অবেলায় তোমার আগমন পর্ব-৩৬+৩৭

0
590

#অবেলায়_তোমার_আগমন🥀
#পর্ব_সংখ্যা_৩৬
#Adrrija_Aman(লেখিনীতে)
[✖️কার্টেসি_ছাড়া_কপি_নিষিদ্ধ✖️]

শরৎ শ্রীজার মুখ চেঁপে ধরে ওকে ঔষধ খাইয়ে দিলো।শ্রীজা চোখ মুখ কুঁচকে ঝিম ধরে বসে রইলো কিছুক্ষণ এই জিনিসটা তার একদম পছন্দ না,বিশেষ করে তার মায়ের এসব জড়ি-পুটি জাতীয় জিনিসগুলো।শরৎ কিছুক্ষন পর শ্রীজাকে পানি আর ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।অনেক কাজ বাকি আছে তার যে কদিন ছুটি আছে সে কটাদিন বাড়িতে বসে বসে শুধু শুধু সময় নষ্ট করার চাইতে অফিসের কিছু কাজ এগিয়ে রাখা ভালো।এসব ভেবে পাশের ঘরে গিয়ে ল্যাপটপ অন করে কাজে বসে পড়লো।

________
বাড়িতে নতুন বউ এসেছে নাদিমদের, নাদিমের কাজিন নয়নের ওয়াইফ আর তার কাজিন কিছু দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে এখানে।মিসেস নাইমা এক হাতে সব সামাল দিচ্ছে আর নতুন বউ সে টুকটাক কাজে সাহায্য করছে,বাড়িতে কুটুম এলে তাদের আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখতে চাননা নাইমা।আর নতুন বউয়ের ব্যাপার হলে তো আরো আগে না।নাইম সাহেব বাজারে গিয়েছেন সালাদের জন্য টাটকা ফল-মূল আর সবজি আনতে,নাদিম বসে বসে রসুনের খোসা ছাড়াচ্ছে।মিসেস নাইমা হাতে চামচ নিয়ে তরকারির স্বাদ পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললেন…

“কিরে নাইম শুধু শুধু রসুন গুলো নষ্ট করছিস কেনো?এগুলো তো এখন কোনো কাজে আসবে না।”

নাদিম কিছু বললো না বেসিনের সামনে গিয়ে ট্যাপটা ছেড়ে দিয়ে বাটিতে থাকা রসুনের চারাটা কোয়া ধুয়ে সেগুলো মাংস তরকারিতে দিয়ে দিলো।নাইমা ছেলের কান্ড দেখে বললেন…

“সত্যি করে বলতো নাইম ব্যাপারটা কি?এমন হাসফাস করছিস কেনো তুই?কিছু বলবি?আর সময় তো তোকে রান্না ঘরে দেখাই যায় না,এখন রান্না ঘর পর্যন্ত এসে আবার রাঁধুনি গিরিও করছিস।”

নাদিম তার মায়ের পাশে গিয়ে দাড়ালো একদম ভদ্র ছেলের মতো।তারপর নিচুস্বরে বললো…

“বাবা সেদিন যে মেয়েটার সাথে দেখা করতে বলেছিলো,তার সাথে দেখা করতে আমি রাজি নাম আর ঠিকানা দিয়ে দিতে বলো তুমি তাহলেই হবে।”

নাইমা বেগম খুব অবাক হলেন নাদিমের এমন আচরণে,তবুও কিছু বললেন না চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন তিনি।নাদিম তা দেখে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলো।স্বভাব মতো ঘরের দরজাটা লাগাতে ভুললো না।পাশের ঘর থেকে নতুন বউয়ের হাঁসির আওয়াজ আসছে স্বামী-স্ত্রীর খুনশুটির সাক্ষি হাঁসির রোল গুলো।নাদিম আকাশের দিকে তাকালো, চোখ জোড়া বুজে নিলো,একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনের একটা মেয়ের চেহারা ভেসে উঠলো,খুব চেনা একটা মুখ।নাদিম দ্রুত চোখ খুলে ফেললো চোখ বন্ধ করেই মায়ায় পড়েছিলো সে,এমন ভাবে আর চোখ বন্ধ করতে চায় না।কিছু মায়া ভালো থাকতে দেয় না,মনের মাঝে অন্যরকম নাম না জানা রোগের সৃষ্টি করে।যে রোগের ঔষধ একটাই আর সে ঔষধ পাওয়া খুব কঠিন,তাই সে রোগের উৎসকে ভুলে ভালো থাকার চেস্টা করাই উত্তম।কিছু মায়া কিছু আবেগ আমাদের জন্য নয়।যা আমাদের নয় তাদের চাওয়ার অধীকারও আমাদের নেই অধীকার চাইতে গেলেই মায়াজালে ফেঁসে যেতে হয় আর তার কাছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অমৃত খুঁজে পাওয়ার মতোই কঠিন হয়ে পড়ে।

নাদিম জানালার গ্রিলগুলোকে হাত দিয়ে শক্ত করে আকড়ে ধরলো।তার চিৎকার করে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে, সে তো নিজেও জানে না কখন কোন মুহুর্তে, ঠিক কিভাবে,কেনো? কোন কারণে সে শ্রীজার মায়ায় আটকে পড়েছে।নাদিম সবটা জানে শ্রীজা বিবাহিত সেটাও সে জানে, আর এই কথাটা শরৎ নিজে তাকে জানিয়েছে।সে অবাক হয়ে শুনেছিলো সে কথা,শরৎ ছেলে মানুষ হিসেবে খুব ভালো।আর বুদ্ধিমান তো বটেই, তা না হলে কথার ছলে কি এতো সহজে কেউ কাউকে বলে দিতে পারে…

“ও আমার স্ত্রী,আর পাশের জন আমার বোন চারু।আমার ওয়াইফের সাথে তোমার মা মানে নাইমা আন্টির খুব ভাব।প্রায় আমাকে তোমার মায়ের কথা বলে ও,আন্টি নাকি বেশ ভালো রান্না করে!তুমিও নাকি একদিন কি একটা রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলে আমাদের বাড়িতে, আমার বোন আর ওয়াইফ তো সে খাবারের স্বাদ এখনো ভোলেনি সুনাম করতে ভোলে না।তাই তোমার কাছে এলাম রান্নার টিপস্ গুলো জানতে।”

নাদিমও হেঁসে উত্তর দিয়েছিলো সেদিন তবে আহামরি কিছু নয়,একদম সাধারণ আর সহজ সরল ভাবে।নাদিম জানালার পাশ থেকে সরে গেলো।ঘরে এসে খাটের ওপর বসে ফোন ঘাটতে লাগলো কিছুক্ষন।এরপর একটা গান প্লে করলো ফোনে লো সাউন্ডে…
“এই অবেলায় তোমারই আকাশে
নিরব আপোষে ভেসে যায়”

গানের এক একটা বাক্য যেনো কিভাবে,কেমন ভাবে অনুভূতীগুলোর সাথে মিলে যায়।অবাক লাগে মাঝে মাঝে নাদিমের,যারা লিখে ঠিক কতোটা অনুভূতী নিয়ে লিখেন তারা?কতোটা কষ্ট আর আবেগ মাখা গান গুলো,যারা শোনে তারাই অনুভব করতে পারে।নাদিমের ঘরের দরজায় ঠক ঠক করে আওয়াজ পড়লো, নাদিম গানটা অফ করে দিয়ে দরজা খুলে দেখতে পেলো।তার মা নাইমা দাড়িয়ে আছেন।নাইমা সৌজন্যতার খাতিরে একটা হাঁসি দিলেন,নাদিমকে বললেন…

“সবাই খেতে বসেছে,রাত তো আর কম হলো না দ্রুত খেতে আয় বাবা।”

নাদিম ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন।নাইমা হেঁসে দ্রুত পায়ে খাওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন,সে জানে নতুন বউ সবার সামনে খেতে পারবে না ভালো করে, তাই তার সেখানে থাকাটা প্রয়োজন আর নাইম সাহেব তো এখনো একটা অগোছালো মানুষ সব কাজ তার এগিয়ে দিতে হয়।সংসার নিয়ে বেশ ব্যাস্ত তিনি।
খাবার টেবিলে পিনপতন নিরবতা কারো মুখে তেমন কোনো আওয়াজ নেই শুধু নাইমা ছাড়া,উনি সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন আর ইকটু পর পর নতুন বউয়ের পাতে হরেক পদের খাবার গুছিয়ে দিচ্ছেন,আর টুকটাক কথা বলছেন তার সাথে ফ্রি হবার জন্য।নাইমার বয়স বোঝা যায় না এখনো সে খুব চটপটে আর গোছালো স্বভাবের।তার স্বভাব আচরেণ নিচে বয়স যেনো চাপা পড়ে যায়।নাদিম ফ্রেশ হয়ে এলো, পড়নে টাউজার আর পাতলা কালো রঙয়ের টিশার্ট।বাবার পাশের চেয়ারে বসলো সে।নাইমা এক প্রকার দৌড়ে গেলেন ছেলের কাছে দ্রুত ভাত প্লেটে বেড়ে দিতে দিতে বললেন…

“এতো দেড়ি করলি ক্যান বাবু?সবার খাওয়া শেষের দিকে প্রায় এখন একা খেতে ভালো লাগবে তোর?খাবারও কেমন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

নাদিম হাঁসলো,হাত দিয়ে ইশারা করে ভাত দেয়া থামাতে বললো তার মাকে।কথায় কথায় বেশ ভালোই ভাত দেয়া হয়ে গেছে নাদিমের পাতে,তার সেদিকে খেয়াল ছিলো না।নাদিম ভাত নাড়তে নাড়তে বললো…

“তুমিও তো সবার শেষে খাও সব সময়,আজ আমিও তোমার সাথে খাই।”

নাইমা দেশি মুরগীর ঝোলের বোলটা হাতে নিতে নিতে হাসঁলেন,নাইম সাহবে কে মনে করিয়ে দেবার জন্য সুযোগ মতো বললেন…

“বিয়েটা দ্রুত কর তাহলে তুই আমি আর তোর বউ এক সাথে বসে খেতে পারবো।আমারও একা থাকা হবে না,বন্ধবী হবে একটা।”

নাদিম কিছু বললো না।ঝোলে ভাত মাখিয়ে খেতে লাগলো।নাইম সর্বদা পোলাও,রোস্ট এসব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে,তার কাছে কেনো জানি সাদা ভাতটাই বেশি ভালো লাগে।নাইমারও একই তাই নিজের ছেলে আর নিজের পছন্দ মতো কয়েকটা পদ রান্না করেছেন তিনি তা ছাড়াও পোলাও কোরমা সব আছে, কুটুমদের জন্য ওসব রাখা সাথে এগুলো আলাদা করে যোগ হয়েছে।নাইম সাহেব মাসের ডাল নিতে নিতে নাইম কে বললেন….

“শোন মেয়েটার নাম হচ্ছে মেঘা,এবার অনার্স ফাস্ট ইয়ারে।সহজ ভাষায় এক বছর আগে এইচএসসি দিয়েছে।ওর বাবাকে তুই চিনবি তোর শফিক আংকেলের মেয়ে।আর মেয়ের নাকি পড়াশোনা করার ইচ্ছেও আছে অনেক, তাই বিয়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে যাবে।ওইটা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই পড়াশোনা করার হক সবারই আছে।মেয়ের ছবি তোর ওয়াটস্এপ এ পাঠিয়ে দিয়েছি আমি,সাথে ফোন নম্বরও কথা বলতে পারিস।কই দেখা করবি তা তোরা নিজেরা ডিসাইড করেনে।সব কি আমরাই ঠিক করে দেবো নাকি?আর শোন মেয়েটা কিন্তু বেশ ভালো।ভদ্রও খুব আস্তে ধীরে কথা বলবি,মতামত জানতে চাইবি, আর কথা গুছিয়ে বলবি ব্যাস,আর হ্যা কোনো কথায় খারাপ লাগলে বা তুই হার্ড হলেও বুঝতে দিবিনা।সব সময় মুখে কৃত্তিম একটা হাঁসি ঝুলিয়ে রাখবি।এটাও একটা পার্সোনালিটি বুঝলি?”

নাদিম মাথা নাড়িয়ে বললো…

“হুম..”

নাইম সাহেব কথা বাড়ালেন না।অহেতুক কথা বলাটা পছন্দ নয় তার।যতোটুকু প্রয়োজন ততোটুকুই বলার চেস্টা করেন।মাঝে মাঝে নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটে নাইমার ক্ষেত্রে।তাছাড়া কারো সাথে তেমন ভাব নেই তার।

নাদিম দ্রুত খেয়ে উঠে গেলো।কিছু একটা মনে করে ছাঁদের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলো ছাদের উদ্দেশ্যে নাইমা ছেলেকে চাবি নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে প্রশ্ন করলেন…

“কই যাচ্ছিস, হাতে ছাঁদের চাবি কেনো?”

নাদিম জুতা পড়ে সিড়ি দিয়ে যেতে বললো…

“ঘরে বোরিং লাগছে মা তাই ছাঁদে যাচ্ছি।”

নাইমা আবার জোড় গলায় বললেন…

“তারাতাড়ি চলে আসিস বেশি রাত করিস না বাপ।”

ওপাশ থেকে নাদিমের কোনো উত্তর এলো না।ছাঁদের দরজা খুলে ছাঁদে গিয়ে দাড়ালো।এই ব্যাস্ত শহরে গাড়ি ঘোড়া, এতো এতো মানুষের ভীরে শান্তিতে খোলা আকাশ দেখাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।ছাঁদ ছাড়া যেনো আকাশ দেখবার জন্য সহজ কেনো গতি নেই।নাদিম আকাশের পানে তাকালো।সাথে সাথে তার চোখ ভরে উঠলো অভিমান,আক্ষেম,কষ্ট মিশ্রিত অনুভূতীদের জানান দিতে।সে সকলের সামনে কাদঁতে পারে না।সে তো ভাবেনি সে কোনো দিন কাউকে ভালোবাসবে।আর এমন কাউকে বাসবে যাকে পাওয়া অসম্ভব, যাকে পাওয়া তো দূর চাওয়াও পাপ।নাদিম আকাশের দিকে ভালো করে দেখলো, সে এখন সে জায়গায় টায় দাড়িয়ে আছে যেখানে শ্রীজার সাথে তার প্রথম কথা হয়েছিলো।নাদিম দু হাত পকেটে পুড়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো।ব্যাথিত কন্ঠে বলে উঠলো…

“আমার সাথে যা হইসে,তা যেনো আর কারো সাথে না হয়।আর কোনো শ্রীজা যেনো, কোনো নাদিমের জীবনে অবেলায় অসময় হানা না দেয়।অবেলায় শ্রীজাদের আগমন,নাদিমদের শেষ করে দেয় ছন্নছাড়া করে দেয়।”

নাদিম এবার কিছুটা চিৎকার করে বললো…

“শ্রীজা শুনছো??? “#অবেলায়_তোমার_আগমন🥀”আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।কেনো আসলা তুমি আমার জীবনে?ক্যান তোমার ছায়া পড়লো আমার দুনিয়াতে?আমি তো তোমারে চাই নাই তুমি আসছো।তাইলে অন্যের হইয়া আমার জীবনে ক্যান ছাঁয়া দিতে আসলা?জানো না তুমি?কারো জীবনে ভালোবাসা হয়ে গেলে তার জীবনে শুধু নিজের ছায়া না পুরো নিজেকেই বিলিয়ে দিতে হয়।তুমি অন্য কাউরে ভালোবাসো,তুমি তোমার শরৎ ভাইরে ভালোবাসো। আমি জানি সব, সব জানি আমি,আমিও তো তোমারে ভালোবাসি ঠিক তেমন করে যেমন করে তুমি তোমার শরৎ ভাইরে ভালোবাসতা।তুমি তো ঠিকই তোমার শরৎ ভাইরে পাইলা কই আমি তো পাইলাম না,ক্যান পাইলাম না?আমার জানামতে আমার ভালোবাসায় তো কোনো খুঁত ছিলো না?,আমার ভালোবাসাটা শুধু আমার পক্ষ থেকে একপাক্ষিক।তাই এতো যন্ত্রনায় আছি আমি।খুব কষ্ট হয় আমার খুব।তুমি তো তোমার ভালোবাসারে দেখতে পাও ধ,রতে পারো,কথা বলতে পারো তার সাথে।আমি তো পারি না।তুমি তো জানিয়ে দিসো তোমার ভালোবাসাকে।আমি জানতে দিবো না তোমাকে আমি তোমারে ভালোবাসছি।আমি বলবো না আমার অবক্ত্য কথা।ভালো থাকো তুমি।আমি সেই ভালো থাকা দেখবো।তুমি ভালো থাকো।”

#চলবে_

#অবেলায়_তোমার_আগমন🥀
#পর্ব_সংখ্যা_৩৭
#Adrrija_Aman(লেখনীতে)

বেশ কয়েকদিন কেঁটে গিয়েছে।শ্রীজা এখন আগের চাইতে অনেকটা সুস্থ।শরৎও অফিসে যাওয়া শুরু করেছে চারুর এইচএসসি এক্সামের লাস্ট ডেট আজ,এক্সাম দিয়েই এবাড়িতে চলে আসবে সে,থাকবে বেশ কদিন তার জাবিতে চান্স পাবার জন্য কিছু পড়াশোনা বাকি যেটা সে এখানে শ্রীজার কাছে করবে।আবারও বিয়ের আমেজ চলছে এ বাড়িতে নাদিমের বিয়ে ঠিক হয়েছে মেঘার সাথে।আজ তাদের গায়ের হলুদ,ছাঁদের ওপড়ে রান্নার তোড় জোড় চলছে।মিসেস নাইমা এবারও শ্রীজাকে দাওয়াত দিতে ভুললেন না।কিন্তু শ্রীজা অসুস্থতার বাহানা দিয়ে পুরোটা বিষয় এরিয়ে গেলো।ওপরে বক্সে জোড় তালে গান বাজচ্ছে আজ কালকার ছেলে পেলেদের উল্টা-পাল্টা গান যাকে বলে।’পোলা তো নয় যেনো আগুনেরই গোলা।’
গান শুনতে শুনতে শ্রীজার মাথা ধরে যাচ্ছে প্রায় এমন অবস্থা।দরজা জানালা লাগিয়ে দিলো শ্রীজা। যেনো গানের আওয়াজ তার ঘর পর্যন্ত পৌছঁতে না পাড়ে।সন্ধ্যায় ঘুম আসবে না,তাই রিদা কে ফোন করলো সে।রিদা আর সামির সম্পর্কটা এখন জমজমাট বিয়ের কথাবার্তা চলছে এখন।রিদার বিষয়টা নুপূর,শ্রীজা,আর আচঁলই সামিকে জানিয়েছিলো।সামিও মনে মনে পছন্দ করতো রিদাকে,মিয়া বিবি রাজি তাহলে আর ঠ্যাকায় কে? রিদার সঙ্গে কিছুটা সময় কথা বলে ফোনটা কেঁটে দিলো শ্রীজা।ফোন কেঁটে বিছানায় বসতেই খেয়াল করলো গানের আওয়াজ আর আসছে না।বন্ধ হয়ে গিয়েছে, হাফ ছেঁড়ে বাচঁলো যেনো ও।কিছুক্ষন বাদে চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলো ও,প্রথমে তেমন পাত্তা না দিলেও পরে চেঁচামেচির আওয়াজ বেড়ে গেলো।দরজা খুলতেই কানে ভেসে আসতে লাগলো মানুষের পায়ের পদ-ধ্বনি, সবাই অগোছালোভাবে এলোমেলো ভাবে দৌড়ে চলছে।ওপর থেকে কয়েকজনের চিৎকার ভেসে আসছে,শ্রীজা স্পষ্ট শুনতে পেলো কেউ একজন আগুন আগুন বলে চিল্লাচিল্লি করছে যে যার মতো ছাদঁ থেকে বেরিয়ে আসছে।আগুনের শিখা যেনো বাড়তেই লাগলো মুহুর্তেই বিদুৎ চলে গেলো পুরো বাড়ির।মেইন সুইচ হয়তোবা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে।সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে শ্রীজা দেখলো তার চারপাশ ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।দম নেয়া কষ্টকর হয়ে উঠছে।চোখগুলো জ্বলে যাচ্ছে আগুনের ধোঁয়ায়।শ্রীজা বুঝতে পারলো যতো সময় বাড়ছে ততো বেশি আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ছে পুড়ো বাড়িতে।প্রায় সবাই নিরাপদ স্থানে চলে গিয়েছে।দেড়ি করেছে শুধু শ্রীজা কিছু দেখতে পারছে না সে।হাত দিয়ে দেয়ালে ঠেস মেরে দাড়ালো ও হাত বাড়িয়ে দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিচে নামার চেস্টা করলো।কিন্তু সে পারছে না।গরমে পুরো শরীর ঘেমে একাকার নিঃশ্বাস নেয়া যাচ্ছে না।জোড় করে শ্বাস নিতে গেলোও কাঁশি উঠে যাচ্ছে,এ বাড়ির ভেতরে বাহিরের বাতাসে এখন বিষ মিশে গিয়েছে।শ্রীজা নামতে গিয়েও পাড়লো না।হুট করে সিঁড়ির এক কোণায় বসে পড়লো,শ্রীজা টের পাচ্ছে তার জ্ঞান হারাবে।কিন্তু সে কিছু করতে পারছে না।নিজের শরীরে সর্বশক্তি দিয়ে শ্রীজা জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয়ার চেস্টা করতে লাগলো।আশার আলো দেখা পাবার আশায় টানা টানা স্বরে খুব কষ্টে কিছুটা জোড়ে সাহায্য চাওয়ার আকুল আবেদন করলো…

“শু শুনছেননন কেউউ আছেন?আ আমি এখানে।কেউ কেউ আছেন?”

বিধিবাম কেউ এলো না।শ্রীজার কপাল মন্দ,কিছুক্ষণের জন্য ওর মনে হলো।মৃত্যুর ফেরেশতা ওর খুব নিকটে,অতি শিঘ্রই সে আসতে চলেছে শ্রীজার কাছে।মৃত্যু শ্রীজার দোয়ারে কড়া নাড়ছে।মনে হচ্ছে মৃত্যু কর্কষ কন্ঠে বলছে…

“অনেক পালিয়ে বেড়িয়েছো আমার কাছ থেকে।এবার আছে ছাড়া পাচ্ছো না।”

শ্রীজার বুক কেঁপে উঠলো,সে তো মরতে চায় না।যেতে চায় না এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে,শরৎ নামক ছেলেটিকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে।তার ভালোবাসাকে ছেড়ে সে যেতে চায় না,আরো কতো যুগ যে শরৎ এর সাথে তার থাকার ইচ্ছে আছে,সে কথা শ্রীজা নিজেও জানে না।শ্রীজা চলে গেলে তো শরৎ নামের ছেলেটি অন্যকারো হয়ে যাবে।যা সহ্য করতে পারবে না শ্রীজা,কখনোই পারবে না।মৃত্যুর পরও সে শান্তি পাবে না।শ্রীজার তো এখনো শরৎতের মুখ থেকে ভালোবাসি ডাক শোনা বাকি আছে।রাস্তার পাশে দাড়িয়ে চানাচুর মাখা খাওয়া বাকি আছে,ঝাল করে ফুঁচকা, ঝালমুড়ি খেয়ে কান্না করে,শরৎতের কাছ থেকে বকা শোনা বাকি আছে।শরৎকে আরো অনেকবার শতোবার হাজারবার ভালোবাসি বলা বাকি আছে।কাঁদতে কাদঁতে শরৎতের শার্টে কোণায় চোখের জল মোছা বাকি আছে,লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে শরৎতের বুকে মুখ লুকানো বাকি আছে,প্রথমবারের মতো হাজারবার শরৎয়ের চোখের মায়ায় পড়া বাকি আছে।শরৎয়ের সাথে ঝগড়া খুনশুটি করা বাকি আছে।শরৎ আর তার সংসারটাকে গোছানোর অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পূর্ন করা বাকি আছে।তাহলে এতো দ্রুত সে চলে যাবে কি করে?এতো কিছু এতো স্বপ্নগুলো কি হবে?শরৎকে তো সে কারো হতে দিতে পারবে না্।সে তো বাচঁতে চায় তাহলে বিধাতা কেনো বারে বার মুখ ফিরিয়ে নেয়?শ্রীজার হঠাৎ করে কাঁশি পেলো।ওড়না দিয়ে মুখ চেঁপে ধরে কাঁশতে লাগলো সে।দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর,আবার শ্রীজার মনে হলো সে বোধয় এবার মরেই যাবে, কিন্তু মৃত্যুর আগে তো শরৎকে সে দেখতে চায়।তার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চায়।শেষ বারের মতো ভালোবাসি বলতে চায়।তাহলে কি সব বৃথাই রয়ে যাবে?কোনো কিছু পূর্ণতা পাবে না।মুছে যাবে শ্রীজার ভালোবাসা,পৃথিবীর মাঝ থেকে উধাও হয়ে যাবে শ্রীজার সব স্মৃতি?যে দেহটায় এখন প্রাণ আছে সে দেহটাও ইকটু পর নিথর হয়ে পড়বে।মাটির নিচে চাপা পড়বে তার এতো সুন্দর দেহটা,যাকে এতোদিন এতো যত্ন করে এসেছে।শ্রীজা ওড়ায় মুখ চেঁপে রইলো।চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।সব অন্ধকার হয়ে উঠছে,আলোরা উধাও হয়ে যাচ্ছে মেনে নিচ্ছে পরাজয়,অন্ধকারেরা জিতে যাচ্ছে প্রায় তাদের উল্লাসের ধ্বনি যেনো মানুষের কান্না চিৎকার আর বিলাপের আওয়াজে পরিবর্তিত হচ্ছে।চোখ মুখ বন্ধ হয়ে আসছে ওর,তাহলে সব শেষ?নতুন অধ্যায়ের শুরু হবে না আর?শরৎয়ের মুখ থেকে ভালোবাসি শোনা হবে না?ভালোবাসা বিনিময় হবে না।সব ছাই হয়ে মিলিয়ে যাবে বাতাসে বাতাসে?

________

অফিসের কেবিনে বসে খুব দ্রুত গতিতে কাজ করছে শরৎ,কেনো যেনো কিছু ভালো লাগছে না তার।মাথার ওপর দামি এসি চলছে,তবুও তরতর করে ঘামছে শরৎ,টিস্যু-বক্স থেকে টিস্যু বের করে, ঘাম মুছে মুছে পাশে থাকা ছোট্ট ডাস্টবিনটাতে টিস্যুগুলো ছুড়ে ফেলছে সে।কাজের ক্ষেত্রে মোনোযোগি হবার চেস্টা করছে।সাথে কম্পিউটারের টাইপিং স্পিড বাড়াচ্ছে।বার বার ফোন বাজচ্ছে তার।কাজের সময় ফোন জিনিসটা একদম অপছন্দ শরৎয়ের।কলটা বার বার কেঁটে দিচ্ছে।তারপরও বেহায়ার মতো কেউ একজন ফোন দিয়ে চলছে।বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে,লোকটির নাম না জেনেই বললো…

“আপনার কি কোনো কান্ড-জ্ঞান নেই?দেখছেন বারবার ফোন কেঁটে দিচ্ছি তবুও ফোন করছেন?কেউ ব্যাস্ত না হলে বার বার এমন করে ফোন কাটে না নিশ্চই।”

ওপাশ থেকে শরৎয়ের প্রশ্নের উত্তর এলো না,কেউ একজন কান্নামাখা গলায় বললো…

“মিষ্টার শরৎ আপনাদের বাড়িতে আগুন লেগেছে।আপনার কাজিন শ্রীজাকে আমরা কেউই খুঁজে পাচ্ছি না।আপনি যথা সম্ভব দ্রুত চলে আসুন।”

কথাটা বলেই ফোন কেঁটে দিলো লোকটা।কে ফোন করলো?কিভাবে নাম্বার পেলো?কখন আগুন লাগলো?কেনো লাগলো কিছুই মাথায় আসছে না শরৎয়ের।সে তা মাথায় আনতেও চাইলো না।দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো অফিস থেকে।পেছন ফিরে একবার দেখলোও না।দেখার প্রয়োজনবোধ করলো না বোধয়।সিএনজি এসে থামলো বাড়ির সামনে।ধোঁয়ায় কালো হয়ে গিয়েছে চার-পাশ।ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেছেন।এখন ভেতর থেকে আহত নিহত ব্যাক্তিদের বের করার কার্যক্রম চলছে।নাইমাকে রাস্তার এক কোনায় মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো।তিনি রীতি-মতো কাঁদছেন।পাশের দাঁড়ানো দুজন মহিলা তাকে শান্তনা দিয়ে চলেছেন।কিন্তু তার কান্না থামছে না তার কথার ভাঁজে বোঝা গেলো।নাদিম কিছুটা আহত হয়েছে সে হসপিটালে ভর্তি।
শরৎ অপেক্ষা করলো না,সকলের বাঁধা নিষেধ অমান্য করে দৌড়ে গেলো ওপড়ে।হন্য হয়ে চারপাশে শ্রীজাকে খুঁজতে লাগলো।বার বার ফোন দিতে লাগলো শ্রীজার নম্বরে। কিন্তু ফোন বন্ধ।ইতিমধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন লোককে শ্রীজার ছবি দেখিয়ে তাকে খুঁজতে পাঠানো হয়ে গিয়েছে।শরৎ তন্নতন্ন করে খুজঁতে লাগলো চারপাশ।ব্যার্থ মনে হলো নিজেকে তার একটা সময়,কাঁদতে ইচ্ছে করলো প্রচুর।আশ পাশে ধোঁয়া আর ধোঁয়া নানান মানুষের আহাজারি।কেউ কেউ বিলাপ করছে।এক মুহুর্তের জন্য তার সকল অনুভূতীরা বদলে গেলো।সে অদ্ভুতভাবে বুঝতে পারলো সে শ্রীজাকে ভালোবাসে,অদ্ভুত সময়ে।সে ভয় পাচ্ছে শ্রীজার জন্য।একা লাগছে তার খুব হাহাকার, একাকিত্ব, কষ্ট,ভয়েরা তাকে ঝাপটে ধরেছে।সে শ্রীজাকে চাইছে খুব করে।তারও মনে হলো তার শ্রীজাকে কিছু বলার আছে,অনেক কিছু।শরৎ হতাশ হয়ে সিড়ির এক কোণায় বসে পড়লো।দু হাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরলো।এরপর হাত দিয়ে মুখ ঢেঁকে একবার ফুপিঁয়ে উঠলো ও।হঠাৎ ওর চোখ গেলো পাশে পড়ে থাকা লাল রঙয়ের একটা ওড়নার দিকে,যেটাতে সাদা আর কালো রঙয়ের সুতোর কাজ করা।ওড়নাটা শ্রীজার বেশ খানিকটা অংশ পুড়ে গিয়েছে।আরেকপাশে দেখলো শ্রীজার দুটো সাধারণ জুতো পড়ে রয়েছে।সেগুলোও পুড়ে গিয়েছে প্রায়।তার মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো।এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো সে শ্রীজাকে হারিয়ে ফেলেছে চিরতরে,চির জীবনের জন্য।হঠাৎ ফায়ার সার্ভিসের একজন লোক এলো,হাতে স্মার্ট ফোন।শরৎয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ডাক দিলো।শরৎ নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করতেই,লোকটা শরৎয়ের বুক কাঁপিয়ে দেয়ার মতো একটা বাক্য বললো।যা শুনে শরৎ মুহুর্তেই যেনো মানব মূর্তিরূপ ধারণ করলো।বাক্যটি এমন…

“আপনার বর্ননা অনুযায়ী একটি মেয়েকে খুঁজে পেয়েছি আমরা।কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে ঘন্টা খানেক আগেই তিনি সি.টি হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেছেন।”

লোকটি ব্যাথিত স্বরে কথাটি বলে।মাথা নিচু করে ধীর পায়ে হেঁটে নিচে চলে গেলো।
শরৎ নড়লো না কিছুক্ষন ওভাবেই সেখানে দাড়িয়ে রইলো।এরপর হাতে থাকা লাল রঙয়ের ওড়নাটাকে খুব গভীরভাবে মোনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।তার চোখের ভেতর নোনাজল ভেসে উঠছে।ঝাপসা চোখে সে এক নারীমূর্তি দেখতে পেলো।নারীমূর্তিটি তার খুব কাছে, খুব,হঠাৎ সে শরৎয়ের কানের সামনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো…

“আমি বলেছিলাম না শরৎ ভাই।আপনি আসবেন ভালোও বাসবেন কিন্তু অবেলায় আসবেন,অসময়ে আসবেন।যখন আসবেন তখন আমি হারিয়ে যাবো।সেখানে হারিয়ে যাবো যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না।”

শরৎয়ের শ্রীজার ভার্সিটির ক্যাম্পাসের সেই দিনের ঘটনা মনে পড়লো।সে চমকে গিয়ে নারী মূর্তিটিকে ছুঁতে চেয়ে বলে উঠলো…

“শ্রীজা আমি..”

শরৎকে কিছু বলতে না দিয়ে সে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে লাগলো।শরৎ তাকে ডাকছে খুব জোড়ে, কিন্তু সে শুনেও শুনছে না।বেপরোয়ার মতো একটা মানুষকে একা করে দিয়ে চলে যাচ্ছে।পাশান হৃদয়ের মানবি সে।কষ্টরাই তো তাকে ঘিরে ধরেছিলো তার ভেতর কষ্টের বাসস্থান তৈরি করে।পাথর হৃদয়ের মানবিতে পরিনত করেছে তাকে।
#চলবে_