#অরুণরাঙা_প্রেম
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
আরোশী ডাইরিটা কোনবতে তুলে রেখে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো।কিন্তু নিচে নামার পর এরকম একটা দৃশ্য দেখে তার বুক কেঁপে উঠলো।
” আহির।” ভয়মিশ্রিত গলায় মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো আরোশী।আহির নিচে বসে আছে আর হাঁটুতে থেকে প্রচুর রক্ত পড়ছে।শান্ত বাচ্চা হলেও আহিরও তো একটা বাচ্চা।ব্যথা আর ভয়ে সে চিৎকার করে কান্না করছে।শিলা পাশে বসে আহিরকে থামানোর চেষ্টা করছে।
” আহির বাবু কি হয়েছে তোমার?কিভাবে পড়লে?দেখি পা দেখাও।”
” না ফেরি আন্টি পা ধরোনা খুব ব্যথা করছে।” কান্না করতে করতে বললো আহির।
” কিছু হবে না বাচ্চা সব ঠিক হয়ে যাবে।দেখি আন্টি একটু দেখি।”
আহির কোনভাবেই আরোশীকে পা ধরতে দেবে না।অনেক কষ্টে অনেকটা জোর করেই আরোশী পা দেখলো।হাঁটুতে খুব বাজেভাবে ব্যথা পেয়েছে আহির।আরোশী শিলাকে তাড়াতাড়ি ফার্স্ট এড বক্স আনতে বললো।ফার্স্ট এড বক্স আনতে আনতে আরোশী আহিরকে কোলে তুলে সোফায় বসালো।
” আহির বাবু এখুনি সব ঠিক হয়ে যাবে।তুমি একটু পানিটা খাও,দেখবে ভালো লাগবে।”
আহির পা খেতে না চাইলেও আরোশী তাকে জোর করে খাওয়ালো।শিলা ফার্স্ট এড বক্স নিয়ে এলে আরোশী তুলো দিয়ে আগে রক্ত পরিষ্কার করে তারপর ব্যান্ডেজ করে দিলো।এই সময় আহির আরো বেশি চিৎকার করে কান্না করছিলো আর উঠে চলে চাইছিলো যার কারণে শিলা তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলো।ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে আরোশী আহিররের পাশে বসে তাকে জরিয়ে ধরলো।
” এসব কিভাবে হলো আহির?তুমি না টিভি দেখছিলে?”
” আমি তো তোমার কাছে যাচ্ছিলাম ফেরি আন্টি।কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় ধুম করে পড়ে গিয়েছি।” নাক টানতে টানতে বললো আহির।
” খুব ব্যথা করছে?”
” হুম।”
আহিরের কথা শুনে আরোশীর মন খারাপ হয়ে গেলো।আরোশী শিলাকে আহিরের জন্য খাবার আনতে বললো।আহিরকে জোর করে কিছুটা খাবার খাইয়ে আরোশী তাকে ব্যথার ওষুধ খাইয়ে দিলো।
আহির ঘুমিয়েছে কিছুক্ষণ আগে।আরোশী ফোনটা নিয়ে আহিরের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।সে চিন্তা করছে আকাশকে ফোন দিয়ে জানাবে কিনা।কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে আকাশ ফোন দিলো।কিন্তু দু’বার ফোন দেওয়ার পরও আকাশ ফোনটা রিসিভ করলো না।আরোশী ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত আহিরের দিকে তাকালো।
সন্ধ্যা বাড়ি থেকে আকাশের কিছু একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।আরোশী আসার পর থেকে আহির আকাশের সাথে আগের থেকেও বেশি ফ্রী হয়েছে।অফিস থেকে ফিরলেই আহির তাকে জরিয়ে ধরতো কিন্তু আজকে বাড়িটা আবারো আগের মতো শান্ত আর নির্জীব লাগছে আকাশের কাছে।
” শিলা আজকে বাড়িটা এতো শান্ত শান্ত লাগছে কেন?আহির কোথায়?” পানির গ্লাসটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললো আকাশ।আকাশের কথা শুনে শিলা একটু ঘাবড়ে গেলো।সে বুঝতে পারছেনা আহিরের কথা তাকে বলবে কিনা।
” কি হলো বলো।”
” আহির ঘুমিয়ে আছে স্যার।”
” এই সময়?” ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞেস করলো আকাশ।শিলার থেকে কোন উওর না পেয়ে আকাশ রুমে এসে দেখলো আসলেই আহির ঘুমিয়ে আছে।
” আহির?কি হয়েছে তোমার?এই সময়ে ঘুমিয়ে আছো কেন?দেখো বাবাই এসে গিয়েছি।উঠো আহির।”
কিছুক্ষণ ডাকার পর আহির চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকালো কিন্তু উঠলোনা।
” কি হয়েছে আহির?এরকম চুপচাপ কেন আজ?শরীর খারাপ লাগছে?”
” হুম।” মাথা নাড়িয়ে উওর দিলো আহির।
” কি হয়েছে তো….”
” আ….বাবাই হাত দিও না পা’য়ে।”
এতোক্ষণ পায়ে কাঁথা ছিলো বিধায় আকাশ আহিরের ব্যান্ডেজ খেয়াল করেনি।কথা বলতে বলতে হুট করেই আকাশের হাত আহিরের হাঁটুতে লেগে যায়।আকাশ তাড়াতাড়ি কাঁথা সরিয়ে আহিরের পা দেখলো।পায়ের এই অবস্থা দেখে আকাশ অস্থির হয়ে গেলো।
” আহির কি হয়েছে তোমার?তোমার পা’য়ে ব্যান্ডেজ কেন?কি হয়েছে আহির বলো।”
” সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে স্যার।”
পেছন থেকে বললো আরোশী।আরোশীর কথা শুনে আকাশ প্রচুর রেগে গেলো।সে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
” পড়ে গিয়েছে মানে কি?কি করছিলে তুমি তখন?”
” আসলে স্যার আমি রুম গোছাচ্ছিলাম।আহির সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময়…..”
আরোশীর কথাগুলো যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে।
” রুম গোছাচ্ছিলে মানে?আর আমাকে ফোন দাও নি কেন?”
” দিয়েছিলাম কিন্তু….. ”
” তোমাকে এখানে কেন রাখা হয়েছে?তোমাকে আহিরের খেয়াল রাখার জন্য রাখা হয়েছে নাকি রুম গোছানোর জন্য।কাজ ঠিক মতো করতে না পারলে কাজ করো কেন?যাও এখন আমার চোখের সামনে থেকে।”
আকাশের কথা শুনে আরোশী মাথা নিচু রেখে আহিরের রুমে থেকে বেরিয়ে গেস্ট রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।এমনিতেই সে সকাল থেকে এই অনুশোচনায় ভুগছিলো তার জন্য আহির পড়ে ব্যথা পেয়েছে,তার উপর এখন আকাশের কথা শুনে তার আরো মন খারাপ হয়ে গেলো।
মাঝরাতে কোন কিছুর তীব্র শব্দ শুনে আরোশীর ঘুম ভেঙে গেলো।সে তাড়াতাড়ি উঠে বসলো।একটু খেয়াল করেতেই সে বুঝতে পারলো দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে।
” আরোশী দরজা খোলো।আরোশী।” আকাশ খুব জোরে দরজায় আঘাত করছে।আরোশী কোনবতে ওড়নাটা গায়ে পেঁচিয়ে দরজা খুললো।
” কি হয়েছে স্যার?এতো রাতে…..”
” তাড়াতাড়ি রুমে এসো।আহিরের খুব জ্বর।আমি অনেকক্ষণ জলপট্টি দিয়েও কোন কাজ হয়নি।”
আকাশের কথা শুনে আরোশী তাড়াতাড়ি রুমে এসে দেখলো আহির জ্বরে কাঁপছে।কপালে হাত দিয়ে দেখলো আসলেই তার খুব জ্বর।
” জ্বর কিভাবে এলো হঠাৎ?রাতেও তো সে ঠিক ছিলো।”
” ব্যথার কারণে জ্বর এসেছে।ছোটবেলা থেকেই আহিরের এই সমস্যাটা আছে।ব্যথা পেলেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।” গম্ভীরভাবে বললো আকাশ।আকাশের কথা শুনে আরোশীর মন আবারো খারাপ হয়ে গেলো।
” ওষুধ খাইয়েছেন?”
” না।”
আরোশী আর কিছু না বলে আহিরকে ওষুধ খাইয়ে দিলো।তারপর তার মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিতে লাগলো।আকাশ চিন্তিত হয়ে সোফায় বসে আছে।আহিরকে আকাশ খুব ভালোবাসে।তার কিছু হলে আকাশের নিজেকে পাগল পাগল লাগে।বর্তমানে আহিরের অবস্থা দেখে তার মাথা ঠিক নেই।তার আরোশীর উপর খুব রাগ হচ্ছে,পারলে এখুনি আরোশী গ*লা চেঁ*পে ধরতো সে।
” স্যার উঠুন,স্যার।” জোরে জোরে আকাশকে ধাক্কা দিতে লাগলো আরোশী।আহিরের কথা চিন্তা করতে করতে আকাশের কখন সে চোখটা লেগে এসেছিলো সে বুঝতে পারেনি।আরোশীর ধাক্কাতে সে ঘুম ঘুম চোখে আরোশীর দিকে তাকালো।
” কি হয়েছে আরোশী?”
” আহির।” এতোক্ষণ আকাশের চোখে ঘুমের রেশ থাকলেও আহিরের নাম শুনে সেটাও চলে গেলো।সে ধরফরিয়ে উঠে বসলো।
” কি হয়েছে আহিরের?”
” আহির মনে নড়া*চড়া করছে না স্যার।মনে হচ্ছে অ*জ্ঞান হয়ে গিয়েছে।” ভীত গলায় বললো আরোশী।আরোশীর কথা শুনে আকাশ তো পাগলপ্রায় অবস্থা।সে আহিরের পাশে বসে তাকে ডাকতে লাগলো,মাঝে মাঝে ধাক্কাও দিতে লাগলো।
” স্যার আমার মনে হচ্ছে আহিরকে হসপিটালে নেওয়া প্রয়োজন।বাসায় বেশিক্ষণ থাকলে অবস্থা অন্যদিকে চলে যেতে পারে।”
আরোশীর কথা আকাশ শুনেছে বলে তার মনে হলোনা।আরোশী দেরি না করে নিচে গিয়ে শিলাকে জাগিয়ে তুললো।বাইরে গিয়ে ড্রাইভারকে বললো গাড়ি বের করতে।
” স্যার তাড়াতাড়ি চলুন।গাড়ি বের করা হয়ে গিয়েছে।স্যার।”
” হুম।”
” স্যার গাড়ি বের করা হয়ে গিয়েছে।আহিরকে নিয়ে চলুন,হসপিটালে যেতে হবে।”
আরোশীর কথা বুঝতে পেরে আকাশ একমুহূর্ত দেরি না করে আহিরকে নিয়ে গাড়ি উঠে বসলো।আরোশী সামনে ড্রাইবারের পাশে বসলো।সামনে বসলেও আরোশী সারা রাস্তা ঘাড় পেছনে ঘুরিয়ে রেখেছিলো আর আকাশ আহিরকে নিজের বুকের সাথে চেপে রেখেছিলো,যেন আহির কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে।কাছাকাছি একটা হসপিটালে তারা গাড়ি থামালো।আকাশ আহিরকে নিয়ে বের হতে হতে আরোশী ভিতরে গিয়ে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে ফেললো।
বাচ্চাদের কেবিনে রাখা হয়েছে আহিরকে।আকাশ চিন্তায় বাইরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।আরোশী একপাশে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের অপেক্ষা করছে।
কিছুক্ষণ পর একজন নার্স তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো।
” বাচ্চার বাড়ির লোক কে?”
” আমি।আহির কেমন আছে?সুস্থ আছে তো?”
” এই ওষুধ আর ইনজেক*শনগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন।দেরি করবেন না,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে আসুন।”
আকাশ নার্সের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে লাগলো।আরোশী এগিয়ে গিয়ে নার্সকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই তিনি চলে গেলেন।আরোশীর এখন আরো বেশি ভয় লাগছে।আহির ঠিক হয়ে যাবে তো?
চলবে……