশ্ন পেয়ে গটগটিয়ে দ্রুত উত্তর দিলো অনু।
” পাস্তা বাবা।আমার আর আপনার ছেলের একই খাবার পছন্দের।”
” তাই নাকি?তা বলতো পাস্তার উৎপত্তি কোথায়?”
থমকে গেল অনু।পাস্তার উৎপত্তি কোথায় এসব জেনে তার কাজ কী?তাকে যদি বলা হতো এই শহরে সবচেয়ে ভালো পাস্তা কোন রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় তবে সে গড়গড়ে বলে দিত।অনুরকে হাঁশফাঁশ করতে দেখে আবিদ ভ্রু নাচালেন।
” কি হলো বলো শুধু কি গিললেই হবে?পছন্দের খাবার নিয়ে একটু আধটু জানাও তো দরকার।”
অনু আড় চোখে তাকালো ঈশার পানে।ঈশা ইশারায় তাকে উত্তরটা বলে দিচ্ছে কিন্তু অনু বুঝতে পারছে না ঈশা ঠিক কি বলছে।তাই ঈশা তার গলার স্বর আরেকটু বাড়ালো,চাপা গলায় ইশারায় বলে,’ইতালিতে’। ঈশা বললো এক অনু বুঝলো আরেক।অনু হাসি মুখে বলে,
” ইন্দোনেশিয়ায় পাস্তা উৎপত্তি হয়েছে।”
অনুর উত্তরে মাথায় হাত ঈশার! আবিদ শাহরিয়ার শ্লেষ হাসলেন এই মেয়েটা বড্ড সহজ সরল।তিনি বিদ্রুপে অনুকে বলেন,
” তুমি বোধহয় সেই স্টুডেন্ট যারা সামনের টপারদের থেকে দেখে লিখেও ফেল করে।আমি আর তুমি একই অবস্থানে মুখোমুখি ঈশা অদূরে দাঁড়িয়ে তোমায় ইতালি ইতালি করছিলো উলটো দিক ফিরেও আমি শুনতে পেলাম আর তুমি সোজাসুজি থেকেও বুঝতে পারলে না।”
১১৩.
পাঁচ জনে বেশ তৃপ্তি নিয়ে রাতের খাবার খেলো।পাঁচ জনের প্রশংসায় ভাসছেন মাহমুদা এই ছেলেগুলো সহজে মন কেড়ে নিতে ওস্তাদ।খাবার শেষে তারা রাসেল এবং আবিদ শাহরিয়ারের সাথে পর্যটন স্থান গুলোর বর্ননা শুনছে আগামীকাল সকালে ঘোরাঘুরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে তারা।
জ্ঞান ফেরার পর থেকে লিজার আচরণের পরিবর্তন সহজে চোখে পড়লো লিপির।মেয়েটা কেমন পাগল পাগল করছে কানে দু’হাত চেপে কিছু একটা বিরবির করছে।অপরদিকে লিজার এখনো মানতে কষ্ট হচ্ছে এরা পাঁচজন এক হলো কী করে?এরা নিশ্চয়ই লিজাকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে?আবিদ শাহরিয়ারের কাছে লিজা তার ব্যক্তিগত জীবনের যত নোংরামো আছে সবটা গোপন করে গেছে সে শুধু জানিয়েছে একটি ছেলের সাথে তার সম্পর্ক আছে অথচ এখন যদি তিনি জানতে পারেন এত এত ছেলের সাথে সে মিথ্যা সম্পর্ক স্থাপন করেছে,তাদের সাথে ইন্টিমেট হয়েছে এসব জানলে তার কপালে অসীম দুঃখ আছে।আচ্ছা এই ছেলেদের খোঁজ নিয়েছে কে?তাদের দেশে এনেছে কে?ঈশান!
মুহূর্তে রাগে দপদপ করে উঠলো লিজার মাথা।সে যেন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে।দ্রুত কক্ষের দরজা খুলে বাইরে তাকাতে কাউকে নজরে এলো না এভাবে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মিনিট।ঈশান যখনি তার কক্ষের সামন দিয়ে গেল ঈশানের পথ আটকে দাঁড়ায় সে।
” ওই ছেলেগুলোকে তুমি এনেছো তাই না?”
“আমি!”
ঈশান চমকে গেল লিজা কেমন করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।ঈশান বুঝতে পারলো এখানে কোন জট আছে ছেলেগুলোকে দেখে লিজাও কেন অজ্ঞান হয়েছিল!ঈশানের ভাবনা চিন্তার মাঝে তার কলার টেনে ধরে লিজা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” তুই আমাকে সবার সামনে বেইজ্জত করতে চাইছিস তাই না?তোর সংসার আমি বাঁচিয়েছি।ভুল করে ফেলেছি তোর ঈশাকে আমি…”
দুজনের ঝগড়ার মাঝে উপস্থিত হয় ঈশা।ঈশানের কলারে লিজার হাত দেখে কিছুটা রেগে যায় সে।দ্রুত দুজনকে ছাড়াতে নিলে লিজা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ঈশাকে টাল সামলাতে না পেরে মেয়েটা কাঁচের বড় ফুলদানিটার সঙ্গে ধাক্কা খায়।তৎক্ষনাৎ ফুলদানিটা মেঝেতে আঁছড়ে পড়ে ভেঙেচুরে বিকট শব্দ তোলে।বাড়ির সবাই সেই আওয়াজ শুনতে পায় তারা ছুটে আসে লিজার কক্ষের দিকে।
লিজার আচরণে ঈশান এতক্ষণ হতবিহবল থাকলেও ঈশাকে মেঝেতে দেখে লিজাকে পালটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঈশার কাছে যায়।ভাঙা কাঁচের টুকরো হাতের কোণায় লেগে একটুখানি কেটে যায় তবে কাটা অংশ বেশি দেবে যাওয়ায় কেমন দেদারাসে রক্ত ঝরছে।লিজা মেঝেতে পড়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।বাড়ির সকলে এখানে ভীড় জমিয়েছে তার প্রেমিক পুরুষেরা তার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে।সিড সকলের দৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে এলো লিজার কাছে হাটু মুড়ে হাত বাড়িয়ে বলে,
” হাতে হাত রাখো।”
এর পেছনে এগিয়ে আসে এলমার সেও হাত বাড়িয়ে দেয় লিজার উদ্দেশ্যে। তার দেখা দেখি বাকি তিনজনেও এগিয়ে এসে হাত বাড়িতে দেয় লিজার দিকে।বাড়ির সকলে অবাক হয়ে পাঁচটি ছেলেটা কাণ্ড দেখছে।লিজা মনে মনে সিডের প্রতি দূর্বল তাই যে ভাবে হোক সিডকে বন্দি করতে হবে তার মায়াজালে।সবার নজর উপেক্ষা করে লিজা সিডের হাত ধরলো উঠে দাঁড়ানোর আগ মুহূর্তে তার হাত ছেড়ে দিল সিড যার দরুনে ছিটকে পড়লো লিজা। লিজার এমন পতন দেখে পাঁচজন ছেলে মুহূর্তে পৈশাচিক হাসি দিলো।সিড কোমড়ে হাত ঠেকিয়ে লিজাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” ঠিক একই ভাবে আমাকে ভেঙে দিয়েছো তুমি।তুমি একজন প্রতারক!আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছো তুমি।”
আবিদ শাহরিয়ার অবাক হলেন।ঈশান নিজেও কিছুই বুঝতে পারছে না।রাসেল সিডের কাছে এগিয়ে যায় ব্যপরটা খোলাসা করা জরুরি এরা ঠিক কি বলতে চায়?”
” সিড তুমি এসব কি বলছো?লিজার সাথে তোমার কোন সম্পর্ক আছে?”
” আমার এখানে আসার মূল কারণ এই মেয়েটা।যাকে আমি ভালোবেসেছি, অন্ধকের মতো বিশ্বাস করেছি,অগনিত অর্থ ব্যয় করেছি তার পেছনে।সে আমাকে ঠকিয়েছে শুধু আমাকে নয় এখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যকটা ছেলের সাথে তার এখনো সম্পর্ক চলমান।এর আগেও সে অনেক ছেলেদের টার্গেট করেছে তাদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়েছে, দৈহিক সম্পর্ক স্থাপণ করেছে।”
মাথায় যেন আকাশটা ভেঙে পড়লো আবিদ সহ অনন্যদের।অনু পিটপিট চোখে চেয়ে রইলো সিডের পানে সে আধো আধো বুঝতে পারছে কি বলছে এই ছেলেটা।ঈশার হাতে রুমাল বেধে দিয়েছে ঈশান।ঈশা হাতের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, “এই একটা মেয়ে এত প্রেমিক কী করে সামলায়?আমি তো ঈশানকে সামলাতে হিমশিম খাই।নাহ মেয়েটা আসলেই ট্যালেন্টেড।”
সিডের বক্তব্যতে বাকিরাও সহমত জানায়।নিজের মেয়ের কুকীর্তির কথা লিপি জানেন তবুও মেয়েকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সিডকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
” আমার মেয়ে যে খারাপ তার প্রামাণ কী?বরং তোমরা তাকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছো নিজেদের লালসা মিটিয়েছো।”
সিড কিছু বলার আগে মুখ খুললো এলমার,
” আপনার মেয়ে আমাদের দেখে জ্ঞান হারালো কেন?আপনার চোখের ভাষা বলে দেয় সত্যটা আপনি জানেন।এমন তুচ্ছ মেয়ের জন্য আমাদের জীবন পড়ে নেই তবুও এই মেয়েটাকে শায়েস্তা করা জরুরি ভেবে এতটা দূর ছুটে এসেছি।মিস্টার ঈশান শাহরিয়ার আপনি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনার কাজিনের সম্পর্কে।আমরা অনেক অনেক প্রমাণ নিয়ে এসেছে।
আমাদের আর কিছুই বলার নেই।”
এলমার কথায় বাকিরাও সহমত পোষণ করে তবে এসব সম্পর্কে কিছু বলার নেই ঈশানের।নর্দমায় হাত দেওয়ার শখ তার নেই এই নর্দমাকে আরো আগেই প্রত্যাখ্যান করে ছুটে এসেছে এই দেশে।আবিদ শাহরিয়ারের বিশ্বাসে আঘাত লাগলো,সম্মানে কালি লাগলো।লিজাকে কোন দিন অবিশ্বাস করেননি যখন যেভাবে পেরেছে মেয়েটাকে আগলে রেখেছেন তার কারণে সন্তানকেও পর করে দিচ্ছিলেন আর সেই লিজা…
বুকটা ভার হয়ে এলো তার।বুকে হাত ঠেকিয় ছোট ছোট পা ফেলে চলে গেলেন বসার ঘরে।সোফায় বসে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন মেঝেতে।মাহমুদা স্বামীর কষ্ট বুঝতে পারলেন দ্রুত এক গ্লাস পানি এনে দিলেন তার সম্মুখে যা এক নিশ্বাসে শেষ করেন আবিদ।
ঈশানের এসবে ইন্টারেস্ট নেই সে চুপচাপ এসে বসলো এক কোণে।সিড এলমার সব প্রমাণ রাসেলের নিকট পেশ করছে ছেলেগুলো যে মিথ্যা বলছে না, তা আর বুঝতে বাকি নেই কারো।
ভাইয়ের বিশ্বাস ভেঙে গেলে পথে বসতে হবে লিপিকে তাই দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ের পা ধরে বসলো সে।ন্যাকা কান্নায় যতটা পারা যায় ভাইয়ের মন গলাতে ব্যস্ত সে।
” ভাইয়া লিজা ছোট মানুষ ওঁকে মাফ করে দেন।একবার সুযোগ দেন মেয়েটাকে আমি বুঝাবো।একাই কি আমার মেয়ের দোষ?ওই ছেলেদেরো দোষ আছে ও ভাইয়া আপনি এভাবে চুপ করে থাকবেন না।”
” সেদিন লিজার অন্যায়ে তুমি যদি আমার ছেলেটাকে না ফাঁসিয়ে নিজের মেয়েকে শাসন করতে তবে আজ আর মেয়েটার অধঃপতন হতো না।সেদিন যদি আমি তোমাদের বিশ্বাস না করতাম তবে আমার ছেলের সাথে আমার এতটা দূরত্বের সৃষ্টি হতো না।সব নষ্টের মূলে তুমি আছো লিপি।”
” ভাইয়া আমি…”
” কোন কথা আমি শুনতে চাই না।আমাদের সাথে ফিরে যাবে তুমি।নিজের মেয়ের ব্যবস্থা নিজে করবে।”
” নিজের মেয়ে?আমার মেয়ে তোমার কেউ হয় না ভাইয়া?তোমার ভাগনি সে।”
তৎক্ষনাৎ লিপির দিকে থুথু ছুড়লেন আবিদ শরীরটা কেমন ঘিণ ঘিণ করছে তার।
” তোমাদের মুখ দেখতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে সামনে থেকে সরে যাও।”
১১৪.
এক সাপ্তাহের মাঝে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন আবিদ শাহরিয়ার।আজ তারা দেশ ছাড়বেন তাদের সাথে আছে লিজা এবং লিপি।তিনি চাইলেই এদের গ্রামের বাড়িতে রেখে যেতে পারতো কিন্তু এখানে রাখা মানে ঈশানের জীবনে ফের কাঁটার আগমন।দুই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন মাহমুদা আবার কবে দেখা হবে তাদের সাথে?কবে এভাবে বুকে আগলে নেবেন।ঈশা,অনু ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে মাহমুদার পানে এগিয়ে এসে তাদের ছুঁয়ে দিতে কেমন বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো।মাহমুদা ঈশা আর অনুকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
” ঈশান তোমাকে বকলে অযথা রাগ ঝারলে আমাকে ফোন করবে।আর অনু রাসেল যদি তোমাকে পড়াশোনা নিয়ে বেশি বকে আমি তো আছি চিন্তা করবে না আমি বকে দিব তাকে।”
ঈশা,অনু ঝাপসা চোখে মাথা দুলায়।আবিদ এগিয়ে গেলেন ঈশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
” তুমি ভীষণ ধৈর্য্যবান একটা মেয়ে কেননা সেচ্ছায় একটা পাগলকে গলায় ঝুলিয়েছো।”
আবিদ শাহরিয়ারের কথায় সবাই চাপা হাসলো।ঈশান পড়লো লজ্জায় এরা তাকে নিয়ে মজা নিচ্ছে।ঈশার পাশে দাঁড়ানো অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে আবিদ বলেন,
” পাস্তার উৎপত্তি কোথায়?”
” ইতালিতে।”
” না কেউ যেন বলেছিল ইন্দোনেশিয়ায়।”
” সে ভুল ছিল বাবা এবার সে সঠিকটা জানে।”
আবিদ শাহরিয়ার স্মিত হাসলেন।সবার চোখে পানি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল রুদবার।আবার সবাই কী আলাদা হয়ে যাবে?আচ্ছা ঈশামনি কাঁদছে কেন?ঈশামনির কী খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?ছোট্ট রুদবা ঈশার হাত টেনে বলে,
” ঈশামনি কেঁদো না।”
ঈশা কোলে নিলো রুদবাকে।গাল বাড়িয়ে বলে,
” তুমি একটা আদর দাও তবে আমি কাঁদবো না।”
” মামা একটু আগে দিয়েছিল এখন কী আমায় দিতে হবে?ঠিক আছে আমিও একটুপরে মামার মতো তোমায় চুপিচুপি চুমু দেব।”
রুদবার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো ঈশা।আশেপাশে সকলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।ঈশান দ্রুত ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল, ঈশা রুদবাকে নামিয়ে উলটো পথে হাটা শুরু করলো।
১১৪.
কেটে গেল একমাস।সিড যতটা চুপচাপ যত্নবান প্রেমিক ছিল লিজার প্রতারণায় ঠিক ততটাই বিষাক্ত হয়ে উঠে।দেশ ছাড়ার পর সিড লিজার নামে সর্বপ্রথম মামলা করে।এরপর বাকিরাও লিজার অনন্য প্রেমিকরা তার নামে মানহানির মামলা করে ।সিডের এমন কাজে উৎসাহ পেয়ে বাকিরাও লিজার বিরুদ্ধে একে একে সকলে উসকে যায়।নিজেকে বাঁচানোর আর কোন পথ খোলা রইলো না মেয়েটার কাছে।আবিদ শাহরিয়ার এসবে গা দিলেন না তিনি তার মতো চললেন লিজাকে জেল থেকে মুক্তি করার তার কোন তাড়া নেই।লিপি ভাইয়ের পা ধরেও কোন কিছুই করতে পারেনি।বরং আবিদ শাহরিয়ার তাকে আলাদা করে দিয়েছে এখন লিপি একাই একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।
আজ তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন।মা হিসেবে যদি একটু সৎ সতর্ক হতেন তবে মেয়েটার সুন্দর ভবিষ্যত থাকতো।শারিরীক অত্যাচারের থেকেও হয়তো মানসিক অত্যাচারটা সবচেয়ে বেশি বেদনাদায়ক যা মোটেও সহ্য করতে পারছেন না লিপি মেয়ের চিন্তায় ধীরে ধীরে তার জীবনের যেন পতন ঘটছে।একা একা দুঃসহ হয়ে পড়ছে প্রতিটি রাতদিন।অপরদিকে লিজার কারাবন্দী জীবনটা বিস্বাদের কড়া নাড়ছে জীবনে।শারীরিক সব সৌন্দর্য, মনের সব সুখ দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে।
#চলবে___