আ না ম পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
248

“আ না ম”- ২৯
-Azyah সূচনা

রবিন আর রামশা ফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।আবার চট্টগ্রাম ফিরতে হবে।যাওয়ার পূর্বে একটা শেষ সাক্ষাৎ এর ইচ্ছে পোষণ করেছে রামশা। হৃদয়টা ওজনদায়ক মনে হচ্ছে বেশ। অস্থিরতায় ভরপুর অথচ মুখপৃষ্ট অত্যন্ত স্বাভাবিক। রামশাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যাচ্ছে রবিন অনেক সময় যাবত।দায়িত্ব আর ভালোবাসা দুটোর মধ্যে বিশাল একটা দেয়াল আছে।যা খালি চোখে দেখা যায়না।

রবিন বলে উঠলো,

-“আইনের চোখে সবাই সমান।কথাটি শুনেছো অবশ্যই”

রামশা ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে।বলে,

-“জানি।কিন্তু আমাকে অপরাধীর মতন কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে আলাদাভাবে প্রশ্ন করতে?আমার প্রতি ভরসা নেই?উত্তর দিতাম না আমি?”

-“তুমি নিজে থেকে চাইলেই আমাকে বলতে পারতে।”

-“ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।ভেবেছিলাম আমার বাবাও যদি এই কাজে জড়িত থাকে তোমার বাবা একটা অপরাধী পরিবারের মেয়ের সাথে কোনোদিন বিয়ে দেবে না তোমাকে।”

অন্যদিকে চেয়ে বললো রামশা।ব্যুরোর নিচে এসেছে অনেকক্ষন হলো। একটাবার এর জন্য মুখ ফিরে চায়নি রবিনের দিকে।

-“আমি আমার কাজ করছি রামশা।ঠিক একই প্রশ্ন আমার আমাকে বিশ্বাস করে তোমার ভয়ের কারণটা জানিয়ে দিতে পারতে।”

-“তুমি আমাকে বারবার বলো যাও বিয়ে করে নাও।এরপরও তোমাকে বলবো আমি?”

তাচ্ছিল্যের হাঁসি হেঁসে রবিন বলল,

– “তাহলে আমাকে চেনোনি এখনো।আমার কথার ধাঁচ এত সময় পরও আন্দাজ করতে পারোনি।”

একে অপরকে দায়ী করতে করতে যাওয়ার পালা এসে গেছে। সাইফা এসে ডেকে নিয়ে গেলো।লম্বা পথ।বৃষ্টির কারণে কোনো ফ্লাইট পায়নি।তাছারাও গাড়ি রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। বিষাদগ্রস্ত হৃদয় নিয়ে বিদায় জানায় রামশাকে।জানে না সামনে কি অপেক্ষা করছে। ভবিষ্যতে কি ঘটতে চলেছে।সম্মুখে চাইলে সবটাই ঘন কুয়াশায় ঢাকা মনে হলো।

লম্বাটে পথের অর্ধেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।নিজের অজান্তেই চোখ বুঝে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিলো রবিন।পরপর বিশ্রাম নিয়ে একেকজন ড্রাইভ করছে।আকষ্মিক চিন্তিত পরিবেশ সৃষ্টি হলো বদ্ধ গাড়ি জুড়ে।

সাইফার অস্থির আওয়াজ বলে উঠলো,- “স্যার!”

শাবাব বিপরীতে জানতে চায়, – “কি হয়েছে?”

-“মির্জা স্যার মেসেজ করেছেন।বললেন ব্যুরোতে আরো একটি চিঠি এসেছে।সেখানে লিখা আর মাত্র পাঁচ দিন। বি রেডি ফর টুয়েন্টি থার্ড সেপ্টেম্বর”

শাবাব রেগে গিয়ে বললো,

-“তুমি এজেন্সিতে বলে এসোনি যে কেউ আমাদের জন্য চিঠি দিতে আসলে আমাদের তৎক্ষনাৎ ইনফর্ম করে।”

সাইফা জবাব দিলো,

-“করেছি স্যার কিন্তু আজকের চিঠি অন্য এজেন্সি থেকে এসেছে।”

বিশাল কোনো অঘটন ঘটাবে তেইশ সেপ্টেম্বর। সংকেত দিচ্ছে।শাবাব জোভান এর ছবিটা বের করে নেয়। ফোনে ছবি তুলে নিলো। সাইফাকে সেন্ড করেছে।আদেশ করলো তার ছবি সিক্রেটলি সব থানায় ছড়িয়ে দিতে।তাকে খোঁজা হচ্ছে কোনোভাবে যেনো আচ না করতে পারে জোভান।সাথেই কিছু সিক্রেট ইনফোরমারকে পাঠানো হলো।শান্ত আছে জোভান।কতদিন শান্ত থাকবে কে জানে?পাঁচ দিনের আগে আগে তাকে হাতেনাতে পেয়ে গেলো হয়তো তেইশ সেপ্টেম্বর এর অজানা ঝড় থামানো সম্ভব!

__

“অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল রহস্য,
হৃদয়ে ঘোরে ছিল অজানা গভীর রাজ্য।
কে ছিল মনের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিপালক,
এই অনুভূতি ভেঙ্গে নেবে কোন অনুমান?”

নিশির অম্বর আজ ফকফকে পরিষ্কার।কালো মেঘেরা শশাঙ্কের চারিদিকে গোলাকৃতির মতন আচ্ছাদিত।তারার মেলা স্থির অম্বর জুড়ে।চকচক করছে।সম্পূর্ণ আকাশ, চাঁদ,তারারা চেয়ে আছে নিচের ধরিত্রীর দিকে।আগেই আন্দাজ করেছে তারা।আজ কিছু ঘটতে চলেছে। তেইশ সেপ্টেম্বর এর সন্ধ্যা এসেছে।ছাদ জুড়ে অপরাধীর জন্মদিনের আয়োজন।আয়োজন এর সাজসজ্জা অদ্ভুত। জরি সুতোয় ঝুলানো মৃত মানুষগুলোর ছবি।টেবিলের উপর সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে তিনটি ইনজেকশন। উচুতে ঝুলছে এক জোড়া গাঢ় খয়েরী রঙের লম্বা জ্যাকেট। উঁচু বুট জুতোর তার ঠিক নিচে অবস্থান।বিশাল আকৃতির একটি ছবি ঝোলানো।যেখানে মুখোমুখি দুইজন দাঁড়িয়ে। কারোই মুখ স্পষ্ট নয়।

পায়ের আওয়াজে আয়োজনে মগ্ন থাকা পুরুষটির ঠোঁটে পৈশাচিক হাঁসি ফোটে।শিকার আসছে তার। নিজ পায়ে নিজের মৃত্যুর দিকে।পেছন থেকে এক নারী কন্ঠ বললো,

-“জীবন ভাই?”

নিজের নকল নামটা শুনতে ভালোই লাগে।পিছন ঘুরে চাইলো জোভান।ঠান্ডা,চুপচাপ আর শীতল সবুজ রাঙা চোখের চাহনির মেয়েটি দাঁড়িয়ে। নিরপরাধ তবে অপরাধী।এসব আয়োজন দেখে রীতিমত চোখ গোলগোল হয়ে আছে তার।

জোভান বললো, – “এসেছো আনাম?”

-“আনাম?”

শব্দ করে হেঁসে জোভান বললো,

– “সরি…লিয়ানা।শুভ জন্মদিন বোন”

লিয়ানার মুখে হাঁসিটুকু ফুটলো না।চারিদিকে এই অদ্ভুত আয়োজনগুলো দেখে।আজ তার জন্মদিন।অথচ তার নিজেরও মনে পড়ছে না। গাঢ় খয়েরী রঙের লম্বা জ্যাকেট এর দিকে চোখ গেলো।পরপর বুট জুতোগুলোর দিকে।পাশেই বড় ছবির একটা ফ্রেম টানানো। ফ্রেমটির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় লিয়ানা।এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।একই উচ্চতার দুজন মানুষ।একই রকম পোশাকে।মুখ মোড়ানো কালো কাপড়ে। আপাদমস্তক ঢাকা।অনেকক্ষন চেয়ে থেকে মাথাটা চিনচিন করে উঠলো লিয়ানার।চোখে ব্যথা শুরু হয়েছে।

পিছন ঘুরে চায়।প্রশ্ন করে, -“এরা কারা জীবন ভাই?”

জোভান এগিয়ে আসে। হাঁসতে হাঁসতে থেমে গেলো। রহস্যময় গলায় বলে উঠলো,

“চিনছো না ইন্সপেক্টর লিয়ানা? দেখোতো দুজনকে এক দেখাচ্ছে।দুজন এই সমাজে আলাদা আলাদাভাবে ছড়িয়ে গেলে কেউ ধরতে পারবে কে কোনটা?”

লিয়ানা বোকার মতন মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়,

-“না।কিন্তু এরা কারা?”

ভারী গম্ভীর গলায় জোভান জবাব দেয়,

-“তুমি আর আমি।আমার প্রতিচ্ছবি তুমি।”

-“কি বলছেন জীবন ভাই?” প্রশ্নবিদ্ধ চোখে জানতে চায় লিয়ানা।

জোভান লিয়ানার হাত শক্ত করে ধরলো।টেনে নিয়ে গেলো পাশের টেবিলের দিকে।সাজিয়ে রাখা তিনটে ইনজেকশন দেখিয়ে বললো,

-“প্রথম ইনজেকশন যেটা একজন মানুষকে অত্যন্ত শক্তিশালী আর হিংস্র করে তোলে,অপরাধ এর দিকে ভয়াবহভাবে আকর্ষণ করে।দ্বিতীয় ইনজেকশন যার ফলে মানুষকে খুব সহজে হিপনোটাইজ করা সম্ভব।আর সে যদি হয় তোমার মত সিজোফ্রেনিয়ার পেশেন্ট তাহলেতো সোনায় সোহাগা।আর তৃতীয় ইনজেকশনটা সেই মানুষটির সব অপরাধ,সব হিংস্রতা তার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্তটা একরাত্রির ব্যবধানে মেমোরি থেকে মুছে ফেলতে সক্ষম।”

মাথা ঝিমঝিম করছে লিয়ানার। একটু আগে জোভানের দেওয়া জ্যুস পান করেছে।এরপর থেকেই অদ্ভুত লাগছে তার।মাথা ঘোরানো উপেক্ষা করেই হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের।

বললো,

– “আমাকে এসব কেনো বলছেন জীবন ভাই!আমার মাথা যন্ত্রণা করছে।এসব আমি শুনতে চাই না!”

তেজী হয়ে উঠলো জোভান।লিয়ানার ছোটছোট চুল নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো চট করে।লিয়ানা অবাক চোখে চেয়ে আছে জোভানের দিকে। বিশ্বস্ত মানুষের এমন ভয়ংকর মুখ আগে কখনো দেখেনি।কি হলো তার?

চুল ধরে লিয়ানাকে মৃত মানুষগুলোর ছবির কাছে নিয়ে গেলো। প্রত্যেকটি মানুষকে দেখিয়ে বলতে লাগলো,

-“তুই এদের প্রত্যেকজনের খুনি।নিজ হাতে খুন করেছিস সবাইকে। ঘুরে দেখ।এই জ্যাকেট,জুতো পড়েই মেরেছিস সবাইকে।”

লিয়ানাকে অন্যপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে কার্মিকার গাছের বীজ দিয়ে তৈরি বিষটা দেখালো।আবার বললো,

-“এই বিষ মিশিয়েছিস তাদের খাবারে।আর জানিস এগুলো তুই কার ইশারায় করেছিস?”

চোখ বেয়ে জল ঝরছে লিয়ানার।অস্থির হয়ে উঠেছে। হৃদপিণ্ড অনবরত উঠানামা করতে লাগলো।কাতর গলায় বললো,

-“জীবন ভাই!…আপনি কি বলছেন এসব?”

-“জীবন না! জোভান! জোভান ডিসুজা!….আর তুই কে জানিস আনাম! যার হাতে বারোজন মানুষ খুন হয়েছে।তোকে খুঁজছে পুলিশ”

গলার জোর বাড়িয়ে লিয়ানা চেঁচিয়ে বললো,

– “মিথ্যে বলছেন আপনি!….কাউকে মারিনি আমি।আপনি মিথ্যে বলছেন”

জোভান আরো জোর প্রয়োগ করে।দুর্বল হয়ে পড়ছে লিয়ানা।হাত পা কাঁপছে। জ্যুসে মিশ্রিত ছিলো ড্রাগ।দেহের শক্তি প্রয়োগ করতে চেয়েও পারলো না।

-“আনাম!একজন অপরাধী!একজন সিরিয়াল কিলার!”

-“আপনি আমাকে ব্যবহার করেছেন জীবন ভাই? জীবনে শেষবার একজনকে বিশ্বাস করেছিলাম।ভেবেছিলাম আপনি অন্তত বাকিদের মতন হবেন না।কিন্তু আপনি…”

লিয়ানার গাল চেপে ধরলো জোভান।পুরুষালি হাতের চাপে ব্যাথায় কাতরে উঠতে শুরু করেছে।মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হতে পারলো না। হিংস্র গলায় জোভান বললো,

-“দেখো আনাম কি সুন্দর রাত।কি সুন্দর তারিখ।এক তোমার জন্মদিন আর আজই তুমি এই পৃথিবী ত্যাগ করবে!”

গাড়ির গতি সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।হৃদপিণ্ড এর অবস্থা বেগতিক।বিস্ফোরণ ঘটাবে উঠানামা করতে করতে। শাবাবের হাতে স্ট্যারিং।তিন ঘণ্টা পূর্বে আমন্ত্রণ তারই একজন ইনফরমার খবর দেয়। জোভানকে দেখতে পেয়েছে।তখন থেকেই সকলে থমকে।সেই চিরচেনা আশ্রমে।অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে তারা।আর অল্প কিছুক্ষণ।সকলের মুখে নীরবতা।একেক জন গাড়িতে বসে একেক কথা ভাবছে। আশ্রমের ঠিকানা দিয়ে চিঠি আসার সাথে লিয়ানার সম্পর্ক নেইতো?থাকতেই পারে।যে যার মতন ধাঁধার সমাধান খুঁজতে লাগলো। শাবাবের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।রাতের আঁধারে অতিরিক্ত গতিবেগে ছুটছে দুটো গাড়ি।

লিয়ানা হাঁপিয়ে উঠছে ধস্তাধস্তিতে।জোর করে তাকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার চেষ্টায় জোভান। লিয়ানা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো,

-“আমাকে ছেড়ে দেন জীবন ভাই!”

-“চুপ একদম চুপ!মনে নেই কি করেছিস। হ্যাঁ! যখন তুই অপরাধ তদন্ত বিভাগে ছিলি তখন আমারই একজন সহযোগীকে জেলের ভাত খাইয়েছিস।তাকে ছাড়া এই দেশে আমি কত অসহায় জানিস।তোর জন্য আমি এমন ওষুধ তৈরি করেছি যেখানে তোর ভয়ঙ্কর রূপটা তুই ভুলে যাবি।মনে আছে তোর জীবনের কোনো ভুল?”

লিয়ানা প্রশ্ন করলো,

– “কার কথা বলছেন আপনি?আমি কাকে শাস্তি দিয়েছি?”

-“ডক্টর আলাউদ্দিন।বেআইনি ঔষধ তৈরির দায়ে তুই!তুই ওকে জেলে ঢুকিয়েছিস।আমার সব প্ল্যান তোর জন্য ভেস্তে যেতে যেতে বেঁচে যায়।আমাকে মূর্খ ভেবেছিলি?আমি বানাতে পারি ঔষধ। সুইডেনে ঘাস কেটেছি এত বছর?”

টলমল করা চোখ বড়বড় করে লিয়ানা প্রশ্ন করলো,

-“আপনি জড়িত ছিলেন এসবে!”

-“জেনে কি করবি আনাম?তোকে লিয়ানা থেকে আনাম বানিয়েছি আমি।তোকে স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক বানিয়েছি আমি।আজ তোর মৃত্যুও আমার হাতে।”

ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে বন্দুক বের করে জোভান। রিলোড করে লিয়ানার কপাল বরাবর তাক করলো।ট্রিগারে হাত চেপে আছে। আচমকা নিজের পেশাগত শক্তি দেহে ফিরে এসেছে। শুট করার পূর্ব মুহূর্তে কৌশলে জোভানের হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিলো লিয়ানা।উল্টো তার দিকেই তাক করে ধরে।জোভান হেঁসে উঠে।

আরো একটি বন্দুক বের করে বললো,

– “এবার কি করবি?”

লিয়ানা চোখ বুঁজে নিলো।অনেকদিন পর ট্রিগারে চেপে জোভানের হাত বরাবর গুলি ছুঁড়েছে।গুলির আওয়াজে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মির্জা চমকে উঠলো।দরজা ধাক্কা দিয়ে শাবাব, রবিন,সাইফার এবং ফাহাদ প্রবেশ করে।জমিনে পড়ে আছে জোভান।এখনও জ্ঞান আছে।

অফিসার প্রত্যেক এর হাতে বন্দুক তাক করা।ঠিক বরাবর লিয়ানার দিকে। লিয়ানার হাতে পিস্তল ও জোভানকে জমিনে পড়ে থাকতে দেখে রবিন বললো,

-“ড্রপ ইউর গান লিয়ানা!”

লিয়ানা বন্দুক ফেললো না হাত থেকে।তার সম্মুখে চারজন তার দিকে পিস্তল তাক করে আছে।অপরাধী ভাবছে তারাও তাকে।সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো।বিনা দোষে অপরাধী হয়ে এসেছে সারাটা জীবন।আজ হলে ক্ষতি কিসে?

লিয়ানার কপাল বরাবর নিশানা শাবাবের।হাত কেঁপে উঠছে বারবার।দুর্বল অনুভব করছে। শিরদাঁড়া বেয়ে শিরশির অনুভূতি।কম্পিত গলায় বললো,

-“লিয়ানা নিজেকে সারেন্ডার করুন! আদার ওয়াইজ আই উইল শুট।”

ছাদের একদম শেষ প্রান্তে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে কল্পনা করছে সবকিছু। ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয় সবকিছু?এই পৃথিবীতে সুখের সন্ধানে হেরে গেছে সে। মিথ্যে অপবাদ ঘাড়ে নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু সুন্দর।কেনো বইতে হবে পাপের বোঝা?সে কি সত্যিই পাপী?লিয়ানা আবারো বন্দুক তাক করে অফিসারদের দিকে।

এক কদম পিছিয়ে ক্লান্ত গলায় বলে উঠলো,

-“আমি পরপারে সুখ খুঁজতে যাচ্ছি।যেখানে আমার সাথে অন্যায় হবে না।পৃথিবী আমাকে জানবে একজন অপরাধী হিসেবে। যার কোনো অপরাধ নেই।”

রুহ কেঁপে উঠে আরেকদফা শাবাবের।আগে কখনো বন্দুক তাক করে হাতের কম্পন অনুভব করেনি সে।আজ হচ্ছে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে চিনতে পারছে না।হৃদয় চাইছে না তাকে এখানে দেখতে।আরো নড়বড়ে হয়ে উঠলো হাত। সাইফা ধীরেধীরে এগিয়ে যাচ্ছে জোভানের দিকে।

রবিন বলল, “লিয়ানা আর এক পা পেছনে নিবেন না!”

লিয়ানা চেঁচিয়ে বললো, -“এগোবেন না আমার দিকে। স্বার্থপর! নিষ্ঠুর মানুষ! কার দিকে বন্দুক তাক করে আছেন?হ্যাঁ! জানেন আমার সম্পর্কে?কিছুই জানেন। আমিই কি আসল অপরাধী?”

“আপনি যদি অপরাধী না হলে আপনাকে আমরা সসম্মানে ছেড়ে দিবো।আপনি পেছাবেন না লিয়ানা….. প্লিজ!”

নির্বাক শাবাব।যুদ্ধ চলছে ভেতরে। সাইফা তাদের অমনোযোগী ভাবের সুযোগ নিয়ে জোভানের দিকে এগিয়ে গেলো।তাকে টেনে তুলে। গুলিবিদ্ধ জোভান আকষ্মিক সাইফার চোখে ধুলো দিয়ে শরীরের অবশিষ্ট শক্তি ব্যবহার করে লিয়ানাকে সজোড়ে ধাক্কা দিলো ছাদ থেকে।ধাক্কাটা সামলানো গেলো না।আকষ্মিক চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেলো বিভ্রম নারী অবয়বটি।লিয়ানার পড়ে যাওয়া মস্তিষ্কে ধরার সঙ্গেসঙ্গে হাত থেকে বন্দুকটা জমিনে পড়েছে।কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধ হয়ে রইলো শাবাব।পরপর কোনদিকে না চেয়ে দৌড় লাগায়।একের পর এক সিঁড়ি নেয় নিচে চলেছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে বারবার।মির্জা কিংকর্তব্যবিমূঢ়!তার সামনে জমিনে পড়ে আছে রক্তাক্ত লিয়ানা।কয়েক মিনিটের কম্পনে সম্পূর্ণ নিথর হয়ে যায়।পা জোড়া এগোতে পারলো মির্জাও। শাবাব দৌড়ে এসে থেমে গেলো ঠিক মির্জার পাশ বরাবর।স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শেওলা পড়া চোখের মণি রক্ত লাল।জমাট বেঁধে আছে।রক্ত ছিটিয়ে পড়েছে তার প্রিয় গাছগুলতে।আজও প্রাণহীন চেয়ে মেঘেদের দিকে।বাকিরা এসে হাজির।সাইফা অ্যাম্বুলেন্স কল করে তৎক্ষনাৎ।মূর্তির মতন নিষ্পলক লিয়ানার দিকে চেয়ে থাকা শাবাবের হুশ ফিরে। আধো আধো পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো লিয়ানার কাছে।রক্ত লাল হয়ে উঠছে তার নিজের চোখ জোড়া। মির্জা সাহস যোগায়।পেছন থেকে এসে পালস চেক করলো।নাকের কাছে আঙ্গুল রেখে নিঃশ্বাসটাও চেক করে নিয়েছে।লালাভ নেত্র মির্জার দিকে তুলে দেয় শাবাব।

মির্জা শাবাবের দিকে চেয়ে ভারী গলায় বলল,

– “সি ইজ নো মোর”

মন মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়েছে।এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো লিয়নার মুখের দিকে। রক্তাক্ত অবস্থায়ও মায়াবী লাগছে।নারীর স্পর্শ অপছন্দের তালিকায় এক নম্বরে।আজ নিজেই হাত বাড়ালো লিয়ানার দিকে।সবুজ চোখগুলো হারিয়ে গেছে তরল লাল রাঙা রক্তের মাঝে।এখনও চেয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। শাবাব নিজের হাতের সাহায্যে চেয়ে থাকা চোখ বন্ধ করে দিয়ে সরে গেলো তৎক্ষনাৎ।অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে এগিয়ে আসছে।মিনিট দশেক এর ব্যবধানে নিয়ে যাওয়া হলো লিয়ানাকে।প্রতিবার লিয়ানা দাঁড়িয়ে থাকতো দরজা ধরে। শাবাব বিদায় নিতো।আজ লিয়ানা বিদায় নিচ্ছে। চিরদিনের জন্য।আবারো সাইরেন বাজছে সাথে আশ্রমের বৃদ্ধ আর বাচ্চাদের আর্তনাদ।চাপ সৃষ্টি হচ্ছে হৃদয়ে।পা জোড়া নড়বড় করে উঠছে।চোখের কোণ বেয়ে মরুভূমির বুকে এক ফোঁটা বৃষ্টি নামলো।বড্ড সময়ে এসেছে এই বৃষ্টি। কয়েকদিন আগে এলেই পারতো?সবার কেউ না কেউ আছে।মনের সব উজাড় করে দেওয়ার জন্য। শাবাব কাকে শোনাবে?

সাইফা এসে দাঁড়ালো শাবাবের পাশে।বললো,

-“অপরাধীর মৃত্যুতে সাব ইন্সপেক্টরের চোখে জল! স্ট্রেঞ্জ!”

রক্তিম চোখজোড়া সাইফার দিকে ফিরল। সাইফা তার দিকে আগে থেকেই চেয়ে। বক্র মুখখানা। কৌটিল্য করলো যেনো শাবাবকে।বুকে দুহাত বেঁধে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলা অ্যাম্বুল্যান্স এর দিকে ছলছল চোখে চেয়ে দেখে একবার।

মুখ খুলে আবার কিছু বাক্য বলে,

-“পানি সচ্ছ ছিলো এস. আই শাবাব।ধুলো আপনার চোখে ছিলো।”

শাবাব ফিরে চায় আবার। মোটা চোখে তাকায়। সাইফা কথা বলছে ঠিক লিয়ানার মতন করে।ধাঁধানো।কাব্যিক। শাবাবের এরূপ দৃষ্টি দেখে সাইফা বললো,

-“এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো? লিয়ানা থেকেই শিখেছি এরূপ কথা”

চলবে…

“আ না ম”- ৩০
-Azyah সূচনা

লিয়ানার ঘরটা নীরবে পড়ে আছে।কদম বাড়িয়ে খোলা দরজা বেয়ে ঢুকে পড়লো শাবাব। ঘরের ভেতরে এসে মনে হলো কেউ ঘোর লাগানো কন্ঠে কথা বলে যাচ্ছে।কালো হৃদয় এখনও বিশ্বাস করতে নারাজ।দেহ চলছে শুধু।দেহের মধ্যকার হৃদপিণ্ড আর মস্তিষ্ক সবটাই অচল।শূন্য মনে হলো নিজেকে।কয়েক মিনিটের ব্যবধানে হাকাকার করতে শুরু করছে পুরো আশ্রম। জোভানকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে ফাহাদ।লাইব্রেরির এক কোণে মির্জা। সাইফা আর রবিন আশ্রমের মানুষদের সামলানোর চেষ্টায়।বৃদ্ধ মানুষগুলোর চোখে অশ্রু দেখে চলে এসেছে এখানে।

আবার ব্যর্থ তারা।তাদের চোখের সামনে লিয়ানাকে ঠেলে দিলো মৃত্যুর কোলে।আর তারা চেয়ে চেয়ে দেখেছে।হাতের ব্যাথাযুক্ত স্থানে বারংবার আঘাত করতে লাগলো শাবাব। অনবরত দেয়ালে আঘাত করে যাচ্ছে। অভ্যন্তরের আর্তনাদ বাঘের গর্জনের ন্যায় কন্ঠনালী বেয়ে বেরিয়ে আসে।তাও শান্তি পেলো না।তছনছ করলো লিয়ানার সম্পূর্ণ ঘরকে।টেবিলের এক কোণায় পড়ে থাকা লাল রঙের ডায়রী হাতে তুলে বসে পড়লো ওলোট পালোট করা বিছানায়। ডায়রী হাতে ধরে থাকলেও খুলে দেখার সাহসটা হচ্ছে না।

শক্ত সম্ভ ভেঙেছে শাবাবের।ভেঙে পড়ার আওয়াজ ঠিক পাচ্ছে ভেতর থেকে।নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে বসে,

-“ভালোবাসতাম?”

নিজের প্রশ্নের জবাবে নিজেই বিড়বিড় করে বললো,

-“শেওলা পড়া ভয়হীন চোখযুগল আমি আবার দেখতে চাচ্ছি! ভীষণভাবে দেখতে চাচ্ছি”

রামশা ছুটে এসেছে পরদিন।বাবাকে সাথে নিয়ে এসেছে।এসেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। একই হাসপাতালে দুজন।লিয়ানার বডি দিয়ে দেওয়া হবে কিছু ফর্মালিটি পূরণ করার পর।অন্যদিকে জোভান।গুলি বের করে নেওয়া হয়েছে বডি থেকে।চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সে সুস্থ হয়ে যাবে আশা দিয়েছেন ডক্টররা। রামশার কান্না শাবাবের কান অব্দি পৌঁছালেও একবার ফিরে তাকালো না। নিষ্পলক সামনের দিকে চেয়ে আছে।মূর্তির মতন, নড়চড়বিহীন।

রামশা এক পর্যায়ে রবিনের হাত ধরে বলতে লাগলো,

-“সবকিছুতো জোভান ভাই করেছে রবিন?লিয়ানা কেনো শাস্তি পেলো?”

তিনদিন পর,

লিয়ানাকে তার আশ্রমের সমাধিস্থ করা হয়েছে।ঠিক তার ফুল বাগানের মধ্যিখানে।মির্জা, রবিন,ফাহাদ সবাই মিলে সব কাজ শেষ করেছে।ছিলো না শুধু শাবাব।দূরে দূরে থাকছে সবকিছু থেকেই। হাসপাতাল থেকে শুরু করে কোনো কাজেই একটাবারের জন্য কাছে আসেনি।

জোভান মোটামুটি সুস্থ।তাকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার সময়টা পর্যন্ত দিতে চায়নি শাবাব।তার এবারের রাগটা ভিন্ন। হসপিটালেই তার জবানবন্দী নিজে তাকে হাজতে পাঠানোর সব চিন্তা ভাবনা করে রেখেছে। শাবাবের জেদ এর কাছে হেরে আর একটা দিনের সময় নেওয়া হয়। আগামীকাল জোভানকে তুলে দেওয়া হবে সি. আই. ডির হাতে।

আশ্রমের সিঁড়িতে একাকী বসে সিগারেট এর ধোঁয়া ওড়াতে দেখে মির্জা এগিয়ে আসে।কিছু বলতে চাইলেই শাবাব থামিয়ে দিলো।বললো,

-“কথা বলার মুড নেই আমার যাও এদিক থেকে।”

-“শাবাব শুনো”

-“কিছু শুনতে চাইছি না। জোভান ছাড়া আমার কারো সাথে কথা নেই এখন কোনো।যাও মির্জা!”

সিগারেট এর ধোঁয়ায় কয়লা হৃদয় আরো কয়লা করছে। ভাসা চোখজোড়া বরাবর সোজা চেয়ে আছে। এখানেই আছে লিয়ানা।নিস্তব্ধ,প্রাণহীন। আধ ঘন্টা পর একটি শিশু এগিয়ে এসে বসলো শাবাবের পাশে। পরনে হাফ প্যান্ট আর লাল রঙের টি শার্ট।তাকে দেখে সিগারেট ফেলে দেয় পাশে।বয়স হবে তার ছয় সাত বছর।পা গুটিয়ে বসে শাবাবের দিকে চেয়ে আছে।

শাবাব ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো -“কি?”

বাচ্চাটি বললো, -“তোমার কি মন খারাপ?”

শাবাব স্মিথ হাঁসে।বলে, -“নাহ!”

-“লিয়াপু কোথায় গিয়েছে জানো?তিনদিন আপুকে দেখছি না”

অন্তরস্থলটা বারবার হুহু করে উঠে।তার কথায় সামনে একবার চেয়ে আবার বাচ্চাটির দিকে নজর দিয়ে বললো,

-“ঘুরতে গিয়েছে তোমার লিয়াপু।আসবে সময় হলে”

বাচ্চাটি উদাস মনে উঠে দাঁড়ালো।যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বললো,

-“আপুকে ছাড়া ভালোই লাগেনা একদম!আমাকে সাইকেল কিনে দিবে বলেছিলো।”

__

কাঠের টেবিলের উপরে রেকর্ডার।মাথার উপর জ্বলজ্বল করছে হলুদ বাল্ব।সংখ্যায় অধিক অফিসারদের দিকে চেয়ে আছে জোভান।কোনো অনুশোচনা নেই তার চোখে-মুখে।কোনো গ্লানি নেই।তাদের উস্কে দিয়ে মিটিমিটি হেঁসে চলেছে। শাবাব আর রবিন জোভান এর মুখ বরাবর বসে।একপাশে মির্জা। আরেকপাশে আবির। সাইফা,ফাহাদ উভয়েই দাঁড়িয়ে আছে।

রবিন প্রশ্ন করলো,

-“অনেক হয়েছে খুনের খেলা!এবার বল এসব কেনো করলি?”

জোভান হাঁসলো উত্তর দিলো,

-“ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছি।”

আশ্চর্য্যজনকভাবে শাবাবের কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া নেই।চুপচাপ কান পেতে অন্যদিকে চেয়ে শুনছে।রবিন আবার বললো,

-“এই মানুষগুলোকে কেনো মারলি?”

-“কারণ ওরা অপরাধ করেছে!আর আমি মেরেছি নাকি?মেরেছে আনাম।”

বলে পাগলের মতোন করে হাঁসতে শুরু করে জোভান। শাবাবের রাগটা যেনো রবিনকে ঘিরে ধরছে আজ।জেদ দমিয়ে বললো,

-“রিমান্ডে নিলে ধীরেধীরে সব কথা বের হবে কিন্তু!”

জোভান তীর্যক দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো, -“রিমান্ডে নেওয়ার কি দরকার?আমি আপনাদের ভয় পাই নাকি?মানুষ মারতে দ্বিধাবোধ করিনি আবার স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করবো?”

রবিন বলল, -“তো দেখা সাহস। বল কেনো করেছিস এসব!”

-“আমার বাপ!আমার বাপ আমার মায়ের জীবন নষ্ট করেছে।আমার মা আমাকে কেঁদে কেঁদে বলেছে সব। আমি আমার মায়ের কান্না সহ্য করতে পারি না।আমার আমার বোনটাও চলে গেলো।আমার মা কষ্টে দিন পাড় করছে।আর ওই লোক!আমার বাবা সে দিব্যি সংসার করছে।”

-“মিথ্যে কথা জোভান।তোমার বাবা তোমার ছোট দুই ভাইবোনের ভরণ পোষণ দিতো।এখনও দিয়ে যাচ্ছে।তোমার মা তোমাকে উস্কেছে বাবার বিরুদ্ধে”

আকস্মিক হিংস্রতা ফুটে উঠে জোভানের মুখে। রক্তচক্ষু হয়ে উঠলো।কপালের রগ ফুটে উঠেছে।জবাব দিলো উচু গলায়,

-“মিথ্যে কথা।আমার মায়ের কোনো কথা মিথ্যে না।”

-“মানুষগুলোকে কেনো মারলে?” প্রশ্ন করলো মির্জা।

চেয়ারে পিঠ এলায় জোভান।পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসলো।বলতে লাগলো,

-“ভালো লাগছিলো।জানেন আমি সুইডেনে থাকতাম।এই আশ্রমটা!এটা আমার।পাপ করছি সাথে পূণ্য কামাতে হবে না।পাপ পুণ্যের একটা ব্যালেন্স দরকার।তাই আশ্রমের মালিককে মেরে আশ্রমটা আমার করে নিয়েছি”

টেবিলে জোরেশোরে হাত রেখে রবিন বললো, -“আমাদের এসব প্রহেলিকায় না ফেলে আসল কথায় এসো।”

-“আহহা বলছিতো!আমি সুইডেনে সাত বছর থেকেছি।আমার বাবার বন্ধুর কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর রাস্তায় তিনদিন কাটিয়েছি আমি।এরপর একজন আমাকে আশ্রয় দিলো।সে ছিলো একজন বিজ্ঞানী।এলেক্স ছিলো ওর নাম।সুইডেন এরই নাগরিক। আমার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে কাজ ম্যানেজ করে দিয়েছে।বেতন অনেক ভালো ছিলো। রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম।ছয়মাসের মধ্যে আমি জানতে পারি টক্সিকোলজি অর্থাৎ বিষবিদ্যা সম্পর্কে।সেদিন প্রথম ওই লোককে কার্মিকা গাছ নিয়ে গবেষণা করতে দেখি।তার বাড়িতেই ল্যাব ছিলো।ধীরেধীরে তার গবেষণার অংশ আমিও হয়েছি।দেখতে দেখতে শিখেছি সবকিছু।তারপর আমি তার কাছ থেকে গাছের গাছের বীজ এনেছি।শালার! এয়ারপোর্ট এর লোকেরা এত বোকা।আমাকে ধরতেই পারলো না। তখন থেকে আমার মাথায় একটা জিনিস এলো।আমি ভাবলাম এত সহজে কড়া সিকিউরিটির আড়ালে বিষাক্ত গাছ আনতে পারলে আমিতো আরো অনেককিছুই করতে পারবো।”

শাবাব এখনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি কোনো।চুপচাপ শুনছে শুধু।বাকিরাও জোভানের কথায় মনোযোগী।সে কথা বলতে বলতে থেমে গেলো।মির্জা পূনরায় বলে উঠে,

-“থেমে গেলে কেনো?পুরো উপন্যাস শেষ করে তারপর থামবে!দেশে এসেছিলে সাত বছরের মধ্যে কখনো?”

অনুশোচনাহীন জোভান বলতে লাগলো, -“বহুবার এসেছি।”

-“শেষ কবে এসেছো?”

-“আমি প্রায়ই আসতাম দেশে।শেষ এসেছি দুই বছর আগে।এরপর আর ফিরিনি”

মির্জা বুঝতে পারলো তার মানসিক অবস্থা ঠিক নেই।হিংস্রতায় পূর্ণ তার স্বভাব।আচার আচরণ বিচিত্র।অপরাধ করে কি অবলীলায় বলে যাচ্ছে।রবিন বলে উঠে,

-“খুনগুলোর কারণ জানতে চাচ্ছি!”

-“আপনাদের ইন্সপেক্টর লিয়ানা!বলদ একটা মেয়ে ছিল।এত বোকা কেউ হয়?এই যুগে এত ভদ্র কে হয়?ওকে আমি আশ্রমে ঠায় দিয়েছি,সাহায্য করেছি সে আমাকে তার বিশ্বাসের সবটুকু দিয়ে দিয়েছে।আমি আশ্রম থেকে এক কিলোমিটার দূরে যখন পয়জন এর এক্সপেরিমেন্ট সফল হয় আমি তার উপর এপ্লাই করি।…ওহ হ্যাঁ! তার আগে এই মেয়ে অপরাধ তদন্ত বিভাগে চাকরি করতো।আমার এক সহকর্মীকে সেই ধরেছে।ওর এই কাজটার জন্য আমার কত ক্ষতি হয়েছিলো জানেন!ওর মৃত্যুটা ওর জন্য পারফেক্ট শাস্তি”

নগদে টেবিলের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে কলার চেপে ধরেছে শাবাব। আকস্মিক আক্রমণের কথা বাকিরাও কেউ কল্পনায় আনতে পারেনি। শাবাব মাত্রাতিরিক্ত জেদী গলায় বললো,

-“আর তোর এমন শাস্তি হবে প্রতিদিন নিজে মরতে চাইবি”

জোভানকে ছেড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় বসেছে শাবাব। সাইফা তার মুখের দিকে চেয়ে।পা নাড়াতে নাড়াতে শাবাব বললো,

-“মুখ যেনো না থামে ওর মির্জা।”

জোভান একই সুরে বলতে লাগলো, -“তারপর শুনলাম ওর প্রেমিক ওকে ধোঁকা দিয়েছে।ব্যবহার করেছে ওকে।সম্মান হরণ করেছে। সে তার বিভাগের উচ্চপদস্থ মানুষের কাছে বিচার চাইলে তাকে নাকি চাকরি থেকেই বের করে দেয়। মিথ্যে এলিগেশন লাগায় ওর উপর। সবটাই বলেছে আমাকে কেঁদে কেঁদে”

কথাটি হয়তো জোভানের কাছে কৌতুক স্বরূপ।তাই শেষ বাক্যে আবারো হাঁসে।তার হাঁসিতে গা জ্বলছে রীতিমত সকলের।কতটা নিকৃষ্ট হতে পারে সে?

রবিন প্রশ্ন করলো, -“তারপর?”

-“মেয়েটাকে একবার ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।ডক্টর জানায় সে মানসিকভাবে অসুস্থ। সিজোফ্রেনিয়া নামক একটা রোগ আছে ওর।ওকে সাবধানে রাখতে।মাঝেমধ্যে সে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে।ডুয়াল পার্সোনালিটি ক্যারি করতে পারে একসাথে।পাশাপাশি ভুলে যাওয়ার রোগটাও ওর মধ্যে ছিলো।মাঝেমধ্যে কেঁদে উঠতো।কখনো চুপ হয়ে যেত।একা একা কথা বলতো।নিজের জগতেই সুখ খুঁজতো।কারণ ও ভাবতো এই পৃথিবীতে ওর কেউ নেই।সে একা।আমার মস্তিষ্কের বাতি তখনই জ্বলে।ওর উপর ভালোভাবে আমার এক্সপেরিমেন্ট সফল হবে।ওকে কাজে লাগাই।ওর প্রেমিককে শাস্তি দেওয়ার জন্য উস্কাই।ওকে এই আশ্রমের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে হাত করে নিলাম ওকে।”

একটু পরপর থেমে যায় জোভান।যেনো বিশ্রাম দেয় নিজেকে। শাবাব থমথমে চোখে চাইলো তার দিকে।চিকচিক করছে শাবাবের নেত্রযুগল।আড়াল করতে চাইছে কিছু জেদের আড়ালে। শাবাব জোভান এর দিকে আঙুল তুলে মির্জাকে বলে উঠলো,

-“ওকে বোঝাও মির্জা।কোনো থামাথামির সুযোগ নেই।”

জোভান তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো, -“কেমন দৌড় ঝাঁপের উপর রাখলাম আপনাদের?মজা পেয়েছেন?আমিতো বেশ মজা পেয়েছি আপনাদের দৌড়াদৌড়ি দেখে।”

হুটহাট আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে শাবাব।এবার বন্দুক বের করে রিলোড করে দিলো।উঠে জোভানের পাশে এসে টেবিলে বসলো।বন্দুক কপালে ঠেকিয়ে বললো,

-“শুরু কর আবার।তোকে ক্রস ফায়ার করার অনুমতি আছে।”

-“মৃত্যুকে ভয় পাই না আমি ইন্সপেক্টর!”

আরো চাপ প্রয়োগ করলো জোভানের কপালে।মির্জা চোখ দেখিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে শাবাবকে। জোভান আবার বললো,

-“মাসের পর মাস ওকে আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে আশানুরূপ ফলাফল পেয়েছি। হিপনোটিজম বিদ্যাটা শিখতেও আমার বেশি সময় লাগেনি।ধীরেধীরে আমি সম্পুর্ণ লিয়ানাকে নিজের আয়ত্বে আনি।তাকে নতুন নাম দেই ‘আনাম’।মেয়েটা এত ভালোবাসা কাতর ছিলো যে আমার সব কথা শুনতো!ভাই ভাবতো আমাকে।আমার এত শখ নেই কারো সাথে সম্পর্ক পাতানোর।কিন্তু রিস্ক ছিলো আমি চাইছিলাম এমনিতে সে স্বাভাবিক লিয়ানা রূপে থাকবে।যেনো সে কিছুই জানে না।আর আমার কাজের সময় আনাম।একমাস সময় নেই।ওকে অবজার্ভ করি। ড্রাগ এর মাত্রা বাড়াই।তারপর কি আমি আবার সফল!প্রথম খুন হলো লিয়ানার প্রেমিক!”

শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে, -“তোর বোনের অপরাধী শুধু প্রফেসর ছিলো।তুই কেনো অন্যদের মারলি?তোর শত্রুতা সবই প্রফেসর এর সাথে ছিলো!”

-“জীবনের দাবায় কি সরাসরি রাজাকে এ্যাটাক করা যায়?আগে বাকিদের শেষ করলাম তারপর রাজাকে ধরতে গিয়েও ছেড়ে দিলাম।”

রবিন উচু গলায় প্রশ্ন করলো, -“বাকিদের মারার কারণ কি?”

জোভান উল্টো জেদ দেখানো শুরু করলো, -“আমার বোন চার বছর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসবের স্বীকার হয়েছে।আমি যতবার বোনের সাহায্য করতে চেয়েছি ততবার আমার বোন আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।আমি নাকি স্বার্থপর।আমাকে সহ্য করতে পারতো না সে।খেয়াল করে দেখুন ইন্সপেক্টর আমার বোন মারা যাওয়ার পূর্বে শুধু একটা খুন হয়েছে।বাকিগুলো পরে হয়েছে।”

রবিন পূনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে, -“কেনো?”

-“আমার বোন যে জিনিসের শিকার হয়ে সুইসাইড করেছে।ওই প্রত্যেকটা পুরুষের শাস্তি পাওয়া উচিত।আমি শহর থেকে শহর ঘুরেছি। আর যখনই কোনো মেয়েকে এভাবে ভুগতে দেখতাম আমার মাথা কাজ করতো না ইন্সপেক্টর!আমি পাগল এর মতন ওর জীবনের পেছনে পড়ে যেতাম।আমার মাথা ঠাণ্ডা হতো না ওকে না মেরে।আমার মনে হতো আমার বোন ওখানে।আমি ওই মেয়েগুলোর মুখে আমি আমার ছোট বোনটা,আমার জারাকে দেখতে পেতাম। ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে হতো মায়ের কান্না দেখে। জাহিন এক সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলো জারাকে না পেয়ে।আমার চারিদিকে এত হাহাকার চলতো!আমি কি করবো বুঝতে পারতাম না।আর তাদের খুন না করে আমি স্বস্তি পেতাম না।”

অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে জোভান। মির্জার প্রাথমিক ধারণাটাই ঠিক। সোশিওপ্যাথ এর লক্ষণ।সমাজ বিরোধী আচরণ তার মধ্যে দৃশ্যমান। শাবাবকে হাত দেখিয়ে থামায়।এক গ্লাস পানি এনে তাকে দিলো।অপরাধী এর পাশাপাশি একজন মানসিক রোগী সে। সবদিকটাই বিবেচনা করতে হবে।

মির্জা বললো, -“তুমি অন্য মেয়েদের বিচার করতে গিয়ে একটা নির্দোষ মেয়েকে ব্যবহার করেছো জোভান।তখন তোমার এই নীতি কোথায় ছিলো?”

জোভান অদ্ভুত চোখ করে চায় মির্জার দিকে। ঘাড় বেঁকিয়ে মাতালের মতন করে বলে উঠলো,

-“আমার লোককে কেনো সে জেলে পাঠালো?আমার কাজে বিরাট বাঁধা দিয়েছিল।সফল হতে হতে থেমে গিয়েছিলাম।”

-“সে আইনের কর্মকর্তা ছিলো।ওটা তার কাজ জোভান।তুমি যেটা করছিলে সেটা লিগ্যাল না।”

জোভান দাঁত কামড়ে বলে উঠলো, -“আমার কাছে সব লিগ্যাল।একেক জনকে মারতে মারতে দেখলাম বিদেশি মুভির মতন আমিতো সিরিয়াল কিলার হয়ে উঠেছি।কেউ আমাকে ধরতে পারছে না।মানে আমি না আনাম!তার চাবি আবার আমার হাতে।তাছারাও সবাই ধর্ষক ছিলো না।ভুল ইনফরমেশন দিয়েছি কিছু।আমি চাইলেই মানুষ মারতে পারি।আমি চাইলেই বাঁচিয়ে রাখতে পারি।আমার মধ্যে পুলিশ আর প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব সৃষ্টি হয়।মস্তিষ্কের সমস্ত বুদ্ধি খাটিয়েছি। প্রফেসরকে এমন মৃত্যু দিতে চেয়েছিলাম যে ও ওর শেষ সময়ে ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়।কিন্তু পরে দেখলাম সি. আই. ডির এন্ট্রি।আমাকে খুঁজছে।……মানে আনামকে আরকি!বারবার ভুলে যাই।অনেক খোঁজা হচ্ছে অনেক খোঁজা হচ্ছে পাচ্ছেই না।পাওয়ার পথ খোলা রাখলে না পাবে।আমার মনে হলো আমি একটা গেম শুরু করি।”

শাবাব এত সময় চেয়ে ছিলো জোভানের দিকে। কাঁটার মতন বিধছে এই জিনিসটি।যে সামনে লিয়ানার খুনি বসে।অথচ ওকে নিঃশেষ করতে পারছে না। হাত বাঁধা আইনের কাছে। মিথ্যে বলেছে ক্রস ফায়ার এর কথা।আসলেই ক্রস ফায়ার এর অনুমতি থাকলে স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য জোভান জীবিত থাকতো না।

শাবাব প্রশ্ন করলো, -“কি গেম?”

-“আপনারা আমার পেছনে আমি আপনাদের পেছনে। ইন্সপেক্টর শাবাব? গাছে উঠতে জানেন?আপনি জানেন ইন্সপেক্টর সাইফা?”

অদ্ভুত প্রশ্নে কপাল কুঁচকে নেয় শাবাব ও সাইফা উভয়েই। জোভান আবার বললো,

-“আহা!সেদিন জঙ্গলে আমাকে খুঁজতে এসে ঘোরাঘোরি করলেন অথচ গাছের দিকেই তাকালেন না।”

এক এক করে সব প্রমাণ এনে সামনে রাখলো ফাহাদ।একটা চিপ। গ্লাভস,পয়জন,গগলস ইত্যাদি।সবগুলোই দুটো দুটো করলে।রবিন প্রশ্ন করে,

-“এগুলো দুটো কেনো?”

-“আহহা!কত কিছু জানার বাকি আপনাদের।লিয়ানা আর আমি ছিলাম একে অপরের প্রতিচ্ছবি।দেখুন আমাদের দুজনের উচ্চতা এক।রং এক।আর এই পোশাকগুলো পড়লে আমাদের দেখায় এক রকম।আর ভয়েস চেঞ্জ! ঐযে চিপটা দেখছেন?এটায় অটোম্যাটিক রোবোটিক ভয়েস বানাতে পারে।”

শাবাব বন্দুক নামিয়ে ফেলেছিল।আবার কপালে চেপে ধরে।অন্যহাতে ঘাড় চেপে ধরলো।বললো,

-“লয়ার এর কাহিনী বল!”

-“ও আমারই লোক।কেনো আইন শাস্তি দেবে তাদের?আমি দেবো শাস্তি।আমি শাস্তি দিবো।আইন কি করবে?আইন দুয়েকমাস জেল খাটিয়ে ছেড়ে দিবে।ওরা ছাড়া পাওয়ার যোগ্য না।ওদের যোগ্য শাস্তি মৃত্যু।”

-“নিজেকে আইনের চেয়ে বেশি বড় মনে করিস?”

-“হ্যাঁ অবশ্যই!আপনাদের সাথে গেম খেলতে গিয়েইতো লাস্ট মোমেন্ট এ প্ল্যান চেঞ্জ করি। প্রফেসরকে বাঁচিয়ে রেখে।আপনারা কি বলেছিলেন সংবাদ মাধ্যমে?আমাকে দেখে নিবেন,না?আজ কে কাকে দেখে নিলো।আমার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই।আমি বিজয়ী।হেরে গেছেন আপনারা।লুজার আপনারা।লুজার!”

সকলেই চুপ। জোভানকে জেলে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।সব রকমের প্রমাণ তাদের হাতে। ফাহাদ তাকে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইলে জোভান দাড়িয়ে পড়লো।পিছনে ঘুরে বললো,

-“মজার কথা শুনবেন ইন্সপেক্টর?একই বেশ ধরে কখনো আমি খুন করেছি।কখনো ওই পাগল মেয়েটা।আসলাম!তবে মনে রাখবেন জিতেও হেরেছেন আপনারা।আপনাদের চোখের সামনে আমার শেষ শিকারকে মৃত্যু দিয়েছি আমি।”

জোভানকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শাবাব চুল খামচে ঠিক একই জায়গায় বসে।মাথা নত করে। মোটামুটি সবার কাছে স্পষ্ট!লিয়ানার জন্য ক্ষুদ্র অনুভূতি হলেও শাবাবের ছিলো।সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে সাইফার।সে নিজেকে কি করে সামলাবে?লিয়ানার মৃত্যু আর নিজের পছন্দের মানুষকে এভাবে ছন্নছাড়া অবস্থায় দেখে। রেকর্ডারটা নিয়ে চলে গেলো সাইফা।মির্জা এসে শাবাবের কাধে হাত রাখতেই মাথা তুলে শাবাব।

বলে, -“আমাকে একটু একা থাকতে দিবে মির্জা?বেশি না পাঁচ দিনের জন্য। ব্যুরোর বাকি কেসগুলো সামলে নিও?আমি বাড়ি যাবো একটু”

চলবে…

“আ না ম”- ৩১
-Azyah সূচনা

লিয়ানার ডায়রী~

প্রথম পৃষ্ঠা,
“জীবনে প্রথম ডায়রী লিখছি।কি লিখবো জানি না। এলোমেলো কিছু কথাই লিখে রাখি।যদি বেঁচে থাকি অনেকবছর পর দেখবো আর হাসবো।মানুষ তারিখ লিখে রাখে। সেদিনটায় তার সাথে ভালো খারাপ যাই হয়েছে মনে রাখার জন্য।আমি ক্লাস নবম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী।এইতো দুদিন হলো ক্লাস শুরু হয়েছে।আমি আমার সহপাঠীদের দেখেছি সবার কাছে একটা ডায়রী আছে।তাই আমিও কিনে নিয়ে এসেছি।তাদের জিজ্ঞেস করেছি ডায়রীতে কি লিখতে হয়।তারা কেউ আমাকে বললো না কেনো জানি।তারা আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলেনা।পছন্দ করেনা হয়তো।এড়িয়ে যায় বারবার।আমি ভালো স্টুডেন্ট নই বলে।আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর ওদের কাছে যাবো না।আমাকে অপছন্দ করে অযথা!আমি কেনো ওদের সাথে মিশবো?আমি সারাদিন পরিশ্রম করার পরও যদি ভালো রেজাল্ট না করতে পারি এতে আমার কি দোষ?চেষ্টা করিতো!…….উম!আজ কোনো কথা মনে পড়ছে না।কি যেনো লিখতে চেয়েছিলাম।ভুলে গেছি।আজ এই পর্যন্তই।”

দ্বিতীয় পৃষ্ঠা,
“অনেকদিন পর লিখছি।এতদিন পরীক্ষার চাপে লিখতে পারিনি।আজ রেজাল্ট দিয়েছে।এই নিয়ে মন ভীষণ খারাপ। হেড মিস্ট্রেস আমার বাবা মাকে ডেকে আমার কথা বলেছেন। দুটো সাবজেক্টে ফেইল এসেছে আমার।…..কিন্তু আমিতো ভালোভাবেই প্রিপারেশন নিয়েছিলাম।কেনো ফেইল আসলো বুঝলাম না।বাবা মাকেও বুঝাতে পারছি না।তারা ভীষণ রেগে আছেন।রেগে গিয়ে খাবারটা অব্দি দিলেন না।খারাপ লাগছে আমার।কান্না পাচ্ছে।আমি কেনো চেষ্টা করেও পারছি না।আমার চেষ্টাগুলো বারবার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।আমি কাউকে বোঝাতে পারছি না আমার ভেতরকার অবস্থা।”

তৃতীয় পৃষ্ঠা,
“আমি আজ আমার আপুর সম্পর্কে লিখবো।বাবা মায়ের প্রথম আর আদরের সন্তান।বাবা মা তাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন।আপু খুব মেধাবী।আমাদের কুড়িগ্রামে সেই একমাত্র মেয়ে।সবাই তাকে খুব ভালো জানে।আমাকেও চেনে।কিন্তু আপুর মতন নয়।কারণ আপুতো ফার্স্ট ক্লাস স্টুডেন্ট।আপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট দিয়েছে।ভালো নাম্বারে পাশ করেছে সে।বাবা মা ভীষণ খুশি আজ।পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে রেঙ্কিং ওয়ান। আজ বাবা হেঁসে হেঁসে বললেন “আমার বড় মেয়ে নাম উজ্জ্বল করছে।আর ছোটোজন ডুবাচ্ছে।”আমার খারাপ লাগলো কথাটি কিন্তু বাবা,মা আর আপুকে দেখে ভাবলাম দুষ্টুমি করে বলেছেন হয়তো।তাদের মতই হেঁসে উড়িয়ে দিয়েছি।বাবা মায়ের কথা ধরে বসে থাকলে হয়?…. আমি না কখনো তাদের হাসি ঠাট্টা আর আলোচনার অংশ হতে পারিনি।একটা দূরত্ব আছে আমাদের মধ্যে।”

চতুর্থ পৃষ্ঠা,
“আপুর চাকরি হয়েছে।আজও সবাই ভীষণ রকমের খুশি।বাবা মিষ্টি বিতরণ করেছেন পুরো এলাকায়।আমিও খুশি।কিন্তু আপু চলে যাবে কিছুদিন পর ঢাকা।এই ভেবে খুশির সাথে সাথে মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।আপুর কাছে গেলাম। জড়িয়ে ধরতে চাইলাম।আপু আমাকে কষ্ট দিয়ে বললেন, “গায়ে হাত দিবি না। ওসব আলগা দরদ আমার পছন্দ নয়।তোর জন্য বাবা মায়ের নাক কাঁটা যাচ্ছে।মানুষ প্রশ্ন করে আপনার বড় মেয়ে এত ভালো ছোট মেয়ের এই অবস্থা কেনো?না পড়ালেখা পারিস ভালোমত না কোনো কাজ।জানিস শুধু মিথ্যে ভালোবাসা দেখিয়ে অ্যাটেনশন নিতে। অকর্মার ঢেঁকি!যা এখান থেকে”
এই কথাটা বাবার কান পর্যন্ত গেলো।বাবা তখন বলেছিলেন, “আমার টাকা জলে ঢেলেছি।ওকে এসব বলে কোনো লাভ নেই।তুই তোর কাজ কর রিয়ানা।”
আমি ভীষণ কষ্ট পাই।বাবার কাছে গিয়ে বললাম, “বাবা আমারতো এখনও চাকরি করার বয়স হয়নি।আমার সময় আসলে আমিও আপুর মতন ঢাকায় চাকরি করবো।তোমাদের নাম উজ্জ্বল করবো।”
ঠিক তখনই বাবা আমাকে চমকে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন।অনেক সময় পর হাঁসি থামিয়ে বলেন, “সেই নমুনা এখনি দেখে যাচ্ছে।”
আমি হয়তো আমার বাবা মায়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারিনি।আমারই দোষ।সারাদিন ঘরে পড়ে না থাকে বাবা মায়ের সাথে গল্প করা উচিত।যেমন আপু করে।”

পঞ্চম পৃষ্ঠা,
“ডায়রীতে ধুলো জমেছে।প্রায় দুইমাস পর লিখতে বসেছি।আমার মা প্রচন্ড রকমের অসুস্থ ছিলেন কিছুদিন।আপু নেই। আমাকেই ঘরের সবটা সামলাতে হয়েছে।ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম আমি।তবে কিছু জিনিস এই কিছুদিন লক্ষ্য করলাম।আমি সারারাত জেগেছি এই ক’টা দিন।কেঁদেছি মায়ের জন্য।পুরো ঘরটা একা হাতে সামলেছি।এতকিছুর পর আমিও ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি।বুঝতে দেইনি মা বাবাকে।এরপর আমার মায়ের কোমড় ব্যথা বাড়লো।আমি তখনও সারারাত জেগেছি।আপু বারবার ফোন করে খবর নিয়েছেন।অনেক টাকা পাঠিয়েছে কিন্তু নিজে আসেনি।মা অসুস্থ শুনে আমাদের আত্মীয়রা আসে আমাদের বাড়ি।আমার বাবা মা দুজনই বড় আপুর তাদের নিয়ে চিন্তা আর টাকা পাঠানোর কথা গর্ব করে বলতে লাগলেন।আমি ভাবলাম দ্বিতীয়তে আমার নাম আসবে।আমি মেহমান যাওয়া অব্দি হাসি মুখে অপেক্ষা করেছি।আমার নামটা আসেনি।তারা চলে গিয়েছিলেন।আর আমি তখনও অপেক্ষারত ছিলাম।”

ষষ্ঠ পৃষ্ঠা,
“মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।দেহে শক্তি আর ধৈর্য্য বাকি নেই।বছর খানেক পর ডেইরীটা খুঁজে পেলাম।ইন্টার প্রথম বর্ষে এগোতে এগোতে ডায়রী লেখার শখটা মিটে গিয়েছিল।আজ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মন নিয়ে এসেছি।গতরাতে ভেবেছি নিজের জীবনটা নিয়ে।নিজের কাছে কিছু প্রশ্ন করেছি।যেদিন থেকে বোধশক্তি এসেছে সেদিন থেকে এই মুহূর্ত অব্দি রাতভর ভেবে এই পরিণতিতে পৌছালাম যে।আমাকে উপেক্ষা আজ থেকে করা হচ্ছে না।আমাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে অনেক বছর আগ থেকে।শুধু বুঝতে শিখেছি দুয়েক বছর হলো।আমি প্রথমে শুধু ভাবতাম আমার খারাপ রেজাল্ট এর কারণে আমার সহপাঠীরা আমাকে পছন্দ করেনা।ভুল!আমার আপন মানুষও আমার আপন না।তারা আমার কাছ থেকে কি চায় আমি বুঝতে পারিনা।আমি মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো নাম্বারে পাশ করেছি।কিন্তু আমার বাবা,মা,বোন কেউই সন্তুষ্ট হতে পারছেনা কেনো যেনো।আমি এতটা দিন বাবা মায়ের সাথে বন্ধুর মতন সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছি।তারা আমাকে তাচ্ছিল্য করে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে বারবার।আমি তাদের মন মোতাবেক চলার চেষ্টা করছি।আপুর মতন হতে চাচ্ছি বিনিময়ে আমি শুধু উপেক্ষা পেয়ে যাচ্ছি।আমার ভালো কাজ কারো চোখে ঠেকছে না!আমি বুঝতে পারছি না আমার আপন মানুষকে!বাহিরের মানুষকে!তাদের রুক্ষতার কারণ কি?আমি দোষ খুঁজে পাচ্ছি না নিজের।আমি যাই ছুঁয়ে দিচ্ছি সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।আমার কঠোর চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে।আমার দম বন্ধ মনে হয়।আমার মনে হয় এরা কেউ আমার না।আমি নির্জীব!আমি অদৃশ্য!আমি কথাগুলো বলার মতন কাউকে পাচ্ছি না।কাকে বলবো এসব!কেউ শুনতে ইচ্ছুক না। দূরে দূরে ঠেলে দিচ্ছে যত কাছে যেতে চাই।আমি সুখের একটা পরিবার চাই।আমি আমার বাবা মাকে চাই।আপুকে চাই।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে একাকীত্বে!পাগলের মতন ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে হয় এদিক ওদিক।”

সপ্তম পৃষ্ঠা,
“আমার মন খারাপের দিনগুলো কাটছে না।একটা অদৃশ্য বাঁধা দেয়াল আমার,আমার পরিবার আর সমাজের মানুষের মধ্যে।আমি ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।আমাকে তারা পদে পদে অপমান করে যাচ্ছে।আমার ব্যর্থতাগুলো আড়াল করতে আমি নিজে আড়াল হয়ে গিয়েছি।কলেজে কোনো নতুন বন্ধু বানাইনি।আমি জানি তারাও বাকিদের মতন আমার জীবনে অল্পদিনের মেহমান।কিছুদিন পর আমার সঙ্গ তাদের কাছে তিক্ত লাগতে শুরু করবে।আমি দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছি।আমার দুদিন আগে ভীষণ খারাপ লাগছিলো।মনে হচ্ছিলো আর পারছি না।এই বুঝি মারা যাবো।দৌড়ে গেলাম ভরসা স্থল মায়ের কাছে।আচ্ছা? শুনেছি মায়েরা নাকি সন্তানের মুখ দেখে বলে দিতে পারে সব।সেটা কতটুকু সত্য আমি প্রমান চাইছিলাম।মায়ের মুখ বরাবর এসে বসি।সে আমার দিকে চায়নি।একবারেই যে তাকায়নি তাও না।কয়েকবার টিভি দেখতে দেখতে মুখ ঘুরিয়েছে।আমার লটকে থাকা মুখ দেখে সে তো কিছুই বুঝলো না।মায়ের হাত টেনে নিজের কপালে রেখেছি।জ্বর জ্বর ভাব ছিলো।মাকে বললাম ‘ আমার কিছুই ভালো লাগছে না।জ্বর আসবে বোধহয়।’ মা একবার চাইলেন আমার দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে।তারপর বললেন, ‘ নাপা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।ঠিক হয়ে যাবে’। কিন্তু ওই নাপাতে আমার জ্বর কমলেও অশান্তি কমেনি।মাথাটা ভারভার লাগছিলো।বুকের মধ্যে ঝড় উঠছে এমন মনে হচ্ছিলো।নিজে বুঝতে পারছিলাম আমি বারবার কুকিয়ে উঠছি।শক্তি যোগালাম গলায়।কাতর গলায় ডাকলাম মাকে কয়েকবার।আসেনি।উল্টো বিরক্ত হচ্ছিলো আমার ডাকে।”

অষ্টম পৃষ্ঠা,
“আজ কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে নার্সারিতে ফুটফুটে গোলাপ গাছ দেখতে পেয়েছি।বেশ মনে ধরেছে।সাথে বেলি আর ক্যাকটাস। হাতে টাকা হলে কিনে আনবো।আমার বাবা অনেক হিসেবী মানুষ।অযথা টাকা নষ্ট করেননা।আমাকে কলেজে যাওয়ার জন্য পঞ্চাশ টাকা দেন। এই টাকাই ভাড়াসহ টিফিনের কাজ চালাতে হয়।”

নবম পৃষ্ঠা,
“অবশেষে দুইমাস পর গাছ তিনটে কিনতে পেরেছি।গাছ কেনার পাশাপাশি গাছ বিক্রেতার ব্যবহার ছিলো অমায়িক।আমাকে কি সুন্দর করে গাছের পরিচর্যা বোঝালো।বেছে বেছে ভালো গাছ দিয়েছেন আমাকে।আমার পরনে কলেজের পোশাক দেখে দামও কম রেখেছেন।তার আচরণে আমি অবাক হই। যেখানে মানুষ আমাকে অপছন্দ করে সেখানে আংকেল আমার সাথে মলিন গলায় কথা বললেন?মায়ের চোখ বাঁচিয়ে গাছগুলোকে ছাদে রেখে এসেছি।রাতে একবার তাদের গিয়ে দেখে আসবো।”

দশম পৃষ্ঠা,
“আমার গাছে ফুল এসেছে। বেলী এসেছে ঝাঁপিয়ে।আজ আমার উচ্ছাসের কোনো সীমা নেই। ওহ! গোলাপও এসেছে পাঁচটা। ক্যাকটাস গাছটাও খুব সুন্দর।আমি ভেবেছি বাবা মায়ের এনিভার্সিরিতে মাকে মালা বানিয়ে উপহার দিয়ে চমকে দিবো।”

এগারোতম পৃষ্ঠা,
“আজ বাবা মায়ের ছাব্বিশতম বিবাহ বার্ষিকী ছিলো।আপু এসেছে।মায়ের জন্য স্বর্ণের কানের দুল এনেছে।সাথে বাবার জন্য জামা কাপড়।এত দামী উপহারের মধ্যে আমার মালাটা অনেক তুচ্ছ মনে হচ্ছিলো।তারপরও আমি মাকে দিয়েছি।সে মালার ঘ্রাণ শুকে পাশে রেখে কানের দুল পড়ে দেখতে লাগলেন।মালাটা অবহেলায় সোফার এক কোণে পড়েছিল।আমি কুড়িয়ে এনেছি পাপড়ি। ডায়রীতে রাখলাম।”

ডায়রীতে থাকা গোলাপ আর বেলির পাপড়ি গুলো চ্যাপটা হয়ে গেছে। শাবাব হাতের মুঠোয় তুলে নিলো।আবার পড়তে লাগলো।

বারোতম পৃষ্ঠা,
“আজ গাছের সাথে আলাপ করেছি। হিম শীতল বাতাসে হেলে দুলে আমাকে জবাব দিচ্ছিলো।তখন আমার মাথায় চিন্তা এলো। গাছেরও প্রাণ আছে।কিন্তু ওরা মানুষের মতন মুখ ফুটে কথা বলেনা।তাদের কথা বুঝে নিতে হয়।তাদের আমি যত্ন করেছি বিনিময়ে আমাকে ফুল দিয়েছে।তাহলেতো মানুষের চেয়ে এই গাছগুলো ভালো।আকাশের মেঘেরা এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়।তাদের সাথেও ক্লান্ত বিকেলে আলাপন শুরু হয়েছে একটু আধটু”

তেরোতম পৃষ্ঠা,
“কিছুদিন পর ইন্টার পরীক্ষা।কিন্তু আমি অসুস্থ।তিনদিন যাবত জ্বরে ভুগছি।আমি ভীষণ মিস করছি আমার মায়ের স্পর্শ।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে একটু ঘুমাতে পারতাম।”

চৌদ্দতম পৃষ্ঠা,
“ইন্টার পরীক্ষার ফলাফল এসেছে। আশানুরূপ ফলাফল আসেনি।বাবা মায়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছে।বাবা মাকে দোষ দিচ্ছেন।আমাকে অনাথ আশ্রম থেকে না আনলে আজ তাদের এই দিন দেখতে হতো না।আমার গাছগুলো দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেয়।সাথে আমাকেও। বেতের আঘাতে রক্তিম আমার সর্বাঙ্গ আর ক্ষতবিক্ষত অন্তর।আমি আশ্রম থেকে নিজে আসা একটা মেয়ে?যাদের সাথে এতদিন রক্তের সম্পর্ক ভেবে ভালোবাসা ভিক্ষে করেছি তারাতো আমার আসল বাবা মা- ই নয়।সিদ্ধান্ত নিয়েছি চলে যাবো এই অবহেলার চার দেয়াল ছেড়ে”

পনেরোতম পৃষ্ঠা,
“ভাগ্যিস ডায়রীটা সাথে এনেছিলাম!নাহয় আমার গাছগুলোর মতন….আমি ছেড়ে এসেছি সব।যেখান থেকে মা আমাকে এনেছিলেন সেখানেই এসে ঠায় মিলেছে আমার।আশ্রমে।জমানো টাকা,মায়ের হাতের তৈরি একটা কাপড়,আমার প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আর আমাদের একটা ছবি। ব্যাস এর চেয়ে বেশি আমার কিছুই প্রয়োজন নেই।আশ্রমে আমার মতন আরো অনেকে আছেন।যারা পরিবার থাকতেও পরিবারহীন।আজ তাদের সাথে আমার তৃতীয় দিন।আমাকে এতটা আপন করে কেউ কখনো নেয়নি।”

ষোলোতম পৃষ্ঠা,
“কাজ শুরু করেছি।কয়েক টাকা রোজগার হয় এখন।জীবন ভাই সত্যিই আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।তার এই আশ্রমটা আমার নতুন ঘর।এই আশ্রমের মানুষগুলো আমার পরিবার। কিছুদিন আগে অপরাধ তদন্ত বিভাগের সার্কুলার দেখলাম।আমার কাছে ভালো লেগেছে। জীবন ভাইকে জানালাম ব্যাপারটা।সে আমাকে সাহায্য করবে বলে রাজি হয়ে যায়।আমাকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করছেন।দেখি কি হয় সামনে।”

এখানটায় থামলো শাবাব।নিঃশ্বাস আটকে আসছে।মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো বারবার।সামনে মাটির নিচে চাপা পড়া লিয়ানার নিথর দেহের দিকে চেয়ে বলে উঠলো,

“এই জীবন নামের মানুষটাই আপনার জীবন নষ্ট করেছে অফিসার লিয়ানা।”

সতেরোতম পৃষ্ঠা,
“এক বিশাল দুঃখ আর ব্যর্থতার সাগর পেরিয়ে এসেছি। অপরাধ তদন্ত বিভাগে আমার চাকরি হয়ে গেছে।আজ ভীষণ মনে পড়ছে বাবা মাকে আর আপুকে।তাদের জানাতে পারতাম যদি?”

আঠারোতম পৃষ্ঠা,
“জানি না কেমন অনুভূতি এটা।খুশিও আবার কষ্টও।একমাস যাবত আমি আশ্রম থেকে দূরে।কাজের সুবাদে আশ্রমটাও ছাড়তে হলো।আজ মন চাইলো দুর থেকে আপন মানুষগুলোকে দেখে আসি।প্রথম বেতন পেয়েছি।বোরকায় নিজেকে আবৃত করে বাড়ির দিকে গিয়েছিলাম।গিয়ে দেখলাম বাড়িতে হইচই। লাইটিং হয়েছে চারিদিকে।পাশের বড় মাঠে বিয়ের আয়োজন।আপুকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বউ সাজে বসে থাকতে দেখে ভীষণ খুশি লাগছিলো।তার চেয়ে বেশি কষ্ট।আমার বাবা মা আমাকে একেবারে ভুলে গেছে।তবে আমারও কষ্টের দিন শেষ।আমি এখন একজন অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তা।”

উনিশতম পৃষ্ঠা,
“একটা বয়সে মনের মধ্যে প্রেম নামক অনুভূতির মধ্য দিয়ে যায় মানুষ তাই না?আমারও ঠিক এমনটাই মনে হচ্ছে আজ।”

বিশতম পৃষ্ঠা,
“আমি বোধহয় অনেক বছর পর শান্তি নামক জিনিসটা ফিরে পেয়েছি। মনের মতন একটা মানুষ খুঁজে পেয়েছি।”

একুশতম পৃষ্ঠা,
“আজ প্রথমবার সে আমাকে অনুভব করালো আমি কোনো অপ্রয়োজনীয় বস্তু নই।আমি বিশেষ।তার কাছে বিশেষ।আগামীকাল তার বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। শীগ্রই হয়তো এই শান্তিটাকে চিরদিনের জন্য খাঁচায় বন্দী করে নিবো।”

বাইশতম পৃষ্ঠা,
“বারবার কেনো ভুল প্রমাণিত হলাম।আমার সুখ এর সাথে সাথে কেড়ে নেওয়া হলো আমার সম্মান।তিনদিন আমাকে এক ঘরে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়।সেই লোকটা আমাকে! লড়েছি আমি। লড়তে গিয়েছি।আমাকে মানসিক রোগী বানিয়ে আমাকে আবারো শূন্য মরুভূমিতে ফেলে দেওয়া হলো।আইন আমাকে সাহায্য করেনি।না সমাজের মানুষ।আমার চাকরিটাও কেড়ে নিলো।অতঃপর আমি আবার নিঃস্ব। আজ থেকে ছুটি দিলাম মানুষ থেকে!মানুষ বড্ড অকৃতজ্ঞ।”

তেইশতম পৃষ্ঠা,
“ভেবেছিলাম ডায়রী লিখবো না।ওই কালো রাতগুলোর কথা এখানে লিখা।ভয় হয় আমার।দেহের দাগগুলো লুকিয়ে রাখি আমি।আমার সেই রাতের চিৎকার এর কথা মনে পড়ে আজও।নিঃশ্বাস আটকে আসে।সেই আধার হাতে একা বন্দী অবস্থায় মাকে অনেক ডেকেছি।আসেনি।আমাকে কোনোদিন ভালোওবাসেনি সে।আজ আবার লিখেছি।আমার পুরোনো পেশার মানুষ পেয়েছি কিছু।তাদের দেখে বেশ ভালো লাগছে আমার।কিন্তু বলতে পারছি না।একজন আমাকে পাগল বলছে।আমিতো পাগল না।আমার হৃদয়ে হাকাকার।একটাই প্রশ্ন করে -যদি আমিও জীবনে কিছু পেতাম?”

চব্বিশতম পৃষ্ঠা,
“তাদের নাম জেনেছি।
অফিসার শাবাব – উগ্র, বদমেজাজি।শুধু আমার পেছনে লেগে থাকে।অযথা ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়।”

টলমলে চোখ আর অধরের এক কোণে এক টুকরো হাঁসি।নিজের অজান্তে লিয়ানার সাথে করা অহেতুক ঝগড়াটাও ভালো ছিলো।একেবারে হারিয়ে ফেলার চেয়ে মনোমালিন্য ভালো ছিলো।আবার পড়তে লাগলো শাবাব।

“অফিসার রবিন – অফিসার শাবাব যত মেজাজি ঠিক তার বিপরীত অফিসার রবিন।শান্ত,ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ।
অফিসার মির্জা – প্রাণোচ্ছল,প্রানবন্ত এই দুটো বৈশিষ্ট তার অসাধারণ।
অফিসার সাইফা- বোকা একটা মেয়ে।ভালোবাসে কিন্তু বলতে পারেনা।
অফিসার ফাহাদ আর আবির – তাদের বিশেষ কিছু দেখা না গেলেও ভেতরে ভেতরে এই দুজন অনেক দুষ্টু।শুধু অফিসার শাবাবের ভয়ে কিছু বলতে পারেনা।”

পঁচিশতম পৃষ্ঠা,
“সেদিন রামশার কথা বলা হয়নি।এই মেয়েটাও খুব ভালো।আজকাল আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না।যেখানে সবাই আমাকে পাগল ভাবে সেখানে ও আমাকে ভালো বুঝে।কিন্তু আজ আমি ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।ওর থেকে মিথ্যে বলে ইনফরমেশন নিয়েছি।সময় পেলে একদিন ক্ষমা চেয়ে নিবো”

সুযোগটা আর এলো না। ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছেটা অপূর্ণই রয়ে গেছে।হয়তো রামশা জানলে তাকে কোনো কিছু না ভেবেই ক্ষমা করে দিবে।দুই বছর পর ডায়রীটা খুলে দেখার সাহস হলো।দেরি করলো না শাবাব।আজ তার বাবা মা আর বোনও এসেছে এই আশ্রমে।দ্রুত পায়ে এগোয়।বাবার সামনে এসে দাঁড়ায় নত চোখে।খানিক সময় নিয়ে অনেকদিনের চাপা কষ্টের বাঁধ ভেঙে দিল।বিনা বাঁধায় জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। লুৎফর বেইগ আশ্চর্যের চরম সীমায়।

শাবাব কাতর গলায় বলে উঠলো, “সরি বাবা”

চলবে…