#আমায়_একটু_ভালবেসো
#জান্নাতুল_ফেরদৌস_কেয়া
(২৫)
হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে পর্ণাকে, আদনানদের বাড়িতে নেয়া হলো। আদনান,অবশ্য জোর করেই এনেছে। তার এক কথা,”আমি আর কিছুতেই আমার সন্তানের, ক্ষ তি হতে দেব না”।পর্ণার আর কিছু বলেনি। সে মাথা নিচু করে সব শুনে গেছে।
সময় বহমান। সে কারো জন্য থেমে থাকে না। এভাবে কেটে গেল কয়েকমাস। অর্ণা আর তাহমিদ ভালোই আছে। তাদের ভালবাসার কেনো কমতি নেই। দু’জনেই একে-অপরের খেয়াল রাখে। একজন ঝগড়া করলে,অপরজন চুপ থাকে।এমন করেই চলছে তাদের জীবন।
অপরদিকে পর্ণার,জীবনে সুখ নেই! আদনান সবদিকে খেয়াল রাখলে ও, পর্ণার সাথে কথা বলে না। পর্ণার কখন কি লাগবে,না লাগবে সব খেয়াল রাখে। তবে পর্ণার সাথে কোনো কথা বলে না।হয়তো অভিমান জমেছে মনে, তাই।
বাড়ির সকলেই পর্ণাকে ক্ষ মা করে দিয়েছে। এমন কি সবাই চেষ্টা করে পর্ণা, যাতে সবসময় হাসি-খুশি থাকে। এমন সময় মেয়েদের বেশি মুড-সুয়িং হয়।তাই সবাই পর্ণাকে কথায় ব্যস্ত রাখে সবসময়। কিন্তু যত যাই-হোক।মেয়েরা তার প্রেগন্যান্সির সময় তার হাসবেন্ড কে পাশে চাই! তাদের আহ্লাদী পেতে চাই।যার কিছুই পাচ্ছে না পর্ণা।আদনান সারাদিন শেষে বাড়িতে ফিরে। গোসল সেরে ভাত খায়,তারপর আবার কলেজের কাজ নিয়ে পড়ে থাকে।রাত নয়টায় সেই কাজ শেষ করে, নিচে বিছানা করে শুয়ে পড়ে। পর্ণার তখন ভিষণ মন খারাপ হয়। তার ইচ্ছে করে, আদনানের বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে।কিন্তু আদনান তাকে ধারে কাছেও সহ্য করতে পারে না।দিন গুলো অসহ্য কাটছে পর্ণার।কেমন যেন দম বন্ধকর। প্রিয় মানুষের অবহেলা যে কতটা অসহনীয়। তার হাড়ে, হাড়ে টের পাচ্ছে পর্ণা।
পর্ণার পেট বেশ উঁচু হয়েছে। হাত,পায়ে পানি এসে গেছে। এইতো পরশুদিন নয়মাস হলো। আজকাল শরীর বেশ জ্বালা-পোড়া করে। সারারাত ঘুমুতে পারে না। পর্ণার জন্য আদনান ও জেগে থাকে।যতক্ষণ পর্যন্ত না পর্ণা ঘুমাবে।ততক্ষণ সে ও সজাগ থাকে। পর্ণার তখন অনেক খারাপ লাগে।কতদিন যে বলেছে, “আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি ঠিক আছি”।
কিন্তু আদনান শুনে না।সে তার মতো চলে।
আজ পর্ণাকে চেক-আপের জন্য নেয়া হবে। সকাল থেকেই আদনান বেশ ব্যস্ত।পর্ণাকে রেডি করিয়ে খাইয়ে দেয়া।তারপর নিজে তৈরি হওয়া।সব রিপোর্ট গুলো একসাথে করা। সবমিলিয়ে বেশ ব্যস্ত।পর্ণা অবশ্য কয়েকবার বলেছে,সাহায্য করতে। কিন্তু আদনান এমন ভাবে তাকালো,যে পর্ণা চুপ হয়ে গেল।
সবকিছু রেডি করে তারা নিচে নামলো।পর্ণা গাড়িতে ওঠতেই আদনান এসি অন করে দিল।গরম মেয়েটা একদম সহ্য করতে পারে না। দোতলা থেকে নেমে আসতেই হাঁপিয়ে গেল। গাল দুটো গোলাপি রঙ ধারণ করেছে। নাকে বিন্দু, বিন্দু ঘাম,ফোলা,ফোলা নাক মুখ।আদনান লুকিং গ্লাসে পর্ণার চেহারাটা দেখতে লাগলো। মা হওয়ার সময়টাতে, সব মেয়েরাই কি পর্ণার মতো সুন্দর হয়।নাকি পর্ণায় আলাদা?মেয়েটাকে আজ-কাল এতো সুন্দর লাগে,আদনানের ইচ্ছে হয় খেয়ে ফেলতে।
আদনান দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।সবকিছু যদি ঠিক থাকতো,তবে কতই না সুন্দর হতো সব।
তাহমিদ অফিসে যাবে। তাই প্রতিদিনের মতো গোসল করে এসে খাটে বসেছে। হাতে থাকা ভেজা তোয়ালেটা খাটের উপর রাখলো।তার চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
অর্ণাকে বেশ কয়েকটা ডাক দেয়া হয়েছে। প্রতিবারই জবাব এসেছে ” আসছি”
তাহমিদ আবার ডাক দিতে যাবে। এমন সময় হাজির হলো অর্ণা।হাতে তার ভাতের প্লেট। আজ ওয়াহিদ সাহেব বাড়িতে নেই। এজন্য ঘরেতে বসে খাবে তাহমিদ।বাবার কারণে শুধু সবার সাথে কথা বলে তাহমিদ। আর নয়তো তাও বলতো না।
অর্ণা রুমে ঢুকেই চেঁচিয়ে ওঠলো।দাঁতে দাঁত খিঁচে বলল,
,এই,আপনার কি আক্কেল-জ্ঞান নেই।কোনো আক্কেলে ভেজা তোয়ালেটা খাটের উপর রাখলেন।তার উপর আবার মাথাটা মুছেননি।চুলের পানি দিয়ে তো, ফের শরীর ভিজে যাচ্ছে।
তাহমিদ অর্ণার কথার কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।উল্টো অণার হাত ধরে টেনে তার কাছে আনলো। দুহাত দিয়ে কোমড় পেঁচিয়ে পেটে নাক গুঁজলো।
অস্পষ্ট সুরে বলল,
“কেন প্রতিদিন চিৎকার করো।জানোই তো আমি এমন।
” তাই বলে নিজেকে শুধরাবেন না? জেঠিমা তো বলল,আপনি নাকি অনেক ম্যাচিউর।নিজের কাজ সব নিজে করেন। কাউকে ধরতে দেন না।তবে এখন কি হলো?
“হ্যা। এতদিন গুছালো ছিলাম।কারণ তুমি ছিলে না।এখন আমার গুছিয়ে দেবার লোক আছে। তাই এখন একটু অগোছালো হলাম।তোমার যদি সমস্যা হয়,তবে আবার আগের মতো হয়ে যাবো।
অর্ণার মন খারাপ হয়ে গেল। সে কি আর ওভাবে বলেছে নাকি?তার তো ভালোয় লাগে তাহমিদের এমন দুষ্টমি গুলো। শুধু তাহমিদ যেনো খেপাতে না পারে, এজন্য ওমন করে বলে।
তাহমিদ বুঝি বোঝলো।যে অর্ণা রাগ করেছে। তাই অর্ণার গাল টিপে বলল,
” আরে মজা করছিলাম। তুমি বললেই কি আমি ঠিক হয়ে যাবে নাকি?এতদিন পর একটা জ্বালানোর মানুষ পেয়েছি। তাকে কি এতো সহজে ছাড় দিয়ে দিবো।
নাও এখন আমার মাথা মুছে,শার্ট পড়িয়ে দাও।তারপর টাই টা বেধে দিবো।আরো আছে,,,
অর্ণা তাহমিদ কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক আর বলা লাগবে না। আমি জানি কি করতে হবে।
অর্ণার কথায় দুজনেই হেসে ওঠে। তারপর অর্ণা তার কাজে লেগে পড়ে।
কেবিনেট থেকে শার্ট নামিয়ে, তাহমিদকে পরিয়ে দিল।তারপর তার টাই বেধে, হাতে ঘড়ি, তার ওয়ালেট, গায়ে পারফিউম,সর্বশেষ কোট পরিয়ে দিল।
তাহমিদকে তৈরি করিয়ে দিয়ে, তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিল অর্ণা। খাওয়ার সময় হুট করে চোখে জল এসে গেল তাহমিদের।তা দেখে অর্ণা ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কি হয়েছে আপনার?কাঁদছেন কেন?
তাহমিদ ধরা গলায় বলল,
“জানো অর্ণা,জন্মের পর তুমি আর আমার বাবাকে দেখেছি আমাকে এতো যত্ন করতে। এছাড়া আর কেউ করে না। এই যে দেখছো, আমরা একান্নবর্তী পরিবার। তবুও আমার ভালবাসার মানুষ খুবই কম।এই পরিবারে সবাই, সবার সার্থের জন্য সবকিছু করে। এই যে দেখছো এতো ভালো জেঠিমা,ওনিও এমন। উনার বড় মেয়েকে আমার বাবার টাকায় বিয়ে দিয়েছে। ছোট ছেলেকে আমার বাবার টাকায় লেখাপড়া করিয়ে বিদেশ পাঠিয়েছে। এখন যে ছোট মেয়ে আছে। তার দায়িত্ব ও বাবার। একথায় এই পরিবার টা বাবার জন্য এক হয়ে আছে। কারণ সব কিছুর খরচ বাবা দেয়।বাকিরা আমাদের টাকায় খায়, আর নিজেদের টাকা জমায়। ভাইয়া তো এইজন্যই ভাবীকে নিয়ে বিদেশ চলে গেছে। কারণ এতো করে ও ওরা আমার ভাইয়ের বাচ্চাটাকে বাঁচতে দেয়নি।
অর্ণা অবাক হলো।কি বলছে এসব তাহমিদ। সে অবাক সুরে বলল,
” কি বলছেন?কে বাঁচতে দেয়নি?
তাহমিদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
“ভাইয়ার বিয়ের পর, ভাই আর ভাবী এখানেই থাকতো।কিন্তু হঠাৎ একদিন ভাইয়া পোষ্টিং হয় অন্য জায়গায়। ভাবী তখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাই ভাইয়া ঠিক করে ভাবীকে এখানে রেখে,সে একায় যাবে। হয় ও এমন। ভাবীকে জেঠিমা, আর কাকীর দায়িত্বে দিয়ে যায়। আমি তখন বাবার সাথে বাইরে থাকি সবসময়। কারণ বাবার নির্বাচন নিয়ে বেশ ঝামেলা চলছিল। বাড়িতে ভাবী আর বাকিরা। ভাইয়া চলে যাওয়ার পরই,ভাবীর উপর শুরু হয় অত্যাচার।তাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করানো,রান্নাবান্না, যা আছে সব কিছু। যেখানে ঐ মেয়ের কাজ অন্যদের করে দেওয়া উচিৎ ছিল।সেখানে তাকে দিয়ে এতসব করিয়েছে।ভাবী হাসিমুখে সব মেনে নেয়।কারণ এটা তো তারই বাড়ি এই ভেবে।এমনই একদিন ভাবী যায় বাবার কিছু কাপড়চোপড় ধোঁয়ার জন্য বাথরুমে। আর সেখানেই সাবানের মধ্যে পিচ্ছিল খেয়ে পরে যায়।সাথে, সাথে ব্লিডিং শুরু হয়।ভাবী অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু ওরা সবাই তখন টিভি দেখায় ব্যস্ত।তাই কেউ শুনতে পাইনি।এমন সময় আমি এলাম বাড়িতে। বাবার কিছু কাগজ-পত্রের জন্য। রুমে ঢুকেই দেখি ভাবীর এই অবস্থা। সাথে, সাথে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়।কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।বাচ্চা টা মা রা যায়। ভাবী অবস্থা যে তখন কেমন ছিল।তা আমি নিজের চোখে দেখেছি।বেচারীর বুক ভরা হাহাকার।
ভাইয়া এসে এসব শুনে আলাদা হতে চাই। কিন্তু বাবা রাজি না।তার এক কথা” জীবন গেলে ও আলাদা হতে পারবে না”সেদিন বাবার সাথে অভিমান করে, ভাবীকে নিয়ে দেশ ছাড়ে ভাইয়া। সেই যে গেল, আর আসেনি।বাবাও ফোন দেয় না।আমার সাথে কথা হয় মাঝে মাঝে। একটা মেয়ে হয়েছে। তিন বছর বয়স।কি যে পাকা হয়েছে।
চলবে,,,
।