#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১৬
গোলাম রসুল বাসায় আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলেন কিছু একটা হয়েছে বাসায়। সে খেতে বসেছে শোনার পরও রোকেয়ার দেখা পাওয়া যায়নি। এরকম ঘটনা সচরাচর হয় না। একমাত্র তীব্র অসুস্থতা ছাড়া রোকেয়া এমন করেনা কখনো। তিনি কাজের মেয়েকে পাঠালেন রোকেয়াকে ডেকে আনতে। রোকেয়া গোমড়া মুখ করে এসে দাঁড়ালেন-“ডেকেছ আমাকে?”
“হ্যা। খেতে বসেছি অথচ তুমি নেই। রুমেও পেলাম না তোমাকে। কি হয়েছে?”
“হয়েছে তো অনেক কিছু। তুমি খেয়ে নাও তারপরে বলছি।”
গোলাম রসুল অবাক হলেও স্ত্রীর কথা মেনে নিয়ে খেতে শুরু করলেন। খেতে খেতে জানতে চাইলেন-“রিফাতের বিয়ে কেনাকাটা কিছু শুরু করেছ? সময় তো এগিয়ে আসছে। আজমল ফোন করেছিল। জানতে চাইলো রিফাতের জন্য ওরা কিনবে নাকি টাকা দিয়ে দেবে। আমি বলেছি তোমার সাথে কথা বলে জানাব।”
রোকেয়া জবাব দিলো না। গম্ভীর হয়ে গেলেন গোলাম রসুল। বুঝলেন সমস্যাটা ছেলের বিয়ে নিয়েই। রোকেয়া কি তাহলে বিয়েতে রাজী না? কিন্তু শোভাকে তো ওর ভালো লেগেছিল? ভাবতে ভাবতে খাবার শেষ করে গোলাম রসুল। ঠিক সেই সময় রিফাত ঢুকলো-“বাবা, জরুরি কথা আছে তোমার সাথে। কিন্তু তুমি তো খাচ্ছ। আচ্ছা পরে আসছি তাহলে।”
“আমার খাওয়া শেষ। তুমি রুমে যাও আমি আর তোমার মা আসছি।”
রিফাত ঝট করে মাকে দেখলো। বুঝতে চাইলো মা এরইমধ্যে বাবাকে সব বলে দিয়েছে কিনা। রোকেয়া ছেলের দিকে তাকালো না। গোলাম রসুল মা ছেলের পুরো বিষয়টা অবাক হয়ে অবলোকন করলেন।
“কি বলতে চাইছিলে যেন?” গোলাম রসুল রিফাতের কাছে জানতে চাইলেন।
“তুমি আগে আমার কথা শোন। রিফাতের হবু বউ নিয়ে আমার একটা কথা আছে।”
মায়ের কথা শুনে রিফাতের মুখ শুকিয়ে গেল। গোলাম রসুল রোকেয়াকে থামালেন-“তোমার কথা শুনবো তার আগে রিফাত কি বলে শুনি। বল কি বলবি।’
“আদৃতাকে নিয়ে বলবো বাবা। ওর সাথে শোভার কথাও আসবে। দয়া করে মন দিয়ে শুনবে। তার আগে বলো তো, শোভার বাবা কি তোমাকে কিছু বলেছে?”
“কোন বিষয়ে?” গোলাম রসুল সতর্ক হলেন।
“এসএসসির পর শোভার একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল সেই বিষয়ে।”
গোলাম রসুল চুপ করে রইলেন। রোকেয়া বিস্মিত হয়ে স্বামীকে দেখলেন-“তুমি জানতে? তাহলে আমাকে বলোনি কেন?”
“প্রয়োজন মনে করিনি। বলার হলে নিশ্চয়ই বলতাম।”
রোকেয়া মেজাজ খারাপ করে বসে রইলো। রিফাত বললো-“তোমার মনে আছে বাবা আদৃতা আমাদের বাসায় এসেছিল কবে? এসএসসি এক্সামের পরে। আমরা ভেবেছিলাম ও মনেহয় কিছু দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন ও থেলে গেলো আমাদের এখানে। তুমি কি জানো শোভা আর আদৃতা ব্যাচমেট ইনফ্যাক্ট ওরা দু’জন বন্ধু।”
“কি বলছো এসব? আদৃতা এখন সেকেন্ড ইয়ার আর শোভা কেবল ভর্তি হলো।”
গোলাম রসুল উত্তেজিত হয়ে গেলেন।
“কারনটা আদৃতা বাবা। ওর কারনে শোভার একটা বছর নষ্ট হয়েছে। শুধু তাই না ওর কারণে শোভার জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেছিল। ফেসবুকে শোভার যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সেখানে শোভার জায়গায় আসলে আদৃতার থাকার কথা। ও মিথ্যে কথা বলে শোভাকে ওখানে পাঠায় তারপর ছেলেগুলো ওকে আদৃতা ভেবে ওই ভিডিওটা করে। আসলে আদৃতা ছেলেদের সাথে ওমন করতো। ও নিজেকে বাঁচাতে শোভাকে ফাঁসিয়েছে। ওই ভিডিওর ফলাফল কি তাতো দেখতেই পাচ্ছ। শোভারা যে ঢাকায় এসে এভাবে আছে এটার জন্য আদৃতা দায়ী।”
“এসব কি বলছিস রিফাত? আদৃতা কেন দায়ী হবে? ও আমাদের এখানে তিনবছর হলো আছে খারাপ কিছু তো নজরে আসেনি। তাহলে এমন অভিযোগ দেওয়ার মানে কি?হ্যা এটা ঠিক আজমল আমাকে বলেছে ওর মেয়েটা ভালো। কেউ ওকে ফাঁসিয়েছে। কিন্তু সেই মানুষটা আদৃতা হয় কি করে? তোর কোথাও ভুল হচ্ছে।”
“আমিও তাই বলছি। আর এসব কথা কে বলেছে ওকে জানতে চাও। নিশ্চয়ই শোভা বলেছে। ওই মেয়ে এখন নিজের দোষ ঢাকতে আমাদের আদৃতাকে খারাপ বানাচ্ছে।”
গোলাম রসুলের সাথে রোকেয়া সুর মেলালেন। রিফাত মরিয়া হয়ে গেলো-
“বাবা প্লিজ বিলিভ মি। আমি মিথ্যে বলছি না। কাল শোভাকে দেখে আদৃতা চিনতে পেরেছে। চিনতে পেরেছে শোভাও। কিভাবে শোভাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে পালিয়ে ঢাকায় চলে এসেছে সেসব ঘটনা
শোভা ওর সামনে বলেছে আমাকে। আর ও সেখান থেকে পালিয়ে চলে এসেছে। তুমি চাচার কাছে ফোন দিয়ে শোন। অবশ্য মেয়েকে বাঁচাতে চাচা মিথ্যে বলতেও পারে।”
গোলাম রসুল খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন-“আমি মিজানের সাথে কথা বলে দেখবো। দেখি ও কি বলে। তবে আদৃতা এত খারাপ কাজ করবে এটা আমার বিশ্বাস হয় না।”
“ঘটনা এমনভাবে ঘটিয়েছে কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে বাবা, আদৃতাকে আমরা যেমন দেখি ও তেমন নয়। কেন যেন ওকে আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না। ও নিজের স্বার্থে অনেক কিছু করতে পারে।”
“তুই কিভাবে জানলি? দুই দিন কথা বলেই শোভাকে চিনে ফেললি? শোন, তুমি যত যাই বলো শোভাকে বউ করতে আমি আর আগ্রহ পাচ্ছি না। একেতো ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া মেয়ে তার উপর এ বাড়িতে আসার আগেই নিজেদের মধ্যে সমস্যা তৈরি করছে। এমন মেয়ে বাসায় আনলে বিপদ।”
“আহ, বাজে কথা বলো নাতো। এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে এখন এসব বলো না। আজমলের এমন ক্ষতি করার কথা স্বপ্নেও ভাববে না। ও অনেক ভালো একটা মানুষ।”
“ভালো মন্দ বুঝি না। শোভা আর এ বাড়িতে আসবে এটাই শেষ কথা। বাকী তোমরা বাপ ছেলে জানো কি করবে। এতো কাহিনি করা মেয়ে আমি চাই না।”
রোকেয়া নিজের কথায় অনড় রইলো। রিফাত নরম হলো-“মা, তুমি কিন্তু মিথ্যে কথায় বিশ্বাস করে শোভার সাথে অন্যায় করার কথা ভাবছো। তোমারও একটা মেয়ে আছে। ওর সাথে কেউ এমন করলে কি তোমার ভালো লাগতো? এতো নিস্ঠুর কথা বলো না মা।”
“বাস রিফাত, আর একটা কথাও না। শোভার জন্য নিজের বোনটাকেও ছাড়লি না? এরপরে তো দেখছি আমাদের ও ছাড়বি না। একটা দু’দিনের মেয়ের জন্য আমাদের পর করে দিচ্ছিস? ওই মেয়েকে কখনো মেনে নেব না। তোর যদি মন চায় একা বিয়ে কর। আমি আর তোর বিয়েতে নেই।”
“মদ প্লিজ এমন বলো না।”
রিফাত অনুনয় করে। রোকেয়া কানে তুললো না কথা। উঠে চলে গেল। রিফাত বাবার দিকে তাকালো। গোলাম রসুল ওকে আস্বস্ত করলো-“ভেব না আমি দেখছি কি করা যায়। আপাতত শোভার কথা বেশি বলো না। তোমার মাকে ঠান্ডা হতে দাও।”
রিফাত নিজের রুমে ফিরে এলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো তাই ভাবছে। আদৃতা আবারও সফল হয়ে গেলো। মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হলো। টেবিলে থাকা কাঁচের গ্লাসটা ভেঙে ফেললো আছার দিয়ে। রিফাত চায় না শোভা হেরে যাক বারবার। বারবার দোষ না করেও দোষী হয়ে যাক। এরকম কিছু হলে এবার হয়তো সহ্য করতে পারবে না শোভা। মাথা নাড়ে রিফাত, এরকম কিছু হতে দেওয়া যাবে না এবার। কিন্তু কিভাবে প্রমান করবে আদৃতার দোষ? আদৃতা নিজ মুখে যদি সব কথা বলতো তাহলে না হয় হতো। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব হবে?
অনেক ভেবেও কোন সুরাহা করতে পারে না রিফাত। আদৃতার মতো চতুর কাউকে কি করে কোনঠাসা করবে? ওর এমন কোন দূর্বলতা আছে কি যেটা ওর বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে?
“আরে ভাইয়া, কি ভাবছো এতো? শোভাকে কি করে বউ বানাবে সেটাই ভাবছো?”
রিফাত দেখলো দরজায় আদৃতা দাঁড়িয়ে আছে, মুখে ক্রুর হাসি নিয়ে। ক্রোধে পাগল হয়ে গেলো রিফাত-“তোর সাহস দেখে পাগল হচ্ছি আদৃতা। অন্যায় করে আবার আমাকে টোন কাটতে এসেছিস? তোর কি ধারণা, আমার আর শোভার বিয়ে ভেঙে দিবি? এতো সহজে?”
আদৃতা গাল ভরা হাসি দিলো-“খুব সহজে। বিশ্বাস না হলে দু’দিন অপেক্ষা করো। হবু বউয়ের সাথে তোমার প্রেমও ছুটে যাবে।”
রিফাত হাসলো-“এতো আত্মবিশ্বাস ভালো না আদৃতা। একবার অন্যায় করে পালিয়ে যেতে পেরেছিস বারবার তুই সফল হবি এমনটা ভাবিস না। মাকে তুই শোভার নামে মিথ্যে বলেছিস। নিজের দোষ আড়াল করেছিস। কি ভেবেছিস? এমনই যাবে দিন?”
“যাচ্ছে তো? তুমি বরং আমাকে নিয়ে ভাবনা বাদ দাও। তোমার শোভাকে নিয়ে ভাবো। দেখ বিয়েটা বাঁচাতে পারো কিনা।”
মুচকি হাসে আদৃতা। রাগে রিফাতের শরীর কাঁপে।
“আদৃতা!” বলেই হেসে দিলো রিফাত-
“বেশি উড়িস না বোন আমার। আমাকে এখনো চিনিসনি তুই। আমি কে সেটা ভুলে যাস না। গতবার শোভা একা ছিল এবার আমি আছি ওর সাথে। তোর সত্যি সবার সামনে আনবো দেখেনিস।”
“ও বাবা! ভয় পেলাম তো। হিহিহি, ভাইয়া তুমি পারোও। এসব জোকস বলে হাঁসানোর কোন মানে আছে? দেখো ভাবো বসে বসে। কিভাবে আমাকে শাস্তি দেবে ভাবো।”
আদৃতা হাসতে হাসতে চলে গেলো। রিফাত মেজাজ হারিয়ে টেবিলে ঘুসি মারে। প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে ককিয়ে উঠলো। নীল হয়ে গেছে হাত। নীলচে হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো রিফাত। হাসলো ঠোঁট বাকিয়ে। ওভার কনফিডেন্স মানেই ভুল। আদৃতা ভুল করবে, অবশ্যই করবে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। ভুল হওয়ার অপেক্ষা!
চলবে—
© Farhana_য়েস্মিন
#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১৭
সেদিন ওভাবে ফিরে যাওয়ার পর থেকে রিফাতের খবর নেই। ফোন দেয় না, কথা বলে না। আজ বৃহস্পতিবার দেখে সারাদিন অপেক্ষা করলো রিফাতের ফোনের। বিকেলে ক্লাস শেষে ফেরার পথে মনটা ভীষণ খারাপ হলো শোভার। প্রায় সবাই আজ বাইরে যাচ্ছে। জুথি আর কনা যাবে বাসায়। শোভার ভীষণ একা লাগে। রিফাত কি আসবেনা আজ? আদৃতা কি শেষ মেষ ওকে ভুল বোঝালো বাকী সবার মতো? হোস্টেলের দিকে ঘুরতে ফোন বাজে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই মুখে হাসি ফুটলো শোভার। রিসিভ করতেই রিফাতের কন্ঠ কানে এলো-
“তাড়াতাড়ি গেটে এসো। আমি দাঁড়িয়ে আছি।”
“আসছি।”
বলেই নিজেকে দেখলো। আজ একদম সিম্পল হয়ে বেরিয়েছিল। ভেবেছিল অন্যদিনের মতো হলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বের হবে। কিন্তু রিফাত যেভাবে তাড়া দিলো তাতে আজ হলে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাছাড়া ওরও তর সইছে না। রিফাতকে দেখার তৃষ্ণা প্রবল হলো। মনেহচ্ছে কয়েক যুগ দেখে না রিফাতকে। অথচ একটা সপ্তাহ হয়নি এখনো। তবে কি রিফাতকে ভালোবাসতে শুরু করেছে মন? লাজে গাল রঙিন হলো। শোভা নিজেকে শাসন করে তবুও ক্ষনে ক্ষনে রিফাতকে ভাবে। পা আপনাতেই জোরে চলতে শুরু করে।
মন খারাপ করে বসে ছিলো রিফাত। শোভাকে দেখতেই চেহারা উজ্জ্বল হলো। শোভার চেহারার খুশি হুট করে নিভে গেল। ছেলেটা সম্ভবত কোন দুশ্চিন্তায় আছে। আদৃতা কিছু করেছে কি? রিফাতের দুশ্চিন্তা কি ওকে নিয়ে? পায়ে পায়ে সামনে এগিয়ে গেল-“আমি ভেবেছি আজ আপনি আসবেন না।”
“কেন? আসবো না কেন? এমনিতেই ক’দিন তোমার সাথে কথা হয়নি, মনটা খুব ছটফট করেছিল।”
শোভার রঙিন গালের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো রিফাত। মেয়েটা লজ্জা পেলে কি দারুণ লাগে দেখতে।
“তুমি কি আমাকে মিস করেছ?”
শোভা মাথা নাড়তেই রিফাতের মুখ গম্ভীর-“আসলেই মিস করনি। মিস করলে তো আমাকে ফোন দিতে।”
শোভার মুখে আঁধার নামে-“আমি ভাবলাম আপনি ব্যস্ত থাকবেন তাই বিরক্ত করিনি। তাছাড়া আদৃতাকে নিয়ে নিশ্চয়ই ঝামেলায় ছিলেন না হলে আপনি নিজেই ফোন করতেন আমাকে।”
হঠাৎ যেন কিছু একটা মনে হয়েছে এমনভাবে তাড়া দেয় রিফাত-“তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো তো। অন্য কোথাও যেয়ে বসি। অনেক কথা জমে আছে।”
শোভা গাড়িতে বসতেই রিফাত গাড়ি চালানো শুরু করে। খুব বেশি দূরে আসলোনা ওরা। ভালো একটা রেস্টুরেন্টে জানালার ধারে এসে বসলো দু’জন।
“আদৃতার কি খবর? ওর সাথে কথা বলেছেন? কি বলে ও?”
শোভার প্রশ্ন শুনে চুপ করে রইলো রিফাত।
“কি হলো কিছু বলছেন না যে?”
“কি বলবো? আচ্ছা, আদৃতা কি সবসময় এরকমই? মানে এমনই চতুর? তোমার সাথে ওর ফ্রেন্ডশীপ হলো কি করে?”
শোভা হাসলো-“ছোট বেলা থেকে একসাথে পড়ালেখা করেছি। আদৃতা সবসময় একটু চতুর। নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যে বলা, লুকিয়ে চুরিয়ে ছেলেদের সাথে কথা বলা, পরীক্ষায় পাশের জনেরটা দেখে লেখা সবই করতে দেখেছি ওকে। ক্লাস সেভেনে উঠতেই ওর হাতে ফোন দেখেছি যেখানে মেট্রিকের পরও আমাদের হাতে ফোন আসেনি। অবশ্য ফোনটা ওর কোন একটা বয়ফ্রেন্ড কিনে দিয়েছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে ফোন ব্যবহার করতো। ওদের বাড়িতে পড়তে গেলে মাঝে মাঝে আমার ছবি তুলে নিত। তখনও জানতাম না আমার ছবিগুলো ও কি কাজে ব্যবহার করে। কারন ওরকম কুটিল ভাবনা আমাদের মাথায় আসা সম্ভব না। অথচ ওর ভাবনা ওইসময়ই অতোটা জটিল ছিলো। আমি কয়েকবার ভেবেছি ওর সাথে আর মিশবো না। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারিনি। ও যখনই আমার মনের ইচ্ছে বুঝতো তখনই আমাদের বাড়িতে এসে আমার হাতেপায়ে ধরতো। নানা ভাবে ইমোশনাল ব্লাকমেল করতো। চাইলেও ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করার উপায় ছিল না।”
রিফাত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো-“ওর মতো মেয়ে এতটা ভদ্র হয়ে আছে কি করে বলোতো? গত তিনবছর ধরে লক্ষীমেয়ে সেজে অভিনয় করছে।”
শোভা হাসলো-“ওকে যতটুকু চিনি ওর পক্ষে কিছু না করে থাকা সম্ভব না। ও নিশ্চয়ই কারো সাথে কিছু না কিছু করছে। আপনারা হয়তো সেভাবে নজর রাখেননি তাই জানেন না। ওর ফোনটা চেক করে দেখেন কোনভাবে।”
“আর ইউ শিওর?”
“হান্ড্রেড পারসেন্ট। ও আমার কথা কি বলেছে? বিয়ে ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে নির্ঘাত?”
রিফাত অবাক হয়ে বলে-“তুমি জানলে কি ভাবে?”
“ও কোনভাবেই চাইবে না আমার কাছাকাছি থাকতে। আপনার বউ হয়ে গেলে ওর সাধু সেজে থাকাটা খুব সহজ হবে না। অবভিয়াসলি আমাকে দূর করতে চাইবে।”
রিফাত মন খারাপ করে বললো-“আসলেও তাই করছে। ও মাকে কি উল্টো পাল্টা বলেছে জনি না। মা এখন তোমাকে সহ্য করতে পারছেনা। আমাদের বিয়েটার ভবিষ্যৎ কি হবে জানি না।”
শোভা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ও জানতো এমন কিছু হবে। আদৃতা আছে আর ওর জীবনে ঝামেলা হবে না এমনটা হতেই পারে না।
“আন্টি যদি আদৃতার সাথে আপনার বিয়ের কথা বলে আমি তাতেও অবাক হবো না। আর বিয়ে নিয়ে আমি আগাগোড়াই আশাবাদী ছিলাম না। কে চাইবে এমন মেয়েকে বউ বানাতে যে মেয়ের এমন হিষ্ট্রি আছে?”
“যাহ, কি সব বলছো? মা এমনটা কখনোই বলবে না। ওকে আমি বোনের বাইরে অন্য কিছু ভাবিই না। ইনফ্যাক্ট শুরু থেকেই কেন যেন ওকে পছন্দ করতে পারি নাই। আর বিয়ে নিয়ে উল্টো পাল্টা ভেবো না একদমই। আমাদের বিয়ে হবে, অবশ্যই হবে। পরিবার রাজী না হলে আমরা পালিয়ে যাব।”
“পাগল হয়েছেন? এমনিতেই বাবা আমার সাথে কথা বলে না। আর যদি পালিয়ে বিয়ে করি তাহলে কি করবে জানি না। আমি তো বিয়ের কথা ভাবি না। বিয়ে না হলেও কোন সমস্যা নেই।”
“কিন্তু আমার যে অনেক সমস্যা হয়ে যাবে তোমাকে ছাড়া?”
রিফাতের কথায় যেন পরিবেশটাই থমকে গেল। দু’জনই কথা হারিয়ে ফেলেছে। কিছুটা সময় পার হলে শোভা মুচকি হাসলো-“শুনুন, আপনি আদৃতাকে এখনো চিনতে পারেননি। আমার কথা মিথ্যে না সে প্রমান আপনি পাবেন কয়েকদিনের ভেতর। আচ্ছা, আপনার এমন কোন বন্ধু আছে যে খুব পপুলার? আপনাদের চাইতে টাকা পয়সা বেশি এরকম কেউ?”
রিফাত সরু চোখে তাকালো-“হ্যা আছে। কিন্তু তাতে কি হবে?”
শোভা দুষ্ট হাসি দিলো-“আদৃতার সাথে ফ্লার্ট করতে হবে আপনার সেই বন্ধুকে। অনেক দামী দামী গিফট দেবে ওকে। তারপর কিছু একটা তো হবে।”
“আমার মনেহয় না এতে কাজ হবে। আদৃতা এখন আগের চাইতে বেশি চালাক। এতো সহজে কারো ফাঁদে পড়বে না। তাছাড়া ভার্সিটিতে ওকে একটা ছেলের সাথে দেখেছিলাম। একদিন জিজ্ঞেসও করেছিলাম। মনেহলো সেই ছেলের সাথে সম্পর্কে আছে।”
“আদৃতা আর ভার্সিটির কেউ? কখনোই না। ও হয়তো ছেলেটাকে ইউজ করে ছেড়ে দেবে। এর বেশি আর কিছু না। আর পারলে ওকে চোখে চোখে রাখুন কিছু না কিছু পেয়ে যাবেন।”
“এত শিওর হয়ে বলছো কি করে?”
“ওকে আর চিনতে বাকী নেই আমার।”
“আচ্ছা শোন, এখন হয়তো তোমার কাছে কম আসবো। তাই বলে তুমি আবার অন্য কিছু ভেবে বসোনা। আসলে আদৃতা আমাদের দেখলেই মায়ের কাছে বলবে। আর মা ভুল বুঝবে আমাদের। আমি চাচ্ছি না আদৃতাকে কোন সুযোগ দিতে। বুঝলে?”
শোভা মাথা দুলায়। না বুঝে উপায় নেই কোন। আদৃতাকে কিভাবে পথে আনবে তাই ভাবছে। ইউনিতে ওর ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিতে হবে। ওকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
“কি ভাবছো?”
রিফাতের প্রশ্নে ভাবনার জগত ছিন্ন হয়। কিছু বলবে তার আগেই ফোনটা বেজে উঠলো। ভ্রু কুঁচকে গেল শোভার। ছোট বোনের ফোন। ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মায়ের গলা পাওয়া গেল। হুড়মুড়িয়ে কথা বলে গেল সাজেদা। ওপাশ থেকে কে কি বলছে তা শুনতে পেলো না রিফাত। তবে শোভার চেহারার পরিবর্তন বেশ চিন্তায় ফেলে দিল তাকে। বোঝাই যাচ্ছে মেজাজ ভয়ংকর রকম খারাপ। ফোন নামিয়ে রাখতেই রিফাত জানতে চাইলো-“কি হয়েছে? বাসায় সব ঠিক আছে? কে ফোন করেছিল?”
শোভার চোখদুটো রক্তজবার ন্যায় রক্তিম হয়ে গেছে। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। সে রিফাতের পানে চাইতেই ভয় পেয়ে গেলো রিফাত।
“আপনার মা আমাদের বাসায় গেছিলো। আমার বাবাকে যা না তা বলে এসেছে। আমার বাবা নাকি ফ্রড করে আপনার সাথে আমার বিয়ে দিচ্ছে। আমার যোগ্যতা নেই আপনার বউ হওয়ার। আমি একটা চরিত্রহীন মেয়ে। আমার নাকি অনেকের সাথে সম্পর্ক। আমি নাকি…”
বলতে বলতে দু হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে দেয় শোভা। রিফাত অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। মা হঠাৎ এমন কাজ কেন করলো?
“শোভা, প্লিজ কেঁদো না। আমি বুঝতে পারছি না মা এমন কিছু কেন করলো। আমি সত্যি জানি না মা এমন কিছু করতে পারে। ধারনাও করতে পারছি না। শোভা! এই শোভা, কান্না বন্ধ করো প্লিজ।”
শোভা আরও কিছুক্ষণ কাঁদলো। তারপর মুখ মুছে নিল-“আপনি চলে যান। আর আসবেন না। এই বিয়ে হবে না আর। আপনার মা বিয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা বিয়েটা আমি বাবার জন্য করতে চেয়েছি। সেই বাবা যখন অপমানিত হয় তখন আর সেখানে বিয়ের প্রশ্নই আসে না।”
রিফাতের বুক ধরফর করে, জলের তেষ্টায় বুক শুকিয়ে আসে। এসব কি বলছে শোভা? এই ক’দিনে শোভা ওর হৃদয়ে কতটা আসন পেতে বসেছে ও কি তা জানে? সে আকুতি নিয়ে বলে-“এসব কি বলছো শোভা? প্লিজ এসব বলো না। আদৃতা নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছে। মা হয়তো রেগে আছে, আদৃতার শয়তানি বুঝতে পারছে না। তুমি ভেব না মাকে আমি ম্যানেজ করে নেব।”
“আর ইউ ম্যাড? আপনার মা আমার বাবাকে অপমান করেছে, অপমান! আর সব মেনে নিলেও বাবার অপমান কিছুতেই মেনে নেব না। এমনিতেই আমি তার কাছে অপরাধী আর বেশি অপরাধের বোঝা চাপাতে চাই না নিজের কাঁধে। চলে যান আর আসবেন না।”
শোভা উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করে। রিফাত ডাকলো-“শোভা, প্লিজ এমন করো না। এটা একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং। আদৃতার শয়তানি।
আমরা দু’জনে মিলে এই সমস্যার সমাধান করে ফেলবো। এভাবে চলে যেয় না প্লিজ। শোভা, আদৃতাকে জিতিয়ে দিয় না। ও তো এটাই চায়। তোমার আমার বন্ধন ছুটে যাক। তাহলে ওর আর কোন ভয় রইলো না। শোভা, শোভা, কথা শোন।”
শোভা শুনলো না, ফিরেও তাকায় না। চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। রিফাত অসহায় চোখে চেয়ে দেখলো। কি করবে ও এখন? কিভাবে ফিরাবে শোভাকে?
আদৃতা শেষ পর্যন্ত আবারও জিতে গেল? কেন? কি চায় ও? রিফাত ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। দ্রুত গতিতে গাড়ি ঘুড়িয়ে নিলো বাসার উদ্দেশ্যে। আদৃতাকে ধরবে আজ। নিজের অপরাধের জন্য একটুও অনুতপ্ত না হয়ে বরং আরও অপরাধ করতে লেগেছে। আজ জানতেই হবো ও কি চাইছে? কেন এমন করছে? আর এতো সাহসই বা পাচ্ছে কোথায়? একটা মেয়ে হয়ে এতটা নিচে নামে কিভাবে?
চলবে—
© Farhana_Yesmin