অরুণরাঙা প্রেম পর্ব-১৯

0
719

#অরুণরাঙা_প্রেম
#পর্বঃ১৯
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

চিন্তিত অবস্থায় মাথায় হাত দিয়ে বাইরে রাখা চেয়ারে বসে আছে আকাশ।সে পারছেনা চিৎকার করে কান্না করতে।কি থেকে কি হয়ে গেলো আকাশ কিছু বুঝতে পারছেনা।আহিরের কিছু হলে আকাশ বাঁচবে না।আহিরই তার বেঁচে থাকা মূল কারণ হয়েছে দাঁড়িয়েছে।কান্না আটকে রাখতে না পেরে আকাশ এবার হাল ছেড়েই দিলো।আরোশী যখন বুঝতে পারলো আকাশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে তখন আরোশী আকাশের পাশে এসে তার কাঁধে হাত রাখলো।

” চিন্তা করবেন না স্যার।সব ঠিক হয়ে যাবে।আহির সুস্থ হয়ে যাবে।”

আরোশী আকাশকে শান্তনা দিচ্ছিলো কিন্তু এতে যে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে তা আরোশী ঘুণক্ষরেও টের পাইনি।

আকাশ আরোশীর হাত নিজের কাঁধ থেকে জটকা মেরে সরিয়ে দিলো।দাঁতে দাঁত চেপে সে বললো, “চুপ করো তুমি,একদম চুপ।আজ আমার আহিরের এই অবস্থা কারণ একমাত্র তুমি,শুধুই তুমি।তোমার কাছে আজ আমার আহিরের এই অবস্থা।আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আহিরের খেয়াল রাখবে,তার কোন ক্ষতি হতে দেবে না কিন্তু তোমার অবহেলার কারণে আজ আমার আহির হসপিটালে।আমার আহিরের যদি কিছু হয় আমি তোমাকে ছাড়বো না আরোশী।জানে মেরে ফেলবো তোমাকে।”

আকাশের কথা শুনে আরোশী যেমন অবাক হলো তেমনি প্রচুর কষ্টও পেলো।আরোশী নিজের দুর্বলতা আকাশের সামনে প্রকাশ করতে চাইনা তাই সে চুপচাপ সব কথা হজম করছে।

” মিস্টার আকাশ।”

অপরিচিত কারো কন্ঠ শুনে আরোশী আর আকাশ দু’জনেই পেছন ফিরে তাকালো।লোকটাকে দেখে আরোশী কিছুটা চমকে গেলো কারণ এটা সেই দোকানের লোকটা যার থেকে আরোশী পুতুল ছিনিয়ে এনেছিলো।লোকটা আকাশের সামনে এসে দাঁড়ালো।

” আপনি এখানে এই ভোরবেলা কি করছেন মিস্টার আকাশ?”

” আমার বাচ্চাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছিলাম মিস্টার রুদ্র।”

” কেন কি হয়েছে আপনার বাচ্চার?”

” তীব্র জ্বরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে তাই….।আপনি কেন এসেছেন হসপিটালে?”

” আসলে একজনকে রক্ত দিতে এসেছিলাম।”

” ও আচ্ছা।”

” আপরার পেছনে উনি কে?আপনার পরিচিত কেউ?”

” হুম।আপনি ওকে আগে থেকে চেনেন নাকি?”

” না,তবে আমি ওনাকে এর আগেও দেখেছি তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

” ও আচ্ছা।আরোশী বাড়িতে যাও তুমি।তোমাকে এখানে থাকতে হবেনা।” গম্ভীর এবং রাগী স্বরে কথাগুলো আরোশীকে বললো আকাশ।আকাশের কথা শুনে আরোশী একবার রুদ্র এবং আকাশের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো।যাওয়ার আগে আকাশের চোখের আড়ালে সে একপলক আহিরকেও দেখে যেতে ভুললোনা।

সকাল নয়টা,

আরোশী বাড়ি থেকে ফ্রেশ হয়ে আহির আর আকাশের জন্য খাবার নিয়ে হসপিটালে এসেছে।কেবিনের দরজা খুলতেই সে দেখতে পেলো আহির বিছানা বসে টিভিতে কার্টুন দেখছে।আহিরের জ্ঞান ফিরেছে দেখে আরোশীর দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো।আরোশী খাবার ব্যাগটা সাইডে রেখে শক্ত করে আহিরকে জরিয়ে ধরলো।

” তুমি এসেছো ফেরি আন্টি।এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?জানো আমি তোমাকে কত খুঁজেছি।আর আমি এখানে কেন?”

” বাবু তুমি অসুস্থতো তাই হসপিটালে আনা হয়ে তোমাকে।যেন তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও।আর আমি বাড়ি গিয়েছিলাম আমার আহির বাবুর জন্য তার প্রিয় খাবার আনার জন্য।”

” তুমি এখানে কেন এসেছো?”

আরোশী পেছন ফিরে দেখলো আকাশ রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আরোশীর মুখে এতক্ষণ যাও একটু হাসির ঝলক ছিলো আকাশকে দেখে সেটাও গায়েব হয়ে গেলো।

” আমি আপনাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলাম।”

” খাবার আনার কোন দরকার নেই।আমরা হসপিটালের ক্যান্টিন থেকেই খেয়ে নেবো।”

” বাইরের খাবার এই সময় আহিরের জন্য ভালো নয় তাই নিয়ে এসেছিলাম।আপনি আমাকে জানলেন না কেন যে আহিরের জ্ঞান ফিরেছে?”

” জেনে কি করতে?জানানোর প্রয়োজন মনে হয়নি তাই জানাইনি।”

আকাশের শেষ কথাটা আরোশীর মনে খুব করে আঘাত করলো।তার মনে প্রশ্ন জাগলো,

” জানানোর প্রয়োজন মনে হয়নি!সত্যি কি এই কথাটা জানার অধিকার আমার ছিলো না?আমি এতোদিন আহিরের খেয়াল রেখেছি,তাকে নিজের বাচ্চার মতো আগলে রাখার চেষ্টা করেছি।এতোদিনের কষ্টের ফল কি এটাই যে আমাকে এই সামান্য কতটা জানানোে কোন উনি মনে করেননি?সত্যিই কি আমি তাহলে ব্যর্থ?”

এছাড়াও আরো অনেক প্রশ্ন আরোশীর মনে জেগে উঠলো।আহিরের কথা শুনে আরোশী নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো।

” ফেরি আন্টি আমাকে খাইয়ে দাও না।আমার খুব খিদে পেয়েছে।”

আরোশীর কষ্ট হলেও মুখে হাসি বজায় রেখে বক্স থেকে খাবার বের করে আহিরকে খাইয়ে দিতে লাগলো।খাওয়ানোর মাঝে আকাশ আরোশীকে বললো,

” তোমার এখানে থাকার দরকার নেই।তুমি বাড়ি চলে যাও।আহিরের খেয়াল রাখার জন্য আমি আছি আর কাউকে লাগবে বলে আমার মনে হয়না।”

আকাশের কথা আরোশী শুনে বলে মনে হলোনা।আর শুনলেও সে কথাটাকে গুরুত্ব দিয়েছে বলে আকাশের মনে হলোনা।সে আগের মতোই আহিরকে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত।

এখন প্রায় বিকেল পাঁচটা।আহির হসপিটালের বেডে বসে আরোশীর সাথে গল্প করছে।আকাশ অফিসে চলে গিয়েছে দুপুরের কিছুক্ষণ আগেই।মূলত অফিস থেকে তাকে ফোন করেছিলো আর সে এখন কেন যেন আরোশীকে সহ্য করতে পারছেনা।আরোশীর সামনে সে পড়তে চাইছে না তাই সে অফিসেই চলে গিয়েছে।

” আসতে পারি?”

কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে আরোশী দেখলো রুদ্র এসেছে।এই সময়ে এখানে রুদ্রকে দেখে বেশ অবাক হলো আরোশী।

” কেমন আছো আহির?” ভেতরে প্রবেশ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো রুদ্র।আহির মিটমিট করে আরোশীর দিকে তাকালো।কথা না বললে বিষয়টা খারাপ দেখাবে তাই আরোশী চোখের ইশারায় আহিরকে উওর দিতে বললো।

” ভালো।”

” শরীর কেমন আছে তোমার?আমি তোমার জন্য আপেল নিয়ে এসেছি,খেও কিন্তু।” হেসে বললো রুদ্র।এবার রুদ্র আরোশীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

” কেমন আছেন তুমি?অনেক দিন পর তোমার দেখা পেলাম।”

” ভালো।আপনি?”

” আমিও ভালো আছি।তা সেইদিন ওভাবে পুতুলটা নিজের জন্য নিয়েছিলে নাকি আহিরের জন্য?”

রুদ্রের কথা শুনে আরোশী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।হুট করে রুদ্র যে এই কথাটা বলে বসবে সেটা সে বুঝতে পারেনি।আরোশীকে বিভ্রান্ত করে রুদ্রর মনে হয় বিষয়টা বেশ মজাই লাগছে।

” তা পুতুল নিয়ে কেমন লাগছে?”

” আসলে তখন রাগের মাথায় আমি কি করে নিজেও বুঝতে পারিনি।তাই না বুঝেই আপনার হাত থেকে ওভাবে পুতুলটা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।”

” তাহলে ফিরে এসে ফেরত দিলেই তো পারতে।”

রুদ্রের আজব ধরনের কথা শুনে আরোশীর ভ্রু-কুচকে গেলো।

” ফিরিয়ে কেন দেবে?আমি টাকা দিয়েছি তাই ওটা আমার।” এটা বলার পর বিরবির করে বললো, ” যেভাবে আমি ডাকা*তের সরদা*রের মতো ছিনিয়ে এনেছিলাম ফিরিয়ে দেওয়ার কি মুখ ছিলো।”

” আচ্ছা তুমি কি কোন সময় ডাকাত ছিলে নাকি?না মানে যেভাবে আমার থেকে পুতুলটা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেলে,আগে থেকে অভিজ্ঞতা না থাকলে সেটা সম্ভব ছিলো না।তাই আরকি…..”

” দেখুন,আমি সামান্য একটা পুতুলই তো নিয়েছি।আর এমন নয় যে ওটা আমি চুরি করেছি।আমি পুতুলের পুরো টাকা দিয়ে তবেই ওটা নিয়েছি।আর এমনিতেও ওটা আমি আগে বুক করেছিলাম।দোষ ওদের,ওরা না জেনে সেটা আপনার কাছে আবারো বিক্রি করে দিয়েছিলো।এবার আপনিই বলুন আমি যেহেতু পুতুলটা আগে দেখেছি তার মানে পুতুলটা তো আমরাই হওয়ার কথা।”

” হুম।বুঝেছি।”

” কি বুঝতে পেরেছেন?”

” এই যে আপনি শুধু ছিনিয়ে নিতে জানেন না,ভালো কথাও বলতে পারেন।”

রুদ্রের কথা শুনে আরোশী ভ্রু-কুচকে ফেলে।

” আচ্ছা ওয়েট এ সেকেন্ড,আমি যে আপনার সাথে এতোগুলা কথা বললাম কিন্তু আপনি এখানে কেন?পুতুল ছিনিয়ে নিয়েছি সেটার জন্য খোঁটা দিতে এসেছেন না?”

” আরে আরে না না,তুমি ভুল বুঝছো।আসলে আমি মিস্টার আকাশকে চিনি।বর্তমানে একটা প্রোজেক্ট এ আমরা একসাথে কাজ করছি।তো যার সাথে কাজ করছি উনার ছেলে হসপিটালে ভর্তি।আমার তো একটা দ্বায়িত্ব আছে তাই না।তাই আহিরকে দেখতে এসেছি।তুমি আবার উল্টাপাল্টা কিছু ভেবে বসোনা।”

আরোশীর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে কি আসলেই রুদ্রের কথায় বিশ্বাস করেছে নাকি করেনি।

চলবে……