#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
২০.
আশ্বিন মাস। নদীর ধারে কাশফুলের শুভ্রতা আর দিগন্ত জোড়া সবুজ, সেসঙ্গে আকাশে ভেসে বেড়ানো চিলতে সাদা মেঘ আমাদের মনে করিয়ে দেয় বর্ষার শেষে আনন্দের বার্তা নিয়ে শরৎ এসেছে। শরতের আগমনে নর নারীর পরিধানে সাদা রংটাই শোভা পায়। কাশফুলের রঙের সাথে মিলিয়ে শুভ্ররঙে রাঙিয়ে দেয় তারা। হিমার জীবনটা এলোমেলোভাবেই চলছে। আজ ছয়মাস মীরের কোনো খবর নেই। হিমা নিজেকে একাকীত্বের দেয়ালে বন্দী করে রেখেছে। প্রথম প্রথম আশা রাগ করে থাকলেও মেয়ের কষ্ট দেখে মন গলে যায়। মেয়েকে এই ধাক্কা থেকে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করতে যায়। কিন্তু হিমা নিজেকে সকলের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একাকীত্বকে বেছে নেয়। তিনবেলা খাবারের টেবিলেই শুধু তার দেখা মিলে। খাওয়ার সময় হাজার কথা বললে একটি উত্তর দেয়। আশা তো একদিন হিমাকে খুব বকেছিল। হিমা সেদিন শুধু বলেছিল,“ আমাকে শাস্তি পেতে দাও মা! আমার থেকে হাজারগুন যন্ত্রণায় মীর ভাই ছিল, এখনো আছে। তাহলে আমি কীভাবে সুখে থাকি! কীভাবে আনন্দে উল্লাসে জীবনকে রাঙিয়ে দেই!”
আশা সেদিক মেয়েকে ধরে খুব কেঁদেছিল কিন্তু হিমা একটুও কাঁদেনি। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে বাহিরে তাকিয়ে ছিল।
শরতের বিকালে হিমা দিয়াবাড়ি এসেছে। এখন সে একাকীই চলাফেরা করে। রিপ্তী অনেক তার কাছাকাছি থাকতে চায় কিন্তু হিমা! রিপ্তী যেন তার প্রধান দুশমন। রিপ্তীকে দেখলেই এক প্রকার পাগলামো করে। রিপ্তী বান্ধবীর এমন অবস্থা দেখে কান্না করে। অদূরে থেকেই বন্ধুর মঙ্গল কামনা করে। কাশবনের একটি নির্জনস্থান খুঁজে হিমা সেখানে বসে। রাদিফের কাছে দেওয়া চিঠিটা ব্যাগ থেকে বের করে পড়তে থাকে। এবারের পড়া নিয়ে হিমা সত্তরবার চিঠিটা পড়ছে। এই চিঠি পড়লে হিমার যন্ত্রণা আরো তীব্র হয়। মীর হীনা জীবন অন্ধকার তা উপলব্ধি হয় তার। তাই তো হিমা চিঠিটা বার বার পড়ে। যন্ত্রণায় নিজেকে ছারখার করতে থাকে তার হৃদয়। হিমা ছলছল চোখে চিঠি পড়া শুরু করে,
হিমালয়,
আজ তোকে মুক্তি দিয়ে দিলাম, হিমালয়! বিশ্বাসহীন সম্পর্ক রেখে কী লাভ বল! তুই আমাকে ভালোবাসিসনি, হিমালয়। আমি হয়তো তোকে অনেকটাই জোর করে ফেলেছি আমার হওয়ার জন্য, তাই না! আমার উচিত হয়নি তোকে এভাবে ফোর্স করার। এজন্যই আজ আমাদের এতো কষ্ট। ঠিক আমাদের বলা উচিত না, আমার কষ্ট, হ্যাঁ হিমালয়! আমার কষ্ট। খুব কষ্ট হচ্ছে রে! একটু আসবি? আরে তুই কীভাবে আসবি। তুই তো আমার থেকে দূরে থাকার জন্যই সম্পর্ক শেষ করে দিলি। তুই সুখে থাক, হিমালয়। একটা রাজপুত্র দেখে বিয়ে করে নিস।আমাকে নিয়ে ভাববি না। এখন থেকে এমনিতেও বেঁচে থেকেও ম’রে যাবে। ভালো থাকিস রে! রাদিফকে দিয়ে গেলাম। মিলির সাথে বিয়ে দিয়ে দিস।
ইতি
আমি
চিঠিখানা পড়ে হিমা ডুকরে কেঁদে উঠে। চিঠিতে অজস্র চুমুও খায়। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,“ আমার রাজপুত্র চাই না,মীর ভাই। শুধু তোমাকে চাই। একটিবার তোমার পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ করো দাও, একটিবার!”
হিমা দূর নীলিমায় তাকিয়ে হাজার হাজার অভিযোগ করে।
সন্ধ্যা হতেই ব্যাগপত্র নিয়ে রিকশা ধরে বাড়ির দিকে রওনা দেয়!
সন্ধ্যায় পড়াশোনা বাদ দিয়ে মিলি বার বার মেইন গেইটের কাছটায় এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। হিমা এখনো বাসায় ফিরেনি। তার জন্য চিন্তায় সে আধমরা। পাগল মেয়েটা বা জানি কোথায় গিয়ে বসে আছে! এই বাড়িতে আসার পর থেকে হিমার আচার-আচরণ দেখে পাগলী বলে উপাধি দিয়েছে। মানুষের খারাপ সময়ে উপহাস করতে নেই কিন্তু মিলি নিজের চরিত্র থেকে বের হতেই পারে না। এই ওয়াদা করে সে ভালো হয়ে যাবে কিন্তু দুই মিনিট পর যেই লাউ সেই কদু। হিমাদের বাড়িটাকে আদর্শ বাড়ি থেকে জঙ্গলের বাড়িতে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। উত্তর পাশটায় যেখানে ফুলের গাছে শোভা পেতো সেখানে এখন শাক সবজির বাগান। মিলি নিয়ম করে দুই বেলা তা পরিচর্যা করে।
মিলির উত্তেজনার সাথে আরো একজন যোগ দেয় সে হচ্ছে মারিয়া। এসেছে বিকালেই। রাদিফ তাকে নিয়ে এসেছে। মায়ের কাছ থেকে কিছুদিন নিজের চুলকে রক্ষা করার জন্যই মূলত এখানে আসা। হোসনেআরা এতোদিন মারিয়ার চুলের যত্নশীল ছিল। ইদানীং সে মারিয়ার গোলাপী গাল নিয়েও বিশ্লেষণ শুরু করে দিয়েছে। তার কথা, পিতৃহীনা মেয়েকে যদি ত্বকের জন্যও কথা শুনতে হয়! তখন কী হবে। এজন্য সে উপটান, কাঁচা হলুদ, আমলকির সিরকা কোনোকিছুই বাদ দেয়নি। সব উপাদান মেয়ের উপর প্রয়োগ করেছেন। মারিয়ার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এখানেই থেকে যেতে। নেহাৎ সে ভদ্র মেয়ে নয়তো মাকে রেখে কবে চলে আসতো!
“ ঐদিকে কি দেখছো? কেউ আসবে নাকি?”
রাদিফ ফোনে কার সাথে যেন ম্যাসেজ করছিল। মিলির অস্থিরতায় সেই অস্থির হয়ে গেছে। এই মেয়েটা এতো চঞ্চল কেন? স্থির হয়ে বসতে পারে না! রাদিফ পুরা একমাস পর ঢাকায় এসেছে। ভবিষ্যৎ স্বামী সে! এখন থেকেই একটু আকটু যত্নাদি করে শিখবে তা না করে সে অন্য জনের অপেক্ষা করছে। রাদিফের কথার প্রত্ত্যুত্তরে মিলি বলে,“ আরে পাগলটার জন্য অপেক্ষা করছি। কোথায় বসে থেকে না জানি কি করছে!”
“ কি বললে?”
ভুল স্থানে ভুল কথা বলায় মিলি জিহ্বা কাটে। উঁকি দিয়ে রান্মাঘরের দিকে তাকায়। আশা নেই সেখানে। থাকলে তাকে আজ বাড়ি ছাড়া করতো! মিলি মিনমিন স্বরে উত্তর দেয়,“ মনু পাগলী এসেছিল। সে বেরিয়ে যাওয়ার পর হিমা আপুও বেড়িয়ে গিয়েছিল। তাই!”
রাদিফ হিমার কথা শুনে চিন্তিত হয়। ফোনে টুকটাক কিছু লেখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হিমাকে খুঁজতে হবে। দেখা গেল রাদিফকে আর আগাতে হয়নি তার আগেই কলিং বেল বেজে উঠে। মিলি গেইটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল বিধায় ঝটপট খুলে দেয়। হিমেলের কাঁধে হিমার হাত! সে মেয়েকে ধরে ধীরপায়ে এগিয়ে আসছেন। মিলি তড়িৎ গতিতে হিমার অন্য হাতে ধরে। হিমার শরীর কাঁপছে। জ্বর এসেছে। দুজন ধরাধরি করে হিমাকে ঘরে শুইয়ে দেয়। আশাও ততক্ষণে চলে আসে।মেয়ের করুণ অবস্থা দেখে কান্না করতে থাকে। মিলি এই ফাঁকে পরিস্কার পানি ও টুকরো কাপড় নিয়ে আসে। আশা নাক টেনে হিমার গা মুছে দেয়। কিছুক্ষণ পর হিমেল রাদিফ আসে। হিমেলের চোখ লাল হয়ে আছে। চোখের সামনে একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা তার সহ্য হচ্ছে না। সে রেগে রাদিফের উদ্দেশ্যে বলে,“ দেখেছো মেয়ের অবস্থাটা? তো দেখবে কেন? তোমাদের কারোর দেখতে হবে না। তোমরা সবাই সুখে থাকো আমি আমার মেয়েকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাব।”
হিমেলের কথার মর্মার্থ কেউ বুঝতে পারছে না। আশা অবাক হয়ে বলতে শুরু করে,“ আমার মেয়ের জন্য আমারও চিন্তা হচ্ছে। তাই বলে মাথা গরম করছি? তুমি এমন ভুলভাল বকছো কেন?”
হিমেল এবার বিরাট এক কাণ্ড করে বসে। টেবিলের উপরে থাকা কাঁচের গ্লাস ভেঙে চিৎকার করে বলে,“ আমার মেয়ের মীরকে লাগবে। তোমরা সবাই জানো সে কোথায়! মেয়ের সামনে নাটক করছো। কেন আমার মেয়েকে এতো কষ্ট দিচ্ছো? ওহ, হ্যাঁ! তোমরা তো আমার মেয়েকে শাস্তি পেতে দিচ্ছো। ছয় মাস কি কম সময় নয়! আর কতো? এই রাদিফ, আমি জানি তুই জানিস মীর কোথায়। এক্ষুনি তাকে কল করবি। সে আজকের মধ্যে ফিরে আসবে নয়তো আমি আমার মেয়েকে নিয়ে সারাজীবনের জন্য দূরে চলে যাবো।দরকার পড়লে পঁচিশ বছরের সংসারও ত্যাগ করব।”
আশা এবার অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। হিমেল তাকে ছেড়ে দিবে এমন কথাও সে বলতে পারল? এদিকে রাদিফ বেগতিক অবস্থা দেখে হিমেলকে থামায় এবং বলে,“ মীর কোথায় আছে তা আমি জানি না।”
“ জানো না মানে! সে তো শেষে তোমার সাথেই ছিলো। নিজের সম্পর্কে কিছুই বলেনি? আমার মেয়েকে না পাগলের মতো ভালোবাসে? এতদিন খোঁজ নেওয়া ছাড়া থাকতে পারছে? নাকি সে আমার মেয়েকে ভালোই বাসেনি। আমি কি ধরে নিব, আমার মেয়ের প্রয়োজন তার জীবনে শেষ তাই ঠুকরে ফেলে দিয়ে চলে গেছে সে!”
“ এমন নয় ফুফা। আপনি শান্ত হোন!”
হিমেল শান্ত হয়নি। বরঞ্চ আশার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে,“ আমি এই মাসের মধ্যেই মেয়েকে নিয়ে দূরে চলে যাবো। তুমি থাকো তোমার পরিবার নিয়ে।”
হিমেল দাঁড়ায় না। মেয়ের এই অবস্থা তার সহ্য হচ্ছে না। আশার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। সে মূর্তির মতো বসে আছে। মিলি কি করবে বুঝতে পারছে না। সে মারিয়ার সাথে এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রাদিফ কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। আজ সে নিরুপায়, অসহায়! চোখের সামনে এতো এতো মানুষের কষ্ট দেখেও কিছু করতে পারছে না।
চলবে ইনশাআল্লাহ………..
#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
২১.
কোন এক বর্ষায় দেখা মিলবে তোমার,
যদি চাও পুনরায় ভালোবাসবে আমায়!
হিজলতলী গ্রামে গড়ব সুখের ঘর
তুমি হও যদি একান্তই আমার!
~আফসানা মিমি
হিমার অবস্থান হাসপাতালের সাদা বিছানার উপর। তিন ডানা বিশিষ্ট পাখায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন ভাবে। কারো সাথে ঠিক করে কথা বলে না। সেলাইনের মাধ্যমেই তার শরীর ঠিক আছে। খাবার বলতে, মিলির হাতের টমেটোর স্যুপ। সকাল সকাল ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে হিমেল মেয়েকে দেখতে আসেন। তার মুখে চমৎকার হাসি। মেয়েকে আজ সুস্থ করে ফেলবেন যেন সেই হাসিতে। শপিং ব্যাগ থেকে একে একে নতুন ড্রেস বের করে আনেন তিনি। সবগুলো মেয়ের সামনে মেলে ধরে বলতে থাকেন,“ দেখ তো মা, কোন জামাটা সবচেয়ে সুন্দর?”
হিমা তার বাবার চোখে কষ্ট কিন্তু ঠোঁটে হাসি দেখতে পায়। তা দেখে শুষ্ক ঠোঁট বিস্তৃত করে সেও হাসে। যেই হাসিতে হাজারো মুক্ত ঝড়তে থাকে। হিমেল মেয়ের হাসি দেখতেই থাকে। হিমা বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। সবগুলো জামার উপর হাত বুলিয়ে লাল রঙের একটি জামার উপর হাত রাখে। বাবার উদ্দেশ্যে মিষ্টি হেসে বলে,“ আমি সুস্থ হয়ে যাবো, যদি তুমি আমাকে পরিবার থেকে দূর না করো!”
হিমা জামাটা নিয়ে বাথরুমে চলে যায়।হিমেল হিমার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারে। সে তো রাগের মাথায় সেদিন চলে যাওয়ার কথা বলছিল। তাই বলে সত্যিই কী সে মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে! তার প্রাণ হচ্ছে মেয়ে কিন্তু জান তো একটাই, আশা। আশাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল সে। দুইজনকে ছাড়া হিমেল অপূর্ণ। পাঁচ মিনিট পর হিমা আসে। অসুস্থতায় একদম রোগা হয়ে গেছে। হিমেল মেয়েকে বিছানায় বসায়। ছোট বেলার মতো মাথায় ঝুঁটি বেঁধে দেয়। এরপর গলায় ওড়না জড়িয়ে বলে,“ বেড়াতে যাবি?”
হিমা দুর্বল হেসে উত্তর দেয়, “কাঁধে করে মেলায় ঘুরাবে?”
মেয়ের বাচ্চামো কথায় হিমেল হিমা দুজনেই হেসে ফেলে। মেয়েকে ধীরে ধীরে হাসপাতাল থেকে বের করে একটা রিকশা ডাকে। অনেকদিন পর রিকশার বাতাস হিমা গায়ে লাগায়। চোখবুঁজে মীরকে স্বরণ করে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝড়ে। বাবার আড়াতে তা অতি সমর্পণে মুছেও নেয়। আজ থেকে সে কাঁদবে না। পরিবারের জন্য হলেও সে হাসবে। অশ্রু জমা করে রাখবে নিশ্চুপ আঁধার রজনীর জন্য। দিনের একটা সময় শুধু সে মীরের কথাই ভাববে। বাবা মেয়ে মিলে সারাদিন ঘুরাফেরা করবে। হিমা অসুস্থ থেকে কেবল সেড়ে উঠেছে তাই সে বাহিরের খাবার মানা করে দেয়। হিমেল মেয়েকে নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। বাবা মেয়ে টুকটাক কথাও বলতে থাকে। একসময় হিমার চোখ যায় সামনের টেবিলের দিকে। হিমার পরিচিত কেউ একজন বসে আছে। এতদূর থেকে কথা শোনা না গেলেও হাতের নড়াচড়া দেখে হিমা চিনতে পারে মানুষটা কে। হিমেলের একটা কল আসায় সে সাইডে গিয়ে কথা বলতে চলে যায় এই সুযোগে হিমাও উঠে পরিচিত মানুষটার কাছে যায়। কোন কথা না বলেই মানুষটার পাশে গিয়ে বসে। টেবিলের উপর এক হাত ভড় দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,“ তা এটা কত নাম্বার মিটিং, রিপ্তী ম্যাডাম!”
রিপ্তী এসেছিল নতুন বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে। আকস্মিক হিমাকে দেখে ভয়ে লাফিয়ে উঠে। সামনে বসা ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলে,“ আঙ্কেল, আপনার মেয়েকে কাল থেকে পড়াবো, পাক্কা।”
সম্মুখে বসা ছেলেটি ভরকে যায়। অবাকের সুরে শুধায়,“ কি সব বলছো, সোনা?”
“ আরে! আপনার মেয়ের নাম সোনা; বড্ড কিউট নাম। ও হিমা, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আপনি চলে যান আঙ্কেল, অফিস আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
ছেলেটি ভেবাচেকা খেয়ে সত্যি সত্যিই চলে যায়। এবার রিপ্তী বোকা হেসে হিমার দিকে তাকায়। হিমা তখনও ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকে দেখছে। রিপ্তী ঢং করে বলতে শুরু করে,“ আমার চল্লিস নাম্বার বয়ফ্রেন্ড আমায় ধোঁকা দিয়ে এক কাল নাগিনীকে বিয়ে করে ফেলেছে রে, হিমা! তাইতো আমি দেবদাস হয়ে মক্কেলদের পটাই!”
রিপ্তীর কথায় হিমা জোরে হাসতে শুরু করে। রিপ্তীও হাসছে। একসময় সে হিমাকে জড়িয়ে ধরে। হিমাও বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে। হিমা খেয়াল করে রিপ্তী কাঁদছে সে জানে রিপ্তীর কান্নার কারণ। পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,“ প্রতিদিন তোকে নিয়ে ঢাকা শহর টই টই করে বেড়াবো। খুশি?”
হিমেল এসে হিমার সাথে রিপ্তীকে দেখতে পেয়ে খুশি হয়। সে বলতে শুরু করে, “ আরে রিপ্তী, কখন আসলে? কারো৷ সাথে দেখা করতে এসেছো বুঝি?”
হিমা বাঁকা চোখে রিপ্তীকে দেখে। রিপ্তী বোকা হেসে মাথা না বোধ ইশারা করো যেন সে হিমেলকে কিছু না বলে। হিমা মুখ চেপে হাসে। রিপ্তীর বেহাল অবস্থা দেখে মজা পাচ্ছে। অনেকদিক পর হিমা মন খুলে হাসছে। আজ কেন যেন হিমার মন হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে আজ ভালো কিছু ঘটবে। ভেতর থেকে আনন্দ উচ্ছ্বাস বের হয়ে আসছে। হিমেল মেয়ের মুখের হাসি দেখে শান্তি পায়।
তিনজন একসাথে খেয়ে দেয়ে ঘুরতে বের হয়। রিকশার হুডি তুলে মন ভরে নিশ্বাস নেয়। রামপুরায় এসে হাতির ঝিলে রিপ্তী ও হিমা নেমে যায়। হিমা হাতির ঝিলের ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আশপাশ দেখতে থাকে। অদূরে চোখ যায় এক জোড়া প্রেমিক যুগলদের উপর। যাদের দেখেই বুঝা যাচ্ছে তারা খুবই খুশি। দুজন একসাথে বসে আছে। ছেলেটা এটা সেটা বলে মেয়েটাকে লজ্জা দিচ্ছে। ছেলেটা লাজুকমূখী প্রেমিকার মাথায় হাত বুলিয়ে লজ্জা নিবারণ করছে। হিমা তাদের দেখে মন খারাপ করে। মীর যদি আজ তার পাশে থাকতো তাহলে তার জীবন আজ অন্যরকম হতো। রিপ্তী ফুচকার অর্ডার করতে গিয়েছিল। হিমেল কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছে। তাদের হাতিরঝিল ছেড়ে জরুরি কল আসায় চলে গিয়েছে।
“ কিরে! কী ভাবছিস?”
“ ভাবছি মীর ভাইয়ার কথা, সে কীভাবে এতোদিন আমাকে ছাড়া থাকতে পারছে? আমি তো যন্ত্রণার আগুনে ক্ষণে ক্ষণে পুড়ছি। সেও কী একই যন্ত্রণায় আছে?”
রিপ্তী কি বলবে বুঝতে পারছে না। মূলত এই মুহূর্তে কি বলা উচিত তার? রিপ্তীর ভাবনার মাঝেই তৃতীয় কেউ একজন এসে উপস্থিত হয়। সে হাসিমুখে রিপ্তীর উদ্দেশ্যে বলে,“ আমার বন্ধুকে তুমি এভাবে ধোঁকা দিতে পারলে? সে তো তোমার স্বরণে দিনরাত মদের নেশায় ডুবে থাকে।”
রিপ্তী ভুত দেখার মতো তাকিয়েই রয়। তারচেয়ে বড়ো অবাক হয়েছে হিমা। তার চোখে অশ্রু, সেই দিনের মতো আজও কথা বলতে পারছে না। আগন্তুক এবার হিমার উদ্দেশ্যে বলে,“ তা আজ কোন কালাচানের সাথে দেখা করতে এসেছিস? সে কি জানে, তোর মনে প্রাণে যে অন্য জনের বাস? নাকি বান্ধবীর সাথে মিশে জনে জনে ছেলেদের ধরে মক্কেল বানাচ্ছিস?”
হিমা শব্দ করে কান্না করতে থাকে। সম্মুখে বসা মানুষটার হাত ধরে মাথা ঠেকে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে থাকে। তা দেখে আগন্তুক পুনরায় বলতে শুরু করে,“ শুনেছি হাতিরঝিলে অনেক সুন্দরী রমণীর আনাগেনা। তাদের কাছে যদি পশমহীনা বুকের ব্যাখ্যা জানতে চাই, বলবে তো?”
হিমা এবার চোখ তুলে তাকায়। আগন্তুকের বুকে আঘাত করে বলে,“ তুমি খুব খারাপ হয়ে গেছো,মীর ভাই! একদম আমার সাথে কথা বলতে আসবে না।”
মীরের চোখ জোড়া ছলছল করে উঠে। সে হিমাকে শক্তকরে বুকে জড়িয়ে ধরে। হিমার মাথায় অজস্র চুমু এঁকে বলে,“ তোর থেকে দূরে থেকে আমিও ভালো ছিলাম না, হিমালয়! একটি সম্পর্কের বিশের প্রয়োজন হয় এটা বুঝতে তুই এতো দেরী করলি কেন, পাগলি?”
হিমা কথা বলছে না। সে মীরের বুকে আজ ছয় মাস পর সুখ খুঁজে পেয়েছে। মীর হিমাকে তুলে মাথার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দেয়। আজ রিপ্তীর চোখেও জল। দুজন মানুষ দূরে থেকেও যন্ত্রণায় ছিল। বাস্তবতা বুঝাতে গিয়ে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। আজ সকল মান অভিমান দূর হবে। তার প্রিয় বান্ধবীর আবারো আগের মতো চঞ্চল হয়ে উঠবে। তাদের অপেক্ষার ফল এবার বুঝি মিষ্টিই হবে!
মীর হিমার হাত ধরে বসে আছে। হিমার মনে হাজারো কথা জমে আছে। কোথায় থেকে কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। মীর তা দেখে হিমার হাত শক্ত করে ধরে। কাব্যিক স্বরে বলতে শুরু করে,
আজও তোমারই অপেক্ষায় রবো নীরবে,
তুমি আসবে, ভালোবাসবে এভাবে।
সকল গ্লানি মুছে হাতে হাত রাখবো গোপনে,
লজ্জিত মুখে তাকিয়ে বলবো,
ভালোবাসি গো তোমাকে!
চলবে ইনশাআল্লাহ……….