অর‌ণ্যে রোদন পর্ব-৩২+৩৩

0
280

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৩২

শ্রাবণ, তূবা‌কে সাই‌কে‌লে ক‌রে বা‌ড়ির পা‌শে না‌মি‌য়ে বলল, ‘তা‌মিম‌কে ব‌লো আজ সন্ধ্যার পর পড়াতে আস‌তে পারব না।’
‘‌কেন?’
‘এক বন্ধুর জন্ম‌দিন আছে। সেখানে‌ যাব।’
‘আচ্ছা।’
‘‌গেলাম।’
‘যা।’
‘‌কিছু বলবা না?’
মৃদু হে‌সে তূবা বলল, ‘না বলব না।’
‘কিছু না ব‌লো সেটা ওকে, বাট তুই বলাটা বন্ধ ক‌রো।’
‘‌কেন?’
‘নি‌জের হবু স্বামী‌কে কেউ তুই তুকা‌রি ক‌রে? পাপ হ‌বে তো।’

তূবা হেসে বলল, ‘‌সেটা বি‌য়ের পর ‌দেখা যা‌বে। তত‌দিন তুই তুকা‌রিই করব।’
শ্রাবণ গাল ফুলা‌লো। তূবা হেসে বলল,
‘আচ্ছা যখন একা‌কি থাকব তখন বলব না। বা‌কি সবার স‌ামনে আগের ম‌তোই ডাকব। এখন যাও।’
শ্রাবণ হে‌সে বলল, ‘আচ্ছা।’

তূবা ঘ‌রে ঢোকার পর তূবার বাবা তা‌রিক সা‌হেব বলল,
‘‌কোথায় গি‌য়ে‌ছি‌লি?’
তূবা মিথ্যা বলল, ‘শম্পা‌দের বা‌ড়ি।’
‘ওহ। তা শ্রাব‌ণের সাই‌কে‌লে কী ক‌রে আস‌লি?’
তূবা একটু ভাবনায় প‌ড়ে গেল। বলল, ‘শম্প‌দের বা‌ড়ি থে‌কে বের হ‌য়ে আস‌ছিলাম তখন শ্র‌াবণও ওদিক দি‌য়ে আস‌ছিল। আমা‌কে বলল, আপু ওঠো একসা‌থে যাই। তাই ওর সা‌থে চ‌লে আসলাম।’
‘আচ্ছা। ভিত‌রে যা।’

তূবা ভিত‌রে গিয়ে দেখল, ওর ছো‌টো ফু‌পি তহ‌মিনা এসে‌ছে। ম‌হিলাকে দেখ‌লেই তূবার মেজাজ খারাপ হ‌য়ে যায়। যখন আস‌বে একটা ক‌রে নতুন নমুনা সা‌থে নি‌য়ে আসে। আজও তার বিপরীত হয়‌নি। তূবা‌কে দেখ‌তেই তি‌নি তূবার হা‌তে একটা ছ‌বি দি‌য়ে বলল,
‘‌দেখ তে‌া ছে‌লেটা কেমন? এ ছেলে কিন্তু বিবা‌হিত না। প্রচুর ধনী। বয়সটা একটু বে‌শি। ত‌বে পুরুষ মানু‌ষের আবার বয়স। ঐ যে ব‌লে না সোনার আং‌টি আবার বাঁকা।’

আজ আর তূবা নি‌জে‌কে নিয়ন্ত্রণ কর‌তে পারল না। রা‌গে মাথায় বেশ চেঁ‌চি‌য়ে ব‌লে ফেলল, ‘ফু‌পি‌ তোমার সমস্যা কী বল‌বে?’
‘আমার আবার কী সমস্যা?’
‘দু‌দিন পর পর একটা ক‌রে নমুনা নি‌য়ে আসো। তু‌মি এসব আমার জন্য কেন আনো? তোমার নি‌জেরও তো একটা অবিবাহিত মে‌য়ে আছে। তাকে কেন এসব নমুনার কা‌ছে দিচ্ছ না। আমার জন্যই কেন আনো?’

তূবার ফু‌পি বেশ রাগ ক‌রে বলল, ‘আমার মে‌য়ের পেটটা তোর ম‌তো পচা না।’
‘‌আমার তো পেট পচা, তোমা‌র মে‌য়েরা যা-ও আছে। তোমার বড় ছে‌লের তো চ‌রিত্রটাই পচা। ক‌দিন আগে পরকীয়া করার জন্য পাব‌লিক ওরে গন‌ধোলাই দি‌ছিল না? তু‌মি আমার চিন্তা বাদ দি‌য়ে নি‌জের ঘরের চিন্তা ক‌রো।’

‘তুই আমা‌কে এত বড় কথা বলতে পার‌লি?’
‘হ্যাঁ পারলাম। কারণ তু‌মি আমার জীবনটা‌কে অতিষ্ট ক‌রে তু‌লে‌ছো। দু‌দিন পর পর বা‌ড়ি আসো, সা‌থে একটা ক‌রে নমুনার ছ‌বি, না হয় প‌রিচয় নি‌য়ে আসো? কেন আমি কি বা‌নের জ‌লে ভে‌সে এসে‌ছি যে আমা‌কে যার তার সা‌থে বি‌য়ে দি‌তে হ‌বে? শো‌নো ফু‌পি আমার বিয়া নি‌য়ে তোমা‌কে চিন্তা কর‌তে হ‌বে না।’

তূবার ফু‌পি ত‌হমিনা বেশ ঝাঁজালো ক‌ণ্ঠে বলল,
‘‌চিন্তা তো সা‌ধে ক‌রি না। তোর ম‌তো বাজা মে‌য়ে‌কে কে বি‌য়ে কর‌বে? নেহাৎ আমার ভাইটা‌কে ভা‌লোবা‌সি, তোর চিন্তা ক‌রি ব‌লে বারবার ছু‌টে আসি।’

তূবাও বেশ ক‌ঠিন গলায় বলল,
‘‌তোমা‌কে চিন্তা কর‌তে হ‌বে না। আমার যখন ম‌নে হ‌বে বিয়ে করা দরকার আমি নি‌জে গি‌য়ে ছো‌টো চা‌চির কা‌ছে বলব। আমার জীবন নি‌য়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার আছে, তোমার নেই। তু‌মি আমার মা‌কেও কম জ্বালাও‌নি। মা মরার পর তু‌মি আমার জীবনটাও অতিষ্ট ক‌রে তু‌লেছে‌া।’

তূবার কথা শু‌নে তা‌মিমা ধমক দি‌য়ে বলল,
‘এসব কী বল‌ছিস তূবা?’
‘একদম ঠিক বল‌ছি, চা‌চি। উনি আমার মা‌কে কম জ্বালায়‌নি। মা যখন মারা গে‌ছেন তখন আমি অতটা ছো‌টো ছিলাম না যে ম‌নে থাক‌বে ন‌া। মা গরীব ঘ‌রের মে‌য়ে ছি‌লেন ব‌লে, এই ম‌হিলা উঠ‌তে বসতে খোটা দি‌তেন। বল‌তেন বাবা‌কে আর দাদা‌কে রূপ দে‌খি‌য়ে বশ ক‌রে‌ছে। অথচ দাদাজান নি‌জে মা কে ঘ‌রের পুত্রবধূ হিসা‌বে পছন্দ ক‌রে এনে‌ছি‌লেন।

নানাজান গরীব ছি‌লেন ব‌লে মা‌কে কম অপদস্থ করত না এই ম‌হিলা। আমার মায়ের তো পরীর ম‌তো রূপ ছি‌লেন এ ম‌হিলার তো কিছু নেই। না রূপ না ব্যবহা‌রের গুণ। আমার জীব‌নে সিদ্ধান্ত নেবার উনি কে? বাবা ওনা‌কে বল‌ছে আমার জন্য ছে‌লে দেখ‌তে? উনি আগ বা‌ড়ি‌য়ে এসব কেন ক‌রেন? উনি তো উনার চ‌রিত্রহীন বড় ছে‌লের জন্যও আমা‌কে নি‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন তা কি এম‌নি এম‌নি? কী ভে‌বে‌ছে উনি আমি কিছু বু‌ঝি না? উনি তো আমার সম্প‌ত্তির জন্য তার ছে‌লের বউ কর‌তে চে‌য়েছি‌লেন। কিন্তু আল্লাহ মহান যে তারপর আমি অসুস্থ হওয়ায় আমার সমস্যাটা ধরা পরায় তার ছে‌লে রা‌জি হয়‌নি। নয়‌তো এই বজ্জাত ম‌হিলা‌কে শাশু‌ড়ি হিসা‌বে পে‌লে আমার জীবনটা জাহান্নাম হ‌য়ে যেত।’

তূবা হুট ক‌রে ড্র‌য়িং রু‌মে ওর বাবা চাচার সাম‌নে গি‌য়ে দাঁড়াল। তারাও তূবার কথা শুন‌ছি‌লেন কিন্তু তূবা এতটাই স‌ত্যি কথা বল‌ছিল যে তারা তূব‌া‌কে ইচ্ছা ক‌রে থামা‌ননি। তূবা ওর ‌ছো‌টো চাচার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল, ‘চাচ্চু, আমি ‌কি তোমা‌দের এতটা বোঝা হ‌য়ে গে‌ছি যে আমা‌কে তোমরা যার তার সা‌থে বি‌য়ে দি‌য়ে তাড়া‌তে চাচ্ছ?’

তূবার ছো‌টো চাচা আরিফ বলল, ‘‌ছি! ছি! মা কী বল‌ছিস এসব? তুই আমা‌দের সবার প্রিয়।’
‘তাহ‌লে তোমা‌দের বোন‌কে এসন ফালতু কাজ কর‌তে নি‌ষেধ ক‌রো। ফু‌পি আজ আমি ভা‌লোয় ভা‌লোয় একটা কথা ব‌লে দি‌চ্ছি, এর পর এ বা‌ড়ি আস‌বে অতিথী হিসা‌বে। অতিথী হিসা‌বে খে‌য়ে বিদায় হবে। আমা‌কে নি‌য়ে তোমার মাথা ঘ‌ামা‌তে হ‌বে না। আমার নি‌জের চিন্তা আমি নিজে ক‌রে নিব।’

তূবার কথাগু‌লো তহ‌মিন‌ার গা‌য়ে খুব লাগল। রা‌গের মাথ‌ায় বলল, ‘ভাইয়া তু‌মি একটা বেয়াদব জন্ম দি‌য়ে‌ছো। যেমন মা তার তেমন মে‌য়ে।’
তা‌রিক সা‌হেব তহমিনার দি‌কে তা‌কি‌য়ে রা‌গি কণ্ঠে বলল,
‘খবরদার তহ‌মিনা, তূবার মা‌য়ের সম্প‌র্কে একটা উলটা পালটা কিছু বল‌বি না। তূবা ভুল কিছু ব‌লে‌নি। যা ব‌লে‌ছে স‌ত্যি ব‌লে‌ছে।’
‘তু‌মি তোমার অসভ্য মে‌য়ের কথায় সায় দি‌চ্ছো ভ‌াইয়া?’
‘হ্যাঁ দি‌চ্ছি। ওর যখন ম‌নে হ‌বে বি‌য়ে করা দরকার ওকে তখন বি‌য়ে দিব আর ও যার সা‌থে বল‌বে তার সা‌থে বি‌য়ে দিব।’
‘‌মে‌য়েকে এত লাই দেওয়া ঠিক না ভাইয়া। প‌রে যখন আকাম ক‌রে আস‌বে তখন পস্তা‌বে।’
‘পস্তা‌লে আমি পস্তাব তোর ভাব‌তে হ‌বে না।’

তূবা নি‌জের রুমে চ‌লে গেল। তহ‌মিনাও রা‌গে গটগট কর‌তে কর‌তে বা‌ড়ি থে‌কে বের হ‌য়ে গেল। রু‌মে এসে তূবা আবার বের হ‌য়ে গেল। ফ্রিজ থে‌কে ঠান্ডা পা‌নি বের ক‌রে পু‌রো বোতলতা তিন বা‌রে শেষ ক‌রে তা‌মিমা‌কে বলল,
‘চা‌চি, খিদে পে‌য়ে‌ছে।’

তামিমা ঠোঁট টি‌পে হে‌সে বলল,
‘যা ঝগড়া ক‌রে‌ছিস তা‌তে খি‌দে তো পা‌বেই। বস নাস্তা দি‌চ্ছি।’
‘চা‌চি, আমি কি ভুল কিছু ব‌লে‌ছি?’
‘না। বরং আমা‌দের সব‌ার ম‌নের কথা তুই একা ব‌লে দি‌য়ে‌ছিস। আমি তো ঘ‌রের বউ। তাই চে‌য়েও অনেক‌কিছু বল‌তে পা‌রি না। তুই তো মে‌য়ে তোর কো‌নো ভয় কর‌তে হ‌বে না। তাছাড়া তোর বাপ চাচারা তোকে সবসময় সা‌পোর্ট ক‌রে।’
‘চা‌চি, তোমার কি মনে হয় বে‌শি ক‌রে‌ছি?’
‘একটু বে‌শি। ত‌বে এত‌দিন তোর সা‌থে যা ক‌রেছে তার তুলনায় অনেক কম।’
তূবা হাসল। হাসল তামিমাও।

আমার নতুন বই “রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া” এর প্রি অর্ডার চল‌ছে। ‌প্রি অর্ডার লিংক সবার শে‌ষে দেওয়া। পা‌শে থাক‌বেন।

৩৫!!
সন্ধ্যার পর,
নিহাদ বাসায় আসল। মো‌মেনা‌কে জি‌জ্ঞেস করল,
‘মা, কথা কোথায়?’
‘ও তো ডাক্তার কা‌ছে গে‌ছে।’
‌নিহাদ চম‌কে উঠে বলল,
‘‌কেন?’
‘তা তো জা‌নি ন‌া। বলল, শরীরটা ভা‌লো লাগ‌ছে না। ডাক্তার দেখা‌বে। আমি সা‌থে যে‌তে চাইলাম বলল, তো‌কে ফোন ক‌রে বল‌বে যে‌তে। কেন ব‌লে‌নি?’
‘কোন হস‌পিটা‌লে?’
‘সি‌টি তে। পূ‌র্বেও না‌কি সেখা‌নে গে‌ছিল।’
‘কখন গে‌ছে?’
‘এই তো মাগ‌রি‌বের কিছুক্ষণ আগে। বলল সা‌ড়ে সাতটায় ডাক্তা‌রের কা‌ছে এ্যাপ‌য়েন্ট‌মেন্ট।’

‌নিহাদ দ্রুত বাই‌কের চা‌বি নি‌তে নি‌তে বলল,
‘‌গেল আমার সব প্ল্যান, ভে‌স্তে গেল।’
‘কী হ‌য়ে‌ছে?’
নিহাদ দ্রুত বাসা থে‌কে বের হ‌তে হ‌তে বলল,
‘মা, এসে সব বল‌ছি।’
‌নিহাদ গা‌ড়ি নি‌লো না। ভাবল খুলনা শহ‌রে এসময় যে জ্যাম। তা‌তে গা‌ড়ি নি‌লে দ্রুত পৌঁছা‌তে পার‌বে না।’

‌নিহাদ বেশ দ্রুতই হস‌পিটা‌লে পৌঁছা‌লো। ও যখন হাসপাতা‌লে পৌঁছা‌লো তখন সা‌ড়ে সাতটার বে‌শি বা‌জে। কথা পূ‌র্বে যে গাই‌নো‌কোলজিস্ট দে‌খি‌য়ে‌ছিল তার চেম্বা‌রের সাম‌নে গি‌য়ে কথা‌কে খুঁজ‌তে লাগল। কিন্তু পেল না।

কথা তখন ডাক্তা‌রের চেম্বা‌রে। কথা, ডাক্তার নি‌ম্নি‌কে বলল, ‘ম্যাম অামা‌কে ‌চিন‌তে পে‌রে‌ছেন?’
ডাক্তার নি‌ম্নি কথার দি‌কে তা‌কি‌য়ে মৃদু হে‌সে বলল, ‘‌জি কথা। আপনা‌কে পু‌রো হস‌পিটাল চি‌নে। সে‌দিন যা সিন‌ক্রি‌য়েট ক‌রে‌ছিলেন আপ‌নি। ভ‌া‌গ্যিস আপনার হ্যাজ‌বেন্ড সাম‌লে‌ছি‌লেন।’
ডাক্তারের কথায় নি‌জের কৃতক‌র্মের কথা ম‌নে ক‌রে কথা বেশ লজ্জা পেল। ডাক্তার নি‌ম্নি ব্যাপারটা বুঝ‌তে পে‌রে বলল, ‘লজ্জা‌ পাবার ম‌তো কিছু হয়‌নি। প্লিজ বসুন।’

কথা ব‌সার পর নি‌ম্নি বলল,
‘হ্যাঁ বলুন। আপনার শরীর এখন কেমন?’
‘‌জি ভা‌লো। কিন্তু কিছু কথা ছিল।’
‘‌জি বলুন।’
‘প্রায় আঠা‌রো দিন আগে আমার এবরশন হয়। কিন্তু আমি যতদূর জা‌নি এবরশন কিংবা মিসক্যা‌রেজ হ‌লে মে‌য়ে‌দের ব্লি‌ডিং হয়। কিন্তু আমার সামান্যতম ব্লি‌ডিং হয়‌নি। কেন? আর আমার তল‌পে‌টেও কো‌নো ব্যথা হয়‌নি। তাছাড়া আমার শা‌রিরীক অবস্থা ঠিক প্রেগ‌নেন্ট অবস্থার ম‌তো। ম‌র্নিং সিক‌নেস, মাথা ঘোরা‌নো, ব‌মি, খাবা‌রে অরু‌চি এভ‌রি থিংক।’
ডাক্তার নি‌ম্নি বলল, ‘এক মি‌নিট আপনার এবরশন হ‌য়েছে কে বল‌ছে? আপনার তো কো‌নো এবরশন হয়‌নি।’

কথা চম‌কে উঠল। নি‌জের অজা‌ন্তেই একটা হাত ‌পে‌টের কা‌ছে চ‌লে গেল। তখনই নিহাদ তাড়াহু‌ড়ো ক‌রে ডাক্তার নি‌ম্নির চেম্বা‌রে ঢুকল। নি‌ম্নি, কথা দুজ‌নেই ওর দি‌কে তাকাল। নি‌ম্নি বলল,
‘আপনার এবরশন হবার আধাঘন্টা আগে আপনার হ্যাজ‌বেন্ড আমার কা‌ছে এসে একরকম অনুনয় বিনয় ক‌রে এবরশন করা‌তে নি‌ষেধ করল। ব‌লে‌ছি‌লেন আপ‌নি তার উপর রাগ করে এবরশন কর‌তে চা‌চ্ছেন।

আমরা ডাক্তাররা এমন কেস অনেক দে‌খি, অনেক মে‌য়েরাই নি‌জের পার্টনা‌রের সাথে রাগ ক‌রে এবরশন করায়। স‌ত্যি বল‌তে আমরাও তো মানুষ। আমরাও এবরশন কর‌তে চাই না। একটা জীবনকে কারণ ছাড়া কেন মারব? তার ম‌ধ্যে আপনার গ‌র্ভে টুইন’স। মিঃ নিহা‌দের অনু‌রো‌ধে আমরা এবরশন না করা‌নোর সিদ্ধান্ত নেই। তি‌নিই ব‌লে‌ছি‌লেন, এবরশন রু‌মে নি‌য়ে গি‌য়ে আপনা‌কে জাস্ট বেহুশ ক‌রে দি‌তে বা‌কিটা তি‌নি বুঝ‌বেন।’

কথা নিহা‌দের দি‌কে তাকাল। নিহাদ যে মুখে হাত দি‌য়ে হাস‌ছে তা বোঝা যা‌চ্ছে। ডাক্তার নি‌ম্নি আবার বলল, ‘‌কিন্তু আপনা‌কে আমা‌দের বেহুশ করার ইন‌জেকশন দি‌তে হয়‌নি। আপ‌নি মান‌সিক ও শারিরীকভা‌বে এতটা দুর্বল ছি‌লেন যে এবরশন রুমে ঢু‌কে নি‌জেই বেহুশ হ‌য়ে গে‌লেন। তারপর আমরা জাস্ট আপনা‌কে চেকাপ ক‌রি। আপ‌নি, আপনার বাচ্চারা হেল‌দি এবং সুস্থ আছেন। বা‌কিটা আপনার হ্যাজ‌বেন্ড এর কাছ থেকেই শুনুন।’

ডাক্তা‌রের কথা শুনে আর নিহা‌দের হা‌সি দে‌খে কথা খু‌শি হ‌বে না‌কি রাগ কর‌বে বুঝ‌তে পারল না। খু‌শি লাগ‌ছে এটা ভে‌বে যে ওর বাচ্চারা বেঁ‌চে আছে। রাগ লাগ‌ছে এটা ভে‌বে নিহাদ গত আঠা‌রো দিন যাবত ওকে মান‌সিকভা‌বে কতটা চা‌পে রে‌খে‌ছে। কথা পূ‌র্বের ম‌তো রাগটা‌কে প্রধান্য দি‌লো। ডাক্তা‌রের চেম্বা‌রের থাকা পা‌নি ভ‌র্তি গ্লাসটা নি‌য়ে নিহা‌দের মু‌খে ছু‌ড়ে মারল। নিহাদ বোকার ম‌তো দাঁ‌ড়ি‌য়ে রইল।

কথা, ডাক্তার নি‌ম্নি‌কে বলল, ‘আপনার ফিস ঐ গাধাটার কাছ থে‌কে নেন।’
কথা এই ব‌লে চ‌লে গেল। নিহাদ ডাক্তা‌রের ভি‌জিট দি‌তে দি‌তে বলল,
‘বুঝ‌লেন ম্যাম, ডাক্তারি পড়ার চে‌য়েও ক‌ঠিন কাজ বউ‌কে বোঝা, তা‌কে সামলা‌নো।’
‌নিহাদ প‌কেট থেকে রুমাল বের ক‌রে মুখ মুছ‌তে মুছ‌তে কথার পিছ‌নে গেল। কথা অন্য একটা গা‌ড়ি‌তে উঠে চ‌লে গেল। নিহাদ ওর পিছু পিছু যে‌তে ল‌াগল। মনে ম‌নে প্রস্তুত হ‌চ্ছিল, ঘ‌রে গি‌য়ে ঝড় সামলা‌নোর।

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব:৩৩

কথা বা‌ড়ি ফি‌রে সোজা মো‌মেনার রু‌মে ঢুকল। নিহাদ পিছু পিছু রু‌মে ঢুক‌তেই কথা ওর মু‌খের উপর দরজা বন্ধ ক‌রে দি‌লো। দরজা এত জো‌রে বন্ধ ক‌রে‌ছে যে, নিহা‌দের না‌কে গি‌য়ে দরজা লাগল। নিহাদ নাক চে‌পে ধরে বলল,
‘এই মে‌য়ে‌কে বি‌য়ের পর থে‌কে নাকটার উপর যত অত্যাচার চালায়। রাগ কর‌লে না‌কে কামড় দেয়, নাক টে‌নে দেয়, আজ তো ফা‌টি‌য়েই দি‌লো। না‌কে দড়ি দি‌য়ে ঘুরা‌চ্ছে আমা‌কে।’

নিহাদ দরজায় টোকা দি‌লো। কথা অপরপাশ থে‌কে বলল,
‘‌নিহাদ, তু‌মি প্লিজ রু‌মে যাও। মা‌য়ের সা‌থে কথা আছে আমার। তারপর রু‌মে এসে তোমার সা‌থে কথা বল‌ছি।’
অগত্যা ‌নিহাদ নি‌জের রু‌মে গি‌য়ে ব‌সে রইল। ম‌নে ম‌নে সা‌জাতে লাগল, কথা কেমন প্রশ্ন কর‌বে আর ও তার কেমন উত্তর দি‌বে।

কথা, মো‌মেনা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে কাঁদ‌তে লাগল। মো‌মেনা বেশ রাগ ক‌রে বলল,
‘ই‌তোরটা আজ আবার তো‌কে কাঁদা‌লো? আজ কী ক‌রে‌ছে? আজ আবার সি‌ন্থিয়া হারামজা‌দির কা‌ছে গে‌ছিল না‌কি?’
‘ও আর জীব‌নে সি‌ন্থিয়ার মুখ দর্শনও কর‌বে না। সে শিক্ষা ওর হ‌য়ে‌ছে।’
‘তাহ‌লে কী কর‌ছে?’
‘ও যা ক‌রে‌ছে ভা‌লো করে‌ছে। মস্তবড় পাপ আমি কর‌তে গি‌য়ে‌ছিলাম। ও আমাকে ‌সেটা থে‌কে বাঁ‌চি‌য়ে‌ছে।’

‘কী হ‌য়ে‌ছে? খু‌লে বল তো? দেখ তো‌কে আমি নি‌জের একমাত্র ছে‌লের ‌চে‌য়ে বে‌শি বিশ্বাস ক‌রি। তুই যখন নিহাদ সি‌ন্থিয়ার বিষয়টা খু‌লে বল‌লি আমি কিন্তু তো‌কে সা‌পোর্ট ক‌রে‌ছি, নিহাদ‌কে না। এমন‌কি নিহাদ‌কে ঘর থে‌কেও বের ক‌রে দি‌তে চে‌য়ে‌ছিলাম। কিন্তু তুই বল‌লি নিহাদ যা‌তে কো‌নোভা‌বেই বুঝ‌তে না পা‌রে আমি তো‌দের বিষ‌য়ে সব জা‌নি।’

কথা চো‌খের পা‌নি মু‌ছে বলল, ‘হ্যাঁ কারণ আমি চাই না নিহাদ ওর বাবা মা‌য়ের চো‌খে ছো‌টো থাক। ও আপনা‌দের সাম‌নে নি‌জে‌কে সবসময় অপরাধী ভাবুক।’
‘ওর ম‌তো একটা গাধা‌কে তুই এত কেন ভা‌লোবাস‌লি বল তো? ও তো তোকে সারাজীব‌নে ভুল‌তে পার‌বি না, এমন কষ্ট দি‌লো আর ত‌ুই সবসময় ওর সম্মা‌নের কথা ভা‌বিস। কেন?’
‘আ‌মি কিছুই জা‌নি না। আমি শুধু জা‌নি, আমি ওকে সবার চে‌য়ে বে‌শি ভা‌লোবা‌সি।’

‘হুম তা তো দেখ‌তেই পা‌চ্ছি। গাধাটা জীব‌নে নির্ঘাত বড়ো কো‌নো ভা‌লো কাজ ক‌রে‌ছিল, নয়তো তোর ম‌তো লাইফ পার্টনার ওর ম‌তো গাধা কেন পা‌বে? ওর জন্য কী ক‌রিস‌নি? আমার সাহায্য নি‌য়ে সি‌ন্থিয়ার অবস্থা বা‌রোটা বা‌জি‌য়ে দি‌লি। আমি খে‌াঁজ নি‌য়ে‌ছি জব‌া চৌধু‌রি, সি‌ন্থিয়ার অবস্থা খুব খারাপ ক‌রে দি‌য়েছে। সি‌ন্থিয়ার পড়ালেখা শেষ। সে এখন জবা চৌধু‌রির বা‌ড়ির চ‌ব্বিশ ঘন্টার কা‌জের লোক।’
‘হুম জা‌নি।’
‘নিহাদ কি জা‌নে ওর জন্য তুই কী কী ক‌রে‌ছিস?’
‘কিছুটা জা‌নে।’
‘এটা জা‌নে যে, তোকে সাহায্য করা ব্য‌ক্তি‌টি ওরই গর্ভধারী মা?’

কথা মাথা দু পা‌শে নে‌ড়ে বলল, ‘না। আমি চাইও না যে ও জানুক।’
‘তোর ভা‌লোবাসা দেখ‌লে নি‌জের ছে‌লে‌কে চাবুক দি‌য়ে চাপ‌কে ছাল চামড়া তু‌লে দি‌তে মনচায়। ইতোর একটা। এই গাধা‌কে আমি পে‌টে ধ‌রে‌ছিলাম ভাব‌তেই পার‌ছি না। শোন ওকে তুই মো‌টেই ক্ষমা কর‌বি না। একদম না।’

কথা, মো‌মেনা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘মা, তোমার ম‌তো শাশু‌ড়ি বোধ হয় পৃ‌থিবী‌তে আর একটা নেই। তু‌মি সে‌দিন আমা‌কে না বাঁচা‌লে আজ তো আমার মরারও অনেক‌দিন হ‌য়ে যেত।’‌
‌মো‌মেনা ধমক দি‌য়ে বল‌লেন, ‘চ‌ুপ কীসব বা‌জে কথা বল‌ছিস?’

কথা, মো‌মেনার কো‌লে মাথা দি‌য়ে চুপ ক‌রে ভাবনায় ডুব দি‌লে‌া। নিহাদ, সি‌ন্থিয়ার ঘটনার পর কথা এতটাই ভে‌ঙে প‌ড়েছিল যে, এক‌দিন ছা‌দে উঠে হাঁট‌তে হাঁট‌তে একদম পা‌শে চ‌লে গি‌য়ে‌ছিল। আর এক কদম এগো‌লেই তিন তলা ছাদ থে‌কে প‌ড়ে একদম শেষ হ‌য়ে যেত। সে‌দিন মো‌মেন‌াই কথা‌কে ধ‌রে ফে‌লে‌ছিল। কিছু কা‌জে মো‌মেনা ছা‌দে উঠে কথা‌কে আনমনে হ‌াঁট‌তে দে‌খে দ্রুত গি‌য়ে কথা‌কে ধ‌রে ফে‌লে‌ছিল। তারপর কথা‌কে অনেক বকাঝকা করে‌ছিল। কী হ‌য়েছে কারণ জান‌তে চাই‌লে কথা তা‌কে সব স‌ত্যি কথা ব‌লে দেয়।

মো‌মেনা সে সময় ভে‌বে‌ছিল নিহাদ, কথার ম‌ধ্যে ছো‌টো খা‌টো ঝা‌মেলা হ‌য়ে‌ছে। নি‌জেরা ঠিক ক‌রে নি‌বে। তি‌নি ছে‌লে বউ এর বিষ‌য়ে নাক গলা‌তে চান না কিন্তু ঝা‌মেলা যে এত বড় তা জান‌তেন না।

কথার থে‌কে সবটা শুনে তি‌নি সিদ্ধান্ত নি‌য়ে‌ছিলেন নিহাদ‌কে ক‌ঠিন শা‌স্তি দি‌বে কিন্তু কথা তা‌কে আট‌কে দি‌য়ে ব‌লে‌ছিল আগে নিহাদ‌কে, সি‌ন্থিয়ার কবল থে‌কে বাঁচা‌নোটা বে‌শি জরুরি। তি‌নিও কথার, কথাম‌তো ওকে সবরকম সাহায্য ক‌রে। কথা যখন যা চে‌য়ে‌ছে, সে হোক টাকা কিংবা অন্যকিছ‌ু তি‌নি তা দি‌য়ে‌ছেন। কথা‌কে সকল তথ্য সংগ্রহ কর‌তে সাহায্য ক‌রে‌ছে। তার জন্যই কথা, সি‌ন্থিয়াকে শা‌য়েস্তা কর‌তে পে‌রে‌ছে।

মোমেনা বলল,
‘আজ কি ক‌রে‌ছে গাধাটা?’
‘মা, আজ তোমার গাধা ছে‌লে যা ক‌রে‌ছে তার জন্য তার অর্ধেক শা‌স্তি মাফ ক‌রে দিলাম।’
‘‌কেন?’
‘‌তোমার গাধা ছে‌লে কৌশ‌লে দু‌টো প্রাণ বাঁ‌চি‌য়ে‌ছে।’
‘মা‌নে?’
‘মা, আমি ‌প্রেগ‌নেন্ট। তোমার একসা‌থে দু‌টো না‌তি কিংবা নাত‌নি হ‌বে।’

‌মো‌মেনা বিস্ম‌য়ে বলল, ‘কী বল‌লি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ক‌বে থেকে?’
‘‌চৌদ্দ সপ্তাহ।’
‌মো‌মেনা অবাক হ‌য়ে বলল, ‘কী ব‌লিস?’
‘তার মা‌নে তো চার মাস চ‌লে।’
‘হুম।’
‘এত‌দিন কেন ব‌লিস‌নি?’

কথা অপরাধী ভ‌ঙ্গি‌তে মাথা নিচু ক‌রে মো‌মেনা সব খু‌লে বলল। ওর রাগ। এবরশন করার সিদ্ধান্ত। আঠা‌রো দিন আগে এবরশন কর‌তে যাওয়া। হস‌পিটা‌লের করা পাগলা‌মি। আজ‌কে ডাক্তা‌রের কাছ থে‌কে সব সত্যি শোনা। সব কথা বলল মো‌মেনা‌কে। কিছু লুকা‌লো না। কেন লুকা‌বে এই মানুষটার কাছ থে‌কে। যে ওকে নি‌জের ছে‌লের চে‌য়ে বে‌শি সা‌পোর্ট ক‌রে, তার কা‌ছে আর কিছু লুকা‌নোর ম‌তো পাপ কথা কর‌বে না।

প্র‌তিটা বিষয় কথা, মোমেনা‌কে বিস্তা‌রিত ব‌লে তার পা দু‌টো জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল, ‘মা, আমা‌কে মাফ ক‌রে দাও। আমি তোমাদের না জা‌নি‌য়ে তোমার না‌তি‌দের মে‌রে ফেল‌তে চে‌য়ে‌ছিলাম। র‌া‌গে আমার মাথা ঠিক ছিল না। হিতা‌হিত জ্ঞান হা‌রি‌য়ে ফে‌লে‌ছিলাম। চোখে রা‌গের পর্দা প‌ড়েছিল। কিন্তু নিহা‌দের বু‌দ্ধির কার‌ণে আমা‌দের দু‌টো সন্তানই সুস্থ আছে।’

‌মো‌মেনা, কথার মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে বলল,
‘‌তোর কথায় রাগ করব না‌কি খু‌শি হব বুঝ‌তে পার‌ছি না। আমার বংশধর আস‌ছে। অথচ তো‌দের স্বামী-স্ত্রীর দ্ব‌ন্দে তারা ম‌রে যেত কিন্তু সৃ‌ষ্টিকর্তা, পরম করুণাময় যেভা‌বে হোক তা‌দের বাঁ‌চি‌য়ে দি‌য়ে‌ছেন। দোষ তোর না। দোষ তো আমার গাধা ছে‌লেটার। ও গাধা‌মি না কর‌লে তুই কখনও রাগ ক‌রে এসব করতে যে‌তি না। দোষ তোরা দুজ‌নেই ক‌রে‌ছিস। কিন্তু আমি এখনও কাউ‌কে কিছু বলব না। বিষয়টা তো‌দের স্বামী-স্ত্রীর, তোরা নি‌জেরাই নি‌জে‌দের প্রোব‌লেম সলভ কর‌বি।

আমি এখন দা‌দি হবার আনন্দ উপ‌ভোগ করব। বেয়াই, বেয়ান‌কে ফোন ক‌রে বল‌তে হ‌বে, আমা‌দের দুই প‌রিবা‌রের প্রথম না‌তি/নাত‌নি আস‌তে চ‌লে‌ছে তা-ও একসা‌থে দুজন। আমার যে কী খু‌শি লাগ‌ছে। তুই যা তো রুম থে‌কে। আমি এখন শুক‌রিয়া আদায় ক‌রে নফল নামাজ পড়ব। তোরা স্বামী-স্ত্রী যা খু‌শি কর। মারাম‌ারি কাটাকা‌টি, খবরদার আমার না‌তি নাত‌নি‌দের যেন কো‌নো ক্ষ‌তি না হয়। আর যেন ভু‌লেও ওদের ক্ষ‌তি কর‌ার চিন্তা না ক‌রিস। ম‌নে থাক‌বে?’
‘হ্যাঁ মা।’
‘যা এখন‌ গি‌য়ে গাধাটার সা‌থে কথা বল।

আমার নতুন বই “রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া” এর প্রি অর্ডার চল‌ছে। ‌প্রি অর্ডার লিংক সবার শে‌ষে দেওয়া। পা‌শে থাক‌বেন।

অ‌নেকক্ষণ যাবত নিহাদ রু‌মে পায়চারি কর‌ছে কিন্তু কথা আস‌ছে না। নিহা‌দের টেনশন হ‌চ্ছে খুব। কথা ওর মা‌য়ের সা‌থে কী না কি বল‌ছে তা ভে‌বে টেনশন আরও বে‌ড়ে যা‌চ্ছে।

কথা দরজার কা‌ছে এসে চুপচাপ দা‌ঁড়ি‌য়ে দেখ‌ছে, নিহাদ কীভা‌বে পায়চা‌রি কর‌ছে, আর একা একা বিড়‌বিড় কর‌ছে। কথা রুমে ঢু‌কে ব্যাগটা বিছ‌ানার পা‌শের ‌টে‌বি‌লে রে‌খে সোজা বাথরু‌মে ঢু‌কে গেল। বাথরুমের দরজায় দাঁ‌ড়ি‌য়ে বলল,
‘‌নিহাদ আমার কা‌মিজ আর প্লাজু দাও।’

‌নিহাদ নিঃশ‌ব্দে সেগুলো দি‌লে‌া। কথা কাপড় পা‌ল্টে আবার রুম থে‌কে বের হ‌য়ে গেল। নিহাদ কিছুক্ষণ অ‌পেক্ষা করার পর, যখন দেখল কথা আস‌ছে না তখন ও নি‌জেই রু‌মের বাই‌রে গেল। গি‌য়ে দেখল কথা টে‌বি‌লে ব‌সে ভাত খা‌চ্ছে আর মো‌মেনা ওর প্লে‌টে খাবার তুলে দি‌চ্ছে।

কথা বলল, ‘মা, মাছ দিও না। মা‌ছে গন্ধ লা‌গে। শেষে ব‌মি ক‌রে দিব।’
‘তাহ‌লে শুধু শাক দি‌য়ে খা‌বি?’
‘ডাল দাও। আর আচা‌রের বয়ামটা কোথায়?’
‘ফ্রি‌জে। তুই খা আমি নি‌য়ে অাসছি।’

‌নিহাদ‌কে দে‌খে মো‌মেনা রাগ কর‌তে চাই‌লে কথা হা‌তের ইশারায় না করল। নিহা‌দের দা‌দি ফা‌তিমা বল‌লেন, ‘কথাবু, তুই তো দেখ‌ছি চুপা রুস্তম। এত বড় খবরটা এত মাস যাবত চে‌পে ছি‌লি কেম‌নে?’
কথা লাজুক হাসল। মো‌মেনা বলল, ‘মা, আমার তো ওর শা‌রিরীক অবস্থা দে‌খে সন্দেহ হ‌য়ে‌ছিল কিন্তু এই দুষ্টু মে‌য়ে কিছু ব‌লে‌নি দে‌খে আমিও তেমন কিছু ভা‌বিনি।’

ফা‌তিমা বল‌লেন, ‘‌দেখ বউ, আমার বইন কিন্তু তো‌গো চে‌য়ে ফা‌স্টো। তুই নিহা‌দের পর আর কো‌নো বাচ্চা নি‌লি ন‌া। সেখা‌নে আমার বইন একবা‌রে দুজন উপহার দি‌চ্ছে।’
মোমেনা লজ্জা পে‌য়ে বলল, ‘মা, ছে‌লে বউ এর সাম‌নে কী সব বল‌ছেন?’

ফা‌তিমা হে‌সে বললে, ‘‌শোন বুবু, নি‌জের খুব যত্ন নি‌বি। আর আমরা তো আছিই। এখন থে‌কে তুই শুধু হুকুম কর‌বি। সেটা সাম‌নে আনার দা‌য়িত্ব আমা‌দের।’
কথা হে‌সে বলল, ‘হুকুম কি করব দা‌দি। যা-ই খে‌তে যাই তা‌তেই গন্ধ। ম‌নে হয় না‌ড়ি ভু‌ড়ি বের হ‌য়ে যা‌বে।’

ফা‌তিমা বল‌লেন, ‘প্রথম চার পাঁচমাস এমন হ‌বে। তারপর দেখ‌বি এত খাই‌তে মন চাই‌বে। তখন যা দেখ‌বি সেটাই খে‌তে চাই‌বি।’
ফা‌তিমা, কথার কা‌নে কানে ক‌য়েকটা কথা বলল। কথা লজ্জায় লাল হ‌য়ে বলল, ‘দা‌দি, তু‌মি বহুত দুষ্টু।’

‌নিহাদ অসহা‌য়ের ম‌তো দাঁ‌ড়ি‌য়ে রইল। ওকে কেউ খেয়ালই কর‌ছে না। একটা চেয়ার টে‌নে বস‌তে নি‌বে তখন মো‌মেনা হুংকার দি‌য়ে বলল, ‘এখনও বাই‌রের কাপড় ছা‌ড়িসনি? দিন দিন তুই এত গি‌দোর হ‌চ্ছিস কেন? শোন ঘ‌রে নতুন মানুষ আস‌ছে। এখন ঘরটা‌রে জীবানুমুক্ত রাখ‌তে হ‌বে। আর তো‌কে দেখ‌লেই বোঝা যায় জীবানুর কারখান‌া। যা গোসল ক‌রে আয়।’

কথা খে‌তে খে‌তে বলল, ‘‌ঠিক বল‌ছো, মা। ওর গা থে‌কে পচা মাছের গন্ধ আস‌ছে।’

‌নিহাদ আবার অসহা‌য়ের মতো রুমে গি‌য়ে গে‌াসল সে‌রে বের হ‌য়ে দেখল কথা বিছানায় শু‌য়ে আছে। নিহাদ পা‌শে বস‌তেই বলল, ‘‌খে‌য়ে আসো। রাত তো কম হ‌লো না। মা কতক্ষণ তোমার খাবার নি‌য়ে ব‌সে থাক‌বে? খে‌য়ে যা বলার বল‌বে।’

‌নিহাদ চুপ করে খে‌তে গেল। খে‌য়ে এসে দেখল কথা গভীর ঘু‌মে আচ্ছন্ন। গত ক‌য়েক‌দিন যাবত কথা একটা রাতও ঠিকম‌তো ঘুমায়‌নি। আজ যেন ওর মাথা থে‌কে সকল চেন্তা, সকল টেনশন দূর হ‌য়ে গে‌ছে। ত‌াই চিন্তা মুক্ত হ‌য়ে আজ গভীর ঘু‌মে আচ্ছন্ন। নিহাদ আর ওকে ডাকল না। কথার পাশে শু‌য়ে ওকে গভীরভা‌বে বু‌কে জ‌ড়ি‌য়ে নি‌লো। অদ্ভুতভা‌বে নিহা‌দের মনটাও আজ শা‌ন্তি লাগ‌ছে। ও-ও কথা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে গভীর ঘু‌মে আচ্ছন্ন হ‌লো।

রাত আড়াইটা,
কথা, নিহাদ‌কে ডাক‌ছে, ‘‌নিহাদ! নিহাদ!’
‌নিহাদ খা‌নিকটা দরফ‌রি‌য়ে উঠে বলল,
‘কী হ‌য়ে‌ছে? সব ঠিক আছে?’
‘আমার খিদা লাগ‌ছে।’
‌নিহাদ কিছু সময় তা‌কি‌য়ে থে‌কে বলল, ‘কী খাবা?’
‘জা‌নি না। শুধু জা‌নি প্রচন্ড খুদা লাগ‌ছে। এখনই খাবার লাগ‌বে।’
‘আচ্ছা ব‌সো। দে‌খি ফ্রি‌জে বা ফুড সেল‌ফে কী আছে?’

‌নিহাদ ফ্রি‌জে রান্না করা নুডুলস পে‌লো। সেটা বের ক‌রে ওভে‌নে দি‌য়ে গরম করল। ফুড সেলফ থে‌কে বিস্কুট নি‌লো। নুডুলস আর বিস্কটু কথাকে দি‌য়ে বলল, ‘আর কিছু লাগ‌বে?’
‘চা খা‌বো।’
‘এত রা‌তে? প‌রে সারা রাত আর ঘুম আস‌বে না।’
‘আসা লাগ‌বে না। দু কাপ চা নি‌য়ে এসো। তোমার সব কথা এখন শুনব।’

অগত্যা নিহাদ রান্নাঘ‌রে গি‌য়ে কথার পছন্দম‌তো চা বানা‌লো। গি‌য়ে দেখল কথা নুডুলস বা‌টি খা‌লি ক‌রে ফে‌লে‌ছে। নিহাদ কথার হা‌তে চা‌য়ের মগ দি‌লে‌া। কথা বলল,
‘‌তোমার ঘুম পা‌চ্ছে?’
‘এখন ঘুম উড়ে গে‌ছে। তু‌মি যেন বল‌বে ব‌লে‌ছি‌লে?’
‘বলবে তু‌মি। আমি শুনব। চ‌লো বারান্দায়।’

বারান্দায় গি‌য়ে বসার পর কথা চা‌’য়ে চুমুক দি‌য়ে নিহা‌দের কাঁ‌ধে মাথা রে‌খে বলল,
‘এখন ব‌লো তো তু‌মি এসব কী ক‌রে কর‌লে? তু‌মি তো জান‌তে না আমার ডাক্তা‌রের কা‌ছের অ্যাপ‌য়েন্ট‌মেন্ট সকা‌লে। তোমা‌কে তো বিকা‌লে ব‌লে‌ছিলাম।’

‌কিছুক্ষণ চুপ থে‌কে নিহাদ বলল, ‘তু‌মি প্রেগ‌নেন্ট এবং এবরশন করা‌তে চাও সেটা আমি তোমার বলার আগে থে‌কে জানতাম।’
‘কীভা‌বে?’
‘‌যে‌দিন শ্রাব‌ণের পা কাটল। আমরা সবাই গেলাম। সে‌দিন সকা‌লে তু‌মি আয়নায় দে‌খে কাঁদ‌ছি‌লে আর পে‌টে হাত দি‌য়ে বাবু‌দের সা‌থে কথা বল‌ছি‌লে। আমি সে‌দিন দরজার আড়া‌লে দাঁ‌ড়ি‌য়ে সবটা শু‌নে‌ছিল‌াম।’

‘তারপর?’
‘তারপর কি তোমার উপর নজর রাখা শুরু করলাম। তু‌মি কোথায় যাও, কী ক‌রো সব‌কিছুর উপর। চাক‌রি ছাড়ার সিদ্ধান্ত তো আগেই নি‌য়ে‌ছিলাম, কিন্তু সে‌দি‌নের পর থে‌কে স‌ত্যি স‌ত্যি চাক‌রি ছে‌ড়ে দিয়ে‌ছিলাম। কো‌চিংও সব ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছি। কিছু স্টু‌ডেন্ট‌কে তা‌দের বা‌ড়ি গি‌য়ে টিউশন দিতাম তা‌দের অন্য টিচার দি‌য়ে‌ছি।

সে‌দিনের পর আমার প্রধান কাজ ছিল তোমার প্র‌তি নজর রাখা। তো সে‌দিন তু‌মি যখন কল ক‌রে বল‌লে তু‌মি হস‌পিটা‌লে। আমি তখন তোমার ঠিক পিছ‌নে ছিলাম। ডাক্তা‌রের সা‌থে আগেই সব কথা ব‌লে রে‌খে‌ছিলাম। তু‌মি অজ্ঞান হওয়ার পর তোমা‌কে ডাক্তাররা চেকাপ ক‌রেন। আল্ট্রা‌সনোগ্রাফি ক‌রে ‌দেখেন আমা‌দের টুইন’স। বাবুরা আলহামদু‌লিল্লাহ হেলদী আছে।’

কথা বেশ রাগ ক‌রে বলল, ‘তাহ‌লে এত‌দিন কেন আমার কাছ থে‌কে স‌ত্যিটা লুকা‌লে?’
‘যাতে তু‌মি বুঝ‌তে পা‌রো তু‌মি কতবড় ভুল কর‌তে যা‌চ্ছি‌লে। তু‌মি তোমার রাগটা নিয়ন্ত্রণ কর‌তে পা‌রো। কথা রা‌গে তু‌মি হিতা‌হিত জ্ঞান হা‌রি‌য়ে ফে‌লে‌ছি‌লে। বুঝ‌তে পার‌ছি‌লে না, তু‌মি কী কর‌ছো? ভু‌লে গে‌ছি‌লে তু‌মি খুন কর‌তে যা‌চ্ছি‌লে। ভু‌লে গে‌ছি‌লে তু‌মি কী হারা‌তে যা‌চ্ছো। তোমাকে বুঝা‌নো দরকার ছিল তু‌মি যা‌দের মার‌তে চা‌চ্ছো তা‌দের তু‌মি কতটা ভা‌লোবা‌সো। তারা তোমার কতটা জু‌ড়ে আছে। তা‌দের হারা‌লে সবার চে‌য়ে বে‌শি কষ্ট তোমার হ‌বে। তু‌মি যা‌তে বুঝ‌তে পা‌রো তু‌মি কী হারা‌চ্ছো, সেটা বুঝা‌নোর জন্যই তোমা‌কে ব‌লি‌নি। তোমার থে‌কে স‌ত্যিটা লু‌কি‌য়ে‌ছি। কিন্তু তোমা‌কে যতটা চালাক ভে‌বে‌ছিলাম ততটা না।’

‘‌কেন?’
‘একটা মে‌য়ের এবরশন কিংবা মিসক্যা‌রেজ হলে তার ব্লি‌ডিং হয়, কিন্তু তু‌মি যে তা-ও বুঝ‌তে পার‌বে না। সেটা তো বুঝ‌তে পা‌রি‌নি।’
‘কীভাবে বুঝব? তোমা‌কে এক‌দিন জি‌জ্ঞেস করলাম, আমার ব্লি‌ডিং কেন হ‌চ্ছে না? তু‌মি কী বল‌লে? বল‌লে এবরশনের সময় আমার অনেক ব্লি‌ডিং হ‌য়ে‌ছে, হয়তো এ কারণে এখন হ‌চ্ছে না। আমি ভাবলাম হয়‌তো সেটাই হ‌বে। তবুও নি‌জের শারী‌রিক গ‌তি‌বিধি দে‌খে কিছুটা স‌ন্দেহ হ‌চ্ছিল, কিন্তু টেনশ‌নে এতসব ভাব‌তে পার‌ছিলাম না।’

‘কথা, তু‌মি কী বুঝ‌তে পে‌রেছো হারা‌নোর যন্ত্রণা?’
কান্না‌ভেজা ক‌ণ্ঠে কথা বলল,
‘হুম।’
‘বুঝ‌তে পে‌রে‌ছো, তু‌মি কত বড় ভুল কর‌তে যা‌চ্ছি‌লে?’
‘হুম।’

‘কথা, আমা‌কে ক্ষমা করা না করা সেটা একান্ত তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমা‌কে শা‌স্তি দি‌তে গি‌য়ে তু‌মি নি‌জে‌কে শা‌স্তি দি‌বে সেটা আমি বেঁ‌চে থাক‌তে হ‌তে দিব না। কথা, তু‌মি আজও জা‌নো না আমি তোমা‌কে কতটা ভা‌লোবা‌সি। ইশ! যদি বুকটা চি‌ড়ে তোমা‌কে দেখা‌তে পারতাম। কিন্তু নি‌জের গাধা‌মির কার‌ণে সারা জীব‌নের জন্য তোমার আস্থা, ভরসা হারালাম। তু‌মি আমায় শা‌স্তি দাও, মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শা‌স্তি দাও, কিন্তু সেটা তু‌মি অন্যভা‌বে তোমার মতো ক‌রে দাও।’

কথা এব‌ার বেশ শব্দ ক‌রে কাঁদ‌ছে। নিহাদ কথা‌কে থামালো না। কাঁদ‌তে দি‌লো।

চল‌বে…