আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৮+৯

0
781

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -৮

নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে চারদিক। দূর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। নির্জন পরিবেশ। কিন্তু সমস্ত নির্জনতা কাটিয়ে পরপর চারটি গাড়ি ঢুকল একটা বড় গেইট দিয়ে। তুলি পুরো রাস্তা আদ্রর বুকে ঘুমিয়েছিল তাতে বেশ লজ্জা অনুভব করছে। যদিও ইচ্ছাকৃত তবুও তার লজ্জার কারণ গাড়িতে থাকা বাকি সবাই। পাশে বসেই আদ্র বাহিরে তাকিয়ে আছে। তুলিও আগ্রহ নিয়ে বাহিরে তাকাতেই রাতের আঁধারে চাঁদের মৃদু আলোয় চোখে পড়ল কিছুটা দূরে বড় বড় পাহাড়ের দিকে। পাহাড়গুলো বিশাল বাড়িটার পেছনে দাম্ভিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুলির কাছে এমনটাই মনে হল। কিন্তু বেশ দূরেই অবস্থান তাহাদের। খুশিতে চকচক করে উঠল তুলির দু’চোখ। এতো বড় পাহাড় এর আগে কখনও দেখে নি সে। পাহাড়ি শহর বান্দরবানে এসে তার খুশির মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পাহাড় টা ছুঁয়ে আসতে। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি এক নিমিষেই দূর হয়ে গেল প্রকৃতির সান্নিধ্যে। নির্মল একটা বাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল আদ্র ও তুলির অঙ্গে। চোখ বুঁজে বাতাসে প্রকৃতির ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টায় লেগে পড়ল তুলি যা দেখে আদ্রর চোখে এক রাশ মুগ্ধতা এসে ভর করল। খুশিতে আত্মহারা তুলি আদ্রর বাহু আঁকড়ে ধরে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠল,

‘ আপনারা সবসময় এইখানে কেন থাকেন না ডাক্তার সাহেব?আপনারা এখানে থাকলে তো আমি বারো মাস আপনাদের বাসায় বেড়াতাম।’

তুলির কথা কর্ণপাত হতেই সবাই মিটমিট করে হাসতে লাগল। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। সে তো দৃষ্টি তুলে নিষ্প্রভ চেয়ে আছে আদ্রর ঠোঁটের কার্ণিশে লেগে থাকা হাসির পানে। পিছন থেকে হাসির শব্দে ধ্যান ভাঙল তার। জড়তায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ল তুলি। অন্তু দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল,

‘ তুমি কিন্তু তেরো মাস বেড়াতে পারো তুলি।’

ভ্রু কুঁচকাল তুলি। অবাক স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ তেরো মাসও হয় নাকি ভাইয়া?’

তুলির প্রশ্নে সবাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অন্তুর দিকে। অন্তুর মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে সবাইকে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পেরে। এতোকাল ছিল অবহেলিত, আজ তুলির কারণে বেচারা সবার কাছে পাত্তা পাচ্ছে। কিন্তু রিস্ক নেওয়া যাবে না। কারণ দেখা যাবে জবাবে উৎসুক দৃষ্টি গুলো আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠবে। আর নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে তাহলে অন্তু কেন বুঝবে না?কথাটা ভেবে অন্তু গম্ভীর স্বরে বলল, ‘ আগে নামি,যেতে যেতে বলব।’

পায়েল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেমে গেল,যা দেখে অন্তু বুকে থু থু দিতে লাগল। ‘এই এক মেয়ে যদি পারত তোকে চোখ দিয়েই খুন করত অন্তু। সাবধান ভাই!সাবধান পায়েল ডাকিনীর নিকট হতে।’ বিড়বিড় করতে করতে গাড়ি থেমে গেল অন্তু। বাড়ির ভিতরের দিকে চলে যেতে নিলে পায়েল সামনে এসে হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল। অন্তু অবিশ্বাস্য স্বরে বলে উঠল,

‘ বেবী ইউ ওয়ান্ট টু হাগ মি?আই কান্ট বিলিভ দিস।’

কথাটা বলেই যেই না পায়েল কে জড়িয়ে ধরতে যাবে পায়েল ধুম করে এক ঘুষি দিল অন্তুর বুকে। বেচারা অন্তু ‘আহ্’ শব্দ করে ছিটকে এল। ততটা ব্যাথা না পেলেও করুন চাহনি নিক্ষেপ করল পায়েলের উপর। হাসতে হাসতে গাড়ি থেকে নেমে এল সবাই। বাড়ির কাজের লোক এগিয়ে এসে ব্যাগ গুলো নিয়ে গেল ভিতরে। আদ্র আমরিনের কাছ থেকে জারিফা কে নিজের কাছে নিয়ে নিল। মেয়েটা এতো ঘুৃম কাতুরে, সারা রাস্তা ঘুমোতে ঘুমোতে এসেছে। এখনো আদ্রর কাঁধে মাথা রেখে গলা জড়িয়ে ঘুমে মগ্ন। পায়েল রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ ঢং না করে তুলির কথার জবাব দিয়ে যা। অনেক তো জিনিয়াস আপনি ফেলটুস ডাক্তার অন্তু। কাইন্ডলি বলে যান তেরো মাস কিভাবে হয়?’

‘ বারো মাসের সাথে এক মাস যোগ করলে তেরো মাস। একদমই সিম্পল।’

অভিজ্ঞদের ন্যায় ভাব নিয়ে প্রতুত্তর করল অন্তু। তুলি ফিক করে হেসে দিল। হাসতে হাসতে আদ্রর বাহুতে মাথা ঠেকাল। অন্যদিকে সাগর,রিমি,নিবিড়,আমরিনও হেসে কুটিকুটি। পায়েল ভাবুক স্বরে বলে উঠল,

‘ ওহ আচ্ছা তাই নাকি ফেলটুস ডাক্তার? আপনার মতো জিনিয়াস কে তো সম্মাননা প্রদান করা নাহলে আমাদের মতো ডাক্তারদের জীবনটাই তেজপাতা।সুতরাং,,,,,,,আমি আপনাকে কিছু দিতে চাই। ‘

পায়েল শয়তানি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। অন্তু আঁড়চোখে একবার পরখ করে নিল পায়েলকে। সুবিধা ভালো ঠেকছে না তার কাছে। হয়তো রক্ত চুষার প্রস্তুতি নিচ্ছে মেয়েটা। অন্তু ওয়ান, টু, থ্রি বলে দৌড়ে এসে পায়েল কে ধাক্কা দিয়ে পালাতে লাগল। পায়েল মাটিতে পড়ে গিয়ে রাগে,অভিমানে চিল্লিয়ে উঠল,’অন্তুর বাচ্চা সন্তু!আই কিল ইউ।’

অন্তু পিছন ফিরে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে বলল,’ আই কিস ইউ।’

হু হু করে আরেকদফা হেসে উঠল সবাই। তুলির সাথে হাঁটতে হাঁটতে রিমি বলল,’ ওরা দু’জন এতো বড় হয়েছে তবুও বাচ্চা। একসাথে হলেই দ্বন্দ্ব। কিন্তু জানো তুলি দু’জন আবার দু’জন কে না রাগানো ছাড়া একটা মুহুর্তও থাকতে পারে না। আমাদের পুরোটা মেডিকেল লাইফ কাটল ওদের খুনসুটি দেখেতে দেখতে।’

‘ ওনারা কি একে অপরকে ভালোবাসে?’ -তুলি মুখ ফস্কে মনের প্রশ্ন বাহিরে প্রকাশ করে ফেলল। করে নিজেই হতভম্ব। রিমি আলতো হেসে বলে,

‘ আরে না। ওরা তো একে অপরের জাত শত্রু। তাছাড়া পায়েলের একটা রিলেশন আছে। রিলেশন বললে ভুল হবে বিয়েটা দু’বছর আগে পারিবারিক ভাবেই ঠিক হয়েছে। হয়তো খুব শিগগিরই বিয়েটা হয়ে যাবে।’

কথাগুলো শ্রবণ গ্রন্থিতে পৌছাঁতেই অজানা এক ব্যাথা অনুভব করল তুলি। কেন সে নিজেও জানেনা। তবে তার অবুঝ মনটা চার জোড়া চোখে ভালোবাসা দেখেছে। হতে পারে তার বুঝার ভুল। তাহলে কি আদ্রর অনুভূতিগুলো বুঝতেও অক্ষম সে?আঁতকে উঠল তুলি। আদ্রর দিকে চাইল সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। তার মন বলছে কোনো কিছুই মিছে নয়,আবার সবকিছুই মিছে। কেননা কার মনে কি আছে কে জানে!চোখ তো অনেক কিছুই দেখায়,কিন্তু মন!মন তো অনেক কিছুই লুকায়। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল তুলি।রিমির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘অন্তু ভাইয়া?’

‘ অন্তু তো পায়েল কে রাগায়। কিন্তু কেন জানিনা আমার মাঝে মাঝে ফিল হয় অন্ত পায়েল কে নিয়ে কিছু অনুভব করে। আমার দ্বারা ভুলও হতে পারে। শুধু এতটুকু চায়, দু’টো ভালোবাসার মানুষ সর্বদা একসাথে থাকুক।’

হতাশ কন্ঠে বলল রিমি। নিজের আঁখি যুগল নিবদ্ধ করল মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভিতরে যাওয়া সাগরের দিকে।
তুলি আর কিছু বলার ইচ্ছে পোষণ করল না৷ সবাই একসাথে বাড়ির ভিতরে ঢুকল। ওদের আগেই বাকি সবাই চলে এসেছে। ড্রইং রুমে আসতেই অপরিচিত অনেক লোক দেখতে পেল তুলি। একজন পুরুষ ও মহিলা এগিয়ে এসে সবার সাথে কথা বলতে লাগল। তাদের চিনে না তুলি। রিমি,পায়েলরা নাকি আগেও এসেছিল এখানে বেড়াতে, তাই জিজ্ঞেস করতেই জানালো ওনারা আদ্রর চাচা-চাচী। দূরে একটা মেয়েকে দেখিয়ে বলল,মেয়েটা আদ্রর চাচাতো বোন ঝুমু। নজরকাড়া সুন্দরী মেয়েটা। বয়স তুলির থেকেও দুই অথবা তিনেক বড় হবে ধারণা করে নিল তুলি। আদ্র জারিফা কে তার ছোট ফুপুর কোলে দিয়ে সবার সাথে হাসিমুখে কৌশল বিনিময় করতে লাগল। মুগ্ধ নয়নে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইল তুলি। ঘোর কাটল তার একটা মেয়েলি কন্ঠস্বরে।

‘ আমি ঝুমু। তুমি নিশ্চয়ই তুলি?আমরিনের কাছ থেকে অনেক শুনেছি তোমার কথা।’

‘ শুনেই চিনে ফেললেন?’

চোখ বড় বড় করে বলল তুলি। বিনিময়ে ঠোঁট প্রসারিত করে একটা মুগ্ধময় হাসি উপহার দিল ঝুমু। তুলির হাত টা টেনে ধরে,

‘ ছবি দেখেছি।’

‘কার কাছ থেকে?’

‘ ইট’স সিক্রেট। ‘–মুখের হাসিটা বজায় রেখে বলল ঝুমু।

তুলিও আর মাথা ঘামাল না। এতোক্ষণ খারাপ না লাগেলও এখন সারাদিনের ক্লান্তি ঝেঁকে ধরেছে তাকে। মাথাটা ভার হয়ে আসছে। আদ্র একবার তুলির দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ঝুমুর উদ্দেশ্যে বলল,

‘ ওকে নিয়ে যা।’

ঝুমু কোনো প্রকার শব্দ না করে বাধ্য মেয়ের মতো তুলি কে নিজের রুমে নিয়ে এল। রুমটা বেশ সুন্দর। বেলকনি থেকে বাতাস ধেয়ে আসছে। সাদা পর্দাগুলো উড়ছে বাতাসের দাপটে। অমায়িক হাসল তুলি। ক্লান্ত মিশ্রিত স্বরে বলল,

‘এটা কি তোমার রুম আপু?’

‘হুম। তুমি আমার সাথেই থাকবে।’

তুলি আর কিছু না বলে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ঝর্ণার পানি ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহের সর্বাঙ্গে। কিছুটা শীত শীত অনুভব করল তুলি। নিজের ডান হাত টা মেলে ধরতেই শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বরাবর। শরীর টা কাটা দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। গাড়িতে বহুবার আমরিন কে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছে মেহেদী সে দিয়েছে কিনা!কিন্তু জড়তা-সংকোচে দমে যায় তুলি। চুল মুছতে মুছতে রুমে আসতেই বারান্দায় একটা অবয়বের উপস্থিতিতে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে তার। তোয়ালে টা রেখে পা পা টিপে টিপে অবয়ব টা কে ভয় দেখানোর দুষ্ট বুদ্ধি নিয়ে শব্দহীন পিছনে এসে স্থির হল। উচ্চস্বরে চিল্লানোর প্রস্তুতি নিতেই মানুষ টা পিছন থেকে তার এক হাত টেনে সামনে এনে নিজের সম্মুখে দাঁড় করাল দ্রুত গতিতে। আচমকা এহেন কান্ডে দু’ চোখ বুঁজে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল তুলি ক্রমাগত। সামনের ভেজা চুল গুলো থেকে টুপ টুপ পানি গড়িয়ে যাচ্ছে শ্যামলা চেহারায়,যা চোখে ভাসতেই ঘোর লেগে এল আদ্রর। হৃদপিণ্ডে প্রবল কম্পন অনুভত করল সে। ঠোঁটে মুগ্ধ হাসি ফুটিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

‘ চোখ খুলো তুলা।’

ধপ করে চোখ মেলে চাইল তুলি। আদ্র কি জানে তার একটা ডাকে তুলির ভিতরটা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে? ঘোর লাগা কন্ঠস্বর সেকেন্ডের পলকেই কেমন করে তুলির হৃদপিণ্ডে আঘাত করেছে?উঁহু জানেনা। জানলে বিরত থাকত তুলি কে এলোমেলো করা হতে। আজকাল তার ছোট্ট মন, হৃদপিণ্ডটা অসুস্থ অনুভব করছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠে, বেদনায় সিক্ত হয়ে পড়ছে আদ্র কে পাওয়ার লোভে। হাতে স্পর্শ পেতেই ধ্যান ভাঙল তার। আদ্র হাত টা আঁকড়ে ধরে বেলকনির হলদেটে আলোয় কিছুটা একটা গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। জমে গেল তুলি। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তার মুখটা। এভাবে লজ্জায় পড়তে হবে ভাবে নি একদম । সে তো ভেবেছিল কয়েকদিন লুকিয়ে রাখলে মেহেদীর রঙ মুছে যাবে সেই সাথে ডান হাতের তালুতে হলদেটে নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করা ‘ আদ্র ‘ নামক নামটাও। আদ্র হাত টা আরেকটু উপরে তুলতেই তুলি এক নাগাড়ে বিষন্ন স্বরে বলতে লাগল,

‘বিশ্বাস করুন আমি লিখি নি। কে লিখেছে জানিনা। আমি তো,,’

‘ আমি লিখেছি। মেহেদী আমরিন দিয়েছে, নামটা আমি লিখেছি।’–আদ্রর নির্লিপ্ত জবাব।

অসম্পূর্ণ থেকে গেল তুলির মুখের বাক্য। কিঞ্চিৎ দূরত্ব তৈরি হল দু ঠোঁটের মাঝে। আদ্রর কথাটা যেন ঠিক বর্জ্যপাতের ন্যায় তরঙ্গিত হল কর্ণকুহরে। এটা একদম অপ্রত্যাশিত তার নিকট। কম্পিত স্বরে প্রশ্ন করল ‘আ,,আপনি?’

‘হু!’

সামান্য মৃদু হাসল আদ্র। তুলির হাতে ছুঁয়ে দিল নিজের শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয়। নিমিষেই ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক টা। নির্ভীক,নিষ্পলক তুলির দৃষ্টি। পা দুটো অসার হয়ে আসছে। তুলি প্রখরভাবে নিজের অনুভূতি গুলো অনুভব করতে পারছে। অনুভব করতে পারছে সদ্য ধেয়ে আসা ঝড়। থম মেরে রইল সে। আদ্র তুলির হাতে একটা ব্রেসলেট পড়িয়ে দিল,যা গাড়িতে ফেলে এসেছিল তুলি। তুলির ছোট ছোট আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের আঙ্গুল রেখে মুগ্ধতার স্বরে বলে উঠল,

‘ আমার অস্তিত্ব না থাকলেও তোমার হৃদয়ের গহীনে যেন ‘আদ্র’ নামটা চির সজীব থাকে তুলা।’

তুলির চমকিত নয়ন দু’টো আদ্রর নীলাভ চোখে স্থির হল। সাথে সাথেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে গেল এক ফোঁটা নোনাজল। দুর্বল হাতে আদ্রর সাদা শার্ট টা টেনে ধরে করুণ কন্ঠে ডেকে উঠল,

‘ ডাক্তার সাহেব? ‘

‘হু!’

‘আমার হার্টের চিকিৎসা করে দিবেন?’

#চলবে….!

(ভুল -ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। রি-চেইক করা হয়নি।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -৯

নিকষ কালো আঁধার কাটিয়ে নব এক প্রভাতের সূচনা ঘটেছে। জানালার কার্নিশ ছুঁয়ে সূর্যের প্রথম কিরণ রুমে প্রবেশ করার প্রয়াস চেষ্টায় মত্ত। চোখ মেলে পাশ ফিরে তাকাল ঝুমু। তুলি বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। শেষ রাতে হালকা গোঙানির আওয়াজ কানে আসতেই ঝুমু হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে এসেছিল ঘুমের রাজ্য হতে। তুলির কপালে হাত দিতেই চমকে উঠল সে। জ্বর এসেছে মেয়েটার। সে আঁতকে উঠে আদ্রর রুমের সামনে দৌড়ে এসে উপস্থিত হলেও ডাকল না। সারাদিনের দীর্ঘ জার্নি ও বিয়ের নানা আয়োজনের ব্যস্ততা কাটিয়ে একটু ঘুমানোর সুযোগ পেল সবাই। তাই আর কাউকে বিরক্ত না করে জেগে থেকে নিজেই জলপট্টি দিল। শরীরের উত্তাপ কিছুটা কমে এসেছে বুঝতেই আবারও ঘুমের রাজ্যে ডুব দিয়েছিল ঝুমু। বিছানা ছাড়ার আগে তুলির কপালে হাত দিয়ে শরীরের তাপ টা পরখ করে নিল সে। আগের চেয়েও কিছুটা স্বাভাবিক। ‘ ঘুম থেকে জাগলে ওষুধ খাইয়ে দিব।’ মৃদু হেসে কথাটা বলে ওয়াশরুমে চলে এল। ফ্রেশ হয়ে রুমের বাহিরে আসতেই দেখতে পেল এখনো সবাই ঘুম থেকে জাগে নি। পা বাড়িয়ে সকালের শুদ্ধ নির্মল হাওয়া উপভোগ করতে ছাদে এসে উপস্থিত হল। কিছুটা এগিয়ে যেতেই ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে এল ঝুমুর। আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে একটা ছেলে। ছেলেটা টের পাওয়ার আগে ঝুমু তড়িঘড়ি করে যেতে নিলেও আটকা পড়ল একটা বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে। স্তম্ভিত হয়ে গেল ঝুমু। পিছন থেকে ছেলেটা তার হাত টা শক্ত করে টেনে ধরে রেখেছে। ঝুমু ভয়ার্ত চোখে সিঁড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। হাতে জোরালো টান অনুভব করতেই দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল,

‘ ছাড়ুন আহান স্যার। কেউ দেখলে আপনার কিছু হবে না কিন্তু আমার অনেক কিছু হয়ে যাবে। আপনার মতো একাধিক গার্লফ্রেন্ড,বয়ফ্রেন্ড রাখার সাহস আমার ফ্যামিলি আমাকে দেয় নি। একটা রাখারও অনুমতি নেই। ‘

ঝুমুর তীক্ষ্ণ বানে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল আহান। বিন্দুমাত্র রাগ হচ্ছে না তার বরং চারটি দিন মেয়েটা থেকে দূরে থেকে মরুভূমির ন্যায় প্রখর উত্তপ্ত তার হৃদয়। মেয়েটা কে এক পলক দেখলেই যেন তার সমস্ত পিপাসা মিটবে,পিপাসায় কাতর কন্ঠনালিতে এক ফোঁটা জলের সঞ্চার হবে। ঝুমুর হাত টা টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে এল। আকস্মিকতায় ভড়কে গেল ঝুমু। আহান কে পিছু ফিরে কিছু বলার পূর্বেই তাকে পিছন থেকে কোমরে হাত পেচিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল দুটো হাত। ধরাস করে কেঁপে উঠল ঝুমু। কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ ককক,কি করছেন স্যার?’

‘হুঁশ!’

ঝুমু কে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল আহান। কানের পিঠে নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে, ফিচেল স্বরে বলে উঠল,

‘ স্যার আমি ভার্সিটিতে, তোমার বাড়িতে নয়। তোমার সাহস হলো কি করে বাড়িতে এসে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার?’

‘ আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে। আমাকে আপনার কি প্রয়োজন?’–কঠোর প্রতিবাদী স্বর ঝুমুর।

‘ বউ আর গার্লফ্রেন্ড কি এক?যদি এক নাহয়, তবে আমার বউ প্রয়োজন। ‘

আহানের বেসামাল কথা কর্ণধার হতেই আগ্নেয়গিরির তো জ্বলে উঠল ঝুমু। নিজের পেটে বিচরণ করা আহানের ফর্সা হাত দু’টো তে নখ বিঁধিয়ে দিল প্রচন্ড জোরে। ব্যাথা ককিয়ে উঠলেও পরক্ষণেই ক্ষীণ হাসির রেখা প্রতীয়মান হল ঠোঁটের কোণে। ঝুমুর কানের পাতায় কামড় বসিয়ে ক্ষান্ত হল সে। সাথে সাথেই ঝুমু চিল্লিয়ে বলল,

‘ ছাড়ুন কুমিল্লার রাক্ষস। ছাড়ুন আমার কান।’

আহান দুষ্টমির সুরে বলল,

‘ আমি কুমিল্লার রাক্ষস হলে,তুমি কি বান্দরবানের পাহাড়ি পেত্নী? ‘

আহানের হাত দু’টো ছাড়িয়ে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে আহানের দিকে ঘুরে দাঁড়াল ঝুমু। তেলে ভাজা বেগুনের মতো জ্বলে উঠার আগেই আহান কোমড় আকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। নির্মল স্বরে বলল,

‘ শুনো পেত্নী,,!’

‘কি?’- চোখ পাকিয়ে।

‘ আনিসা আমার গার্লফ্রেন্ড নয় বরং তোমাকে রাগানোর জন্যই মিথ্যে বলেছে সে। ও শুধু কলেজ লাইফের বান্ধবী।’

‘ বিশ্বাস করি না।’–মুখ বাঁকিয়ে বললো ঝুমু।

‘ বিশ্বাস না করলেও আমি তোমায় ছাড়তে পারব না।’

ঝুমুর নাকে নাক ঘষতে ঘষতে কটাক্ষ করল আহান। আলতো করে একটা চুমু খেল ঝুমুর লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠা গালে।

আহান রাজশাহীর একটা ভার্সিটির টিচার। সেই ইউনিভার্সিটিতেই দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ঝুমু। স্টুডেন্ট হিসেবে আহানের সাথে পরিচয়,তারপর আত্মীয়তার সূত্রে যোগাযোগ, অতঃপর প্রণয়। আজ চারদিন হয়েছে বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে এসেছে সে। আহান কে বলে আসে নি। বাড়িতে আসার পর থেকে তার মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তীব্র অভিমান ছিল তার আহানের উপর। বিয়ে,অভিমান সব মিলিয়ে আহানের সাথে যোগাযোগ করে নি সে।কিন্তু তার তো ধারণা ছিল আহান এখানে আসবেই। কারণ তুলির খালাতো ভাই যে আহান তা সে জানে। সকল অভিমান ভুলে গিয়ে আহান কে ঝাপটে ধরল ঝুমু। সকালের স্নিগ্ধতায় নীল গগনে অভিমানগুলো এক ঝাঁক পাখির ন্যায় উড়ে গেল মহা আনন্দে।
________

গোধূলি লগ্ন ছাড়িয়ে রাতের ঘন কালো আঁধারে ডুবে গেছে প্রকৃতির সজীব রূপ। চারদিকে ব্যস্ত সবাই রেডি হতে। আজ সারাটাদিন সবার ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে গেছে। বোনের হলুদের আয়োজনে মগ্ন আদ্র কে এক পলকও দেখার সাধ্যি হয় নি তুলির আজ। মনে অজস্র কষ্টের দানা বেঁধেছে তার। আদ্র কে না দেখতে পেয়ে বারবার শ্বাস টা ভারি হয়ে আসছে। দু’দিনের সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতিগুলোর প্রখর এতোই বেশি যে তুলির মন টা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। আদ্র কে দেখতে না পারার বিতৃষ্ণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে সামান্য কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে। এই নিয়ে বারো বার নিচে গিয়েছে কিন্তু প্রতিবার দেখার তৃষ্ণা মিটানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। আমরিন কালোর মধ্যে লাল পাড়ের একটা শাড়ি নিয়ে বড় বড় পা ফেলে তুলির রুমে এল। কিন্তু তুলির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। শাড়ি টা ধপ করে পাশে রাখল আমরিন। তুলির অনিচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে শাড়িটা পড়িয়ে দিল। তারপর নিজেও লাল একটা শাড়ি পড়ে রেডি হলো। অলরেডি সবাই প্রস্তুত হয়ে ইনশিতা কে নিয়ে স্টেজের কাছে চলে গেছে। আমরিন তুলি কে নিয়ে উঠতে গেলে তুলি আকুতি ভরা ব্যাকুল কন্ঠে প্রশ্ন করল,

‘ আদ্র ভাইয়া কোথায়?’

কিয়ৎপরিমাণ চমকাল আমরিন। নিজের বিচক্ষণ দৃষ্টি তাক করতেই আন্দাজ করে নিল কিশোরী তুলির মনের অবস্থা। আলতো হেসে ভ্রু নাচিয়ে জবাব দিল আমরিন,

‘ ভাইয়া মাত্র রুমে গেল। কেনো বলতো?’

আমরিনের কথার জবাব দেওয়ার পিছনে সময় ব্যয় করে নিজের চোখের তৃষ্ণা আর বাড়াতে চাইল না তুলি। তড়িৎ গতিতে পা বাড়াতে বাড়াতে শাড়ির আঁচল টা কোমরে গুঁজে ছুটে যেতে লাগল আদ্রর কাছে। কাউকে পরোয়া করার সময় তার নেই । এই মুহুর্তে সে কেবলই একজন তৃষ্ণার্ত আবেগী কন্যা। যার তৃষ্ণা নিবারণের সাধ্যি একমাত্র ‘আদ্র’ নামক মানুষটার। কিন্তু তুলির মনে সূর্যের প্রবল উত্তাপে সৃষ্ট মাটিতে ফাটলের ন্যায় ফাটল সৃষ্টি হবে তা কি সে আদৌও জানত!জানত না। জানলে হয়ত উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসত না। অজানা আশঙ্কায় অন্তর টা মোচড় দিয়ে উঠল তুলির। চোখ দুটো তাকে ধোঁকা দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে দিতে লাগল অশ্রু। আদ্রর রুমের দরজার থেকে ছুটে আসল রুমে। দরজা লাগিয়ে পা দুটো ভেঙে ফ্লোরে নিশ্চুপ হয়ে বসে পড়ল । শাড়ির আঁচল টা ছুটে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। তুলি পাথরের মতো স্থির, নিস্তেজ। বাহ্যিক নিস্তেজ হলেও অভ্যন্তর টা?তুলির অভ্যন্তর টা ভালোবাসা না পাওয়ার আকুলতায় আর্তনাদ করছে। সেই দৃশ্য তাকে উপলব্ধি করিয়েছে ভালোবেসে ফেলেছে সে। ভালোবেসে ফেলেছে তার ডাক্তার সাহেব কে। নেত্রযুগল থেকে অবাধ্য জল অবলীলায় ভিজিয়ে যাচ্ছে গাল। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে তুলি চিল্লিয়ে বলে উঠল,

‘ আপনাকে পাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই তবু্ও আমি কেন আপনাকে চাই আদ্র,কেন চাই?আপনার জীবনে যদি আমিই না থাকি তবে কেন আমার মনে ভালোবাসার সৃষ্ট হলো আপনার প্রতি?’

তুলির প্রশ্নগুলো চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ রইল। অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে এক রাশ চাঁদের আলোয় তুলির চোখের পানি চিকচিক করে উঠল। তুলি আনমনে ভাবতে লাগল,’ কাছের মানুষ গুলোর অভিনয় খুবই নিখুঁত হয়। নয়তো সামনে থেকে বুকে আগলে নিয়ে পিঠে কিভাবে ছুরি গাঁথে! নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে তার। আদ্র তো কখনও তাকে বলে নি ভালোবাসে,কারণ আদ্রর জীবনে পারফেক্ট কাউকে মানায় তার মতো গ্রাম্য মেয়েকে নয়।’

#চলবে,,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)