আ না ম পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
212

“আ না ম”- ২৬
-Azyah সূচনা

-“ওয়েল প্লেইড মিস রামশা ডিসুজা! ভেরি ওয়েল প্লেইড!”

রবিনের গলার স্বরে বৈদ্যুতিক গতিতে ফিরে চায় রামশা।কল্পনাও করতে পারেনি কক্স বাজারে এসে তার দেখা মিলবে। হঠাৎ আশ্রমে রবিনসহ বাকিদের উপস্থিতি আশ্চর্য্যের চরম সীমায় পৌছে দিচ্ছে। তাছাড়াও তার খাপ ছাড়া কথাবার্তা।রবিনের কথার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন। আশপাশে তার বন্ধুরা চেয়ে আছে।সাথে লিয়ানাও। শাবাবের দিকে চোখ পড়লে শাবাব ইশারা করলো বাকিদের নিয়ে ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য।নিমিষেই শাবাবের চোখের ইশারা ধরে বাকিদের ডেকে নিলো।

বললো,

-“আপনারা আমার সাথে আসুন।ওনাদের কিছু পার্সোনাল কথা আছে।”

হয়তো কেউই বিশ্বাস করলো না।কিন্তু লিয়ানার কথায় সরে চলে আসে।লিয়ানার পেছনে পেছনে চলে যায় অন্যদিকে।ফের একই স্থান,একই জায়গা।শুধু মানুষ ভিন্ন। লাইব্রেরিতে অপরাধীর স্থানে নাম উঠেছে রামশার।রবিনের দ্বেষী নেত্র রামশার মধ্যে ভয়ের হানা দিচ্ছে।

চোখ ঘুরিয়ে সকলের দিকে চেয়ে রবিনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,

-“কি হয়েছে?আমাকে এভাবে অপরাধীর মতন কেনো বসিয়ে রাখা হচ্ছে।”

শাবাব এগিয়ে আসতে চাইলে হাত তুলে বারণ করলো তাকে।এমন মানুষকে বিশ্বাস করে সে নিজেও দোষী।নিজের দোষ নিজেই সামলাবে।রবিন বলল,

-“অপরাধী বলেই এখানে বসিয়ে রেখেছি।বলো!সবটা জানা স্বত্বেও কেনো এই অভিনয়টা করে গেলে?”

-“কিসের অভিনয় করেছি আমি রবিন!কি বলছো কি তুমি?”

রামশার জন্য যে কণ্ঠে সর্বদা মধু মিশ্রিত থাকতো সেই কণ্ঠে তিক্ততা ভরা।হৃদয়ের মধ্যে বিশাল ঝড় উঠতে চলেছে।নিজের দায়িত্বের কাছে হেরে গেলো এবারও।কণ্ঠের কঠোরতা বজায় রেখে বললো,

-“তোমার সাস্পেসিয়ার একটিভিটি। বারবার আমার কাজে জোর জবরদস্তি ঢুকে যাওয়া।তোমার বাবার সাথে মূল অপরাধীর বাবার নাম মিলে যাওয়া।আর তোমার ভাই অর্থাৎ তোমার বাবার আগের ঘরের সন্তান জোভান, জারা,জাহিন।এগুলো জানার পরও তুমি কি স্বাভাবিক ব্যবহারই না করেছো।এটা কি অভিনয় নয় রামশা ডিসুজা?”

এতোটাদিন যে সত্যিটা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল তা রবিনের মুখে শুনে নিস্তব্ধ চেয়ে রইলো রবিনের দিকে।কেস গড়িয়ে এই পর্যন্ত চলে এসেছে?প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাঝে।

রবিন পূনরায় প্রশ্ন করে, -“সত্যিটা কি এখনও বলবে না?”

-“বলবো!অবশ্যই বলবো।যেখানে আমার কোনো দোষ নেই সেখানে আমি নিজেকে ডিফেন্ড করবো না?তুমি আমাকে ভালো করেই চেনো রবিন।”

-“গুড।বলতে শুরু করো”

-“আমি জানতাম বাবার আগের বিয়ের কথা।আমার মাও জানতো।তবে তার প্রাক্তন স্ত্রীর আরো দুজন সন্তান আছে সেটা আমি জানতাম না। শুধু জোভান ভাইয়ার সাথে আমাদের পরিচয় ছিল।”

-“তারপর?”

-“জোভান ভাইয়া আমাদের সাথেই ছিলেন অনেক বছর।সে ছিলো বাবা ভক্ত।কিন্তু যত সময় যেতে থাকে সে জেদী হয়ে উঠে।তার মায়ের অপরাধী হিসেবে বাবাকে দায়ী করতে থাকে প্রতিনিয়ত।তারপর একদিন বাবা তাকে তারই বন্ধুর স্পন্সরে সুইডেন পাঠিয়ে দেয়।দেশে থাকলে সে কোনোদিন বাবা মায়ের দ্বন্দ্ব ভুলতে পারবে না।”

-“জোভান যে দেশে ফিরেছে জানতে?”

-“না।তবে আমার সন্দেহ শুরু হয় সেদিন থেকে যেদিন বাবাকে আমি জোভান ভাইয়ের সাথে তর্ক করতে দেখি।তাকে কোনো বিষয়ে বোঝাচ্ছিলো। দীর্ঘসময়ের তাদের কথায় বুঝতে পারি তাদের আলোচনা স্বাভাবিক কোনো বিষয়ে না।বাবা বারবার বলছিলো তুমি যা করছো তোমার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।ওই পথ ছেড়ে দাও।এর কিছুদিন পর আমাদের কাছে হুমকির লেটার আসে। জোভান ভাই সম্পূর্ণ সাইকোতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো।নানাভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে আমাদের।সে তার লেটারে লিখে তোদের কারণে আজ আমার মায়ের এই অবস্থা। একজনকেও ছাড়বো না।কিছুদিন আগে আরো একটি চিঠি দেয়। সেটায় লিখে চলে যাচ্ছি সুইডেন।তবে খুব শীগ্রই আরো হিংস্র হয়ে ফিরবো।”

মুখ খুললো শাবাব।কিছুটা এগিয়ে এসে রামশার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,

-“মায়ের জন্য এতোই যখন দরদ তাহলে বাবার লেজ ধরে এসেছিল কেনো?থেকে গেলেই পারতো মায়ের কাছে?”

-“আমি বিস্তারিত এত কিছুই জানি না।যতটুক জানি আপনাদের কাছে সবটাই বলেছি।”

রবিনের কন্ঠস্বরে এখনও নমনীয়তা আছে। শাবাব চাইলো কঠোর হতে আরো খানিকটা।বললো,

-“আপনার বাবা কোথায়?ডাকুন তাকে।”

-“আমার বাবা দেশের বাহিরে।”

রবিন তাদের দুজনের মধ্যিখানে রাগী গলায় প্রশ্ন করলো,

-“দেশের বাহিরে কি করতে গেছে?নিশ্চয়ই পালিয়েছে?”

-“আপনারা আমার বাবার নাম কি করে জানলেন?”

রবিন নিজের ঘাড়ে দোষ তুলে নেয়।বলে উঠে, -“আমি বলেছি!”

রামশা নিজের ফোন হাতে নিলো।কোনো জবাব দিলো না রবিনের কথার।অনুমতিবিহীন ফোন তুলে হোয়াটস অ্যাপে কল করলো বাবাকে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর স্পিকার অন করে। মানভ ডিসুজা ফোন রিসিভ করে বললো,

-“হ্যালো”

-“হ্যালো বাবা? কোথায় আছো?”

মানভ ডিসুজা জবাব দিলেন, -“আপাদত হোটেলে আছি।কেনো কি হয়েছে?”

-“কিছু হয়নি বাবা।কি কাজে গিয়েছো তুমি?বললে না যে?”

মানভ ডিসুজার দিকটায় নীরবতা চেয়ে গেলো।রবিন আর শাবাব গভীর মনোযোগী।বাবা ও মেয়ের কথোপকথন শুনছে এক ধ্যানে।খানিক সময় পর মানভ ডিসুজা বললেন,

-“জোভানের খোঁজে এসেছি।তোরা সাবধানে থাকিস।আমি ওকে বুঝিয়ে নিয়ে আসবো।আমি জানতে চাই ও কিভাবে এতটা হিংস্র হয়ে উঠলো।সব জবাব এখানেই মিলবে।”

রামশা আতঙ্কিত হয়ে জবাব দেয়, -“কিন্তু বাবা এটা অনেক রিস্কি।”

-“আমি জানি”

ইশারা করে ফোনের মাইক মিউট করার জন্য। রামশা রবিনের কথামত ফোন মিউট করলো।রবিন বলল,

-“ওনাকে বলো ফিরতে। জোভান দেশেই আছে।কোনো সুইডেন যায়নি”

রামশা ফোন আনমিউট করে বাবার উদ্দেশ্যে বললো, -“বাবা জোভান ভাই দেশেই আছে।”

মানভ ডিসুজা উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলেন, -“তুমি কিভাবে জানো?”

রামশা শাবাব আর রবিনের দিকে চাইলো।কি জবাব দিবে বাবার প্রশ্নের বিপরীতে।রবিন শাবাব উভয়ই মাথা দুলিয়ে না বোধক উত্তর দেয়। সাইফা পেছনে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,

-“ওনাকে আমাদের কথা বলবে না।শুধু ফিরে আসতে বলো”

রামশা গলা ঝাড়া দিলো।বললো,

-“আমি জানি বাবা তুমি ফিরে এসো।নাহয় সে এখানে অনেক বড় কোনো কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে।”

বলেই দ্রুত ফোন কেটে দেয়। মিথ্যে বলতে বলতে এক সময় সত্যি বেরিয়ে আসবে।বাবার সামনে বরাবরই রামশার এই সাহস কম। মানভ ডিসুজা পূনরায় ফোন করলেও রিসিভ করলো না।

মির্জা বললো,

-“আমারতো মনে হয়না সে জোভানকে খুঁজতে গিয়েছে।নির্ঘাত এই প্ল্যানে সে নিজেও জড়িত!”

রামশা জবাব দেয়,

-“আমরা কেউ জড়িত নই অফিসার।আপনি চাইলে তদন্ত করতে পারেন।”

রবিন প্রশ্ন করে, -“এতই যেহেতু নির্দোষ তাহলে সবটা আগে স্বীকার করলে না কেনো?আমাদের সাহায্য করলে না কেনো?ঠিক চুপচাপ আমাদের সাথে থেকে আমাদের উপর নজর রেখেছো।এখনও কিছুই ক্লিয়ার না তোমার তরফ থেকে রামশা”

চোখ ছলছল করছে রামশার।রবিনের এই রূপে অন্তর পুড়ে ছাই।ঠোঁট কামড়ে সামলে নিলো নিজেকে।চোয়াল শক্ত করে বললো,

-“যেদিন বাবার মুখে সিরিয়াল কিলার শব্দটা শুনতে পাই ঠিক সেদিন থেকে আমি ইচ্ছেকৃত তোমাদের সাথে জুড়েছি।জানতে চেয়েছি আসলেই কি সেই সিরিয়াল কিলার জোভান ভাই নাকি।কিন্তু তোমরা যখন আনাম নামটা বললে।আমি সরে যাই।”

সবটা শুনে শাবাব বললো, -“তিনদিন সময় দিলাম।এর মধ্যে যদি আপনার বাবা ফিরে না আসে?তাহলে সে এই অপরাধের সাথে জড়িত।আর যদি ফিরে আসে?….. তারপরও ছাড় নেই আপনার আর আপনার বাবার।হতে পারে আপনারাও এসবে জড়িত।ততদিন আপনার ভাইয়ের খোঁজ করি।তার সব সাইকোগীরি সারাবো!”

___

খাবার ঘরে আড্ডায় মগ্ন রামশার বন্ধুদের দল।তাদের আলোচনার মুখ্য টপিক একটাই। রামশার সাথে এভাবে কথা বলা লোকগুলো কারা।কি আলোচনা হচ্ছে তাদের মধ্যে আলাদাভাবে?রাতের খাবারের আয়োজন সামলাতে সামলাতে নজর রাখছে লিয়ানা তাদের উপর।আশ্রমের একজন নারী এসে তাদের জন্য খাবার পরিবেশন করলো।তাদেরকে খেতে দিয়ে সেই সুযোগে লিয়ানা বেরিয়ে এসেছে। লাইব্রেরীর দিকে এগোতেই দেখলো রবিনকে।বাগানের এক কোণে একাকী দাঁড়িয়ে।বাকিরা ভেতরে হলে সে এখানে?

পা বাড়িয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে,

-“কি ব্যাপার অফিসার রবিন?”

আধাঁরে ঢাকা মুখমন্ডল লিয়ানার পানে তুলে ধরলো।কর্ম থেকে দূরে ব্যক্তিগত শোক নিজেকে মিশিয়ে নিচ্ছিলো এই তমসাচ্ছন্ন রাতের ন্যায়।লিয়ানার ডাকে যেনো ফিরে এলো। ঠোঁটে মিথ্যে হাঁসি টেনে বললো,

-“কিছুনা দাঁড়িয়ে ছিলাম শুধু।”

-“রামশার সাথে কিছু হয়েছে?….কি কথা বললেন?”

রবিন বলতে গিয়েও থেমে গেলো।লিয়ানা অনেককিছু জানে কিন্তু অনেককিছুই জানেনা। গভীরের ডিটেইলস তারও জানা নেই।বলা অনুচিত বলে থেমে গেলো।

বললো, -“তেমন কিছুই না।একটা বিষয়ে সন্দেহ করছিলাম।”

-“তারপর?”

-“আমাদের সন্দেহ ভুল।এই আরকি!”

-“সহজে কারো প্রেম অথবা মোহে ধরা দিতে নেই।সামান্য কথা কাটাকাটি সম্পর্কে ছেদ সৃষ্টি করে।আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে রামশার সাথে আপনার ব্যক্তিগতভাবে কোনো মনোমালিন্য হয়েছে।”

রবিন হেঁসে উঠে।বলে,

-“মানুষ নিয়ে এত অভিযোগ আপনার।আপনি কি মানুষ নয়? ভূত নাকি?নাকি কোনো অতৃপ্ত আত্মা? প্রতিশোধ নিতে মানুষের রূপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?”

-“প্রাণ আছে তবে মানুষ আমি নই” স্বাভাবিক সুরেই উত্তর দিলো লিয়ানা।

হাসি থামায় রবিন।এক পলক দেখলো লিয়ানাকে। অবলীলায় ভারী ভারী কথা বলে ফেলে।শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো,

-“হৃদয় নেই আপনার মাঝে?”

-“হৃদয় একটা অপ্রয়োজনীয় বস্তু।জানেন আমিও ডুবেছিলাম একজনের মোহে।এমনভাবে ভেঙে দিয়ে চলে গেছে আমি এখনও আমার হৃদয়ের গুঁড়ো হওয়া অংশ খুঁজে বেড়াই।এখানে আসার পর মনে হলো সব সম্পর্কের দরকারতো অবশ্যই আছে।তবে সেটা বাস্তবিক না কাল্পনিক সম্পর্ক।বাস্তবের মানুষের সাথে চলে ফিরে দেখেছি।আপনাকে নিঃশেষ ছাড়া আর কিছুই করতে জানে না।….আমাকে বলেন না পাগল আমি?সাধে পাগল হয় কেউ?” বলে চলে গেলো লিয়ানা।

পথে আরো একজনের সাথে মুখোমুখি সংর্ঘষ হওয়ায় ঘাবড়ে উঠে লিয়ানা।লোহার ন্যায় শক্ত দেহে ধাক্কা খেয়ে নাকের ডগা বোধহয় শেষ! ব্যাথা অনুভব করছে প্রচন্ড রকমের।মুখ তুলে শাবাবের কালো ছায়ায় ঢাকা মুখখানা দেখে দ্রুত গতিতে পেছনের দিকে সরে গেলো। শাবাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।যেনো ধাক্কা খাওয়ার জন্য লিয়ানা একমাত্র দায়ী।তবে মস্তিষ্ক শীতল হয়ে উঠলো মোহনীয় সুবাসে।হিপনোটিজমের মত ঘোর লাগিয়ে দিতে শুরু করেছে।ঝিম ধরে যাচ্ছে মাথায়।

সামনে দাঁড়ানো লিয়ানার অদ্ভুত শীতল চাহনি মেজাজটা আরো বিগড়ে দিলো। সহ্যই করতে পারেনা কেনো জেনো এই মেয়েটিকে। সুভাসে সম্পূর্ণ মত্ত হওয়ার পূর্বেই ক্যাটক্যাটে গলায় বলে,

-“অন্ধ আপনি?”

-“প্রশ্নটা আমিও আপনাকে করতে পারি অফিসার শাবাব।”

-“আমার চোখ এর পাওয়ার একদম ঠিক আছে।আপনি নিজেই অন্যমনস্ক।”

অত্যন্ত ধীর পায়ে সাদা রঙের একটা বিড়াল এসে দাঁড়িয়েছে লিয়ানার পেছনে। সাড়াশব্দহীন চুপচাপ। শাবাব এর চোখে পড়লেও সে চুপ হয়ে রইল।লিয়ানা সামনে চেয়েই পেছনের এদিকে হাত ঘুরিয়ে ডেকে নিলো বিড়ালটিকে।একলাফে এসে তার হাত জাপ্টে ধরেছে।

বিড়ালটিকে দুহাতে তুলে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, -“টেস্ট করছিলেন?আমার সেন্স কেমন?”

শাবাব সরাসরি জবাব দেয়, -“জ্বি নাহ!….আর এমনভাবে চেয়ে থাকেন কেনো? চেইস করেন আমাকে?সাহস দেখান?”

লিয়ানা চোখ নামায়।বুঝলো তার মেজাজ আজ অন্যদিনের চেয়ে বেশি খারাপ।তবে এক চুলও যে ছাড় দেওয়া যাবে না।লিয়ানা বিড়ালের মাথায় আবারো হাত ফেরায়।আর বলে,

-“আমার প্রতি অহেতুক রাগ কেনো আপনার?আপনার কোনো ক্ষতি করেছি?”

-“অবশ্যই করেছেন।আপনার সাথে থেকে থেকে আমার অফিসারগুলোও পাগল হচ্ছে।”

লিয়ানা শাবাবের দিকে চেয়ে বলল,

-“আমিতো ডাকি না।আপনি নিজে আসেন। বারবার!”

-“এক্সকিউজ মি শেওলা।কাজে আসি।আমার কোনো শখ নেই পাগলের কারখানায় আসার।”

-“আমাকে ছাড়া এতদিন কাজ চলেনি?”

শব্দভান্ডারে শব্দের অভাব দেখা দিচ্ছে।নিজে একা কথা বলেছে সবসময়।উত্তর দেওয়ার তেমন কেউ ছিলো না।সাহস করেনি।তাই হয়তো স্বভাবে পরিণত হয়েছে।মুখের উপর ধারালো জবাব সহ্য করতে পারছে না।

দমলো না তারপরও।বলে উঠলো, -“কার সাথে কথা বলছি আমি! যার নিজের মাথা ঠিক নেই।আপনি যদি আমার টিমের হতেন তাহলে আমার চোখে চোখ রেখে জবাব দেওয়ার সাহস করতে পারতেন না কোনোদিন।”

শাবাবকে তাচ্ছিল্য করে লিয়ানা জবাব দেয়,

-“এখন আপনার আমার চেয়ে থাকা নিজেও সমস্যা! তবে হ্যাঁ প্রমাণ হলো যে,আমি অন্যমনস্ক না।বরং আপনি নিজে।ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।মুখ শুকিয়ে গেছে কেস এর প্রেশারে।মাথা গরম।রক্ত টগবগ করছে।ভাবতে পারছেন না কিছুই।তাই না?”

বাহিরের দিকে বজ্রপাতের আওয়াজ জানান দিলো বিগত দিনগুলোর ন্যায় আবারো অশ্রু ঝরাবে আকাশ। বৃষ্টিরুপে।মনোযোগ সমস্তটাই হরণ করে নিলো জোরালো পবন।ছোট চুলগুলো দুলছে অনবরত।স্থির দাঁড়িয়ে চোখ বুজে লিয়ানা।হিম বাতাসে নেত্রযুগলকে বিশ্রাম দিচ্ছে কয়েক মুহূর্তের।দৃষ্টি প্রখর শাবাবের।অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে লিয়ানার দিকে।ভাবতে লাগলো তার প্রাথমিক বর্ণনা সঠিক। মেয়েটার মধ্যে ইন্দ্রজাল।তার চাহনি আকর্ষণ করতে পারে মানুষকে নিমিষেই।চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসিকতার পরিচয় দেয় পদেপদে।শেওলা পড়া চোখের মণিযুগল অজান্তেই সমগ্র মনোযোগ হরণ করে নিয়ে যায়।আগে কখনো ঠিকমতো দেখার ইচ্ছেটুকু জাগ্রত হতে দেয়নি এই খিটখিটে স্বভাব।আজ প্রকৃতি আর লিয়ানার বিচিত্র সম্পর্ক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে।অতিরিক্ত চাপে শেওলা ভূতের মতন হ্যালুসিনেট করতে শুরু করলো নাতো?নাকি সম্মোহন?

দূর দেখে মির্জার নজরে পড়ে এদের দুজনকে মুখোমুখি।একই সাথে দুজন অফিসার দশ নাম্বার মহাবিপদ সংকেত। কদমজোড়া দ্রুত এগোয়। শাবাবের কুচকে থাকা কপাল আর লিয়ানার স্বাভাবিক মুখভঙ্গি বুঝিয়ে দিল নিশ্চয়ই যুদ্ধ পূর্ববর্তী নীরবতা।তাদের মধ্যিখানে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

-“তোমরা কি আবারও ঝগড়া করছো?”

ধ্যান ভাঙ্গে শাবাবের।বারংবার চোখ পিটপিট করে বলে উঠলো,

-“ঝগড়া করার মতন ফ্রি টাইম থাকলেতো হতোই।”

মির্জা লিয়ানার দিকে ফিরে বললো, -“লিয়ানা?”

-“তেমন কিছুই হয়নি।”

ঠিক সেই সময় ডাক পরে মির্জার।আবির ডাকছে চেচিয়ে।এখানে পরিস্থিতি অনুকূলে।দুজনকে টপকে আবারো লাইব্রেরী এর দিকে এগিয়ে যায় মির্জা।তার ঠিক কিছু সময় পর শাবাবও তার ভারী পা জোড়া ফিরিয়ে চলে যেতে চাইলে অবলীলায় লিয়ানা বলে উঠলো,

-“প্রেমে পড়ছেন অফিসার শাবাব”

আগ বাড়ানো পদচারণ থেমে যায়। তড়াক করে পিছনে ফিরে চাইলো।বেশি দুরত্বে এগোতে পারেনি।এর আগেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশ্চর্য্য হওয়ার ভঙ্গিতে শাবাব বলে উঠলো,

-“কিহহ!”

-“বলেছি আপনি প্রেমে পড়ছেন নিজের অজান্তেই।”

বড়বড় কদম ফেলে এগিয়ে আসে শাবাব।রক্ত টগবগ করে উঠলো ছোট্ট কারণে।নেত্রদ্বয় বড়বড় করে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠে,

-“কে বলে এসব ফালতু কথা?টোটালি রাবিশ!সাইকো মেয়ে কোথাকার!প্রেমের মতন ফালতু জিনিসের জন্য আমার সময় নেই।”

শাবাব যতটা উদ্দীপিত ঠিক ততটাই শান্ত লিয়ানা।শীতল গলায় বলে উঠে,

-“সত্যটা মানতে চাইছেন না তাই এতটা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন”

চলবে…

“আ না ম”- ২৭
-Azyah সূচনা

লিয়ানার কথাটি ভাবিয়েছে।রাত্রীর শেষ প্রহর অব্দি মাথায় ভনভন করছিলো মাছির মতন।হুটহাট মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে শাবাবের।এইটুকু মেয়ে!সে নাকি মানুষের মনের অজান্তে কি চলে সেটা বলে ফেলতে পারে।কোনো আধ্যাতিক শক্তি নিজে জন্মেছে নাকি?আজগুবি কথাবার্তায় পড়ে শাবাব নিজেকেও পাগল হয়ে যাওয়ার পথে এগোতে দেখলো।মাথা থেকে দিয়ে ‘আপনি প্রেমে পড়ছেন’ বাক্যটি ঝেড়ে ফেলে দিলো।রাত ভর বৃষ্টির তাণ্ডব চলেছে।সকালে চোখ মেলে মনে হলো এখনও রেশ কাটেনি।আরো বেড়েই চলেছে।জানালার সামনে আকাশের দিকে চেয়ে বোঝা গেলো এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম এর উদ্দেশ্যে বের হওয়া অসম্ভব। আশ্রমটা এমনভাবে জুড়ে গেছে তাদের সাথে। একবার আসলে আর ছাড়তেই চায় না।

ঘর ছেড়ে নিচের দিকে পা বাড়ায়।গাড়ীর অবস্থাটা চেক করা উচিত। সেপ্টেম্বর এর দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষভাগে বৃষ্টির জোর যেনো আরো বেড়েছে।ঝরতে শুরু হলে একাধারে ঝরতেই থাকে।গতরাত থেকে শুরু হলো কে জানে কবে শেষ হয়!গাড়ীর ইঞ্জিনে পানি প্রবেশ করলে ঝামেলা হয়ে যাবে অনেকটা।নিচে কাঠের দরজার দিকে এগোতেই দেখলো অদ্ভুত চিত্র। লিয়ানা উপস্থিত সেখানে।সিঁড়িতে বসে কুকুর বিড়ালের সাথে বৃষ্টি বিলাসে মগ্ন।কি অদ্ভুত!তারাও নড়চড় বিহীন চুপচাপ লিয়ানার পাশে।কেউ বসে আছে কেউ আরাম করে শুয়ে। শরীর ভিজে যাচ্ছে তাতে তাদের তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।তাদের উপেক্ষা করেই জোরালো বাতাস আর ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেলো শাবাব।জিপ এর দিকে গিয়ে ঝুঁকে বসলো। ডোর খুলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চেক করে দেখলো সব ঠিক আছে আপাদত।ফিরে এসে লিয়ানার মুখোমুখি হলে লিয়ানা হাত তুলে একটি তাওয়াল এগিয়ে দিলো।অর্ধ ভেজা শাবাবের দিকে যেনো কুকুর বিড়ালগুলোও অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে।

ছো মেরে তোয়ালে নিজের হাতে নিয়ে বলতে লাগলো,

-“আকাশ,বাতাস,গাছ বাদ দিয়ে কি এখন কুকুর বিড়ালকে সঙ্গী করেছেন?”

-“করলে দোষ কোথায়?ওরা বিশ্বস্ত”

-“হাহ!”

লিয়ানা কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না। আবার চোখ ফিরিয়ে সামনের দিকে চেয়ে তীব্র গতিতে আকাশ থেকে জমিনে গড়িয়ে পড়া প্রত্যেকটি বৃষ্টি বিন্দুর মধ্যে আকর্ষণ অনুভব করলো। হাঁসফাঁস অবস্থা শাবাবের।প্রশ্ন মস্তিষ্কের উপর চেপে বসে আছে।জানতে চাইছে গতরাতে তাকে বলা অদ্ভুত কথার বিশ্লেষণ।তার পূর্বেই লিয়ানাই বলে উঠে,

-“ইগো বাঁধা দিচ্ছে তাই না অফিসার শাবাব?কি বলতে চাইছেন বলে ফেলুন।এই প্রাণীগুলো অবুঝ আর আমি সবসময়ের মতন নির্লিপ্ত।কেউ বিচার করবে না আপনাকে।”

সুযোগ পেয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলে শাবাব,

-“গতকাল আমাকে সেই কথাটা কেনো বললেন?আমার কোন লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে আমি প্রেমে পড়ছি।আর কার প্রেমে পড়ছি।স্বপ্ন দেখেছেন জেগে জেগে?”

শেষ প্রশ্নে শাবাবের কন্ঠস্বর উচুতে উঠেছে কিয়ৎ।তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে তা এখনও বোধগম্যতার বাহিরে।নিজের ব্যক্তিত্ব থেকে যেনো আলাদা কেউ একজন দাড়িয়ে লিয়ানার সামনে।তার স্বরে দুটো বিড়াল আয়েশী ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলো।যাওয়ার পথে শাবাবের পায়ের উপর দিয়ে গেছে।

অতর্কিতে হেঁসে উঠে লিয়ানা।ঠোঁটের প্রসারণ অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি।যা আবারো দৃষ্টি আকর্ষণ করলো শাবাবের।তার মতই আচরণ।হাসতে যেনো খাজনা দিতে হয়।তাই কালেভদ্রে দেখা যায় তাদের হাস্য।

-“বিড়ালটাও আপনার কর্কশ আওয়াজে বিরক্ত হয়ে চলে গেলো।”

নড়েচড়ে উঠলো শাবাব।ক্ষ্যাপা চেহারার দেখা মেলে। শাবাব বললো,

-“আপনার বিড়ালতো আপনার মতই হবে।অভদ্র!”

গায়ে মাখলো না শাবাবের বলা কথাটি।সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে গেলো। প্রসঙ্গ ফিরিয়ে নিয়ে গেলো পূর্বের বিষয়ে।বললো,

-“আসুন আপনার প্রশ্নের উত্তর দেই। কার প্রেমে পড়ছেন জানতে চাচ্ছেন?…আপনার বারবার তর্কে হেরে যাওয়া,চোখ এড়ানো,কথা বলতে বলতে চুপ হয়ে যাওয়া আর বিশেষ করে কারণে অকারণে আমার সামনে এসে হাজির হওয়া।সবটা আমার দিকে ইঙ্গিত করছে।”

-“আমি আপনার প্রেমে পড়ছি?খুব হাসালেন!কেনো পড়বো আপনার প্রেমে?আমাদের কোনো মেল আছে?আর সবচেয়ে বড় কথা আপনার অদ্ভুত আচরণের কারণে আপনাকে আমার বিরক্ত লাগে।কাজের দায়ে সাথে আছি। নাহয় পাগলা গারদে আপনার জন্য আলাদা একটা সুবিন্যস্ত সেল রিজার্ভ করতাম”

লিয়ানা প্রত্যুত্তরে বললো, -“চোখে চোখ রেখে দুটো ভালোবাসার কথা বললে প্রেম হয় অফিসার শাবাব?কখনো একে অপরকে ঘৃণার মধ্যেও ভিন্ন কিছু লুকায়িত থাকে।সাইফাকেই দেখুন না?”

শাবাব হাসলো লিয়ানার কথাকে তুচ্ছ করে।বললো,

-“আবার সাইফা আসলো কোথা থেকে এখানে?ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।”

-“আপনাকে একটা শেষ কথা বলি”

-“বলেন! না বলেতো ক্ষ্যান্ত দিবেননা”

-“কোনোদিন ভুল বাগানে কদম ফেলবেন না। কাঁটা বিধবে।তারপর সেই বিষ বেদনায় অশ্রু ঝরবে।আপনাদের মধ্যে যে মন নামক দুর্বল যন্ত্রটা আছে?কাবু করে ফেলুন যত দ্রুত সম্ভব”

সকালে লিয়ানার সাথে কথা বাড়ায়নি আর।অযথা নিজের মেজাজ নষ্ট করে কি লাভ?এই চিন্তায় এড়িয়ে চলে গিয়েছিলো লিয়ানাকে।সকাল গড়িয়ে দুপুর। বৃষ্টির জোর কমে গেছে।গতরাতে একবারের জন্য রামশা আর রবিনের কথা হয়নি।এবার গন্তব্য কক্স বাজার থেকে চট্টগ্রাম।চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা। মানভ ডিসুজার সাথে সাক্ষাৎ করতে হবেতো!আবারো একই দৃশ্য দ্বিতীয়বার।বিদায়ের পালা।

মির্জা এগিয়ে এসে বললো, -“আসি লিয়ানা।”

স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা শাবাবের পানে চাইলো লিয়ানা।চোখ নামিয়ে ইচ্ছেকৃত ফোনের মধ্যে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে।

লিয়ানা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

– “কেস?”

-“অনেকাংশে সলভ”

-“তাহলেতো আমার সাথে আপনাদের শেষ দেখা।”

-“এমন কোনো কথা নেই লিয়ানা।কর্ম ব্যস্ততা থেকে কিছু সময় পেলে আমরা আসবো তোমার সাথে দেখা করতে।”

বলেই মির্জা চলে গেলো।আজ রামশা লিয়ানার কাছ থেকে বিদায় নেয়নি। সাইফা শুধু হাত তুলে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে চেপে বসলো।নিজের অজান্তেই আবারো মন উদাস হতে শুরু করে লিয়ানার।সেতো চায়নি রামশাকে সন্দেহ করতে।এই কারণেই কি রাগ করলো সে?সবার মতন দায়ী করছে সেও লিয়ানাকে? শাবাবের চোখে আবারো একই দৃশ্য ভেসে উঠেছে।গাড়ীর গতির সাথে সামনে হাত বেঁধে রাখা মেয়েটি ধীরেধীরে উধাও হয়ে গেলো।

-“কি করছো শাবাব সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাও!”

মির্জার গলার আওয়াজে সামনে চেয়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রন কষে ধরলো।কিছু সময়ের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।মন মস্তিষ্ক সচল হয়। সাইসাই করে ছুটে চললো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। শাবাবের সবটাই যেনো গভীরভাবে লক্ষ্য করে সাইফার।বোকার মতন দেখাচ্ছে এক শাবাবকে।মুখখানা ফ্যাকাশে।কপাল কুঁচকে নিজেকে পূর্বের ন্যায় দেখানোর চেষ্টা ধরা পড়েছে সাইফার দৃষ্টিতে। সাইফা ঘুরে রামশার দিকে চাইলো।মেয়েটির মুখটাও থমথমে।কে জানে অন্য গাড়িতে রবিনের কি খবর?

___

-“বেশি বাড় বাড়তে না করেছিলাম।রেস্ট দেওয়ার সময় দিয়েছিলাম তোদের।কিন্তু তোরা চাস আমি আবারো খুনের খেলায় মেতে উঠি।ধৈর্য্য শক্তি নেই তোদের না?আমার কথার এদিক ওদিক হবে না ইন্সপেক্টর!নিজেদের জীবন আর অন্যদের জীবনের মায়া কর!হয়তো অপেক্ষা কর নয়তো….”

একহাতে আরো হুমকিভরা একটি চিঠি।অন্যদিকে সিসিটিভি ফুটেজ।একজন ডেলিভারি বয় এসে দারোয়ান এর নিকট তাদের উদ্দেশ্যে এই চিঠি দিয়ে যায়।

শাবাব সাইফা আর ফাহাদের দিকে চাইলো। উদ্ভট হেসে বললো,

-“আপনাদের কি আমার হাত জোড় করে অনুরোধ করতে হবে এখন?জানেন না কি করবেন এখন?”

তরতর করে ‘ইয়েস স্যার’ বলে দুজনে বেরিয়ে পড়ে। এতক্ষন শাবাব ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে নীরব ব্যাক্তি।ব্যুরোর বাতাস লাগতেই সিনিয়র সিনিয়র ভাব এসে গেছে তার মধ্যে। যা সবসময় থাকে।বুলেটের মত একেকটা কথা ছুঁড়ে। তারতো বন্দুকেরও প্রয়োজন নেই।এসব ভাবতে ভাবতেই দারোয়ান এর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে চলে যায় ডেলিভারি ম্যানকে খুঁজতে।

অন্যদিকে শাবাব রবিনের দিকে চেয়ে সকলকে চমকে দিয়ে বললো,

-“আমি জানি আপনার মানসিক অবস্থা ঠিক নেই।কিন্তু আশা করি কেসে এর প্রভাব পড়বে না।”

শাবাবকে এত সুন্দর করে কথা বলতে দেখে রবিনও রীতিমত অবাক।মির্জা চোখ গোলগোল করে চেয়ে আছে।

রবিন বলল, -“অবশ্যই।আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমি গেস করছি জোভান আমাদের দিকে নজর রেখেছে।”

মির্জা বললো, -“কানেকশন অন্যদিকে আছে আমার মনে হয়।এর পিছনে জাহিন আর ওর মায়ের হাত নেইতো।আমরা রামশাকে এক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় ফেলতে পারি না।সে আমাদের নজরদারিতে।তার ফোন আমাদের কাছে। সাইফা ছিলো চব্বিশ ঘণ্টা তাদের সাথে।আমার যতদূর মনে হচ্ছে জোভান তার বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছে।কোনোনা কোনোভাবে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদের কথা জেনে আমাদের এই চিঠি পাঠিয়েছে আমাদের।”

-“কথা সেখানেই থেকে যাচ্ছে যে যদি সে বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতো তাহলে সবার আগে প্রফেসরকে মারতো।বাকিরা কেনো?”

রবিনের কথার উত্তর স্বরূপ শাবাব বললো, -“এর উত্তরতো জোভান ডিসুজাই দেবে।আর নয়তো মানভ ডিসুজা।”

রবিন প্রশ্ন করলো, -“আমরা কি আবার যাবো খুলনা?আমার গাটস ফিলিং বলছে শ্যামলি ডিসুজা আর জাহিন ডিসুজার সাথে জোভানের এখনও যোগাযোগ আছে।”

মির্জা বললো, -“না যদি থেকে থাকে যোগাযোগ আমরা আবার তদন্ত করতে গেলে কোনো না কোনোভাবে জেনে যাবে জোভান।আমাদের হাতে পোক্ত প্রমাণও নেই।হয়তো আরো কিছু অপরাধ ঘটাতে পারে।”

শাবাব বললো, -“মাঝেমধ্যে অপরাধীর কথা মেনে নেওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ।”

__

সেদিন ভুক্তভোগী মেয়েদের বাড়ি গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। আজ আরো একবার যাবে সাইফা এবং ফাহাদ একত্রে ডেলিভারি ম্যান এর খোঁজ নেয়।জানতে পারে তাদের কাছে জোভান নামের একজন এসে চিঠির খাম দিয়ে গিয়েছিলো।সন্দেহ প্রখর হয়।তার দেওয়া ঠিকানা ভুল।হতাশ হয়ে পা বাড়ালো মেয়েটির বাড়ির দিকে।আজ ভাগ্য সাথে ছিলো।গিয়েই দেখলো তারা বাড়িতে আছেন।নিজেদের পরিচয় দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।বাড়ি ঘরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো নিম্নবিত্ত পরিবার।

ভুক্তভোগী মেয়েটির নাম আশা। সাইফা তাকে আর তার বাবা মাকে সামনে বসিয়ে নরম গলায় বললো,

-“ভয়ের কোনো কারণ নেই।শুধু কিছু প্রশ্ন করবো আর আপনারা উত্তর দিবেন।এতে কোনো ঝুঁকিও নেই।”

আশা বললো, -“জ্বি”

-“তোমার সাথে…আই মিন তুমি এবং তোমার পরিবার একজনের নামে মামলা করেছিলে আজ থেকে সাত মাস আগে।তার ঠিক একমাস পরই কেনো মামলা তুলে নিলে?”

আশা অবাক হয়।তারা সাত মাস আগের ঘটনা আবারো টেনে আনছে।নিজেকে বাবা মায়ের সামনে অপরাধী মনে হচ্ছে।তারা দুজনও নত চক্ষু। আশা বললো,

-“প্লিজ আপনারা সেই ঘটনা টেনে আনবেন না।খুব কষ্টে বেঁচে আছি এই সমাজে।”

সাইফা বললো, -“রিল্যাক্স আশা! আমরা এই কেস ঘাটাঘাটি করছি না।কিন্তু তোমার দেওয়া কিছু তথ্য আমাদের অনেক সাহায্য করবে।”

-“কেমন সাহায্য?”

-“সেটা তোমার না জানলেও চলবে।তোমার সাথে জড়িত নয় এটা।কিন্তু এই উত্তরটা দাও কেনো তোমরা কেস সরিয়ে নিলে।”

আশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, -“অনবরত হুমকি আসতে থাকে।সাথে টাকার অভাবে কোনো লয়ার হায়ার করতে পারিনি।আমাদের কোনো রকমের সাহায্য করা হয়নি।”

সাইফা তাড়াহুড়ো করে প্রশ্ন করলো, -“কেমন হুমকি?আর বিপক্ষে কোন লয়ার ছিলো?”

আশার বাবা ভারী গলায় বলে উঠলেন, -“যদি মামলা তুলে না নেই তাহলে আমার মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি।আর লয়ার এর নাম আমরা জানি না।তবে সে খুব ভালো মানের লয়ার।”

-“আচ্ছা সেটা আমরা পারবো বের করতে।আপনাদের যে হুমকি দেওয়া হয়েছে সেটা জানাননি কেনো পুলিশকে।”

-“পুলিশকে জানালে আরো বিপদ হতো!”

আরো টুকটাক ইনফরমেশন নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ফাহাদ আর সাইফা।লয়ারের ইনফরমেশন নিতে।নাম জানা যায় নাহিদ শেখ।যিনি আপাদত দেশের বাহিরে অবস্থান করছেন।আরো কিছু তথ্য পাওয়া গেলো। বেশিরভাগ কেস যেগুলো জিতে যায় আসামিপক্ষ সবটাই তিনি লড়েছেন। সাইফার বুঝতে বাকি রইলো না ঘটনা কি।সবার পেছনেই কেউ না কেউ আছে। সাহায্যকারী হিসেবে।

__

তিনদিন কেটেছে চোখের পলকে।এদিক ওদিক দৌড়ে ক্লান্তি দেখা মিলছে না কারো মুখেই।সবাই তৈরি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য।লম্বা পথ।সাথে কড়া নজরে রাখা রামশাও আছে। একেকজন টিম মেম্বারকে তাদের বাসস্থান এর অনেকটা দুর থেকে নেওয়া হয়।সকলেই আলাদা আলাদা হয়ে একই সাথে যুক্ত হয়।রাতের আঁধারে একটি গাড়ি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। গাড়িটাও সাধারণ।আজ জিপ নেয়নি।কোনোভাবে রিস্ক নেওয়া যাবেনা। ব্যুরোতে আবির,মির্জা আছে।রবিন আজ অনেকদিন পর নিজের শহরের দিকে রওনা হচ্ছে।সাথে এক বিশেষ পরিচিত মানুষ থাকলেও অপরিচিতদের মতন ব্যবহার তার।তবে অন্তরের অন্তঃস্থলে একটাই চাওয়া কোনোভাবে যেনো রামশা অপরাধের সাথে জড়িত না থাকে।

সকাল আটটায় ঢাকা এসে হাজির হলো পুরো টিম। দাঁড়িয়ে আছে রামশাদের বাড়ি থেকে কিছু দুরত্বে। শাবাব বললো,

-“বাড়ি গিয়ে দেখেন আপনার বাবা এসেছে কিনা।আমাদের সাথে কানেকটেড থাকবেন সবসময়।এক সেকেন্ডের জন্য লাইন বিচ্ছিন্ন যেনো না হয়।আর হ্যাঁ সুযোগ বুঝে আমাদের বলবেন।আমরা আশেপাশেই আছি।”

রামশা শাবাবের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।এক পলক রবিনের দিকে চেয়ে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে।ভারী লাগেজ টেনে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেছে। ঘন্টাখানেক পাড় হলো রামশার।কানের ইয়ার বাডসে মায়ের সাথে আলাপন শুনা যাচ্ছে। রামশা তার বাবার কথা জানতে চাইলে সে জানায় বাংলাদেশে সকাল দশটায় ল্যান্ড করবেন।এখনও দুইঘন্টা বাকি।

রবিন গাড়িতে বলে উঠলো, -“অনেক সময় বাকি।আমার বাড়িতে চলুন।পাঁচ মিনিট এর রাস্তা।”

শাবাব প্রশ্ন করলো, -“আমরা চলে গেলে যদি কিছু ঘটে এখানে?”

-“আপনারা ফ্রেশ হয়ে চলে আসবেন।আর রোড এর সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে থাকলেইতো হয়।আসুন।”

এ্যারিক রোজারিও এর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ শাবাবের।লোকটাকে মনেমনে ভীষণ মানে শাবাব।তবে হাত মেলালো খুব স্বাভাবিভাবেই।তার মতে যাকে যত দাম দেওয়া হবে সে তার মূল্য তত বৃদ্ধি করবে।রবিন ওই এরিয়ার সিসিটিভি ফুটেজ এর একসেস নিয়ে নিজেদের ল্যাপটপে অন করল। সাইফা বসে বসে চেক করছে প্রত্যেকটা চলাচল করা মানুষের একটিভিটি।কেস সম্পর্কে আলোচনায় মগ্ন শাবাব,রবিন। ফাহাদ আর সাইফা তাদের আলোচনার মধ্যে থাকলেও অন্যহাতে কাজ সামলাচ্ছে বটে।ঘণ্টা খানেক এখানেই পাড় করে দেওয়ার পর মানভ ডিসুজাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায়।

সাইফা বললো, -“স্যার মানভ ডিসুজা এসে গেছেন।”

এক মুহুর্ত সময় ব্যয় করেনি।গাড়ি রেখেই বেরিয়েছে। রামশার সাথে আবার যোগাযোগ করলো। রামশা বলে,

-“আধ ঘন্টার মধ্যে আপনারা আসুন।”

শাবাব উত্তরে কিছু বললো না।বিচক্ষণ চোখ গেড়ে আছে রামশাদের বাড়ির দিকে।যেনো পুরো নকশাটা মুখস্ত করে ফেলেছে।সময় পেরিয়ে আধ ঘন্টা। রামশা তাদের আসতে বলে।দ্রুত পায়ে হেঁটে দোতলায় রামশাদের খোলা দরজার সামনে দাঁড়াতেই খানিকটা ভরকে উঠেন মানভ ডিসুজা।

প্রশ্ন করেন, -“কে আপনারা?”

-“ওনারা সি. আই. ডির লোক।”

রামশা পেছন থেকে জবাব দেয়।মেয়ের দিকে ঘুরে চাইলেন মানভ ডিসুজা।একদিকে সি. আই. ডি অন্যদিকে মেয়ে।হিসাব মেলাচ্ছে। প্রশ্নও জাগছে মনে।কেনো এসেছেন তারা এখানে।লোপা ডিসুজারও একই অবস্থা। শাবাব ও রবিন ভেতরে আসে রামশার অনুমতিতে।

মানভ ডিসুজাকে সামনে বসিয়ে শাবাব প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-“জোভান আপনার আর শ্যামলি ডিসুজা এর ছেলে?”

মানভ ডিসুজা নিচু গলায় জবাব দিলেন, -“জ্বি”

শাবাব বললো, -“আসুন শুরু থেকে শুরু করি। শ্যামলি ডিসুজাকে না জানিয়ে বড় ছেলেকে নিয়ে পালালেন কেনো?”

আকস্মিক মানভ ডিসুজা চোখ তুলে তাকান। সারামুখে আশ্চর্য্য।উত্তরে বললেন,

-“পালিয়েছি মানে?আমি কেনো পালাবো আমার সাথে শ্যামোলির মিচুয়াল ডিভোর্স হয়েছে। জোভানের কাস্টাডি আমি পেয়েছি।আর জারা আর জাহিন এর শ্যামলি”

চলবে…

“আ না ম”- ২৮
-Azyah সূচনা

-“পালিয়েছি মানে?আমি কেনো পালাবো আমার সাথে শ্যামলির মিচুয়াল ডিভোর্স হয়েছে। জোভানের কাস্টাডি আমি পেয়েছি।আর জারা আর জাহিন এর শ্যামলি”

মানভ ডিসুজার এমন কথায় রবিন শাবাব উভয়েই অবাক। শ্যামলি ডিসুজার ভাষ্যমতে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে তার ছেলেকে নিয়ে।ডিভোর্স এর কোনো কথা বলেনি।ছেলের খোঁজ করেও তিনি পাননি।

রবিন প্রশ্ন ছুঁড়ে মানভ ডিসুজার দিকে।বলে,

-“ডকুমেন্ট আছে?”

মানভ ডিসুজা জবাব দিলেন,

-“আছে।আমাকে সময় দিন নিয়ে আসছি।”

মানভ ডিসুজা উঠে গেলেন।ঘরের আলমারি থেকে এক একটা ফাইল বের করে তাদের ডিভোর্স আর জোভানের কাস্টাডি এর ফাইল খুজে দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসেন।সবটা নির্দ্বিধায় রাখলেন অফিসারদের সামনে। শাবাব আর রবিন উভয় ফাইল মনোযোগ সহকারে চেক করছে।এখানে শ্যামোলি ডিসুজার বলা মিথ্যে আর মানভ ডিসুজার সত্যটা স্পষ্ট।

-“আপনাদের ডিভোর্সের কারণ?”

মানভ ডিসুজা হতাশ গলায় বলতে লাগলেন, “কারণটা ব্যক্তিগত।পারিবারিক কলহ।আমি শান্তিতে ছিলাম না ওই নারীর সাথে।দুয়েক দিন পরপর আমাদের মধ্যে ঝগড়া হতো।যেকোনো ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে।এমন কোনো বড় কারন ছিলো না। জারা আর জাহিন তখন ছোট।আর কোনো বড় কারণ নেই আমাদের ডিভোর্সের।আমরা যখন বুঝতে পারি সম্পর্কে তিক্ততা এসে পড়েছে দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেই আমরা আলাদা হয়ে যাবো।তিনমাস সময় দেওয়া হয়।আমরা সেই সময়েও চেষ্টা করেছি সব ঠিক করার সম্ভব হয়নি।”

শাবাব সরাসরি বলে উঠলো,

– “আপনার কথাগুলো আমরা কেনো বিশ্বাস করবো?”

মানভ ডিসুজা বললেন,

-“না করাটাই স্বাভাবিক।কারণ পুরুষের মানসিক চাপ না সমাজ বুঝে না আইন। নারীদের জন্য সমস্ত পথ উন্মুক্ত।পুরুষদের জন্য নেই।আমি আমার একটা সন্তানের জন্য লড়েছি।মাসে মাসে বাকি দুই সন্তানের জন্য টাকা পাঠাই।তাদের সাথে দেখা করতাম।কিন্তু সেটাও বন্ধ হয় তিন বছর আগে।”

-“কেনো?” রবিন জানতে চাইলো।

-“সেখানে গেলে শ্যামলির ব্যবহার আমাকে কষ্ট দিতো।আমার মেয়েকে আর ছেলেকে সম্পূর্ণ আমার থেকে সরিয়ে ফেলেছিল।তারা চাইতো না আমার মুখ দেখতে।”

দুজনের দুই রকমের কথার মধ্যে এখনও একটা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।কে সত্য বলছে আর কে মিথ্যে।তবে কিছু অংশে শ্যামলি ডিসুজার মিথ্যে প্রমাণিত ডকুমেন্ট এর মাধ্যমে।প্রতিমাসের খরচ পাঠানোর হিসেবটাও এখানেই আছে।আঠারো বছর অব্দি তার ব্যয়ভার বহন করতে হবে।

শাবাব বললো,

-“আসল কথায় আসি এবার।আপনার ছেলে জোভান।সে যে খুনের খেলায় মেতেছে আপনি জানেন?….অবশ্যই জানেন মিস্টার ডিসুজা”

নিচু গলায় জবাব এলো,

-“আমার ছেলে একজন অপরাধীতে পরিণত হয়েছে এটা আমি জেনেছি।যেদিন থেকে আমাকে হুমকিভরা চিঠি দিতে থাকে।আমি তাকে তার ভালো ভবিষ্যৎ আর মায়ের উস্কানি থেকে দূরে রাখার জন্য সুইডেন পাঠিয়ে দেই।আমার বন্ধুর কাছে।গিয়ে সে আমার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।বন্ধুর ফোনে ফোন করে জানতাম ওর খবর।একদিন হঠাৎ জানতে পাড়ি ওর বাড়ি থেকে টাকা আর অনেক দামী জিনিস নিয়ে পালিয়ে গেছে সে।আমার বন্ধু পুলিশে খবর করতে চাইলে আমি তার কাছে হাত জোড় করি।তাকে বলি তার ক্ষতি পূরণ আমি দেবো।সেখানে পুলিশের কাছে ধরা পড়লে ওর জীবন শেষ হয়ে যেত।”

শাবাব ঠোঁট কামড়ে হাসলো।যেনো কোনো কৌতুক বলেছে মানভ ডিসুজা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-“সেতো নিজের জীবন নিজে নষ্ট করেছে।আর বাকি যতটুকু আছে সেটা আমরা নষ্ট করবো জেলের বাতাস খাইয়ে।”

সন্তান যত বড়ো অপরাধীই হোক না কেনো।বাবা মায়ের মনের কোনো এক কোনায় তাদের জন্য সহানুভূতি থেকেই যায়।চোখ ছলছল করে উঠলো মানভ ডিসুজা এর।

নীরবতা কাটিয়ে রবিন বলে,- “তারপর কি হয়েছে?”

একহাতে চোঁখ মুছে মানভ ডিসুজা বললেন,

-“ছয়মাস পর জোভান আমার সাথে যোগাযোগ করে।সে সম্পুর্ণ ড্রাংক ছিলো।আমাকে কি যেনো আজেবাজে বকছিলো।অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করেছে।তারপর বলেছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালাবো আমি।আমার মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ ব্যবহার করছি।আরো বলেছে যে আমাকেও ছাড়বে না।”

রামশা বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে।লোপা ডিসুজা আজ নতুন করে অনেক কিছুই জানছেন জোভান সম্পর্কে।

রামশা বললো, -“ভাইয়া ছোটবেলা থেকেই জেদী ছিলো।আমি তখন ছোট।আমাকে গলা চেপে ধরতো মাঝেমধ্যে।”

সামনে রাখা পানির গ্লাস থেকে পানি পান করেন মানভ ডিসুজা।তারপর বলতে লাগলেন,

-“আমি তাকে আমার কাছে রেখেছিলাম।যখন তার জেদ সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন ভেবেছিলাম পরিবার থেকে দূরে থেকে বুঝতে শিখবে।একবার কাজের দিকে মনোযোগী হয়ে গেলে জেদ আপনাআপনি কমে যাবে।এটাইতো নিয়ম।দায়িত্ব কাঁধে পড়লে ছেলেরা শুধরে যায়।কিন্তু আমার ছেলেতো অপরাধী হয়ে উঠলো।আমাকে ফোন করে বলে,আমি মানুষের প্রাণ পিপাসু হয়ে উঠেছি।কত মানুষের প্রাণ নিলাম।এখন ইচ্ছে হচ্ছে নিজের বাবাকেও শেষ করে দেই।”

রামশা উঠে যায়। হুমকিভরা চিঠিগুলো তুলে রেখেছিলো।নিয়ে এসে সরাসরি শক্ত মুখে রবিনের সামনে ধরে।রবিন এক পলক রামশার দিকে চেয়ে চিঠিগুলো নিলো।এক একটা পড়ে পরে শাবাবের কাছে হস্তান্তর করছে।

-“পড়ে আপনি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?” শাবাব প্রশ্ন করলো।

-“বাবা হিসেবে বোঝাতে চেয়েছি।ফিরে আসতে বলেছি আমার কাছে।সে আসেনি।উল্টো আমার আর আমার পরিবারের জানের দুশমন হয়ে উঠেছে।শেষ চিঠি দিয়ে সে সুইডেন চলে যায়।আমি এইসব নিতে পারছিলাম না।তাই আমিও রওনা হই সুইডেন এর উদ্দেশ্যে।”

-“জ্বি না মিস্টার ডিসুজা।সে দেশেই আছে।বোকা বানিয়েছে আপনাকে।”

-“আমি সেদিন রামশার কথা বিশ্বাস করিনি।চিন্তায় পড়ে ফিরে এসেছি।”

-“আপনি জানেন আপনার ছেলে কোথায় থাকতে পারে?”

-“আমি জানি না।”

-“আপনিও জড়িত নয়তো এসবে।”

মানভ ডিসুজা বললেন,

-“যত রকমের তদন্ত করতে চান করুন।আমি দরকার পড়লে কো- অপারেট করবো।যদি আমার বিরুদ্ধে তিল পরিমাণও কোনো প্রমাণ পান আমি নিজেকে আপনাদের হাতে তুলে দিতে রাজি।তবে হ্যাঁ এতটুকু বলবো আপনি শ্যামলির কাছে খোঁজ নিন।হয়তো জোভানের খোঁজ পেতে পারেন।বাবা ভক্ত থেকে মায়ের দলে চলে গিয়েছিলো।একমাত্র উস্কানির ফলে।”

শাবাব আর রবিন উঠে দাঁড়ালো।সবটাই শুনেছে।বুঝেছে।জট অনেকটা খুললেও জোভানকে পাকড়াও করা এখন মুখ্য কাজ।

শাবাব বললো,

– “থ্যাংক ইউ মিস্টার ডিসুজা।তবে হ্যাঁ নজরে নজরে আছেন আপনারাও। ব্যাপারটা যেনো মাথায় থাকে।আসি”

জোভানের একটি ছবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শাবাব আর রবিন।তাদের পিছু পিছু নিচ অব্দি গিয়েছে রামশা। শাবাব লক্ষ্য করলো সেটা।মুখ দেখে বোঝা গেলো হয়তো রবিনকে কিছু বলতে চায়।পকেটে হাত গুজে সরে দাঁড়ালো শাবাব।কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো ইচ্ছে তার নেই।

রামশা রবিনের চোখে চোখ রেখে রুঢ় গলায় বললো,

-“আমি আর আমার পরিবার অপরাধী নই মিস্টার রোজারিও।আর হ্যাঁ যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে সম্পর্ক থাকার কোনো মানে হয়না।”

___

এয়ারপোর্ট থেকে আরো একজনকে ঘাড় ধরে আনার পরিকল্পনা।উকিল সাহেব ট্রিপ থেকে ফিরেছেন।আইনের লোক সে।অথচ এত এত বিলাসবহুল জীবন যাপন থেকে অবাক না হয়ে পারছে না শাবাব। সাইফার তথ্যে জানা গেছে আজই নাহিদ শেখ দেশে ফিরেছেন। যে এতদিন বিপক্ষ দল হয়ে কেস লড়ে গেছেন। মিথ্যেকে সাজিয়েছেন সত্য হিসেবে। এয়ারপোর্টে ফাঁদ পেতে বসে থাকা অপরাধ তদন্ত বিভাগের টিম আর পুলিশ কর্মকর্তা। এ্যারিক রোজারিও এর রেফারেন্স হিসেবে তারা এই পদক্ষেপে এগোতে সক্ষম হয়।

এয়ারপোর্টে সাধারণ মানুষের মতন হেঁটে চলা শাবাব চমকে দিলো নাহিদকে। কাঁধে হাত রেখে বন্ধুর মতন পাশে দাঁড়িয়েছে।বিরক্ত হয়ে নাহিদ শাবাবের দিকে চেয়ে বলে,

-“কে আপনি?এভাবে ধরে আছেন কেনো আমাকে?”

শাবাব বোকার মতন মুখ করে প্রশ্ন করলো, “আহা! চেনেননি?আপনার কাছের এলাকার লোক আমি।”

-“হোয়াট ননসেন্স!সরে দাঁড়ান বলছি।”

-“এস. আই শাবাব অপরাধ তদন্ত বিভাগ, চট্টগ্রাম।”

নাহিদের মুখে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।পরিচয় জেনে স্বাভাবিকভাবেই বললো,

-“আমাকে দিয়ে কি কাজ?”

-“কাজতো আপনি করেছেন।তারপর ধামাচাপা দিয়েছেন।”

রবিন এগিয়ে এসে বললো, -“আর আমরা দেই ধামাচাপা পড়া কাজকে পুনরুদ্ধার করতে এসেছি।”

নিজের বিরক্তি আর রাগ দুটোই তীব্র মাত্রায় দেখাতে শুরু করে নাহিদ।কেউই তোয়াক্কা করলো না।তুলে নিয়ে গেছে ঢাকা ব্যুরোতে।

শাবাব কোনো দেরি না করে প্রশ্ন করলো, – “মিথ্যে কেস কেনো লড়েছেন।প্রত্যেকটা কেস আপনি লড়েছেন আর জিতেছেন।ভুক্তভোগী মেয়েদের হুমকি দিয়েছেন।তারপর তারা কেস থেকে সরে গেছে।সব প্রমাণ মিথ্যে তৈরি করে অপরাধীকে জিতিয়ে দিয়েছেন।কেনো মিস্টার নাহিদ?”

নাহিদ তেজী গলায় বললো, -“মাথা খারাপ আপনাদের?ওই মেয়েগুলোই খারাপ ছিলো।নষ্ট মেয়ে।টাকা খাওয়ার ধান্দায় মিথ্যে কেস করেছে।”

রবিন বলল, -“রিয়েলি মিস্টার নাহিদ!একজন উকিলের মুখের ভাষা এমন?”

-“তো কেমন হবে?কেস লড়তে লড়তে জবান ধারালো হয়ে গেছে।আমার দোষ কি?”

শাবাব বারেবারে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টায়।নিজেকে কাবুতে রাখলো।যতই হোক সে একজন উকিল তার কথার মধ্যে থাকবে নানা ছল।

রবিন প্রশ্ন করে,- “আপনাকে কে লড়তে বলেছে এই কেস?”

-“কে বলবে আর যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারাই বলেছে”

তুচ্ছ হেঁসে রবিন বলল, -“অবশ্যই সব কেসে আপনার নামটা কাকতালীয় না।কখনো এই শহরে কখনো অন্য শহরে। সিন্ডিকেটতো অবশ্যই আগে।”

-“আছে হয়তো।যদি প্রমাণ করতে পারেন তাহলে করেন।”

আয়েশী ভঙ্গিতে পিঠ এলায় নাহিদ শেখ।রক্ত টগবগ করছে শাবাবের।অপরাধের সাথে যুক্ত থেকেও এই লোকটার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই।দেশের অপরাধকে প্রমাণ করে শাস্তি দেওয়ার পরবর্তী অপরাধকে আস্কারা দিচ্ছে!

তর্জনী আঙ্গুল দেখিয়ে শাবাব বলে উঠে, – “প্রমাণ পাবো না এটাও ভাবছেন আপনি? আপনার পেছনে যে মাস্টারমাইন্ড আছে তাকে পেয়েছি।আপনি পালিয়ে বেড়াবেন ভাবছেন?”

-“গো এহেড ইন্সপেক্টর।”

রবিন কড়া গলায় জবাব দেয়, -“উই উইল!”

-“আমাকে অযথা এখানে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা দিলে কেমন হয়?”

রবিন আবারো বলে উঠলো, – “চেষ্টা করে দেখুন!”

-“চ্যালেঞ্জ করছেন? বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে কিন্তু।আমার কেস আমি নিজেই লড়বো আপনাদের বিরুদ্ধে।আমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে উকিল মহলে জেনে নিবেন।ভালো থেকে ভালো খারাপ কেস আমার হাতে ধুলো বরাবর।”

নেহাতই কোনো প্রমাণ নেই তার বিরুদ্ধে।তার বিরুদ্ধে একশন নেওয়ার জন্য আনাম নামধারী জোভানকে ধরতে হবে।তারপরই সমস্ত রহস্যের জট খুলবে।জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি থাকলেও আটকে রাখার অনুমতি নেই। অগত্যা ছেড়ে দিলো তাকে।

যাওয়ার পূর্বে নাহিদ শেখ বললো,- “আমরা কিন্তু কিছু নিয়ে দিয়ে ঝামেলা শেষ করতে পারি।কি বলেন এস. আই শাবাব।”

মাথাটা ফেঁটে পড়ছে রাগে।সংযত থাকা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না।এখানে একটা ভুল স্টেপ তাদেরকে আরো পিছনে ঠেলে দিবে।সাইফা দরজা খুলে দিয়ে বুঝিয়ে দিলো নাহিদকে তার জন্য স্থান ত্যাগ করাই ভালো।নাহিদ হাসতে হাসতে চলে যায়।

দেয়ালে ঘুষি দিয়ে নিজের নিজের মেজাজ ঠাণ্ডা করার চেষ্টায়।দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

-“যেদিন প্রমাণসহ হাতেনাতে ধরবো সেদিন ওকে বোঝাবো ঘুষ কত প্রকার ও কি কি!”

হাত বেয়ে রক্ত পড়ছে।জেদের বসে অনেক জোরে হাত মেরেছে দেয়ালে।সাইফার চোখে পড়তেই দৌড়ে যায় সে।অন্য একজন অফিসার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স চেয়ে নিয়ে আসলো।ভীত মুখে শাবাবের অগ্নিচক্ষুর সামনে দাঁড়ালো।

মিনমিনে গলায় বললো, -“স্যার..রক্ত পড়ছে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফার্স্ট এইড বক্সটা সাইফার হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রাখে।চেয়ারে বসে এক হাতে ব্যান্ডেজ করার চেষ্টা করছে।

সাইফা আবার এসে বললো, -“একা পারবেন না স্যার।আমি…দেই? প্রমিস আপনার গায়ে স্পর্শ লাগবে না।”

হাত ঝাড়া দেয় শাবাব।ফার্স এইড বক্স দূরে সরিয়ে হাত রাখলো টেবিলে। সাইফা চেয়ার টেনে বসেছে।বেশ খানিকটা দূরত্ব নিয়ে। ভয়টা এখনও কমেনি।মৃদু কম্পিত হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগলো। খুব সাবধানে।তার হাতের স্পর্শে না আবার শাবাবের হাত ক্ষয় হয়ে যায়।নারীর স্পর্শে বিগলিত না হয়!

চলবে…