আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-২৬

0
210

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২৬

“গাইজ, পরিচয় করিয়ে দেই। তোদের হলেও হতে পারতো ভাবি মানে আমার হলেও হতে পারতো বউ এর সাথে। ওর নাম শোভা, ছদ্ম নাম মেঘা। আর মেঘা ওরা আমার বন্ধু। এই যে বামে দাঁড়িয়ে আছে ওর নাম মিনহাজ, তারপর হাফিজ, নিয়াজ আর ও ফুয়াদ।”
“হাই ভাবি। কেমন আছেন?” ফুয়াদ হাত তুললো।
“আরে ভাবি বলছিস কেন? শুনিসনি রিফাত কি বললো?”
মিনহাজের কথায় ফুয়াদ অবাক চাহুনি দিলো।
“বললো হলেও হতে পারতো ভাবি। মানে ভাবি এখনো হয়নি, আবার হবে কিনা তাও শিওর না।”
ফুয়াদ বোকা বোকা চেহারা করে মাথা চুলকে জানতে চাইলো-“মানে কি? হবে নাকি হবে না? সম্পর্কে এমন অনিশ্চয়তা থাকলে ওকে আমাদের সামনে নিয়ে এলো কেন? আর পরিচয়ই বা কেন করিয়ে দিচ্ছে?”
“সেটা রিফাতই ভালো বলতে পারবে।”
মিনহাজ কাঁধ ঝাঁকালো। ওদের এসব কথা শুনে শোভা বেশ বিব্রত বোধ করলো। ওর ইচ্ছে করছে এখনই এই স্থান ত্যাগ করতে। ও রিফাতের মুখের দিকে তাকালো। রিফাতকে খুব একটা বিচলিত দেখালো না। সে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাসলো-“আরে, তোরা এতো ইস্যু ক্রিয়েট করছিস কেন? বউ না হলেও বন্ধু তো হতে পারি। নতুন একজন মানুষকে নিয়ে এসেছি ওকে আপ্যায়ন করবি কিনা করছিস জেরা। আমরা তাহলে চলে যাই। এই মেঘা চলো তো যাই।”
রিফাত চলে আসতে নিলে নিয়াজ দৌড়ে এলো-“আরে করছিস কি? এতোদিন পরে এসে এসব কি বলছিস? বাদ দে ভাই। তোর অভাবে আড্ডা দেওয়া ভুলে গেছি। আয় বোস। এতো সহজে ছাড়ছি না আজ তোকে। ভাবি… সরি সরি মেঘা তুমিও এসো। তুমি করে বলছি বলে আবার কিছু মনে করলে নাতো?”
শোভা অনিচ্ছায় ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে এলো-“না ভাইয়া কিছু মনে করিনি। আমি তো আপনাদের অনেক জুনিয়র। তুমি বললে কিছু মনে করবো কেন?”
“দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল। এসো বসো আমাদের সাথে।”
হাফিজ শোভার দিকে চেয়ার এগিয়ে দিলো-“তুমি কি জাদু জানো বলো তো? আমার বন্ধুটিকে সেই কবে শেষ দেখেছিলাম। আমাদের আড্ডায় আসায় ভুলে গেছে। বহুদিন পরে আজ আবার তার দেখা পেলাম তোমার কল্যানে।”
শোভা কি বলবে ভেবে পেলো না। রিফাতের কোন ব্যাপার সে জানে না জানার চেষ্টা করেনি কখনো। এখন মনেহচ্ছে জানা উচিত ছিলো। শোভা তাকিয়ে দেখলো রিফাত বন্ধুদের সাথে আলাপে মগ্ন। মিনহাজ, ফুয়াদ আর নিয়াজ রিফাতকে ঘিরে ফিসফিস করছে। রিফাত একবার আড়চোখে শোভাকে দেখতে যেয়ে দু’জনার চোখা চোখি হলো।
এরকম চুপি চুপি কি কথা বলছে ওরা? খুব শুনতে ইচ্ছে করলো।

হাফিজ যেন শোভার মনের ইচ্ছে টের পেলো। শোভার মন ঘোরানোর জন্যই ও জানতে চাইলো-“তোমার কথা একটু বলো তো। কিছুই জানি না তোমার ব্যাপারে। রিফাতও কখনো কিছু বলেনি। কি করে আলাপ হলো তোমাদের?”
“পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল ওনার সাথে। উনিই কথা বলতে এসেছিলেন আমার সাথে।”
“স্ট্রেন্জ! রিফাতকে কখনো কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে যেচে পড়ে আলাপ করতে দেখিনি। তার মানে বুঝতে হবে তুমি বিশেষ কেউ।”
শোভার গাল দুটো রক্তাভ হলো। হাফিজ হাসলো-“আরে, তুমি দেখি লজ্জা পাচ্ছ।”
শোভা খুস খুস কাশলো। হাফিজ প্রাসঙ্গ পাল্টে ফেলে-“তোমার ভিডিওটা দেখেছি। স্যাড পাস্ট সম্পর্কে জেনে খুব খারাপ লেগেছে। আদৃতাকে দেখেছি কয়েকবার। ও ওরকম মেয়ে কখনো বুঝিনি। মেয়েটা বেশ ভালো অভিনয় জানে বলতে হবে।”
“এসব বুঝি আপনার বন্ধু বলেছে?”
হাফিজ জিভে কামড় দেয়-“ছিছি, ওকে ওরকম খারাপ ভেব না। আর তোমার কোন কথা ওর পেট থেকে বের করতে পারিনি। বুঝতে পারছো তো তুমি কি ওর জন্য। ওই যে মিনহাজকে দেখেছ না? ওকে আমরা মিডিয়া মিনহাজ বলে ডাকি। দুনিয়ায় যাবতীয় খবর থাকে ওর কাছে।”
হাফিজের বলার ভঙ্গিতে শোভা হেসে দিলো। হাফিজও হাসলো। মিনহাজ কান খাঁড়া করে শুধালো-“এই তোরা কি নিয়ে হাসছিস রে। নিশ্চয়ই আমার বদনাম করছিস তাই না?”
সেকথা শুনে দু’জনে আবার হাসলো। হাফিজ বললো-“আসলেই তোর কথা বলছিলাম।”
“কি বলছিলি শুনি।”
মিনহাজ এগিয়ে এলো। ওর সাথে বাকীরাও। টুকটাক এ কথা সে কথা বলতে বলতে বেশ ভালো সময় কাটলো শোভার। যদিও শোভা থাকাতে বন্ধুদের আড্ডা খুব একটা জমলো না। বিদায় নিয়ে ওরা যখন বাইরে এলো তখন সন্ধ্যার আকাশে ঘনঘন মেঘ ডাকছে। শোভার মুখেও যেন মেঘের ঘনঘটা। রিফাত বার কয়েক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো শোভার মনের হাল। মেয়েটা এতোক্ষণ তো ভালোই ছিল, ওদের সাথে তাল দিয়ে হাসাহাসি করছিল। এখন হঠাৎ কি হলো? ওরা কেউ তো তেমন কিছু বলেনি যে রাগ করবে। তাহলে? গাড়িতে বসেও কোন কথা বললো না শোভা। রিফাতও প্রশ্ম করলো না।

গাড়ি ধানমন্ডি সাতাশ আসতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। এমনই বৃষ্টি যে কয়েক কদম দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎই রিফাতকে মানিক মিয়া এভিনিউতে গাড়ি ঘোরাতে দেখে শোভা ভ্রু কুঁচকে দেখলো রিফাতকে-“এদিকে এলেন যে? যে বৃষ্টি হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যে এদিকে পানি জমে যাবে। তখন গাড়ি নিয়ে যেতে সমস্যা হবে। তাছাড়া রাত হয়ে গেলে মা টেনশন করবেন।”
রিফাত গাড়ি থামিয়ে শোভার দিকে তাকালো-“তোমার মুড অফ কেন? কি হয়েছে?”
“এইজন্য গাড়ি থামিয়েছেন?”
রিফাত মাথা দুলালো-“কি হয়েছে?”
“কিছু না। তাড়াতাড়ি গাড়ি চালান বৃষ্টি কিন্তু বাড়ছে।”
“আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। জবাব না পেলে গাড়ি ছাড়বোনা।”
“আরেহ এসব কি কথা? জোর করবেন এখন?”
“করবো৷ বলো তোমার মন খারাপ কেন? আমার কোন কথায় কষ্ট পেয়েছ?”
শোভা মেজাজ খারাপ করে বলে-“হ্যা পেয়েছি। এখন কি কথা ফিরিয়ে নেবেন?”
রিফাত তার আয়ত চোখ নিয়ে শোভাকে দেখছে-“যতদূর মনে পড়ে তোমার কষ্ট লাগবে বা মন খারাপ হবে এমন কিছু আজ আমি বলিনি।”
শোভার দৃষ্টিতে রাগের আভাস-“অবশ্যই বলেছেন। আমি শুরুতেই আমাকে অপমান করেছেন বন্ধুদের সামনে।”
“অপমান করেছি? কিভাবে?”
“বড্ড জ্বালাচ্ছেন কিন্তু। আমি আর কথা বাড়াতে চাইছি না। প্লিজ চলুন রাত বাড়ছে।”
শোভা অস্থির হলো। রিফাত সিটে মাথা হেলান দিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করে-“কোন কথা বলেছি। কিসে তুমি কষ্ট পেলে? বলো প্লিজ।”
“বললাম না বলবো না।”
শোভা গোয়ারের মতো মাথা নাড়ে।
“তাহলে গাড়িও চলবে না।”
“বেশ। আপনি থাকুন তাহলে। আমি নেমে গেলাম।”
রিফাতকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে শোভা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। হতচকিত রিফাত বোকা বনে গেলো। তড়িৎ গতিতে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। তাকিয়ে দেখলো শোভা ততক্ষণে কয়েক কদম এগিয়ে গেছে। গেছে। এরই মধ্যে ভিজে গেছে মেয়ে। রিফাত দৌড়ে গিয়ে শোভার হাত ধরলো-“এসব কি বোকামি মেঘা? এই বৃষ্টির মধ্যে এভাবে গাড়ি থেকে নেমে পড়ার কোন মানে হয়?”
শোভা ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়াতে চাইলো-“ছাড়ুন আমি একাই চলে যেতে পারবো। আপনার সাথে যাবো না।”
রিফাত কোন কথা না বলে শোভাকে টেনে নিয়ে এলো গাড়ির কাছে-“এই বৃষ্টির রাতে ভেজা কাক হয়ে তুমি বাড়ি যাবে? আর ইউ ম্যাড?”
“হ্যা আমি পাগল। তো আপনার কি? আপনি কেন বাঁধা দিচ্ছেন? আমি কে আপনার? হলেও হতে পারতাম বউ?”
এতক্ষণে রিফাতের কাছে শোভার অভিমানের কারণটা স্পষ্ট হলো। বুঝতে পেরেই রিফাতের ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো-“হ্যা, ঠিকই তো। তুমি তো আমার হলেও হতে পারা বউই। এতে এতো রাগের কি আছে? আমি তো সত্যি কথাই বলেছি ওদের।”
“তাই তো, রাগের কি আছে? আমি তো রাগিনি। কেন রাগবো, কার উপর রাগবো? আপনার উপর? কোন অধিকারে?”
বৃষ্টির পানিতে শোভার চেহারা ভিজে একাকার। বৃষ্টির পানি পড়ে ওর মুখচোখে অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। রিফাত মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। ভিজে গেছে রিফাতও। ঠান্ডা জলের ধারায় ওর শরীর কাঁপছে মৃদু। তবুও শোভার বৃষ্টিতে ভেজা চেহারার আকর্ষন কাটাতে পারছেনা। রিফাত আঙুল দিয়ে শোভার ভেজা ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিস করলো-“হবু স্বামীর অধিকারে রাগ করতে পারো। এমনকি প্রেমিকের অধিকারেও অভিমান করতে পারো। আমি কিছু মনে করবোনা।”
শোভার শরীর খানিকটা কেঁপে উঠলো রিফাতের স্পর্শে-“আমার বয়েই গেছে আপনার উপর রাগ করতে।”
রিফাত শোভার গালের উপর রেখা আঁকে-“কিন্তু তুমি যে রাগ করে ফেলেছ। আর আমার তোমার এই রাগটা ভীষণ ভালো লাগছে। ভীষণ রকম ভালো।”
বলতে বলতে রিফাত শোভার গালে অধর ছোঁয়ায়। শোভার গায়ে যেন বিদ্যুৎ স্পর্শ করে এমন ভাবে কেঁপে উঠলো। কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলো-“এই, কি করছেন আপনি?”
রিফাতের অধর তখন শোভার অধরের খুব কাছাকাছি। সে মদিরা পান করা কন্ঠে বলে উঠলো-“তোমার অভিমান ভাঙাচ্ছি। তুমি কি রাগ করবে প্রিয়?”
প্রিয় সম্মোধনে শোভা যেন জমে গেছে। মাথা নাড়িয়ে মানা করবে এই শক্তিটুকুও নেই। রিফাত ওর নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে খুব ধীরে ধীরে শোভার নরম অধরে অধর নামিয়ে আনলো।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন