আঙুলে আঙুল পর্ব-৩৫+৩৬

0
189

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩৫)

অরুণিমা কী উপায় পেয়েছে সেটা না জানা অবধি মাইমূন শান্তি পাচ্ছিল না। গোসলের কাজ দ্রুত শেষ করে রান্নাঘরে হাজির হলো। জিজ্ঞেস করল,
” রান্না শেষ হয়নি এখনও। ”

তার কণ্ঠস্বর ও হাব-ভাবে অধৈর্য্যতার লক্ষণ খুঁজে পেল অরুণিমা। ধারণা করল, মাইমূন ভীষণ ক্ষুধার্ত। তাই রান্নার কাজে গতি বাড়াল। মাইমূনও অযথা বসে থেকে সময় নষ্ট করল না। গিন্নির রূপে হাজির হওয়া মেয়েটিকে কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। রান্না শেষের দিকে বুঝতে পেরে নিজেই থালা ধুয়ে নিয়ে রেখে আসল রুমে। পানির জগ ও গ্লাসটাও রেখে আসল। অরুণিমা তার এই সামান্য সাহায্যেও বেশ মুগ্ধ হলো। খুব কম পুরুষই আছে, যারা নিসংকোচে ঘরের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করে। এই কম সংখ্যক পুরুষগণের মধ্যে মাইমূনও আছে ভেবে গর্ববোধ করছে। থালায় ভাতের সাথে তরকারি দিতে মাইমূন অসহিষ্ণু গলায় বলল,
” বললে না তো, তুমি কী উপায় বের করলে! ”

অরুণিমা প্রথমে বুঝতে পারল না। সপ্রশ্নে তাকাতে আচমকা মনে পড়ল নিজের বলা কথাটা। জানতে চাইল,
” তোমার তাহলে ক্ষুধা লাগেনি? উপায় জানার জন্য আমাকে তাড়া দিচ্ছিলে? ”
” হ্যাঁ। তোমার বাবার শর্ত শোনার পর আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব চলে গেছে। এই মুহূর্তে আমার একমাত্র লক্ষ্য তার শর্ত পূরণ করে তোমাকে জয় করা। ”

মাইমূনের মুখের ভাবে পরিবর্তন এসেছে। চোখের তারায় তারায় জয়ের উ’ন্মাদ’না, চিত্তবিক্ষোভ। কথাগুলো বলতে বলতে তার শিরদাঁড়া লোহার মতো সোজা ও শক্তে রূপান্তর হলো। শিনা হলো উঁচু। যেন তার বীরত্ব ও পুরুষত্ব দুটোকেই বাজিতে লাগিয়েছে!

” চুপ হয়ে গেলে যে! বলবে না? ”

অরুণিমা খাওয়ার জায়গা থেকে উঠে গেল। ত্বরিত গতিতে নিজের কাঁধ ব্যাগটা নিয়ে এলো মাইমূনের সামনে। আগের ন্যায় আরাম আসনে বসে ব্যাগের চেইন খুলল একটানে। একটা বাদামী রঙের প্যাকেট ও মুখ বাঁধা কালো রঙের পলিথিন বের করে রাখল মাইমূনের কোলের উপর। দূরে সরিয়ে রাখা ভাতের থালাটা টেনে বলল,
” প্যাকেটটাতে পঁচিশ হাজারের মতো টাকা আছে। শূভ্রাকে মোবাইল কিনে দিব বলে জমিয়েছিলাম। এখন ওর মোবাইল কিনে দেওয়ার মানুষ হয়েছে। এই টাকাগুলো অন্য কাজে লাগাতে পারি। ”

মাইমূন প্যাকেটের মুখ খুলে ভেতরে হাত দিল। সত্যি অনেকগুলো টাকা! পঞ্চাশ টাকার নোট থেকে শুরু করে এক হাজার নোটে গিয়ে শেষ হয়েছে। সবগুলোকে একত্রে রাখার জন্য চুল বাঁধার রাবার ব্যান্ড দিয়ে প্যাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সে হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে আছে টাকার বান্ডিলে। সে অবস্থায় শুনল,
” পলিথিনটাও খুলো। ওখানে স্বর্নের গয়না আছে। ”

মাইমূন যন্ত্রমানবের মতো আদেশ রক্ষা করল। পলিথিনের ভেতর থেকে একটা চেইন, টিকলি, একজোড়া কানের দুল ও একটি আংটি বের করে সুধাল,
” এগুলো তোমার? ”
” হ্যাঁ। আমার বিয়ের জন্য বাবা গড়িয়ে রেখেছে। ”

কথাটা বলতে বলতে শূভ্রার বিয়ের দিনের মুহূর্তটা স্বরণে এলো তার। সেদিন শূভ্রার শরীরে এই গয়নাগুলো দেখেছিল। সেই হিসেবে এই গয়নাগুলো তার সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা। অথচ সেখানে না গিয়ে মায়ের আলমারির ড্রয়ারে পড়ে আছে। কীভাবে ঘটল এই আশ্চর্য ঘটনা অরুণিমা জানে না। শুধু অনুমান করেছে সঞ্জয়ান ফিরিয়ে দিয়েছে। দিতেও পারে, তার ব্যক্তিত্বের সাথে এমন আচরণই মানায়। মাইমূন দ্বিধা ও সন্দেহ নিয়ে বলল,

” বিয়ের গয়না, জমানো টাকা এসব আমাকে দেখাচ্ছ কেন? কী করতে চাচ্ছ বলো তো। ”
” তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছি। পাশে থাকতে চাচ্ছি। এই মুহূর্তে স্বর্ণের দাম জানা নেই আমার। তবে আশা রাখছি এগুলো বিক্রি করে লাখ টাকার মতো হবে। এতে তোমার হবে না? আরও লাগবে? কত লাগতে পারে জানিও। আমি ঋণ তোলার ব্যবস্থা করব। আশা সমিতিতে আমার এক পরিচিত আছে। ”

মাইমূন এমন কিছুর জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না। সে ঘটনার আকস্মিকে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। তাৎক্ষণিক কোনোরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারল না। অনেকটা সময় নীরব সময় কাটিয়ে নিজের ভেতরকার সত্তাকে জাগ্রত করতে সক্ষম হলো। টাকা ও গয়না ব্যাগের মধ্যে ভরতে ভরতে বলল,
” তুমি পাগল হয়ে গেছ অথবা আমাকে পাগল ভাবছ। নাহলে এমন চিন্তা কারও মাথায় আসে? অরুণিমা, তোমাকে আমি যথেষ্ট বুদ্ধমতি মেয়ে ভাবতাম। আমার সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করেছ আজ। অত্যন্ত হতাশের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, তুমি খুব বোকা একটা মেয়ে। ”

অরুণিমা ব্যাগের উপর হাত রাখল। মাইমূনকে চেইন বন্ধ করতে না দিয়ে প্রশ্ন করল,
” এখানে বোকামির কী দেখলে? ”
” সবটাই বোকামি। প্রথমত, আমাদের আইনিভাবে নির্ভরশীল কোনো সম্পর্ক হয়নি এখনও। অথচ তুমি তোমার সারাজীবনের পুঁজি ও দামী সম্পদ আমার হাতে তুলে দিচ্ছ। দ্বিতীয়ত, শর্ত পূরণের ভার আমার একা। তোমার বাবা যেখানে আমার বাবার টাকাতে হাত দিতে নিষেধ করেছেন সেখানে তোমার টাকাই হাত দিব কী করে? এটা তিনি জানতে পারলে কি আমাকে বিজয়ী ঘোষণা করবেন? তোমাকে আমার হাতে তুলে দিবেন? উল্টো এই শেষ সুযোগটাও হারাব। ”

পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করে মাইমূন সামান্য জোর খাটিয়ে ব্যাগটা নিজের কাছে নিল। চেইন লাগিয়ে দূরে সরিয়ে তাকাল তার ভালোবাসার দিকে। চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল,
” হয়তো তোমাকে নিজের করে পাওয়ার এটাই শেষ সুযোগ। আমি সেই সুযোগটা এত সহজে হারাতে চাই না। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমার শরীরে শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও ল’ড়ে যেতে চাই। ”

তার এই বিজয়োন্মত্ত শীতল কণ্ঠস্বরের দুর্দমনীয় চেতনা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি অরুণিমা। শুধু অবাক চোখে একস্থির ভাবে কয়েক মুহূর্ত নিরবে দেখেছে এক যো’দ্ধা’রত সৈনিককে।

_________
ছায়ানীড়ে এখন সাঁঝবাতি জ্বলছে। শূভ্রা তিনদিন যাপত ইকবালের রুমেই পড়ে আছে। সামনের দিকে একটা জানালা থাকা সত্ত্বেও খুলেনি এখন পর্যন্ত। আজ খুলবে নাকি ভাবছে। তার হাতে একটি আইফোন। আইফোনটি উপহার পেয়েছে ইকবালের কাছ থেকে। সে এর আগে এটি ব্যবহার করেনি। ছুঁয়েও দেখেনি। এবারই প্রথম ছুঁয়েছে। পাওয়ামাত্র অতি উত্তেজনাবশত ইকবালের সামনে বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে ডায়াললিস্টে ঢুকল। বাবার নাম্বারে কল দেওয়ার জন্য নাম্বার উঠানোর সময় শুনল,
” এই যা! নতুন সিম আনতে ভুলে গেছি। কল ঢুকবে না, বউমা। ”

শূভ্রার সকল আনন্দ, খুশি, উত্তেজনায় মেঘাবরণ ঘটল নিমিষে। প্রথমে মনখারাপ ও পরে বি’র’ক্ত হলো। চোখে পড়ে এমন রা’গ নিয়ে বলল,
” তাহলে এই বা’ল দিয়ে কী করব আমি? নিয়ে যান আপনার উপহার। ”

সে জোর করে ইকবালের হাতে মোবাইলটি দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল ধুপ করে। কপাল ও ভ্রদ্বয় কুঁচকে অপ্রসন্ন বদনে ছেড়ে রাখা এলোমেলো চুলগুলো মুঠোয় চেপে নিয়ে খোপা করল। ওড়নার ধার দুটো কোলের উপর টেনে জোড় করে বলল,
” এখনও দাঁড়িয়ে আছেন যে? যেতে বলেছি না? ”

ইকবালের চেতন ফিরল আচমকা। শূভ্রার কণ্ঠস্বর থেকে নির্গত হওয়া ‘ বাল ‘ শব্দটি তাকে স্তব্ভিত করে দিয়েছিল। সঞ্জয়ানের মুখে তার সম্পর্কে নেতিবাচক অনেক কিছু শুনেছে। কিন্তু এইরূপ ব্যবহার ও শব্দ প্রয়োগ তার সামনে করবে এটা ভাবনাতীত ছিল। তাই হজম করতে একটু সময় লাগল। একটু তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে বলল,
” এত অল্পতে রা’গ করলে চলে? বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে, জানো তো? আমারও তেমন হয়েছে। নাহয় ইচ্ছে করে তোমাকে রা’গা’ই? ”

সে শূভ্রার মান ভাঙানোর চেষ্টা চালাতে চালাতে সামনে এগিয়ে গেল। মোবাইলটা তার পাশে রেখে বলল,
” একটু অপেক্ষা করো। আমি এখনই তোমার জন্য নতুন সিম নিয়ে আসছি। বেশিক্ষণ লাগবে না। যাব আর আসব। ”

তার এই ‘ যাব-আসব ‘ কথার দান ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল বিকেলে। এরমধ্যে একটি সন্ধ্যা, রাত ও আজকের সারাদিন কেটে গেছে। কিন্তু ইকবালের নতুন সিম নিয়ে আসা হয়নি এখন পর্যন্ত। এক রুমে এই দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা শূভ্রাকে অস্থির করে দিয়েছে। চার দেয়ালে ব’ন্দি হাওয়া, আলোকে যতটা অ’স’হ্য লাগছে তার চেয়ে অধিক অ’স’হ্য লাগছে নিজের নিশ্বাসের শব্দটাকে। হঠাৎ করে বাইরে যাওয়ার তীব্র বাসনা তৈরি হলো। মুক্ত বাতাসের মাঝে শরীরটাকে মেলে ধরতে ইচ্ছে হলো। বুকের ভেতরটা অ’স’হ’ণীয় হাঁসফাঁস বোধ থেকে জানালা মেলে দিল এক ধা’ক্কা’য়। কাঠের পাল্লা দুটো আলগা হয়ে দু’পাশে সরে যেতে বৈশাখীর হাওয়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আচড়ে পড়ল মুখ, গলা ও বুকে। এতদিন বাদে এই নির্মল ও ঠাণ্ডা হাওয়ার আ’ক্র’ম’ণটাকে সহজভাবে নিতে পারল না সে। চোখদুটি বন্ধ হয়ে হলো আচ্ছন্নতায়। বন্ধ চোখদুটি ততক্ষণ বন্ধ থাকল যতক্ষণ না মনের অস্থিরতা ও হাঁসফাঁস ভাবটা কাটল। যখন খুলল তখনই দৃষ্টি গিয়ে ঠেকল নাক বরাবর দেয়ালটায়। ছায়ানীড়কে ঘিরে রাখা ইটের দেয়ালের চারপাশে বৃক্ষরোপণ করেছিলেন স্বর্ণলতা। তাদের মধ্যে দুটো কৃষ্ণচূড়া গাছও ছিল। যা বড় হয়ে যেমন হাওয়া দিচ্ছে, ছায়া দিচ্ছে তেমন কৃষ্ণচূড়ার ফুলের সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে বছরের পর বছর। আজ সেই সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে শূভ্রার। সন্ধ্যার অন্ধকারে গাছের ডাল ও পাতা স্পষ্ট দেখা না গেলেও ফুলগুলো অ’গ্নি’শি’খার মতো জ্ব’লজ্ব’ল করছে যেন! সে প্রথমে ঘা’ব’ড়ে যায়। ভ’য়ে জানালার পাশ থেকে সরে যাওয়ার জন্য চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও থেমে যেতে বাধ্য হলো। ভী’রু ও আগ্রহী চোখ জোড়া গাছের চূড়া থেকে নিচে নামিয়ে আনল ধীরে ধীরে। থামল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির উপর। তার পরনে দুধ সাদা রঙের পাঞ্জাবী ও পাজামা।অন্ধকারেও মুখটা এত স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে যে, শূভ্রা দূর থেকেও মুখের নিখুঁত আদল ও যাদুকরী লাবণ্য, শোভায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। কৃষ্ণচূড়ার মতো পাঞ্জাবী থেকেও যেন শূভ্ররঙা আ’গু’ন ঝরছে! তার বিমোহিত দৃষ্টি আবিষ্কার করল শূভ্ররঙা আ’গু’ন ঝরানো যুবকটির হাতে একটি সাদা কবুতর। পরম স্নেহে তার নরম শরীরে আদর বুলিয়ে দিচ্ছে। তার এই আদুরে স্পর্শটাকে এতটা গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করল যে, শূভ্রা ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠল। সর্বাঙ্গের লোমকূপ কণ্টিকার ন্যায় শক্ত হয়ে আসতে শুনল,
” অনেকটা সময় অপেক্ষায় রেখেছি, তাই না? আমি খুবই দুঃখিত, বউমা। একটা জরুরী কাজে গ্রামের বাইরে যেতে হয়েছে। রাতে ফিরতে পারিনি। কিছুক্ষণ আগেই আসলাম। ”

ইকবালের কণ্ঠস্বর পেয়ে শূভ্রা জানালা থেকে সরে পড়ে এক লাফে। অপ্রস্তুত অবস্থায় তার স্বীকারোক্তি শুনতে শুনতে নিজেকে সামলে নিল।

” এই তোমার সিম। লাগাতে পারবে? ”

শূভ্রার কথা বলার মতো মেজাজ তৈরি করতে পারেনি এখনও। তাই হেঁটে গিয়ে মোবাইলটা মামার দিকে বাড়িয়ে দিল। সেও আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ মোবাইলে সিম ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজে মনোনিবেশ করল। এই সুযোগে শূভ্রা জানালার পাল্লা দুটো লাগাতে অগ্রসর হলো। এক ঝলক সেই স্থানটায় তাকাতে দেখল, ওখানটা ফাঁকা। কেউ নেই।

ইকবাল সিম ভরে দিয়ে মোবাইলটা ফেরত দিতে দিতে বলল,
” তোমার জন্য আরও কতগুলো উপহার এনেছি। পরে একসময় দেখে নিও। এখন আমি যাই। ”

সে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল সহসা শূভ্রা পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল,
” এ বাড়িতে কবুতর পোষে কেউ? ”
” হ্যাঁ, তোমার শ্বাশুড়িমা পশু-পাখি ভীষণ পছন্দ করেন। শুধু কবুতর নয় আরও অনেক পাখি আছে। ছায়ানীড়ের সামনে যে বিশাল উঠোন তার অর্ধেকটা তাদের জিম্মাতেই আছে। ”

_____________
সঞ্জয়ান রাতে খেতে বসে দেখল, একটি বড় ট্রে’তে ভাত-তরকারি ও পানি সাজিয়ে দিচ্ছেন মামাকে। মায়ের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,
” মামা কি এখন রুমে বসে খায়? ”

তিনি উত্তর দিলেন,
” না। এগুলো তোর বউয়ের জন্য। ”

সঞ্জয়ানের হঠাৎ খেয়ালে এলো শূভ্রার কথা। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” ও কি এখনও ঘরে বসেই খাচ্ছে? বাইরে বেরুচ্ছে না? ”

প্রশ্নটা করে উঠে দাঁড়াল। উত্তরের পরোয়া না করে মামার হাত থেকে ট্রে’টা ছিনিয়ে নিয়ে রাখল টেবিলের উপর। তারপর সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
” আজ থেকে ও এখানেই খাবে। তোমরা শুরু করো আমি শূভ্রাকে নিয়ে আসছি। ”

ইকবাল তার পেছন পেছন ছুটলে সে থেমে গিয়ে বলল,
” আমাকে আর বাঁধা দিবে না। অনেক সহ্য করেছি আর না। ”

কয়েক মিনিটের মাথায় সঞ্জয়ান ও শূভ্রাকে খাবার রুমে ঢুকতে দেখা গেল। স্বর্ণলতার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল শূভ্রার ডানহাতে। যেখানটায় সঞ্জয়ান শ’ক্ত করে চে’পে ধরে থাকায় শূভ্রার চোখে-মুখে ব্য’থার ছাপ বুঝা যাচ্ছে। তিনি দ্রুতপায়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ছেলের হাত থেকে শূভ্রার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
” এসব কী, সঞ্জু? মেয়েটা ব্যথা পাচ্ছে বুঝতে পারছিস না? তোর এত তাড়া কিসের? ও একটু সময় চেয়েছে, সেটা দিতে পারছিস না? ”

সঞ্জয়ান নিচু কিন্তু সবল গলায় বলল,
” না, পারছি না। ও সময় না সুযোগ নিচ্ছে। তোমরা বুঝতে পারছ না কেন? ”
” আমরা ঠিকই বুঝছি তুই বুঝতে পারছি না। ”
” আমি আবার কী বুঝতে পারছি না, মা? ”

স্বর্ণলতা মায়া দৃষ্টিতে তাকালেন শূভ্রার দিকে। একহাতে জড়িয়ে বললেন,
” এখন না। ঘুমানোর আগে আমার সাথে দেখা করিস। ”

তিনি শূভ্রাকে নিজের বাম পাশের চেয়ারটায় বসালেন। সকলের পাতে ভাত বেড়ে দিচ্ছেন ঘুরে ঘুরে। ছেলের কাছে এসে ফিসফিসে স্বরে বললেন,
” তুই জানিস, তোর বাবার অনেক কিছু আমার অপছন্দ। মতের মিল হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। রা’গ চলে, অভিমান চলে। তর্কবিতর্ক হয়। এত সবের মাঝেও আমি গর্বের সাথে বলতে পারি তিনি কখনও আমার গায়ে হাত তু’লে’ননি। হাত তো দূর, আজ অবধি ধ’ম’ক দিয়ে কথা বলেননি পর্যন্ত। যেই খা’রা’প গুণ তোর বাবার মধ্যে আমি পাইনি সেই খা’রা’প গুণটা তোর মাঝেও দেখতে চাই না আমি। কথাটা মনে থাকে যেন। ”

সে আয়ন মস্তক ও নয়নে প্রত্যুত্তর করল,
” থাকবে। ”

সবাইকে খাবার পরিবেশন করে স্বামীর কাছে এলেন তিনি। ভাতের সাথে তরকারি মেখে লোকমা তুলে ধরলেন মুখে। তিনি খাবার গ্রহণ করার পূর্বে বললেন,
” ছেলে আমার মতো দেখতে না হলেও আচার-ব্যবহার পেয়েছে কিছুটা। ”
” তাই নাকি? ”
” হ্যাঁ। দেখছ না, আমার মতো সেও অ’ধৈ’র্য্য। ”

সকলের সাথে খাওয়া শেষ করে শূভ্রা ইকবালের রুমে ফিরে এলো। যেখানটায় সে এতদিন ছিল। আজ আর এখানে থাকা যাবে না। ইকবাল বলেছে, সে শূভ্রার সব চাওয়া পূরণ করবে। বিনিময়ে তাকে এই বাসায় ও সঞ্জয়ানের রুমে থাকতে হবে। সে শর্তটা মানুক বা না মানুক সঞ্জয়ান যে তাকে তখনকার মতো আবারও টে’নে-ছিঁ”চ’ড়ে এই রুম থেকে বের করতে পারে এই ভ’য়টা তার মনে গেঁথে গেল। তাই আপোষ স্বীকার করে নিজের জিনিস-পত্র গুছিয়ে ইকবালের সাচার্যে রুম থেকে বেরুনোর সিদ্ধান্ত নিল।

চলবে।

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩৬)

ইকবালের রুমের প্রধান দরজা বাইরের দিকে। বারান্দার শেষ মাথায়। ছায়ানীড়ের ভেতর রুমে যেতে হলে অনেকটা হাঁটতে হবে। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় শূভ্রাকে সেদিক দিয়ে নিয়ে গেল না সে। স্বর্ণলতা ও তার রুমের মধ্যভর্তি দরজাটি ইশারা করে বলল,
” তুমি এগোও। আমি তোমার জিনিসপত্র নিয়ে আসছি। ”

শূভ্রার হাতে কাপড়ের ব্যাগ ছিল। সেটা বিছানায় রেখে আইফোন ও ব্লুটুথ হেডফোনটা নিয়ে দরজাটির দিকে এগুল। অন্যমনস্কতায় সিটকানিতে হাত দিয়ে মনে পড়ল, এটা নেই। সিটকানি নেই বিধায় এ ঘরে অন্যদের আসা-যাওয়া আটকাতে পারেনি। অন্যসময় এটা নিয়ে বিরক্ত ও রাগ হলেও এবার কৌতূহলী হলো। জিজ্ঞেস করল,
” এটা ভাঙল কিভাবে? ”

ইকবাল কাপড়ের ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস পিরামিডের আকারে গুছানোতে ব্যস্ত ছিল। মাথাটা হালকা উঁচু করে তাকাল শূভ্রার দিকে। পরক্ষণে দরজার সিকটানির ভাঙা অংশে চেয়ে থেকে বলল,
” এটা নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। ”

শূভ্রার কৌতূহল দ্বিগুণ হলো। সম্পূর্ণ পেছন ঘুরে আগ্রহ নিয়ে তাকাল মামার দিকে। খানিক উত্তেজিত স্বরে সুধাল,
” কেমন মজার ঘটনা, মামা? ”

ইকবাল ঠোঁটের দুই কোণ টেনে মৃদু হাসল। সেই হাসির ঝলক চোখে ধরা পড়ল না। উপরন্তু উদাসে রূপ নিল। শূভ্রা গলাটা সামান্য সমুখে বাড়িয়ে ডাকল,
” মামা? শুনাবে না? ”

সে হাসি হাসি ঠোঁটদুটি নিয়ে মাথা ঝাঁকাল। জড়ো করা ব্যবহার্য পত্রগুলো দুই হাতে জড়িয়ে উঁচু করল এক টানে। শূভ্রার সামনে দিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে বলল,
” এই বাড়ির বউমা হয়ে উঠো। কথা দিচ্ছি, অবসর সময় পেলে তোমার সাথে গল্প করতে বসে যাব। শুধু এই ঘটনা না আমার দেখা সব ঘটনাই বলব। ”

দরজা পেরুতে শাশুড়ির রুমে প্রবেশ করল শূভ্রা। স্বর্ণলতা ও সঞ্জয়ানকে একসঙ্গে বসা দেখতে পেল। তার স্মরণে এলো, খাবার টেবিলে মা তার ছেলেকে ডেকেছিল। হতে পারে সেই মিটিং করতে এসেছে। এসবে তার কোনো আগ্রহ নেই। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বেরুনোর জন্য দরজা খুঁজতে তার নয়নজোড়া জুড়িয়ে গেল, কাঠের পাল্লার নিখুঁত ও মনকাড়া নকশায়। সে এমন মনোমুগ্ধকর দরজার কাজ দেখেনি আগে। যাত্রাপথে থেমে গেল। অনেকটা ঘোরের মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রুমটা পর্যবেক্ষণ করল গভীর দৃষ্টিতে। ঘরটা ইকবালের রুমের থেকে তিনগুণ বড় হবে। সেই তুলনায় আসবাবপত্র সীমিত। প্রধান আসবাবপত্রের মধ্যে শুধু আলমিরাহ, খাট ও বুকশেলফ। বই ভর্তি বুকশেল্ফের সামনে একটি ইজিচেয়ার। শূভ্রা এতক্ষণে খেয়াল করল খাটের আকার ও নকশা পালঙ্কের মতো। এটিও সে প্রথমবারের মতোই দর্শন করেছে। দাদির মুখে ছোটবেলা এমন খাটের কথা শুনেছিল, তাই চিনতে পারছে।

” দাঁড়িয়ে আছো কেন, মা? বসো। ”

স্বর্ণলতার আদুরে ও স্নেহপূর্ণ সম্ভাষণে শূভ্রার চোখের পলক পড়ল। শাশুড়ির দিকে তাকাতে তিনি পুনরায় বললেন,
” আমার পাশে এসে বসো। সঞ্জয়ানের সাথে কথা শেষ হলে দুজন একসাথে যেও। ”

তার চোখদুটির ভাষা বদলে গেল চট করে। সঞ্জয়ানের দিকে রা’গ চোখে চেয়ে বলল,
” অন্য সময় বসব। এখন আমার ঘুম পেয়েছে। ”

শূভ্রা কথাটা শেষ করে মুখ বাঁকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো মেঝেতে ভারী ও শসব্দের পদাঘাত ফেলে। সঞ্জয়ান তার এনেন আচরণ একদমই সহ্য করতে পারল না। মুহূর্তে রাগ উঠে গেল মাথার তালুতে। মায়ের সামনে থেকে উঠার জন্য তৈরি হতে তিনি হাত রাখলেন উরুতে। সামান্য বল প্রয়োগে বললেন,
” এখন কোথাও যাবি না। আমার কথা শেষ হয়নি। ”
” শুনব। আগে ওর তেজটা ভেঙে আসি। কত বড় সাহস তোমার কথা অমান্য করে! তুমি বসো, আমি শূভ্রাকে নিয়ে আসছি। ”

স্বর্ণলতা হাত সরিয়ে নিলেন। ছেলের মুখের দিকে একস্থির চেয়ে থেকে বললেন,
” শূভ্রা কি তোর বড় কোনো ক্ষ’তি করেছে? ”

সঞ্জয়ানের চাহনি আটকে ছিল দরজার পানে। সেটা ফিরিয়ে আনল মায়ের দিকে। প্রশ্নের উত্তরটা নিয়ে ভাবনা উদ্রেক হতে তিনি বললেন,
” উত্তর দিতে এত দেরি করছিস যে! তাহলে কি ধরে নিব ও তোর কোনো বড় ক্ষ’তি করেনি? সেরকম হলে ওর উপর তোর এত রাগ কেন? আমি খেয়াল করেছি, শূভ্রা তোর সামনে আসলে তুই সম্পূর্ণ বদলে যাস। খুব অধৈর্য, উগ্র ও বদমেজাজি ভাব থাকে। তুই তো এরকম না। তোর মধ্যে যে এত রাগ আছে, আমি বুঝতেই পারিনি কখনও। ”

সঞ্জয়ান দৃষ্টি নামিয়ে নিল। মাথা নত করতে গিয়েও করা হলো না। আচমকা বলল,
” অসম্মান করেছে, মা। এইটুকু একটা মেয়ে অথচ কথার কি ধা’র! জে’দ আর তে’জে ভরা শরীর। সামান্যতম ভদ্রতা নেই, বিনয় বলতে যে দুনিয়াতে কিছু আছে জানেই না হয়তো। ”
” এইটুকু? অনেক ছোট, তাই না? তাহলে তো ভালোই হলো। তুই শিখিয়ে-পড়িয়ে নিবি। ছোট দেখেই তো ভালো-মন্দটা বুঝতে পারছে না। ”

মায়ের এই কথাটা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারল না। কিছুটা অসহায় ও হতাশ ভাবে বলল,
” তুমি বুঝতে পারছ না, মা। যতটা ছোট মনে করছ ততটাও না। শিখিয়ে-পড়ানোর মতো কাঁচা বয়স ও মাথা নয় ওর। বোকা-সোকাও নয়। বদ বুদ্ধির পাহাড় নিয়ে ঘুরে। ”

স্বর্ণলতা একটুক্ষণ চুপ থেকে সুধালেন,
” খুব খারাপ মেয়ে? ”
” হ্যাঁ, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ”
” করতেও চাই না। আমি বিশ্বাস করি, খুব ভালো মানুষটা যেমন সবার কাছে ভালো হতে পারে না তেমন খুব খারাপ মানুষটাও সবার কাছে খারাপ না। কারও না কারও কাছে সে খুব ভালো। ”

সঞ্জয়ান একটু যেন টলে গেল। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমাকে কী করতে বলছ? ”
” সব ভুলে যা। মনে কর, শূভ্রার সাথে তোর আজই দেখা, প্রথম আলাপ। যেই ব্যবহারটা আমি পাই সেই একই ব্যবহারটা শূভ্রাকেও উপহার দে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই খারাপ মেয়েটা তোর কাছে ভালো হয়ে উঠবে। আর যদি না হয়, তাহলে তুই আমাকে যা করতে বলবি, তাই করব। ”

__________
সঞ্জয়ানের রুমে এসে শূভ্রা আরেক দফা মুগ্ধ হলো। অবাক চোখে আবিষ্কার করল, এই রুমের আকার ও সাজসজ্জা স্বর্ণলতার রুমটার মতোই। কোনো কিছুর কমতি নেই। সামান্য অদল-বদলও না। ইকবাল চলে যেতে সে সযত্নে সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। এরমধ্যে সঞ্জয়ানের আগমন ঘটল। সে অপ্রস্তুত ও ভীত দৃষ্টিতে তাকালেও দৃষ্টি জোড়া আটকে গেল তার পরনের সাদা পাঞ্জাবীতে। অনিচ্ছায় জিজ্ঞেস করে বসল,
” আপনি পাঞ্জাবীও পরেন? ”

সঞ্জয়ান নিজের পাঞ্জাবীর দিকে তাকাল। সাথে সাথে বিরক্ত জড়ো হলো পুরো মুখটায়। মনে মনে আওড়াল, ‘ পাঞ্জাবী পরিহিত মানুষকে জিজ্ঞেস করছে, পাঞ্জাবী পরে নাকি। আজব! ‘ সে নিঃশব্দে শূভ্রাকে পাশ কাটিয়ে আলমিরাহর কাছে গেল। ভেতর থেকে একটা সাদা রঙের টি-শার্ট বের করে তার সামনেই কাপড় বদলাতে শুরু করে দিল। শূভ্রার এসবে ধ্যান নেই। তার মন পড়ে আছে সন্ধ্যাবেলার সেই কৃষ্ণচূড়ার গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির উপর। সেই সময় মুখটা পরিচিত মনে হলেও পরিচয়টা ধরতে পারেনি। এবার ধরতে পারল। মুখের আদল সঞ্জয়ানের মতো মনে হতে সে চিৎকার করে ওঠল,
” কখনও না। ওটা আপনি হতে পারেন না। একদমই না। ”

বলতে বলতে সে দৌড়ে এলো সঞ্জয়ানের কাছে। খুলে রাখা পাঞ্জাবীটা দূরে ছুঁড়ে বলল,
” এমন বিশ্রী রঙের পাঞ্জাবী আর কখনও পরবেন না। কালো কাউয়ার মতো দেখতে লাগে। ”

শূভ্রার এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণটা দাঁত চেপে সহ্য করতে চেয়েও পারল না। তার দিকে ঘুরে বলল,
” আমাকে কাউয়ার মতো লাগে? আমার গায়ের রঙ কালো নাকি তোমার? মুখটা আয়নায় ঠিকমতো দেখেছ? আমাদের বাসায় ইঁদুরও এরচেয়ে সুন্দর। ”

এই প্রথম অপমানকে গায়ে মাখল না সে। আশপাশে চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে টেনে টেনে সুধাল,
” আপনাদের বাসায় ইঁদুর আছে? ”

সঞ্জয়ানের প্যান্ট বদলানো বাকি ছিল। শূভ্রার সামনে থেকে সরতে সরতে বলল,
” আমার রুমেই তো আছে। পুরো পাঁচ ফুটের বেঁটে ইঁদুর। ”

শূভ্রা ইঁদুরকে ভীষণ ভ’য় পায়। তাই সঞ্জয়ানের খোঁচা মারা কথাটা ধরতে পারল না। এক লাফে বিছানায় উঠে বসল। একটা বালিশ টেনে নিয়ে চোখদুটি খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। হাত-পা যতটা পারল গুটিয়ে নিয়ে একভাবে পড়ে থাকল। চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, আজ সে সঞ্জয়ানের রুমে আছে। তার খাটে ঘুমিয়েছে। তার বন্ধ চোখের পাতা খুলে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, সঞ্জয়ান এখনও স্নাগার থেকে বেরোয়নি। সে শুয়া অবস্থায় গড়িয়ে গেল কর্ণানের রাখা ছোট টেবিলটার কাছে। পানিভর্তি জগটা এক হাতে টেনে এনে তার পাশের ফাঁকা জায়গাটা ভিজিয়ে দিল নির্দ্বিধায়। আগের মতো চোখ বন্ধ করে নিতে নিতে বলল,
” আমি ভ’য়ে ম’রে যাব তবুও সাজনা শাকের সাথে ঘুমাব না। ”

পরদিন সকালে সে ঘুম থেকে উঠতে পারল না। জ্বরে গা গুলিয়ে বিছানায় বমি করলে স্বর্ণলতা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ছেলেকে ডাক্তারের কথা বললে সে জানাল,
” এসব ওর নাটক, মা। নিজের ইচ্ছে রাখতে মৃ’ত্যু’র অভিনয়ও করতে পারবে। ”

_____________
” আমি যদি সেলসম্যানের চাকরি করি, তোমার লজ্জা হবে? ”

মাইমূনের প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল অরুণিমা। তাকে কাজে যেতে দেয়নি আজ। প্রতিদিন তাকে রিকশায় করে কলেজে দিয়ে আসে ও নিয়ে আসে মাইমূন। আজ যাওয়ার পথে রিকশা অন্যদিকে ঘুরায়। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পায় না অরুণিমা। অনেকটা সময় নীরব থেকে সহসা এমন প্রশ্ন করলে চিন্তা-ভাবনা থমকে যেতে বাধ্য। অরুণিমা সংশয় নিয়ে ফিরতি প্রশ্ন করল,
” তুমি সেলসম্যানের চাকরি করবে? ”
” তোমার লজ্জা না লাগলে করব। ”
” আমার লজ্জা লাগবে কেন? কয়েক মাস আগে আমিও এই চাকরি করেছি। ”

মাইমূন আজ তার ভালোবাসার দিকে চেয়ে কথা বলছে না। রাস্তার দিকে চেয়ে থেকে উত্তর করল,
” তোমার করা আর আমার করা এক নয়। মেয়েদের চাওয়া থাকে তার জীবনসঙ্গীর সামাজিক মর্যাদা তার চেয়ে একটু হলেও উঁচুতে থাক। ”

চলবে