আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-২২+২৩

0
647

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২২

চারদিকে পিঠার স্টল দেখে পুলকিত হয়ে উঠল তুলি। খানিকক্ষণ আগের ভয়,কষ্ট ভুলে পাশে দাঁড়ানো মানুষটার এক হাত চেপে ধরল শক্ত করে। আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠল,

“এতো পিঠার দোকান? এখানে কি পিঠা উৎসব হচ্ছে ডাক্তার সাহেব? ”

আদ্রর ছোট্ট জবাব,

“হু।”

খুশিতে তুলির চোখ চকচক করতে লাগল। আদ্রর হাতে চাপের প্রভাব বাড়িয়ে বললো,

” জানেন ডাক্তার সাহেব, আমি কখনও পিঠা উৎসব দেখি নি। এতো সুন্দর সুন্দর পিঠাও দেখি নি। ”

আদ্র কোনো প্রকার প্রতুত্তর করলো না। শুধু সূক্ষ্ণ একটা হাসি ফুটিয়ে তুলল অধর কার্ণিশে। প্রাণ প্রিয় বান্ধবী তুলির খুশি দেখে আমরিনের মনে প্রশান্তি জড়ো হলো। আদ্রের উদ্দেশ্যে বললো,

“ভাই,তুলি কে নিয়ে আমি স্টল ঘুরে ঘুরে দেখি?”

সম্মতি জানালো আদ্র। তৎক্ষনাৎ তুলির হাত আঁকড়ে ধরে আরেকটু ভিতরের দিকে চলে এল আমরিন। কিন্তু ভুলবশত একটা ঘটনা ঘটে গেল। আমরিন ও তুলি একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে চেয়ে হাঁটতেই যেনো ভুলে গেল। ফলস্বরূপ তুলি বেসামাল ভাবে ধাক্কা খেল একটা ছেলের বুকের সাথে। ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেল তুলি, আমরিন দু’জনেই। চট করে সরে এলো তুলি ছেলেটার বুকের কাছ থেকে। ব্যস্ত গলায় বললো,

” আ’ম স্যরি। ক্ষমা করবেন ভাইয়া। ভুল টা আমারই, আমি দেখে চলি নি। সত্যি আমি খুবই দুঃখিত। ”

তুলি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে কিছু টা স্থির হলো। বুক প্রচন্ড জোরে ঢিপঢিপ করছে। কি করে এতোটা বেখেয়ালি হতে পারলো? যদি আদ্র দেখে ফেলতো?তুলি নত মস্তক তুলে দেখলো ছেলেটা বাঁকা হেসে নির্নিমেষ চেয়ে আছে তার দিকে। দৃষ্টি টা অন্যরকম। আরেকটু সচকিত নয়ন ফেলতেই চোখে পড়ল পিছনে দাঁড়ানো আরও তিন টা ছেলের দিকে। ছেলেগুলো ওদের দিকেই তাকিয়ে। আদ্র ব্যতীত অন্য পুরুষের এহেন চাউনিতে তুলির গা গুলিয়ে আসতে লাগল। পাথরের ন্যায় সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। না কিছু বলছে,না এক দন্ড নড়ছে। আমরিনের কাছে চাহনি টা ভালো ঠেকলো না। ছেলেগুলো কে কেমন বাজে,বিগড়ে যাওয়া মনে হলো। সামনের ছেলেটা কে মনে হলো বড়লোক উম্মাদ। যার বর্ণনা হলো এমনটা- বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া পোলা। মন মানসিকতা অস্বাভাবিক অর্থাৎ বদ,পাগল,উম্মাদ। তুলির হাত টা চেপে ধরে আমরিন ছেলে গুলো কে পাশ কাটিয়ে চলে এলো। একটা বারও পিছু ফিরে দেখলো না। তবে বাতাসের সাথে মিলিত হয়ে কানে এতটুকু আসলো-” মেয়ে দুইটা জোস।” এরকম এক তিক্ত বাক্যে কান গরম হয়ে উঠেছে আমরিনের। অনুভব করলো মেজাজ প্রচন্ড অগ্নি তেজে জ্বলে উঠেছে। আমরিন নির্বাক থাকল। কথার প্রেক্ষিতে দিল না জবাব। এ মুহুর্তে কোনো প্রকার সিন ক্রিয়েট হোক চায় না। তুলির চোখের, মুখের খুশি বিলীন হয়ে যাবে এতে। দুর্বিষহ হয়ে উঠবে সময়টা। দাঁতে দাঁত চেপে নিচু স্বরে বললো,

” জানোয়ারের দল।”
_________

তুলি ও আমরিন দু’জন মিলে পাটিসাপটা পিঠা কিনেছে। পিঠা দেখে মুখে পানি চলে এসেছে তুলির। কিন্তু আমরিন তাকে খেতে দিচ্ছে না। একটু সবুর করতে বলে মোবাইল বের করলো পার্স থেকে। দু’জন মিলে সুন্দর কয়েকটা সেলফি তুললো। এতোক্ষণ পিঠা খাওয়ার লোভ সামলাতে পারছিল না তুলি,অথচ এখন নিজের হাতের পিঠের বাটি আমরিনের হাত ধরিয়ে দিল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে স্মিত হাসল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে উঠল-,

” মানুষের নিঃশ্বাস একটা সময় সঙ্গ ছাড়ে,স্মৃতি হিসেবে রয়ে যায় ছবির ন্যায় কত-শত মুহুর্ত ও এক আকাশসম বেদনা। ”

আমরিনের পার্সে মোবাইলটা রেখে দিল তুলি। বাটি থেকে পিঠা তুলে মাত্র কামড় বসাবে তখনি কর্ণধার হলো চেনা-পরিচিত স্বর। দ্রুত পিছন ফিরল দু’জনে। আরো একবার হাসি মুখের কথা শুনলো।

” ভাবী আমাদের ফেলে একা একা খেয়ে ফেলছেন,এটা কিন্তু ঘোর অন্যায়। কতো কষ্ট করে হসপিটাল থেকে ছুটে এলাম শুধু আপনাদের জন্য। ”

“ভাবী?” এটা না ডাকলে কী হতো না?অন্তুর মুখে ভাবী ডাক কর্ণপাতে চরম লজ্জা অনুভব করছে তুলি। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো,

” আসলে,,,”

” আসলে নকলে পরে হবে তুলি। আগে পিঠা খাওয়া জরুরি। ”

প্রফুল্ল মনে কথাটা বলে অন্তু তুলির বাটি থেকে পিঠা খেয়ে নিল। তুলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। মস্তিষ্ক বলে উঠল-“এটা কি হলো?শেষমেশ পিঠা তোর পেট ফেলে অন্তু ভাইয়ার পেটে চলে গেল?”
তুলি চমৎকার একটা হাসি হাসল। হাসির কারণ, সামনে আদ্র,নিবিড়, পায়েল,সাগর,রিমি আসছে। ওরা দু’জনে হলুদ শাড়ি পড়ে এসেছে। ওদের আসার অপেক্ষাতেই কি ডাক্তার সাহেব গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন?তুলির হুট করে মনে হলো আদ্র তাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। আদ্রর পাশাপাশি তার বন্ধুমহলও এখন খুব পছন্দের তুলির। পায়েল,রিমি কে বড় বোন হিসেবে খুব ভালোবাসে। পছন্দের মানুষ গুলো কে এমন এক উৎসবে একসাথে পাওয়া সারপ্রাইজ নাহলে আর কি হবে!তুলির এখন ইচ্ছে করছে, ভীষণ ইচ্ছে করছে আদ্র কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। আশেপাশে মানুষের ভিড়ে দমে গেল সদ্য জেগে উঠা ইচ্ছে টা। পায়েল,রিমি এগিয়ে এসে অন্তুর থেকে বাটি ছিনিয়ে নিল। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

“তুলির পিঠে খেয়ে ফেললি পেটুক অন্তু,দেখিস আদ্রর কেলানি না আবার খাস।”

ঢোক গিলল অন্তু। বছর চারেক আগে সাজেকের কেলানির কথা মনে পড়ে গেল তার। সাজেক ঘুরতে গিয়ে ওখানকার এক আদিবাসীর সাহায্যে বিয়ারের যোগাড় করে পুরো এক বোতল সাবাড় করেছিল। বিয়ার খেয়ে মাতলামো করে রুমে গিয়ে পায়েল কে রিমির সামনে বলেছিল,” তোকে একটা চুমু খাবো।” পায়েল তো রাগিণী। রাগ সর্বদা তার নাকের ডগায় উপস্থিত থাকে। অন্তুর অবস্থা বেগতিক দেখে সে নিজে কিছু করে নি বরং কথাটা তুলেছিল আদ্রর কানে। এতে বেচারা অন্তু চুমু তো পেলোই না উল্টো কনকনে শীতের মাঝে সারারাত কটেজের সামনে ঘাসের উপর কাটিয়েছিল শাস্তি সরূপ।

অন্তু অতীব দ্রুত পিঠা কিনে তুলির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

” তুলি ভাইয়া কিন্তু মাত্র একটা খেয়েছি। নাও তার বদলে তিন তিনটা কিনে দিলাম তোমায়।”

অন্তুর কান্ডে তুলির ভীষণ হাসি পেল। কোনে ক্রমেই চেপে রাখতে পারলো না। এই মুহুর্তে উপলব্ধি করলো হাসি চেপে রাখা বড়ই কষ্টসাধ্য। আদ্র এগিয়ে এসে তুলির পাশে দাঁড়ালো। নিচু স্বরে বললো,

” গাড়ির কাছে এসো।”
_____________

সাগর,রিমি দু’জন অন্তু,পায়েলের দুই পাশে দাড়িয়ে আছে। এমনভাবে দু’জন দু প্রান্তে উপস্থিত যেনো চক্ষুদ্বয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলেই দু’জনের হৃদপিণ্ডে ছেদ করে ধারালো কিছু বেরিয়ে যাবে। দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্ব হয়েও আজ দু’জন খুবই অচেনা। দেখা হলেও, আড্ডা হলেও কথা হয় না দু’জনের মাঝে গত একটা বছর ধরে। পাশাপাশি থাকা সত্বেও কথা না বলতে পারার মতো পীড়াদায়ক কিছু কি হয়?এই অসহনশীল পীড়ায় যে ভুগে কেবলমাত্র সেই বুঝে। পায়েল আঁড়চোখে সবটা চেয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠল,

” স্বামী স্ত্রী হয়েও দু’জন কেন দু’জনের মাঝে এতো দূরত্ব আনছিস? তোরা কি ভুলে গেছিস স্বামী -স্ত্রী হওয়ার আগে তোরা বন্ধু। এইবার তো কথা বল দু’জন, মানিয়ে নে সম্পর্ক টাকে। বলতে বলতে আমরা হাঁপিয়ে যাচ্ছি রিমি,সাগর। ভালোবাসা না পাওয়ার আফসোসে তিলে তিলে শেষ হবার আগে শেষ করে দে দূরত্ব। ”

কথাটা সাগরের বুকে গিয়ে বিঁধল। চকিতে তাকাল সে রিমির দিকে। রিমির চোখে চোখ আটকালো ক্ষণিকের জন্য। অস্থির হয়ে চোখ সরিয়ে নিল রিমি। এক মুহুর্তও স্থির থাকতে পারলো না সাগরের সামনে। সে কি করে পায়েল কে বুঝাবে, ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্টে প্রতি রাতের অর্ধেক সময় একাকী আকাশ দেখে পার হয় তার?পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হলো মনের সুপ্ত কোণে জমায়িত কষ্ট কাউকে দেখানো যায় না। যদি কষ্টগুলো দৃশ্যমান হতো তবে হয়তো মানুষ গুণেও শেষ করতে পারত না। রিমির নিকট দীর্ঘ শ্বাস বৈকি কিছুই রইল না।


তুলি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে একা একা। একটু আগে আদ্রর সাথে গাড়ির কাছে এসে জানালো তার তৃষ্ণা পেয়েছে। আদ্র গাড়িতে চেইক করে দেখলো পানি নেই। তুলি কে গাড়িতে বসিয়ে গালে পরশ বুলিয়ে বলে গিয়েছিল গাড়িতে বসে থাকতে। গাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল তুলির। তাই আদ্র যাওয়ার এক মিনিটের মাথায় শরতের নাতিশীতোষ্ণ ভাব অনুভব করতে নেমে দাঁড়ালো গাড়ি থেকে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল। ভিতর থেকে গানের উচ্চ আওয়াজ ভেসে আসছে। পরিবেশ টা জমজমাট হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। তুলি বুঝতে পারছে না আদ্র কেন এখানে নিয়ে এলো। পানি নিয়ে এসে যদি গাড়ির বাহিরে দেখে তাহলে আজ মোবাইলের মতো করে তার হাড়গুঁড়ও ভাঙতে পারে ভেবে ভয়ে আঁতকে উঠল। উল্টো ঘুরে গাড়ির দরজা খুলে বসার জন্য উদ্যোত হতেই একটা হাত তুলির কোমল হাত টা শক্ত করে চেপে ধরল। অজানা ভয়ে বুক টা মোচড় দিয়ে উঠল তুলির। ঘাড়ে গরম,উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ভারি খেতে লাগল। অন্তরস্থ কম্পন নিয়ে তুলি ভয়ে ভয়ে ফিরল। নিমিষেই তুলির চক্ষুকোটর তীব্র ভয়ের প্রলাপে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। পায়ের তলা থেকে শুরু করে সারা শরীরে কম্পন ছড়িয়ে পড়ল। নিস্তব্ধ, বাক্যহীন তুলি। নাসারন্ধ্রে দোলা দিয়ে যাচ্ছে বাজে এক গন্ধ। ভয়ের তাড়নায় তুলি স্তম্ভিত। স্পর্শ টা তুলি কে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। সম্মুখে দাঁড়ানো ব্যক্তি দূরত্ব কমিয়ে আনতেই তুলির অশ্রুভেজা কন্ঠ চিৎকার করে বললো,

” ডাক্তার সাহেব!”

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৩

একটা শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ হাত ছেলেটার হাতের বাঁধন থেকে তুলি কে ছাড়িয়ে নিল। দেহের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তুলি কে চেপে ধরল নিজের প্রশস্ত বুকে। মুখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না তুলির। গভীর স্পর্শে মানুষ টা কে চিনতে একটুও বেগ পোহাতে হয় নি তার। বহু কষ্টে মানুষ টার পিঠে খামচে ধরল শক্ত করে। বুকে মুখ গুঁজে নিরব রইল কয়েক সেকেন্ড। ক্রন্দন মিশ্রিত স্বরে বললো,

” আদ্র, ওই,,,”

কান্নার জোরে গলায় আঁটকে আসতে লাগল একেকটা শব্দ। চেয়েও পারল না কিছু বলতে। হঠাৎ অপরিচিত এক ছেলের বাজে ছোঁয়া সহ্য করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে স্পর্শ করা হাত টা বুঝি কলঙ্কিত হয়ে গেছে। চিরতরে কলঙ্কের দাগ লেগে গেছে শরীরে। ঘৃণায় রি রি করে উঠছে দেহের সর্বাঙ্গ। কষ্টে বুক চিরে আসতে চাইছে দীর্ঘ শ্বাস। তুলি পারল না নিজেকে ধরে রাখতে। তার কিশোরী মন কেঁদে উঠল। আদ্রর পিঠে খামচে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। কান্নার বেগ বাড়তে লাগল ক্রমশ। কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট ধরা গলায় আদ্রের দিকে এক পলকের চাউনি দিয়ে বললো,

” আমার কষ্ট হচ্ছে আদ্র। খুব কষ্ট হচ্ছে । ”

বুক টা ব্যাথায় চিন চিন করে উঠল আদ্রর। তুলির অস্পষ্ট বাক্য টা হৃদয়ের গহীনে সূচালো তীরের মতো গিয়ে গাঁথল। মুহূর্তেই রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল হৃদপিণ্ডের সারা অংশ। রক্ত বর্ণ ধারণ করা নেত্র যুগল ধপধপ করে জ্বলে উঠলো। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল সামনের ছেলেগুলোর দিকে। সেই দৃষ্টিতে কি ছিল তা বুঝা মুশকিল!ছেলে তিনটা ছিটকে গেলো। ঘাম ছুটে গেল সারা শরীরে। কিন্তু সামনের সেই ছেলেটা ভাবলেশহীন। মাতাল হয়ে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে তুলির উপর। তুলি কান্নার চোটে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। কেঁপে উঠছে পুরো শরীর। আদ্রর বুকে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলো,

” আমার হাত,,,আমার হাতে, গলায় ছেলেটা বাজে ভাবে ছুঁয়েছে আদ্,,আদ্র। আপনি স্পর্শ গুলো ধুয়ে দিন না। মুছে দেন। ”

এতোকাল ধরে আগলে রাখা তুলির আকুল কন্ঠে আদ্র দু’চোখ বুঁজে নিল। নিমিষেই চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে কপোল বেয়ে এক ফোঁটা বিষাক্ত অশ্রু স্পর্শ করলো তুলির ঘাড়। নিবিড়ভাবে লেপ্টে রইল তুলি আদ্রের বুকে। কান্নার শব্দ টাও থমকে গেল আকস্মিক। পকেট থেকে ফোন বের করলো আদ্র। সাগর কে কল দিয়ে বললো,

” এখুনি গাড়ির কাছে আয় সবাই। ”

আদ্রের ফোন পেয়ে সবাই বিনা সময় ব্যতীত ছুটে এলো। তুলি কে বিধস্ত অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠল সবাই। আদ্রর ঝাঁঝালো, অগ্নি রূপ দেখে হতবাক সকলে। আমরিন ছেলেগুলো কে দেখে বুঝার বাকি রইল না এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে। মেয়েটার নেতিয়ে পড়া চেহারা দেখে হাহাকার করে উঠল বুক টা। নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল মনে মনে। হয়তো তখন ভাই কে জানানো হলে এতোটা খারাপ পরিণাম দেখতে হতো না। কাঁপা কাঁপা হাতে তুলি কে আদ্রের বুক থেকে সরিয়ে আনতে হাত বাড়ালে আদ্র নিজেই কোলে তুলে তুলি কে গাড়িতে বসিয়ে দিল। আমরিন তড়িঘড়ি করে বসে তুলির মাথা টা আগলে ধরলো হাত দিয়ে। তীব্র ভয়ের ফলে মেয়েটা জ্ঞান হারিয়েছে। ভেঙে পড়েছে মানসিকভাবে।
পায়েল,রিমি ও গাড়িতে উঠে বসল। অন্তুর দিকে চেয়ে আদ্র ভারী গলায় বললো,

” তুলি কে বাসায় নিয়ে যা। ”

অন্তু নির্বিকার ভঙ্গিতে গাড়ি স্টার্ট দিল। নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আদ্র গাড়িটির যাওয়ার দিকে। গাড়ির জানালা দিয়ে যতক্ষণ তুলির অচেতন মুখটা দেখা গিয়েছে ততক্ষণ অব্দি অস্থির চক্ষুদ্বয় নিষ্পাপ চেহারায় স্থির ছিল।সেই সাথে স্থির ছিল হৃদয়ের যন্ত্রণা। না চাইতেও দ্বিগুণ বেড়ে গেল হৃদয়ের সৃষ্ট হওয়া যন্ত্রণা টা। তীক্ষ্ণ একটা বাক্য কর্ণে প্রবেশ করলো দ্রুত বেগে। ছেলেটা মাতাল কন্ঠে বললো,

” কি ব্রো মেয়েটা বেহুঁশ হয়ে গেল?এতো নাজুক! নাজুক তো হবেই,হাত টা তো অনেক কোমল ছিল। ধরতে না ধরতেই আমার নেশা লেগে গেল। পাঠিয়ে দিলে কেন?দু’জন মিলে নাহয় একসাথে ইনজয় করতাম।”

ছেলেটা দুর্বোধ্য হাসল। নিবিড়, সাগরের মস্তিষ্ক রাগে দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল। কিন্তু ওরা কিছু করবে না। দাঁড়িয়ে শুধু দেখবে। আদ্রর কপালের ফুলে উঠা একেকটা রগ জানান দিচ্ছে রাগের তীব্রতা। উজ্জ্বল ফর্সা মুখশ্রী লাল আভায় ছেয়ে গেছে। হাতের রগ গুলোও ফুলেফেঁপে উঠছে। শিরা-উপশিরায় রাগের প্রদাহ,উত্তাপ বয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। ছেলেটার হাত টা ধরে প্রচন্ড জোরে বাঁকিয়ে ধরলো সে। একটা কটমট ভাঙনের শব্দ সবার কর্ণ ছিদ্র ভেদ করে সুর সুর করে ঢুকে পড়ল। ভয়ে সেঁটে গেল পিছনের ছেলে তিনটা। নিবিড়, সাগরের ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত হলো বাঁকা হাসি। ছেলেটা আর্তনাদ করে উঠল ব্যাথার চোটে। মুখের ভাবভঙ্গি বদলে গেল তার। ব্যাথায় বদলে গেল মুখের আভা। হাত ভাঙাতেই থেমে থাকল না আদ্র। ছেলেটা কে মাটিতে ফেলে বেধরম মারতে লাগল। ঠিক কতক্ষণ মারল তার হিসেব নেই। ক্ষণে ক্ষণে রাগ টা বাড়ছে,সেই সাথে বাড়ছে ছেলেটা কে ভস্ম করে দেয়ার ইচ্ছে। ছোট্ট একটা নাইফ বের করে ছেলেটার হাতের রগ কাটতে নিলে নিবিড় আঁটকে দিল। অস্থির কন্ঠে আওড়ালো,

” এমনটা করিস না আদ্র,মরে যাবে।”

নিবিড়ের কথাটা সম্পূর্ণ রুপে অগ্রাহ্য করে ছেলেটার বুকে ছুরির আঁচড় কেটে দিল। ছ্যাৎ করে উঠল ছেলেটার পুরো দেহ। ব্যাথায় বিষিয়ে গেল সারা অঙ্গ। মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল শুধু ফোঁপানোর শব্দ। বাকি তিন টা ছেলে এমন অবস্থা দেখে পালাতেও ভুলে গেল। লড়বড়াতে লাগল পা। সাগর থেমে থাকলো না, বাকি তিনটা কে বেধরম পিটালো। মাটিতে মুখ থুবড়ে কুঁকড়াতে লাগল ছেলে গুলো। আদ্র মাটি থেকে তখন আনা পানির বোতল টা তুলে ছেলেটার মুখের উপর ঢালতে লাগল অনবরত। গাল গড়িয়ে গলা বেয়ে জল ধারা ছেলে টার বুকের কাটা অংশ স্পর্শ করলো। জ্বলন্ত শিখার ন্যায় জ্বলে উঠল জায়গাটা। মনে হচ্ছে যেনো কেউ মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে। পানির জন্য দৃশ্যমান না হলেও ছেলেটার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে যন্ত্রণা মিশ্রিত অশ্রুর বেগে। চোয়াল শক্ত রেখে আদ্র শ্লেষাত্মক স্বরে বলে উঠল,

” আমার তুলা কে কখনও আমি ওর অনুমতি ব্যতীত স্পর্শ করার চেষ্টা করি নি। বছরের পর বছর দূর থেকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটিয়েছি। স্পর্শ করতে বারবার চিন্তা করি আমার তুলার কোমল দেহে আবার ব্যাথা না লেগে যায়। আর তুই তাকেই কষ্ট দিলি?তুই ওর হাত টা দেখেছিলি? আমার তুলার হাতে তোর কলুষিত ছোঁয়ায় লাল ছাপ পড়ে গেছে। তুই ওকে শুধু বাহ্যিক ভাবে নয় মানসিক ভাবে আঘাত করেছিস। ব্লাডি বাস্টার্ড। তুই আমার তুলা কে হার্ট করেছিস। আমার তুলা কে!”

লাস্টের কথাগুলো অস্থির কন্ঠে চিৎকার করে বললো আদ্র। ইতিমধ্যে এখানে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। কারো তোয়াক্কা না করে কঠোর ভাবে আঘাত করতে লাগল ছেলেটা কে। যেনো ছেলেটা মরে গেলেও তার কোনো ভয় নেই।
____________

পিটপিট করে নেত্র যুগল মেলে তুলি নিজের অবস্থান বুঝার চেষ্টা করলো। রুমের পর্দা দেখে বুঝতে বাকি থাকল না এটা আদ্রর রুম। জানালার পর্দা হালকা হাওয়ায় মৃদু মৃদু নড়ছে। তুলি সময়টা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। বাহিরে হালকা অন্ধকারের সমারোহ। দুপুরের কথা মনে পড়তেই চট করে উঠে বসলো তুলি। হাতে টান অনুভব করতেই পাশে তাকাল। চোখের পাতায় ভেসে উঠল কপালে হাত ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় থাকা আদ্র। বাজে সেই মুহুর্ত টা মনে করে তুলির কান্না পেলো। ফুপিয়ে কান্না আটকানোর শব্দ কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হতেই আদ্র উদগ্রীব হয়ে গেল। হাতে টান পড়ায় তাল সামলাতে না পেরে তুলি আদ্রর বুকে গিয়ে পড়লো। আহ্লাদী স্বরে বলে উঠল আদ্র,

” কাঁদছো কেন তুলা?”

প্রতুত্তর করলো না তুলি। মিশে রইল আদ্রর বুকের মধ্যে। কান্নার কারণ টা তো আদ্রর অজানা নয়। সূক্ষ্ণ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল আদ্র। তুলি কে বুক থেকে টেনে বিছানায় শুয়ে দিল। নিজেও শুয়ে পড়ল পাশে। বাম হাত টা হাতের মুঠোয় বন্দী করে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিল গভীর ভাবে। তুলির শরীরের লোমশ খাড়া হয়ে গেল আকস্মিক স্পর্শে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেল লজ্জার শিহরণ। হাতে পরপর ঠোঁটের পরশ বুলিয়ে দিল আদ্র। মুখ এগিয়ে গলার কাছে আনতেই তুলির ভিতরটা কাঁপতে লাগল। অস্বাভাবিক হয়ে পড়ল হৃৎস্পন্দন। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল লজ্জায়। আলতো ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে সরে এলো আদ্র। ম্লান হেসে বললো,

” তুমি প্রত্যেক টা মুহুর্তে আমার স্পর্শ অনুভব করবে তুলি। ”

কথাটায় কি ছিল তুলি জানে না। তবে নতুন এক মিষ্টি অনুভূতির সাথে পরিচয় হলো তার। চোখ বুঁজে কীয়ৎক্ষণ অনুভব করল সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতিটা কে। আঁখি পল্লব মেলতেই নজর ঠেকল আদ্রর হাতের দিকে। নিমিষেই লজ্জিত চোখে ফুটে উঠল সূক্ষ্ণ ব্যাথার ছাপ। আদ্রর হাত টা ধরে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠল,

” আপনার হাতে তো রক্ত।”

” ব্যান্ডেজ করে নিব।”–আদ্রর নিষ্প্রভ স্বর।

তুলি মলিন মুখে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। আদ্র ক্ষীণ হেসে পুনরায় বললো,

” বাহিরে সবাই তোমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় বসে আছে তুলি। তাদের আসতে বলি?”

প্রচন্ড অবাক হলো তুলি। সবাই বসে আছে মানে?আনমনেই মাথা নাড়াল। আদ্র উঠে গিয়ে দরজা খুলতে না খুলতেই সবাই একসাথে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল। এর মধ্যে রাদিফ সাহেব, তৌফিক সাহেব কেউই বাদ যায় নি। রিমি,আমরিন,পায়েল এসে ঝাপটে ধরল তুলি কে। ভালো লাগায় ভরে গেল তুলির আবেগি মন টা। সবার চেহারা বলে দিচ্ছে মানুষ গুলো কতটা ব্যাকুল হয়ে তার অপেক্ষায় ছিল। রক্তের সম্পর্ক না হয়েও জীবনে আপনজনের খাতায় নাম লেখাল। মনে মনে হাজারো ধন্যবাদ জানালো তুলি আদ্র কে। এই মানুষ টা জীবনে না আসলে এতো আপনজন পেতো না কখনও। দূরে দাড়িয়ে আছে আদ্র। ঠোঁটে তার অমায়িক হাসি। তুলি আজকের বিষাক্ত মুহুর্ত টা ভুলে গেল, চিরতরে মুছে গেল মন থেকে। তৃপ্ত হেসে মনে মনে বললো,

” আমার যেনো এই মানুষ গুলোর সাথে দীর্ঘ একটা জীবন কাটানোর সুযোগ হয়। মানুষ গুলোর ভালোবাসায় সিক্ত থাকতে পারি দীর্ঘক্ষণ।”

#চলবে,,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)