#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
২৬।
গরম গরম ধোয়া উঠা চিতাই দুটো প্লেটে সাইড দিয়ে সাজানো আলু ভর্তা.. শ্যামার জিবে যেন জল চলে এলো। সময় ক্ষণ নষ্ট না করে, একটু ছিড়ে ভর্তা মাখাইয়ে পুরে নিলো মুখের ভিতরে। এত গরম গরম খাবার মুখে পুরতে দেখেই ইজহান বলল,
” ঠান্ডা হতে দাও, মুখ পুড়ে যাবে নয়তো!”
শ্যামা ক্যাবলাকান্তের মতো হেসে মাথা নাড়লো। বলল,
” তোমার মনে আছে? আমাদের স্কুলের একজন আন্টি পিঠা বানাতেন যে, রোজ সকাল সকাল ঠিক এমনি.. ধোয়া উঠা আলুভর্তা দিয়ে৷ খেতাম আমি। এত এত মজা লাগতো!”
ইজহান হাসলো,
” হুম। মনে আছে, লাইন লেগে থাকতো স্কুলের সামনে। আমারো অনেক প্রিয় ছিলো। লাস্ট সেই স্কুলেই খাওয়া হয়েছিলো আমার। ”
হালকা একটু শ্বাস নিয়ে আবার বলল ইজহান,
” তবে আজ এক যুগ পড়ে পেটে যাচ্ছে!”
শ্যামা অবাক হয়ে শুধু চেয়ে রইলো ইজহানের দিকে।
তারপর দুজনেই চুপ করে গেল সে।
কিছুক্ষণের মাঝেই ঝালের কারণে হাসফাস করতে লাগলো ইজহান। টিকালো নাক টকটকে লাল টমেটো আর চিকন ঠোঁটে যেন এক দলা রক্তে মাখা-মাখি। শ্যামা এভাবে ইজহানকে দেখে হেসে ফেললো। চিতই স্টেলের আন্টির কাছ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ইজহানকে দিলো। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে শ্যামা..!
” তুমি এতটুকু ঝাল সহ্য করতে পারো না?”
ইজহান কিছু বললো না। চোখ, মুখ, লাল করে ঢক ঢক করে গিলতে লাগলো পানি টুকু। এক নিশ্বাসে শেষ করে, ঝালে ফোপাঁতে ফোঁপাতে বলল,
” খুব মজা পাচ্ছো? না..!”
শ্যামা হাসতে হাসতে বলল,
” হ্যাঁ অনেক। ভাবো তো কেউ যদি এমন অবস্থায় তোমাকে দেখে ফেলে তখন কি কান্ড হবে? খবরের কাগজের প্রথম হ্যাডলাইন হয়ে যাবে,
‘ দেশে হ্যান্ডসাম হান্ট, যার জন্য দেশ না.. বিদেশের কোটি কোটি নারী পাগল, সে বসে পিঠা খাচ্ছে মধ্যে রাতে রাস্তার ধারে….!”
ইজহান চোখ ছোট করে চাইলো শ্যামার দিক। ভ্রু কুচকে বলল,
” যতসব উদ্ভট কথা।”
” এই না না। সত্যি বলছি। এই খবরটি যদি আমি ক্যাপচার করি না… একদম মালামাল হয়ে যাবো।”
ইজাহান এবার হেসে ফেললো। বলল,
” পাগলী একটা!”
মধ্যরাতের অন্ধকার গড়িয়ে প্রভাতের স্নিগ্ধ আবছায়া আলো নেমে এলো। কিছুক্ষণের মাঝেই সূর্যি মামা তার লাল আলোয় রাঙ্গিয়ে দিবে ধরনীর বুক। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এই পৃথিবী কিশোরীর মতো খিল খিল করে হেসে খেলা করবে প্রতিটি বাড়ির উঠান, মাঠ, ঘাট, বড় বড় দালানের ছেদ করবে স্বচ্ছ কাচের জানালা। হাসপাতালের পাশেই থাকা ফ্লাইওভারের কার্নিষ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দুজন কপোত কপোতী। স্থীর দৃষ্ট শূন্য ভুবনের কোনো এক জায়গায়। সাপের মতো পেচিয়ে থাকা রাস্তা ঘাট অস্পষ্ট। মেঘের আব নেমে এসেছে সবুজ ঘাসের বুকে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বুক ভরে শ্বাস নিলো তারা। ফ্লাইওভারে এই মুহূর্তে একটা দুটো গাড়ির আনাগোনা। প্রথবার নিরবতা কাটি মুখ মুখলো শ্যামা,
” আজকের এই সময় গুলো আমি কখনো ভুলবো না!”
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ইজহান তার দাম্ভিক মুখখানা ঘুরলো তার দিকে। মৃদু বাতাসে দুলছে শ্যামার বড় ঘন চুল গুলো। যেন রাতের শেষ ভাগে পৃথিবীর বুক নেমে এসেছে এক পরি। ইজহান শ্যামার কাছে আরো ঘেষে দাঁড়ালো। হাত দিয়ে পেচিয়ে ধরলো শ্যামার মসৃণ কোমর। ইজহানের স্পর্শে কেঁপে উঠলো শরীর হালকা। ইজহানের চোখে চোখ রাখতেই ইজহান বলল,
“আমি-ও..!”
কন্ঠে যেন কি ছিলো ইজহানের। এক রাশ মাদকতায় ভরে উঠলো দুজন। দুজন দুজনের মুখোমুখি আরো কাছে এসে দাঁড়ালো। এক হাত কোমরে আরেক হাত শ্যামার ঘারের পিছন ছুয়ে স্পর্ষ করলো শ্যামার ঘন কালো চুল। শ্যামা আবেশে চোখে বুঁজে নিল। ঠিক সেই সময় তাদের বেধ করে উঁকি দিলো সূযি মামা। রক্তিম লাল আলোয় ভিজিয়ে দিলো সব। ভিজিয়ে দিলো ফ্লাইওভারের উপরে থাকা চুম্বন রত এক যুগলকে। উঁড়ে যেতে থাকা ভোর রাতে পাখির কিচিরমিচির যেন তাদের ভালবাসার জয়গান শুনিয়ে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে… দৃষ্টি এতোই সুন্দর যে ক্যাপচার করে নিলো শ্যামার অগোচরে ইজহান। শ্যামাকে৷ ছবিটি গিফট করবে বলে।
এভাবেই কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়ে গেলো। দুজন দাম্পত্যি ভেসে যেতে লাগলো ভোরের স্নিগ্ধ আলোয়। স্বপ্ন পুরোন হয়ে গেলো শ্যামার তার অগোচরে-ই। সুফিয়ানের সাথে এমনিতো কত স্বপ্ন দেখেছিলো সে। ভোর রাতে সূর্য উদয়ের সময় ঠোঁটে ঠোঁটে কথা বলবে সুফিয়ানের সাথে। কিন্তু কে জানতো? তার স্বপ্ন সত্যি-ই এভাবে পূরণ হয়ে যাবে….! ডুবে যাবে ইজহানের ভালোবাসায়…
ফোনের বিপ বিপ করে ভ্রাইব্রেটের আওয়াজটা শরীরে ঝংকার তুলো। এতখনের ধ্যানখন ভুলে থাকা মানুষ দুজনের মাঝে সম্মতি ফিরে এলো। কিছুক্ষণ আগের কথা ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো শ্যামা। মুচকে হেসে ইজহান ফোনটা তুলতে দেখলো, তার ছোট বোন আয়ানা ফোন করেছে। ইজহানের কঁপালে খানিকটা ভাজ পড়লো। ফোন তুলতেই অপাশ থেকে ভেসে এলো আয়ানার উৎকন্ঠা গলা,
” দাদা ভাই? কই তুমি? দাদিজানের জ্ঞান ফিরেছে। জলদি আসো?”
ভাজ করা কঁপাল দেখে শ্যামা একটু চিন্তায় পরে গেছিলো। পরমুহূর্তেই ইজহানের ঝলমলে করে উঠা মুখের হাসি দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ইজহান ” আসচ্ছি” বলে কল কেঁটে দিলো। অনুভূতিহীন, উদাসীন মানুষটির মাঝে আজ অনুভূতি খুঁজে পেয়েছে সে। ইজহান শ্যামাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” দাদিজানের জ্ঞান ফিরেছে, আমাদের যেতে হবে!”
শ্যামা হেসে মাথা নাড়লো। ১০ মিনিটের মাঝেই৷ পৌঁছে গেলো তারা। সকাল সকাল আরমান, জান্নাত আর মেহরাবে নিজেও এসেছে খবর শুনে। সকলেই আলিয়াকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আলিয়ার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বার বার করে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। এক পলক তার বড় নাতিকে দেখবে বলে।
” ইজহান.. ইজহান কই! আরমান? তোর ভাই এলো না?”
ব্যথায় জর্জরিত আলিয়ার কন্ঠ। তবুও বৃদ্ধ চোখ মেলে অপেক্ষার প্রথর গুনচ্ছে ইজহানের পদর্পণের।
আরমান বলল,
“দাদিজান, ভাই সারা রাত এখানেই ছিলো। হয়তো কোনো কাজে গেছে। চিন্তা করো না এখুনি চলে আসবে!”
আলিয়া মাথা নাড়লো। ঠিক সে সময় ঘরে পা ফেললো ইজহান। দাদিজান বলে জড়িয়ে ধরলো আলিয়াকে। এতক্ষণে যেন মনের ভার হালকা হলো তার। ইজহানের পিছনেই ছিলো শ্যামা। অফিস থেকে আসা কলের জন্য একটু পরেই ভিতরে প্রবেশ করে শ্যামা। বলে উঠে,
” মেডাম আপনি এখন কেমন আছেন?”
ইজহানের দাদি শ্যামার উত্তর দিবে তার আগেই আয়ানা এক প্রকার ছুটে এসে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় শ্যামার গালে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। সময় লাগে কিছুক্ষণ এখানে হলোটা কি? ইজহান যখন বুঝলো সে আয়ানার সামনে এসে ধমকে বলে উঠলো,
” এটা কেমন অভদ্রতা আয়ানা? ”
আয়ানা ইজহানের কথার জবাব না দিয়ে চিৎকার করে বলল,
” এই মেয়ে দাদিজানের কাছে আসবে না। সি ইজ এ মার্ডারার। খুন করতে চেয়েছিলো দাদিজানকে, নিজ হাতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলো। যার জন্য… যার জন্য দাদিজান আজ হাসপাতালে…! ”
বলেই কান্না করে দিলো আয়ানা। শ্যামা হতবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এত… এত বড় অপবাদ। শ্যামা ছলছল চোখে চেয়ে রইলো শুধু ইজহানের দিকে। ইজহানের গম্ভীর মুখটা আরো ঘন কালো হয়ে এলো। শ্যামা বলল,
“বিশ্বাস করো ইজহান আমি কিছু করিনি!”
বড্ড আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে ইজহানের মুখের দিকে শ্যামা। কি বলবে ইজহান? সে-কি এই কথাটা বিশ্বাস করেছে? তাকে? তাকে কি সে এর জন্য ভুল বুঝবে? শাস্তি দিবে? শ্যামা তাকিয়ে রইলো সমানের লম্বাচওড়া দাম্ভিকপূর্ণ মুখখানার দিক। ইজহান এবার পলক ফেলে তাকালো শ্যামার দিক। তার দৃষ্টির অর্থ কিছুতেই বুঝতে পারলো না শ্যামা। যখন ইজহানের ঠোঁট নড়লো…. শ্যামার শরীর বেয়ে নেমে গেলো যেন একটা শীতল বরফ স্রোত……
চলবে,