আবেগময় সম্পর্ক পর্ব-০৭

0
252

#আবেগময়_সম্পর্ক
#৭ম_পর্ব
#লেখিনীতে_মৃদু_সুপ্রিয়া

মেহুল অন্তরার বিষয়েই ভাবছিল এমন সময় আমিনা আক্তার তার রুমে চলে আসে। মেহুলকে দেখে বলে, “আমার বড় ননদ এসে গেছেন। তোমাকে দেখতে চান উনি। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিচে চলে এসো।”

মেহুল বলে, “জ্বি, আচ্ছা। আমি সাজগোজ করে নিচে যাচ্ছি।”

মেহুল এরপর সুন্দর করে তৈরি হয়ে নেয়। তবুও নিজেকে বারংবার আয়নায় দেখছিল। আগে কখনো নিজের প্রতি কোন বিতৃষ্ণা ছিল না মেহুলের। কিন্তু আজ তার নিজেকে নিয়ে বিতৃষ্ণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে অন্তরার থেকে কম সুন্দরী এটাই তার দোষ। স্বভাব বশতই মেয়েরা তার সতীনের প্রতি হিংসাত্মক হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটে নি। তবে মেহুল নিজেকে সামলে নেয়। ভাবে, “যে এখানে উপস্থিত নেই তাকে হিংসা করে কি হবে? সৃষ্টিকর্তার তৈরি করা সবকিছুই সুন্দর। আমি আর তাই এসব নিয়ে ভাববো না।”

অন্তরা তৈরি হয়ে বাইরে আসে। আমিনা আক্তার নিজের বড় ননদের সাথে মেহুলের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “ও হলো মেহুল। আমাদের আকাশের বউ।”

আমিনা আক্তারের বড় ননদ আফরোজা নাজনীন বরাবরই ঠোঁটকাটা স্বভাবের। তাই তিনি মুখের উপরেই বলে দেন, “ও এই তাহলে আকাশের সেকেন্ড ওয়াইফ। হ্যাঁ ভালোই আছে। কিন্তু আকাশের প্রথম বউয়ের মতো আগুন সুন্দরী নয়।”

মেহুলের মন এমনিতেই খারাপ ছিল অন্তরার ছবি দেখে এরপর আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে তার মন আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়। মেহুল ততক্ষণাৎ সেখান থেকে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসে এবং বিছানায় শুয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। মেহুল বলতে থাকে, “কেন বারবার সবাই আকাশের প্রথম স্ত্রী অন্তরার সাথে আমার তুলনা করছে? মানছি আমি তার মতো সুন্দরী নই কিন্তু আমিও তো একজন মানুষ। আমার তো খারাপ লাগে যখন কেউ এভাবে তুলনা দেয়। আমি তো নিজেই নিজেকে তৈরি করিনি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে তৈরি করেছেন। তাহলে কেন এইসব খোটা আমাকে সহ্য করতে হবে?”

এসব ভাবনার মধ্যে কেউ একজন মেহুলের মাথায় হাত রাখে। মেহুল মাথা তুলে আমিনা আক্তারকে দেখতে পায়। তখন সে খুবই সন্তপর্ণে নিজের চোখের অশ্রু মুছে নেয়। আমিনা আক্তার মেহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “আমার ননদের কথায় কিছু মনে করো না। উনি বরাবরই একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবের কিন্তু ওনার মন অনেক ভালো। তুমি যে এভাবে চলে এলে এটা নিয়ে উনি অপরাধবোধে ভুগছেন। যাইহোক তুমি একটা কথা মনে রাখবে নিজেকে নিয়ে কখনো হীনমন্যতায় ভুগবে না। তোমার কাছে যা আছে যতটুকু আছে, সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে, দেখবে পৃথিবীটা অনেক বেশি সুন্দর মনে হবে।”

মেহুল বুঝতে পারে আমিনা আক্তার কি বোঝাতে চাইছে। তাই সে সাথে সাথে উঠে পড়ে এবং স্বাভাবিক হয়ে পুনরায় আফরোজা নাজনীন এর সামনে যায়। আফরোজা নাজনীন মেহুলকে দেখে বলে, “আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিও। একচুয়ালি আমি মুখের উপরেই অনেক কিছু বলে দেই।”

“ঠিক আছে, কোন ব্যাপার না।”

বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক হয়। আমিনা আক্তারও আশ্বস্ত হন। আফরোজা নাজনীন দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আবার নিজের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে ফিরে যান। তিনি যাওয়ার পর মেহুল একটু বাইরে ঘুরতে বের হয়। তখনই তার মনে পড়ে যায় রায়ানের স্কুল ছুটির সময় হয়ে গেছে। তাই মেহুল ঐদিক থেকে একেবারে রায়ানকে স্কুল থেকে আনতে যায়। রায়ানের স্কুলের সামনে উপস্থিত হয় মেহুল। কিছু সময় বাদেই রায়ানের স্কুলে ছুটির ঘন্টা বেজে ওঠে।

এক এক করে অনেক স্টুডেন্ট বেরিয়ে আসে৷ সবার সাথে রায়ানও বের হয়ে আসে। রায়ান মেহুলকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে তার কাছে। আশেপাশের অন্যান্য বাচ্চারা অবাক হয়ে যায়। রায়ানের এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞাসা করে, “ইনি কে রায়ান? তোকে তো রোজ তোর মামা নিতে আসে।”

“আমার নতুন মা আজ আমাকে নিতে এসেছে।”

মেহুল রায়ানকে সাথে নিয়ে ফিরে আসতে থাকে। রায়ান মেহুলের সাথে অনেক আনন্দ করে আসার সময়। এক সময় রায়ান বলে, “নতুন মা জানো কাল আমাদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠান হবে। সেখানে সবাই বিভিন্ন কিছু পারফর্ম করবে। আমিও একটা রেইম বলব। সবার মা-বাবা’কে নিয়ে অনুষ্ঠানে আসবে৷ তুমি আর আব্বু আসবে তো আমার সাথে?”

“আমি তো অবশ্যই যাবো তোমার রেইম শুনতে। বাট তোমার আব্বুর কথা বলতে পারছি না।”

“তুমি আব্বুকে রাজি করাতে পারবে তো নতুন মা? আমার না খুব ইচ্ছা যে, আব্বু আমার রেইম শুনবে।”

রায়ানের সরল আবেদন শুনে মেহুলের মন কেমন করে। বাচ্চারা সবসময় ভালোবাসার কাঙ্গাল হয়। রায়ানও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু রায়ানের যেই বয়সে বাবা-মায়ের ভালোবাসায়, স্নেহে বড় হওয়ার কথা সেই সময় তার মা তার কাছে নেই, বাবা যেন থেকেও নেই। মেহুল রায়ানকে আশ্বাস দিয়ে বলে, “আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব তোমার আব্বুকে রাজি করানোর। বাকিটা তোমার আব্বুর ইচ্ছা।”

রায়ান খুশি হয়ে যায়। তার যেন অগাধ বিশ্বাস তার নতুন মায়ের উপর যে সে তার আব্বুকে রাজি করাতে পারবেই।

❤️
রাতে আকাশ ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরল৷ খাওয়া দাওয়া শেষে যখন আকাশ রাতে ঘরে আসল তখন মেহুল রায়ানকে প্রাকটিস করাচ্ছিল। রায়ান তার স্কুলের প্রোগ্রামে, “Johny Johny Yes Papa!” রেইমটি বলবে। মেহুল সেটারই প্রাকটিস করাচ্ছে তাকে।

আকাশ রুমে এসে জিজ্ঞাসা করে, “কিসের প্রস্তুতি চলছে?”

রায়ান উৎসাহী কন্ঠে বলে, “আমার স্কুলে কাল প্রোগ্রাম আছে। সেখানে আমি এই রেইমটা বলব।”

“ওকে৷ অল দা বেস্ট। ভালো করে প্রাকটিস করো।”

“আব্বু তুমি যাবে আমার স্কুলের প্রোগ্রামে।”

আকাশ গম্ভীর গলায় বলে, “আমার কাল অফিসে খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং এটেন্ড করতে হবে। সো আমি যেতে পারব না।”

রায়ানের মন টা খারাপ হয়ে যায়। সে কত আশা নিয়ে ছিল যে আকাশ হয়তোবা রাজি হবে তার সাথে প্রোগামে যেতে। অন্য সবার বাবার মতো রায়ানের পারফরম্যান্স তার বাবা দেখবে কিন্তু সেসবের কিছুই হলো না।

রায়ামের মন খারাপ দেখে মেহুলের অনেক বেশি খারাপ লাগে। তাই সে আকাশকে বলে, “ছেলেটা যখন এত আশা নিয়ে তোমাকে বলেছে তখন তুমি একটু চেষ্টা করে দেখুন যদি কোন ভাবে ম্যানেজ করা যায়। মিটিং তো আসবেই যাবে কিন্তু ছেলেটার প্রোগ্রাম তো আর বারবার হবে না।”

মেহুলের কথা শুনে আকাশ রাজি হওয়ার বদলে আরো বেশি রেগে গিয়ে বলল, “আমার মিটিংটা অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। এসব ফালতু প্রোগ্রাম এটেন্ডের থেকেও।”

মেহুলের মেজাজ বিগড়ে যায়। সে বলে, “নিজের ছেলের প্রোগ্রাম তোমার কাছে ফালতু মনে হচ্ছে। কেমন বাবা তুমি?”

“এই ব্যাপারে আমি আর কিছু শুনতে চাইনা।”

“শুনতে তোমাকে হবেই। আমি তোমাকে বলছি পৃথিবী এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক, ঝড় তুফানে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক পুরো পৃথিবী তবুও তোমাকে কাল তোমাকে রায়ানের প্রোগ্রামে যেতেই হবে।”

“আর যদি আমি না যাই তাহলে কি করবে তুমি? কি হলো আন্সার মি।”

“আমি নেগেটিভ কিছু ভাবতে চাইছি না। কারণ তুমি কাল রায়ানের প্রোগ্রামে যাচ্ছ এটাই ফাইনাল। আর যদি না যাও তাহলে রায়ানকে নিয়ে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তখন বুঝবে ঠ্যালা।”

আকাশ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ে।

#চলবে