#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব- ৩৭)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
জুনের তপ্ত বিকেল। পুলিশ কোয়ার্টারের ইন্সপেক্টর সাদাত আফজলের বাসায় আজ এলাহি আয়োজন। পরিবারের আদরের দুলালিকে দেখতে আসছে কি না। মা সায়রা বেগম ব্যস্ত নাস্তা বানাতে। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার খুশিতে প্রফুল্ল বদনে সাজতে বসেছে সেঁজুতি। বসার ঘরে গম্ভীরমুখে বসা সাদাত। পেশাগত গম্ভীরতার বিচরণ সর্বদা তার চোখে। ঠোঁটে হাসিটি নেই। পরিবারের একমাত্র অভিভাবক সে। পাত্রপক্ষের আগমনের পর স্বাগতম জানানোর দায়তাও তার। সৌজন্যতাবোধে সেই দায় পালন করেছেন। পাত্রের পক্ষ থেকে বাবা, মা, বোন, দুই বন্ধু আর পাত্র এসেছে।
সবার সাথে কুশল বিনিময় করে তীক্ষ্ম চোখে তাকালেন পাত্রের দিকে। লম্বা, সৌম্য, সুদর্শন ছেলেটা তার নয়, তার বোনের পছন্দ। একমাত্র বোন তার। দেশ, দশ বেছে বোনের জন্য সবচেয়ে চমৎকার ছেলেটাকে বাছাই করার ইচ্ছে ছিল। ইতিমধ্যেই কম হলেও শ’খানেক ছেলের সমন্ধ এসেছে। একটা ছেলে ভারি পছন্দ হয়েছিল তার। মন্ত্রণালয়ের জয়েন করবে। প্রথমবার কথা বলেই তার মনে হয়েছিল, এমন ছেলেই সেঁজুতির জন্য খুঁজছেন তিনি। ছেলেটার পরিবার ও অমায়িক। এমন পরিবারে বোন গেলে সুখেই থাকবে। সেই সমন্ধ ও হলো না।
তা ছাড়া তার ডিপার্টমেন্ট থেকে ও এসেছে। ডি আইজির ছেলেটা তার ভারি পছন্দ হয়েছিল।
কিন্তু তার বোন সোনা ফেলে রূপায় মজেছে। এই খামখেয়ালিপনা ছেলেকে বিয়ে করার জেদ ধরেছে, কদিন তো নাওয়া খাওয়া ও বাদ দিয়েছে।
সাদাত নিজেই এই ছেলেটাকে অনেকবার নাস্তানাবুদ করেছেন। রাত বিরাতে এসে হ্যাংলামো করেছে। বোনটাকে ঘরবন্দী করে রেখেও কোন লাভ হয়নি। সেই সাদাত ঢাকার বাইরে পা রাখতেই ছেলেটার সাথে দেখা করেছে, সবই কানে গেছে সাদাতের। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ইচ্ছে করছিল ছেলেটাকে পিটিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিতে। কিন্তু বোনের জন্যই পারেনি।
এবারও সাদাত জোর করতে চেয়েছিল, পাত্রদের ডেকেছেন ও বাড়িতে, কিন্তু বোন এসে তার পা ধরে আকুতি করায় আর পারল না।
পিতৃহীন বোন তার, মনে বড়োই দুঃখ। আর দুঃখ না বাড়াতে মা ও যোগ দিলেন মেয়ের দলে। মেয়ের হয়ে সুপারিশ করলেন। সাদাত অবাক হয়ে জানল সেদিন, বাউণ্ডুলে ছেলেটাকে না কি মায়ের ও পছন্দ। মা ও চাইছেন, তার সাথেই সেঁজুতির বিয়ে হোক।
সম্ভ্রান্ত বংশ, চারদিকে বেশ নামডাক। একমাত্র ছেলে সহায় সম্পত্তি বেশ। নিজস্ব ব্যাবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছেলের। বাবা মা দুটো বেশ অমায়িক। একটামাত্র বোন। তারও নাকি বিয়ে ঠিক। দু’দিন বাদে বিয়ে করে চলে যাবে, তখন জ্বালানোর কেউ থাকবে না। এমন শান্তিপূর্ণ সংসারে মেয়ে দেয়া সব মায়ের স্বপ্ন। সায়রাও তার ব্যতিক্রম নয়।
মা আর বোনের দিকে চেয়েই বোনের পছন্দের পাত্রকে বাসায় ডেকেছে সাদাত। আদ্যপ্রান্ত সব খোঁজ নেয়া হয়ে গেছে। কেবল আবেগের বশে বোনকে যার তার হাতে তুলে দেয়ার মানষিকতা নেই। পুলিশী মন, হিস্টোরি না জেনে কাজ করেন না। ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন। বাজে নেশা নেই তার। সেঁজুতি ছাড়া তার জীবনে অন্য নারীর সাথে সখ্যতা ও নেই। সেঁজুতির ব্যাপারে সে ভীষণ সিরিয়াস। ফ্যামিলি, ব্যাকগ্রাউন্ড ও ভালো। ভদ্র পরিবার। ছেলের এডুখেইশনার ব্যাকগ্রাউন্ড ও খারাপ না। এদিকটা সচ্চ, শান্তিদায়ক। সমস্যা হলো, ছেলে বড্ড খামখেয়ালি।
ক্যারিয়ারের প্রতি সিরিয়াসনেস নেই। এত পড়ালেখা করে নিজবলে কিছু করেনি, বাবার ব্যবসায় বসেছে। তাতেও হেয়ালিপনা। দায়িত্ববোধ নেই। এই ব্যাপারটাই অপছন্দ সাদাতের।
পড়াশোনা শেষ, এবার ক্যারিয়ারে ফোকাস করার পালা। এত বড় ব্যবসার একমাত্র কর্ণধার সে, শক্ত হাতে কোথায় আগলে নিবে, তা না। কালেভদ্রে উঁকি দেয় অফিসে।
এই দায়িত্বহীন ছেলে কিভাবে তার বোনের দায়িত্ব নিবে, আদৌ নিতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান সাদাত।
তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখ সরালেন সাদাত। তার রোষানলে পড়ে রুবাব ভ্রু কুঁচকাল। বিড়বিড় করে পাশে থাকা অন্তরকে বলল,
” দ্যাখ, শা লা ক্যামনে চাইয়্যা আছে? খাইয়্যা ফেলব না কি!”
একবারে নিচু স্বরে নাহিদ উত্তর দিল, ” কতা কইস না। সরম কর। পাত্রগো সরম করতে অয়।”
অন্তর ও ধীর স্বরে বলল, ” তুই যা চিজ, খাইয়্যা হজম করতে পারবো না। উগড়াইয়্যা দিব। চিন্তা করিস না। আমরা কাজী ডেকে তোকে উগড়ানোর অপেক্ষা করব। যদি না উগড়ায় তয়, শা লার পেটের ভেতর থেইক্যাই কবুল কইস। বাসরের আগে ডেলিভারি করামু তোর শালারে। চিল, মামা।”
রুবাব কপট রাগ নিয়ে তাকাল, তার বন্ধুরা একটু সিরিয়াস হয়ে ভরসা দিতে পারে না! এই ক্ষণে সৈকতকে মনে পড়ল তার। সৈকত এখানে থাকলে ভালো হতো। ও পরিস্থিতি সামলাতে পারে। সাদাতের হাবভাব ভালো ঠেকছে না। ডেকে এনে অপমান করবে না তো! রুবব ধীরে বলল,
“সৈকতরে আইতে ক। ”
সেঁজুতিদের হলরুমে সবাই বসা। মনির শেখ সাদাতের সাথে গল্প করছেন। সায়রা, তারিনার সাথে। মুন গেছে সেঁজুতির কাছে। রুবাবরা একলা বসা। সৈকত আসেনি। গতকাল বাড়ি গিয়েছিল সে। আজ ফেরার কথা। রুবাব কড়া গলায় বলে দিয়েছে, সোজা যেন সেঁজুতির বাসায় থাকে। সৈকত বলেছে পারলে আসবে।
সাদাতের দিকে তাকাতেও ভয় হচ্ছে রুবাবের। আসার পর থেকে সেভাবে কথাও বলেনি। চোখেমুখে ওর জন্য তীব্র রাগ, ক্ষোভ। রুবাব স্পষ্ট বুঝেছে, সাদাতের ওকে পছন্দ না। সাদাতের পছন্দ অপছন্দের বালাই করেনা রুবাব। কে কী ভাবল তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন সেঁজুতির , তখন সব ফিকে পড়ে। যে কোন ভাবে সেঁজুতিকে চায় রুবাব। এখন তার পুলিশ ভাই বাঁধা হলে খুব বিপত্তি ঘটে যাবে। পালানো ছাড়া উপায় থাকবে না। কপালে চিন্তা ভাঁজ পড়েছে রুবাবের।
বন্ধু বিপদে পড়েছে আর সৈকত হাজির হবে না তা কী করে হয়? রুবাবের চিন্তিত ক্ষণেই এসে হাজির হলো সৈকত। দীর্ঘ জার্নির কান্তি ভাসছে চোয়ালে, এসেই সবার আগে চাইল রুবাবের পানে। চিন্তিত মুখখানা দেখে একটু হাসল, সেই হাসিতেই ছিল ভরসা। সৈকতের আগমনের পরেই হুট করেই রুবাব অনুভব করল, ওর মন হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে, এবার সব ঠিক হবে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো আপনাআপনি।
সৈকতকে দেখে সাদাত চমকালেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
” সৈকত! হোয়াট প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ! তুমি কোথা থেকে!”
সাদাতের চোয়াল ঝলমল করে উঠেছে। প্রফুল্ল স্বর। এতক্ষণের গম্ভীরতা নেই চোখে। উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এল সৈকতের দিকে। সৈকত বিনয়ী হেসে বলল,
“বন্ধুর শুভদিন বলে কথা, আসতেই হয়। ”
সাদাত ফের চমকালেন, ” তুমি পাত্রের বন্ধু, আগে বলবে না? ”
সৈকত ভারি নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল, “আমি বাড়িতে ছিলাম তো, ব্যাপারটা জানতাম না। আই এম অলসো সারপ্রাইজড।”
বলে একটু হাসল। সেই হাসিতে কত রহস্য ছিল সাদাতের গোয়েন্দা চোখেও তা ধরা পড়ল না। সাদাতকে ভারি খুশি দেখাল। বুঝাই যাচ্ছি, সৈকত তার পছন্দের। হেসে বলল,
” দাঁড়িয়ে কেন? বোসো!”
সৈকত বন্ধুদের কাছে বসল। সাদাত তার সামনে বসলেন। সবাইকে রেখে সৈকতের সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। সৈকত ও হেসে কথা বলছে। মাঝখানে উপস্থিত মহল হতভম্ব হয়ে গেছে। রুবাবের চোখ কপালে। তার শা লা তাকে ফেলে সৈকতের সাথে গল্প জুড়েছে! কী ভাব তাদের! দেখেই বুঝা যাচ্ছে পূর্ব পরিচিত তারা? সৈকতের সাথে সাদাতের কী সম্পর্ক? কই কখনো তো বলল না সৈকত। রুবাব ধীরে প্রশ্ন করল,
” এদের কাহিনি কী রে?”
অন্তর দ্বিধা নিয়ে বলল, ” বুঝতেছিনা, সৈকত এই হি ট লাররে পটাইছে ক্যামনে!”
নাহিদ বলল, “দেখেই বুঝা যাচ্ছে, এরা পূর্ব পরিচিত। ”
রুবাব বিরক্তি নিয়ে বলল, ” সিলেবাসের ভেতরের কথা সবাই জানে, বাইরের কথা জানলে বল। সৈকত ক্যামনে চিনে?”
উত্তর পেল না ওরা। সেই প্রশ্নই করলেন মনির শেখ। বিস্ময় নিয়ে,
” তোমরা পূর্বপরিচিত?”
সাদাত বড় আনন্দের সাথে বলল,
” কাজের সূত্রে ওদের গ্রামে যাওয়া হয়েছিল কয়েকবার। স্থানীয় হিসেবে সৈকত খুব সাহায্য করেছিল আমাদের। ইভেন, আমরা ওদের বাড়িতে লাঞ্চ ও করেছিলাম। ওদের ফ্যামিলির হসপিটালিটি চমৎকার।”
সৈকত প্রশ্রয়ের হাসি দিল। রুবাব সন্দিহান চোখে তাকাল, যার অর্থ, বলিস নি তো! সৈকত রুবাব থেকে চোখ সরিয়ে সাদাতের দিকে তাকাল। প্রশ্রয়ের সুরে বলল,
“বাবা এখনো আপনাকে স্মরণ করে। গেলবার ঢাকা আসার পর আপনার থানায় যেতে চেয়েছিল।”
“নিয়ে যেতে!”
সৈকত ছলেবলে কৌশলে বলল, ” কুটুমদের জায়গা বাড়িতে, থানায় নয়। দুই কুটুম হতে যাচ্ছেন, এবার দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকবে। ”
“দুই কুটুম!” ভ্রু কুঁচকালেন সাদাত। এবার মনির শেখ বললেন,
” আমার জামাতা হতে যাচ্ছে।”
সাদাত চমকে চাইল। সৈকত হাসল। যেন সে এটাই জানাতে চাইছে। সাদাত চাপা শ্বাস ফেলল। সৈকত বলল,
“রুবাব আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা এক সাথে কলেজ ভার্সিটি পেরিয়েছি। এই সম্পর্কটাও আগের। আমি বন্ধু পরিচয় দিতেই পছন্দ করি। আজ কিন্তু আমি বন্ধু পরিচয় নিয়েই রুবাবের জন্য আপনার বোনের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।”
সাদাত কিয়ৎক্ষণ অপ্রতিভ দেখা। তা সরিয়ে সৌজন্যবোধে হাসলেন। তারিনা এসে বললেন, “অনেক আলাপ হলো। এবার মেয়েকে আনা হোক?”
সায়রা সায় জানিয়ে ভেতরে গেলেন। ফিরলেন খানিক বাদে। সেঁজুতিকে শাড়ি পরানো হয়েছে, মুখে বেশ সাজ। মা ধরে আনছেন। আরেকপাশে মুন। সফেদা কাঞ্চিতে সেঁজুতিকে দেখে বিমোহিত রুবাব। হার্টবিট মিস হলো। দিক বেদিক ভুলে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল। ওর হার্টরেট যে কত পেরুল তা বলা দায়। চিত্ত নড়া টের পেয়ে পাশে থাকা অন্তর বলল,
” ভাই, একটু শান্ত হ। পাশে তোর শা লা আছে। ছক্কা মে রে অক্কা পে য়ে বসাবে। একটু সরম কর। এই ছেলেরে সরম শিখাইতে পারলাম না। কাল থেকে সকাল বিকাল আমার কাছে সরম শিখতে বসবি।”
সে কথা শুনলে তো রুবাব! সে তো ধ্যানজ্ঞান ভুলে চেয়ে আছে। সেঁজুতি ধীরে পায়ে এগুতে এগুতে এক পল চাইল সামনে। তাতেই লজ্জায় হিম ধরে গেল। চির পরিচিত মানুষটা কিভাবে চেয়ে আছে তার দিকে! চোখে মুগ্ধতা ঢেউ খেলছে। লাজুক হেসে চোখ সরাল সেঁজুতি। মুনের দৃষ্টি ভাবির দিকেই ছিল। সেঁজুতিকে লজ্জা পেতে দেখে মশকরা করল,
” ভাবি, একটু লম্বা পা ফেলো। আমার ভাইটা শ্যাষ হয়ে যাচ্ছে। ”
সেঁজুতি আবার চাইল রুবাবের দিকে। রুবাব তখনো চেয়ে আছে। এবার হাসছে। সেঁজুতির লজ্জার মাত্রা বাড়ল। মুন আবার বলল,
“ভাবি ঘোমটা টেনে দিব?”
হাসতে হাসতে চাইল সামনে। এবার বোধহয় তার পালা। দেখল ভাইয়ের পাশে থাকা মানুষটার গভীর চাহনি তার পানে নিবদ্ধ। মুন চমকাল বেশ। জনাব কখন এলো! চোখাচোখি হতেই মানুষটা গভীর চোখে চেয়ে সুন্দর করে হাসি উপহার দিল। মন এলোমেলো করে গেল হাসিটা। মুনকে দেখাল ভীষণ উৎফুল্ল। সেও হাসল। হাসি বিনিময় হলো। এই হাসি বিনিময় দেখলেন সাদাত। সৈকতের দিকে তাকালেন। হেসে বললেন,
“এই ব্যাপার তবে?”
সৈকত লাজুক হাসল। মুন সেঁজুতিকে নিয়ে এসে মায়ের পাশে বসাল। সেঁজুতিকে দেখে এক পলেই পছন্দ হয়ে গেল তারিনার। কী মিষ্টি মেয়ে! আলাপ করলেন কিছুক্ষণ। ভালোই লাগল।
তখন সৈকত বলল,
“সেঁজুতি -রুবাব আগ থেকেই একে অপরকে নিজেদের জন্য বেছে নিয়েছে। দুজনই যথেষ্ট পরিণত ছেলে মেয়ে একে অপরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিবারকে জানিয়েছে। আমি যদি ভুল না হই আপনি এবং আংকেল দুজনই দুই পরিবারের ব্যাপারে যথেষ্ট খোঁজ নিয়েছেন। আমার ধারণামাফিক, নেতিবাচক কিছু পাননি, যার ফলাফল আজকের এই বিকেল। ছেলে মেয়ে একে অপরকে পছন্দ, বড়রা খোঁজ নিয়েছেন। এরপরের ধাপ বোধহয় পাঁকা কথা। আমরা কি সেই ধাপে যেতে পারি?”
কিছু মানুষ থাকে, যাদের উপস্থিতিতে সব ঠিক হয়ে যায়। বিগড়ানো পরিবেশ ক্ষনিকেই ঠিক করে ফেলে। সৈকত তেমন মানুষ। এসেই সাদাতের নেতিবাচক মনোভাব দূর করে পরিবেশটা শান্ত করে ফেলল। সবকিছু গুছিয়ে নিল। মনির শেখ নিজেও চুপ আছেন। সৈকতের জন্য রদবদল হওয়া পরিবেশ দেখে তিনি নিজেও মুগ্ধ। এখন সবটা সৈকতের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। সৈকত অভিভাবকের মত সাদাতের সাথে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করছে।
রুবাব গর্বিত চোখে চেয়ে আছে বন্ধুর দিকে। একটু আগে ও সাদাতকে দেখে তার মনে হয়েছে সাদাত সুযোগ পেলে এখনই বিয়ে ভেঙে দিবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সাদাত পারলে এখনই সেঁজুতিকে তার হাতে তুলে দিবেন। সৈকত যেন তাকে হিপনোটাইজ করে ফেলেছে।
রুবাব বিস্ময় নিয়ে দেখল এমন বন্ধু কোথায় পাওয়া যায়? খুব ভাগ্য ছাড়া পাওয়া যায়?
আলাপের মাঝে অন্তরের কথায় পাত্র পাত্রীকে আলাদা কথা বলতে পাঠানো হলো ছাদে। বাকিরা বিয়ের দিনতারিখ করতে বসলেন।
______________
রুবাবকে নিয়ে সেঁজুতির এক কাজিন আগেই ছাদে গিয়েছে। রুবাবকে রেখে ফিরেছে এসেছে। সেঁজুতিকে ঠেলে পাঠাল। সেঁজুতি ধুরুধুরু বুকে ছাদে পা রেখেছে সবে, তখনই একটা হাত টেনে নিল ওকে। চঞ্চল মানব আঁকড়ে নিল বুকে। কিছুই বলল না। নিশ্চুপ হয়ে আগলে রাখল। সেঁজুতি তার কথা শুনল না, কেবল টের পেল ওর হৃদ স্পন্দন। খানিক বাদে প্রচন্ড প্রফুল্ল স্বরে প্রেমিক বলে উঠল,
” আমি তোমাকে পেয়ে যাচ্ছি সেঁজুতি। ”
খুশিতে ছেলেটা কোলে তুলে নিল। ঘুরাতে লাগল। এত খুশি! পাগল হবার জোগাড়! সেঁজুতি মুগ্ধচোখে দেখল। মনটা ভরে এলো। চোখে পানি এলো। চোখের পানি ছেড়ে বলল,
” ফাইনালি!”
রুবাব ওকে নামিয়ে দিল। আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“কান্না নয়, এবার শুধু হাসবে। রুবাবের বউকে চোখের জলে নয়, হাসিতে মানায়।”
সেঁজুতি চাইল এক পল, চেয়ে রইল। তারপর হুট করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভালোবাসি।”
______________________
যাবার কালে রুবাব সৈকতকে জিজ্ঞেস করল, ” সাদাত ভাইয়ের সাথে তোর কাহিনি কী?”
সৈকত থমথমে মুখে বলল, “যেই কাহিনি থাকলে সাদাত ভাই তার বোনের জন্য প্রস্তাব দেয়।”
বন্ধুরা আর মুন সবাই উপস্থিত ছিল সেখানে। সবার চক্ষুচড়ক। বিস্ময় নিয়ে চাইল। রুবাব হকচকিয়ে গেল,
” সেঁজুতির জন্য…. ইম্পসিবল!”
অন্তর বলল, ” কবেকার ঘটনা? ক্যামনে কী?”
” মাস তিনেক আগে। আমাদের বাসায় গেছিল। মায়ের আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়ে ফেরার সময় একলা ডেকে বললেন, তার বোনের জন্য আমাকে পছন্দ হইছে। আমি সায় জানালে ঘটা করে প্রস্তাব দিবেন বাবা মা কে । ”
এতক্ষণে মুখে বিরক্তির চাপ ফুটল সৈকতের। নাহিদ বলল,
“আসতাগফিরুল্লাহ!”
মুন শ্বাস আটকে বলল, “তুমি কী বলেছিলে?”
সৈকত একবার রুবাবের দিকে তাকাল। তারপর মুনের দিকে ঝুঁকে এসে রহস্যময় হাসল। কিন্তু উত্তর দিল না। মুন ভ্রু কুঁচকে চাইল। বলার তাড়া দিল, কিন্তু সৈকত বলল না। রুবাব বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের বন্ধুর জন্য প্রেমিকার প্রস্তাব যায় শুনে কেমন লাগবে প্রেমিকের তা বলার ভাষা রাখে না। প্রচন্ড গম্ভীরমুখে রুবাব বলল,
“আমারে বলিস নাই ক্যান?”
সৈকত বিরক্তি নিয়ে বলল, ” গাধার মতো কথা বলবি না। আমি কী বলতাম তোরে! রুবাব জানিস? সেঁজুতির ভাই আমাকে ডেকে তার বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিছে? এটা বলব? বন্ধুর প্রেমিকার জন্য প্রস্তাব আসে, এটা বলে বেড়ানোর কথা! এটা আমার জন্য খুব সম্মানের তাই না?”
আকস্মিক রেগে গেল সৈকত। চোখ মুখে তীব্র বিতৃষ্ণা। রুবাব নাক ফুলিয়ে বলল,
“তো সত্যটা বলে দেস নাই ক্যান? এরপরও যোগাযোগ রাখছস ক্যান? ”
সৈকতের চোখেমুখে বিরক্তি উল্কি দিচ্ছে, ” তোরে কতবার বলছি, অফিসে মন দে। দিয়েছিস? খামখেয়ালিপনা করে ঘুরে বেড়িয়েছিস? তোর পুলিশ শা লা এর জন্য বেঁকে অলমোস্ট বিয়ে ভেঙে দিচ্ছিল, গাঁ ধা। এসব খামখেয়ালির জন্যই দিই নি পরিচয়। ”
বলে রাগে এগিয়ে গেল। রুবাব প্রশ্নবিদ্ধ মনে চেয়ে রইল। অন্তর বলল, ” রুবাবের খামখেয়ালির সাথে সৈকতের পরিচয় না দেয়ার কী সম্পর্ক? ”
নাহিদ বলল, ” এডভান্টেজ। ”
“কিসের এডভান্টেজ? ”
“সাদাত ভাই সৈকতকে পছন্দ করেন। সৈকত সাদাতকে চিনতো, কিন্তু সাদাত ভাই চিনতেন না। বোনের প্রেমিকের বন্ধু শুনলে নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখতেন না। এজন্য পরিচয় দেয়নি। যোগাযোগ রেখেছিল, যাতে আজ একটা কথা বললে সাদাত ভাই না ফেলতে পারেন। এন্ড সেটাই হয়েছে। ” বলল নাহিদ
তিন বন্ধু সরু চোখে চেয়ে রইল তাদের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত বন্ধুর দিকে। সৈকত এগিয়ে গেছে অনেকটা। মুন তার পিছু হাটছে। বড়রা এখনো নামেননি।
মুন কদম বাড়িয়ে ডাকল,
” সৈকত দাঁড়াও!”
সৈকত দাঁড়াল না। হাঁটার গতি কমাল। মুন তার পাশে গেল। হাত ধরে বলল,
” শুনো না?”
সৈকত সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, ” শুনছি, বলো।”
মুন হাত ঝাঁকিয়ে বলল, “আমার দিকে তাকাও।”
সৈকত তড়িৎ তাকাল। গভীর চোখ ওর দিকে তাকিয়ে রইল। উপর নিচ দেখে নিয়ে বলল,
“দেখলাম।”
মুন মৃদু থাপ্পড় দিয়ে বলল, ” অসভ্য! এভাবে তাকাতে বলিনি। আমার চোখের দিকে তাকাও।”
সৈকত এবার গভীর চাহনিতে চাইল চোখে। মুনের চিত্ত নড়ে উঠল। লাজে বলল, “আল্লাহ! আমি ম রে ই যাব। এভাবে তাকিয়ো না!”
সৈকত বলল, “দোষ আমার চাহনির নয়, দোষ তোমার রূপের। অথচ তুমি দ্বিধায় আছো চন্দ্রকথা!”
মুন হার মানল। “আচ্ছা দোষ আমার। কিন্তু দ্বিধা দূর করার দায় তোমার।”
“তাই না কি!”
“আমার অশান্তি লাগছে সৈকত!” রাগ নিয়ে বলল মুন। সৈকত ভীষণ গম্ভীর হয়ে বলল,
“তা কী এমন দ্বিধা, যা আমার চন্দ্রকথাকে অশান্তি দিচ্ছে, শুনি?”
মুন আমতা-আমতা করল। তারপর বলল,
“তুমি কী উত্তর দিয়েছিলে?”
সেঁজুতির বিয়ের প্রস্তাবের পরের প্রসঙ্গ বেশ বুঝতে পারল সৈকত। বুঝেও উত্তর দিল না। হাসল। মুন তাড়া দিল,
” তখনও বলো নি, এখনও বলছো না। ”
“সব কথা কী আর সবার সামনে বলা যায়? ”
মুনের কৌতূহল বাড়ল। অতি আগ্রহী সুরে বলল,
“কী বলেছিলে, যা সবার সামনে বলা যাবে না? বলো প্লিজ!”
সৈকত একটু হাসল। একটা হাতে মুনের বাহু আগলে নিয়ে বলল,
” আমি উত্তর ছিল, আকাশে একটা চাঁদই থাকে। আমার আকাশে চাঁদের বিচরণ হয় খুব করে। ”
মুন ওর দিকে চেয়ে ছিল। হুট করে অন্যদিকে ফিরে গেল। ওর চোখেমুখে প্রশান্তি। সুখ, লজ্জা, হাসি। তা দেখে সৈকত বলল,
“তুমি চাইলে আমার আকাশের চাঁদকে দেখতে পারো। আমার বুকের বাঁ পাশে হৃদয়ে বাস তার। তবে এই মুহুর্তে সে আছে সেই পাশটাতেই।”
মুন নিজের অবস্থান চাইল। সৈকতের বুকের সাথে লেগে আছে। বুকের কোন পাশটায়? বাঁ পাশে। সেই ক্ষণে কানে এলো হৃদস্পন্দন। যেন তার নামেই বাজছে…. কী সুন্দর!
ভালোবাসার বড়ন্ত অধ্যায়ে এলো বিসিএস রেজাল্টের দিন।
চলবে….
#অলীকডোরে_চন্দ্রকথা। (পর্ব-৩৮)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
উদগ্রীব হয়ে ডেস্কটপের সামনে বসা সৈকত। চোখমুখে অজস্র কৌতুহল। মস্তিষ্ক জুড়ে হাজারো চিন্তা। খানিক আগেই সরকারি কর্ম কমিশন বিপিএসসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল। এর উপর তার জীবনের মোড় নির্ভর করছে। চাপা উৎকন্ঠা নিয়ে স্ক্রিনে চোখ বুলাচ্ছে। খুঁজছে নিজের রেজিষ্ট্রেশন নাম্বারটা।
এ যাত্রায় সে একা নয়, তার পাশে আছে বিসিএস ফলপ্রার্থী দুই বন্ধু নাহিদ ও অন্তর। দুজনের কপালে ভাঁজ। চোখমুখ বিমূঢ়। চিন্তায় শ্বাস আটকে আসছে নাহিদের। অন্তর তো নখ কা মড়ানো শুরু করেছে।
প্রিলি গেল, রিটেন গেল ফলাফলের সময় চিন্তার বালাই করেনি কেউ। একজন মেরিট লিস্ট দেখেছে। বাকিদের জানিয়েছে, এর এসেছে ওর আসেনি। তাতেই শেষ।
সর্বদা প্রফুল্ল থাকা মানুষ গুলো ও আজ অস্থির। আশায় যে বুক বেঁধেছে। রিটেন পেরিয়ে ভাইভা অবধি আসা চাট্টিখানি কথা নয়, কত শ্রম দিতে হয়েছে কেবল ওরাই জানে। বড়ন্ত পথে দেখেছে আশার আলো। এক নতুন জীবনের প্রীতিক্ষা।
এ যাবতে তিনজনই পেশাগত দিক থেকে ভালো অবস্থানে আছে। ওয়েলপ্লেস জব। একটা হ্যান্ডসাম স্যালারি পায়। এই চাকরিতেই জীবন পার করে দিতে পারবে। কিন্তু বিসিএসের মানটা এর চেয়েও অতি উচ্চ। বর্তমানে বিসিএস ক্যাডার সরকারি চাকুরিজীবীদের খুব উচ্চচোখে দেখা হয়। নিজেকে যাচাই করার যেন উত্তম প্রন্থা। মানুষ শুনেই ভ্রু নাড়ায়, সমিহ করে চলে।পেশায় সম্মান বৃদ্ধির সাথে সাথে পদ ও উন্নত হয়। সচিবালয়ে, মন্ত্রণালয়ের, প্রশাসনে, প্রভাষকের কত পদ হাতছানি দেয়। নিঃসন্দেহে তা এ চাকুরী থেকে ভালো।
“ওই তো নাহিদ!” একটা সংখ্যায় চোখ আটকে গেল সবার। আনন্দে চিৎকার দিল অন্তর। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“ক্যাডার হইয়্যা গেছো, মামা। এবার বোন বিয়া দাও।”
এই গম্ভীর ক্ষণে ও অন্তরের ঠাট্টা ফুরাবার নয়। নাহিদ বিড়বিড় করে মুখ নাড়ল। একটা স্বস্তির আভা দেখা গেল মুখে। বোধহয় ‘আলহামদুলিল্লাহ ‘পড়তেছে। এই হলো ওর উৎযাপন। তারপর আবার ঠিকঠাক বসে স্ক্রিনে চোখ ফেলল। কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলল,
” আজাইরা না বকে এদিকে দ্যাখ।”
সৈকত নাহিদের কাধ চাপড়াল, “ইউ ডিড ইট।”
নাহিদ দৃঢ় স্বরে বলল, “ইউ উইল ঠু।”
তিনজন ফের মনোযোগ দিল লিস্টে। বুক ধুকপুক করছে। এই বুঝি এলো সামনে। একে একে দেখতে দেখতে সাধারণ ক্যাডারের দ্বিতীয় স্থানে থাকা রেজিঃ নাম্বারটায় চোখ আটকে গেল। স্তব্ধ হয়ে রইল সবাই। অবিশ্বাস্য চাহনি। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না কেউ। এরপরই অন্তর হৈহৈ করে উঠল,
” কংগ্রাচুলেশনস দুলাভাই! চান্দে আপনারে স্বাগতম। ”
সৈকত তখনো কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসা। বাকরুদ্ধ সে। সাধারণ ক্যাডারে দ্বিতীয় হয়েছে সে! এ যেন বিস্ময়ের কার্য। মুখে হাত দিয়ে বসে রইল । এই ক্ষণটার অপেক্ষায় ছিল কতকাল, অবশেষে এল। ওর স্বপ্ন সত্য হলো। ওর চন্দ্রকথা এবার ওর হলো! হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। নাহিদ এবার কাধ চাপড়াল,
” তুই পেরেছিস, তোর সাধনা সফল। যা ডিজার্ভ করিস তাই পেয়েছিস। ”
নাহিদকে ভীষণ খুশি দেখাল। নিজের রেজাল্ট থেকে সৈকতের রেজাল্টের আনন্দ বেশি ওর। সেই ক্ষণে ফোন বাজল। ডেস্কটপের পাশেই ফোন রাখা। স্ক্রিনে ‘চন্দ্রকথা’ নামটা ভাসছে। স্তব্ধতায় তা নজর কাড়ল না সৈকতের। একই ধ্যানে বসে রইল। চোখ বন্ধ ওর। ফোন তুলতে না দেখে অন্তর বলল,
“খুশিতে পটল তুলতে চলে গেলেন না কি! আপা ফোন দিতাছে। সুখবর দিয়া দেন দুলাভাই। ”
সৈকতের ধ্যানভগ্ন হলো। ফোন হাতে নিল। রিসিভ করে কানে দিতেই মুন উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
” কী খবর? রেজাল্ট পেলে? এসেছে? বলো তাড়াতাড়ি? চিন্তায় আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।”
লাগাতার প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে নিশ্চুপ রইল সৈকত। এই মেয়েটা তার সব ব্যাপারে এত উদ্ধিগ্ন কেন? মনে মনে স্বস্তি এলো। নেতিবাচক উত্তর দিলে বোধহয় মেয়েটা শ্বাস আটকে ওপারে পাড়ি জমাতো। এত উদগ্রীব। সবকিছুতে হাইপার হওয়া লাগবে তার। ওর নিরবতা দেখে মুন তাড়া দিল,
” সৈকত? তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমায়? প্লিজ বলো? আমার চিন্তা হচ্ছে। না এলে ও বলো, আমি কিছু বলব না প্রমিজ।”
শেষ কথাটায় শিশুসুলভ ভাব ফুটে উঠল। সৈকতের ঠোঁটের কোণে হাসির আভা দেখা গেল। একটু হেসে বলল,
“বধূ সেজে বসে থাকো, বর বেশে আমি আসছি নিতে।”
অপাশ গুমোট হলো। এক মুহুর্ত কোন রা এলো না। বোধহয় বুঝতে সময় লাগল। তারপরই খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল,
“সিরিয়াসলি?”
সৈকত হেসে বলল, “সিরিয়াসলি, মিসেস সাফায়াত সৈকত।”
‘মিসেস সাফায়াত সৈকত’ কথাটায় কী ছিল কে জানে। মুন অভিভূত হয়ে গেল। সুখে, লজ্জায় মিশে গেল। কেঁদে দিল, পরপরই হেসে উঠল। কত কথা বলতে চাইল, পারল না। কেটে দিল ফোন।
__________________
ফোন রেখে রুমে ফিরে এলো সৈকত। নাহিদ অন্তর তখনো টেবিলে বসা। সৈকত ভ্রু কুঁচকাল,
“অন্তরেরটা পাসনি এখনো?”
ঠোঁট উলটে অন্তর বলল, “আসেনি বোধহয়। ”
সৈকত থমকাল, পরপরই ধমকে উঠল, ” আজাইরা কথা বলিস না! সর আমি দেখি।”
অন্তর উঠে দাঁড়াল। শান্ত হয়ে বিনব্যাগে বসল। সৈকত বসল চেয়ারে। এক এক করে প্রতিটা রেজিঃ নাম্বার যাচাই করতে লাগল। নাহিদ ও নিজের ল্যাপটপ মেলে দেখছে। অনেক সময় নিয়ে খুঁজল। প্রথমবার পেল না। দ্বিতীয়বার আবার খুঁজতে লাগল। যদি দেখা ভুল হয়। সময় গড়াতে লাগল। আঁধার নামল দুজনের মুখে। নিজেদের সফলতার আনন্দ মুছে গেল। হতাশায় ছোঁয়াল গাল। সৈকত নাহিদ একে অপরের পানে চাইল। করুণ চোখে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
অন্তর চাপা শ্বরে বলল, “হুদাই বইসা খুঁজতাছস। না আসলে পাবি কই? আসেনাই। উইঠ্যা আয়।”
কেউ ওঠল না। বিমূঢ় হয়ে বসে রইল। রিটেনের সেই ধা ক্কাটা আবার লাগল। এতদূর এসে ঝরে গেল অন্তর। রিটেনে রুবাব, ভাইবাতে অন্তর ব্যর্থ হলো। শেষ অবধি সফল হলো সৈকত আর নাহিদ। এমন তো চায়নি ওরা। ভাইবার প্রস্তুতি একসাথে নিয়েছে সবাই। ধারণা ছিল, হলে সবারই হবে। কিন্তু অন্তর….!
অন্তরের ফোন বাজছে অনবরত। বাড়ি থেকে কল আসতেছে। রেজাল্ট জানার জন্যই বাবা ভাই ফোন দিচ্ছে। চাপা শ্বাস ফেলে ফোন বন্ধ করে দিল অন্তর। খানিক আগ অবধি হাসিখুশি থাকা ছেলেটা হুট করেই নিরব হয়ে গেল। বিমূঢ় হয়ে বসে রইল। এক বন্ধুর বিফলতায় বাকি দুই বন্ধু সফলতার আনন্দ উপভোগ করতে পারল না।
____________________
টাইয়ের নাট ডিলে করতে করতে চৌকাঠে এসে দাঁড়াল রুবাব। আজ অফিসে কাজের প্রেশার বেশ ছিল। সব গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে মায়ের জন্য। আজ মায়ের চেকাপ আছে। বলা বাহুল্য, রুবাব একনিষ্ঠ মনে বাবার ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছে। এখন কর্মই তার ধর্ম।
ক্লান্তির শ্বাস ফেলে ভেতরে পা বাড়াতেই দোতলা থেকে প্রচন্ড শোরগোল কানে এলো।
রুবাব ভ্রু কুঁচকাল। বসার ঘরে মাকে পেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এত হৈচৈ কিসের? ”
তারিনা কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলল, ” কিসের আবার তোর বোনের। সকাল থেকে দেখলাম শুকনো মুখে নখ কামড়াচ্ছে। তারপর হুট করে কোন সুখে মেতেছে কে জানে, গান ছেড়ে নাচানাচি শুরু করেছে। একবার হাসছে, একবার কাঁদছে। আমার তো ভয় করছে, জ্বিন পরী আছর করল না কি আবার!”
রুবাব প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে ভাবল কিয়ৎক্ষণ। তারপর বলল, “আমি দেখছি।”
দোতলার দিকে পা বাড়াল রুবাব। মুনের ঘরের দরজা খোলাই পাওয়া গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে চাইল। সাউন্ড বক্সে হাই ভলিউমে গান বাজছে। তালে বেতাল হয়ে নাচছে মুন। ঠিক নাচ নয়, লাফাচ্ছে। হাসছে, চিৎকার দিচ্ছে। কী ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে ওকে! বোনের খুশি দেখে আপনাআপনি হাসি ফুটল রুবাবের মুখে। ক্লান্তিটা যেন নিমিষেই ঝরে গেল। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে পরখ করল বোনের খুশিটা। কারণ জানবার ইচ্ছে হলেও ব্যাঘাত হবে বলে নিজের উপস্থিতি জানান দিল না। ফোন হাতে নিয়ে কল ঘুরাল। রিসিভ হতেই বলল,
” মুন বাড়ি মাথায় তুলছে, কাহিনি কী রে?”
মলিন মুখে তখনো চেয়ারে বসা সৈকত। গুমোট পরিবেশ ঘরের। মনটা বড্ড খারাপ। কথা বলতে ইচ্ছে করতেছেনা। তবুও ফোন তুলেছে। মূলত, রুবাবকে বাসায় ডাকাই তার উদ্দেশ্যে। তিন বন্ধু মিলে অন্তরের হতাশা কা টাবে।
ফোন তুলে কিছু বলার আগেই রুবাবের কথা ভেসে এলো। প্রশ্নবিদ্ধ হলো মন। মুনের আবার কী হলো? চিন্তা নিয়ে বলল,
” কী হইছে ওর? ও ঠিক আছে?”
“নিজেই দ্যাখ।” বলে অডিও রেখে ভিডিও কল দিল রুবাব। রিসিভার বাটন প্রেস করতেই হৈ-হুল্লোড় কানে এলো। উদ্ধিগ্ন হয়ে স্ক্রিনে চাইল সৈকত। তাতেই থ বনে গেল। ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজতেছে, “মুজে সাজান কি ঘার জানা হ্যায়…..
গানের তালেতালে নাচছে মুন। চিৎকার করে করে আবার গান ও গাইছে।
সাজনা ক্যা লিয়ে সাজনা হ্যায় মুজে…
ওর চোখে মুখে হাসি। হাসছে, গাইছে, নাচছে, আবার লাফাচ্ছে। এমনভাবে মুনকে দেখা হয়নি সৈকতের। সে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। মুনের নাচের কারণ ধরতে সময় লাগল না তার। তার রেজাল্ট আর বউ সাজার কথাই কারণ। মেয়েটা বিয়ের খুশিতে নাচছে। এত বিয়ে পাগল এই মেয়ে। বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে আকস্মিক শব্দহীন হেসে ফেলল সৈকত। মনের অজান্তেই হাসি খুশি ছুঁয়েছে মন।
রুমে থাকায় আর হাই ভলিউমের কারণের গানের শব্দ রুমে থাকা দুজনের কানে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। সৈকতের হাতের থাকা ফোনে মুনকে হাল চোখ এড়াল না কারো। প্রচন্ড মন খারাপের মাঝেও হো হো করে হেসে ফেলল অন্তর। হাসল নাহিদ ও। মুহুর্তে যেন পরিবেশটাই বদলে গেছে। অন্তর নিজের স্বরূপ ধরে বলল,
” চান্দ জমিনে নাইম্যা যাইতাছে বিয়ার খুশিতে। সাজানজি তাত্তারি তল্পিতল্পা গুটিয়ে দৌড় দে। সাজনা সাজক্যা ব্যাটা হ্যায় তেরে লিয়ে। আমি কিন্তু কনে পক্ষ। গেইটের লাখটাকা দেওন ছাড়া বোন পাবিনা। ”
সৈকতের মুখে প্রসন্নতা দেখা গেল, এই প্রসন্নতা মুনের পাগলামো দেখে নয়, অন্তরের নিজ স্বরূপে ফেরা দেখে। সে অন্তরের পানে চেয়ে হাসল। বলল,
” কনে পক্ষ হলে কিন্তু বরের জন্য স্পেশাল খাসির রোস্ট পাবি না, ভেবে দ্যাখ।”
খাবারের কথা আসতেই অন্তর নরম গলায় বলল, ” শুধুমাত্র খাবার টেবিলের সময় ডিসকাউন্টে আমি বরপক্ষ। খানা শ্যাষ হইলেই আবার কনে পক্ষ। ঠিক আছে?”
সৈকত হাসল। অন্তর নাহিদকে বলল,
“শা লা তুই কী নিষ্ঠুর! বন্ধুর বোনের অভাবে বিসিএস হইলো না আমার। সান্ত্বনা হিসেবে বিয়া দিয়ার ওয়াদা দিতে পারোস না!”
নাহিদ মুখ কুঁচকাল, ” উল্টাপাল্টা বকবি, খাসির বদলে তোরে রোস্ট করব। ”
“রোস্ট হইলে বোন বিয়া দিবি? তাইলে আমি রোস্ট হইতেও রাজি।”
নাহিদ রাগ নিয়ে চাইল। তখন বি কট শব্দ এলো কানে। মুন ভলিউম বাড়িয়ে দিয়েছে। গান পালটে তখন ‘মেরে সাইয়্যা সুপারস্টার, ম্যায় ফ্যান হুয়ি উনকি…. গান বাজতেছে….
সবাই হো হো করে হেসে ফেলল। সবার ওট্টোহাসি শব্দ গান ভেদ করে মুনের কানে গেল। তড়িৎ চাইল। ভাইকে দেখল, দেখল হাতে ধরা ফোন ও মুন। মুন চমকে গেল। তড়িৎ থেমে গেল। লজ্জায় চোখমুখ কুঁচকে এলো। রুবাব হেসে জানতে চাইল,
” আমার বোনটা কী নিয়ে এত খুশি?”
মুন আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়াল। উত্তর দিল না। অন্তর আওয়াজ করে উত্তর দিল, ” সৈকতের মেরিট লিস্টে নাম্বার আইছে। এই জন্যই নাচতেছে আপা।”
রুবাব ভ্রু নাঁচাল, “ও, এই কাহিনি! ”
মুন অন্তরের কথা শুনে বিস্মিত চোখে চাইল। কাঁচুমাচু করে বলল, ” ভাইয়া ফোনে কে? ”
রুবাব ফোন ঘুরালো। গ্রুপ ভিডিও কল। সবার আগে সৈকতের মুখটা চোখে ভাসল। মিটমিটিয়ে হাসতেছে। মুনের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। এরা সবাই দেখেছে ওর নাচ! আল্লাহ! অন্তর বলল,
“হ্যালো, আমরা আপনার সাইয়্যার বন্ধু ভাইয়া।”
নাহিদ বলল, ” পিচ্চ, তুমি যে এত ভালো ডান্স করো, বলো নি তো!
থেমে বলল, “তোমার সাজানকে পাঠাব না কি বাই দুয়া ওয়ে?”
সবার কথার মাঝে মুন লজ্জায় হিম হয়ে যাচ্ছে। কোথাও লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সবচেয়ে বেশি লজ্জা পাচ্ছে সৈকতের জন্য। সবাই হাসিমজা করছে, এটা ওটা বলছে। সৈকত কিছুই বলছে না। কেবল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাসি আর চাহনি একবারে ভিন্ন। যা সবার কথা মাড়িয়ে ওকে লজ্জার সাগরে ডুবাচ্ছে। অনেকক্ষণ বাদে বলল,
” আমার কি এখন এটা গাওয়া উচিত যে,
তেরে ঘর আয়া
ম্যায় আয়া তুঝকো লেন
দিল কে বাদল মে
দিল কা নজরানা দেনে….
নাকি গাওয়া উচিত,
উঠালে জাউনগা
তুঝে ম্যায় ডোলি ম্যেইন
দেখতি রেহজায়েগি সাখিয়া তুমহারি
তুমকো মুঝসে পেয়ার হ্যায়
পেয়ার হ্যায় পেয়ার……
সুর তুলে গেয়ে সৈকত বলল, “কোনটা গাওয়া উচিত আমার?”
লজ্জায় গা ঝাড়া দিতে এক ছুটে পালাল মুন। সবাই হেসে উঠল। নাহিদ বলল, “দুলহান সারমা গায়ি।”
হাসির রোলে রুবাব সৈকতকে বলল, ” সৈকত কবে আসতেছস?”
“দেখি।”
রুবাব হেসে বলল,
” তাত্তারি আয়, তোর বিয়ার জন্য আমি বউ ঘরে তুলতে পারতেছিনা। বুক খা খা করতেছে বউয়ের জন্য। ”
সৈকত মুখ কুঁচকে বলল, ” ছোটো বোনের জামাইর সামনে কী বলতেছিস এসব! একটু তো সরম কর শা লা ।”
রুবাব ও চোখ রাঙাল,
” শা লা বাবু লাগাইতে আইলে আগে সম্মান দে। সম্পর্কে বড় সমন্ধি তোর। ভাইয়া ডাকবি।”
” ভালো আছেন, রুবাব ভাইয়া?” ব্যাঙ্গ করে বলল সৈকত। এরপর হো হো করে হেসে দিল। পরপরই অন্তরের দিকে চেয়ে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম, আমার দুইমাত্র শ্যালক অন্তর ভাইয়া। ভালো আছেন? আপনারে ও কি পা ধরে সালাম করতে হবে? আসেন সালাম করি।”
আবার হেসে ফেলল সৈকত। অন্তর চোখমুখ কুঁচকে বলল,
“দোয়াই লাগে এমন আপনি টাপনি করিস না! গালির মতো ভয়ংকর লাগছে। ”
ব্যাপারটা এত হাস্যরসে ভরপুর হলো যে সবার মাঝে হাসির রোল পড়ল। কিছুক্ষণ হাসি চলতেই থাকল। হাসি থামিয়ে রুবাব রেজাল্ট জানতে চাইল। নাহিদের পর অন্তরের রেজাল্ট শুনে মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল। তৎক্ষনাৎ বলল,
“আমি আইতেছি, আজ তোদের সাথে থাকব।”
________________
শেখবাড়ির হলরুমে আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আছেন মনির শেখ। সামনে বিশালাকৃতির টিভিতে দৃষ্টি তার। সেখানে চলছে বিসিএস আলাপন নামে একটা শো। এখানে প্রথম ছ’জন এসেছে। সব বিভাগের প্রথম দুজন। সেই শো এর আজকের এপিসোড বেশ জমেছে। মনির শেখ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। চোখ ভরা তার গর্ব। সুদর্শন অতিথির চমৎকার বচনে বিমোহিত তিনি। ঠোঁটের কোণে প্রসন্ন হাসি। টিভিতে চোখ ফেলে ডাকলেন মেয়েকে,
“মুন? এদিকে আয়। ”
বার কয়েক ডাকে উপর থেকে নিচে নামল মুন।
“জ্বি, বাবা!”
“আয় বোস।”
মুন ভ্রু কুঁচকে ঘটনা পরখ করবার চেষ্টা করল। তখনই চোখ গেল টিভিতে। এ্যাশ টি-শার্ট পরিধেয় সুদর্শন পুরুষ স্ক্রিন দখল করে আছে। এক পল দেখেই বিস্ময়ে ভ্রু উঁচাল। জনাব তবে এখানে! ফলাফলের পরদিন শেখবাড়ি আসার কথা থাকলে ও আজ দিন তিনেক বাদে ও তার দেখা নেই। তিনি মহা ব্যস্ত। বিভিন্ন চ্যানেল, মহল থেকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকছেন, রাত দিন এক করে তিনি সাক্ষাৎ দিয়েই বেড়াচ্ছেন। এদিকে তার সাথে সাক্ষাৎ দেয়ার বালাই নেই। টিভি, ফেসবুক দখল করে আছেন। রীতিমতো সেলিব্রিটি হয়ে গেছেন। বিসিএসে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছেন কি না!
টিভির দিকে তাকিয়েই বসল মুন। ও বসতেই মনির শেখ গদগদ হয়ে বললেন,
” সৈকত ছেলেটার মাঝে অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে। বুদ্ধি, মেধা, আত্মবিশ্বাস, আচরণ সবটা মুগ্ধ করার মতো। নিজ যোগ্যতা বলেই এতটুকু এসে পড়েছে। এমন ছেলে মেলা ভার। আই এম ইমপ্রেসড।”
উপস্থাপক বিসিএস জার্নির ব্যাপারে প্রশ্ন করছেন। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে দৃঢ় স্বরে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে সৈকত। ভাবভঙিতে চমৎকার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। ধূসর শার্টটায় কী সৌম্য দেখাচ্ছে মানুষটাকে! মুন মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। আনমনে বিড়বিড় করল, ” আমিও।”
উপস্থাপক প্রশ্ন করলেন, “পরবর্তী পরিকল্পনা কী?”
সৈকত উত্তর দিল, ” আমার ভীষণ পছন্দের বিষয় অর্থনীতি। সেদিকেই যাব। অডিট এন্ড একাউন্ট ক্যাডার বেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ নিরিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হবার মনস্থির করেছি। ”
মনির শেখ উৎফুল্ল হয়ে বলল, “ব্রিলিয়ান্ট! আই প্রাউড অফ ইউ।”
মনির শেখ কথা শুনছেন। মুনের কানে কোন কথা ডুকছে না। সে তো তার মানুষটাকে দেখতেই ব্যস্ত। এই সুন্দর মানুষটা ওর, ভেবেই আনন্দ লাগছে। মুনের বিভোরতার মাঝে বাবার হৈহৈ কানে এলো। ধ্যান ফিরল। বাবার উৎফুল্লতা দেখে অবাক-খুশি দুটোই হলো। মনির শেখ টিভির দিকে ইশারা করে বললেন,
“এই চমৎকার ছেলেটাকে বাবা তোর জন্য পছন্দ করেছি। তোর কি কোন আপত্তি আছে?”
মুন থমকাল। মনে মনে খুব হাসল। বাবা পছন্দ করেছেন! সাত নাচ তো ওরা নেচেছে। হাস্যকথা চেপে মুখে লাজ টানল। নত মুখে মাথা নাড়াল। মনির শেখ বললেন,
” আজ সন্ধ্যেবেলা সৈকত পরিবার নিয়ে তোকে দেখতে আসবে। চেনা জানার মধ্যে হওয়ার ঘটা করে আয়োজন নেই। এমনিই ওরা পরিবার আসবে। সৈকতের মা ফোন দিয়ে জানিয়েছেন আজই পাকা কথা সারতে চান। তোর কী মত?”
‘আজ আসবে!’ মনটা উড়ুউড়ু করল মুনের। কী ভীষণ খুশি লাগছে। মুন সেই খুশি প্রকাশ করতে পারল না। লাজুক স্বরে বলল,
“তোমরা যা ভালো বুঝো। আমার কোন আপত্তি নেই।”
রুবাব থাকলে এখন ফের বলতো, “ওভার এক্টিং কম কর। ধরা খেয়ে যাবি।’ ভাগ্যিস নেই। মুন মুখ চেপে হাসল। সাক্ষাৎকার চলল আরও কিছুক্ষণ। সৈকতক্র জিজ্ঞেস করা হলো, এই সফলতার পেছনে কার অনুপ্রেরণা আছে ।
সৈকত, ক্রেডিট দিল বাবা মাকে আর বন্ধুদের।
এরপর উপস্থাপক হেসে প্রশ্ন করলেন, ” কোন জিনিস আপনাকে তাড়া দিয়েছে যে, বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে?”
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হেসে ফেলল সৈকত। সময় নিয়ে বলল, ” আ নিউ লাইফ।”
মনির শেখ ভ্রু কুঁচকালেন। উত্তরটা বুঝলেন না তিনি। সন্দিহান চোখে তাকালেন। পরের প্রশ্নটাও এ সম্পর্কিতই ছিল।
” প্রেম আর ক্যারিয়ার দুটো বিষয়কে একসাথে সামলানোর ব্যাপারটা কিভাবে দেখেন? অনেক ছেলেমেয়ে ভাবে অনুভূতিকে প্রাধান্য দিলে সফল হওয়া যাবেনা। এ সম্পর্কে আপনার কী মতামত? ”
সৈকত একটু হাসল। শান্ত স্বরে বলল,
” প্রেম এবং ক্যারিয়ার দুটোই জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুটোতেই সফলতা মেলে, কোনটা জীবনে, কোনটা মনে। জীবন আর মন দুটো একই সূত্রে গাঁথা। অনুভূতি মনে প্রফুল্লতা আনে, আর প্রফুল্ল মনেই জীবনের নতুন উদ্যমের সাহস জাগে। মনে থাকা মানু্ষই, জীবনের পথসঙ্গী হয়, সফলতার তাড়া দেয়। পড়তে পড়তে, কিংবা চলতে চলতে হতাশ হয়ে গেলে একটা হাসি, একটু কথাই আনন্দ দেয়। আগলে রাখতে জানলে জীবন এবং মন দুটোই সমানতালে চলে। ”
মনির শেখের সন্দেহ গাঢ় হলো। প্রেম না করলে এতসব কিসব কীভাবে জানে? প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন তিনি। মুন প্রশান্ত মনে বসে আছে। সৈকতকি সব ওকেই বলল? মুন কি সৈকতের জীবনে প্রশান্তি হতে পেরেছে?
কত ধ্যান তার? বাবার খেয়ালটি নেই।
দুষ্টু উপস্থাপক ফের ব্যক্তিগত জীবনে প্রশ্ন করলেন, ” জীবন এবং মনের চমৎকার ব্যাখ্যা কি আপনার জীবনের? সংজ্ঞায় কি আপনার সঙ্গী? ”
সৈকত নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিশ্চুপ রইল। উত্তর দিল না। কেবল খানিক বাদে ক্যামরার দিকে চেয়ে চমৎকার একটা হাসি উপহার দিল। সম্মতির ঝলমলে হাসি। সেই হাসিতেই বলল,
“আমার জীবন, মন, সফলতা, সংজ্ঞা, সাহস সবখানেই আছে সঙ্গী। ”
মনির শেখ চোখ বড়সড় করে চাইলেন। সঙ্গী তো মুন হতে যাচ্ছে। এর মানে….. ত্বরিত ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলেন মেয়ের দিকে। মুনের শ্বাস আটকে এলো। লজ্জায় অসাড় হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর এক ছুটে পালাল। যেতে যেতে বলল,
“স্যরি বাবা!”
মনির শেখ হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। নিজের পছন্দের পাত্রের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে মেয়ের মত চেয়ে নিলেন। কথা পাকা হবার আগে জানতে পারলেন, পছন্দ পাত্রকে তিনি নয়, মেয়ে করেছেন। কী অবাক কান্ড! ওকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছিল এরা! রোষাগ্নি চোখে চাইলে টিভির দিকে। যার অর্থ, আজ আসো, হচ্ছে তোমার।
চলবে…….
#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব- ৩৯)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
“বাবা কিন্তু আমাদের কথা জেনে গিয়েছে।”
সন্ধ্যেবেলা পাত্রপক্ষ আসতেই পাত্রের কানে কানে গিয়ে বলল মুন। খানিকের জন্য থমকে গেল পাত্র। পাশে বাবা, মা, ভাই। সবার সামনে পাত্রীর এহেন কানাকানিতে একটু অস্বস্তি ও হলো বোধহয়।
ভাইকে ইশারা করল। ভাই সবাইকে নিয়ে এগিয়ে গেল। সামনেই পাত্রীর ভাই অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছে। ভাই এসে ভেতরে নিয়ে গেল তাদের। কেউ নেই তবুও পাত্র ফিসফিস করে বলল,
“কী জেনে গিয়েছে, চন্দ্রকথা?”
মেয়েটার নিচু স্বরে বলল, “বাবা তোমার সাক্ষাৎকার দেখে বুঝে ফেলেছে, আমরা রিলেশনে আছি। এটা এরেঞ্জ নয় লাভ ম্যারেজ। এখন কী হবে? আমার তো ভয় হচ্ছে, সৈকত। বাবা যদি বিয়ে ভেঙে দেয়!”
সৈকতকে কিঞ্চিৎ ও বিস্মিত হতে দেখা গেল না। যেন জানতো সবটা। সৈকত সন্ধ্যেবেলা শেষ আলোয় দেখছিল প্রিয়তমাকে। আজ অর্কিড কালার শাড়ি পরেছে। মুখে এলোমেলো প্রসাধনী। ঠোঁটে টিন্ট। এক চোখে আইলাইনার দেয়া, অন্যচোখে নেই। দুই পায়ে দু’রকমের জুতো। বোধহয় ওর আসার খবর শুনে লুকিয়ে চলে এসেছে। চোখমুখে সে কী ভয় ওর! মেয়েটা এত ভীতু কেন? সবকিছুতে ভয় পায় । এই যে কদিন বাদে দেখা হলো ওদের। সৈকতের জীবনে অনেক সাফল্য এসেছে। কোথায় শুভকামনা দিবে, মনে পড়ার গল্প বলবে।। তা না, ভয় পাচ্ছে। ভয়ে সুন্দর মুখটাকে এটুকুনি করে ফেলেছে। তাতেও মায়াবী লাগছে সৈকতের কাছে।
সৈকত ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। মুন রেগে বলল,
“তুমি হাসছ কেন?”
সৈকত ঠোঁট চেপে হেসে বলল, “এক চোখের আইলানাতে তোমাকে সুন্দর লাগছে।”
মুন অবাক হয়ে চাইল, “তোমার কি বিন্দুমাত্র চিন্তা হচ্ছেনা? বাবা জানতো এটা এরেঞ্জ ম্যারেজ। আমরা প্রেম করছি জানলে না করে দিতো। এইজন্যই ভাইয়া হাইড করেছিল। এখন তুমি সব এলোমেলো করে দিলে। এখন কী হবে?”
মুন ভয়ে ঘনঘন পলক ফেলছিল। ইতিউতি করে দেখছিল এদিক ওদিক। আঁধার নেমে গেছে চারপাশে। গেইটে বাতি জ্বলছে। ওরা তখনো গেইটের বাইরে আঁধারে। সেই আঁধারে সৈকত ঘটাল এক ঘটনা। তড়িৎ টেনে গাঢ় অধর পরশ দিল। ত্বরিত ছেড়ে আলতো সুরে বলল,
” আমি আছি তো, চন্দ্রকথা।”
ভরসার জোয়ার বয়ে গেল। সেই তালে বয়ে গেল মুন। আকস্মিক শান্ত হয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে অনুভব করল, ওর ভয় অবশিষ্ট নেই আর। সে রক্তিম গালে, মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সৈকত হাত বাড়িয়ে বলল,
“আসো একসাথে যাই।”
মুন চমকে চাইল। কী করতে চাইছে সৈকত? বাবার সামনে হাত ধরে হাজির হবে? ওর মনোভাব বুঝে সৈকত হাসল,
” বিয়ের খুশিতে বাড়ি মাথায় তুলতে পারো, অথচ হাত ধরতে এত ভয়! তোমার সাজান এসেছে, নিয়ে যেতে। ধরো হাত, আর সঙ্গে চলো।”
সৈকতের হাতটা তখনো বাড়িয়ে রাখা। মুন প্রশ্নবিদ্ধ মনেই হাতে হাত রাখল। সৈকত শক্ত করে হাত ধরে পা বাড়াল সামনে। মুন বলল,
“তুমি করতে চাইছোটা কী!”
” প্রেম আমার জীবনের সবচেয়ে সবচেয়ে সুন্দরতম সত্য। আর তুমি আমার জীবনে সুন্দর সুখের অধ্যায়। এই অধ্যায়কে আমি অস্বীকার করতে চাইনা।”
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল সৈকত। ওর চোয়ালে বিন্দুমাত্র ভয় নেই। গাঢ় আআত্মবিশ্বাস আছে কেবল। ঠোঁটের কোণে বিজয়ী হাসি। এই দৃঢ় মুনের হৃদয় ছোঁয়। ওকে নিয়ে মানুষটা একবারে দিলখোলা। প্রশান্তিতে হাসল মুন। পরপরই বলল,
“তুমি ইচ্ছে করে জানিয়েছো? এতদিন জানালে না। আজই কেন?”
সৈকত হাসল। সেই হাসিই যেন উত্তর দিল। লুকোচুরি পছন্দ না আমার। এতদিন শুধু যোগ্য প্রমাণ করবার জন্য আড়ালে ছিলাম। সৈকত উত্তর দিল,
“কিছু সত্য যোগ্য হবার পরেই বলা যায়।”
মুন বেশ বুঝল সৈকত আটঘাট বেঁধে এসেছে। মুন বলল,
” আমি কি কিছু করব?”
সৈকত ওর দিকে চেয়ে বলল, “আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনি শুধু আপনার সাজনার জন্য সাজা সাজটা সম্পূর্ণ করে আসুন। আপনার মনোহর রূপ দেখেই আমি বারবার ধন্য হবো।”
মুন নিজের দিকে চেয়ে বলল, “আমাকে কি দেখতে খারাপ লাগছে?”
” চাঁদকে কখনো খারাপ লাগতে পারে না।”
মুন লাজুক স্বরে বলল, “তুমি আজকাল বেশিই করছো না?”
সৈকত দুষ্টু হাসল, ” বেশির অধ্যায় তো এখনো খুলিই নি। কম বেশি তো সব পড়েই আছে। তাড়াতাড়ি বউ হয়ে যাও তো!”
গভীর চোখে চাইল সৈকত। বুকে কাঁপন ধরল মুনের। সে হাত ছুটিয়ে পালাতে চাইল। সৈকত হেসে বলল,
” বউ তো দেখি লজ্জা পাচ্ছে।”
“আমি আর তোমার সামনে আসবই না।”
“আমি তোমাকে দেখতেই এসেছি। ”
“দেখেই তো নিয়েছো।”
মুন পা বাড়াল। সৈকত ডাকল,
“শুনো?”
মুন দাঁড়াল। সৈকত কোমল সুরে বলল,
” মায়ের দেয়া বালা পরে দেখা দিও। মা এবং মায়ের ছেলে দুজনেই খুশি হবে।”
__________________
অত্যন্ত ভীত মুখে মাথা নিছু করে বসে আছে মুন আর রুবাব। সামনেই বসা মনির শেখ, অতিব গম্ভীরমুখে। গোঁপন কথা ফাঁস হবার পর ছেলেমেয়ের উপর ফুঁসে আছেন। মুনকে সেইক্ষণের পর আর দেখেননি। মেয়ে ঘরে দরজা আটকেছে। ছেলেটাও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মনির শেখ ভাগে না পেয়ে সৈকত আসার পর তিনজনকে একসাথে নিজের ঘরে ডেকেছেন। বাবা ভীতি থাকা রুবাব -মুনের অবস্থা নাজেহাল। মুন মনে মনে দোয়া পড়ছে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রুবাবের চিন্তা দিগুণ হলো। বিয়ে টিয়ে ভেঙে দিবে নাকি! ওদের চিন্তার ক্ষণেও একবারে প্রসন্ন সৈকত। ভয় ডর নেই। শান্ত, স্বাভাবিক হয়ে বসে আছে। ওর এহেন মুখভঙ্গি দেখে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন মনির শেখ। গম্ভীরমুখে বললেন,
“তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি, সৈকত।”
সৈকত কপাল চুলকাল। আড়চোখে একবার তাকাল মুনের দিকে। সম্পর্ক করার জন্য কি এবার শ্বশুরকে জবাবদিহি করতে হবে? ওর জন্য প্রেম নিষিদ্ধ না কি! সৈকত হালকা কেশে ধীর স্বরে বলল,
” কিছু ব্যাপারে আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, আংকেল। আমার পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সব আমার বিবেক নিয়ন্ত্রণ করলেও আবেগটাকেই কেবল বশ করতে পারেনি। ”
থামল সৈকত। মনির শেখ তীক্ষ্ম চোখে চাইলেন। সেই চাহনিতে ভয় পেল না সৈকত, একটু যেন কষ্ট পেল। একটা বাবার রাগ দেখল সে। দিনের পর দিন তার বাসায় এসেছিল, ছেলের বন্ধু ভেবে আসে বলে অনেক আপ্যায়ন করেছেন। এই ছেলের কথাতেই মেয়ের বিয়ে ঠেকিয়েছেন। আর সেই ছেলেই…. চাপা শ্বাস ফেলল সৈকত। দৃঢ় স্বরে বলল,
” লুকোচুরি ব্যাপারটা আমার পছন্দ নয়। আমি প্রেম নয়, বিয়েটাকেই বেছে নিয়েছিলাম। ইভেন, সম্পর্কে যাওয়ার আগে আমি রুবাবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য রুবাব থেকে সময় নিয়েছি। ব্যাপারটা হাইড করে বিয়ে করতে আমার মন সায় দেয়নি বলে আপনাকে জানিয়ে দিলাম। ”
এরপর সৈকতের স্বর নরম হলো, ” আপনার মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর জন্য আমি দুঃখিত নই। মুন আমার লাইফের সুন্দরতম অধ্যায়। দুঃখিত হতে গেলে ওকে এবং সেই অধ্যায়কে অস্বীকার করা হবে। আমি সম্পর্কের যাবার জন্য স্যরি নই, তবে দেরি করে জানানোর জন্য স্যরি।”
শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে শ্বশুরের সামনে কনফেস করে দিল সৈকত। মুন বাবার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে। রুবাব বন্ধুর মনোভাব বুঝে নড়ে-চড়ে বসেছে। মনির শেখ আক্কেলগুড়ুম। বিস্ময়ে হতভম্ব। তিনি ভেবেছেন, ছেলেটা ভয়টয় পাবে। অথচ এই ছেলের কাছে ভয়ের ছিঁটেফোঁটা ও নেই। কী নির্দ্বিধায় ভালোবাসার বুলি ফোটাচ্ছে। তার সামনে বসে বলছে, মুন ওর জীবনের সুন্দরতম অধ্যায়। স্যরি বললে অস্বীকার করা হবে। কী আত্মবিশ্বাস! মনির শেখ থমকে গেলেন। ছেলের দিকে রাগান্বিত চোখে চাইলেন,
“তুই জানতি? আমাকে না বলে সময় দিলি কী ভেবে?”
রুবাব ভয়ে ভয়ে তাকাল বাবার দিকে। সৈকত বন্ধুকেও বাঁচিয়ে দিল,
“আংকেল, আপনি ভুল বুঝছেন। রুবাব আমাকে আশ্বাস নয়, শর্ত দিয়েছিল। বিসিএস হলে আমাকে ভগ্নিপতি হিসেবে মেনে নেয়ার কথা ভেবে দেখবে। নয়তো না।”
মনির শেখ সৈকতের দিকে চাইলেন ফের। গোয়েন্দা চোখে চেয়ে জেরা করলেন,
“বিসিএস না হলে…?”
উত্তর দিতে গিয়ে সৈকত একটু হাসল। বাঁকাভাব নিয়ে বলল, ” আমার যতটুকু ধারণা, ছেলে হিসেবে আমাকে আপনার অপছন্দ নয়। চার পাঁচ দিন আগ অবধিও একটা স্নেহ কাজ করেছে আমার প্রতি। তখন প্রস্তাব দিলেও আপনি বোধহয় নিষেধ করতেন না।”
এ তো দেখি ধুরন্ধর ছেলে! তার মতিগতি ধরে ফেলেছে। মনির শেখ হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছেন সৈকতের কথা শুনে। তাও তিনি দমলেন না। তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে তার মেয়ের সাথে প্রেম করে বেড়িয়েছে। এত সহজে ছাড়বেন না তিনি। গম্ভীরমুখে বলল,
“তুমি এবং তোমার স্যরি যদি আমি গ্রহণ না করি?”
“সেই অপশন কি আদৌ আপনার কাছে আছে, আংকেল? ” ফের প্রশ্ন ছুঁড়ল সৈকত। মনির শেখ রুষ্ট হয়ে বললেন,
” মুনের বাবা আমি। অপশন কেন থাকবে না, অবশ্যই আছে। ”
সৈকত প্রসন্ন হেসে বলল, ” গ্রহণ না করার অপশন আপনাদের কারো কাছেই নেই। না আপনার কাছে, না মুনের, আর রুবাবের। অপশন নয় দায় আছে।”
“কিসের দায়?” ভ্রু কুঁচকালেন মনির শেখ। সৈকত বলল,
” আপনি আমাকে জামাতা হিসেবে সিলেক্ট করে, আমার বাবার সাথে কথা বলে দাওয়াত দিয়ে ডেকে এনেছেন। আজ পাত্র পাত্রী দেখা নয়, আংটিবদলের কথা। এটা বাছাইপর্বের পরের ধাপ। এ ধাপে এসে হুট করে বিয়ে ভেঙে দেয়া যায়না।দুই পরিবারের সবার অসম্মান। বিশেষ করে আমার পরিবারের। আজকের আয়োজক যেহেতু আপনি, যেহেতু আমার পরিবারের সম্মান রক্ষা আপনার দায়িত্ব। ”
“আমার মেয়ের ব্যাপারে আমি দায়িত্ব সব ভুলতে পারি। ” প্রচন্ড গুরুগম্ভীর মুখে বললেন মনির শেখ। ছেলেটার স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছেন তিনি। সৈকত সে রাগের বালাই না করে বলল,
” আমাদের এলাকায়, মেয়ে পছন্দ হলে ছেলের মা মেয়ের হাতে বালা পরিয়ে দেন। এই বালা পরানোর মানে মেয়েটা ছেলেটার জন্য রিজার্ভ। আমার মা রুবাবের উপস্থিতিতে বালা পরিয়ে দিয়েছেন মুনকে। এতে শেখ বাড়ির ছেলেমেয়ে কেউই আপত্তি করেনি। বালা গ্রহন করে আমার হয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষার দায় মুনের। ”
মনির শেখ তড়িৎ চাইলেন মেয়ের মুখের দিকে। মুন ও মাথা উঠাল বিস্ময়ে। হাত উঁচু করে চুড়ির দিকে চাইল। এখন বুঝতে পেরেছে সবার সামনে বালা পরানো আর আজ ওকে বালা পরতে বলার কারণ। এত বুদ্ধি ওর! ওকে ও জড়িয়ে নিল!
মনির শেখের ও চোখ পড়ল মেয়ের হাতে। এক জোড়া সোনার বালায় দৃষ্টি আটকাল। এ বালা তারিনার নয়। তবে… পরপরই আবার চাইলেন মেয়ের দিকে। মুন ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করে মাথা নিচু করল।
মনির শেখে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এ ছেলে তো দেখি ভারি সাংঘাতিক! দাবার গুটির মতো সব গুছিয়ে নেমেছে। ছেলে মেয়ে সবাইকে দলে টেনেছেন। শুধু ক্যারিয়ারের দিকে নয়, পার্সোনাল দিকেও একই। স্ট্রং, আত্মবিশ্বাস আর দীপ্ত। কী বলবেন একে! মাকে জানিয়ে বালাও পরিয়ে দিয়েছে। তার ছেলেটাও সাক্ষী দিয়েছে। আর মেয়েটাও চুড়ি পরে বসে আছে। নিজের ছেলেমেয়ে যখন অন্যের গান গায় তখন তারই বা কী বলার থাকে? মনির শেখ কথার খেই হারালেন যেন। সৈকত বলল,
“এই বালা আমার দাদী, আমার মাকে দেখে পরিয়ে বিয়ের পাকা কথা বলেছেন। আমার মা মুনকে দেখে পরিয়ে দিয়ে একপক্ষীয় বন্ধন কিন্তু সেদিনই জুড়ে দিয়েছেন।”
মনির শেখ দ্বিরুক্তি করতে গেলেন। তখন তার ফোন বেজে উঠল। সাদাতের ফোন। কথা বলে নিয়ে বললেন,
“সাদাতের গাড়ি আটকে গেছে গলিতে। গিয়ে নিয়ে আয়। ”
শা লা আসতেছে! বুক কেঁপে উঠল রুবাবের। বাবা নিশ্চয়ই দাওয়াত দিয়েছেন। রুবাব তার থেকে পালিয়ে বাঁচে। কেন ডাকতে গেল, বাবা! রুবাব বাবাকে একদিকে টেনে নিয়ে গেল। অনুরোধের সুরে বলল,
“বাবা তুমি প্লিজ কথা বাড়িয়ো না! সৈকতকে মেনে নাও। ”
মনির শেখ ছেলের উপর চড়াও হলেন, ” তোর স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি আমি।”
“সৈকতের চেয়ে ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না। ও মুনকে ভালো রাখবে।”
“সে আমি বুঝব। তুই অনেক বাড়াবাড়ি করেছিস, এবার আমি যা চাইব তাই হবে।” কড়া স্বরে বললেন মনির শেখ। রুবাব হুট করেই বাবার হাত ধরে ফেলল। আকুতি করল,
” বাবা প্লিজ! আমার জন্য! আমার লাইফটা শেষ হয়ে যাবে।”
মনির শেখ থমকালেন, ” এতে তোর লাইফ শ্যাষ হবে কেন?”
রুবাব চুপ রইল। মনির শেখ খেয়াল করলেন ছেলেকে অস্থির লাগছে। অন্যরকম কেমন যেন। তিনি উদ্ধিগ্ন হলেন, ” কী হয়েছে রুবাব? তুই এমন করছিস কেন?”
রুবাব দাঁতে দাঁত চেপে রইল। বলতে পারল না, আমার শা লা সেঁজুতির জন্য সৈকতকে পছন্দ করে বেছে বসে আছেন। মুনের বিয়ে ভাঙলে তিনি সৈকতের দিকে আবার টার্ণ করবেন। যা ভয় ং কর মানুষ, কোনভাবে বাধ্য টাধ্য করে ফেলেন বলা দায়।
রুবাব বলতে পারল না বাবাকে। ঘরের বাইরের পায়চারি করছিল নাহিদ অন্তর। মনির শেখ নাহিদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। ঘটনা গম্ভীর করতে সেও বলে দিল, ” ছেলে আমাদের লাখে এক। সব মেয়ের পরিবারের পছন্দ হয়ে যায়। এমন করে সাদাত ভাইয়ের ও পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। প্রস্তাব টস্তাব ও দিয়েছিলেন সৈকতকে। সাদাত ভাইয়ের ফার্স্ট চয়েজ রুবাব নয়, সৈকত। সৈকতের ফার্স্ট চয়েজ অলওয়েজ মুন ছিল বলেই রিজেক্ট করতে এক সেকেন্ড দেরি করেনি। ”
ঘটনা বুঝিয়ে বলল নাহিদ। সেই সাথে রুবাবের ভয় উল্লেখ করল। মনির শেখ থ। কী অদ্ভুত কথা! জামাতার জন্য পুত্রবধূর প্রস্তাব যায়! বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলেন না।
বিস্ময় নিয়েই গিয়ে বসলেন ফের। সৈকত তখনো অপেক্ষায় বসা। অনেক কথা বাকি। শ্বশুরের বিক্ষিপ্ত মুখ দেখে চাপা হাসল। মুনকে বলল,
“তুমি যাও, আমি কিছুক্ষণ পর আসছি।”
মুন চলে গেল। ঘরে কেবল মনির শেখ আর সৈকত। তিনি ভাবুক হয়ে বসে আছেন। সৈকত ধীর পায়ে তার পাশে বসল। চাপা মুখটা দেখল এক পল। ওর স্বর নরম হলো,
“আংকেল, মুন আপনার মেয়ে। ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখেন আপনি। আমি আপনার সব সিদ্ধান্ত সম্মানের চোখে দেখি। আপনার বিরুদ্ধে গিয়ে মুনকে বিয়ের করার পক্ষে আমি নই। বিয়ে আপনার সম্মতিতেই হবে। মুনের অভিভাবক হিসেবে আপনার অনুমতি ছাড়া বিয়ে হবে না আংকেল।”
মনির শেখ অবাক হতেও ভুলে গেছেন। এতক্ষণ কথার জালে আটকে হুম কি দিয়ে এখন সুর নরম করছে! মনির শেখ অন্যদিকে মুখ ঘুরালেন। সৈকতের স্বর দৃঢ় হলো,
“আমি মুনকে ছাড়তে পারব না। বিয়ে ওকেই করব। কিন্তু আপনাদের সবার সম্মতিতে। আমার মা আসার সময় রিং নিয়ে এসেছেন। এই রিং আমি তখনই মুনকে পরাব যখন আপনি অনুমতি দিবেন। আংকেল, আমি আপনার কাছে আপনার মেয়ের হাত চাইছি। আপনি কি অনুমতি দিবেন? ”
ফের স্বর নরম হলো। অনুরোধ ঝরে গেল। সৈকত প্রপোজ করল শ্বশুরকে, মেয়ের জন্য। এভাবে কেউ মেয়ে চায়? মনির শেখ স্থির চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর অন্যদিকে চেয়ে গম্ভীরমুখে বললেন,
” আমি কিছুক্ষণ একা থাকব। ”
এর মানে, তুমি চলে যাও। সৈকত চাপা শ্বাস ফেলে চলে গেল। প্রথমে মেয়ে তারপর ভাই, এখন বাবা এদের মানাতে মানাতেই অর্ধেক জীবনে কে টে যাবে বোধহয় ।
_________________
হলরুমে আসর বসেছে। মনির শেখ ছাড়া দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত। সাদাত ও এসে পৌঁছেছে ইতিমধ্যে। সবাই জড়ো হয়েছে হলরুমে। বাগদান হবে, তারপরেই খাবারের পালা। খাওয়ার পর আবার সৈকতরা ফিরে যাবে। একটু তাড়া আছে বৈকি। সুরমা মুনকে পাশে নিয়ে বসেছেন। সৈকতকে বারকয়েক ডেকেও পাশে বসানো যায়নি। সে বন্ধুদের সাথে ডিভানের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। চাপা গুঞ্জন চলছে ওদের মাঝে। রুবাব রাগ ঝাড়ছে সৈকতের উপর,
” আমি সব গুছাইয়া আগাইতেছিলাম। হিরো সাইজা ঢং মাইরা সব শ্যাষ করছস। এখন বাবা বিয়া শাদী ভা ইঙ্গা দিলে কী হইব? ক্যান যে তুই ইন্টারভিউতে ওগুলো কইতে গেলি! মনটা চাইতেছে উষ্ঠা মাইরা গুষ্টি ভুলাইয়্যা দিই। মুনের কথা ভাইব্বাই পারতেছিনা। ”
সৈকত মাথায় হাত বুলিয়ে ভাব নিয়ে বলল, ” আমার দিক থেকে আমি পুরোপুরি ক্লিয়ার। আমি, আমার ক্যারিয়ার, লাইফ, ওয়াইফ সব ঠিকঠাক। তোর শর্ত ও পূরণ হয়েছে। বিয়া আর বাবা হওয়া ছাড়া আর সব করে ফেলেছি আমি। এবার বাকি দায় তোর।”
“আমার দায় হইলে আমারেই বুঝতে দিতি। এখন আমি বাবারে ক্যামনে মানাব? ” ক্ষেপে গেল রুবাব। সৈকত ওর পিঠে হাত রেখে বলল,
“চিল! তোর মানানো লাগবে না। আংকেল অলরেডি মেনে নিয়েছেন। জাস্ট একটু ভাব নিচ্ছেন।”
“ভাব!” অবাক হলো রুবাব। সৈকত হাসল,
” মেয়ের বাবা না? কোলে পিঠে করে মানুষ করা একটা মেয়ে দিয়ে দিচ্ছেন আমার কাছে, ভাব তো থাকবেই। ”
প্রশ্রয়ের হাসি সৈকতের। রুবাব চাপা শ্বাস ফেলল। সৈকত এখনো ওর বাবাকে চিনেনি, এটা ভাব না রাগ। যা শেষ হবার নয়। ঘরে দরজা দিয়ে বসে আছেন মানে মেনে নিবেননা। অন্তর বলল,
” এদিকে সাদাত ভাই গপাগপ মিষ্টি গিলছে। এটা তিননাম্বারটা চলছে। রুবাব তোর শা লার ভাবসাব ভালো ঠেকছেনা। সবাই চিন্তায় মরছে। রুবাব তোর শা লার ভাবসাব ভালো ঠেকছেনা। ”
প্রেমের পর থেকে কম জ্বালায়নি সাদাত। নাকে দড়ি বেঁধে নাঁচিয়েছে। এতে একটু ক্ষোভ আছে রুবাবের। তার উপর বন্ধুর জন্য প্রেমিকার প্রস্তাব পাঠিয়েছে জানার পর থেকে সেই রাগ বেড়ে দিগুণ। শালাকে সহ্য হচ্ছে না রুবাবের। দেখলেই রাগ লাগছে। একে তো রেগে আছে, তারউপর সাদাতের মিষ্টি খাওয়া দেখে রুবাব আরও রেগে গেল। ফোঁসফোঁস করে বলল,
“এই শা লা জীবনটা ত্যানা ত্যানা কইরা ফেলছে আমার। শা লারে প্যাকেট কইরা বিয়ার আগে চান্দে পাঠানোর ব্যবস্থা করতো। বিরক্ত লাগতেছে। ”
অন্তর বলল, ” চান্দে তো মুন থাকে। আবিত্তা বেডারে পাঠানো ঠিক হবে না। মঙ্গলে পাঠাতে হবে। চিন্তা করিস না, আমি আজই নাসার সাথে কথা বলব। কদিনের প্যাকেজ নিবি? বিয়ার পরে ব্যাক করাবি নাকি ওখানেই থানা ট্রান্সপার করবি ? ” গম্ভীর দেখাল অন্তরকে। যেন সত্যি সত্যি ব্যবস্থা করবে।
এহেন সময় ওর হেয়ালি দেখে রুবাব ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল, ” আজাইরা কথা বলবি, লা থি মে রে তোরে ও পাঠামু। একলগে বইয়্যা মিষ্টি খাইস। ”
অন্তর নাহিদের দিকে চাইল। ওর চোখের ভাষা বুঝে নাহিদ চোখ গরম করল, “বোনের কথা টানবি, এক লাথি আমি ও মারব। ”
অন্তর তাও দমল না। বরং অবাক হয়ে ওদের পায়ের দিকে তাকাল। পরখ করে বলল, “তোগো ঠ্যাংগের এত জোর! রকেটের কাজ করে! দেখলে বুঝা যায় না। এগুলো ঠ্যাং নয়, দেশের সম্পদ। লগে রাখছস ক্যান? খুইলা দে। আমি মিউজিয়ামে রাইখ্যা আসি।”
এই ছেলের হেয়ালি যাবে না। রুবাব সৈকতের দিকে চেয়ে নালিশ করল, “সৈকত, এরে চুপ করতে ক। ”
সৈকত ঠোঁট চেপে হাসছে। হাসি থামিয়ে দাঁত চেপে ধীরে বলল, ” অন্তর আজকের জন্য প্ল্যান স্থগিত রাখ। এনগেজমেন্টটা হয়ে যাওয়ার পর জাদুর ঠ্যাংগের বিহিত করিস। ”
রুবাব এবার সৈকতের দিকে তাকাল রেগে। সৈকত হেসে বলল, ” শা লা বাবু একটু শান্ত হন, বুকের দহন থামান। আপনার জলজ্যান্ত চাঁদ আছে। সাত কলা পাঁকিয়েও আমার মন সরাতে পারবেনা। মঙ্গলের প্ল্যান ক্যান্সেল করেন। বেচারা মানুষ ভালো। ”
সৈকতের প্রথম কথা রুবাবকে স্বস্তি দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই নিচ্ছিল, তখনই সৈকতের মুখে প্রশংসা বাণী শুনে ফের রাগ নিয়ে বলল,
” ভালা না ছাই। ধুরন্ধর লোক। উনার দ্বারা কিছুই অসম্ভব না। তুই উনার থেকে দূরে থাকবি। আজই ব্লক দিবি। কোনপ্রকার কন্টাক্ট রাখবি না।”
সৈকত একটু দূরে সরে গেল, ” সাদাত ভাই না, আমার তো তোর জন্য ভয় হচ্ছে। তুই কেমন প্রেমিকার মতন কথা বলতেছিস। ভাই, আমি আগেই বলে দিচ্ছি, আমি আমার চন্দ্রকথাকে ঠকাতে পারব না। আমি চন্দ্রকথা ছাড়া দ্বিতীয় কারোতে আসক্ত হতে পারব না। প্লিজ আমাকে ভুলে যা! ”
নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল সৈকত। ওর এহেন কথায় হুট করেই নাহিদ অন্তর শব্দ করে হেসে ফেলল। যোগ হলো সৈকত। ওদের সমস্বরের হাসিতে হলরুমের সবাই চমকে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। সাদাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। একজন বিসিএস ক্যাডার বন্ধুদের সাথে মিশে যেন বাচ্চা হয়ে গেছে। কোন রাখঢাক নেই। কী হেয়ালি মজা!
সৈকতরা লজ্জা পেল। সবাই হাসি থামিয়ে ভদ্র হয়ে দাঁড়াল। সাদাত জিজ্ঞেস করলেন,
“কী নিয়ে হাসছো তোমরা? আমাদের ও বলো। আমরাও হাসি।”
কী বলবে ওরা? এসব বলা যায়? ফের হাসি পেল সবার। হাত মুখের কাছে টেনে কোনমতে ঠোঁট ঢাকল।
___________
অনেকক্ষণ বাদে মনির শেখ নিজ থেকে বেরিয়ে এলেন। তার চোখমুখ গম্ভীর। সৈকতের বাবা এগিয়ে এলেন,
“ভাই, আপনার তো দেখা নেই। দাওয়াত দিয়ে এনে নিজেই উধাও।”
হাসলেন তিনি। তারা দুজন পূর্বপরিচিত। ভাব বেশ। মনির শেখ ও একটু হাসলেন। বললেন,
” কতদূর এগুলো?”
” আপনার জন্য বসেছিলাম। শুরুই হয়নি।”
মনির শেখ হলরুমে গিয়ে দেখলেন সব আগের মতোই। তিনি একটু স্বস্তি ফেলেন। ভেবেছিলেন, এতক্ষণে আংটিবদল হয়ে গেছে। সবাই রাজি, তার তোয়াক্কা কে করবে? নাহ, তেমনটা হয়নি।
রিং দুটো পড়ে আছে সেন্টার টেবিলে। মুন বসে আছে সুরমার সাথে। সৈকত দূরে বন্ধুদের সাথে। কোন সংযোগ নেই। অথচ দুটো সোফা পুরো খালি। তিনি ছেলেকে বললেন,
“তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
রুবাব ধীরে বলল, ” সৈকত বসছে না। ”
মনির শেখ তীক্ষ্ম চোখে চাইলেন সৈকতের দিকে,
“কী সমস্যা?”
সৈকত প্রসন্ন স্বরে বলল, “আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম আংকেল। আপনি অনুমতি দিলে বসব। ”
বসার নয় কোন অনুমতির কথা বলছে বেশ বুঝতে পারলেন মনির শেখ। তিনি অনুমতি দিলে রিং পরাবে, নয়তো পরাবে না। বসবেও না। মনির শেখের চোখে বিস্ময় দেখা গেল। এটা কল্পনাতীত ছিল তার। একটা সম্মান প্রকাশ পেল। মনির শেখ মেয়ের দিকে তাকালেন। হাত কাঁপছে মেয়ের। ভয় পাচ্ছে।
রুবাব শ্বাস আটকে তাকিয়ে আছে। মনির শেখ ওর দিকেও তাকালেন। রক্তশূণ্য মুখটা একবার দেখলেন। তারপর আবার চাইলেন সৈকতের দিকে। সৈকত সটান দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে চেয়ে। দৃঢ় মুখভঙ্গি। চোখে একটা শ্রদ্ধা আছে। চোখাচোখি হতেই সৈকত একবার পলক ঝাপটাল। পরপরই তাকাল মুনের দিকে। আবার তাকাল তার দিকে। তারপর একটু সরে গেল।
যার অর্থ,
‘ আমি আপনার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। আপনি বললে আংটি উঠবে না মুনের হাতে। আমি ফিরে যাব। তবে বালা ও কিন্তু খুলবে না। ‘
মনির শেখ স্থির চোখে দেখলেন ওকে। কিয়ৎক্ষণ গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ধীরে বললেন,
“বসো।”
যে তার এতটা সম্মান করে তাকে অনুমতি দেয়াই যায়। সৈকত তৎক্ষনাৎ বসল না। মনির শেখ বসল প্রথমে তারপর বসল। বড্ড বিনয়ী ভঙিতে। শ্বশুরের উপর জয় পেয়ে মুখে বিজয়ী হাসি ভাসার কথা, আজকালকার চর্চায় থাকা উচ্চপদস্থ ব্যক্তি হবার সুবাধে অহংকার বোধ থাকবার কথা। অথচ কিছুই নেই। সে আগের মতোই বিনয়ী। সে দৃঢ় কিন্তু বেয়াদব নয়। ছেলেটাকে দেখে অবাক হন তিনি। কেন যেন রুষ্ট হতে চেয়েও পারেন না। একটা স্নেহ, মুগ্ধতা এসেই যায়।
মনির শেখ ফের বিমোহিত হলেন। মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল তার। সেন্টার টেবিল থেকে তারিনার কেনা রিংটা তুলে নিয়ে মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সাবলীল স্বরে বললেন,
“মুন, এটা সৈকতকে পরিয়ে দে।”
এই ক্ষণেই যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, এমন করেই চাইল মুন রুবাব, নাহিদ অন্তর। নিজ থেকে বলছেন! সৈকতের চোখে বিন্দুমাত্র বিস্ময় দেখা গেল না। কেবল দেখা গেল এক পশলা কৃতজ্ঞতা। তা প্রকাশ পেল মনির শেখের উদ্দেশ্যে দেয়া হাসিতে। মনির শেখ ও হাসলেন। পিঠ চাপড়ে ধীরে বললেন,
” আমার মেয়েটাকে ভালো রেখো। ”
সৈকত সুন্দর হেসে বলল, ” অভিযোগের সুযোগ দিব না ইনশা আল্লাহ। ”
এই দৃশ্য দেখে মুন বিস্ময়ে থ। এদের ভাব হলো কিভাবে? রুবাবের মনে হলে, সৈকত নয় সে তার বাবাকে চিনে উঠতে পারেনি।
দুজনের রিং বদল হলো। রুবাব সব ভুলে চেঁচিয়ে উঠল
। একটা মিষ্টি তুলে সাদাতের মুখে পুরে দিল। উল্লাসিত মুখে বলল,
“বাগদান হয়ে গেছে। ভাইয়া, মিষ্টিমুখ করুন।”
সাদাতের চোখমুখ গম্ভীর। একটা আফসোস হচ্ছে বোধহয়। রুবাব হাসছে। আরেকটা মিষ্টি এগিয়ে দিল,
“ভাইয়া, আরেকটা খান?”
সাদাত ভ্রু কুঁচকাল। এই ছেলে এমন করছে কেন? সবাইকে ফেলে ওকেই মিষ্টি খাওয়াচ্ছে কেন?
অন্তর টেনে নিল রুবাবকে, ” মিষ্টি খাইয়ে মা রিস না।
আমি মঙ্গলে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। টের পেলে ছক্কা মেরে অক্কা পাইয়ে দিবে। পকেটে রিভলবার আছে দ্যাখ। ”
“ভাই, আমার এত আনন্দ লাগতেছে। আরও কয়টা মিষ্টি খাওয়াইতে পারলে শান্তি লাগতো। মেরে ইয়ার কি শাদী হ্যায়, গানটা বাজাতো। একটু নাচি। ”
রুবাব পারলে নাচা শুরু করব। অন্তর নাহিদ দুই হাত চেপে ধরল।
“ভাই শান্ত হ। বেখাপ্পা লাগতেছে। ”
রুবাব শ্যালকের দিকে চাইল একবার। তারপর বলল,
“অন্তর, মঙ্গলের প্ল্যান ক্যান্সেল কর। সৈকতের বিয়ার মিষ্টি খাওয়াইতে হবে। বিয়ার পর আগামী ছ’মাস আমি শ্বশুরবাড়ি খালি মিষ্টি নিয়া যামু। আহ্! কী শান্তি! ”
চলবে……