#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১৪
শোভা জানতো আদৃতা পালাবে ঠিক সেদিনের মতো। ও একজন ঠগী, প্রতারক, মুখোশধারী। প্রয়োজনে নিজের রুপ দেখাবে। কিন্তু রিফাতের ঠিক হজম হলো না। এই আদৃতাকে ও চেনে না। অবশ্য আগে যে চিনতে এমন না। তাদের ছোট বেলার স্মৃতিতে দাদার বাড়ি নেই। বাবার সাথে তার বাড়ির কোন যোগাযোগ ছিলো না। কেন ছিলনা এই প্রশ্নের উত্তর বাবা দিয়েছিলেন একদিন। পড়ালেখা শেষ করে ব্যবসার জন্য দাদার কাছে টাকা চেয়েছিল বাবা। কিন্তু দাদা টাকা দেয়নি উল্টো বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে বলেছিল। বাবা তাই রেগে সেই যে বাড়ি ছেড়েছিল আর ফিরে যায়নি। অনেক কষ্ট করে এই ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তার বাবা গোলাম রসুল। বাবা বলে মায়ের কারনে তার এই অর্জন। মা সাহস দিয়েছে বাবার পাশে থেকেছে বলেই বাবা এতদূর আসতে পেরেছে।
দাদার মৃত্যুর খবর পেয়ে একবার দাদার বাড়ি গেছিল তার বাবা। রিফাত ইন্টারে পড়ে। তখন থেকে আবার যাওয়া আসা হচ্ছে। যাওয়া আসা বলতে বাবা মা বছরে একবার যায় দাদীকে দেখতে। ওখানে ছোট চাচা মানে আদৃতার বাবা আছে। আছে রিফাতের দুই ফুপু। রিফাতের মনে পড়লো বছর তিনেক আগে একদিন হঠাৎ করেই আদৃতা এলো। বাবার কাছে জানলো তাদের চাচাতো বোন হয় আদৃতা। ও ভালো ছাত্রী তাই এখন থেকে এখানেই থাকবে, পড়ালেখা করবে। আদৃতা খুব দ্রুত নিজেকে ঢাকার রঙে রাঙিয়ে নিলো। নিজের আচরণ পোশাক সবকিছুতে দ্রুত পরিবর্তন হলো ওর। কিন্তু গ্রাম্য মেয়েটাকে শুরু থেকেই কেন যেন পছন্দ হলো না রিফাতের। মনেহতো ও যা না তা হওয়ার চেষ্টা করছে। তাই সর্বদা এড়িয়ে চলতো। আজ যেন শোভা তার হৃদয়ের গহীনের সেই ভালো না লাগার কারণ প্রকাশ করে দিলো।
“আদৃতা পালিয়ে গিয়ে কাজটা ভালো করলো না।”
রিফাতের কথা শোভার মুখে বাঁকা হাসি-“আমি জানতাম ও পালাবে। এটাই ওর স্বভাব। জানেন, গত তিনটে বছর মনে মনে কত খুঁজেছি ওকে? আমাকে নরক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়ে ও কি করে চলে এলো এই প্রশ্নের জবাব চাইতে ওকে খুঁজেছি প্রতিনিয়ত। আজ এতো অদ্ভুত ভাবে ওর দেখা পাব ভাবিনি।”
“তারপর কি হলো বলোতো? ওই ঘটনার পর তুমি আদৃতাকে ধরনি? চাচা চাচীকে বলনি কিছু? তোমার বাবা মা বিশ্বাস করলো?”
শোভা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“বিশ্বাস শব্দটা খুব ভঙ্গুর, এটা জানেন? সামান্য আঁচড়ে বিশ্বাসের দেয়ালে ফাটল ধরে। এমন রসালো ঘটনা খুব দ্রুত ছড়ায়। আমাকে নিয়ে করা ভিডিওটাও ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। দু’দিনের মধ্যে সবাই জেনে গেলো আমি প্রেমবাজ মেয়ে। ছেলেদের সাথে প্রেম করে গিফট নেই টাকা নেই। মফস্বলে এসব ঘটনা কি ধরনের প্রভাব ফেলে সেটা আপনি না দেখলে কখনোই বুঝবেন না। লোকজন আমাদের বাড়িতে ভীর করতে লাগলো। আমার মা বাবাকে কথা শুনাতে লাগলো। অথচ এলাকায় সবাই আমাকে চেনে, আমি কেমন মেয়ে জানে। স্কুল আর প্রাইভেটের বাইরে কখনো বাসায় বাইরে না যাওয়া আমি হয়েগেলাম খারাপ মেয়ে। একটা ভিডিও এই এতো বছরের চেনাজানাকে মিথ্যে প্রমান করে দিলো।
সব শুনে আমার বাবা অসুস্থ হয়ে গেলেন। আমি যতই পুরো ঘটনা বলি না কেন তারা বিশ্বাস করার আগেই লোকে এতো কথা বলতে লাগলো যে মিথ্যেটাই সত্যি মনে হতে লাগলো। আমি মোবাইল ব্যবহার করি না, বাবা কখনো কিনে দেয়নি। মোবাইলটা যে আমার না সেটাও সবার কাছে অবিশ্বাস্য লাগতে লাগলো। আম বাবার হাতে পায়ে ধরি। পুরো ঘটনা খুলে বলি। ঘটনা শুনে বাবা একটু নরম হলেন। বললেন আদৃতার সাথে কথা বলতে। আমাকে সুযোগ দিলেন নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার।
বাবা আমাকে নিয়ে আদৃতাদের বাসায় গেলেন। প্রমানস্বরুপ আদৃতার ফোন আমার কাছে ছিল ওটা নিয়ে নিলাম। কিন্তু ওখানে যেয়ে শুনলাম আদৃতা নেই। ও নাকি ওর চাচার বাসায় গেছে। আদৃতার মা সব কিছু শুনে দেখে বেমালুম অস্বীকার করলেন সব। ফোনটাও নাকি আদৃতার না। আমি নিজের বদনাম ঢাকার জন্য আদৃতার কাঁধে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছি। তার মেয়ে এমন কিছু করতেই পারে না। বাবাকে যা নয় তা বললেন। নিজের মেয়েকে সামলে রাখতে পারেন না এখন অন্যের মেয়ের গায়ে কালিমা লোপন করতে এসেছেন এমন কথাও বললেন। অথচ আমার বাবা কেমন মানুষ তা আপনার চাচী খুব ভালো মতো জানতেন। চাচীর কথায় বাবার মাথা হেট হয়। অপমানিত বাবা সেদিন মাথা নিচু করে আদৃতাদের বাড়ি থেকে ফিরে আসেন।
বাসায় এসে বাবা জীবনে প্রথমবারের মতো আমার গায়ে হাত তুলেছিলেন। অনেক অনেক মেরেছিলেন আমাকে এবং সেইদিনের পর থেকে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। আমাদের হাসিখুশি পরিবার থেকে হাসি গায়েব হয়ে গেলো। ওখানে থাকা আমাদের জন্য ভীষণ অপমানজনক হয়ে যাচ্ছিল। চারপাশের মানুষের কথাবার্তা থেকে মুক্তির জন্য আমরা আমাদের ভিটেমাটি ছেড়ে এই ঢাকা শহরে চলে এলাম। বাবার আড়তদারি ব্যবসা অন্যের হাতে দিয়ে ঢাকায় এসে কোনরকমে একটা চাকরি নিলেন। চালের ব্যবসার থেকে যা পায় তা আর চাকরির টাকা দিয়ে আমাদের চলা কষ্টকর হলেও বাধ্য হয়ে আমাদের মেনে নিতে হয়। কিছু করার নেই। এরমধ্যেই আমরা নিজেদের জীবন স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি।
ঢাকাতেও শুরুতে অনেকে চিনে ফেলতো। তাই নিজেকে যথাসম্ভব ঢেকে রেখে বাইরে বের হতাম যাতে কেউ চিনে না নেয়। একবছর গ্যাপ দিয়ে ইন্টারে ভর্তি হলাম। আবার পড়ালেখা শুরু করলাম। বাইরে বের হতাম না একদমই। কারো সাথে কথা নেই, বন্ধু নেই। একদম একা জীবনে পড়ালেখার বাইরে আর কিছু করি না। সেটার ফল পেলার এইচএসসিতে আর ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টে। বাবার জন্য কষ্ট হয়। আমার কারনে বাবা নিজের ঠিকানা ফেলে এই অচেনা শহরে পড়ে আছে। আর এই সবকিছুর জন্য দায়ী আদৃতা। ওর কারনে আমাদের পুরো পরিবার অমানুষিক কায়ক্লেশের জীবন যাপন করছে।”
“তুমি ভেব না মেঘা। আদৃতা তার কর্মের সাজা অবশ্যই পাবে। ওর অপরাধের ফল অবশ্যই ভোগ করতে হবে ওকে।”
রিফাত শোভাকে স্বান্তনা দেয়।
“কিভাবে পাবে? আর কি সাজা দেবেন ওকে? আমার আর আমার পরিবারের পুরনো সন্মান ফেরত আসবে? সেই হারানো দিন কি ফিরে আসবে? আমার মানসিক যাতনা কি মুছে যাবে। একটা বছর নষ্ট হয়েছে জীবনের সেই সময় কি ফেরত দিতে পারবেন?”
“সেসব কিছুই হয়তো করতে পারবো না। এমনকি কি সাজা দেব তাও জানিনা। কিন্তু ও তোমাকে কষ্টে ফেলে নিজে আরাম করেছে সেটাও আর হতে দেব না।”
শোভা কিছু বললো না। ও জানে আদৃতাকে কাবু করা অতোটা সহজ নয়। ও এরমধ্যে নিশ্চয়ই অন্য কোন ফন্দি এটে ফেলবে। এতদিনে আদৃতাকে এইটুকু বুঝে ফেলেছে শোভা।
★★★
“কি করে রুখবে শোভাকে?”
বাসে আসতে আসতে সারাপথ এটাই ভেবেছে আদৃতা। ঘুনাক্ষরেও যদি টের পেত রিফাতের বিয়েটা শোভার সাথে ঠিক হয়েছে। কেন যে বাড়ীতে গেল এবার? বাড়িতে না গেলে আগেই জানা যেত রিফাতের বউ কে। উফফ, এতো বিচ্ছিরি কপাল কেন তার? ওই শোভাটাকে কেন রিফাতের বউ হতে হবে? আর কি মেয়ে ছিলনা পৃথিবীতে? নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিড়তে মন চাইছে আদৃতার।
গত তিনটে বছর ধরে চাচার বাড়িতে যে আরাম আয়েশ, আদর আহলাদ জুটেছে সেসব কি নিমিষে হাতছাড়া হয়ে যাবে ওই শোভার কারনে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই মাথা গরম হয়ে গেলো আদৃতার।
সেবার শোভাকে ফাঁসিয়ে দিয়েই পালিয়ে চলে এসেছিল চাচার বাসায়। চাচার বাড়ির শানশৌকত দেখে মনে মনে স্থির করেছিল এখানেই থেকে যাবে বাকি জীবন। তার জন্য অল্পদিনেই নিজের বেশভুষা আচরণ চাচাত ভাইবোনদের মতো করে ফেললো। চাচীকে পটিয়ে নিজের জন্য দামী পোশাক কিনে নিলো কয়েকটা। তারপর এসএসসির রেজাল্ট ভালো হলো এই সুযোগে ঢাকায় ভর্তি হয়ে গেলো। চাচা চাচীও কিছু বলতে পারেনি। সেই থেকে বেশ আরামেই চলছে তার জীবন।
এখন শোভা যদি তার সত্যিটা সবাইকে বলে দেয়? বলেছেই তো। রিফাতকে তো বলে দিয়েছে অলরেডি। ও নিশ্চয়ই বাকী সবাইকে জানাবে। তাহলে কি এই আরামের জীবনের ইতি ঘটতে চলেছে? বারবার মাথা নেড়ে বিরবির করে আদৃতা-“কখনোই না। এমন কিছু কখনোই হতে দেবে না সে। শোভা গাধী, তুই গতবার আমাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল। এবার বিপদে ফেলবি তা কি করে হয়? কাটা দিয়ে কাটা তুলবো আমি। এবারও তোর কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালাবো। এক ঢিলে ক’টা পাখি মারা যায় দেখি। রাজ্য আর রাজপাট সব যদি হাতে চলে তাহলে এর চাইতে ভালো আর কি হবে? গতবারের মতো এবারেও তুই হয়ে যাবি দোষী। এবার তুই পুরো দেশের মধ্যে ভাইরাল হবি। কোথাও লুকনোর জায়গা পাবি না, কোথাও না। আদৃতা ভয়ানক হাসি দিলো। মনে মনে সে এখন দানবীয় পরিকল্পনা রচনা করে চলেছে।
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১৫
রোকেয়া বসে বসে বিয়ের কার্ড বাছাই করছে। রিফাতের বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসছে। কাজগুলো গুছিয়ে নিতে চাইছেন তাড়াতাড়ি। এখনো বলতে গেলে কিছুই হয়নি। পুরো কেনাকাটা বাকী। তোড়াকে সাথে নিয়ে টুকটুক করে সেরে ফেলবেন। অনেক দেখে টেখে কয়েকটা কার্ড আলাদা করে রাখলেন। রিফাত আর গোলাম রসুল সাহেবের মত নিয়ে এখান থেকে একটা ফাইনাল করবেন।
আদৃতা দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে চাচীর মেজাজ বোঝার চেষ্টা করলো। সকালের এই সময়টা চাচী ফ্রি থাকে। মন মোটামুটি ভালো থাকে। কাল রিফাতের ফিরতে অনেক রাত হয়েছে। রিফাত এখন ঘুমে। অতএব এটাই চাচীর সাথে কথা বলার উপযুক্ত সময়। এই কারনে আজ ক্লাস বাদ দিয়েছে সে। আদৃতা দরজায় টোকা দিল-“চাচী, আসবো?”
“আদৃতা? ক্লাসে যাসনি আজ?”
“নাহ চাচী। আজ শরীর খারাপ লাগছে।”
“আয় ভেতরে আয়।”
আদৃতা এসে রোকেয়ার কাছে বসলো-“কি করছো?”
“কার্ড দেখছিলাম। বিয়ের প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করতে হবে। ভাবলাম কার্ড পছন্দ করা দিয়েই শুরু করি। দেখতো কোনটা পছন্দ হয়?”
আদৃতা মন দিয়ে কার্ড দেখতে লাগলো। রোকেয়ার পছন্দের কয়েকটা কার্ড দেখালো-“এই কয়েকটা ভালো লেগেছে। বাকী সবাই কি বলে দেখো।”
রোকেয়া খুশি হয়ে গেলেন-“আরে এই কয়েকটা আমারও ভালো লেগেছে। দেখি ওদের দেখাই। কি বলে ওরা। শাড়ী টাড়ি কোথায় দেখা যায় বলতো?”
“অনেক জায়গা আছে। মিরপুর বেনারসি পল্লী, বেইলি রোড আছে। আচ্ছা চাচী, ভাইয়ার ভাবি বউ কি আমাদের ইউনিতে পড়ে?”
“তোরটাতে… আরে হ্যা, তোরটাতেই তো পড়ে। দেখ কান্ড, আমার তো মাথাতেই নাই এসব। তুই তো ওকে দেখিসনি তাই না?”
“দেখিনি বলেই জানতে চাইছি। সেদিন রিফাত ভাইকে দেখলাম ভার্সিটিতে।”
“ওর হয়তো কোন প্রোগ্রাম ছিল।”
“আরে না চাচী। ওনাকে একটা মেয়ের সাথে গল্প করতে দেখেছি।”
রোকেয়ার হাসিমুখ কিছুটা গম্ভীর হলো-“মেয়েটা দেখতে কেমন বলতো?”
“শ্যামা চেহারায় মায়া আছে আর চুলগুলো বেশ লম্বা। ভাইয়ার মতোই লম্বা হবে।”
“ওর নাম শোভা।”
মিটিমিটি হাসি দেখা গেল রোকেয়ার মুখে। ছেলে বিয়ে করতে চায় না অথচ হবু বউয়ের সাথে লুকিয়ে দেখা করতে যায় ভেবে হাসি হাসলো মনে মনে।
“শোভা! নামটা চেনা চেনা লাগছে। ওরা কি আমাদের দেশের মানে দিনাজপুরের?”
“হ্যা। কেন বলতো?” রোকেয়া উদ্বিগ্ন হলো।
“ইয়ে মানে চাচী না থাক কিছু না।”
আদৃতা দাঁড়িয়ে যায়। রোকেয়া ধমকে উঠলো-“আরে কি হলো? কথা শেষ না করে কোথায় যাচ্ছিস? কি বলতে চাইলি বল।”
“থাক চাচী। ওসব শুনলে আবার ঝামেলা হতে পারে। পরে চাচা আমাকে বকবে।”
“আজব, বকবে কেন? আচ্ছা আমাকে বল তোর চাচা কিছু জানবে না।”
আদৃতা আবার বসলো-“মেয়েটাকে দেখে খুব চেনা মনেহচ্ছিল। কোথায় যেন দেখেছি। পরে মনে পড়লো অনেক আগে ওর একটা ভিডিও দেখেছিলাম। একসাথে পাঁচটা ছেলের সাথে প্রেম করে, তাদের থেকে গিফট নেয় টাকা নেয়। পরে ছেলেগুলো প্ল্যান করে ওর ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। ও তো একজন ভাইরাল গার্ল। কিন্তু এসব নিশ্চয়ই তোমরা জানো। না জানিয়ে কি আর বিয়ে দেবে? শুনলাম যে ওর বাবা চাচ্চুর বন্ধু? চাচ্চু নিশ্চয়ই সবকিছু জানে।”
খানিকক্ষণ চুপ থেকে চাচীর মেজার বুঝে বাঁকা হাসলো আদৃতা। চাচীকে ফোঁড়ন কাটলো-“অবশ্য এখন এসব বলেই বা লাভ কি? রিফাত ভাই তো মনেহয় অলরেডি ওই মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছে। ভাইয়াকে কয়েকদিন দেখেছি ইউনিতে। আমি ভেবেছিলাম কাজে যায়৷ এখন বুঝলাম অন্য কারন।”
রোকেয়ার চেহারা মেঘে ঢাকা আকাশ যেন। মেজাজের পারদ উপরের দিকে উঠছে। এতো বড় কথা তার থেকে লুকানো হলো? তার এত গুনি ছেলের জন্য এই মেয়ে? কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তবে আদৃতাকে কিছু বুঝতে দিতে চাইলেন না-“তুই যেয়ে দেখতো বুয়া কি করছে? আমাকে এককাপ চা বানিয়ে দিতে বল। হঠাৎ মাথাটা ধরে গেল। একটু চা খেয়ে দেখি কমে কিনা।”
“আচ্ছা। চাচী, আরেকটা কথা। আমি যে এসব বলেছি তা যেন কাউকে বলো না। নয়তো ভাইয়া আমাকে ভুল বুঝতে পারে। ভাববে আমি তার বিয়ে ভাঙতে অ।”
“বলবো না। তুই যা।”
রোকেয়ার মেজাজ চুড়ান্ত খারাপ হলো।
আদৃতা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বেড়িয়ে এলো। যে ঢিল ছুড়েছিল তা একদম জায়গা মতো যেয়ে লেগেছে। বাইড়ে এসে তৃপ্তির হাসি হাসলো আদৃতা। শোভা ডার্লিং, এবার কি হবে তোমার?
★★★
সকালে বেশ বেলা করে ঘুম ভাংলো রিফাতের। শোভাকে স্বান্তনা দিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত বারোটার বেশি বেজে গেছিল। তারপর মিনহাজের কল এলো। বন্ধুরা সবাই কনফারেন্স কলে আড্ডা দিয়ে শেষ হতে হতে রাত দু’টো। সকালে উঠতে চাইলেও সম্ভব হল না। ঘুম ভেঙে ফ্রেশ হয়ে বাবার খোঁজে এলো। আজ শনিবার বাবার বাসায় থাকার কথা।
“মা, বাবা কোথায়? দেখছি না যে?”
রোকেয়া দুপুরের রান্নার আয়োজন করছিল। রিফাতকে দেখে থামলেন-“তোর বাবার জরুরি মিটিং আছে অফিসে। দুপুরে চলে আসবে বলেছে।”
“ওহহ।”
ছেলের মন খারাপ টের পেলো রোকেয়া।
“কি হয়েছে? বাবাকে কি দরকার?”
“দরকার আছে মা। বাবা আসুক রাতে কথা বলবো। আদৃতা ভার্সিটিতে গেছে?”
“না বাসায়ই আছে। কেন বলতো?”
আদৃতা বাসায় শুনে অবাক হলো রিফাত। এই মেয়ের সাহস দেখে অবাক হচ্ছে সে। কালকো পালিয়ে এসে আজ বাসায়ই বসে আছে?
“এমনিতেই। ওকে একটু নজরে রেখ মদ। কোথায় কখন কি করছে খেয়াল রেখ।”
“কেন? ও কি করেছে?”
“করেছে তো অনেক কিছু।”
ছেলের আচরনে রোকেয়া বিরক্ত হলো। রিফাত শুরু থেকেই আদৃতাকে পছন্দ করে জানেন। তবে কখনো মুখে কিছু বলেনি। এখন আবার কি হলো? আদৃতা শোভাকে চিনে ফেলেছে সেটাই কি কারন?
“তুমি নাকি আদৃতার ইউনিতে যাচ্ছ ঘনঘন? বিয়ের আগে এত মেলামেশা কি ভালো?”
রিফাত বিব্রত হল। মা কখনো সরাসরি কোন কথা বলে না। আজ হঠাৎ এমন বলার কোন কারণ খুঁজে পেলো না। আদৃতা কি কিছু বলেছে? এত সাহস কি করবে ও?
“হঠাৎ এসব বলছো কেন মা?”
“এমনিও বলছি। তোর বাবা হঠাৎ করে এই মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইলো। মেয়ের বৃত্তান্ত কিছু জানি না। শেষ পর্যন্ত যদি বিয়েটা না হয়? তাই বলছি এত মেলামেশার দরকার কি?”
রিফাত হতবাক হয়ে মাকে দেখলো। বিয়ে হবে না? কেন? এরকম ভাবনা তার মা ভাবছে কি করে?
“মা, কি বলছো এসব? ঠিক হওয়া বিয়ে ভাঙবে কেন?”
“ভাঙতে পারে না? আমি ঠিক করেছি মেয়ের সম্পর্কে গ্রামের বাড়িতে খোঁজ খবর নেব।”
রিফাত কি জবাব দেবে বুঝে পেল না। হঠাৎ মায়ের মাথায় এমন পাগলামি চাপার মানে খুঁজে পেলো না সে। হতভম্ব হয়ে বললো-“বাবাকে বলেছ এসব? বাবার বন্ধু যেহেতু তার সাথে কথা বলো।”
“বলবো। আজ বাসায় আসুক তোর বাবার সাথে কথা বলবো। আমার বড় ছেলের বিয়ে দেব যেনতেন কারো সাথে তা কি হয়?”
“কি আজব মা! শোভা যেনতেন কেউ কেন হবে? তোমরা ওর পরিবারকে ভালোমতো চেন, তাই না? তবুও এসব বলছো কি করে?”
রোকেয়া সরু চোখে ছেলেকে দেখলো-“তোরই বা হঠাৎ শোভার প্রতি দরদ উথলে উঠেছে কেন? বিয়েই তো করতে চাইছিলি না। ওই মেয়ের সাথে ক’দিন দেখা করেই পাল্টে গেলি? আদৃতা তো ঠিকই বলেছে দেখছি?”
“আদৃতা তোমাকে এসব বলেছে? আর কি বলেছে ও?”
রিফাতের প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলেও মায়ের সাথে রাগ দেখালো না। ও বুঝে গেছে নিজেকে বাঁচাতে আদৃতা এরইমধ্যে পর মাকে নিজের দলে টানার জন্য শোভাকে নিয়ে মায়ের কানভারী করেছে।
“যাই বলুক সেসব শুনে তোর কাজ নেই। শোন, তুই আর শোভার সাথে দেখা করতে যাস না। ওর সাথে বিয়ের ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের।”
রিফাত চেচিয়ে উঠলো-“পাগল হয়ে গেছ মা? ওই আদৃতার কথা বিশ্বাস করে কিসব বলছো? তুমি জানো আদৃতা কি কান্ড করেছে? জানলে ওকে এ বাড়িতে রাখতে না।”
রোকেয়া রেগে গেল-“আদৃতাকে নিয়ে কোন কথা শুনতে চাই না আমি। ও তোমার বোন হয়। একটা অচেনা মেয়ের জন্য ওকে দোষারোপ করতে বিবেকে বাঁধছে না তোমার?”
রিফাত অবাক নয়নে মাকে দেখলো। বুঝলো আদৃতা মাকে পুরোপুরি নিজের জালে বশ ঠিক যেমন ভাবে শোভাকে ফাঁসিয়েছে। রিফাত হতাশ হয়ে বললো-“তুমি ভুল করছো মা। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছ। তোমাকে আর কিছুই বলবো না। বাবা আসুক বাবার সাথে কথা বলবো।”
রোকেয়া রেগে গেলো-“আমিও তোমার বাবার সাথে কথা বলবো। যে মেয়ে বাড়িতে আসার আগেই এত ঝামেলা হচ্ছে সেই মেয়ে এ বাড়িতে বউ হয়ে আসবেনা কিছুতেই।”
রিফাত ফিরে যেতে গিয়ে থমকে গেলো, ওর মুখ থেকে ভাষা হারিয়ে গেল। মা এরকম কথা বলে কি করে? শোভাকে ছাড়া জীবন! ভাবতেও পারে না।
চলবে—
©Farhana_Yesmin