আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব-১০

0
132

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#দশম_পর্ব

-‘এই আবার কেমন জাতের ছেলে, বাবা মায়ের ডিভোর্স করাতে উঠে পড়ে লেগেছে?’

উক্ত কথাটি মনে মনে বললেও কুহুর মুখের এক্সপ্রিয়েশনটা ছিল হতবাক করার মতোই। যেন মুভির কোনো দৃশ্য লাইভ টেলিকাস দেখছে। রিদওয়ান হিরো। আর প্রিন্সিপাল স্যার অসহায় একজন বাবা। বাবা ছেলেকে নিজের অবলম্বনটুকু দিবে না আর বেয়াদব ছেলে জোর করে নিবে৷ নিয়েও ক্ষান্ত হবে না আরো জোর জুলুম করবে। গায়ে হাত তুলবে না তবে কথা দিয়ে পিষ্ট করবে৷ খোঁচা মারবে৷ এ মুহূর্তে রিদওয়ানের
ভিলেনমার্কা ভাবভঙ্গি দেখে তেমন মনে হচ্ছে। তাছাড়া কেউ কারো বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলে? বললে কিভাবে বলে?কোন যুক্তিতে বলে? যার জন্য তার জন্ম সেই মানুষটা হচ্ছে বাবা। বাবারা মানুষ। তারা ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। রাগ তাদেরও
আছে। কষ্ট আছে। মান অভিমানও আছে। একথাও স্মরণে রাখতে হবে। এছাড়া কার সংসারে বা ঝগড়া হয় না? সবারই হয়। তার নিজের বাবা মায়েরও ঝগড়া হয়। কথা বলাও বন্ধ করে দেয়, নাওয়া-খাওয়াও অফ, আবার সেটা মিটেও যায়।
মিটে গেলে দু’জনে বসে সমস্যার সমাধানও করে। এটাই তো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। হয়তো উনাদের ব্যাপারটা জটিল। নানান জটিলতার কারণে কেউ কারো মান ভাঙায় নি। আর দু’জন দু’দেশে থাকায় সম্ভব হয় নি। আবার এমনও হতে পারে কেউ একজন যোগাযোগ করতে চেয়েছিল তবে আরেকজন সেই সুযোগটুকু দেয় নি। এভাবে দুরত্ব আরো বেড়ে গেছে। কিন্তু সর্বশেষ চেষ্টাটুকু তাদেরকে মুখোমুখি বসিয়েই করা উচিত।
এদিকে ছেলের রণমুর্তি মুখ দেখে আতিকুর রহমান ঘাবড়ে গেছে। কুলকুল করে ঘামছেন। কুহু সেটা ভালোভাবে লক্ষ্য করে উঠে দাঁড়াল। আশেপাশে তাকিয়ে পাশে রান্নাঘর দেখে একগ্লাস পানি এনে দিলো আতিকুর রহমানের হাতে। সত্যিই উনার গলা শুকিয়ে আসছিল। বুকটা খুব ধড়ফড় করছিল। উনি গ্লাস নিয়ে গলায় পানি ঢেলে নিলেন। বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন। তখন টুটুল ট্রেভর্তি নাস্তা এনে রাখল তাদের সামনে থাকা সেন্টার টেবিলে। রিদওয়ান বিরক্ত মুখে টুটুলের দিকে তাকালেও নাস্তা ছুঁয়ে দেখল না। তাকে কিছু খেতে না দেখে আতিকুর রহমান খেতে বললেও শুনল না৷ অনড় হয়ে বসে রইল। আর কুহু এটা বুঝল না সে খাবে কি না। খাওয়া ঠিক হবে কি না৷ কারণ বাবা ও ছেলের মধ্যে নীরব যুদ্ধ চলছে।
যুদ্ধের অবস্থা বেগতিক হচ্ছে। দু’জনেই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কখন ফেটে পড়ে বলা মুশকিল। কুহু ওর এই বোঝা না বোঝার চিপাগলিতে আঁটকে চুপ করে বসে রইল। ক্ষ্যাপাটে রিদওয়ানকে দেখে তার ভয় লাগছে৷ তাই এদের মধ্যে কথা বলার সাহস করছে না। বলার উচিতও হবে না। আবার চলে যেতেও পারছে না। তখন আতিকুর রহমান আগে বললেন,
-‘ তোমার মাকে কল দাও। কথা বলি।’
রিদওয়ান হাসল। ক্ষ্যাপাটে হাসি। তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বাবার চোখে চোখ রেখে পাল্টা জবাব দিলো,
-‘এতদিন বলার সময় হয় নি। তবে আজ কেন?’
-‘ ‘কেন’ এর উত্তর সব সময় শ্রুতিমধুর হয় না তাই। এখন দিতে বলছি দাও।’
-‘ প্রয়োজনটা আপনার, আমার নয়। যার প্রয়োজন তারই কল দেওয়া উচিত নয় কি?’
-‘আমার কল ধরবে না।’
-‘এর দায় ভার আমার নয় নিশ্চয়ই। আর কল ধরার মতো সৎকর্ম করেও রাখেন নি। যা করেছেন প্রাপ্য হিসেবে সেসব পাচ্ছেন।’
-‘আমি খারাপ। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ পুরুষ। খারাপ স্বামী। এই অভিযোগ মাথা পেতে নিলাম। তার কি উচিত ছিল একটাবার যোগাযোগ করার সুযোগ দেওয়ার? সে কি দিয়েছে? সব সময় আমাকেই কেন তার পেছনে ছুটতে হবে, তার কথায় রাখতে হবে? আমি কি মানুষ না? আমার রাগ থাকতে পারে না?’
আজ রিদওয়ানও যেন হারতে আসে নি। তার ভঙ্গিমায় সেটা স্পষ্ট। কেমন বুনো ষাঁড়ের মতো ফুঁসছে সে। বাবার বলা কথা শুনে তার রাগটা তরতর করে বেড়ে গেল। সে জবাব দিলো,
-‘পারে অবশ্যই পারে। পারে বলেই বউ পিটিয়ে মধ্যরাতে বাসা থেকে বের করে দিতে পেরেছিলেন। সুপুরুষের মতোই কাজ করেছিলেন। এজন্য পুরুষ হিসেবে আপনি ধন্য।’

একথা শুনে আতিকুর রহমান কথার খৈই হারিয়ে ফেললেন।
অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। কুহুর ভীষণ
মায়া লাগছে মানুষটাকে দেখে। সাপোর্টার হিসেবেও পাশে কেউ নেই। তখন রিদওয়ান খামটা খুলে ডিভোর্স পেপারটা এগিয়ে দিলো। এরপর তাচ্ছিল্যভরা সুরে পুনরায় কথার বাণ ছুঁড়ে দিলো,
-‘সাইন করুন। অনন্তকাল বসে থাকতে আসি নি আমি।
আগামী সপ্তাহেই দেশ ছেড়ে যাচ্ছি। দেশের আর কখনোই ফেরা হবে না। আর না আম্মু আর রিমিকে আসতে দেবো।
এতদিনের অবহেলায় বয়ে বেড়ানো সম্পর্ক থেকে আমাদের মুক্তি দিন, নিজেও মুক্তির স্বাদ গ্রহন করুন। তাছাড়া আপনি
আম্মুর সঙ্গে কি বলবেন, এটা আপনার একান্তই, ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাকে যেই কাজটা করতে পাঠানো হয়েছে আমি ঠিক সেটাই করতে এসেছি। নয়তো আপনার বাড়িতে পা রাখার ইচ্ছে ছিল না আমার। আদৌও জানি না আম্মু পরে সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করবে কি না!
তবে আমরা দুই ভাইবোন আর আপনাকে বাবা হিসেবে চাই না। আপনি বাবার হওয়ার যোগ্যও না। তবে আপনার বাবা মায়ের আর্দশ সন্তান আপনি। যে কারণে অকারণে বউকে প অবিশ্বাস করতে পারে। হাতে হাত তুলতে পারে। একটা কথা না বললেই নয়, শিক্ষা আপনার বাহ্যিক লেবাসটুকুই চেঞ্জ করেছে, মানসিকতা চেঞ্জ করতে পারি নি। যদি পারত তবে আপনার এই বড় বাড়িতে আজ শূন্যতা বিরাজ করতো না। স্ত্রী সন্তান থাকতেও নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতেন না।’

রাগে উগড়ানো রিদওয়ানের বলা কঠিন কঠিন কথাগুলো শুনে আতিকুর রহমান শুধু তাকিয়ে রইলেন। মৃদু হাসলেন।
অনেকদিন পর ছেলেকে রাগতে দেখছেন। রাগে চোখ, মুখ, লালবর্ণ আকার ধারণ করেছে ছেলের। আজকে যেন বাবা ও ছেলের বুকচাপা কষ্টগুলো কথার মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু রিদওয়ানের কষ্ট কিসের? কিসের বা এত মান?
বাবাকে এতদিন কাছে না পাওয়ার কষ্ট, বোনকে বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে দেখার কষ্ট নাকি অন্যকিছু? উনি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। এতদিন বুকচাপা কষ্ট গুলো অভিমান হয়ে ছিল, আজকে ক্ষোধ রুপে উপস্থাপন করছে ছেলেটা। সেই ছোট্টো রিদ উনাকে রাগ দেখাচ্ছে। যাকে কথা বলা শিখিয়ে, আঙুলে আঙুল ধরে হাঁতে শিখিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে, বুকে ঘুম পাড়িয়েছে কত রাত। সেই ছেলে এতদিনের পুষে রাখা রাগটা কথা দিয়ে বুকটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। উনি ছেলের রাগ মাত্রা কমাতে একটাও জবাব দিলেন না। বলা বাহুল্য, ইচ্ছে করে দিলেন না। সব কথা যেন হারিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে৷ ঘড়িতে সময় দেখে রিদওয়ান পুনরায় সাইন করতে তাগাদা দিলো। সাইনের মাধ্যমে সম্পর্ক ছিন্ন করার
কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। আতিকুল রহমান আবারও ঠান্ডা মেজাজে বললেন সাইন করবে না, তবুও রিদওয়ান শুনছেই না। তার একটাই কথা সাইন করতেই হবে। এবার মনে হচ্ছে, ছেলের মায়ের থেকে ডিভোর্স করাতে ছেলেরই তাড়া বেশি।
ডিভোর্স! ডিভোর্স! যে করছে ডিভোর্স দিবো বললেই দিতে হবে? স্বামী স্ত্রীর মাঝে মান অভিমান হতে পারে না? ডিভোর্স দিলে এতদিনে দিতে পারতেন না? বিয়ে করে নতুন সংসার করতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন। তবে কেন করেন নি এটা তো বুঝতে হবে। ছেলে বড় হয়েছে। বুঝতেও শিখেছে। মন আছে। মনেও হয়তো কারো জন্য ভালোবাসাও আছে। টানও আছে৷ সে কি আদৌও কিছু বোঝে না? নাকি বুঝতে চাইছে না? এখন কি ছেলেকে মুখ ফুটে বলতে হবে, ‘তোমার মাকে আমি ভালোবাসি। ঠিক আগের মতোই ভালোবাসি। সে আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। তাকে ছাড়া দীর্ঘদিন একা থাকলেও একেবারে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারি না। কোনো অবস্থাতেই তাকে ডিভোর্স দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
আতিকুর রহমান এতক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেও এবার রাগে উনার শরীর জ্বলে উঠল। ছেলের গালে সপাৎ করে একটা থাপ্পড় বসাতে ইচ্ছে করল। মেরেও দিতেন যদি কুহু মেয়েটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে না থাকত। উনিও এবার তেজি সুরে মুখ খুললেন,
-‘ডিভোর্সের তাড়া তোমার নাকি মায়ের?’
-‘দু’জনেরই। আম্মু চাচ্ছে আমি সংসারী হই। আর আমি চাচ্ছি আমার বিয়ের আগে এই ভিভোর্সের খেলা বন্ধ হোক। আম্মুর একটা গতি হোক। তাহলে আমার বিবাহিত জীবনে আমিও নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। ‘
-‘তোমার আম্মুর গতি মানে কি দ্বিতীয় বিয়ে?’
-‘ঠিক ধরেছেন। ভুল কে ফুল ভেবে কত দিনই বা আঁটকে থাকা যায়। এবার সমাপ্তি পার্ট প্রয়োজন। কথায় কথা বাড়ে, আপনি সাইন করুন।’
-‘রিদওয়ান বড় হয়েছো মানে এই না শাসণ করতে পারব না৷ বাড়াবাড়ি করিও না। কোনো সাইন টাইন হবে না।’

রিদওয়ান এবার চট করে দাঁড়িয়ে গেল। সেন্টার টেবিলের উপরে থাকা নাস্তার ট্রে ছুঁড়ে মারল। ঝনঝন শব্দ ভেঙে গেল চিনা মাটির কফির মগ। কাঁচের গ্লাস। তাতেও ক্ষান্ত হলো না চেয়ারে লাথি মেরে হনহন করে বেরিয়ে গেল। কুহু একবার আতিকুর রহমানের দিকে তাকিয়ে আরেকবার রিদওয়ানের দিকে তাকাল। রিদওয়ান দরজা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। তাকে এভাবে যেতে দেখে কুহুও প্রাণপণে তার পিছনে ছুঁটল। আর আতিকুল রহমান করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ছেলের ব্যবহারে উনি স্তব্ধ। এটা রিদওয়ান? উনার একমাত্র ছেলে রিদওয়ান? এ কিভাবে সম্ভব? উনি সেভাবে বসে হাট করে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। শেষ আশাটুকু এবার নিভে গেল। এতদিন যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন তা এক নিমি ভেঙে যাবে কল্পনাও করেন নি। ছেলেটাও উনাকে
বুঝল না।
এভাবে ঘন্টা খানিক সময় চোখ বন্ধ করে একইভাবেই বসে রইলেন। শরীর খারাপ করছে৷ টুটুল এলো। কত কি বলল, উনি টু শব্দও করল না। শুধু বললেন একা থাকতে দিতে। এ কথা শুনে টুটুল কিছুক গাইগুই করে চলে গেল। তারপর কি ভেবে যেন উনি ডিভোর্স পেপারে চোখ বুলাতেই হঠাৎ চমকে উঠলেন। উনি চশমা মুছে আবারও দেখলেন। হ্যাঁ যা দেখছে সত্যি। এটা ডিভোর্স পেপার নয় রেজিস্ট্রি পেপার। রিদওয়ান দেশে ফেরার আগের সপ্তাহে নতুন করে উনাদের রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। সেখানে রিদওয়ানের মায়ের সাইন আছে। উনি পুরো পেপার উল্টে পাল্টে দেখতেই একটা চিরকুট পেলেন।
কাঁপা হাতে চিরকুটের ভাঁজ খুলতেই দেখতে পেলেন উনার
প্রিয় মানুষটার হাতের লেখা জ্বলজ্বল করছে,
-‘ছেলে এমন ডোজ দিয়েছে মান অভিমানের পালা ভেঙে, পুনরায় রেজিস্ট্রি পেপার সাইন করে আবারও নিজেকে তোমার নামে লিখে দিলাম। খুব শীঘ্রই দেশ ফিরছি।’

এইটুকু পড়ে কথার মানে বুঝতে সময়ও নিলে কিছুক্ষণ। তারপর চিরকুটটা বুকে জড়িয়ে আতিকুর রহমান ঝরঝর করে কেঁদে ফেলছেন। উনার কান্নার বেগ বাড়তেই থাকল।
এতদিন একা থেকে কষ্ট বুকে চেপে রেখেছিলের তবুও কাঁদে নি। একফোঁটা জল গড়াতে দেন নি। অথচ আজ এই খুশির মুহূর্তে চোখের অশ্রুই বাঁধ মানছে না। উনি উল্টে পাল্টে বেশ কয়েকবার রেজিষ্ট্রি পেপারটা দেখলেন। প্রিয়তমার সাইনের উপর চুমু দিলেন। কতদিন পর চিরকুট। ঝরঝর অক্ষরের
চিরচেনা সেই লেখা। । তখন দরজার বাইরে থেকে মাথা বের করে উঁকি মারল রিদওয়ান আর কুহু। এই দৃশ্য খানা দেখে
তাদের মুখেও ফুটল বিশ্বজয়ের হাসি। পরিশেষে পরিকল্পনা সাকসেস!

To be continue…………….!!