#আছি_তোমার_পাশে
অন্তিম পর্ব
লেখা – #Anjum_Tuli
.
.
সায়ান ভাই আবারও বলে উঠলেন বড় বাবা! তুতুল কিছুক্ষন ভেবে বলে উঠলো,
‘বড় পাপা’
রায়ান হেসে বলল, ‘হ্যা বড় পাপা’
সায়ান ভাইও হাসলো। এগিয়ে আসলো তুতুলের কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভালো থাকো মা’
কথাটায় হয়তো গভীর মায়া মেশানো ছিলো। সায়ান ভাই আর বেশিক্ষন অপেক্ষা করেন নি। চলে গেলেন।
চেয়ে দেখলাম। লম্বা দাড়ি বড় চুলেও যেনো মানুষটাকে খারাপ লাগলো না। কিংবা এক মুহুর্তের জন্যও মনে হলো না যে মানুষটা খারাপ।
সায়ান ভাই আসার পর থেকে বাড়িটা কেমন যেনো আনন্দে ভরপুর হয়ে গেলো। আম্মা সারাক্ষন ঘরটা মাতিয়ে রাখেন। সারাদিন সায়ান রায়ান করে উনার সময় পার হত। ছেলেরাও মায়ের এক কথাতেই সামনে এসে হাজির।
দেখতে দেখতে আমার ডেলিভারীর ডেইট এগিয়ে আসতে লাগলো। আট মাসের সময়ই ডাক্তার সিজারিং করার পরামর্শ দেন। বাচ্চার পজিশন দেখে। রায়ান ভয় পেলেও আমাকে একটুও বুঝতে দেন না। আমাকে উলটো সাহস দেয়।
আমি মানুষটার দিকে তাকাই। আমার সংসারের দিকে তাকাই। এই মুহুর্তে যেনো পৃথিবী থমকে গেছে মনে হচ্ছে। আমি এই সুন্দর পৃথিবী। আমার সংসার আমার পরিবার আমার তুতুলকে ছেড়ে যেতে চাই না। কিছুতেই এত তাড়াতাড়ি যেতে চাই না। পেটে হাত রাখলে মনে হয় আমি কিছু অনুভব করতে পারছি। আমার বাচ্চার অস্তিত্ব আমি টের পাই। চোখ থেকে দু ফোটা পানি নির্গত হয়। যদি! যদি কোনো কারণে অপারেশন থিয়েটার থেকে আমার জ্ঞান না ফিরে? তখন কি হবে? আমার বাচ্চা, আমার তুতুলের কি হবে? আচ্ছা রায়ান কি আরেকটা বিয়ে করবে?
তুতুল হুট করে এসেই আমায় জড়িয়ে ধরলো। পেটে একটু চাপ অনুভব করতেই মৃদু আওয়াজ বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে। তুতুল সাথে সাথেই সরে গেলো। ভয় পেয়ে গেলো। পাপা দাদু বলে চিৎকার করতে থাকলো। হুট করে কি হয়ে গেলো বুঝলাম না। আমার দুনিয়া যেনো অন্ধকারে পরিণত হয়ে গেলো। ঝাপসা চোখে দেখলাম সায়ান ভাইকে। তারপর তারপর সব কিছু অন্ধকার…..
পিটপিট করে তাকালাম যখন তখন চোখ দেয়ালে ঠেকলো। সাদা ওয়াল। পাশ ফিরে তাকালেই রায়ানকে দেখলাম। চেহারায় টেনশন। আমার হাতে ক্যানোলা লাগানো। মুহুর্তেই আমার বাচ্চার কথা মনে হতে পেটে হাত দিলাম। রায়ানের দিকে তাকালে সে বলে, ‘কিচ্ছু হয়নি। বাবু ঠিক আছে’
তুতুল ভয়ে সিটিয়ে আছে। আমি হাতের ইশারায় ডাকলাম। আসলো না। বিড়বিড়িয়ে যেনো কি বলল। রায়ান টেনে আনলো। ডান হাত দিয়ে গাল ছুলাম। মেয়েটা আমার ঝড়ঝড়িয়ে কেদে দিলো। আলতো করে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘কি হয়েছে সোনা। মাম্মা ঠিকাছি তো’
‘না মাম্মা আমি ছুলেই তুমি দুক্কু পেয়ে যাবে’ -কান্নার জন্য কথাগুলো যেনো অস্পষ্ট শুনালো।
আমি মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করলাম। এর ভিতরেই নার্স এসে বলল, ‘অপারেশন থিয়েটার রেডি। রোগীকে নিয়ে যেতে হবে। ‘
আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। সায়ান ভাই তুতুলকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন কেবিন থেকে। রায়ান এসে আমার মাথায় আলতু চুমু খেয়ে বলল, ‘আছি তো আমি। কিচ্ছু হবে না। টেনশন নিও না। আল্লাহ ভরসা।’
কি জানি আমার কি হলো। হুহু করে কেদে দিলাম৷ রায়ানের হাত ধরে বললাম, ‘আচ্ছা আমি যদি মরে যাই?’
রায়ান বাধা দিলো। বলল, ‘শু.. এমন কথা বলে না। থাকতে হবে তুমায়। আজীবন থাকতে হবে। আমার পাশে। ভালোবাসি রোদু। অনেখানি। যতখানি বাসলে কাউকে গভীর থেলে উপলব্ধি করা যায়। ‘
ট্রেজারে করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। মুহুর্তেই কি হয়ে গেলো। পৃথীবি আলো করে আমার কোলজোরে আমার রাজপুত্র এলো। রায়ানের খুশি দেখে কে। আমার প্রাণ ভরে গেলো তার খুশি দেখে। তুতুল বার বার কোলে নেয়ার বায়না করলো।
আমার ছেলেটার বয়স দেড় মাস। হেসে খেলেই দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। সায়ান ভাই এসে রায়ানকে বলল তিনি তুতুলকে নিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে চান। এই কথাটা শুনার জন্য আমরা কেউই মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। রাতে আর এ নিয়ে টেনশনে দুজনের কারো ঘুম হলো না। তবে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলাম। তুতুলকে সব জানতে হবে। যদিও তার বয়সটা খুব কম। তবুও তার ছোট্ট মস্তিষ্কে এটা ঢুকাতেই হবে সায়ান ভাই তার বাবা।
রায়ান রোদুসির একটা ছবি প্রিন্ট করে এনে তুতুলের হাতে দিলো। তুতুল ছবিটা নেড়ে চেড়ে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কে পাপা’
রায়ান মুচকি হেসে বলল, ‘তোমার মা’
তুতুলের চেহারা মলিন হয়ে গেলো। আমার কোল ঘেষে বসে বলল, ‘উহু আমার একটাই মাম্মা।’
আলতু হেসে আমার মেয়েটাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললাম,
‘দেখো মাম্মা তুমি না ব্রেভ গার্ল। আর ব্রেভ গার্লদের কখনো দুঃখ পেতে নেই। তারা তো স্ট্রং। আর স্ট্রংরা সব সময় হাসি খুশি থাকে।
এই যে ছবিটা দেখছো না? এটা তোমার একটা মাম্মা। আর আমি আরেকটা।
তোমার মা পৃথীবি থেকে অনেকখানি দুঃখ নিয়ে চলে গেছেন সোনা। অনেকখানি। কিন্তু একজন রয়ে গেছেন। যার দুঃখ গুলি তুমি চাইলেই দূর করতে পারো…!’
‘কে মাম্মা’
তুতুলের কথা শুনে আমি রায়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তোমার পাপা, বড় পাপা’
তুতুলকে বুঝালাম তার বাবা সায়ান ভাই। সে ধানাই পানাই করলেও। সায়ান ভাই সামনে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে কাদলো। কাদলো সায়ান ভাইও। কাদলাম আমিও। মুহুর্তটা ভীষণ বেদনা দায়ক। এক বাবা থেকে সন্তান কেড়ে নিয়ে আড়েক বাবাকে দিয়ে দিয়েছি বলে কি আকাশে বাতাসে দুঃখের ফোয়ারা বইছে?
রায়ানের দিকে তাকালাম। কি সুন্দর দৃশ্য। চোখে জল অথছ ঠোটের কোণে চমতকার এক হাসি। দুচোখ বুজে অশ্রু গুলোকে ফেলে দিলাম। আর কাদবো না। সুখের প্রহর গুনবো কেবল তুমি আমি মিলে।
রায়ান ভাই আর তুতুলের মিষ্টি সম্পর্কটা দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এই মানুষটা জীবনে কিছুই পায় নি। নিজের সন্তানকে চেয়ে কি খুব স্বার্থপরের মত কাজ করেছেন? রায়ানের দিকে তাকালে হাজারো কষ্টেরা জমলেও মনে হয় এই মানুষটুকুর এইটুক সুখ প্রাপ্ত। সে ডিসার্ভ করে।
______
শতেক ঝামেলার পর ফাইনালি আজ সায়ান ভাই তুতুলের ফ্লাইট। উহু শুধু তাদের দুজনের না। সাথে আম্মাও যাচ্ছেন। কেবল মাস ছয়েকের জন্য পিছিয়ে গিয়েছি আমি রায়ান আর আমার ছেলেটা। এই ছমাসই যেনো আমার কাছে অনেক অনেক দিন মনে হচ্ছে। বাচ্চা মেয়ে আর রায়ানকে বুঝ দিলেও মনে হচ্ছিলো আমার সন্তানকে কেউ আমার থেকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তুতুলকে কাছে এনে সারা মুখে চুমু একে দিলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে দেশ ছাড়ার আগে শেষ বাক্য বলল, ‘মাম্মা পুচুন আর পাপার খেয়াল রেখো, হ্যা?’
বাচ্চা মেয়েটা আমাকে কত বড় এক দায়িত্বের পাহাড় দিয়ে গেলো। রায়ান কাদছে। খুব কাদছে। আরে! বাচ্চা নাকি? এভাবে কেউ কাদে।
সিড়ির কাছে গিয়ে দুজন বসলাম। রায়ান আমার কাধে মাথা রেখে সুধালো,
‘থেকো মোর কাছে প্রিয়
সারাটিজীবন ধরে।
বিষন্নতার এই শহরে
ইট পাথরে ধুলো জমে
তবুও তুমি শেষ রাত্রি ভোরে
বলিও একটি বুলি
যেই বুলিতে প্রাণো মোর
শান্তিতে দুচোখ বুজে’
আমি হাসলাম বললাম,
‘আছি তো আছি, থাকবোও। তোমারি পাশে। আজীবন ভর। কাছে থেকো, ভালোবেসো ঠিক এমনি করে!’
____
এয়ার্পোরটের টিভির নিউজচেনেলে রেড এলার্ট দিয়ে হেডলাইন আসছে। শেষ পর্যন্ত ধরা পরলো অশ্র মামলায় পাচার কারী দল। সাথে তাদের লিডার।
হাতে নাতে ধরা ফয়সাল। সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর।
এবার কি হবে? এত এত অন্যায়ের বিচার কি হবে এই দেশে? নাকি আবারো পরিস্থিতি আর সমাজের যাতাকলে রোদুসি আর সায়ানের মত আরো কারোর জীবনে ভয়াবহ ঘূর্নিঝড় বয়ে যাবে।
রায়ানের দিকে তাকালাম। সে বিদঘুটে একটা হাসি দিলো। কি আশ্চর্য এসবের পেছনে কি সে আছে? থাকলে মন্দ নয়। বরং আমি আমার প্রিয়তমকে নিয়ে গর্ব করবো। বাসর রাতে বসে ভাবা বদরাগী বিরস সেই মানুষটাকে নিয়ে গর্ব করে বলবো, ‘তুমি সৈনিক, তুমি প্রেমিক, তুমি দায়িত্ববান স্বামী। তুমি ভাই, তুমি বাবা তুমিই মায়ের ছেলে। ছিলাম, আছি, থাকবো আজীবন তোমার পাশে’
সমাপ্ত
[গল্পটা একটা নির্দিষ্ট থিমে সাজিয়েছিলাম। হয়তো বা আমার কাচা হাতের লেখা সবার মন ছুতে পারে নি। তবে আমি আমার লেখার হাত ভালো করার চেষ্টায় আছি। এই ছোট লেখালেখির সখটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। অনেক আশা। আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার ইরেগুলার গল্পটাও এত ভালোবেসে পড়ার জন্য অনেক ভালোবাসা। ভালো থাকবেন। ভালোবাসবেন। ভালোবাসা নিবেন। শেষ পর্যন্ত কেমন লেগেছে তা বলতে ভুলবেন না।]