#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
১৬.
রাদিফ নিখোঁজ। সংবাদটা শোনার পর থেকে হিমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সে ঘরে বসে সবার আড়ালে কাঁদছে। রাদিফ তাকে পছন্দ করতো আর তার জন্যেই রাদিফ দূরে চলে গিয়েছে। আফজাল হোসেন নিচে বসে কাঁদছে, আশা কি বলে ভাইকে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারছে না সেও ভাইয়ের সাথে কাঁদছে। হিমেল অফিস থেকে খবর পেয়েই চলে এসেছে। হিমার কান্না বন্ধ হয় মীরের কল পেয়ে। সে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। এখন বিকাল চারটা বাজে এই সময়ে মীরের অফিসে থাকার কথা। হিমা চোখের জল মুছে কল রিসিভ করে। ” হ্যালো” বলতেই অপরপাশ থেকে মীরের আওয়াজ ভেসে আসে, “ আমার জানপাখিটা কি করছে?”
হিমা নিজের কান্না অনেক কষ্টে আঁটকে রেখেছিল। মীরের আদুরে মাখা স্বর শুনে জোরে কান্না করতে থাকে। এদিকে মীর ছটফট করছে তার হিমালয়ের কোথায় কষ্ট বুঝতে চেষ্টা করছে। এক সময় ফোন কে’টে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল করে। হিমা তখন বিছানায় শুয়ে কাঁদছিল। মীরের কল রিসিভ করে সে ফিরে তাকায়! মীর হিমার রক্তিম চোখজোড়া দেখে বুঝতে পারে সিরিয়াস কিছু হয়েছে। তাই গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করে,“ কি হয়েছে, হিমা? কাঁদছিস কেন?”
“ রাদিফ ভাই আমার কারণেই চলে গেছে,মীর ভাই?
মীর চোখ বন্ধ করে নেয়। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে বলে,“ তোকে বলেই দিয়েছে?”
হিমা অবাক হয়। মীর কি সব জানতো? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,“ তুমি সব জানতে?”
মীর মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক ইশারা করে এবং কয়েক সপ্তাহ পূর্বের ঘটনা খুলে বলে।
সেদিন ছাদে হিমা চলে যাওয়ার পর রাদিফ ও মীর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। ভনিতা ছাড়াই রাদিফ বলে ওঠে, “ আমি হিমাকে ভালোবাসি,মীর!”
মীর কথাটা শুনেই রাদিফকে মা’র’তে প্রস্তুত হচ্ছিল ঠিক তখনই রাদিফের পরের কথা শুনে থেমে যায়,“ আমি তাকে ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু সে তোকে ভালোবাসে। সে তোকে পেয়েই খুশি তাই আমিও তার খুশিতে খুশি। তাকে ভালোবাসি বলেই তোর কাছে দিচ্ছি কারণ আমি তোকেও ভালেবাসি। আমার ভালোবাসাকে ভালো রাখিস মীর!”
মীর চুপ করে থেকেছিল সেদিন! হিমাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। সেদিন রাদিফকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,“ তোর জীবনসঙ্গী যেন তোকে খুব ভালোবাসে, রাদিফ। শুধু তুই আমাদের ভুল বুঝিস না।”
হিমা কথাগুলো শুনে আরো কাঁদছে। তার জন্য আজ তিন তিনটে জীবনে ঝড় নেমে এসেছে। না জানি হিমার রাদিফ ভাই কেমন আছে!
———————————-
“ আব্বা, একজন ছেলে লালপানি নদীর পাড়ে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে, জলদি আসো!”
“ বাঁইচা আছে তো, মিলি!”
“ শ্বাস চলছে, কতক্ষণ চলবে জানি না। মাথায় র’ক্ত জমাট হয়ে আছে। না জানি কতদিন ধরে এই অবস্থায় আছে।”
সিলেটের জৈন্তাপুর সদর থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমের উপত্যকায় বাবা, মেয়ের বসবাস। ধান ক্ষেতের পাড়ে সেখানে একটি কুঁড়ে ঘরে তারা থাকে। ধান চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করে। উপত্যকার পাহাড়, ক্ষেত সবকিছুই তাদের চেনা। সকালে মিলি সদরে গিয়েছিল। ফেরার পথে লাল পানির পাড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে সে। সাথে সাথে দৌড়ে বাবাকে খবর দিতে আসে। রফিক মিয়া এসে ছেলেটাকে সোজা করে। মুখ থেকেই তার আফসোসের স্বর বের হয়ে আসে,“ আহারে চান্দের মতন ছেলেটা কার কি দোষ করছিল!”
রহিম মিয়া ছেলেটার বুকে মাথা পেতে হৃৎস্পন্দন শুনতে চেষ্টা করে।
“ আব্বা, বেঁচে আছে তো?”
“ হো, চল বাড়ি নিয়া যাই। র’ক্ত পরিষ্কার কইরা সদরে নিয়া যামু নে।”
বাবা মেয়ে ধরাধরি করে ছেলেটাকে কুঁড়ে ঘরে নিয়ে আসে। মিলি চঞ্চল পায়ে কুসুম গরম পানি করে এনে ছেলেটার হাত,পা কপাল পরিষ্কার করে দেয়। সে ভেবেছিল, মাথার আঘাত খুবই বড়ো হবে; কিন্তু না! ডান পাশের ভ্রুর ওপর অংশ কে’টে গেছে। যার দরুন র’ক্ত প্রবাহিত হয়েছে। মিলি আরো লক্ষ করে ছেলেটার শরীর কাঁপছে। দুর্বলতার কারণে নড়তে পারছে না। সে ভাবে, ছেলেটাকে কী খাওয়াবে। তাদের কাছে তে বড়োলোকি খাবার নেই। সে সদরের এক দোকানের টেলিভিশনে দেখেছে। কেউ অসুস্থ হলে তাকে লাল পানি জাতীয় স্যুপ রান্না করে খাওয়ায়। হঠাৎই মিলির মনে পড়ে যায়, তার মা ছোট বেলায় ভাতের মাড় ফেলতেন না। মিলি জিজ্ঞেস করলে বলতেন, “ ভাতের মাড় খেলে শক্তি হয়,শরীর ভালো থাকে।”
মিলি সেই কথা স্বরণ করে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না। কিছুক্ষণ আগেই সে ভাত চড়িয়েছিল। সেখান থেকে মাড় এনে একটি চামচের সাহায্যে ছেলেটার মুখে অল্প অল্প ঢালতে থাকে। খওয়ার পর্ব শেষ করে চিন্তিত হয়ে ছেলেটার পাশে বসে সে। রহিম মিয়া সদরে গেছেন তাদের সাধ্যি মতো ঔষধ আনতে।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর ছেলেটা নড়েচড়ে উঠে। মিলি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা চোখ খুলে তাকায়। আশপাশ চোখ বুলিয়ে মিলির দিকে গিয়ে থামে। মিলির ডাগর আঁখিদ্বয় যেন তাকে বলছে, “ আপনি ঠিক আছেন?”
দেখা গেল ছেলেটার ভাবনা অনুযায়ী মিলি মুখ খুলে,“ আপনি ঠিক আছেন?”
উত্তরে ছেলেটা মাথা নাড়ায়। অনুভব করে মাথার তীব্র যন্ত্রণা। মিলি তাড়হুড়ো করে বলে,“ মাথা নাড়াতে হবে না, আব্বা সদর থেকে ঔষধ আনতে গেছে। খেলে মাথার যন্ত্রণা কমে আসবে। একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আব্বা এই আসলো বলে!”
ছেলেটা তাই করে। চোখ বন্ধ করে দাঁত খিঁচে শুয়ে থাকে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রহিম মিয়া ঔষধ হাতে ফিরে আসে। মিলি তখন তাজা টমেটো চটকাতে ব্যাস্ত। বাবাকে দেখে হাত ধুয়ে বলে,“ জ্ঞান ফিরেছে, আব্বা। তুমি দেখোতো কি নাম, কই বাড়ি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারো কি না!”
মিলি পুনরায় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটি পাতিলে টমেটোর রস ঢেলে তাতে কিছু শুকনো মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে জ্বাল দিতে থাকে। রান্না হয়ে যেতেই বাটিতে টমেটোর ঝোল ঢেলে উঠে দাঁড়ায়।
রহিম মিয়া ছেলেটার পাশে বসতেই চোখ খুলে তাকায়। রহিম মিয়ার সাহায্যে বসতে চেষ্টা করে। রহিম মিয়া ধরে ছেলেটাকে বসায়। শরীরে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,“ এই অবস্থা কেমনে হলো, বাজান? তোমার দেশ কই, তোমার নাম কি?”
মিলি তখন বাটি হাতে ঘরে প্রবেশ করে শুনতে পায় ছেলেটি কোন কথা বলছে না। মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছে। মিলি ঘরে প্রবেশ করে বাবার উদ্দেশ্যে বলে,“ অসুস্থ মানুষের মাথায় বেশি চাপ দিতে নাই, আব্বা। আমি বইয়ে পড়ছি। তুমি ধান ক্ষেতে ঘুরে আসো। রান্না চড়ানোর আগে ছাগল তাড়িয়ে আসছি।”
রাহিম মিয়া তাই করে। গামছা কাঁধে ফেলে বাড়ির সামনের অংশের ক্ষেতের দিকে এগিয়ে যায়।
মিলি ফু দিয়ে টমেটোর ঝোল ঠান্ডা করছে। পরিধানে সস্তা সুতোর কাপড়। বাম বুকে ওড়না ঝুলিয়ে কোমরে প্যাঁচিয়ে রেখেছে সে। বয়স সতেরো আঠারো হবে। এজ চামচ টমেটোর ঝোল ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,“ আমার নাম মিলি। টেন পাশ। আব্বা মুর্খ মানুষ, তার সাথে বইয়ের ভাষায় কথা বললে খুশি হয়। আমি কথা বললে নাকি আব্বার গর্বে বুকে ফুলে উঠে। এই উপত্যকায় জন্ম। আব্বা ছাড়া আমার কেউ নাই। আমি কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলতে পারি,,,,,!”
মিলির কথায় ছেলেটা কিছু বলে না। চুপ করে মিলির হাত থেকে টমেটোর ঝোল ফেয়ে নেয়। মিলও আবারও বলতে শুরু করে, “ আপনাকে দেখে ঢাকার ছেলে মনে হচ্ছে। আর ঢাকায় যারা থাকে তারা বড়োলোক হয়। আপনিও বড়োলোক। সদরে একটি দোকানে সিনেমাতে দেখেছি, অসুস্থ হলে টমেটোর স্যুপ খাওয়ায়। ঐসব কেনার সামর্থ্য নাই তাই নিজের গাছের টমেটোর সাথে গুরে মরিচ মিশিয়ে ঝোল রান্না করেছি। কেমন লাগছে?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে ভালো বলে আবার খেতে শুরু করে।মিলি ভাবে, ছেলেটা হয়তো বোবা, কথা বলতে পারে না তাই তো মিলির এতো কথা বলার পরও উত্তর দিচ্ছে না! মিলির খুব আফসোস হয়। সে মনে মনে বলে,“ আহারে! এতো সুন্দর ছেলেটা কথা বলতে পারে না!”
পরেরদিন সকালে মিলি ঘুম থেকে উঠে উনুনে আগুন দেয়। প্লেট বাটি নিয়ে পাশের নালায় চলে যায়। আজ তার ভালো ঘুম হয়নি। সে আজ জমিনে শুয়েছিল। মেহমান এক খাটে আর তার আব্বা আরেক খাটে। তার উপর মেহমান জোয়ান অপরিচিত ছেলে, চিন্তায়, ভয়ে ঘুম হয়নি। তাই সে প্রতিদিনের তুলনায় আজ একটু সকালে উঠে কাজে লেগে পড়ে। সকালের রান্না চড়িয়ে সে উঠোন ঝাড়ু দিতেই কারো সাথে ধাক্কা খায়। মিলি পিছনে ফিরে অসুস্থ ছেলেটাকে দেখতে পেয়ে হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করে,“ এতো সকালে কোথায় যান?”
ছেলেটি ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। উনিশ-বিশ কিছু একটা ভেবে গম্ভীর স্বরে বলে,“ আমার নাম রাদিফ। কথা বলতে পারি। তবে বাচালদের থেকে দূরে দূরে থাকি।”
চলবে ইনশাআল্লাহ…………..
#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
১৭.
সারারাত কান্না করার ফলে সকালে গভীর ঘুমে তালিয়ে আচ্ছন্ন হিমা। তার দিকে যে কেউ গভীর নয়নে তাকিয়ে আছে তার খবর নেই। কেউ একজন হিমার গালে হাত ছুঁয়ে দেয়। ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় হিমার ঘুম কিছুটা হালকা হয়ে যায়। ততক্ষণে গালের স্পর্শ আরো গাঢ় হয়ে যায়। হিমা পিটপিট করে তাকাতেই মীরের হাস্যজ্বল হাসি দেখতে পায়। সে তাড়াহুড়ায় উঠলে মীরের মাথায় সাথে আঘাত পায়। মীর আহ করে শব্দ করে উঠে এতে হিমা নিজের মাথার সাথে মীরের মাথাও চেপে ধরে বলে,“ জলদি আরেকটা লাগাও, মীর ভাই! নয়তো শিং গজাবে।”
মীর ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। সে ভেবেছিল হিমা তাকে দেখে আহ্লাদ হয়ে বলবে,“ ওগো! তুমি এসেছো? আমি যে কী খুশি হয়েছি!”
তা না বলে সিনেমার ফালতু ডায়ালগ ছাড়ছে। সে বিরক্ত হয়ে হিমার হাত ছাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। খুবই ভদ্রতার সাথে হিমার কপালে চুমু এঁকে বলে,“ নিরামিষ কোথাকার! এই কাজ তোর করার কথা ছিল কিন্তু আমাকে করতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে আমিষ এখানে সেখানে খুঁজতে হবে।”
মীর সত্যিই তার কাছে ভাবনায় আসতেই হিমা ছিটকে দূরে সরে আসে। বোকার মতো প্রশ্ন করে,“ তুমি এই সময়ে কীভাবে এলে? বাড়িওয়ালা কিছু বলেনি? নাকি একেবারের জন্য এসে পড়েছো?”
“ বাড়িওয়ালা কী আর এভাবে এভাবেই ছেড়ে দিয়েছে? তার মেয়ের সাথে বিয়েশাদির কথা ফিক্সড করার পর ছেড়েছে।”
একজনের সাথে এনগেজড হওয়ার পর কীভাবে মানুষ অন্য নারীর কথা মুখে আনে! হিমা রেগে মীরকে মারধর শুরু করে। বুকে কয়েকটা ঘা দিয়ে বলে,“ তো আমার কাছে এসেছো কেন? বাড়িওয়ালার মেয়ের কাছেই থেকে যেতে! তোমার সাথে কথা নেই, মীর ভাই।”
রেগে বোম হয়ে হিমা ঘর থেকে নের হয়ে যায়। মীর বুকে হাত রেখে হাসে। আকস্মিক হাসির বদলে মুখে চিন্তার ছাপ দেখা যায়। রাদিফ কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে কে জানে! সে মুঠোফোন বের করে কাউকে ফোন করে। ঐপারের মানুষটা রিসিভ করার পর বলতে শুরু করে,“ কোনো খবর পেয়েছো? ও একা ছিল নাকি বন্ধুদের সাথে?”
“ একাই ছিল। যেই বাস করে এসেছিল সেটারও সন্ধান পেয়েছি। ড্রাইভার হেলপার দুজনেই বলছে, তাকে সিলেট সদরে নামিয়ে দিয়েছে। আমরা আশেপাশের সিসিটিভি ফুটেজও দেখেছি। আশানুরূপ কিছুই পাইনি। খোঁজ চলছে।”
“ আমি বাড়ির সবাইকে সামলে রাতেই রওনা হবো। রাখছি।”
দুজনের কথোপকথন শেষ হতেই মীর নিচে চলে যায়। রাদিফের বাবাকেও সামলাতে হবে। এদিকে হিমাকেও বুঝাতে হবে যে, রাদিফের এই অবস্থার জন্য নিজেকে দোষারোপ না করতে!
অতিরিক্ত চিন্তার ফলে আফজাল হোসেনের প্রেশার বেড়ে গেছে। আশা তেঁতুলের টক এনে ভাইকে খাইয়ে দেয়। তিনি সোফায় মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। মীর সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে,“ তুমি চিন্তা করো না। রাদিফ ঠিকই আছে। আমি খোঁজ নিচ্ছি। আজ রাতের বাসে আমিও রওনা দিব।”
আফজাল হোসেন চোখ খুলে তাকায়। শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,“ এখন তুই-ই শেষ ভরসা। আমার ছেলেকে সহি সালামতে নিয়ে আসিস, মীর! ছেলেটা কোথায়, কী অবস্থায় আছে কে জানে!”
মীর আশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়। অত:পর আশাকে ইশারা করে যেন আফজাল হোসেনকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয়।
গেস্ট রুমে এসে মীর হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। রাদিফের জন্য তারও চিন্তা হচ্ছে। সে শেষবার রাদিফের সাথে দেখা হওয়ার কথা স্বরণ করে। এই কামরায়ই সে রাদিফের ফোন নিয়ে নিয়েছিল সেদিন রাদিফের চেহারা দেখার মতো ছিল। বন্ধু নয় ভাই ছিল তারা দুজন। মীর কখনো রাদিফের সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করেনি কিন্তু তবুও রাদিফ মীরকে মানতো সাথে কিছুটা ভয়ও পেতো। মীর হাজার কথা ভেবে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,“ তুই কী সত্যিই আমার আর হিমার জন্য চলে গিয়েছিস? আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না রাদিফ! চলে আয় ভাই, চলে আয়।”
___________________________________
শ্রীপুরের উপত্যকা মিলির কোণায় কোণায় পরিচিত। কোন পাহারেকয়টা গাছ আছে তাও তার গোনা আছে যেন। অসুস্থ মেহমানকে মিলির একদম পছন্দ হয়নি। তাই সকালের খাবার তার হাতে তুলে দিয়ে দা ও ঝুড়ি নিয়ে পাহাড়ে চলে আসে। পাহাড়ের কলা গাছ থেকে কাঁচা কলার ছড়ি কা’ট’তে কা’ট’তে একাই বকবক করতে থাকে সে, “ এ্যাহ আমাকে বাচাল বলছে, আমি কী বেশি কথা বলি নাকি? ঐ অচেনা মানুষকে দেখে নিজের পরিচয়ই তো দিচ্ছিলাম। প্রেমের আহ্বান তো আর দেইনি?”
প্রেমের কথা মুখে আসায় মিলি নিজের মাথায়ই আঘাত করে। কলার ছড়ি ঝুড়িতে রেখে পিঠে তুলে পাহাড়ের পথ ধরে চলতে থাকে।
রাদিফ বাড়ির পিছনটায় একাকী বসে আছে। সে ভাবছে, এভাবে আর বেশিদিন থাকা যাবে না। কয়েকঘন্টায় সে আশ্রয়দাতাদের অবস্থার সম্পর্কে অবগত হয়েছে। তারা মৃত্যুকেও গ্রহণ করতে প্রস্তুত কিন্তু অতিথিদের কষ্ট দিতে রাজি নয়। এসব ভাবতে ভাবতে রাদিফের চোখ যায় অদূরে পাহাড়ের রাস্তায়। রাদিফের চিনতে ভুল হয়নি আগন্তুক মেয়েটা কে! আঁকাবাঁকা রাস্তায় লাফাতে লাফাতে আসছে সে। বয়ঃসন্ধি কালের কথা যেন ভুলেই গিয়েছে সে। শরীরের অপ্রকাশিক অঙ্গের অঙ্গভঙ্গির ভাবগঠন সম্পর্কেও নয়। রাদিফ নজর সরিয়ে নেয়। এক দিনের অতিথি হয়ে এতো ভাবাও উচিত নয়। না চাইতেও রাদিফের নজর সেদিকটায় যায় হঠাৎ সে দেখতে পায় মিলি নামক চঞ্চল পাখি উড়ে আসতে আসতে ধপাস করে মাটিতে থুবড়ে পড়ে গিয়েছে। রাদিফ বিরক্ত হয়ে উঠে দাড়াঁয়। দ্রুত গতিতে হেঁটে মিলির কাছে চলে আসে, এমন সময় সে শুনতে পায় মিলি বলছে,“ ঐ মিচকে শ’য়’তা’ন’টার কথা ভেবে কোমড়টা ভেঙে গেলো রে! কে বলেছিল মিলি, তোকে একটা কথা নিয়েই পড়ে থাকতে!”
মিলির কথা শুনে রাদিফ ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। সে নিস্তব্ধে ঝুলিতে কলা তুলতে থাকে। আকস্মিক কারো ছায়া দেখতে পেয়ে মিলি ঘুরে তাকায়। রাদিফকে কাজ করতে দেখে বলতে শুরু করে,“ আরে কি করছেন? আপনি কাজ করছেন কেন? আমার মা বলতো, খবরদার মিলি! নিজে খেটে ম’রে যাবি, কিন্তু বুড়োদের কাজ করতে দিবি না! আমি মায়ের সব কথা মনে রেখেছি এবং মেনেও চলি। আপনি,,,,,,,!
বকবক করতে করতে মিলির চেখ রাদিফের দিকে যায়। যে এখন বিরক্তিকর দৃষ্টিতে মিলিকে দেখছে। ঝুড়িতে কলার ছড়ি উঠিয়ে বলে,“ কম কথা বলা যায় না! আপনার এক এক বক্যকে মিলিয়ে বিশাল বড়ো ইতিহাস লেখা যাবে। আর কোন দিক দিয়ে আমাকে বুড়ো মনে হচ্ছে?”
“ বুড়ো নয়! কি বলছেন? ঐ ঝরনার ধারে গিয়ে স্বচ্ছ পানিতে নিজের চেহারা দেখুন,বুড়োর নানা মনে হচ্ছে!”
রসিকতা রাদিফের একটুও পছন্দ নয়। মিলি কথা বলে চুপ করে থাকেনি। অঙ্গভঙ্গি হেলিয়া দুলিয়ে হাসছে। তা দেখে রদিফ ধমক দেয় মিলিকে,“ বড়ো হয়েছেন। এখানে কেউ আসে না জানি কিন্তু আমি আছি তো! অঙ্গভঙ্গি ঠিক রেখে কথা বলাও যায়। নিজের দিকে খেয়াল করুন।”
রাদিফ ঝুড়ি হাতে নিয়ে চলতে শুরু করে। পেছনে রেখে যায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মিলিকে। রাগে লজ্জায় যার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে রেগে ধপধপ পা ফেলে বলতে শুরু করে,“ ব’দ’মা’শ লোক! আমি তোর ঠিকই নাম দিয়েছি। তুই আস্তো একটা মিচকে শ’য়’তা’ন।”
দুপুরে খাবার খাওয়ার পর মিলি ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রহিম মিয়া ধান ক্ষেতে ঘাস তুলছে। পাশেই টমেটোর ক্ষেত। মিলি নিজেই চারা রোপণ করে যত্নাদি করে বড়ো করেছে। আমরা যারা কাজ করতে ভালোবাসি তারা এক মিনিটও বিশ্রাম নেই না। আমাদের বিশ্রামই যেন কাজের মধ্যেই। মিলিদের ক্ষেত্রেও তাই। বাবা মেয়ে মিলে সারাদিন কাজ করে। কাজ করতে আনন্দ পায় উভয়ে। টমেটোর ক্ষেতে মিলির আজ আসা হয়নি। দুইদিন আগে তুলে নেওয়া টমেটো দিয়েই সে রাদিফকে স্যুপ বানিয়ে দিয়েছে। আজ হাতের কাজ শেষ করে সময় নিয়েই এসেছে সে। টমেটো তুলবে সাথে অতিরিক্ত ঘাসও পরিষ্কার করে দিবে। লাল টসটসে রসালো টমেটো তুলতে তুলতে একটাতে কামড় বসিয়ে দেয় মিলি। ওড়নার আঁচলে টমেটো রাখতে গিয়ে অনুভব করে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি। সে ও তার বাবা ছাড়া তৃতীয় জন এখানে কে আছে তা মিলির জানা আছে। ততক্ষণাৎ মিলির সকালের কথা মনে পড়ে যায়। সে নিজের জামা কাপড় ঠিক করে পিছনে ফিরে তাকায়। রাদিফ মিলিকেই দেখছিল। মিলির বোকা হাসি দেখে রাদিফ ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। তা দেখে মিলি টমেটো সহ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,“ টমেটো খাবেন?”
রাদিফ এই মেয়ের বোকামি দেখে হেসে ফেলে। পরবর্তীতে বলে,“ তোমার এঁটো টমেটো মেহমানকে খাওয়াবে? তোমার মা এই সম্পর্কে কিছু বলে যান নি?”
—————————–
সন্ধ্যা লগনে আশা নাস্তা তৈরী করে সবাইকে পরিবেশন করে। আফজাল হোসেন এখন সুস্থ আছেন। তিনিও খাচ্ছেন। হিমার রাগ এখনো ভাঙেনি। মীরকে এবার সে এতো সহজে ক্ষমা করবে না। মীরের সামনাসামনি বসে সে খাচ্ছিল। মীরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঘুরে বসে। মীর তা দেখে অসহায় কণ্ঠে বলে,“ বিয়ের পর এই মেয়ের অভিমান ভাঙাতে মেতরের কাজ পর্যন্ত করতে হবে, মনে হচ্ছে।”
মীর কিছুক্ষণ পরই সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। তাই আপাতত মাথায় কোনো চিন্তা আনছে না। অবশ্য হিমার অভিমান ভাঙাতে হিমারই বুদ্ধি কাজে লাগিয়েছে সে। সেটা আপাতত নাই জানুক সবাই! মীরের ভাবনার মাঝেই তার মুঠোফোন বেজে উঠে।ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে শুনতে পায়,“ রাদিফের ব্যাগ, ঘরি, মোবাইল পাওয়া গেছে জৈন্তাপুর সদরের এক ডাস্টবিন থেকে। দুঃখের বিষয় হলো, প্রাতিটা জিনিসে র’ক্তের দাগ রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ডা’কা’তে’র পাল্লায় পড়ে হয়তো রাদিফ আহত বা নি’হ’ত,,,,,,!
মীর আর কিছু শুনতে চায় না। সে কিছুটা রাগান্বিত হয়ে উচ্চ আওয়াজে বলে,“ খবরদার! নি’হ’ত হয়েছে এই কথা একবারও মুখে উচ্চারণ করবে না। রাদিফের কিছু হয়নি। আর একবার যদি এসব শুনি তো তোকে মে’রে ফেলবো।”
মীরের কথা শুনে অপর পাশের লোকটা বলে উঠে,“ আমি জানি আপনার বর্তমান অবস্থা শোচনীয় নয়। আমি হোয়াটসঅ্যাপে ছবিগুলো পাঠাচ্ছি। আপনি নিজেই দেখে নিন।”
ফোন কাটার সাথে সাথে মীর হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করে। ছবি পাঠানো হয়েছে যেখানে স্পষ্টত রাদিফের ব্যাগ, ঘড়ি, মোবাইল দেখা যাচ্ছে। রাদিফ সোফায় ধপ করে বসে। হিমা অনবরত কান্না করছে। আফজাল হোসেন আবারো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আশা কাকে সামলাবেন বুঝতে পারছেন না। উনার মনের অবস্থাও খারাপ।হিমা এগিয়ে এসে ফোন হাতে নেয়। রাদিফের ফোন চিনতে একটুও ভুল করে না সে। এক সময় হিমা চিৎকার করে বলতে শুরু করে,“ আমার জন্যই রাদিফ ভাইয়ের এই অবস্থা হয়েছে।আজ যদি আমি বিয়েতে রাজি না হতাম তাহলে এত কিছু হতো না!”
মীর চিন্তার মাঝেও রেগে যায়। সে হিমাকে নিষেধ করেছিল এসব না ভাবতে। সে ধমক দেয় হিমাকে কিন্তু হিমা মানতে নারাজ। অবশেষে খুব কঠিন একটি কাজ করে বসে।হিমার পাগলামো বন্ধ করার জন্য হিমার গালে থা’প্প’ড় দিয়ে বসে। এতে হিমা অবাক হয়ে যায়! অবিশ্বাস্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,“ তুমি আমায় মা’র’লে, মীর ভাই?”
চলবে ইনশাআল্লাহ……….