আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব-৩৯+৪০

0
11

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_ঊনচল্লিশ


চারিদিকে আনন্দ সমাগম। হইহই রব। চেনা অচেনা বহু মানুষদের ভিড়ে রিদওয়ানদের ড্রয়িংরুম গিজগিজ করছে। সেখানে অনুষ্ঠানের গেষ্টদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন নিলুফা ইয়াসমিন। তিনি নিজেও কিছু কিছু মানুষকে চিনে না আবার অনেককে চিনেন না। কখনো দেখেও নি। তাও
হাসিমুখে কথা বলে যাচ্ছেন।পাশে দাঁড়ানো আতিকুল রহমান উৎফুল্লের সঙ্গে উনাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। এতদিন পর উনাদের একসঙ্গে দেখে একটা চাপা গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেকে আড় চোখে দেখে যাচ্ছেন আভিজাত্যপূর্ণ পোশাকে আবৃত করা নিলুফা ইয়াসমিনের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে। এ বয়সেও তিনি যথেষ্ট স্মার্ট।উনার বাচনভঙ্গি
, হাঁটা চলা, হাসি, সব কিছু পাফেক্ট লেভেলের। যেটা সহজে সবার নজর কাড়ছে। আতিকুল রহমান হঠাৎ করেই খেয়াল করলেন রিদওয়ান, কুহু, রিমি, তিনজনের একজনও এখানে নেই। তারা এখনো নিচে’ই নামে নি।
উনি নিলুফা ইয়াসমিনকে ইশারায় সাইডে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,

-‘আচ্ছা ছেলে মেয়েরা কই? নামছে না কেন তারা? সবাই তাদের কথা জিজ্ঞাসা করছে। কোনো সমস্যা হলো নাকি, এত দেরি হওয়ার তো কথা না?’

-‘ উপরে গিয়ে দেখছি আমি।’

-‘কুহুর বাবা মাও তো এখনো এলো না।’

-‘দুপুরে ওভাবে চলে গেল কেন সেটাই তো বুঝলাম না। কুহু নিশ্চয়ই কিছু বলেছে।’

-‘বারণ করো নি?’

-‘করেছিলাম। শোনে নি।’

-‘আচ্ছা তুমি গিয়ে দেখো রিমির হলো নাকি? রাত বাড়ছে। ‘

-‘হুম।’

-‘আর শোনো?’

-‘হুম।’

-‘রিদওয়ান আমার কল ধরছে না রেগে আছে বোধহয়। তাকে বলো রাগ টাগ পরে দেখাতে। এখন যেন নিচে নামে। আমি বাবা। আমার মেয়ের জন্য যেটা মঙ্গলজনক আমি সেটাই করব।’

-‘রিদওয়ানের যুক্তিটাও কিন্তু মন্দ নয়। রিমি তার বোন। সেও নিশ্চয়ই বোনের খারাপ চাইবে না, তাই না?’

-‘তাই বলে, এভাবে?’

-‘সমস্যা কি তাতে?’

একথা বলে পা বাড়াতেই সব লাইট বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে অন্ধকার।
কথাবার্তা গুঞ্জন বেড়ে গেল। নিলুফা ইয়াসমিনও থমকে দাঁড়িয়ে গেল। লোডশেডিং কিংবা কোনো সমস্যা হলো নাকি দেখার জন্য আতিকুলও রাজুকে ডাকতে উদ্যত হয়েছেন। তখন হঠাৎ একটা নীল আলো জ্বলে উঠল সিঁড়ির কাছে। আলোটা এঁকে বেঁকে এদিক ওদিকে যাচ্ছে। তখন কেউ একজন সেখানে এসে দাঁড়াল। আবছা তবে মেয়েলি অবয়। মুখটা নিচু থাকায় কেউ দেখতে পারল না। তবে তার পরণে বিশাল ঘেরওয়ালা পার্টি গাউন। লম্বা খোলা চুলগুলো কার্ল স্টাইলে বাঁধা।মাথায় ক্রাউন। সে ধীরে ধীরে নামতে নামতে উজ্জ্বল আলোয় তার মুখ স্পষ্ট হলো। অচেনা মেয়েটিকে কেউ চিনে না অথচ সবার মুগ্ধ দৃষ্টি তার দিকেই। অনেকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল পুতুল মুখের মেয়েটির দিকে। তখন বার্থডে টোন বেজে উঠল। সে যে বার্থডে গার্ল স্পষ্টও হলো। সবাই করোতালি দিলো।
মুখোরিত হলো চারিপাশ। মায়ের ইশারায় রিমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। চারিদিকে আলোয় আলোয় ভরে গেল। ভীষণণ সুন্দর দেখাচ্ছে
তাকে। স্বল্প সাজে যেন জীবন্ত পুতুল একটা। আতিকুল রহমান মুখভর্তি হেসে এগিয়ে গেলেন। মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বেশ গর্ব করে সবাইকে জানালেন এটাই উনার একমাত্র মেয়ে; রিমি। রিমিকে বেশির ভাগ মানুষ দেখে নি চিনে না। তাই সবার দৃষ্টি এখন তার দিকেই। এত এত মানুষের দৃষ্টি তার দিকে থাকার পরেও রিমির মধ্যে নার্ভাসনেস কাজ করছে না।
আনইজি ফিল করছে না। হাত-পা ঘামা তো দূর তার কোনো ফিলিংসই কাজ করছে না। তবে তার চোখ দুটো বড়ই চঞ্চল। কাউকে খুঁজছে সে।
কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটি তার আশে পাশে নেই দেখে সে দীর্ঘশ্বাস চেপে স্মার্টলি হেঁটে এসে বাবা মায়ের পাশে দাঁড়াল। মুখে আঁটল মিষ্টি হাসি।
নিলুফা ইয়াসমিন মেয়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দু’একবার পরখ করে নিলেন। সব ঠিক আছে দেখে পুনরায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সিঁড়ির দিকে। আর দুজন কই? তারা আসছে না কেন? রুমে তৈরি হতে গিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে বসে আছে নাকি কে জানে! ছেলেটাও আজকাল
ছোটোদের মতো ঝগড়া করে কুহুর সঙ্গে। মেয়েটার পেছনে কোনো না কারণে লেগেই থাকে। এদিকে রিমির সঙ্গে কথা বলতে অনেকে এগিয়ে এসেছে। কিছু না কিছু জিজ্ঞাসা করছে। রিমি সুন্দর করে জবাব দিচ্ছে।
উনি মনে মনে বিরক্ত হয়ে সময়ও দেখে নিলেন। রাত বাজে এগারোটা।
আর দেরি করা ঠিক হবে না ভেবে উনি রিদওয়ানকে ডাকতে যাওয়ার আগে আরেকবার সিঁড়ির দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে উনার চোখ মুখে একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেল। রিদওয়ান আর কুহু একসাথে নামছে। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে দু’টোকে। রিদওয়ানের পরণে ব্ল্যাক শুট আর কুহুর পরণে ব্ল্যাক শাড়ি। কুহুর শাড়িটা খুব বেশি জমকালো না। বলা বাহুল্য, পার্টির জন্য একেবারে পারফেক্ট। চুলটাও বেঁধেছে চমৎকারভাবে। স্বল্প সাজ। তাদেরকে নামতে দেখে এবার সবার দৃষ্টি রিমির থেকে সরে গিয়ে বিঁধল সিঁড়ির দিকে। তাতে গুঞ্জন বেড়ে গেল। তারাও ধীরে ধীরে নেমে বাবা মায়ের পাশে পাশে দাঁড়াল। পাঁচজনের সুখী পরিবার। আতিকুর রহমান এবারও সবার সঙ্গে,পরিচয় করিয়ে দিলেন পুত্র এবং পুত্রবধূর সঙ্গে। পরিচয় পর্ব সেরে শেষ হলো কেক কাটার আয়োজন করা হচ্ছে। রিদওয়ান আশেপাশে কিছু বন্ধুদের দেখে পা বাড়ালো সেইদিকে। সর্তক দৃষ্টিতে খেয়াল করল সবাই থাকলেও এখানে রুপক নেই। রুপক আসে নি। সারাদিন তার কল রিসিভ করে নি। রাগে তার হাত নিশপিশ করতে লাগল। কড়া কিছু বলার জন্য ফোন বের করার আগেই সেখানে রুপক হাজির হলো। রিদওয়ান তাকে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকাতেই রুপক গালভর্তি হেসে বলল,

-‘ জ্যামে পড়েছিলাম ভাই তাই একটু দেরি হলো। কুহু কই? সব ঠিকঠাক তো?’

-‘আঙ্কেল আন্টি কই?’

-‘ওই যে আসছে।’

-‘সারাদিন ফোন ধরিস নি কেন?’

-‘ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। একঘুমে দিন পার করেছি।’

-‘ওহ।’

-‘ আচ্ছা দাঁড়া বার্থডে গার্লের সঙ্গে একটু কথা বলে গিফ্ট দিয়ে আসি।’

-‘না।’

-‘কি না?’

-‘রিমির সঙ্গে কথা বলবি না?’

-‘ কেন?’

-‘আমি বারণ করছি তাই।’

-‘বারণ করবি কেন? বারণই যদি করবি তাহলে এখানে আসতে বলার মানে কি?’

-‘সব ‘মানের’ মানে জানতে হবে এমন কোনো কথা নেই।’

-‘কি হয়েছে বলবি তো নাকি? রেগে আছিস কেন?’

-‘নিজেকে একটু বেশিই চালাক ভাবিস, তাই না?’

-‘মানে?’

-‘মানেটা তো আমার থেকে তুই ভালো জানিস।’

-‘আরে ভাই কি হয়েছে? কি করেছি আমি?’

-‘তুই নিজে নাহয় ভাব।’

হঠাৎ রিদওয়ানের এমন আচরণে রুপক অবাকই হলো। তার চোখ মুখে একপ্রকার বিষ্ময় খেলে গেল। হঠাৎ একথা কেন? রিদওয়ান তো এভাবে কথা বলে না। সে আড়চোখে একবার দেখে নিলো প্রিয় বন্ধুকে। অজানা একটা ভয় কাজ করছে তার মনে। রিমি কি কিছু বলেছে রিদওয়ানকে?
কি বলেছে? কতটুকু বলেছে? সে এ ব্যাপারে কথা বাড়াতে চাইল না তাই কুহুকে দেখে ডেকে উঠল। কুহু ভাইকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বোনের কাজে রুপক হতবাক।সে একবার রিদওয়ানের দিকে তো একবার কুহুুর যাওয়ার দিকে তাকাল। তখন গেস্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কেক কাটার পর্বও শুরু হলো। রিমি বাবা_মায়ের হাত ধরে বিশাল বড় কেক কেটে সবাইকে খাওয়াল। বাদ গেল না রিদওয়ানের বাম পাশে দাঁড়ানো রুপকও। বেচারা অভদ্রতার খাতিরে কেকটুকু মুখে নিয়ে আর গিলতে পারছি না। বুকের ভেতর যন্ত্রণাদায়ক একটা কাটা খচখচ করে
তাকে রক্তাক্ত করছিল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ওদিকে কেক কাটার পর্ব শেষ করতেই রিদওয়ান এবার এগিয়ে গেল। মাইক্রোফোন হাতে নিলো কিছু বলার উদ্দেশ্যে। সে বোনকে নিয়ে কিছু কথা বলে বলল,

-‘প্রতিবার তোমার জন্মদিনে তোমার জন্য দু’টো করে গিফট রেডি রাখি আমি। এবারও আছে। গতবারের জন্মদিনে তোমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘বার্থডে গিফ্ট হিসেবে আমার থেকে কি চাও? র্নিদ্বিধায় সেটা বলতে পারো।’ তুমি আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে মন খারাপের সুরে বলেছিল, ‘ একটা পরিবার। এক টুকরো সুখ। সময় অসময়ে আবদার পূরণ করা কিছুু মানুষ।’ আমি বুঝেছিলাম তোমার চাওয়াকে। তাই কিছু দিন সময় চেয়েছিলাম। আজ তোমার সেই চাওয়া পূরণ করেছি। একটু দেরি হলেও অপরিপূর্ণ রাখি নি। বছর ঘুরে আজও তোমার জন্ম দিন।
একইভাবে আজও জিজ্ঞাসা করছি, ‘বলো কি চাও? যেটাই চাইবে ভাই হিসেবে এনে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।’

রিদওয়ানের কথা শুনে রিমি ছলছল করে তাকিয়ে আছে। বাবাকে সে ছোটো থেকেই কাছে পায় নি। কিন্তু আবদার পূরণের মানুষটা ছিল তার ভাইয়াই। যখন যেটা চেয়েছে এনে দিয়েছে। এতদিন যা চেয়েছিল আজ
সেসব চাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। সে বড় হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। তাই এখন আর পুতুল, ফোন, হাজিবাজি প্রতি আগ্রহ নেই। সে ভাইয়ার দিকে
একবার তাকাল। মুখভর্তি হাসল। এরপর ছলছল চোখ নিয়েই হাসিমুখে বলল,

-‘আমি এখন বড় হয়েছি ভাইয়া। এখন আর পুতুল, সাইকেল, কিংবা রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার আবদার করব না। সুযোগ দিচ্ছো ভেবে দাও কারণ এবার আমি ছোটো মোটো কিছু চাইব না। এখন বড় হয়েছি তাই আবদারও বড় সড় কিছুই হবে।’

-‘হোক।’

-‘তাহলে আমাকে একটা বিশ্বস্ত হাত খুঁজে দাও। বাবা কিংবা তোমার পরে যে আমাকে ভালো রাখবে। যার কাছে আমি নিরাপদে থাকব।’

উপস্থিতি সকলে বিষ্মিত। এমন দৃশ্য তারা কেউ কখনো দেখে নি।কোনো ভাই এভাবে কোনো বোনের চাওয়া পূরণ করে? বোনও এভাবে ভাইকে তার মনের কথা জানাতে পারে, আশ্চর্য! তাও এমন অদ্ভুত চাওয়া। তবে বোনের আবদার শুনে রিদওয়ান মুচকি হাসল। হাসতে হাসতেই সরাসরি তাকাল অদূরে দাঁড়ানো রুপকের দিকে। রুপক হতভম্ব। মজার ব্যাপার হলো রিদওয়ানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবার দৃষ্টি এখন রুপকের দিকে।
সেকেন্ডের মধ্যেই স্পষ্ট হলো অনেককিছুই। রিদওয়ান রুুপককে ডাকল।
রুপক দ্রুত হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল বন্ধুর দিকে।
রিদওয়ান এবার রুপককে বলল,

-‘আমার বোন চেয়েছে বিশ্বস্ত হাত। বিশ্বস্ত হাত খুুঁজতে গিয়ে তোকে ছাড়া আর কাউকেই আমার নজরে পড়ল না। আমার বোনের বিশ্বস্ত কেউ হবি? সরাসরিই বলছি, আমি তোকে আমার বোনের দায়িত্ব দিতে রাজি। নিবি আমার বোনের দায়িত্ব?’

-‘হুম।’

এবার ইসমত আরা এগিয়ে এলেন। ছেলের হাতে একটি রিং ধরিয়ে দিয়ে ইশারা করলেন রিমিকে পরিয়ে দিতে।

To be continue…!!

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_চল্লিশ


আকষ্মিক এ ঘটনায় রুপক স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল তার বোধগম্য হচ্ছে না। মস্তিষ্কে চক্কর দিচ্ছে বেশ কিছু প্রশ্ন। রিদওয়ান এসব জানল কিভাবে? কে বলল? কুহু নিজেই এসব জানত না, জানার কথাও না, তাহলে কীভাবে কি? নাকি রিমি আগ বাড়িয়ে কিছু বলেছে? বললে কি বলেছে? রিদওয়ান কি তাকে ভুল বুঝেছে? ভুল না বুঝলে তখন ওভাবে কথা বলল কেন? আর হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানে কি? সে মুখ কাচুমাচু করে রিমির দিকে তাকাল। মেয়েটা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। আশপাশ মেহমানভর্তি। সবার উৎসুক দৃষ্টি তার উপর। নিলুফা ইয়াসমিন এবং আতিকুল রহমান অপেক্ষা করছে তার জবাবের। এগুলো মানুষ মাঝে সে কি বলবে? কি করবে ভেবে পেলো না। অস্বস্ত্বিতে ডুবে গেল। ইসমত আরা বেগম ছেলের হাতে রিং ধরিয়ে দিয়ে হাসলেন। আন্দাজ করে নিলেন ছেলের মনের কথা। মায়ের কান্ডে সে আরেকদফা অবাক হলো তার মাও জানে? জানে বলেই কি এভাবে রিং নিয়ে একেবারে হাজির হয়েছে? আসার সময় রিংটা কিনেছে। সে নিজে পছন্দ করেছে ভেবেছে বার্থডে গিফ্ট হিসেবে দিবে কিন্তু তার মাও আরেকধাপ উপরে..! ছেলেকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে কুহু বিরক্ত হয়ে ফিসফিস করে বলল,

-‘কি হলো, তাড়াতাড়ি পরাও? কেক খাব আমি। ভদ্রতার খাতিরে একা গিয়ে খেতেও পারছি না।’

কুহুর কথা শুনে রিদওয়ান আড়চোখে তার দিকে তাকাল। বেশ লাগছে কুহুকে। তবে সে মুখ ফুটে প্রশংসাও করবে না। এই মেয়েটা বড্ড পাজি হয়েছে। আজকাল কথায় কথায় প্যাঁচ মারে। কিছুক্ষণ আগে রেডি হয়ে বের হওয়ার সম্ভব তাকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখে বলেছিল,

-‘চমৎকার লাগছে আমার পুতুল বউটাকে।’

-‘লাগবেই তো ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে না?’

-‘মানে?’

-‘মানে কিছু না।’

-‘এই, এই দাঁড়াও! কি বললে তুমি? ‘রাত বাড়ছে’ এক কথা দিয়ে কি মিন করলে?’

-‘সেটা বুঝেছেন সেটাই মিন করেছি।’

-‘কুহু!’

-‘রিদওয়ান!’

-‘তুমি আমার নাম ধরে ধমকাচ্ছো? এত্ত বড় সাহস? আমি তোমার বড়। সন্মান দিয়ে কথা বলবে বেয়াদব। ভুলে যেও না তোমার স্যার’ও ছিলাম।’

-‘তো?’

-‘তো আবার কি? কি আশ্চর্য, দেশের মাটিতে পা রাখতে না রাখতেই প্রেম হারিয়ে গেল? বেয়াদবি শুরু হয়ে গেল?’

-‘কি আশ্চর্য, দেশে মাটিতে পা রাখতে না রাখতেই খ্যাচ খ্যাাচানি শুরু হয়ে গেল আপনার? খ্যাচ খ্যাচ করে দেশে ছেড়েছিলেন আবার ফিরে এসে ওই খ্যাচ খ্যাচানি শুরু হয়ে গেল?’

-‘খ্যাচ খ্যাচ কখন করলাম! মিথ্যাবাদী কোথাকার। গতকাল রাতে ফিরে আদর করে বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ালাম। ঘুম ভেঙে যাবে বলে সারারাত পাশও ফিরি নি। এক কাতেই রাত কাবাড় করেছি।
সকালে উঠলামও দেরি করে। এরপর সারাদিন বিজিই ছিলাম কাছেই ঘেঁষতে পারি নি। তাহলে খ্যাচ খ্যাচ কখন করলাম, বুঝাও আমারে?’

-‘কাউকে বুঝানোর দায় পড়ে নি আমার। সরুন সামনে খেকে।’

-‘ জবাব না দিয়ে কোথাও যাবে না তুমি। কোমরের এপাশে পিন লাগাও।
কোমর দেখা যাচ্ছে কেন?’

-‘পারব না লাগাতে। দেখা যাক। প্রয়োজনে সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাব এই দেখুন আমার কোমর। সাদা ফকফকা কোমর।’

-‘মাইর দিবো। দেখি, এদিকে এসো।’

-‘না।’

-‘ আরে বাবা এত রাগের কারণ কি বলবে তো নাকি? না বললে বুঝবো কিভাবে? যার উপরে রাগ করেছো সে রাগের কারনই জানে না। তাহলে কিভাবে হবে? রাগ করলে ভালো করে রাগ করা উচিত যাতে পাশের মানুষটা বুঝতে পারে। রাগ ভাঙানোর প্রয়োজন মনে করে। মনের মধ্যে রাগ নিয়ে বসে থাকলে হবে?’

-‘রাগের কারণ মুখে বলতে হবে কেন? আপনি চোখে দেখেন না? নাকি চোখে ঠুসি পরে থাকেন?’

-‘ঠুসি কি?’

-‘আমার মাথা।’

-‘ওহ।’

রিদওয়ান এবার ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে একটা পিন নিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর কুহুর শাড়িতে লাগিয়ে দিয়ে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে দেখে নিলো। এরপর একটা টিস্যু নিয়ে কুহুর ঠোঁটের পাশে জড়িয়ে যাওয়া লিপস্টিক মুছে দিলো। এবার সব ঠিকঠাক দেখে গলায় স্বর নরম করে বলল,

-‘বউদের এত রাগ বাগ করতে নেই। বউয়ের রাগী চোখ স্বামীদের হার্ট এ্যার্টাকের অন্যতম কারণ।’

-‘দুপুরবেলা একটু জড়িয়ে ধরার আবদার করায় ঝাড়ি মারলেন কেন?
বিকেলে চা করে দিলাম না খেয়ে হনহন করে চলে গেলেন কেন? সন্ধ্যায় বেলি ফুলের মালা আনতে বললাম ভুলে গিলে খেলেন। এরপর বললাম শাড়ি চুজ করে দিতে দিলেনই না বরং নিজের ড্রেসটাও আমাকে দিয়ে চুজ করালেন। সারাদিনে কি ব্যবহার করলেন মনে করুন। এখন আবার সুর তুলেছেন ‘চমৎকার লাগছে আমার পুতুলবউটাকে’ ঢং!’

-‘ দুপুরে ভীষণ রেগে ছিলাম তো তাই না? বাবার সঙ্গে একচোট ঝগড়া হওয়াতে মেজাজ খু্ব খারাপ ছিল। এজন্য ঝাড়ি দিয়ে ফেলেছি।এখন ‘সরি’ বলছি। তখন আমার আর্জেন্ট কাজ ছিল চা বানাতে দেরি হচ্ছিল দেখেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। বেলি ফুলের মালার কথা সত্যি সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের এত সব কাজ বাজ আমাকে সব দেখতে হচ্ছে। সবদিকে এত খেয়াল থাকে? তারপরও যখন মালার কথা স্মরণ হলো গিয়ে গোলাপের গাজরা এনে দিলাম তো। বেশি ফুলের মালা খুঁজে পাই নি। অন্যদিন এনে দেবো?’

-‘লাগবে না। এতকিছু শুনতেও চাই নি কারো থেকে। ভাইয়া এলেই আজ ওই বাসায় চলে যাব। যে শুধু শুধু খ্যাচ খ্যাচ করে তার কাছে থাকব না।
পুরনো হয়েছি গেছি তাই না? এখন তো আর ভালো লাগবে না।’

-‘এসব আবার কি কেমন কথা? ভালোবাসি তো। ভালোবাসা পুরনো হয় নাকি?’

-‘জানি না।’

-‘জানো তো রেগে যাচ্ছো কেন শুধু শুধু?’

-‘খবরদার বলছি সাধু সাজবেন না। সারাদিন খ্যাচ খ্যাচ করে রাতের বেলা মিষ্টি মধুর সুর তুলেছেন। ভেবেছেন কিছু বুঝি না আমি? আজকে একা ঘুমাবেন আপনি। থাকব না আমি। সত্যি সত্যি চলে যাব।’

একথা বলে কুহু বেরিয়ে এসেছে। তাকে কিছু বলার সুযোগটুকু দেয় নি।
বউকে যেতে দেখেও সেও সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। এরপর মুখে হাসি এঁটে দু’জন একসঙ্গে নেমেছে। কিন্তু নিচের পরও কুহু তার কাছ ঘেষছে না। দূরে দূরে থাকছে। যদিও এটা কোনো সমস্যা না তার কাছে। কারণ কুহু মুখে যতই বলুক তাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। ঝগড়া করবে, দূরে দূরে থাকবে কিন্তু চোখের আড়াল করবে না। কুহুর কথা ছেড়ে সে এবার রুপকের দিকে তাকাল।রুপককে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে তার বিরক্তের মাত্রা বাড়ল। ইচ্ছে করল, নাক বরাবর ঘুষি মেরে আক্কেল আনতে। এরা দুই ভাই বোন গবেট প্রজাতির। নিজেদের অনুভূতির কথা তো জানাবেও না। উল্টে তাদের অনুভূতিকে সন্মান করে এগিয়ে এলেও তারা বিকারশূন্য। রিদওয়ান আর অপেক্ষা করতে পারল না। সে এবার ফিসফিস করে বলল,

-‘রিং পরাবি নাকি এখানকার কাউকে খুঁজে নিবো? আমার বোনের জন্য ছেলের অভাব হবে না।’

-‘রিদ তুই ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তো?’

-‘যেখানে আমার বোনের জীবন জড়িয়ে আছে সেখানে না ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বোকা আমি নই নিশ্চয়ই!’

-‘ঠিক আছে আমিও তবে খুশি মনে গ্রহণ করলাম।’

একথা বলে রুপক ইসমত আরা বেগমের থেকে রিং নিয়ে রিমির হাতে পরিয়ে দিলো। করতালিমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হলো। এরপর খাওয়ার পর্ব শুরু হলো। হলো অরো অনেক মজা। রিমি, রুপক, মনের অভিমান সব ঝেড়ে ফেলে আনন্দে সামিল হলো। রিদওয়ান আর কুহু তাদেরকে কথা
বলার সুযোগ করে দিয়ে সরে এলো। ধীরে ধীরে গেস্টরাও চলে যাচ্ছে।
নিলুফা ইয়াসমিন তাদের বিদায় জানাচ্ছেন। রিদওয়ান বাগানের দিকে যাচ্ছে দেখে কুহুও তার পেছন পেছন এলো। বসল বাগানের দোলনায়।
আকাশে চাঁদ উঠেছে। চারপাশের ফুলের সৌরভ। পাশে সহধর্মিণী। খুব সুন্দর একটি মুহূর্ত। হঠাৎ রিদওয়ানের মনে হলো কুহু রাতের মেডিসিন
খায় নি এখনো। আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেল। সে তড়াক করে উঠে হাঁটা ধরল। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে গ্লাসভর্তি পানি এনে কুহুর হাতে
মেডিসিন ধরিয়ে দিলো। কুহু খেলো বরং না মুখ গোমরা করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তা দেখে রিদওয়ান তার হাত থেকে মেডিসিন নিয়ে গাল চেপে ধরে মুখে পুরে দিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। অগত্যা মেডিসিন গিলে নিলো। তার মনের অভিমান দূর হয়ে গেল। যে মানুষটা তার এত খেয়াল রাখে, ভালোবাসে, তার প্রতি অভিমান করে থাকা যায়? না তো। সে অভিমানও করে নি তবে অভিমানের ভাণ ধরেছে। শখের পুরুষটাকে
পেছন পেছন ঘুরানোর ধান্দা আর কি। তখন হঠাৎ তার মনে একটা প্রশ্ন জাগল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘এত সহজে মেনে নিলেন কেন তাদের? রিলেশনের কথা শুনে রাগ বাগ করা উচিত ছিল আপনার।’

-‘কার উপরে রাগ করতাম?’

-‘ভাইয়া আর রিমি আপুর উপরে?’

-‘তারা আমার কে?’

-‘একজন বোন আর আরেকজন বন্ধু।’

-‘তারা দু’জনেই আমার আপনজন। তারা কষ্ট পেলে আমিও পেতাম। ‘

-‘ কথাটা যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে না। আপনজন বলেই কি সাতখুন মাফ? আপনি কি কিছু লুকাচ্ছেন? ‘

-‘তেমন কিছু না। রুপককে আমি ছোটো থেকে চিনি। ছেলে, ভাই কিংবা বন্ধু হিসেবে সে দায়িত্ববান একজন মানুষ। নেশাভান করে না। খারাপ কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত নেই। দেখতে শুনতে ভালো। ভালো স্যালারির জব করে। ছিমছাম পরিবার। আর কি চাই? পাত্র হিসেবে সব দিক দিয়ে পারফেক্ট। মোদ্দাকথা, রিমি রুপককে ভালোবাসে। বোন ভালো একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। তাকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়। ভাই হিসেবে আমার দায়িত্ব নয় কি তাদের চার হাত এক করে দেওয়া? বন্ধু বলেই তো তাকে ভালো করে চিনি, জানি, এজন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুব তাড়াতাড়ি তাদের অনুষ্ঠানটাও সেরে ফেলবো।’

পুরো কথা সম্পূর্ণ করে রিদওয়ান কুহুর দিকে তাকাল। কুহু মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনোমুগ্ধের মতো তার কথা শুনছে। এভাবে তাকাতে দেখে রিদওয়ান হেসে তার নাক টেনে দিলো। কুহু ব্যথা পেয়ে কিছু বলার আগে সেখানে দুই পরিবারে সদস্যরা উপস্থিত হলো। গেস্টরা চলে গেছে। বাড়ি ফাঁকা। কাজের লোককে ডেকে রিদওয়ান চেয়ার এনে
সবাইকে বসার ব্যবস্থা করে দিলো। সবাই উপস্থিত এখানে। তাই বড়রা রুপক আর রিমির বিয়ের ডেট ঠিক করার আলোচনা শুরু করল। এমন না ব্যাপারটা কেউ জানে না। রিদওয়ান আজ দুপুরে সবাইকে ডেকে এই কথা জানিয়েছে। আসলেই সেও এ ঘটনা জানত না জেনেছে গতকাল।
কাল দেশে ফেরার পথে রুপকের ফোন কুহুর কাছে ছিল। গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল কুহু। তাকে ঘুমাতে দেখে রিদওয়ান ইয়ারফোন খুলে রুপকের ফোন হাতে নিতেই একটা মেসেজ আসে। এরপর হঠাৎই কিভাবে যেন সেটা অন হয়ে যায়। এরপরে দেখে রিমির আইডি সবার
প্রথমে। সচারাচর যার সঙ্গে বেশি কথা বলা হয় তার আইডিই প্রথমে শো করে। কৌতুহলবশত সে ইনবক্সে ঢুকে বেশ কিছু মেসেজ দেখে। এরপর
হোয়াটসঅ্যাপে করা তাদের কথোপকথন তার নজরে পড়ে। মেসেজের
ধরণ দেখে স্পষ্ট হয় অনেককিছুই। প্রিয় বন্ধুর প্রেমালাপ খুঁটে খুঁটে পড়া গেলেও বোনের প্রেমালাপ পড়তে পারছিল না সে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল তার। এবং আরেকদফা অবাক হয় যখন দেখে রিমিই রিলেশনের প্রস্তাব দিয়েছে রুপককে। রুপক শুরুর দিকে রিমিকে অনেক বোঝায়। বকে’ও। পরে রুপকও যে দূর্বল হয়ে পড়ে তাদের মেসেজই তা বোঝা যায়। এসব দেখে রিদওয়ান আর কাউকে কিছু বলে নি। সরাসরি বোনকে জিজ্ঞেস করে এবং রিমিও অকপটে স্বীকার করে। এরপর রিদওয়ান বাবা মা সহ, কুহু এবং ইসমত আরা বেগমকে সরাসরি জানায়। যেখানে তারা দু’জন দু’জনকে চায় সেখানে কেউ আর দ্বিমত করেন নি। সংসার করবে তারা তাই তাদের পছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছে সবাই। সত্যি বলতে রিদওয়ানের সিদ্ধান্তে কেউ দ্বিমত পোষণ করার সাহস করে নি। বড়রা সিদ্ধান্ত নিলেন সামনে মাসের প্রথম সপ্তাহে রুপক আর রিমির বিয়ের অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ করবেন। হাতে বিশ পঁচিশ দিন সময় বাকি। এমন আরো কিছু ব্যাপারে
আলোচনা করা হলো। তখন নিলুফা ইয়াসমিন একটা প্রস্তাব রাখলেন,

-‘আমার এক ছেলে; এক মেয়ে। ইসমত আরা আপাও তাই। ভাগ্যে ছিল বলে হয়তো এই বাড়ির মেয়ে ওই বাড়িতে যাচ্ছে। ওই বাড়ির মেয়ে এই বাড়িতে এসেছে। আমি ভাগ্য বিশ্বাসী তাই মেনেও নিয়েছি। আমরা বাবা মায়েরা চাই আমাদের সন্তানরা যেন ভালো থাকে।সুখে থাকে। তবে এটা
ঠিক রিদওয়ান আর কুহুর বিয়েতে আমার মত ছিল। রিদওয়ান জোর করে বিয়েটা করেছে। এবং সময়ের প্রেক্ষিতে সব ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু রিদওয়ান আর কুহুর বিয়ে একদম সাদামাটাভাবে সম্পূর্ণ করা হয়েছে। তাই আমি চাই, তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটাও এই সুযোগে সম্পূর্ণ করতে।
আমাদের দুই পরিবারের দুই রাজকন্যা একই দিনে বউ সাজুক।’

To be continue……!!